#দ্বিতীয়জন [১৫]
#Tahmina_Akhter
—মিতা, কতবছর পর তোমায় দেখলাম মেরিজান?কতটা কষ্ট পেয়েছি তোমায় স্পর্শ করতে না পেরে? ভালেবেসেছি ঠিকই কাছে টানতে পারিনি। এই তোমার চোখে জল কেন?
অচেতন মাহির চোখের কোন ঘেষে পানি গড়িয়ে পরল। Mr.. A পুরুষালি হাতে মিতার চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর, কাউকে ডাক দিলো। একটি রাশিয়ান মহিলা এসে দাঁড়ালো সেই কক্ষে।
— ওর খেয়াল রাখবেন মিস মাদাম। আমি ফিরে আসব কিছুক্ষণের মধ্যে।
Mr.A চলে গেল। মিস মাদাম অপেক্ষায় আছে কখন মিতা জেগে উঠবে? Mr. A,এর কাছে বহুবার এই চমৎকার মেয়েটার কথা শুনেছে।
ঘন জঙ্গলের আঁকাবাকা রাস্তায় সাপের ন্যায় ছুটছে একটি কালো মার্সিডিজ। হুডি পরিহিতা এক পুরুষ। নিকষ কালো চোখের মনিগুলো দিয়ে যেন কিছু আক্রোশ বেড়িয়ে আসতে চাইছে। হুট করে গাড়ি ব্রেক কষল। গাড়ি থেকে বের হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো।
পুরনো হন্টেড বাাড়ি ; দেখতেই কেমন গা ছমছমিয়ে উঠে! পায়ের পাতার তলে শুকনা পাতার মুচমুচে শব্দ যেন এই ব্যাপারটাকে আরও নান্দনিক করে তুলেছে। লোকটা ধীরে ধীরে হন্টেড বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। নীচতলা গোডাউন টাইপ রুমটায় দরজা খুলতেই এক ডজন কালো পোশাকধারী লোক স্যালুট করল লোকটাকে।
লোকটা সকলকে উপেক্ষা করে চেয়ারে বেঁধে রাখা রক্তাক্ত মানুষটার দিকে এগিয়ে যায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তার পরিণতি। একজন এসে আরও একটি চেয়ার দিয়ে গেলো। লোকটা চেয়ারে বসে সবাইকে চোখের ইশারা দিয়ে বলল বেরিয়ে যেতে। সবাই চলে গেল।
রক্তাক্ত মানুষটার চোখেমুখে পানি ছুঁড়ে মারল। লোকটা পানির ঝাপটায় ঝাপসা চোখেলাগা দৃষ্টিতে তাকায়। লোকটাকে চোখ খুলতে দেখে হুডি পরা লোকটা ফিচেল হেসে বলল,
— ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড মি. নির্বাণ। দ্য সিক্রেট এজেন্ট অফিসার। আমার মেহমানদারি আপনার কেমন লাগছে? আমি তো আপনাকে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছি। আমার লোকেরা আপনাকে এত চমৎকার ভাবে আপ্যায়ন করেছে। দেখেই আমার চোখে জল চলে এসেছেে।
— আপনি এত নির্দয় Mr.. A?
— হ্যা হ্যা আমি নির্দয়। কারণ, আমার ওপর যখন অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল তখন আপনাদের মত কিছু অফিসার আমার ওপর নির্দয় হয়েছিল।
— অসৎ পথে উপার্জন করেছিলেন! আপনাকে কি প্রশাসন ফুল দিয়ে বরণ করবে?
নির্বাণের কথায় Mr. A হাসল। পায়ের ওপর পা তুলে বলল,
— পুরান কথায় মাটি দেন। আগে এটা বলেন আপনি আমার জিনিসে হাত দেয়ার সাহস পেয়েছেন কি করে? জানেন কতটা মূল্যবান ও?
