দ্বিতীয়জন পর্ব-৯+১০

0
14

#দ্বিতীয়জন [৯+১০]
#Tahmina_Akhter

বারান্দায় ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। চারদিকে রাতের নীরবতা। দূরের কোনো গাছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। তারই মাঝে মিতা আর আব্রাহাম দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

আব্রাহাম বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাথা আকাশের দিকে তুলে কিছু একটা ভাবছিল। হঠাৎ সে মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

— তুমি জানো মিতা, আদনান আর আমি প্রায় সমবয়সী।

মিতা চুপচাপ শুনছিল, আব্রাহামের কণ্ঠে একটা পুরনো দিনের স্মৃতির আবছা সুর ছিল। আব্রাহাম একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল,

— আদনান যখন এখানে এসেছিল,তখন প্রায়ই পথঘাট আর স্থানীয় ভাষা নিয়ে ঝামেলায় পরত। দোকান থেকে পানি কিনতে গেলেও ভুল উচ্চারণে এমন কিছু চাইত, বিক্রেতা কিছুই বুঝত না।

আব্রাহাম হালকা হেসে ফেলল। সেই হাসিতে মৃদু কষ্ট লুকানো ছিল।

— ওর মুখটা কেমন শিশুর মতো হয়ে যেত তখন। কিছুই বুঝত না, তবুও হাল ছাড়ত না। ধীরে ধীরে সব শিখে ফেলেছিল। নিজের অবস্থান তৈরি করেছিল এখানে।

মিতা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাসে তার ওড়নাটা উড়ছিল । আব্রাহামের কথায় আদনানের অদেখা দিনগুলোর চিত্র যেন মিতার চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছিল। আব্রাহাম একটু দম নিল, তারপর নিচু গলায় বলল,

— তুমি জানো মিতা, আদনান অনেক কঠিন সময় পার করেছিল এই অচেনা শহরে। কিন্তু একটা জিনিস কখনো হারায়নি। আর তা হলো ওর স্বপ্ন।

মিতা আর কথা বলল না। শুধু বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের কোণে জমে থাকা জল আলতো করে ঝরে পড়ল।
আকাশে তখন আধা চাঁদ। নরম আলোয় ঢাকা পুরো শহর, আর দুই মানব-মানবীর হৃদয়ের নীরব স্মৃতিচারণ।

আব্রাহাম হালকা করে হাসল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু স্মৃতি হাতড়ে বলল,

— আদনান সবকিছু ভুলে গেলেও, মিতা, তোমার নাম, তোমার স্মৃতি ; কিছুই ভুলত না।

আব্রাহাম থামল। নরম বাতাস মিতার চুলগুলোকে আলতো করে উড়িয়ে নিচ্ছিল। আব্রাহামের কণ্ঠ আরও মোলায়েম হয়ে এল,

— আমি ঠাট্টা করে বলতাম, ‘এত যখন ভালোবাসিস, তবে দূরে আছিস কেন?’

মিতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। বুকের মধ্যে যেন দপদপ করছিল কোনো পুরনো ব্যথা।

আব্রাহাম হালকা মুচকি হেসে আদনানের গলা নকল করে বলল,

— আদনান জবাবে বলত, ‘মিতা হচ্ছে আমার রাজ্যের রানী। রাজ্য গুছিয়ে নেই, তারপর রানীকে নিয়ে আসব।’

কথাটা বলেই আব্রাহাম চুপ করে গেল। যেন পুরো আকাশটাই নিঃশব্দে আদনানের জন্য শোক প্রকাশ করছে। মিতা ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখল। মনটা ভীষণ ভারী হয়ে এল। মনে হচ্ছে যেন এই শহরের বাতাসের মধ্যে আদনানের স্বপ্ন বেঁচে আছে এবং থাকবে মিতার চারপাশে, মিতার ভেতরে।

আব্রাহাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিতার দিকে তাকাল। তার চোখে ভেসে উঠল গভীর সম্মান আর একরাশ আন্তরিকতা। তারপর মৃদু স্বরে বলল,

