দ্বিতীয়জন পর্ব-১১+১২

0
11

#দ্বিতীয়জন [১১+১২]
#Tahmina_Akhter

—I Love You.

আব্রাহাম হাঁটু গেড়ে বসে, হাত বাড়িয়ে ধরল একটি কালো গোলাপ। তার কণ্ঠে ছিল ভয়, লজ্জা, আর অনির্ভরতার সুর।

মিতা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আব্রাহামের দিকে। যেন কোনো সিনেমার দৃশ্য বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে তার সামনে। চারদিকে নিরবতা, হালকা বাতাসে মিতার ওড়না উড়ছে। আব্রাহামের চোখে চোখ রাখতেই মিতা দেখল, সেখানে কোনো ঠাট্টা নেই। কোনো হালকা ভালো লাগা নয়। গভীর, তীব্র, দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এক অনুভব।

মিতা কিছু বলল না। শুধু পেছনে এক পা হেঁটে পিছিয়ে গেল। তারপর খুব আস্তে, ফিসফিস করে বলল,

— আমার হৃদয়ে কেউ আগে থেকেই ছিল এবং আছে। যার অস্তিত্ব এখনো আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।

তবুও আব্রাহাম হাত বাড়িয়ে রেখেছিল, ঠিক যেন এই অন্ধকার ভালোবাসার গোলাপের মতো, সে জানত যে সে হয়তো প্রত্যাখ্যাত হবে, তবু অপেক্ষা করাই তার ভালোবাসার মূলমন্ত্র।

আব্রাহাম সেই মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল। মিতার চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বলল

— আমি জানি আমার ভালোবাসা তোমার কাছে অন্যায় মনে হতে পারে।
তোমার জীবনে একজন ছিল। আছে আর থাকবে।
আমি তাকে সরাতে আসিনি। আমি শুধু চাই, তুমি যাতে জানতে পারো। এই পৃথিবীর এক কোণে, কেউ আছে যে তোমার মুখে একফোঁটা হাসি দেখতে দিন কাটায়।
যে রাতে তোমার বারান্দায় আলো জ্বলে উঠলে, নিঃশব্দে দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। কেউ একজন আছে যে তোমার নামটা মনে মনে জপে, যেন তাতে তার মন শান্ত হয়।

আব্রাহামের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। মিতার চোখে জল টলমল করে।

–আমি কোনো দাবি নিয়ে আসিনি, মিতা। আমি জানি, আদনান তোমার হৃদয়ে আজও আছে। আমি শুধু আমার ভালোবাসার ভারটা তোমার সামনে রাখলাম।
তুমি যদি চাও, আমি চলে যাবো। কিন্তু জেনে রেখো আমি সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।

এই কথাগুলো বলেই আব্রাহাম পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। আর মিতা?সে একটুও নড়ল না।
শুধু বুকের ভেতর একটা শব্দ হলো, আবার কেউ মিতাকে ভালোবেসেছে! কিন্তু ; কেন?

মিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আব্রাহামের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। মিতা শুধু ফাঁকা বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন চোখের সামনে একটাই দৃশ্য আব্রাহামের চলে যাওয়া ।একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বাইরে আসে।

তার চোখে জল জমে, কিন্তু সে মুছে ফেলে। কোনো কিছু বলে না, কিছু ধরে রাখার চেষ্টা নেই।
শুধু দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক, নিরব, নিস্তব্ধ অবস্থায়।

চারদিকে সন্ধ্যার রঙ গাঢ় হয়ে আসে।
হালকা ঠান্ডা হাওয়া মিতার চুল এলোমেলো করে দেয়।
আর মিতা ভাবতে থাকে,

–ভালোবাসা কি সত্যিই একবারই আসে?
না কি কিছু ভালোবাসা, নিঃশব্দে, একতরফায় বেঁচে থাকে! মনের গভীরে?