— এমন কড়াক টাইপ মেয়ে আপনি ডিজার্ভ করেন না Mr. A। আপনি রাশিয়ান। আপনার উচিত বাঙালি মেয়ে ছেড়ে রাশিয়ান কাউকে বিয়ে করা।
— সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আমি যাকে চেয়েছি সে আমারই। বাঙালি ডাজ নট মেটার। এই যে ওর শরীরে আপনি হাত লাগিয়েছেন তারজন্য আমার কি করতে ইচ্ছে করছে জানেন?আপনার হাতটা কেটে মিতাকে উপহার দেই। কিন্তু বেচারি ভয় পাবে তাই প্ল্যান বদল করলাম। আপনার মাথাটা কেটে আপনার ওয়াইফকে গিফট করব। চোখদুটো খুলে রেখে দেব আমি। কারণ, এই চোখ দুটো দিয়ে আমি পরীক্ষা করব। এই চোখের কত পাওয়ার আছে? ঘরে স্ত্রী থাকতে কি করে পরনারীর দিকে নজর যায়। পরনারীর স্বামীর ইউজড করা পারফিউম ইউজ করে মেয়েদের মতিভ্রম করে গায়ে হাত দেয়ার কত চিপ প্ল্যান!
—- Mr. আদনানের কেইসের জন্য করতেই হতো?
আর আপনি কি করে জানলেন পারফিউমের কথা?
নির্বাণ Mr.A এর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো।
— অনেকক্ষণ হলো ভদ্রতা করলাম। এবার আসল ফর্মে আসা যাক। তোর শরীর থেকে এখনও আদনানের ইউজ করা পারফিউমের গন্ধ আসছে। আবার এটা বলিস না আমি কি করে জানলাম?
আদনান আমার কে হয় জানিস তুই? তুই কিছুই জানিস না? তুই টাকা খেয়ে পূনরায় একটা মিথ্যা ঘটনা বানিয়ে আদনানের মামলা নতুন করে কোর্টে তুলতে চাইছিস। অথচ, তুইও জানিস আমিও জানি। আদনানকে কেউ মারেনি। ওর মৃত্যুর কারণ সবাই যা জানে সেই কারণে হয়েছে।
নির্বাণ ঢোক গিলল। কারণ মি. A যা বলছে সব সত্যি। নির্বাণকে ওপর মহলের একজন প্রথমে টাকার লোভ, পরে চাকরি খেয়ে ফেলার চাপ দিয়ে কেইসটা নতুন করে সাজানোর প্ল্যান বাস্তবায়ন করে। কিন্তু, বাংলাদেশের খবর রাশিয়ায় বসে থাকা এই পাগলা ডাক্তারের জানার কথা না। আচ্ছা এই কেইসে যে তাকে ফাঁসানো হবে এটা কে জেনে ফেলল নাকি Mr. A ।
—- গুড নাইট মাই ডিয়ার নির্বাণ। Rest in peace. Bye bye. প্ল্যান বদল করলাম। তোর চোখ আমি পরীক্ষা করব না। আর না তোর বৌকে তোর কাটা মাথা গিফট করব।
Mr. A ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে বেরিয়ে এলো একডজন গার্ড। রুমটায় অন্ধকার ভরে গেল। দরজা লক হয়ে গেল। তারপর ভেতর থেকে ভেসে এলো নির্বাণের গগনবিদারী চিৎকার। আর হায়েনার মাংস খুবলে খাওয়ার শব্দ।
————————
সকালের মিষ্টি আলোর পরশে ঘুম ভাঙল মিতার। কম্ফোর্টারের নীচে নরম বিছানায় দেবে যাওয়া শরীরটাকে টেনে তুলল। এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা করল। তারপর,চট করে বিছানার পাশে কোনো পুরুষের অবয়ব দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল মিতা।
— ডোন্ট শাউট মেরিজান। আমি অনেক ক্লান্ত।
ঘুমঘুম চোখে তাকালো Mr. A। মিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিছানায় শুয়ে থাকা পুরুষটার দিকে। সাদা বিছানার ওপর ফর্সা শরীরটা, কোমড় অব্দি টেনে রাখা কম্ফোর্টার। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা অন্যদিকে ফেরানো। ওই অবস্থায় ঘুমঘুম স্বরে কথা বলার মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করছে। নির্বাণ বলেছে Mr. A ভালো মানুষ নয়। গতকাল রাতের কথা একে একে মনে পরল মিতার। তারপর রাগের মাথায় খাটের কোণায় গিয়ে কম্ফোর্টার একটানে খুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে।
— আপনি Mr. A নাকি B সরি! ধুর বাল। কিছুই মনে থাকে না। আপনি নির্বাণ সাহেবকে কোথায় রেখেছেন?