— মিতা, আমি জানি আদনান তোমাকে কতটা ভালোবাসত। তার অসমাপ্ত স্বপ্ন, তার প্রতিটি ইচ্ছে, সবকিছুর মধ্যে তুমি ছিলে, শুধুই তুমি।

আব্রাহাম একটু থেমে, আরও গম্ভীর গলায় বলল,

— তুমি এখনও একা নও, মিতা। আমি আছি। আদনানের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তোমার পাশে থাকার জন্য আমি আছি সবসময় । যত দূরেই যাও, যত কঠিনই হোক, আমি ছায়ার মতো তোমার সঙ্গে থাকব।

মিতা শব্দহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর কান্না কেমন কুঁকড়ে আসছিল। অচেনা এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এমন এক প্রতিশ্রুতি যেন তার ভাঙা বুকের ওপর একটা কোমল হাত রেখে গেল।

রাতের হালকা ঠান্ডা বাতাসে মিতার ওড়না উড়ছিল। দূরের আকাশে তারা একে একে ফুটছিল , একদম আদনানের স্বপ্নের মতো, নিঃশব্দে, মৃদ্য আলো ছড়িয়ে।

মিতা এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো, রাতের তারা গুলোও যেন আজ একটু বেশি আলো ছড়াচ্ছে এবং একটু বেশি কাছে চলে এসেছে পৃথিবীতে।
হঠাৎই মনের ভেতর গভীর একটা আর্তনাদ বেজে উঠল। চোখের কোনে জমে থাকা জলকে শক্ত করে চেপে ধরল সে।

—আমি ভেঙে পড়বো না। আমি তো তোমার সেই মিতা, আদনান। যে মিতা তোমার স্বপ্নের রাজ্য পেরিয়ে এসে
তোমার রাণী হতে চেয়েছিল।
আজ তুমি নেই,
তবু আমি আছি, তোমার স্বপ্নের শেষ প্রহরী হয়ে।
তোমার অসমাপ্ত গল্পগুলো আমি শেষ করবো।
তোমার রেখে যাওয়া ভালোবাসা নিয়ে আমি এগিয়ে যাবো।
আমি জিতবো, কারণ আমার পরাজয় মানে তোমার স্বপ্নের পরাজয়।
আমি হারতে পারি না, আদনান। তোমার জন্য হার মানতে রাজি নই।

আব্রাহাম কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু মিতার মুখের কাঠিন্যতা আর কথাগুলো শুনে আর কিছু বললো না। মিতাকে রেখে আব্রাহাম নিজের ঘরে চলে যায়।
মৃদু হাওয়ায় মিতার ওড়না উড়ছিল।
আর ব্যালকনির পাশ দিয়ে নেমে যাচ্ছিলো এক নীরব প্রতিজ্ঞার জোছনা, নতুন ভোরের অপেক্ষায়।

***********★*★**

রাত কেটে ভোর এলো।
আকাশের গায়ে ধূসর আলোর টুকরো ছড়িয়ে পড়ছে।
পাখিরা ভোরের গান বুনছে।
আর মিতা?

মিতা ধীরে ধীরে ব্যালকনি থেকে ঘরে ফিরল।
ঘরে এসে কাঁথা মুড়ি দিল, তবে ঘুম আর এলো না।
চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে আদনানের হাসিমুখ ভেসে ওঠে। তারপর সেই অদৃশ্য হাত ধরে আদনান যেন ফিসফিস করে বলে,

—উঠে দাঁড়াও মিতা। সামনে অনেক পথ।

মিতা গভীর নিঃশ্বাস ফেললো।
মনের ভেতর সাহস এলো।
ভোরের প্রথম আলো জানালার ফাঁক দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। সেই আলোয় মিতা নিজের ভেতর একটা অদেখা দীপ্তি টের পেলো।