ঠিক তখনই মিতার মোবাইলটা বেজে উঠল।

মিতা চমকে তাকাল স্ক্রীনের দিকে। গতকাল যে নাম্বার থেকে কল এসেছিল সেই নাম্বার থেকে কল এসেছে।
অপরিচিত, অচেনা, অথচ আজ বেশি পরিচিত লাগছে।

মিতার হাত কাঁপছিল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তবুও, সাহস করে কল রিসিভ করল।

ওপাশে প্রথমে কিছুক্ষণ নীরবতা।
শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো, ভারী, স্পষ্ট।

তারপর সেই কণ্ঠস্বর! ভরাট এক সুরে,
যা শুনেই মিতার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।

— ভুলে গেছো নাকি? আজ আমাদের দেখা করার দিন। পার্কে আসবে, ঠিক যেমন সময়ে আসতে বলা হয়েছে। আমি অপেক্ষা করব, মিতা।

এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া যেন বয়ে গেল। মিতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কলটা কেটে গেছে,
কিন্তু কণ্ঠটা রয়ে গেছে বাতাসে, দেয়ালে, তার মস্তিষ্কে।

তার মাথার ভেতর এখনো ঘুরছে সেই কণ্ঠ

—আমি অপেক্ষা করব, মিতা।

সে কি যাবে?কে এই মানুষ? কি বলতে চায় মিতাকে?

ভয় আর কৌতূহল এসে চেপে বসে মিতার বুকের ওপর।

পেছনের বারান্দা দিয়ে সূর্যের আলো এক ফালি করে বিছানায় পড়েছে। মিতা সে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে,
ভবিষ্যতের সবচেয়ে অজানা বিকেলের অপেক্ষায়।

পার্কে যাওয়ার আগে এক মগ কফি বানালো। তারপর এক নিঃশ্বাসে কফিটা শেষ করে মিতা বেরিয়ে পড়ে।
পা চালিয়ে চলে যায় ঠিক ওই পার্কে, যেখানে আজ তার এক অজানার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা।

পৌঁছে দেখে পার্কটা প্রায় শুনশান।
গাছের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছে পাথরের বেঞ্চগুলোতে।
একটা বাচ্চা দোয়েল পাখি ডালে বসে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে।
সব কিছু স্বাভাবিক। অথচ মিতার মনে হচ্ছে, কিছুই স্বাভাবিক নয়।

তারপর, একটা ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
তারপর, মিতা আর কাউকে কিছু জানাতে পারেনি।

দু’দিন কেটে গেছে।

সায়মা পাগলের মতো রাস্তায় ছুটছে।
আব্রাহাম পাগল হয়ে গেছে, সে হাসপাতাল, ক্যাম্পাস, পার্ক কোনো জায়গা বাদ রাখেনি।
যেখানেই মিতা যেতে পারত, সবখানে খুঁজে চলেছে।

— তোর সাথে কোনো ঝগড়া হয়েছিল?
সায়মা রাগে কেঁপে উঠে বলল।

আব্রাহাম মাথা ঝাঁকাল,

–না।

প্রপোজালের বিষয়টা চেপে যায় আব্রাহাম।

— হঠাৎ করে মানুষ উবে যায় না, আব্রাহাম!

সায়মার গলা ভেঙে এল।

অবশেষে তারা পুলিশের শরণাপন্ন হয়।

পুলিশ প্রথমে নিখোঁজ ডায়েরি নেয়।
তারপর অনুসন্ধান শুরু হয় মিতার মোবাইল লোকেশন, সর্বশেষ কল রেকর্ড, এমনকি সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজে।

সেখানে এক চমকে ওঠার মতো দৃশ্য ধরা পড়ে।
পার্কের ঢোকার মুখে মিতা দেখা করেছে এক মুখঢাকা লোকের সঙ্গে। মিতা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সেই ব্যক্তির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। মেইন রোডে আসতেই ওদের আর ট্র্যাক করা সম্ভব হয়নি কারণ সিসিটিভি ফুটেজের ব্যবস্থা নেই সেখানে। সেদিনের পর থেকে মিতা আর ফিরে আসেনি।