মিতার সাহস দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল Mr.A। তৎক্ষনাৎ উপুড় থেকে সোজা হয়ে বসল। তারপর একটানে মিতাকে নিজের কোলের ওপর বসালো। মিতার পিঠ Mr. A এর লোমশ বুকে জায়গা নিয়েছে। মিতা হকচকিয়ে উঠতে চায়। কিন্তু ক্রমশ চাপে মিতা যেন আর গাঢ় হয়ে সেটে গেল লোমশ বুকটায়। মিতার কাঁধের ওপর তপ্ত চুমু খেল।
মিতার শরীর অচেনা এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। হাত-পা থেকে পুরো শরীর কেমন অচেনা অনুভূতির সঙ্গে আন্দোলন শুরু করেছে!
মিতার শরীরে এই প্রথম এমন স্পর্শ! হয়ত বিয়ে হয়েছিল আদনানের সঙ্গে কিন্তু এমন স্পর্শ পাওয়ার ভাগ্য জুটার আগেই তো মানুষটা হারিয়ে গেল।
Mr. A দুহাতে পেচিয়ে ধরল মিতাকে। তারপর মিতার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
— I am Adam. your one side lover. How can you forget me? My love.
বলেই মিতাকে নিয়ে শুয়ে পরল বিছানায়। Adam এর সুঠাম দেহের ওপর মিতার বাঁকানো শরীরটা। মিতা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য অবস্থায় আছে। আর Adam মিতার গলায় মুখ গুঁজে নেশাক্ত বলল,
— তোমার হৃদয়ে কেবল আমি থাকব মাই লাভ। নির্বাণ ইজ নট ইউর পার্সন। আমি তোমার। তুমি আমার। কারন আমি তোমার। কারণ আমার তোমারই হবার কথা।। আর কারো নয়। কারণ, আমি তোমাকে আর কারো হতেই দেব না।
মিতাকে ঘুরিয়ে নিলো সম্মুখে। তারপর মিতার lips লক হলো Adam এর force kiss এর জোড়ে।
চলবে
#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
১৬…
মিতার এবার শরীরের সবোর্চ্চ শক্তি দিয়ে এ্যাডামকে ধাক্কা মারল।
আকস্মিক আক্রমণে এ্যাডাম দু’কদম পিছিয়ে গেল। চোখে অবিশ্বাসের ছায়া।
মিতার চোখে পানি। ঠোঁটদুটো ওড়না দিয়ে ঘষে ঘষে মুছছে, যেন সেই স্পর্শ মুছে ফেলতে চায়।
তবুও যেন কিছু একটা বাকি থেকে যাচ্ছে। ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে মিতার। সে হঠাৎই এগিয়ে গিয়ে এ্যাডামের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারল।
চটাশ!
রুম জুড়ে সেই শব্দ ধ্বনিত হলো। মিতা ফুঁপিয়ে উঠল।
— আপনি কি জানেন, আমি ওকে স্পর্শ করতে পারিনি কখনও। কিন্তু ওর স্পর্শ না পাওয়ার ব্যথা আমার জীবনের অংশ হয়ে আছে। আপনি সেটা কেড়ে নিয়েছেন! আপনি শুধু আমার শরীর না, আমার আত্মাটাকেও, আমার ভালোবাসাকে অপবিত্র করেছেন!
এ্যাডাম কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ফর্সা মুখটা থাপ্পড়ের দাগে লাল।
— আপনি বলেছিলেন আমাকে ভালোবাসেন, তাই তো? ভালোবাসা এমন হয় না! আপনি জানতেন আমি কষ্টে আছি। জানতেন আমার হৃদয়ে এখনো আদনানের বসবাস। তাহলে কেন?