মেডিকেল কলেজে যাওয়ার আগে নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখল মিতা। কপালের ভাঁজে, চোখের কোণে বেদনার ছাপ থাকলেও, ভেতরের শক্তি আজ যেন একটু বেশি ঝকঝক করছে। মিতা মনে মনে বলল

—আজ থেকে আমার দিন শুরু। তোমার অসমাপ্ত ইচ্ছে, আমি আমার সবটা দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করবো।

মিতা হাসলো।
একটুকরো নীরব ভালোবাসা বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে, সে নতুন দিনের দিকে এগিয়ে গেলো।

মেডিকেল কলেজের করিডোর দিয়ে হাঁটছিল মিতা।
হাতে বইয়ের গাদা, কাঁধে ব্যাগ, মুখে একগাল গাম্ভীর্য।
পেছন থেকে কারো দৌড়ে আসার শব্দ।
মিতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই ঠাস করে ধাক্কা খেয়ে বইগুলো মাটিতে ছিটকে পড়লো। মিতা সামলে উঠতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে রাগে চোখ বড় হয়ে গেলো।

অ্যাডাম!

ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

— আমি, আ’ম সরি মিতা! আমি তোমাকে লক্ষ্য করিনি।

মিতার চোখে রাগ আর অবিশ্বাসের ঝড়।
সে ঠাণ্ডা গলায় বলল,

— প্রথমে প্রপোজালের নাটক, তারপর এই নাটক! আপনি আসলে কী চান?

চারপাশে কয়েকজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে দেখছিল দৃশ্যটা।
অ্যাডাম অপ্রস্তুতভাবে হাঁটু গেড়ে মাটিতে পড়ে থাকা বইগুলো তুলে মিতার দিকে বাড়িয়ে দিল। তার গলায় নরম অনুতাপের সুর,

— আমি শুধু বন্ধু হতে চেয়েছিলাম। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি কখনও।

মিতা নির্লিপ্ত মুখে বইগুলো নিয়ে নিল। একটুও নরম হয়নি ওর চোখ।৷ তারপর বলল,

— বন্ধুত্ব? নাকি নাটক ?

অ্যাডাম কিছু বলতে গেল, কিন্তু শব্দ যেন আটকে গেল গলায়। মিতা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, সোজা হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে।

পেছন থেকে অ্যাডামের মৃদু কণ্ঠ ভেসে এলো,

— আমি অপেক্ষা করবো, যতদিন লাগুক।

মিতা দু’পা এগিয়ে গেল অ্যাডামের সামনে।
চোখে তীব্র অবজ্ঞার ছায়া। কঠিন গলায় বলল,

— শুনুন, আমি আপনার কাছে কোনো বন্ধুত্ব চাই না, সহানুভূতি চাই না, আর আপনার উপস্থিতিও চাই না। আপনি আমার জীবন থেকে দূরে থাকুন। আপনার ছায়াটাও যেন আমার চোখে না পড়ে।

অ্যাডাম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল মিতার দিকে।
ওর চোখের কোণে সামান্য ব্যথার ছায়া ফুটে উঠল।
তবুও মিতা একটুও নরম হলো না।

চোখের ভাষায় অপমান আর ঠাণ্ডা অবজ্ঞা ছুড়ে দিয়ে মিতা ঘুরে দাঁড়াল। কাঁধে ঝোলা ব্যাগটা এক ঝটকায় ঠিক করল আর দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল সামনে।

অ্যাডাম সেই করিডোরে একা দাঁড়িয়ে রইল।
হাতের তালু মুঠো হয়ে আসল।
নিজের অজান্তেই ওর ঠোঁট ফিসফিস করে বলল,

— দূরে যাবো। কিন্তু তোমার দুঃখের ভাগীদার হয়ে থেকেই যাবো, দূর থেকে।

এরপর থেকে শুরু হলো অ্যাডামের একতরফা ভালোবাসার দিনগুলো। যেখানে কেবল অ্যাডামের অনুভূতি আর ভালোবাসা আর মিতার চোখ রাঙিয়ে তাকানো।