পুলিশ স্টেশন থেকে বের হবার পর উদ্ভান্তের মত হাঁটছিল আব্রাহাম। এমন সময় মনে হলো একজন মানুষের কথা যে কিনা মিতাকে পাওয়ার জন্য যে কোনো কিছুর শরণাপন্ন হতে পারে। আব্রাহাম পাগলের মতো দৌড়ে অ্যাডামের বাড়ির দিকে ছুটে যায়। তার মন যেন জ্বলন্ত আগুন, গলতে থাকা ইস্পাতের মতো, মিতা ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারছে না। মিতার নিখোঁজ হওয়া তাকে প্রায় পাগল করে দিয়েছে, রাগ আর শঙ্কার মিশ্রণে সে কিছুই ভাবতে পারছে না।

অ্যাডামের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় আব্রাহাম। তার হাতের কোণ দিয়ে রক্ত ঝরছে, চোখে রক্তের চেয়ে বেশি অন্ধকার। সে অ্যাডামের বাড়ির দরজায় থামলো।

— মিতা কোথায়? আব্রাহাম গর্জে উঠলো।

অ্যাডাম কাঁপতে কাঁপতে সামনে আসে, তার চোখে ভয় আর অবাক হওয়ার মিশ্রণ।

— আমি জানি না, আব্রাহাম! আমি সত্যি জানি না! কথা বলার সময় অ্যাডাম গলাটা কাঁপছিল।

আব্রাহামের হাতের কনুই তীব্রভাবে অ্যাডামের গালে আছড়ে পড়ে।

— মিতা কোথায়!?

আব্রাহামের গলা প্রায় ভেঙে যাচ্ছে, চোখে আগুন, যেন সে কোনো মানুষ নয়, একখণ্ড হিংস্র ভয়ঙ্কর জন্তু হয়ে উঠেছে।

অ্যাডাম অবাক হয়ে তার গালে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

— এমন করছো কেন? আমি জানি না মিতা কোথায়? অ্যাডাম কাঁপতে কাঁপতে বলল।

আব্রাহাম এক পলক না ফেরাতেই আবার তার গাল থেকে চোখ সরিয়ে অ্যাডামকে মারতে গেল।

আব্রাহাম মনের মধ্যে ক্ষোভ আর হতাশার আগুন নিয়ে অ্যাডামের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার হাতের প্রতিটি আঘাত যেন ছিল মিতার হারানোর যন্ত্রণার প্রতিফলন। সে আর কিছু ভাবতে পারছিল না, শুধু মিতাকে ফিরে পেতে হবে। তবে ততক্ষণে অ্যাডামের কাঁধে ঠান্ডা হাত পড়ল, পুলিশ এসে উপস্থিত হয়েছে।

পুলিশের একজন অফিসার এসে আব্রাহামের হাত থামিয়ে দেয়।

— তুমি কি করছো? চল, আমাদের সঙ্গে আসো।

অফিসারের কণ্ঠে ছিল এক ধরনের কঠোরতা, যার অর্থ আইন নিজের হাতে তোলা যাবে না।

আব্রাহাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পুলিশের হাত তার কাঁধে পড়লো এবং সে বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে যেতে শুরু করল। অথচ তার মন, শরীর, শুধু মিতার দিকে ছুটে যেতে চাচ্ছিল।

অ্যাডামের পরিবার পুলিশকে জানিয়ে ছিল সবকিছু। সময়মতো পুলিশ পৌঁছেছে বলে। নয়ত বড়ো ধরণের অঘটন ঘটতে পারত।

পুলিশ স্টেশনে আব্রাহামের নামে মামলা করা হলো।
আব্রাহাম এই মুহূর্তে শুধুমাত্র মিতার চিন্তা করছিল। কিন্তু তার ভিতরের যন্ত্রণা, হতাশা আর ভয়ে সে নিজের ভুল বুঝে উঠতে পারছিল না। মিতার জন্য তার টান, তার ভালোবাসা, ওকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে এতটা অন্ধ করেছিল যে, সে বুঝতে পারেনি তার এই হিংস্র প্রতিক্রিয়া কতটা বিপদজনক হয়ে উঠেছে।

