#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
১৭…
এ্যাডামের গাড়ি থামতেই মিতার বাইরে দাঁড়ানো উঁচু ভবনটা দেখে প্রশান্তি এলো মনে। Khamovniki শহরের ঐতিহ্যবাহী স্টোন ফেসাড, গাঢ় লাল ইট আর সাদা স্টোনের ছেঁড়া কারুকার্য যেন দূর থেকে ফ্ল্যাটটাকে একটি প্রাচীন প্রাসাদের মতো করে তুলেছে। বড় জানালা, লম্বা বারান্দা আর লোহার রেলিং। সবকিছুই রাশিয়ার আর্কিটেকচারের নিখুঁত ছোঁয়া।
বাংলাদেশ থেকে যেদিন প্রথমবার এলো রাশিয়ায় ঠিক সেদিনও এমন অনুভূতি দোলা দিয়েছিল মিতার মনে। আদনানকে ছুঁয়ে থাকা সকল কিছুকে নতুন করে দেখার মত প্রশান্তি আর কিছুতেই নেই। মিতা ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে চলল। মিতার পেছনে এ্যাডাম।
ফ্ল্যাটের লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পরল হালকা ধূসর কাঠের ফ্লোরটি। চারপাশের দেওয়ালে মৃদু ক্রিম কালারের পেইন্ট। একপাশে বড় চিমনি, যার ওপর রাখা পুরনো ফ্রেমে চোখ পড়ল, একজন একা মানুষ তুষার ঢাকা লেকের ধারে দাঁড়িয়ে। আরেক কোণায় এক চামড়ার সোফা, পাশে কাঠের ছোট টেবিল, যেখানে রাখা আছে কিছু বই আর ফটোফ্রেম।
ডাইনিং এরিয়া হলরুমের সঙ্গে সংযুক্ত। লম্বা ওভাল টেবিল, পাতলা সূচিকর্মের রানার আর মাঝখানে রাখা ক্রিস্টাল বোল
শুকনো ল্যাভেন্ডার আর সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো। টেবিলের চারপাশে তিনটি চেয়ার। একটা সায়মার, একটি আব্রাহামের, অন্যটি মিতার।
মিতা ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল। চোখে পড়ল ছোট্ট বইয়ের তাক, যেখানে সুন্দরভাবে সাজানো বাংলা সাহিত্যের কিছু বই। ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা নীল-সাদা টেবিলম্যাট, আদনান বিশেষ করে মিতার জন্য কিনেছিল। ফটোফ্রেমে আছে মিতার একটি একক ছবি, আর পাশেই হাতের পেন ধরে রাখা আদনানের ছবি। যেন তাদের দু’জনের গল্প এখনও ঘরে লুকিয়ে আছে।
মিতার বুক ধক করে ওঠে। মনে হয়, আদনান এখনও এখানে আছে। এই সাজানো ঘর, বই, ছবি, এমনকি ফ্ল্যাটের নীরবতা সবকিছুই তার অস্তিত্বের সাক্ষী।
মিতা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।বিশাল জানালা। ফ্লোর থেকে সিলিং পর্যন্ত, কাঁচের প্যানেল দিয়ে ঢাকা। বাইরে বরফের আবরণ, ভেতরে উষ্ণতা।
মিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে।বুকের ওপর হাতদুটো ভাজ করে বলল,
— আপনি এবং আপনার স্মৃতিরা আমাকে এখনও তাড়া করছে আদনান। কেন আদনান? আপনি বেঁচে থাকলে কি খুব ক্ষতি হত? আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। আপনার মত করে কেউ যে আমাকে আগলে রাখতে পারে না। আমার বয়স কত হয়েছে? আমার কি বিধবা হওয়ার বয়স হয়েছে? যখন আপনাকে বুঝিনি, স্বামী হিসেবে মানতে চাইতাম না। তখন তো ঠিকই আমার পেছনে ছায়ার মত ছিলেন। যখন আপনাকে বুঝলাম, ভালোবাসলাম, সংসার করার সাধ জাগল ঠিক তখনি আপনি… আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আপনার কবরটার পাশে কবর খুঁড়ে সেখানেই বাসা বাঁধি।
মিতা চোখ মুছল। তারপর, আবারও মনে মনে বলল,
–আপনার মৃত্যু নিয়ে এখন ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কার কথা বিশ্বাস করব? নির্বাণ নাকি এ্যাডামের কথা বিশ্বাস করব?