অ্যাডাম লাইব্রেরির কোণে বসে ছিল, বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার চোখ মিতার দিকে ছিল। মিতা টেবিলের সামনে, গাঢ় নীল রঙের থ্রী-পিসে সোজা হয়ে বসে পড়েছিল। চোখে বইয়ের পাতার মাঝে ডুব দেওয়া মনোযোগ। অ্যাডামের বুকের ভেতর যেন কিছু একটা কেঁপে উঠেছিল। তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি ছিল। যেখানে ভালোবাসা ছিল, তবে তা প্রকাশ করার কোনো উপায় ছিল না। মিতা তার অজান্তে সেখানে ছিল, শুধু একটু দূরে। অ্যাডামের হাত থেকে বইয়ের পাতা যেন নড়ছিল না। অথচ মন গিয়ে আছে মিতার দিকে।

এমনই এক দিন, মাঠে সে ফুটবল খেলছিল। শট নিয়েছিল। কিন্তু তার চোখ ছিল মিতার দিকে। মিতা মাঠ থেকে একটু দূরে। মিতার সেই সূর্যরশ্মি ছোঁয়া মুখ, তার গাঢ় নিঃশ্বাস, মুচকি হাসি। সব কিছু যেন অ্যাডামের মনে এক নতুন অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। খেলার মাঝেই সে মাঝেমধ্যে মিতার দিকে তাকাতো। আর ভাবত মিতার অপারগের কারণ কি। অ্যাডাম কি এতটাই অযোগ্য মিতার কাছে!

আরেকদিন, ক্লাসে যখন অ্যাডাম মিতাকে চোখের দেখা দেখতে পায়, তখন তার বুকের মধ্যে তীব্র অনুভূতির ঝড় উঠে। মিতা ঠোঁটের কোনায় অজানা কারণে এক ছোট্ট হাসি দেখে অ্যাডামের মনে হল যেন সে এক পৃথিবী জয় করেছে। সে বুঝতে পারছিল না কীভাবে তার এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবে? মিতা তার কাছে অনেক দূরের এক স্বপ্নের মতো ছিল।

অ্যাডাম জানতো, তার ভালোবাসা মিতার জন্য শুধুই দূর থেকে। তার অন্তরের গভীরে ভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে । মিতার ছবি তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। শুদ্ধ ভালোবাসার অনুভূতি মনের মধ্যে অদৃশ্য, কিন্তু জ্বলন্ত আগুনের মতো ছিল, তবে ভালোবাসার তাপ প্রকাশের সুযোগ ছিল না।

তবে, অ্যাডাম মনপ্রাণে বিশ্বাস করে একদিন হয়তো সেই সময় আসবে। সে তার ভালোবাসার গল্প মিতার কাছে বলতে পারবে হাতে হাত রেখে। ততদিন পর্যন্ত, সে মিতাকে তার কাছের এক অমোচনীয় স্বপ্ন হিসেবেই ভাববে।

#দ্বিতীয়জন [১০]
#Tahmina_Akhter

চার বছর পরে

সময় সত্যিই বদলে দেয় সবকিছু। রাশিয়ার মাটি, যে দেশে মিতা একদিন বুকভরা শোক নিয়ে পা রেখেছিল, আজ সেই মাটিই মিতার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছে।

মিতা এখন রাশিয়ার অন্যতম সেরা মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফেলেছে। তার ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য!