******★★★**★***★*

মিতার মনে হলো, কেউ যেন তার নরম গালে আঙুলের প্যাঁচালিতে গল্প লিখছে। নরম, আদুরে ছোঁয়া। ঘুমের নেশা তখনও ভাঙেনি, চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মনের মধ্যে এক অদ্ভুত টান, এক অজানা কৌতূহল কাজ করছে। কে ছুঁলো তাকে এত মমতায়? এমন অনুভূতি তো সে শুধু স্বপ্নে পেয়েছে, আদনানের ছোঁয়ায়।

হঠাৎ মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে সে কি এখনো বেঁচে আছে? যদি মরে যেত, তবে এই অনুভব এত বাস্তব হতো না, হতো?

মিতা চোখ না খুলেই শ্বাস আটকে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ অনুভব করল। কেউ যেন ওর গলার কাছে মুখ গুঁজে আছে। তপ্ত নিশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে তার ত্বক, অদ্ভুত শিহরণ নামছে মেরুদণ্ড বেয়ে।

মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যায়। এই নিশ্বাস, এই ঘ্রাণ, এতো চেনা! এতো আপন!

মিতা ভয়ে-আবেগে চোখ মেলে তাকাতে চায়, কিন্তু চোখদুটো যেন খুলতে চাইছে না । তার সমস্ত অস্তিত্বে কেবল একটাই প্রশ্ন গুঞ্জন তুলছে।

মিতা অনেক চেষ্টার পর চোখ খুলে তাকাতেই বুঝতে পারল, সে কারো বাহুডোরে বন্দি। আলো আঁধারির মাঝে ঠিক স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু গায়ের গন্ধটা পরিচিত। পুরনো, চেনা এক ঘ্রাণ।

হুট করে চোখের কোণ ভিজে উঠল মিতার। একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট, অভিমান আর ভালোবাসা সব যেন একসঙ্গে গলে জল হয়ে বেরিয়ে এল।

মানুষটা বুঝতে পারল কি না, কে জানে! কিন্তু তার বাহু আলগা থেকে আরও জোরে মিতাকে আঁকড়ে ধরল। যেন পৃথিবীর কোনও শক্তিও আর মিতাকে তার থেকে আলাদা করতে পারবে না।

আর ঠিক তখনই এক গাঢ় কণ্ঠ ছুঁয়ে গেল মিতার কানের পাশ দিয়ে

–আর কাঁদিস না মিতা। তোর ভালোবাসা তোর কাছে এবার ধরা দিয়েছে।

মিতার হৃদয়ে যেন ধ্বনিত হল হাজারটা ধুপধাপ শব্দ, আবার থেমে গেল সব। কারণ, নিস্তব্ধতায় গলে যাওয়া ভালোবাসার নাম আদনান।

#দ্বিতীয়জন [১২]
#Tahmina_Akhter

সূর্যলোকের সোনালি আলো পর্দার ফাঁক গলে ধীরে ধীরে এসে পড়ছিল মিতার মুখে। সেই কোমল উষ্ণতায় মিতার চোখ খুলে গেল। চোখ দুটো আধভেজা, মাথাটা ভারি হয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল।

ধীরে ধীরে উঠে বসল বিছানায়। আশপাশটা দেখল।নরম বিছানা, কাঠের তৈরি একটি সাদামাটা টেবিল, জানালার পাশে একটা বইয়ের তাক। ঘরটা অপরিচিত, কিন্তু যেন কোথায় যেন একটা চেনা অনুভূতি ছড়িয়ে আছে বাতাসে।

হুট করে মনের ভেতর কেঁপে উঠল একটা স্মৃতি।
আদনান! কাল রাতে আদনান ছিল। আদনান তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, বলেছিল