— আদনানের কথা মনে পরেছে?
মিতা পেছনে ফিরে তাকালো। এ্যাডাম দাঁড়িয়ে আছে । মিতা চোখের জল মুছল।
এ্যাডাম মিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ডানহাতের তর্জনী আঙুলের ডগায় মিতার চোখের জল নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল। এ্যাডাম চোখ বন্ধ করে মনে মনে আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—মিতাকে কেমন ভালোবেসেছিলে আদনান? তোমার অনুপস্থিতি তাকে এখন অস্থির করে তোলে! তোমার ভালোবাসায় কি এমন আছে যে মিতার পুরো জীবনে তুমি নেই আবার অনেকটা জুড়ে তুমি আছো?
— মিতা!!!
এ্যাডাম এবং মিতা দরজার দিকে তাকালো। আব্রাহাম এবং সায়মা দু’জনেই
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সায়মা দৌড়ে এসে মিতাকে জড়িয়ে ধরল। মিতা হেসে সায়মাকে জড়িয়ে ধরল। বহুদিন পর যে সখীর দেখা পেল। আব্রাহাম এ্যাডামের পাশে এসে দাঁড়ালো। এ্যাডাম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আব্রাহাম নাক ফুলিয়ে বলল,
— তোকে সেদিন মার বোধহয় কম দিয়েছিলাম! পুলিশের সামনে তো তুই স্বীকার করিসনি যে তুই মিতাকে কিডন্যাপ করেছিস ?
— আমি যদি মিতাকে কিডন্যাপ করতামই। তাহলে নিশ্চয়ই ওকে এখানে নিয়ে আসতাম না।
— তাহলে এতদিন মিতা কোথায় ছিল? টেল মি ড্যাম ইট?
আব্রাহাম এ্যাডামের জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল। মিতা আর সায়মা হকচকিয়ে যায়। দু’জনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। মিতা এ্যাডামের বাহু ধরে টানতে টানতে বলল,
— খোদার কসম লাগে এ্যাডাম। প্লিজ আব্রাহামকে ছেড়ে দাও।
এ্যাডাম রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আব্রাহামের দিকে। তারপর, ছেড়ে দিল ওকে। এদিকে মিতা স্বস্তি পেলো। কারণ, এ্যাডাম যতটা না ভদ্র তারচেয়ে বেশি ডেঞ্জারাস হচ্ছে মি. A হিসেবে।
— তুমি ঠিক আছো মিতা? এই লুজারটা তোমাকে কিডন্যাপ করেছে না? সত্যি করে বলো আমাকে?
আব্রাহাম মিতার দুগালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে। এদিকে সায়মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আর এ্যাডাম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— তুই এত ডেস্পারেট হচ্ছিস কেন? মিতাকে খালি স্পর্শ করার ধান্দায় থাকিস নাকি?
ছাড় ওকে। নয়ত তোর হাতদুটো আমি..
এ্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগে মিতা আব্রাহামের হাত সরিয়ে দিলো। তারপর নিজের কানের পেছনে চুলগুলো গুছিয়ে রাখল। আব্রাহাম অবাক হয়ে বলল,
— তুমি কি আমার এত অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারছো না মিতা?
মিতা অসহায় হয়ে তাকালো। এদিকে সায়মা আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে ভাবছে যে, আব্রাহাম আসলে কি চাইছে?
— উত্তর আগেও দিয়েছি। এখনও দিচ্ছি। তোমাকে কেন আরও কাউকে আমি ভালোবাসতে পারব না আব্রাহাম। আদনানকে ভালোবেসে আমি ক্লান্ত।
— কিন্তু?
— ভালোবাসা কি জোরপূর্বক হয়? ভালোবাসা সবসময় একপাক্ষিক বিষয়। একটা সম্পর্কে দুটো মানুষ একই পরিমানে ভালোবাসতে পারে না। কমবেশি হয় দুজনের ভালোবাসায়। তুমি আমাকে ভালোবেসেছো এটা তোমার একপাক্ষিক বিষয় আব্রাহাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি না। এটাও আমার একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত।
মিতার কথা শেষ হওয়ার পর এ্যাডাম হাতে তালি বাজালো। সায়মা, মিতা এবং আব্রাহাম বিরক্তি নিয়ে বলল,
— কোন খুশিতে হাতে তালি বাজাচ্ছ?