গ্র্যাজুয়েট স্কোর: ৯১% (ডিস্টিংশনের সাথে)।
সেরা শিক্ষার্থীদের তালিকায় তার নাম উঠে এসেছে।

মিতার পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর আকাশের মত মাথা নত রেখে চলার কারণে ইউনিভার্সিটির একাধিক প্রফেসর তাকে অত্যন্ত পছন্দ করত। বিশেষ করে রবার্ট স্যার। যিনি মনে মনে ভেবেছিলেন, মিতা যদি চায়, তাকে ইন্টার্নশিপে সুপারিশ লেটার দিতে তিনি পিছপা হবেন না।

এদিকে, সায়মা নিজের ফিল্ডে এগিয়ে গেছে। আব্রাহাম নিজের বিজনেস নিয়ে ভালোই আছে। তিনজনের বন্ধুত্বের বন্ধন সময়ের সাথে আরো দৃঢ় হয়েছে।

মিতা ইতিমধ্যেই Khamovniki District Hospital-এ ইন্টার্নশিপের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। সেখানেই ইন্টার্নশিপ শেষ করে ফাইনাল এক্সাম দেয়ার পর, তাকে রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি হাসপাতাল থেকে ডাক পড়তে পারে। সায়মা প্রথম জানল খবরটি রবার্ট স্যারের কাছ থেকে। সায়মা খুশিতেই আত্মহারা।

রাশিয়ার গরম হালকা কমে আসছিল। দিনগুলো এক অন্যরকম আলোয় ভরে যাচ্ছিল। মিতা আজ খুব ব্যস্ত। মেডিকেলের রেজাল্টের পর থেকে তার জীবনে নতুন এক গতি এসেছে। এক নামী হাসপাতাল থেকে ডাক এসেছে রেসিডেন্ট ডাক্তারের পদে। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো।

আজকের সকালটা অন্যরকম। ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মিতা ফোনে বাংলাদেশের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিল। এক এক করে সবার সঙ্গে কথা হলো।

মিতার মা কান্না চেপে রেখে বললেন,

— আল্লাহর অশেষ রহমত রে মা, তুই এত বড় হইছিস। গতকাল আদনানের কবরের সামনে দোয়া করছিলাম। আল্লাহ যেন তোকে আদনানের স্বপ্নের মতো গড়েন। আর তোর বাবা তো বোধহয় খুশিতে পাগল হয়ে যেতেন। যাকেই সামনে পেতেন তাকেই বোধহয় বলতেন, আরে শুনছেন আমার মিতা পাশ করেছে। ডাক্তার হয়েছে ডাক্তার।

রহিম সাহেবের কণ্ঠ কেঁপে উঠলো,

— মেয়েটা আমার মাথা উঁচু করল রে। আমরা গরীব মানুষ, শুধু ইজ্জতটাই ছিল, তুই তা আরও উঁচু করলি।

অদিতি ফোনে হাসছিল, কাঁদছিল, আবার বলছিল,

— ভাবি, ভাইয়ার স্বপ্ন তুমি পূরণ করলে। ভাইয়া থাকলে আজ কত খুশি হতো! মনে হয় ভাইয়া ওপর থেকে দেখছে আর হাসছে।

মিতার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছিল প্রতিবার “ভাইয়া” শব্দটা শুনলেই। আদনান আজ নেই, কিন্তু তার ছায়া যেন ওর জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে মিশে গেছে।

মিতা ফোন রেখে একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নরম বাতাসে ওড়নায় হালকা দোল। দূরের আকাশের নীলতায় আজও মিতা যেন আদনান এবং ওর বাবার মায়াভরা হাসি দেখতে পেলো। ওর চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু চিকচিক করে উঠলো। বাবা আর আদনানের জন্য আজ ভীষণ মন পুড়ছে যে মিতার।

একসপ্তাহ পর ; মস্কোর এক শান্ত সকাল।

জুলাইয়ের হালকা ঠান্ডা বাতাস মিতার ওড়নাটাকে নরমভাবে উড়িয়ে নিচ্ছে।
আজ তার প্রথম ইন্টার্নশিপের দিন Khamovniki District Hospital-এ। হাতের এপ্রোনটা শক্ত করে ভাঁজ করা, বুকের ভেতর অদৃশ্য এক কাঁপুনি। আদনানের কথা মনে পড়ে। যদি সে থাকত, আজ তার চোখের তারায় গর্বের আলো ফুটত।

সায়মা আর আব্রাহাম দুজনেই তাকে শুভকামনা জানিয়ে বাসা থেকে বিদায় দিলো। আব্রাহাম মজা করে বলেছিল,

–মিস মিতা, প্রথম রোগীকেই ভয় দেখিয়ে দিবেন না যেন!