–“তোর ভালোবাসা তোর কাছে এবার ধরা দিয়েছে।”

মিতা হন্তদন্ত হয়ে পাশ ফিরে তাকাল। না ; কেউ নেই।

বিছানার ও পাশে শুধুই শূন্যতা। যেন রাতের সেই উষ্ণতা, সেই অস্তিত্ব, সেই কণ্ঠ সবই যেন একটা গভীর স্বপ্ন ছিল। হৃদয়ের গভীরে গেঁথে থাকা কোনো মায়াবী আচ্ছাদন।

মিতার বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে এল। নিজেকে প্রশ্ন করল

—তাহলে কি সবটাই কল্পনা ছিল?

মিতার ভেতরের টানাপোড়েন, দ্বিধা আর বিস্ময়ের মাঝেই দরজায় হালকা নক হয়। মুহূর্তেই মিতার ভাবনার জাল ছিন্ন হয়।

— কাম ইন,

মিতা প্রায় ফিসফিস করে বলল।

দরজা খুলে এক চল্লিশের কোঠায় বয়সী, গাঢ় বাদামি শেফের এপ্রোন পরা এক ভদ্রমহিলা নাশতার ট্রলি ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। মুখে নরম হাসি, আচরণে সাবলীল সৌজন্যতা। তিনি মিতাকে একবার দেখেই বুঝে ফেলেন। মেয়েটা খুব ঘরকুনো ধরনের।

— শুভ সকাল, ম্যাম। স্যার বলেছেন, আপনি যেন ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নেন। ট্রলিতে আজকের নাশতা সাজানো আছে। খেয়ে নেবেন।

মিতা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। “স্যার”? কে স্যার? কে এই নারী? আদনান? না; অন্য কেউ?

হুট করে মিতার চোখে জল চলে আসে। চোখ দুটো মুছে মিতা হালকা গলায় বলল,

— আপনি কি বলতে পারবেন , আমাকে এই বাড়িতে কে এনেছে ? তার পরিচয় কি?

নারীটি মাথা নিচু করে নম্রভাবে বলল,

— আমাকে কিছুই বলা হয়নি, ম্যাম। আমি এই বাড়ির একজন কর্মচারী। আমাকে শুধু আপনাকে যত্নে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এটাও বলেছেন, আপনি যেন আজ বিশ্রাম নেন।

মিতা ধীরে ধীরে ট্রলির কাছে এগিয়ে গেল। ট্রলিতে তখন ধোঁয়া ওঠা কফি, ব্রেড ওমলেট, এক বাটি ফল,
চোখ গেল সেই ছোট নোটের দিকে। কাঁপা হাতে নোট হাতে নিলো মিতা। ততক্ষণে নারীটি চলে গেছে। ধীরে ধীরে নোটটি খুলে মিতা চোখ রাখতেই এক পরিচিত হাতের লেখা ভেসে উঠল। বুকের ভেতর কেমন যেন ধকধক করে উঠল ওর।

চিরকুটে লেখা

“তোমার ঘুমের মাঝে তোমায় ছুঁয়ে থাকা আমার প্রিয় অভ্যাস।
তুমি জানো না, আজ ভোরে কতবার তোমার চোখের পাতায় চুমু খেয়েছি। আজ না হয় একদিন বিশ্রাম নাও, রানী। আমার রাজ্যের সব ব্যস্ততা আজ তোমার জন্য বিরতি নিয়েছে। রাতে দেখা হবে। নিজের খেয়াল রেখো”

চিরকুটের নিচে কোনো নাম নেই, শুধু একটা ছোট্ট ছবি আঁকা। একটা অর্ধেক চাঁদ আর তার পাশে ছোট্ট মেঘ। চাঁদটাকে মেঘটা আড়াল করে রেখেছে।

মিতা চিরকুটটা বুকে চেপে ধরে ফেলল, ওর ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। এই আদুরে গলায় কে শব্দ লিখেছে? আদনান? না অন্য কেউ, যে ওর হৃদয়ের গোপন গলি চিনে গেছে?