— আব্রাহাম রিজেক্ট হইছে সেই খুশিতে।
উত্তরটা দিয়ে এ্যাডাম মিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মিতার ঘাড়ে এক হাত রেখে সামনে টানল। তারপর, কপালে দীর্ঘ এক চুমু খেলো। মিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আকস্মিক ঘটনায় আব্রাহাম এবং সায়মা হতবাক। বিদেশির ছাওয়াল কামডা করছে কি? বলেই নাক সিটকালো সায়মা।
মিতার কাছ থেকে সরে এলো এ্যাডাম। মিতা হাত দিয়ে কপাল মুছতে যাবে। এমনসময় এ্যাডাম মিতার হাত ধরে বলল,
— ডোন্ট ডু দিস মেরিজান। আমি ভীষণ কষ্ট পাব। এমনিতেই কষ্ট পাঁচ্ছি কারণ আজ থেকে আবারও তোমাকে ছাড়া আমাকে থাকতে হবে।
মিতা কিছুই বলতে পারল না এ্যাডামকে। অথচ এই একই কাজ আব্রাহাম করলে ওকে যে কি করত?
— আব্রাহাম, আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে ফার্স্ট এন্ড লাস্ট টাইম ওয়ার্নিং দিচ্ছি তোকে। মিতাকে নিয়ে কোনো নোংরা খেলার চেষ্টা করবি না। মিতা যে কার তুই তো চিনিস না তাকে । অবশ্য তোর জানার কথাও না। যদি কিছু করার চেষ্টা করিস তো মনে রাখিস সেদিন তোর জানাজা হবে তবে লোকজন ছাড়া। কবর হবে তোর। কিন্তু মাটি তোকে তার গর্ভে জায়গা দেবে না। তোর অস্তিত্ব এমনভাবে মুছে যাবে যে প্রকৃতিও তোকে খুঁজে পাবে না।
কথাগুলো বলেই আব্রাহামের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিতার দিকে ফিরল এ্যাডাম।
–আমি চলি। মিতা আই লাভ ইউ মেরিজান। সি ইউ ছুন। কোনো সমস্যা ফিল করলে কল করবে আমায় এনিটাইম। তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি সবসময়৷
এ্যাডাম চলে গেল। আব্রাহাম রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এ্যাডামের সঙ্গে ওর অনেক বোঝাপড়া আছে। সেদিন এত মার খেল ওর হাতে। আর আজ কথার খই ফুটছে? এত সাহস হুট করে পেলো কোত্থেকে?
সায়মা মিতার কাঁধে হাত রেখে বলল,
— কি হয়েছে তোমার সঙ্গে বিগত দিনগুলোতে? আমাকে নিঃসংকোচে বলতে পারো মিতা।
— কিছুই হয়নি আবার অনেক কিছুই হয়েছে সায়মা। আমি এখন দোটানায় আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় যা দেখছি তা কি সত্যি? নাকি চোখে দেখার অন্তরালে আরও কিছু দেখা বাকি আমার?
— তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না?
সায়মা বোকার মত তাকিয়ে আছে। মিতা সায়মার হাতদুটো ধরে অনুরোধের সুরে বলল,
— বাংলাদেশে ফিরে যাব আমি সায়মা। আমার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।
— কিন্তু, আব্রাহাম ?
— কাউকে কিছু বলবে না। কেবল আমার বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার এখনও অনেক কিছু জানার বাকি আছে।
“চলবে”
#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
[১৮+সর্তকতা🚫ভায়োলেন্স, অতিরিক্ত সা’ইকো, থ্রিলিং- মা’র্ডার সমস্ত পরিস্থিতি মেনে চলতে পারবেন এবং গল্পের স্বার্থে অবাঞ্চিত দিক, কথাবার্তা ও খু*না*খুনির বর্ণনা থাকবে তারাই আজকের পার্টটি পরবেন।]
১৮….
