#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
২৩…
ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিতার সামনে এসে থামল। মুহূর্তটুকু এতটাই গুমোট যে নিস্তব্ধতা ভেঙে নিজের হৃদস্পন্দনও মিতার কানে বজ্রধ্বনির মতো লাগছিল।
হঠাৎ ছায়ামূর্তি মিতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। এই অপ্রত্যাশিত ভঙ্গি মিতার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।সে আতঙ্কে পেছনে সরে গেল, শিকলে বাঁধা পা যেন ইস্পাতের বাঁধনের মতো মেঝেতে ঠেকে ঝনঝন শব্দ তুলল।
ছায়ামূর্তি থামল না। মুখের অর্ধেকটা ছায়ায় ঢাকা। ঠোঁটের কোণে ভয়ঙ্কর মুচকি হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসি নিঃশব্দে যেন মিতাকে বলল
—তুমি পালাতে পারবে না।
ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এলো, মিতার চারপাশের বাতাসকে গ্রাস করতে করতে। মিতার দম আটকে গেল, সে ঠেকাতে চাইলো, কিন্তু শিকলে বাঁধা দেহের মাঝে প্রতিরোধের শক্তি নেই।
ছায়ামূর্তি একদম কাছে এসে মিতার শরীর ঘেঁষে বসল। কক্ষের অন্ধকার হঠাৎ আরও গাঢ় হয়ে উঠল, যেন সমুদ্রের গভীর থেকে কোনো রহস্য ভেসে উঠছে।
মিতার শরীর শীতল হয়ে উঠল, তার মন জেগে উঠল আতঙ্ক আর কৌতূহল।
—এই ছায়ামূর্তি আসলে কে? কেন তার এতকাছে? আর কেনইবা এই ভয়ঙ্কর নৈকট্যে অদ্ভুত এক অচেনা পরিচয়ের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে?
অচেনা মানুষটির নিঃশ্বাস মিতার কানের কাছে এসে থেমে থাকল। শিকলের ঝনঝন শব্দ যেন সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত সিম্ফনি বাজাচ্ছে।
মিতার চোখ স্থির, ভয়ে তার মণি প্রসারিত।
ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তি ফিসফিস করে বলল,
—ভেবেছিলে মৃতেরা কবরেই ঘুমায়? না, মিতা। কিছু মৃতরা আবার হাঁটতে শুরু করে।
কথাগুলো মিতার শিরায় শিরায় ঠাণ্ডা বিষের মতো প্রবাহিত হলো।
ছায়ামূর্তির হাত ধীরে ধীরে মেঝেতে পরে থাকা শিকলকে স্পর্শ করল। ঠাণ্ডা লোহা বেজে উঠল, আর সেই শব্দ যেন শূন্য ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো, এক অশুভ সংকেতের মতো।
মিতার ঠোঁট শুকিয়ে এল, সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করতে চাইলো
—আপনি কে?
ছায়ামূর্তি হঠাৎ ধীরে ধীরে হুড টেনে নামাল। অন্ধকার ঘরে ম্লান আলো তার মুখে পড়তেই মিতা নিঃশ্বাস আটকে ফেলল।
চোখ দুটো অস্বাভাবিক গভীর। কৃষ্ণসমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কালো, আর সেই চোখের ভেতরে যেন জমে আছে বহু বছরের দগ্ধ ক্ষত আর লুকোনো রহস্য। মুখে হালকা দাড়ি, ঠোঁটের কোণে লেগে আছে অস্বস্তিকর হাসি।
মিতার বুক কেঁপে উঠল
এই মুখটা সে কোথাও দেখেছে! হয়ত পুরনো কোনো ছবি, হয়ত অতীতের ধূসর কোনো স্মৃতি। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারল না।
ছায়ামূর্তি মিতার দিকে ঝুঁকে এল। মাটিতে বসা অবস্থাতেও তার উপস্থিতি যেন ভয়ঙ্করভাবে প্রবল।
—চেনার চেষ্টা করো না এখনই। তোমার ভয়কে আমি উপভোগ করতে চাই। সময় হলে সব বলব।
সে মুচকি হাসল। আলোতে হঠাৎ চোখের কোণে একটা দাগ দেখা গেল। পুরোনো কোনো ক্ষতের চিহ্ন।
মিতার শরীর কাঁপতে লাগল, কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন ঘুরতে লাগল
—কে এই মানুষ? কেন তার মুখ এতটা পরিচিত লাগছে?
