দ্বিতীয়জন পর্ব-৭+৮

0
13

#দ্বিতীয়জন [৭]
#Tahmina_Akhter

রাশিয়ায় মিতার প্রথম সকাল।

আলতো সূর্যের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে মিতার চোখে এসে পড়ে। ঘুম ভেঙে যায়। কয়েক সেকেন্ড ঘোরের মধ্যে ছিল মিতা। মনে হচ্ছিল যেন নিজের বাসাতেই আছে। আদনান পাশের ঘরে বই নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু মুহূর্তেই বাস্তবতা বুকের ওপর চেপে বসে। সে রাশিয়ায়। আদনান নেই। কেউ নেই। শুধু স্মৃতি আর শূন্যতা ছাড়া।

মিতা ধীরে ধীরে উঠে বসে। আশপাশে চোখ ঘোরায়। আদনানের সাজানো ঘর, খাটের পাশের ছোট টেবিল, জানালার পাশে রাখা সেই ল্যাম্প ; সব কিছুতেই আদনানের ছোঁয়া। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চোখ জলে ভরে ওঠে। কাঁদতে চায় না, তবুও চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।

— আদনান ? আপনি থাকলে এতটা একা লাগত না!

ফিসফিস করে বললল মিতা।চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় নিজেকে শক্ত করে।

— আমি ভেঙে পরব না। আপনি যা চেয়েছিলেন, আমি তাই হবো। আপনি যেখানে আছেন এবং দেখছেন একদিন ঠিকই আমার জন্য গর্বিত হবেন।

মিতা রান্নাঘরে গিয়ে কফির পানি বসায়। কাপে কফি ঢেলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। জুলাইয়ের হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগে। নীল আকাশে রোদের ছটা আর নিচের দিকে ব্যস্ত রাশিয়ান শহর ; সব মিলিয়ে এক অন্যরকম সকাল।

মিতা কাপে চুমুক দেয়। চোখ রাখে দূরে, খুব দূরে। আদনানের মুখ মনে পড়ে। তার হাসি, তার স্বপ্ন, তার আদর।

— এই শহরটা এখন আমার আশ্রয়। আর আপনি আমার প্রেরণা আদনান ।

রাশিয়ার আকাশ তখন নতুন গল্পের সূচনা করছে। মিতার বুকের গভীরে এক নতুন অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি আঁকতে শুরু করে।

অন্যমনস্ক মিতা তখনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল। চোখে ছিল ভেজা জলরেখা। মনটা অনেক দূরে গিয়েছে আদনানের কাছে। সে বুঝতেই পারেনি অপরপাশের বিল্ডিংয়ের ছয়তলার একটি ব্যালকনি থেকে একজন সূদর্শন যুবক তার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে।

ছেলেটার চোখে ছিল বিস্ময় আর এক ধরনের কঠিন চাহনি। যেন সে খুঁজে পেয়েছে এমন কাউকে, যাকে অনেক আগে থেকেই খোঁজছিল। মেয়েটার কাঁদোকাঁদো মুখ, তার গভীর নিঃশ্বাস, সেই নিঃশব্দ কান্না সব কিছু ছেলেটাকে ছুঁয়ে গেলো। কিন্তু সেটা তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিল না। বরং তার চোখের দৃষ্টি ছিল কঠিন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মিতা ভেতরে চলে যায়। কাঁচের দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় তার পেছনে। ছেলেটা তখনও দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে একটা হালকা বাঁকা হাসি। যেটার অর্থ ভিন্ন কিছুই বলছে। ছেলেটা ফিসফিস করে নিজেই নিজের সাথে বলল।

— তোমার চোখের কষ্টে একটা গল্প আছে, মেয়ে। দেখা যাক, সেই গল্পটা আমি পড়তে পারি কিনা।

____________

“Khamovniki ” মস্কোর এক প্রাণবন্ত, ঐতিহাসিক এবং রুচিশীল এলাকা। সবুজে মোড়া রাস্তা, পুরনো আর আধুনিক স্থাপনার চমৎকার মিশ্রণ, আর আরামদায়ক জীবনযাত্রার এক চমৎকার রূপ এই এলাকায়। এখানেই First Moscow State Medical University (Sechenov University)। মস্কোর প্রাচীনতম এবং নামকরা মেডিকেল ইউনিভার্সিটি। অনেকেই একে মেডিকেলের হাভার্ড বলে থাকেন।