মস্কোর আগস্টের ভোরের সোনালি আলো কুয়াশার আড়ালে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে।
আকাশের সাদা রঙ, হালকা ধূসর রঙের মেঘের ভেলা প্রথম সূর্যের কিরণগুলো সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
শহরের পুরনো ছাদ ও নদীর জলরাশিতে
শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে,
গাছের পাতা শিশিরকে নাচিয়ে হেলেদুলে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে।
শিশিরে ভেজা পাতার ঝিকিমিকি,
দূরের পাখির কণ্ঠ।
সব মিলিয়ে যেন এক মৃদু সুর বানিয়েছে,
মিতার জন্য নতুন ভোরের কাব্য।
মিতা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখে এখনও আদনানের স্মৃতি ভাসছে। মনে হচ্ছে সেই হারানো দিনগুলো যদি ফিরে আসত! প্রতিটি নিশ্বাসে সে অনুভব করছে ভবিষ্যতের অজানা পথ,
যেখানে নিজেকে আবার খুঁজে পাবে,
বাংলাদেশের দিগন্তের দিকে অদৃশ্য যাত্রা,
যেখানে সে নিজেকে নতুনভাবে রচনা করবে।
মিতা মনে মনে ভাবছে, কতটা চেনা পথে সে আবার নিজেকে ফিরে পাবে, কতটা স্মৃতি ও নতুন আশার মধ্যে সমুদ্র পার হবে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। চোখে শান্তি আর কানে হালকা বাতাসের গুনগুন। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেন আজকের ভোর তার জন্য নতুন অধ্যায় খুলছে।
সায়মা পাশে দাঁড়িয়ে, নীরবভাবে অপেক্ষা করছিল মিতার ভাবনার দেশ থেকে ফেরার। মিতা সায়মার উপস্থিতি টের পেতেই সায়মা মৃদু হেসে বলল,
— আজ রাত নয়টায় ফ্লাইট।
মিতার চোখ বন্ধ হলো এক মুহূর্তের জন্য। ভেতরের চাপ, হাহাকার, এবং বিদায়ের উত্তেজনা মিলেমিশে কেবল এক নিঃশ্বাসে বের হলো। তারপর চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে বলল,
— তাহলে প্রস্তুতি শুরু করি?
শহরের আলো ক্রমশ বেড়ে উঠছে, আর ভোরের কুয়াশা মৃদু ঢেকে দিচ্ছে মিতার পেছনের পথ। শূন্যতা আর স্মৃতির মাঝেই জন্ম নিল নতুন এক অধ্যায়।
মিতার পুরো দিনটা ব্যস্ততা আর পরিকল্পনার মধ্যে কেটে গেল। ফ্লাইটের প্রস্তুতি, ব্যাগ প্যাক করা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব মিলিয়ে একরাশ উত্তেজনা। সায়মা পাশে থেকে সহায়তা করছে, প্রতিটা ছোট ছোট কাজ ঘুরে দেখছে যেন কিছু বাদ না থাকে। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সে, শুধু মিতার জন্য।
মিতা হসপিটাল থেকেও তিন মাসের ছুটি নিয়েছে, নামে মাত্র। বাস্তবে সে জানে, এই ছুটি শেষ হওয়ার পর হয়ত আর রাশিয়ায় ফিরে আসবে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিজের জীবনের এই অধ্যায়কে আলাদা করে নতুন দিকে এগিয়ে নেওয়ার।
বাড়িতে চারপাশে সবকিছু শান্ত। তিন মাসের ছুটি, এই নির্জন প্রস্তুতি, যেন একটি দীর্ঘ যাত্রার শুরু। আর সায়মার সহায়তায় মিতা প্রতিটি মুহূর্ত যেন নিখুঁতভাবে শেষ করতে চাচ্ছে, যেন বিদায়ের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।
পৃথিবীর বুকে যখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আড়াল নেমে আসছে, তখন সায়মা মিতার সঙ্গে গাড়িতে উঠে রওনা হলো। রাস্তায় হালকা বাতাসে আগাছার ঘ্রাণ মিশে আছে, রাস্তার বাতির আলোয়ে অন্ধকার ছন্ন শহর ঝলমল করছে।
সায়মার মনে অদ্ভুত এক ভয় কাজ করছে। হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। ভাবছে
—আব্রাহাম বা এ্যাডাম যদি জানে মিতার চলে যাওয়ার পরিকল্পনা, তখন কী হবে? সবকিছু এক মুহূর্তেই উল্টো হয়ে যেতে পারে।
সায়মা মনে মনে প্রার্থনা করছে