মিতা এক গভীর গোলকধাঁধায় আটকে গেছে। না চাইতেও এক অদ্ভুত জটিল অনুভূতির জালে। এই ঘর, এই অচেনা পরিবেশ, আর সেই চিরকুট। সব মিলে এক রহস্যময় কুয়াশার চাদর ওকে আড়াল করে ফেলেছে।

মিতা চাইছে সে এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে। যুক্তিবাদী, কঠিন বাস্তবতার ভিত গড়ে ওঠা একজন চিকিৎসক হয়ে এসব রহস্যময়তা, অনুভূতির টানাপোড়েন, স্বপ্ন আর স্মৃতির আবেশে জড়িয়ে পড়াটা যেন অসম্ভবই! তবু সে কি না ভাবতে বসেছে সেই অচেনা মানুষটিকে। যার মুখও এখনো স্পষ্ট হয়নি। এমনকি সেই স্পর্শ, সেই চিরকুট সব যেন স্বপ্নের মতো মায়াময়। কিন্তু মায়ায় জড়ানো তো মিতার স্বভাব নয়!

“আমি তো এমন মেয়ে নই” নিজেকে নিরবে বলল মিতা। আর তখনই আদনানের কথা মনে পড়ে গেল।
তীব্র কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠল।

–আদনান। তুমি কি সত্যিই ফিরে আসতে পারবে?

এই প্রশ্নটা বারবার মিতার মনে ধাক্কা খাচ্ছে।

একজন ডাক্তার প্রাণ আর মৃত্যুর সীমারেখা যারা স্পষ্ট করে চেনে, তাদের জন্য এই প্রশ্ন অবান্তর, হাস্যকর।
কিন্তু আজ? আজ সে-ই নিজের যুক্তিবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

একজন মৃত মানুষ ফিরে আসে না এটা তো জানি।
তাহলে এই অনুভূতি? এই গন্ধ? এই কণ্ঠস্বর, এই চিরকুট?

মিতা যেন হারিয়ে গেছে এক অলৌকিক ধাঁধার ভিতর, যেখানে বিজ্ঞান আর হৃদয়ের সংঘর্ষে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত কল্পনার জাদু।

সে নিজের কপাল চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

–আমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছি?

এবং ঠিক তখনই বাতাসে কোথা থেকে যেন আদনানের হাসির শব্দ ভেসে এলো। নাকি কেবল মিতার কল্পনামাত্র?

____________

এদিকে আব্রাহাম থানা থেকে বের হয়েছে। সায়মা ওর জামিন করিয়েছে। গাড়ি চলছিল। গাড়ির জানালার ধারে বসে থাকা আব্রাহামের চোখ তখনও ঘোলাটে, ক্লান্ত, আর গভীর আশঙ্কায় ডুবে ছিল তার মস্তিষ্ক । শহরের আলো ঝলমলে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি যখন একটা নির্জন রাস্তায় উঠলো, হঠাৎ আব্রাহাম নিচু গলায় বলল,

— সায়মা? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার পুরনো শত্রুদের মধ্যে কেউ ফিরে এসেছে।

সায়মা চমকে তাকাল ওর দিকে।

— কী বলছো তুমি?

আব্রাহাম চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,

— প্রতিশোধ নিতে তারা ভুলে না। আমি অনেকের ক্ষতি করেছি একসময়, বিশেষ করে যারা সৎ পথে চলত। আমি তাদের ক্ষতি করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে থেকে কেউ মিতাকে কিডন্যাপ করেছে। আমার হৃদয়টাকে ছিঁড়ে প্রতিশোধ নিতে।

সায়মার কণ্ঠে উদ্বেগ আর হতাশার মিশেল,

— তাতে কি তাদের স্বার্থ হাসিল হবে? মিতার মতো একজন নিষ্পাপ মানুষকে কষ্ট দিয়ে কী পাবে তারা?