এ্যাডাম একধাপ এগিয়ে এলো।
— আমি জানি আমি অন্যায় করেছি, মেরিজান। আমি নিজেকেও ঘৃণা করছি এখন। কিন্তু আমার হৃদয়ে তোমার জন্য যে ভালোবাসা আছে সেটা মিথ্যা নয়। আমি তোমাকে পাওয়ার নেশায় ছিলাম না কখনোই । আজ কি যে হলো! আমি শুধু একবার তোমার চোখে নিজের জন্য কিছু দেখতে চেয়েছিলাম।
— আমি ভেবেছিলাম আপনি ভিন্ন। আপনি একজন ভালো মানুষ। আজ বুঝলাম, আপনি Mr. A! পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট, জালিম, আমার আদনানের হত্যাকারি। আমার দ্বিতীয়জন হবার যোগ্য আপনি নন। আজকের পর থেকে আমার দ্বিতীয়জন হবার চেষ্টা করার দুঃসাহস দেখাবেন না। নয়ত এর পরিণাম ভীষণ খারাপ হবে।
মিতা কাঁপছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল। এ্যাডাম মুখ নিচু করে মিতার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
— তোমার হাতে রচিত আমার পরিণতি দেখতেই তো চাই আমি। শতবার বারণ করবে করো। তবুও আমি তোমার দ্বিতীয়জন হয়েই থাকব৷ কারণ আমি সেই পাপী, যে শুধু তোমাকেই চায়। এমনকি তোমার ঘৃণাতে যদি আমার স্থান হয়। তবুও আমি তোমাকেই চাই মেরিজান।
মিতার কানে সশব্দে চুমু খেলো এ্যাডাম। মিতা স্পর্শটুকু হজম করল চোখদুটো বন্ধ করে।
— কে বলেছে দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায় না? আদনানকে ভুলতে বলছি না আমি। শুধু তোমার মনের একটুখানি জায়গা দিলে চলবে আমার। মিতা, তোমাকে সেই যে ভার্সিটির করিডোরে দেখলাম সেই থেকে আমি তোমাকে একতরফা ভাবে ভালোবাসছি। বহু বছর তো পেরিয়ে গেছে মিতা তুমি নিজেকে আরও একবার সুযোগ কেন দিচ্ছো না?
মিতা জবাব দিলো না। এ্যাডামের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিল। কাঁধে ঝুলে আছে হাহাকারের ভার। ঠিক তখনই পিছন থেকে এ্যাডাম এসে ওর কোমর দুহাতে জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।
মিতা ছটফট করছে, চিৎকার করছে
— ছাড়ুন! প্লিজ লিভ মি এলোন, আদম!
এ্যাডাম যেন শোনেও না। ওর চোখে এখন অনুশোচনা।
— আমি কাউকে আমার জীবনে দ্বিতীয়বার জায়গা দিতে চাই না!
মিতা শ্বাসরুদ্ধ গলায় বলে যায়,
— বিশেষ করে তোমাকে তো নয়। আদনানকে তুমি মেরেছো, তাই না? নির্বাণ সাহেব আমাকে সবটা বলেছে।
আদমের শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল। কিন্তু মিতা থামে না।
— তুমি জানো না, আদনান আমার ভেতরে কতখানি জুড়ে ছিল, আছে। আমি ওকে পাইনি ঠিকই। তবু সেই না-পাওয়াটাকেই ধরে রেখেছি। আর তুমি? সেই মানুষটাকে মেরে ফেলেছো বহুবছর আগে। ভালোবাসার মিথ্যে বাহানায় আজ আমাকে ছুঁতে চাও?
মিতার কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছে। বুকের গহীন থেকে গর্জে ওঠে ওর কথাগুলো।
— আদনানের খুনিকে ভালোবাসার মতো দুঃস্বপ্ন আমার জীবনে না আসুক। তোমার ছায়াও যেন আমার পথে না আসে।
আদম এবার আস্তে করে ছিল মিতাকে।
চোখ দুটো জলে ভেসে উঠেছে। তবু মুখে নরম স্বর, মিতা যে ওকে সত্যি আদনানের খুনী ভাবছে!
— আমি.. আমি ওকে মারিনি, মেরিজান।
আমার সঙ্গে কখনোই আদনানের পরিচয় ছিল না। আদনানের পাশের বিল্ডিংয়ে আমি শিফট হয়েছিলাম তুমি রাশিয়ায় আসার এক সপ্তাহ আগে। যেখানে আদনানের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই সেখানে আদনানকে মারার প্রশ্নই আসে না। তবে, বেশ কিছুদিন হলো আমি একটা রিসার্চে আছি। পশুপাখি নিয়ে আমাদের বারোজনের একটিদল গবেষণা করছি। সেখানে জয়েন হবার পর থেকে তোমার সঙ্গে আমাকে অদৃশ্য একটানে বেঁধে ফেলল। কেন? সেটার উত্তর পাচ্ছি না।
মিতা যেন এ্যাডামের কথায় কান দিচ্ছে না। তবুও এ্যডাম থামল না।
–নির্বাণের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা আছে শুনবে মিতা?
এ্যাডাম মোবাইল ফোন বের করে রেকর্ড প্লে করল। গতকাল রাতে নির্বাণের বলা সব কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে মিতা। মিতা সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেল। নির্বাণের বলা আগে কথাগুলো নাকি এখন যা শুনতে পাচ্ছে সেগুলো?