সকাল সকাল মিতা আর সায়মা রওনা দিলো ইউনিভার্সিটির দিকে। Khamovniki এলাকার ফুটপাথ ধরে হাঁটছে তারা। দুই পাশে গাছের সারি, কিছুটা দূরে Moskva নদীর ধারে মানুষ হাঁটছে, সাইকেল চালাচ্ছে। এক পাশে ছোট ছোট ক্যাফে, যেখানে কফির সুবাস বাতাসে মিশে আছে। সায়মা মিতাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে।

— এই দেখো, ওটা আমাদের ইউনিভার্সিটির পুরাতন বিল্ডিং। প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো। আর ওই দিকে রিসার্চ সেন্টার। দেখো, রাশিয়ান স্টুডেন্টরা কত ফোকাসড! কেউ কেউ তো ক্লাস শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেই এসে বসে পড়ে।

মিতা চারপাশের এই রুচিশীল, সংযত জীবন দেখে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। তবে মনের গভীরে আদনানের অভাব এখনও কাঁটার মতো বিঁধছে।

হাঁটতে হাঁটতে তারা ইউনিভার্সিটির মেইন গেটে পৌঁছায়। ইউনিফর্ম পরা ছাত্রছাত্রীরা ভিতরে প্রবেশ করছে, কেউ কেউ হাসছে, কেউ মোবাইলে কথা বলছে, কেউবা মুখ গুঁজে বইয়ে।

সায়মা বলল,

— এই গেট দিয়েই একদিন আদনান ভাই আর তুমি একসাথে প্রবেশ করার কথা ভেবেছিলে, তাই না?”

মিতা চোখ নামিয়ে ফেলে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলল না কিছুই। সায়মা মিতার হাতটা ধরল শক্ত করে।

— চল, আজ শুধু একজন স্টুডেন্ট হিসেবে নয় একজন স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার দায় নিয়ে তুমি এই গেট দিয়ে ঢুকবে, মিতা।

মিতা তাকাল সায়মার দিকে। চোখ ভিজে যায় জলে,।তবে এবার সেই জলে ছিল শক্তি।

— চলো সায়মা আমি আমার স্বপ্নকে নিয়ে আমি ঢুকি, তারপর একদিন আমার স্বামীর স্বপ্নকে পূরণ করে একজন ডাক্তারের পরিচয় নিয়ে বের হব।

সায়মার হাত ধরে মিতা প্রবেশ করল।

মিতা তার ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কাঁধে ব্যাগ, হাতে ভাজ করে রাখা সাদা এপ্রোন। পরনে বটল গ্রীন রঙের থ্রি-পিস, তার সঙ্গে সাদা পায়জামা আর ঘোমটা। সযত্নে মাথা ঢেকে রেখেছে। এক ধরণের মিশ্র অনুভূতির ভারে সে মাথা নিচু করে হাঁটছিল। ভবিষ্যতের টানাপোড়েন, আদনানের স্মৃতি, নতুন পরিবেশের চাপে খানিকটা নিঃশব্দ, গম্ভীর।

ঠিক এমন মুহূর্তে, তার সামনে হঠাৎ করেই কেউ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মিতা আঁতকে উঠল, পা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখতে পেল, এক সুদর্শন যুবক তার দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা-চওড়া গড়ন, চোখে এলোমেলো চুল, গায়ে ইউনিভার্সিটির জ্যাকেট।

মুখটা থমথমে, কিন্তু কণ্ঠ কাঁপছে।

— I love you.

মিতা নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তার চোখ বড় হয়ে গেল, ভ্রু কুঁচকে গেল। চারপাশে কিছু ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ থেমে গেছে এমন হঠাৎ ঘটনাতে। হঠাৎ করেই চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। সেই নীরবতার মধ্যে শুধু যুবকের কণ্ঠটা যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।

— I saw you from that building… that time when you were crying in the balcony. I don’t know you. But something… something made me fall for that sadness. That strength. That silence.

মিতা নির্বাক। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সায়মা দৌড়ে এসে মিতার পাশে দাঁড়াল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

— Adam! Are you serious ?

ছেলেটা মৃদু হেসে বলল,

— Yes. And I don’t expect her to say anything. Not now. Just, I had to say it.

তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা। আর একবার তাকাল মিতার চোখে। মিতা কোনো শব্দ করল না। তার ঘোমটার ভেতরে থাকা চোখ দুটো শুধু গভীরভাবে তাকিয়ে রইল ছেলেটার চোখে। হয়তো ওখানেই ছিল এক নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া।

ছেলেটা ফিরে যেতে যেতে থেমে বলল,

— My name is Adam. Just in case, you ever want to remember it.

তারপর সে চলে গেল। বাতাসে ওর কণ্ঠের ধ্বনি রয়ে গেল, মিতার চোখে রয়ে গেল এক অদ্ভুত বিস্ময়, যা সে নিজেও বোঝার চেষ্টা করছিল। যাকে চিনে না জানে তাকে এক পলক দেখলে কি ভালোবাসা হয়ে যায়? এই এক মূদ্রা দোষ বিদেশিদের। এদের ভালোবাসা হুট করে হয় হুট করে ভেঙে যা।

আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্টুডেন্টরা বিস্ময়ে একে একে মুখ তুলে তাকাল মিতার দিকে। কেউ ফিসফিস করছিল, কেউ চোখ কচলাচ্ছিল যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সদ্য যা ঘটেছে। একটা অদৃশ্য চাপ যেন চারপাশের বাতাসে জমে উঠল। মিতা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। চোখেমুখে ধরা বিস্ময়, ভয়, এবং খানিকটা বিব্রততা।

ঠিক তখনই সায়মা ওর হাত ধরে ফেলল।

— চলো মিতা, এখান থেকে যাওয়া যাক। কানে কানে বলল সে।

সায়মার কণ্ঠ ছিল চাপা কিন্তু দৃঢ়। মিতা কিছু না বলে ওর সঙ্গে হাঁটা দিল। মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালাল। সায়মা চারপাশের কৌতূহলী চোখগুলোকে উপেক্ষা করে দ্রুত মিতাকে ওর ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। পেছন থেকে কিছু ফিসফাস কানে আসছিল,

— বাংলাদেশি মেয়েটা নাকি ইন্ডিয়ান?

— ছেলেটা কি সিরিয়াস ছিল না প্র্যাঙ্ক?

— Adam তো এমন না.!

মিতা কিছু শুনতে পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ওর মন তখন কোথাও জমে থাকা এক পুরনো স্মৃতির খাঁচায় আটকে। বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ, চোখেমুখে হালকা অস্থিরতা। যেন ঠিকমতো শ্বাসও নিতে পারছে না।

ক্লাসরুমের দরজায় পৌঁছে সায়মা দরজাটা খুলে মিতাকে ভেতরে বসাল।

— শান্ত হয়ে বসো। কেউ কিছু কিছু মনে করবে না। এখানে এইসব ব্যাপার নিয়ে ঘাটানোর মত কেউ নেই। তুমি জানো না, Adam এখানকার সবচেয়ে ভদ্র আর ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে। ওর এরকম publicly কিছু বলা মানেই একটা বড় ঘটনা।

মিতা চুপচাপ বসে রইল। চোখ মেলে তাকাল জানালার বাইরের দিকে। মনটা ভার হয়ে রইল। আব্রাহামের সেই চোখ, তার কথা, তার কাঁপা গলা বারবার ফিরে আসছিল মনে।

একটু পর, সায়মা বলল

—আমি পাশেই আছি। আজ প্রথম দিন, তুমি চাইলে আমি এখানেই বসে থাকি তোমার সঙ্গে।

মিতা হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

ক্লাসরুমের কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যায় মিতার মন। কিন্তু ওর মনে বারবার একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। Adam কেন বলল সেই কথা? শুধু এক পলকের জন্য দেখা কেউ এত কিছু অনুভব করে কীভাবে?

রবার্ট স্যারের ক্লাস চলছে। স্যার কালো বোর্ডে মলিকিউল স্ট্রাকচার আঁকছেন আর মাঝে মাঝে গলার স্বরে জোর দিয়ে বলছেন,

— Every chemical bond has a reason just like human connections. You break one, and the entire chain reacts.