আব্রাহাম গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল,

— প্রতিশোধ অন্ধ হয় সায়মা। তারা চায় আমি মিতাকে হারানোর আগুনে পুড়ি, আমি কাঁদি। মিতাকে কষ্ট দিয়ে আমার বুকটাকে চিরে ফেলতে চায় ওরা ।

–এবার কী করবো আমরা? সায়মা প্রশ্ন করল।

আব্রাহাম জানালার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

— ওদের খুঁজে বের করব। মিতাকে ফেরাব। হোক সে যত বড় শত্রুই।

আব্রাহাম বাড়ি ফিরতেই তার চোখে পড়ল একটি পার্সেল, যেটি বেনামি ঠিকানা থেকে এসেছে। অবাক হয়ে সে পার্সেলটি খুলল। এক লহমায় তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ছবিটিতে মিতা, একজন পুরুষের বুকের মাঝে লেপ্টে আছে, চোখ বন্ধ। মিতার চেহারায় যেন অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ছবিটি দেখে আব্রাহামের বুকটা যেন থমকে গেল। এক মুহূর্তেই তার ভিতরে এক অদ্ভুত রাগের আগুন জ্বলে উঠল। মাথার মধ্যে খারাপ চিন্তা ভর করল, আর তার পর মুহূর্তেই তিনি ঘর ও বাসার জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করলেন।

সায়মা তার ঘর থেকে শব্দ শুনে বের হয়ে আসতেই দৃশ্যটি দেখে, সায়মা দ্রুত আব্রাহামকে থামানোর চেষ্টা করে। তার চোখে ভয়, হৃদয়ে দুশ্চিন্তা। কিন্তু কোনোভাবেই আব্রাহামকে শান্ত করা যাচ্ছে না। তার মাঝে এক অদৃশ্য দুঃখ, রাগ আর কষ্ট যেন মিশে গেছে। সায়মা বার বার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আব্রাহামের চোখে সেসব তেমন কোনও প্রভাব ফেলছে না। হৃদয়ের ক্ষোভ আর মনের ভেতর চলা অশান্তির ঝড় তাকে শান্ত হতে দিচ্ছে না।

রাত বারোটা বাজে, আব্রাহাম বারান্দায় বসে আছে। তার চোখ ছাঁদের দক্ষিণ দিকে, যেখানে একসময় সে মিতাকে প্রপোজ করেছিল। সেই জায়গাটিই ছিল তাদের সম্পর্কের অমূল্য মুহূর্ত। আর তারপর থেকেই মিতা নেই, হারিয়ে গেছে। আব্রাহামের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটা মানুষ কিভাবে এমন করে হারিয়ে যেতে পারে? এই ভাবনাতেই তার কপালের শিরাগুলি ফুলে উঠল, চোখের কোনে অশ্রু জমে আসছে।

হঠাৎ, তার মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। এক মুহূর্তে আব্রাহাম চট করে কলটি রিসিভ করল। তার মনে যেন কোনো অজানা আশা জেগে উঠল। এটা হয়তো মিতার খবর, হয়তো তার সন্ধান পাওয়া যাবে!

— হ্যালো?

— আব্রাহাম?

আব্রাহাম হঠাৎ সন্দেহভাজন হয়ে পড়ে, তার মনে হাজারো প্রশ্ন। খুবই সর্তকভাবে প্রশ্ন করল,

— কে তুমি?

এক মুহূর্তের জন্য দ্যুতি ঘরটাকে ম্লান করে দেয়। ওপাশ থেকে এক দীর্ঘ হাসির আওয়াজ ভেসে আসে, যেন তাতে কোনো অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে আব্রাহামের মস্তিষ্কে ছুটে চলে একাধিক চিন্তা। এমন হাসি কি সে কখনও শুনেছে? কেন মনে হচ্ছে কণ্ঠটা পরিচিত?