লোকটা নিচু স্বরে বলল,
—আমাকে খুঁজছিলে তো? বহু জায়গায়,বহু মানুষের ভিড়ে। অথচ আমি নিজেই এখন তোমার কাছে ধরা দিয়েছি
মিতা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল,
—কে… কে আপনি?
—আমার নাম হানিফ। ডা. হানিফ।
মিতার ঠোঁট শুকিয়ে গেল। বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় যেন সত্য হয়ে আঘাত করল তার মস্তিষ্কে।
হানিফ ধীরে ধীরে মিতার শিকলের কাছে হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু তালা খুলল না। বরং তালায় আঙুল ঘষে বলল,
—তোমাকে মুক্ত করতে আসিনি। তোমাকে বোঝাতে এসেছি,আদনানের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। সাজানো গোছানো একটা মৃত্যুর আয়োজন ছিল মাত্র।
মিতার গলা শুকিয়ে গেল। প্রতিটি শব্দ তার কানে তীর হয়ে বিঁধতে লাগল।
ম্লান আলোয় হানিফের মুখটায় যেন চিকিৎসকের শান্ত ভাবনার সঙ্গে লুকানো শিকারীর নিষ্ঠুরতা মিশে আছে।
মিতা ধীরে ধীরে পিছু হটল, শিকলের টানায় তার গোড়ালি ঠেকল ঠান্ডা লোহার মেঝেতে। তবুও সে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
—আপনি, আপনি আদনানের ডাক্তার, তাই না? কেন? কেন আমাকে এখানে এনেছেন? আদনানের সঙ্গে কি করেছেন আপনি?
হানিফ মুচকি হেসে একটুখানি ঝুঁকল।
—ডা. মিতা, তুমি সত্য খুঁজছ আমার কাছে। আদনানের অস্তিত্ব নিয়ে আমি কিছু বলব না। তবে মনে রেখ মৃত্যুর রহস্য কখনো কাগজে লেখা থাকে না। লাশের ভেতরে, রক্তের ভেতরে, শিরার ভেতরে লুকিয়ে থাকে।
তার চোখে এক ধরণের পাগলামি ছিল, যেন বিজ্ঞান আর পাগলামির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ।
—- তোমার পালানোর পথ নেই। তুমি এখন অবস্থান করছো কৃষ্ণ সমুদ্রে। ইংরেজিতে উচ্চারণ করলে হবে Black Sea। কখনো নাম শুনেছো তো?
মিতা আতঙ্কিত হলো। কখন হল এত কিছু? সে টের পায়নি কেন? মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় আছে এখান থেকে মুক্ত হবার?