মিতা মাথা নিচু করে নোট নিচ্ছিল। চোখের কোণ দিয়ে মাঝে মাঝে বাইরের জানালার দিকে তাকাচ্ছিল। কাঁচের ওপারে সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে আদনানের স্মৃতি যেন আলো হয়ে তার চোখে ভেসে উঠছে বারবার।

ঠিক এমন সময় পাশে কারো উপস্থিতি টের পেল সে।

চেখ তুলে তাকাতেই যা দেখল তাতে বুকটা ধক করে উঠল। সকালবেলা যে ছেলেটা ওকে পুরো ডিপার্টমেন্টের সামনে হাঁটু গেড়ে I love you বলেছিল সেই ছেলেটা এসে ওর পাশে বসেছে।

ছেলেটা চুপচাপ, চোখে দৃষ্টির গভীরতা, মুখে মৃদু এক আশ্চর্য হাসি। মিতার চোখে চোখ পড়তেই ওর ঠোঁটের কোণে কাঁপা একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল।

মিতা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

— you?

ছেলেটা আস্তে বলল,

— Yes. I requested the seat change. I wanted to say sorry. for what happened this morning.

মিতার মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু চোখে ছিল বিস্ময়ের ছাপ আর চাপা রাগ। পারলে এই বিদেশী ছেলেটাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। আদনানের ভালোবাসার ভারই তো মিতার মন নিতে পারছে না। আর কোত্থেকে এই এই সাদা বিড়াল এসে ভালোবাসার নামে মিাঞাও মিঞাও করছে। গাধা একটা!

কে জানে ছেলেটা বাংলা বুঝে কিনা? তাহলে তো মিতা যে গালি দিয়েছে তা বুঝে ফেলবে!

চলবে…

#দ্বিতীয়জন [৮]
#Tahmina_Akhter (পাঠকদের সুবির্ধাতে Adam এর সংলাপ বাংলায় লিখব এখন থেকে)

মিতার মুখে কোনো শব্দ নেই। চোখে বিস্ময়ের ছাপ আর ভেতরে চেপে রাখা একরাশ ক্ষোভ। ওর মনের ভেতর যেন আগুন ধরে গেল।

—পারলে তো এই বিদেশী ছেলেটাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিই! আদনানের ভালোবাসার ভারই তো আমি এখনো বইতে পারছি না, সেখানে এই সাদা বিড়াল কোথা থেকে এসে ভালোবাসার নামে মিঁয়াও মিঁয়াও শুরু করেছে! গাধা একটা!

মনের কথা মনেই রেখে চোয়াল শক্ত করে ফেলল মিতা। চোখ নামিয়ে আবার খাতায় মন দিতে চাইল। কিন্তু কলমটা যেন আর চলে না। মনের মধ্যে ছেলেটার সেই ভোঁতা কণ্ঠ বাজতে লাগল, “I love you…”। যতবার ভাবছে, ততবার মাথার মধ্যে ঝাঁঝালো একটা রাগ টগবগ করে ফুটছে।

ছেলেটা ওর পাশে বসে খুব ধীরে একটু এগিয়ে বলল,

— আমি বুঝতে পারছি। তুমি এখনই প্রস্তুত নও। I am really sorry.

মিতা এবার চোখ তুলে সরাসরি ছেলেটার দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে বলল,

— আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। ভুল মেয়েকে পাওয়ার ইচ্ছে জেগেছে আপনার মনে । আমি আমার উপন্যাসের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অংশ ।

ছেলেটা চুপ করে থাকল। মাথা নিচু করল। শুধু একটা কথাই বলল,

— কখনো, কখনো। বেদনাদায়ক গল্পগুলোই সবচেয়ে সুন্দর হয়।

মিতা ভেতরে ভেতরে নড়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার ব্যথার গভীরতাকে এক মুহূর্তেই পড়ে ফেলেছে। কিন্তু এখন নয়। এই অনুভব, এখন মিতা আর অনুভব করতে পারবে না।

মিতা এবার রবার্ট স্যারকে ডেকে উঠল। অগত্যা, Adam হকচকিয়ে গেল। রবার্ট স্যার ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন মিতার দিকে, তারপর তার গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— এনিথিং রং?