— হয়ত ভাবতে পারো এগুলো মিথ্যে। কিন্তু, আসল সত্য একটাই আদনানের মৃত্যু স্বাভাবিক। শুধুমাত্র আদনানের মৃত্যুর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করার জন্য কেউ জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
মিতা বিছানায় বসে পরল। কি হচ্ছে এসব? মাথায় কিছুই ঢুকছে না! কে এমন করতে পারে
এ্যাডাম মিতাকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় মিস মাদাম এসে দরজার সামনে নক করল। এ্যাডাম মিতার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। মিতা চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল।
— কাম ইন।
মিস মাদাম ভেতরে এসে মাথা নীচু করে সম্মান জানিয়ে বলল,
— সকালের নাশতা তৈরি হয়েছে। আপনারা দুজন নীচে চলুন।
— মিতাকে নিয়ে এসো মিস মাদাম।
এ্যাডাম চলে গেল। মিস মাদাম এ্যডামকে দেখল ভিন্নরুপে। উন্মুক্ত বুক, কালো ট্রাউজার পরিহিত চেনা রুপের অচেনা এ্যাডামকে। দুজনের মাঝে কি আসলেই কিছু হয়েছে? কিন্তু..
মিস মাদাম আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। মিতা ধীরে ধীরে পা ফেলছে তাঁর পেছনে।
গতকাল রাতে পাওয়া জীবনের দ্বিতীয় তীব্র ধাক্কা, দেহ আর মনের ওপর ছায়া ফেলে রাখলেও আজ যেন এক নতুন বোধ খুলে যাচ্ছে ওর সামনে।
করিডের পেরিয়েই প্রথমে চোখে পড়ল লম্বা কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা হয়ে নেমে গেছে। সিঁড়ির কাঠটা গাঢ় ওক কাঠের, রেক্সিন পোলিশে চকচক করছে। । রেলিংটা লোহার, যার গায়ে হালকা তুষার-আবহের জং, আর কারুকার্য আছে রুশ প্রাসাদের মতো। সিঁড়ি বেয়ে একবার নামলে মনে হয়, ইতিহাসের ভেতর হাঁটছে।
হলরুমটা বরং একদম উল্টো। উষ্ণ, কিন্তু থমথমে। বড় চিমনি, পাশে কাঠের টুকরো জ্বলে জ্বলে লালচে আলো ফেলছে কাঁচের জানালায়। জানালাগুলো দীর্ঘ, দেয়ালজোড়া। কিন্তু ভারী কটন আর লিনেনের পর্দায় ঢাকা, যেন বাইরের শীত আর ভেতরের উষ্ণতার মাঝখানে এক নিঃশব্দ দেয়াল টেনে দিয়েছে।
চামড়ার সোফা আর কাঠের মেঝে, এক কোণায় রাখা ভায়োলিন, তার পাশেই পুরনো টাইপরাইটার। এই বাড়ির কেউ হয়ত চিঠি লিখত কারও নামে। দেয়ালে একটাই ছবি কোনো তুষারাবৃত লেকের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একলা মানুষ। ছবির দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসে।
ডাইনিং রুম ঠিক হলরুমের পাশেই। লম্বা ওভাল টেবিল, টেবিলের উপর পাতলা সূচিকর্মের রানার, আর মাঝখানে রাখা ক্রিস্টাল বোলের মধ্যে শুকনো ল্যাভেন্ডার আর সাদা গোলাপ। চারপাশে ছয়টা চেয়ার, কিন্তু মিতার মনে হলো খুব কম মানুষ এখানে খেতে বসে। যেন টেবিলটা অতিথির অপেক্ষায় থাকে চিরকাল।
ছাদের ওপর ঝুলছে একখানি ছোট ঝাড়বাতি। কাচের প্যান্ডেন্ট গুলো ঠান্ডা বাতাসে টুকটুক করে বাজছে, যেন জমে যাওয়া সময় কাঁপছে অল্প করে।
— কতদিন আঁটকে রাখবেন এভাবে? মানুষ আটকে রাখা যায়। মন আটকাবেন কি করে মি. A?
এ্যাডাম খাওয়া বন্ধ করে মিতার দিকে তাকালো। চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন করল মিতা। এ্যাডাম মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমি কি একবারও বলেছি তোমাকে আঁটকে রাখব মেরিজান? তুমি স্বাধীন। তোমাকে আঁটকে রাখব তবে ভিন্ন উপায়ে। আমি এসব চিপ বন্দি টাইপ ভালোবাসা প্লে করতে পারব না।
— বাহ্ শুনে ধন্য হলাম। ধলা বিলাই।
বাংলায় কথাটি বলল মিতা। মিতার কথা শুনে এ্যাডাম বলল,
— ধলা বলাই কাকে বলছো?