—সব ঠিকঠাক হবে, কেউ আমাদের পথচলায় বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না।
এয়ারপোর্টের বিশাল লবি ঘরে মানুষের চাপ আর ব্যস্ততার মধ্যেও সায়মার চোখ শুধু মিতার দিকে।
মিতা লাগেজ হাতে, স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে একরাশ দুঃখের ছাপ। মনে পড়ছে ছয় বছর আগের সেই দিনের কথা, যেদিন প্রথম পা রেখেছিল রাশিয়ার মাটিতে। তখনও সায়মা ঠিক এই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।
সায়মা হাত বাড়িয়ে মিতার হাতে হাত রাখে ; নিঃশব্দে, কোনো শব্দ ছাড়াই। এই স্পর্শে মনে হচ্ছে ছয় বছরের সব স্মৃতি, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা এক সঙ্গে ফিরে এসেছে।
মিতা ফিসফিসিয়ে বলল
— আজ সত্যিই… আমি চলে যাচ্ছি।
সায়মার চোখে জল জমে আসে, কিন্তু সে লাজুকভাবে মাথা নত করে শুধু। মনে মনে বলল,
— তোমার ফিরে যাওয়া উচিত মিতা। তুমি জানো না তুমি কোন গোলকধাঁধায় আঁটকে গেছো? না তুমি এই গোলকধাঁধা থেকে মু্ক্তি পাবে? আর না তুমি সমাধান করতে পারবে এই গোলকধাঁধা? তাই পালিয়ে বাঁচো।
flight call ঘোষণার সাউন্ড বেজে ওঠে। বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে।
সায়মা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে মিতাকে বলল
— মিতা, তুমি যেখানেই থাকো, আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে। তুমি যখন আমার পাশে ছিলে, আমি শিখেছি সাহস আর ধৈর্যের মানে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা যায় কি করে? জীবনকে আরও একবার সাজিয়ে দেখো। খুব সুখী হবে তুমি।
মিতা একটা সামান্য হাসি দিল, চোখে জল জমে গেল। লাগেজ আরও শক্ত করে ধরল।
সায়মা চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে, মনে মনে প্রার্থনা করল
—ইনশাআল্লাহ, মিতা নিরাপদে পৌঁছাবে। আর তার হৃদয় শান্তি পাবে।
এয়ারপোর্টের আলোয় দুজনের ছায়া মিলিত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো। departure board-এর লাল আলোতে flight-এর নাম ঝলমল করছে। বিদায়ের সময় এসেছে। মিতা এক গভীর শ্বাস নিয়ে লাগেজ হাতে তুলে, সায়মার হাতে হাত রেখে বলল
— বিদায়, সায়মা। ভালো থেকো।
সায়মার চোখে জল ভরে উঠল । সে শুধু মাথা নত করে হাত দুলিয়ে বিদায় জানালো। মিতা flight gate-এর দিকে এগোচ্ছিল।
_______________
সায়মা এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে বাড়িতে ঢুকতেই আব্রাহামকে দেখতে পেল। সে সোফায় বসে ফোনে মগ্ন। খানিকটা অবাক হয়ে সায়মা ফিসফিস করে বলল,
— আব্রাহাম, তুমি এখানে?
আব্রাহাম ফোন রাখল এবং মৃদু হেসে বলল,
— হ্যাঁ, কাজের শেষের পরে কিছু নোট দেখতে বসেছিলাম। তুমি?
সায়মা হাঁটা থামিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল, মনে মনে চিন্তা করল
— কেন যেন আজকে আব্রাহামকে অন্যরকম লাগছে! মিতার চলে যাওয়ার খবর যদি সে জানতে পারে?
আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে সায়মা হালকা হাসি দিল, ভেতরে নিজের কণ্ঠে সতর্ক করল
— সত্য আড়ালে রাখ। আব্রাহাম যেন কিছু জানতে না পারে।
ঘরের মধ্যে অদৃশ্য একটা নিঃশব্দ উত্তেজনা চলছে। সায়মা জানে, মিতার নিরাপত্তা, পরিকল্পনা সব কিছু এখন তার হাতে। তাই সামান্য ভুল করাটা অনেক বোকামি হতে পারে।
সায়মা হাতের ব্যাগ সোফায় রেখে রুমের দিকে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ আব্রাহামের কণ্ঠ ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো
— সায়মা, এক মিনিট!