মিতা তখন ইশারায় Adam এর দিকে আঙুল ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দিল। এক মুহূর্তে পুরো ক্লাসরুমের দৃষ্টি চলে গেল Adam এর দিকে। সবার সামনে সে একেবারে অবস্থায় পরে গেল। এই ছিল তার জীবনের প্রথম এত বড় বিব্রতকর পরিস্থিতি।

রবার্ট স্যার কিছু বলার আগেই, মিতার দিকে এক নজর দেখে Adam দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল। তার শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা, লজ্জা আর অপরাধবোধ যেন একসাথে জড়িয়ে ধরেছে।

Adam চলে যাওয়ার পর মিতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বুকের ওপর চাপা একটা ভার যেন নেমে গেল। এবার সে পুরো মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে মন বসাল। রবার্ট স্যারের লেকচার, স্লাইড শো। সবকিছুই মন দিয়ে শুনল।

শেষ ক্লাসটা শেষ হতেই ইউনিভার্সিটির ঘণ্টা বাজল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সায়মার সঙ্গে বেরিয়ে এল মিতা। দিনটা শুরু হয়েছিল অস্বস্তিকরভাবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু একটু করে সব স্বাভাবিক হচ্ছে।

ঠিক তখনই হঠাৎ করে কোত্থেকে যেন আবির্ভাব হল আব্রাহামের। টিফিন কর্নারের পাশের করিডোর থেকে সে হেঁটে এল দুজনের সামনে। তার মুখে সেই চিরচেনা প্রাণবন্ত হাসি।

সায়মা বিস্ময়ে বলল,

— আব্রাহাম! তুই হঠাৎ এখানে?

আব্রাহাম দুষ্টুমির সুরে মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

— মাথাটা কেন যেন কাজ করছে না! তাই ভাবলাম মিস মিতার কাছে চলে আসি। ওর হাতের একটা ভালো মানের বাড়ি খেয়ে যদি মাথাটা আরেকটু নষ্ট হয়!

তারপর ঠোঁটের কোণে একপাশে বাঁকা হাসি টেনে আবার বলল,

— কি বলেন মিস মিতা? পারবেন তো একটু সাহায্য করতে?

সায়মা থামিয়ে রাখতে পারল না হাসি, মুখ চেপে হেসে ফেলল। আর মিতা? মিতা চোখ কুচকে তাকাল আব্রাহামের দিকে। ঠোঁট টিপে হাসিটা আটকাতে চাইলেও চোখে একটা লুকানো amusement খেলে গেল আব্রাহামের।

— তোমার মাথার যা অবস্থা, তাতে বাড়ি না, একেবারে হাতুড়ি লাগানো দরকার।

শান্ত সুরে বলে মিতা পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলো। আব্রাহাম পিছন থেকে বলে উঠল,

— তাহলে ঠিক আছে, রুটিন করে দিও, আমি রোজ আসব!

সায়মা হেসেই কুপোকাত।
নতুন দেশে, নতুন শহরে এমন হালকা আনন্দের মুহূর্তগুলোই হয়তো মিতার ভাঙা মনটায় একটু একটু করে আনন্দ জড়ো হচ্ছিল।

সায়মা আর মিতা একসাথে হাঁটছে। পাশ দিয়ে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, গাছের পাতাগুলো ঝিমিয়ে পড়া রোদের আলোয় কাঁপছে। আর ওদের ঠিক পেছনে হাঁটছে আব্রাহাম চেনা ছন্দে, ফুরফুরে ভঙ্গিতে।

আব্রাহাম আর সায়মার মধ্যে চলছে গুটুরগুটুর গল্প, মাঝে মাঝে হালকা হাসির শব্দ। আর সেই গল্পের শ্রোতা হচ্ছে মিতা। যদিও মুখে কিছু বলছে না, তবু কানে ঢুকছে প্রতিটা কথা।

একসময় সায়মা ধীরে ধীরে পুরো Adam এর ঘটনাটা জানাল আব্রাহামকে। সকালে ঘটে যাওয়া সেই অবাক করা প্রপোজাল, ক্লাসরুমে মিতার প্রতিবাদ, Adam এর চলে যাওয়া ; সবটা।

শুনে আব্রাহাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল

— ওহ্, তাই বল। তাহলে বুঝলাম, এই ছেলেটার মাথাও আমার মতই ঠিকঠাক নেই। তবে একটা পার্থক্য আছে আমি জানি কাকে, কখন, কোথায় বললে ঝাড়ি খাব? আর সে বেচারা বুঝে উঠতে পারেনি যে, Miss Mita মানে শুধু নামেই মিষ্টি, আদতে একদম গরম চায়ের কাপে হাত ডুবিয়ে দিলেই পোড়াবে!