আধো আধো বাংলায় উচ্চারণ করল। মিতা পানি খাচ্ছিল। এ্যাডামের ভাঙা বাংলা শুনে বিষম খেলো। এ্যাডাম মিতার অবস্থা দেখে বলল,
— আর ইউ ওকে।
— ইয়েস। বাংলা রপ্ত করেছেন?
— বাঙালি মেয়ের জন্য আমার মন গান গায়। আর মস্তিষ্কে সামান্য বাংলা ভাষার ঠাঁই হবে না। এটা আবার না ইনসাফি হবে না। তাই শিখে ফেললাম। নয়ত জানতেও পারতাম না কেউ আমাকে দুনিয়ার সকল গালি রেখে ধলা বিলাই বলে ডাকে!
–ওয়াও। রোমান্টিক ডায়লগও বাংলায় শিখেছেন?
— শিখতে হত। না হলে কী করে জানতাম কেউ আমাকে দুনিয়ার সমস্ত গালি বাদ দিয়ে ‘ধলা বিলাই’ ডাকে!
— হাহাহা!
মিতার মুখ থেকে এবার সত্যিকারের একটা হাসি বের হলো। হাসতে হাসতে গালে হাত চাপা দিল। এই হাসির ভেতরেও ছিল লুকানো কিছু ব্যথা, তবে সেই মুহূর্তে, কেবলমাত্র সেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য, এ্যাডাম মিতার মনে যেন কিছুটা জায়গা পেয়ে গেল।
এ্যাডাম মিতার হাসি দেখল। তারপর বলল,
— খাওয়ার পর আমরা বেরিয়ে যাব। আজ তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে যাবে।
মিতা চমকে তাকালো। এ্যাডাম মিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— আমাকে ভালোবাসতে হবে না। কেবল এই শহরে তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাশে রেখো। প্রমিস করছি আজকের পর তোমার সামনে আমার ভালোবাসার দাবি না দাঁড়াব না। তবে হ্যা যদি কখনো তোমার মনে হয় এ্যাডামকে তোমার প্রয়োজন। নির্দ্বিধায় চলে এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব ।
———————-
খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর এ্যাডাম মিতাকে নিয়ে রওনা হলো ওর বাসার উদ্দেশ্য। যে বাসাতে আদনানের স্মৃতি লেপ্টে আছে। যেই বাড়িতে থেকে মিতা রাশিয়ায় বসবাস করছে এতবছর ধরে। এ্যাডাম চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ড্রাইভ করছে। পাশে বসা মিতা আনমনে কিছু ভাবছে, তারপর সোজা হয়ে বসল। এ্যাডামের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
— আপনি কি গ্যাংস্টার? দেখলে তো আলাভোলা টাইপ ডাক্তার মনে হয়!
— গ্যাংস্টার হলে এতক্ষণে তোমাকে আমার বিছানায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতাম আমি। আলাভোলা দেখেই তোমার মত সুন্দরীকে কেবল চোখে দেখেই ফিল নিচ্ছি।
—- কিহহ্
মিতার চিৎকারে গাড়ির ইঞ্জিন অফ হয়ে গেছে। এ্যাডাম কপালে দুই আঙুল দিয়ে ঘষছে আর মিতার দিকে তাকিয়ে আছে। মিতা এ্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল,
— এই জন্যই আমি বিদেশি লোক দেখতে পারি না। চোখ দিয়ে দেখে ফিল নেয়। কেমন ভয়ানক কথাবার্তা! ছিহ্! এই আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিন। আমি একাই বাড়িতে যেতে পারব।
মিতা বের হবার জন্য দরজা খুলতেই যাচ্ছিল এ্যাডাম মিতার হাত ধরে ফেলল।
— তোমরা মেয়েরা আসলেই এক লাইন বেশি বুঝো? বিদেশিনী বা বাঙালী নারী হোক। ক বললো কলা বুঝে।
বসো থাকো চুপচাপ নয়ত চোখের ফিল বাদ দিয়ে…
বাকি কথা শেষ করল না এ্যাডাম। মিতাকে এক চোখ মারল। মিতার রাগে শরীর কাঁপছে।
“চলবে”