মিতা হেসেছে। সত্যি, আজ বহুদিন পর সে একটু প্রাণ খুলে হেসেছে।

সকালের আকাশ ছিল পরিষ্কার। রোদের আলো হালকা করে শহরটাকে স্নিগ্ধ করে রেখেছিল। মিতা ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আয়নার সামনে একবার নিজেকে দেখল। পরনে সাদা ল্যাবকোট, নরম সাদা ওড়না মাথায়। চোখের নিচে হালকা চাপা ক্লান্তি, কিন্তু গভীর আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধকধক করছিল।

হাসপাতালের গেট দিয়ে পা রাখতেই মনে হলো, কত শত জীবন এখানে এসে ভেঙেছে, গড়েছে, বেঁচেছে, হেরেছে।
আজ থেকে সেও এই ইতিহাসের এক ক্ষুদ্র অংশ।

রিসিপশনের সামনে এসে দাঁড়াতেই এক নার্স মৃদু হেসে বলল,

— আপনি নতুন রেসিডেন্ট না? ডক্টর মিলোভা আপনার অপেক্ষায় আছেন।

মিতা মাথা নিচু করে হাসল। হাতের তালুতে ঘাম জমেছে টের পেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল করিডর ধরে। হাসপাতালের প্রতিটি গন্ধ, প্রতিটি শব্দ যেন ভেতরটা নাড়া দিচ্ছিল। আদনানকে হারানোর দিনকে যেন নতুন করেই চোখের সামনে দেখতে পারছে।

ডক্টর মিলোভা ; মাঝবয়সী রাশিয়ান এক মহিলা, চোখে ভারী চশমা। তিনি মিতাকে দেখে গম্ভীরভাবে বললেন,

— স্বাগতম, ডক্টর মিতা। আশা করি তুমি জানো, এখানে শুধু বিদ্যা নয়, মন দিয়েও কাজ করতে হয়। রোগীদের শরীরের চিকিৎসা যেমন জরুরি, তেমনি হৃদয়েরও।

মিতা সম্মান দেখিয়ে মাথা নত করল।

— আমি চেষ্টা করবো, ম্যাম।

প্রথম ডিউটি ছিল পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে অর্থাৎ শিশুদের বিভাগে।

ছোট ছোট বাচ্চাদের হাসি, কান্না, ব্যথা। মিতার মন ছুঁয়ে গেল। একটি ক্ষীণকায় মেয়ে শিশুর মাথায় হাত রাখতেই মিতার মনে হলো, আদনানের হাত যেন ওর মাথার ওপর স্নেহ মেখে দিল।

দিনের শেষে হাসপাতালের ব্যস্ত করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিতা আকাশের দিকে তাকাল। হৃদয়ে কেবল একটাই অনুভূতি।

—আদনান, আমি আসতে পেরেছি। তোমার দেখানো পথেই হাঁটছি। আজ আমি মাথা উঁচু করে বলছি, আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, ভেঙে যাবো না। সেই কথা রেখেছি আমি।

একটি উষ্ণ বাতাস মিতার গাল ছুঁয়ে গেল। মনে হলো দূর কোথাও আদনান মৃদু হাসছে।

দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। মিতা ধীরে ধীরে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে।

সেদিন দুপুরের ঠিক আগে, হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে হঠাৎ করে অ্যালার্ম বেজে উঠল।

একজন নার্স দৌড়ে এসে বলল,

— ডক্টর মিতা! এক ইমার্জেন্সি কেস এসেছে! খুব জটিল অবস্থা!