আরো খানিকটা চেষ্টা করার পর, আব্রাহামের মস্তিষ্কে আলোর ঝলকানির ন্যায় একটি নাম ভেসে উঠল। বেশ পরিচিত একটি নাম মনে আসে। তার চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। অপর দিকে হাসি থেমে যায়। ওপাশ থেকে আসা কণ্ঠস্বর আরও একবার শোনা যায়।

— আমাকে চিনতে পারছো না! ভেরি সেড। তবে শুনে আনন্দিত হলাম যে আমার কোনো স্মৃতি তোমার মনে নেই।

এক মুহূর্তের জন্য আব্রাহাম যেন স্তব্ধ হয়ে যায়, সে যেন পুরোপুরি সাপোর্ট হারিয়ে ফেলেছে। তার কথা যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এ যেন এক এলোমেলো মুহূর্ত।

— প্রতিশোধ নিতে চাইছিস? আব্রাহাম অবশেষে অস্ফুট স্বরে প্রশ্নটি করে।

পাশ থেকে হালকা হাসির শব্দ শোনা যায়।

— বাহ! চিনতে পেরেছো তাহলে। প্রতিশোধ নিতে চাওয়াটা অপরাধের বিষয়? যদি অপরাধের বিষয় হয়ে থাকে তাহলে তো তোমার অপরাধ আমার করা অপরাধের চেয়েও বড়ো।

মনের মধ্যে হাজারো আবেগের ঝড় বয়ে যেতে থাকে আব্রাহামের। মাথার মধ্যে একে একে ছুটে চলে কিছু অস্বস্তিকর স্মৃতি, কিন্তু এখনো কোনো কিছু পরিষ্কারভাবে তার মস্তিষ্কেপৌঁছাচ্ছে না।

— মিতা যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন?

আব্রাহামের কণ্ঠে অসহায়, উদ্বেগ কাজ করছে । মনে মনে সে ভাবছিল, কীভাবে মিতা জানবে? কিভাবে সে তার পরিস্থিতি বদলাবে? সে কি এই রহস্যের জাল ভেদ করতে পারবে?

অপেক্ষা না করে ওপাশের কণ্ঠ আরও গভীর হয়ে ওঠে,

— মিতাকে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি আব্রাহাম। অনেক চিন্তা করেছো ওকে নিয়ে। আর নয়। এবার নিজেকে নিয়ে ভাবো কি করবে তুমি? এবার যে তোমার পালানোর কোনো পথ নেই।

এই কথাগুলো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কল কেটে যায়। আব্রাহামের হৃদয় ধক করে ওঠে। পুরো ঘর যেন তার ওপর চেপে বসে। তাঁর সমস্ত শরীর এক চরম অস্থিরতায় ভরে যায়। মনে মনে এক নীল গভীরতা তাকে গ্রাস করে নেয়। মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন ধুকছে,

“আদনান কি আসলেই বেঁচে আছে?”

তাড়াহুড়া করে আব্রাহাম সায়মার রুমের দরজায় জোরে নক করে। সায়মা দরজা খুলতেই আব্রাহামের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে বিভীষিকার মতো শ্বাস। তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগল,

— আদনান বেঁচে আছে সায়মা। ও এবার আমাদের কিছুতেই ছাড়বে না। মিতাকে যেহেতু ওর দখলে নিয়ে ফেলেছে তাহলে আর কোনোভাবেই আদনানকে আঁটকানো যাবে না।

সায়মা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মুখ থেকে অচেতন ভাষা বের হয়ে আসে,

— তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? আদনান মরে গেছে।

আব্রাহাম তীব্র এক হাহাকার দিয়ে উত্তর দেয়,

— আদনান মরেনি। ও সেদিন মরেনি।

এ কথা বলার পর, সায়মার চোখে বিস্ময়ের ছায়া পড়ে। তার মস্তিষ্কের কোণে কোন এক অজানা গাঢ় সত্যি ভেসে ওঠে। কণ্ঠ শূন্য হয়ে যায়। একটি নিঃশ্বাস, একটা শূন্যতা এরপর আর কিছুই মাথায় ঢুকছে না সায়মার।

চলবে…