সায়মা থমকে দাঁড়াল। আব্রাহামের চোখে অস্পষ্ট উদ্বেগ। যেন কিছু বলার আছে কিন্তু বলতে পারছে না। সায়মা ধীরে ধীরে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল
— হ্যাঁ? কী হয়েছে?
আব্রাহাম কিছুক্ষণ নীরব থাকল, তারপর ঠোঁটের কোন এক হাসি আনল।
— কিছু না… শুধু ভাবলাম, তুমি কি ঠিক আছো? মিতাকে দেখছি না যে?
সায়মা ভেতরটা কেঁপে উঠল। মনের মধ্যে সতর্কতা কাজ করল
—এখন কিছু বললে বিপদ হবে। নীরব থাকতে হবে।
তাই সায়মা শান্ত এবং নরম সুরে জবাব দেয়।
— হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। চিন্তা করার কিছু নেই। মিতার আজ নাইট শিফট। সকালে ফিরে আসবে।
আব্রাহাম আবারও হালকা মাথা নেড়ে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। ঘরের মধ্যে আবার নীরবতা নেমে এলো।
আব্রাহামের চোখে অস্বস্তির ছায়া ভেসে উঠল। কণ্ঠে হালকা জোর দিয়ে বলল,
— তোমার কাছে সব ঠিক থাকলেও, আমি কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছি না । মিতা আজ হসপিটাল যায়নি। তারচেয়েও বড় কথা মিতা তিন মাসের লিভ নিয়েছে কেন?
সায়মার এবার ভয়ের সঙ্গে আতংক বেড়ে যায়। আব্রাহামের চোখে তখন আর কোনো পরিচিত মায়া নেই, মুখের ভদ্রতার আড়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে অমানুষিক রূপ। সে গর্জে উঠল,
— তুই সাহস পেলি কই থেকে? মিতাকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে পারলি কেমনে?
তার আঙুলগুলো সায়মার গলায় শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। সায়মার বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাস আটকে আসছে। চোখ লালচে হয়ে উঠছে, কপালের শিরাগুলো টনটন করছে।
সায়মা দু’হাত দিয়ে মরিয়া হয়ে আব্রাহামের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। শরীরটা এদিক-ওদিক ছটফট করছে, কিন্তু আব্রাহামের হাত যেন লোহার মতন শক্ত। গলার ভেতর থেকে শুধু কর্কশ শ্বাসরুদ্ধ শব্দ বের হচ্ছে।
মুহূর্তের মধ্যে ঘরের সময় যেন জমে গেছে।আব্রাহামের মুখ থেকে সব ভালো সেজে থাকার মুখোশ খুলে গিয়ে, প্রকাশ পেয়েছে আসল নিষ্ঠুর মুখ।
আব্রাহাম এক মুহূর্তের জন্য যেন থমকে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ ক্ষিপ্রতায় আবার তেতে উঠল। সায়মাকে ছেড়ে দেওয়ার পর আব্রাহামের দম নিতে যেন কষ্ট হচ্ছিল, বুক ওঠানামা করছে প্রচণ্ড রাগে। সে ঘরের এক কোণা থেকে আরেক কোণায় পায়চারি করছে পাগলের মত। চোখে রক্তিম আভা, দাঁত কিঁচিয়ে ফিসফিস করছে
— আমাকে ফাঁকি দিবি? আমাকে বোকা বানাবি?
হঠাৎই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে সায়মার দিকে এগিয়ে এল। সায়মা তখনো গলা চেপে ধরে কাশছে, নিঃশ্বাস ঠিকমতো নিতে পারছে না। ঠিক সেই সময় আব্রাহাম পাগলের মত পা তুলল, আর এক ঝটকায় সায়মার বুক বরাবর লাথি বসাল।
সায়মা ব্যথায় ককিয়ে উঠল, শরীরটা সোফার ওপর ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। বুকের ভেতর আগুনের মত ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাস যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের কোনে পানি জমে উঠেছে কষ্টে আর অপমানে।
আব্রাহাম ততক্ষণে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে, চুল এলোমেলো, চোখদুটো শিকারির মতন জ্বলছে।
সায়মা মেঝেতে পড়ে ছটফট করছে। বুকের ভেতর ব্যথায় দম আটকে আসছে। আব্রাহামের চোখে তখন আর মানুষ নেই।নির্মম দানবের ছায়া। পায়চারি থামিয়ে সে হঠাৎ নিচু হয়ে সায়মার চুল মুঠি করে টেনে ধরল।
— তোকে আমি মাফ করব ভেবেছিস? আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বেঁচে থাকবি?