মিতা সাথে সাথেই গ্লাভস পরে ছুটে গেল ইমার্জেন্সি রুমের দিকে।

বিছানায় শুয়ে আছে সাত বছরের একটা রুগ্ন মেয়ে। নাম এলেনা। মুখটা ফ্যাকাশে, চোখের নীচে কালি, দেহে এক বিন্দু শক্তি নেই।

রিপোর্ট দেখে মিতার মুখ কঠিন হয়ে গেল।

— Acute Lymphoblastic Leukemia। চূড়ান্ত অবস্থা।

রোগের চিকিৎসা চলছে, তবে মেয়েটির অবস্থা হঠাৎ করেই আশঙ্কাজনক হয়ে গেছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্রুত কমছে, শরীর টক্সিক শকে যাচ্ছে।

ডক্টর মিলোভা সঙ্গে ছিলেন না। পুরো দায়িত্ব এখন মিতার কাঁধে।

মিতা চোখ বন্ধ করে মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিল।

মিতা নার্সদের দ্রুত নির্দেশ দিল,

— High-flow oxygen দাও। Vein ওপেন করো, IV fluids স্টার্ট করো। CBC, Electrolytes, Blood gas রিপোর্ট তড়িঘড়ি করো!

সবার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। নতুন ডাক্তার, এত বড় কেস! কেউ কেউ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু মিতা ভেঙে পড়ল না। চোখ দুটোতে আত্মবিশ্বাস।

মিতা নিজ হাতে এলেনার ভেন খুলে লাইফ সাপোর্ট শুরু করল। শিশুটির নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছিল। হঠাৎ এলেনার মিতার হাত চেপে ধরল।
সেই ছোট্ট, নরম হাতের উষ্ণতা যেন মিতাকে নতুন শক্তি দিল।

মিতা নিচু হয়ে এলেনার কানে ফিসফিস করে বলল,

— ভয় পেয়ো না, ছোট্ট পাখি। আমি আছি। আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাচ্চার অবস্থা স্থিতিশীল হলো। রিপোর্ট এলো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স ছিল, সাথে ইনফেকশন। মিতা দ্রুত যথাযথ মেডিকেশন প্ল্যান তৈরি করল।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই এলেনার শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হলো। রুমে নিস্তব্ধতার ভেতর বাচ্চাটির ক্ষীণ হাসির আভাস ফুটে উঠল। নার্সরা অবাক হয়ে মিতার দিকে তাকাল। এক নতুন রেসিডেন্ট মিরাকল করে ফেলেছে!

ডিউটি শেষে মিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। একফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ল।
কিন্তু সেটা ছিল আনন্দের, গর্বের।

—আদনান, তুমি দেখছো তো? আমি হারিনি। তোমার স্বপ্নের পথে আজ আমার প্রথম যুদ্ধটা জিতে গেছি।

হাসপাতালের করিডোরের আলো ম্লান। মিতা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াটার কুলারের কাছে দাঁড়াল। মাথার পেছনে হালকা ব্যথা, চোখে ঝাপসা ভাব।

হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত গম্ভীর গলা,

— ডক্টর মিতা?

মিতা চমকে তাকাল।

ডক্টর মিলোভা দাঁড়িয়ে আছেন। হাসপাতালের অন্যতম সিনিয়র কনসালটেন্ট, যিনি সাধারণত কঠোর এবং রূঢ় ব্যবহারেই পরিচিত।

মিতা ভয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে।

ডক্টর মিলোভা এগিয়ে এসে বললেন,

— আমি আজ সবকিছু দেখেছি। এলেনার কেস তুমি কিভাবে সামলালে! সেটা প্রত্যেকটা স্টেপ আমি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি।

মিতার মুখ শুকিয়ে গেল। নিঃশব্দে মাথা নিচু করল।

ডক্টর মিলোভা একটু থেমে নরম কণ্ঠে যোগ করলেন,

— তুমি শুধু একজন ডাক্তার নও, তুমি একজন খুব ভালো মনের মানুষ।

মিতা অবাক হয়ে তাকাল। মিলোভার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মৃদু হাসি।