মিতা থমকে দাঁড়িয়ে এক পলক তাকাল আব্রাহামের দিকে।

— আর আপনি কি খুব ঠান্ডা শরবত নাকি?

আব্রাহাম ভ্রু নাচিয়ে বলল,

— না, আমি লেবু চা। গরমও, টকও, দরকারে ঝাঁঝালো হতে পারি।

সায়মা হেসে উঠে বলল,

— তোমাদের দুজনকে নিয়ে একটা ঝগড়ার নাটক বানালে ভালোই হবে মনে হয়!

আর মিতা? মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিল। তবু চোখের কোণে হাসি লুকিয়ে থাকল যা কেউ না দেখলেও আব্রাহাম ঠিকই দেখতে পেল।

বাসায় ফিরেই সায়মা আর আব্রাহাম একে অপরকে দেখল এবং মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ঠিক আছে, তাহলে আমরা তিনজন মিলে বাড়ির কাজগুলো ভাগ করে নেব। এতে কাজের চাপও কমবে এবং আমাদের মধ্যে একটু ভালো সম্পর্কও তৈরি হবে।

মিতা একটু সময় নিলো, তারপর আস্তে বলে উঠল,

— হুম, তা ঠিক। তবে কাজটা ভাগ করলেই হবে না, সবাই যেন নিজের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে।

আব্রাহাম হাসি দিয়ে বলল,

— একদম! আর জানো, আমি বাসার কাজগুলোতে খুব ভালো! আমি বিশেষ করে রান্নায় দক্ষ, যেকোনো খাবার চমৎকার বানিয়ে দিতে পারি।

সায়মা মুচকি হাসল,

— রান্নায় তো ভালো, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি মিঠাইয়ের দোকান খুলতে পারো!

আব্রাহাম চপলভাবে উত্তর দিল,

— দোকান? আমি তো বিদেশী খাবার বানানোর জন্য একটা ক্যাটারিং সার্ভিসই শুরু করতে পারি! ওকে ডান। তাহলে আমি বাড়ির কাজগুলোতে সাহায্য করব। তবে সায়মা, তোমাকে তো কিছু কাজ করতে হবে!

মিতা মাথা ঝাঁকাল,

— এটা তো ভালোই লাগছে। সবাই কাজ ভাগ করে নেবে, তাতে করে কাজও তাড়াতাড়ি হবে।

তিনজনেই একসাথে কাজ ভাগ করে নিল, সবার দায়িত্ব চলে আসল। সায়মা ঘর পরিষ্কার করবে, আব্রাহাম রান্না করবে আর মিতা বাজারের কাজগুলো সম্পন্ন করবে। এই ফ্রেন্ডলি পরিবেশ তাদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া এবং বন্ধুত্ব তৈরি করেছিল ধীরে ধীরে ।

রান্নার টেবিলের চারপাশে বসে সবাই মজা করছিল। মিতা পেট ভরে খেয়ে খুব আনন্দিত ছিল, কারণ অনেকদিন পর এতটা ভালো করে খেতে পেরেছিল। সায়মা রান্না করেছে আলু ভর্তা, ডাল, ডিম ভাজা আর শুকনো মরিচ ভাজা, সঙ্গে ছিল ঘি। খাবারের গন্ধ ও স্বাদ মিতাকে এক মুহূর্তের জন্য বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।

আব্রাহাম খেতে খেতে সায়মার দিকে তাকাল এবং মুচকি হাসল,

— তোমার স্বামী তো ভাগ্যবান হবে, সায়মা! তোমার হাতে রান্না করা খাবারের স্বাদ তো একদম অন্য রকম।

সায়মা এক চোখে আব্রাহামকে তাকিয়ে বলল,

— অতটা বাড়াবাড়ি করিস না! তোর কি মনে হয়, আমি এতটা ভাল রান্না করি? এটা তো সাধারণ খাবার!