সায়মা অসহায়ভাবে কেঁদে উঠল। গলা শুকিয়ে গেছে, কোনো শব্দ বেরোতে চাইছে না। হাত দুটো আব্রাহামের শক্ত মুঠি থেকে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বৃথা।
হঠাৎ আব্রাহাম সায়মার মাথাটা জোরে মেঝেতে ঠুকতে লাগল। ঠাস! ঠাস! ঠাস! প্রতিবার ধাক্কায় সায়মার কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, শরীর দুর্বল হয়ে আসছে।
কিন্তু আব্রাহাম থামল না। বরং আরও ভয়ানক হয়ে উঠল। এবার সে দু’হাত দিয়ে সায়মার গলা চেপে ধরল। সায়মার পা দুটো ছটফট করছে, শ্বাসের জন্য বুকটা হাহাকার করছে। কণ্ঠনালী থেকে শুধু করুণ এক গরগর শব্দ বেরোচ্ছে।
কিছুক্ষণের ভেতর হাত-পা স্থির হয়ে এল। চোখের মণি নিস্তেজ হয়ে গেল। ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, যেন শেষ নিঃশ্বাসে কিছু বলতে চেয়েছিল! কিন্তু পারল না।
আব্রাহাম তখনো গলার ওপর হাত চেপে ধরে আছে, যতক্ষণ না সায়মার শরীর নিথর হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে হাত ছেড়ে দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে তাকাল নিজের কাজের দিকে। তার ঠোঁটে এক ভয়ংকর তৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠল ।
মেঝেতে নিথর সায়মার দেহ পড়ে রইল।রক্তে ভিজে, দমবন্ধ এক করুণ মৃত্যুর নিদর্শন হয়ে।
আব্রাহাম সায়মার নিথর দেহের পাশে বসে পাগলের মতো হাঁপাচ্ছিল। একসময় ঠান্ডা স্বরে ফিসফিস করে বলল
— এটাই তো প্রাপ্য ছিল তোর। বিশ্বাসঘাতকের কোনো জায়গা নেই আমার পৃথিবীতে।
মেঝেতে রক্তের দাগ ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। সেই দাগ যেন আব্রাহামের চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার মুখে ভেসে উঠল ভয়ের ছাপ।
“যদি এ্যাডাম জেনে যায়? যদি মিতা জানে সায়মার কী হয়েছে?”
তার ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। রক্তমাখা মেঝের দিকে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে গেল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।নাহলে তার মুখোশ খুলে পড়তে একটুও দেরি হবে না।
অন্যদিকে, দূরে তখন মিতার ফ্লাইট আকাশে উড়ছে। জানালার কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে সে তাকিয়ে আছে অন্ধকার রাতের দিকে। তার মনে শুধু একটাই ভাবনা
–আমি কি সত্যিই নিরাপদে ফিরতে পারব? আমার অতীত কি আমাকে ছেড়ে দেবে?
মিতা জানে না, তার ঠিক পেছনে কত বড় এক অন্ধকার ফেলে এসেছে সে।
এদিকে এ্যাডাম হঠাৎই সায়মার ফোনে কল দিল। বারবার রিং হতে লাগল, কিন্তু কেউ ধরল না। অস্থির হয়ে উঠল সে। কয়েক ঘণ্টা আগেই মিতার কোনো খোঁজ না পেয়ে সে সায়মার ওপর নির্ভর করছিল। আর এখন সায়মারও কোনো সাড়া নেই।
কিছু একটা ঘটছে নিশ্চয়ই! এ্যাডামের ভেতর থেকে কেউ ভয়ানক এক অশনি সংকেত দিচ্ছে।
“চলবে”