— প্রথমবারের জন্য কোনো নতুন রেসিডেন্টের ওপর আমি এতটা গর্ব অনুভব করছি। ভবিষ্যতে তুমি বড় ডাক্তার হবে, মিতা। বিশ্বাস রাখো নিজের উপর।

মিতা যেন কিছু বলতে পারছিল না। গলার ভেতর কেমন যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল। শুধু ফিসফিস করে বলল,

— ধন্যবাদ।

ডক্টর মিলোভা মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন। সেই স্পর্শে মিতার বুকটা কেঁপে উঠল। মনে হলো, দূরে কোথাও আদনান দাঁড়িয়ে হাসছে।

ডক্টর মিলোভা চলে গেলেন।
আর মিতা একা দাঁড়িয়ে, চোখের কোনায় জমে থাকা অশ্রু মুছতে মুছতে মনে মনে বলল,

— আমার জীবনে যা কিছু অর্জন করেছি সবই তোমার অবদান আদনান। তোমার এত ঋণ আমি কি করে শোধ করব বলো?

—- ——-

রোজকার মতোই মিতা এক মগ গরম কফি হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা। মৃদু বাতাস বইছে, আকাশের কোণে রঙ বদলাতে থাকা মেঘের খেলায় মুগ্ধ হয়ে যায় সে। এক চুমুকে কফির উষ্ণতা ঠোঁট ছুঁয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, আজকের দিনটা যেন একটু শান্তিতে কাটে।

ঠিক তখনই, ঘরের ভেতর থেকে মিতার মোবাইলের ঝাঁকুনি শোনা যায়। টুনটুন করে ভেসে আসে রিংটোনের শব্দ ।

মিতা একটু বিরক্ত হয়ে ফিরে আসে ঘরে। ফোনটা তুলে দেখে অচেনা একটা নম্বর। নাম্বারটা দেশের নম্বরের মতো না, আবার রাশিয়ার লোকাল নম্বরও মনে হচ্ছে না। হালকা কুঁচকে যায় মিতার ভ্রু। দ্বিধা নিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে।

শেষমেষ কৌতূহল ও অজানা আশঙ্কায় ফোনটা রিসিভ করে।

— হ্যালো?

ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে, গভীর ও অচেনা, যেন কিছু একটা লুকোনো আছে কণ্ঠের গভীরে।

— মিসেস মিতা?

মিতা বুকের মধ্যে একটা ঝাঁকুনি টের পায়। কারণ বাংলায় কথা বলছে লোকটা। মিসেস বলল কেন? লোকটা কি জানে মিতার বিয়ে হয়েছিল এবং…

তবুও মিতা সেই চিন্তা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করল,,

— হ্যাঁ, বলুন। কে বলছেন?

ওপাশের কণ্ঠ থমকে যায় এক মুহূর্ত। তারপর ধীরে ধীরে বলে,

— আমি এমন একজন ; যার কথা আপনি ভুলে গেছেন। অথচ আমি আপনাকে ভুলতে পারিনি। সত্য জানার সাহস আছে তো, মিসেস মিতা?

মিতার হাতের মগ কাঁপতে থাকে। কফির কয়েক ফোঁটা মেঝেতে পড়ে যায়। কণ্ঠটা আবার বলে,

— যদি সাহস থাকে, কাল রাত আটটায় Khamovniki Park এ আসুন। একা আসবেন। সত্যের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকবেন।

ফোনটা কেটে যায়।
এক অজানা শীতল স্রোত বয়ে যায় মিতার শরীর জুড়ে।

কে এই মানুষ? কেন সে বলল ; ভুলে গেছেন? কী সত্যের কথা বলছে সে? আর কেন মিতার হৃদয় এত অজানা ভয় আর অদ্ভুত প্রত্যাশায় কেঁপে উঠছে?

বারান্দার বাতাস থেমে গেছে। আকাশের রঙ অদ্ভুতভাবে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। মিতার মন বলছে, আগামীকালের রাত তার জীবনের আরেক নতুন বাঁক এনে দিতে চলেছে।

চলবে..