আব্রাহাম সায়মার টেবিলের দিকে তাকিয়ে হাসল এবং বলল,

— ওহ, আমি জানি, জানি! কিন্তু তোর ভবিষ্যত স্বামী তো দারুণ সুখী হবে, যেভাবে তুই এত সুন্দর রান্না করিস। আমার তো মনে হচ্ছে, একদিন তোর বাড়ির রান্নাঘরই পৃথিবীর সেরা রান্নাঘরের ট্যাগ পাবে।

সায়মার লজ্জা একটু বেড়ে গেল, মুখ লুকিয়ে বলল,

— তুই আবার কি বলছিস! এইভাবে বললে তো আমি?

আব্রাহাম দুষ্টুমির সুরে আবার বলল,

— ওহ, সায়মা! তোকে তো আরও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমি জানি, তুই লজ্জা পাবি।

সায়মা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

— আচ্ছা, এবার থাম। আমাকে লজ্জ্বা না করে ভাত খা। আর খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে নেই।

এমন সময় মিতা হেসে উঠল,

—আপনি তো ভারী দুষ্ট! সায়মাকে লজ্জা দিয়েই ছাড়লেন! কোনো না কোনো কথা বলতেই হবে নয়ত শান্তি পাবেন না, তাই না?

আব্রাহাম সোজা হয়ে বসে বলল,

— ঠিক বলেছো, মিতা। তবে, সায়মা যা রান্না করেছে, তা সত্যিই মজা হয়েছে। আর কিছু না, অন্তত খাবারের জন্যে হলেও আমি সায়মার খুব প্রশংসা করলাম।

সায়মা হালকা হাসি দিয়ে বলল,

— ধন্যবাদ, তবে এখন আর তোর কোনো দুষ্টুমি কাজ হবে না, সোজা খা।

সবাই হেসে উঠল এবং মজা করে খাওয়াদাওয়ার পর্ব চলল।

মিতা বেশ রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করছিল, বইয়ের পাতায় ডুবে ছিল। কখনো কখনো মন ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল, তবুও সে নিজেকে ফিরে পেত বইয়ের পৃষ্ঠা ঘেঁটে। হঠাৎ তার মনে হলো, কিছু একটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। ঘরটা বেশ শান্ত, তবে একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে গেল। সে এক নজরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তবে যেন মনে হল, কে যেন তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।

মিতা ঘুমাতে যাওয়ার আগেই সে বুঝতে পারল, হয়তো কোনো কারণে মনে হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ ? মিতার হৃদয়ে কেমন যেন একটা অজানা টান অনুভব হতে লাগল। সাহস করে সে নিজের পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে রুমের দরজা খুলল। খুব চুপচাপ। পায়ের নিচে মেঝেটি ঠাণ্ডা। সে বাহিরে বেরিয়ে গেল, বাইরের বাতাসের মৃদু ঠাণ্ডা তাকে একটু শীতল করল।

তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ল বারান্দায়। সেখানেই, অন্ধকারের মাঝে, আব্রাহাম দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনে বড় এক চাঁদ ঝলমল করছিল, তার আলো আব্রাহামের উপর পড়ছিল, যেন তাকে আরো রহস্যময় ও আকর্ষণীয় করে তুলছিল। তার মুখে কোনো হাসি ছিল না, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি ছিল স্থির এবং গভীর। যেন কিছু বলার ছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলছিল না। তার মাথার উপরে রাতের নরম আলো, তার হালকা শার্টের কোল দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল।

আব্রাহাম খুব ধীরে মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

— তুমি এখানে, মিতা? এত রাতে বাইরে বের হলে কেন? ঘুম আসছে না?

মিতা এক মুহূর্ত নীরব থাকল, কিছু বলল না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল। আব্রাহামের চোখে যেন কোনো অজানা দুঃখ ছিল, যেটি সে শেয়ার করতে চাইছিল। বাতাসের হালকা তোড়, বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনের মধ্যে একটি অসম্পূর্ণ কথোপকথন বয়ে যাচ্ছিল। নীরবতা, বারান্দার শীতল আবহাওয়া আর আব্রাহামের উপস্থিতি মিতাকে আরেকটু কাছে এনে দিল।

শেষে মিতা ধীরে ধীরে বলল,

— ? কি হয়েছে? এত রাতে কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?

আব্রাহাম একটুখানি মুচকি হাসল, কিন্তু তার হাসিটা কিছুটা চাপা ছিল। মিতাকে কিছু বলবে বলে তার শব্দগুলো যেন সময় নিচ্ছিল গুছিয়ে নেয়ার জন্য।

চলবে…