সমুদ্র অন্ধকার বিরাজ করছে, ঢেউয়ের শব্দ। মিতার চোখ বন্ধ, শরীর শিকলে আবদ্ধ। হানিফ চলে গেছে। মিতা হঠাৎ জাহাজের কাঠের তলার নিচ থেকে এক অদ্ভুত কম্পন অনুভব করল।
ধীরে ধীরে মিতাদের জাহাজটির পেছনে ছায়ার মত আরেকটি জাহাজে পিছু নিতে শুরু করল। বাতাসের সঙ্গে ঢেউয়ের আছড়ে পড়া শব্দ মিশে ভয়ংকর দৃশ্য সৃষ্টি করছে।
মিতার হৃদয় দ্রুত ধক ধক করছে। শিকলের হাতকড়ি যেন আরও শক্ত হয়ে ধরছে তার হাত। দূরে অন্য জাহাজের নেভিগেশন লাইট হালকা ঝলমল করছে।যেমন মৃত্যুর ছায়া আসছে ধীরে ধীরে।
অন্য জাহাজটি তাদের গতিপথে অনমনীয়, আর সমুদ্রের ঢেউয়ে এক অদ্ভুত ছন্দে তাদের পিছনে পিছনে এগোচ্ছে। হঠাৎ, মিতার দেহে শীতল বাতাস লাগল, মনে হল কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিতার চোখ যখন খুলল, দূরের জাহাজের লাল নেভিগেশন লাইট দেখতে পেল। প্রতিটি ঢেউয়ের সাথে মনে হচ্ছে জাহাজটি আরও কাছে আসছে।
ক্যাপ্টেনের এনাউন্সমেন্ট শোনা যাচ্ছে
— সবাই স্থির থাকুন! কেউও অযথা ছুটাছুটি করবেন না! একমাত্র জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আমি নির্দেশ দিচ্ছি।
ক্যাপ্টেন, নিজের চোখে ঝুঁকি ও সমুদ্রের অদ্ভুত গতিবেগ দেখছে, সতর্কতার বার্তা দিচ্ছে।যেন প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে খেলছে জীবন ও মৃত্যু।
ক্যাপ্টেনের মুখে চিৎকার উঠার আগেই
বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল, জাহাজের পাশ দিয়ে ভেসে আসা আরেকটি জাহাজের ধ্বনি। মিতাদের জাহাজ কেঁপে উঠল। বাইরে, সমুদ্রের বুকে, একটি অচেনা জাহাজ হঠাৎ তাদের পাশে এসে ঘেঁষে চলে।
ক্যাপ্টেন আবারও চেষ্টা করল সতর্ক করার
–সবাই! সাবধান! কেউ…..
কিন্তু হঠাৎ, আচমকা হামলা হলো। লণ্ঠন আলো ফাটিয়ে ছড়ালো, ঢেউ ছুটে আসছে যেন আগুনের মতো। জাহাজের কড়া কাঠ চূর্ণ হওয়ার মতো কেঁপে উঠল।
সমুদ্রের হিমেল বাতাসের গর্জন আর ধ্বংসাত্মক ধ্বনি একাকার হয়ে এক ভয়ংকর সূর সৃষ্টি করছে।
সমুদ্রের ঢেউ ক্রমশ আক্রমণাত্মক। মিতাদের জাহাজ কেঁপে উঠছে, আর সমুদ্রের বুকে চলা সেই দ্বিতীয় জাহাজ থেকে দস্যুবাহিনী ধীরে ধীরে জাহাজের ধারে উঠে আসে। ছোট নৌকা বা হুক ব্যবহার করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এক রক্তিম দৃশ্য তৈরি হলো জাহাজে। যাকে দেখছে তাকেই হত্যা করেছে তারা। ধোঁয়া, ধুলা, রক্তের গন্ধ সব মিলিয়ে জাহাজের বায়ুমণ্ডল যেন কোনো রণক্ষেত্রের ময়দান।
ক্যাপ্টেন তখন কন্ট্রোল রুমে। তার চোখে আতঙ্ক, কিন্তু সে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য। জাহাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। কোনো কথা বলার আগেই, দস্যুরা কক্ষের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে।
জাহাজের ঢেউয়ের সঙ্গে ধাক্কা খায়, বিকট শব্দ হয়। মিতা চিৎকার করে , কিন্তু গলা শুকিয়ে গেছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক ছায়ামূর্তি, অচেনা মুখমণ্ডল, কালো পোশাক।
জাহাজের ক্যাপ্টেন কন্ট্রোল রুমে চিৎকার করছে, রেডিওর মাধ্যমে সাহায্য চাইছে, কিন্তু দস্যুরা তাকে ঘিরে ফেলেছে। বাইরে ঢেউয়ের শব্দে আর চিৎকারে সব মিশে যাচ্ছে।
মিতা তখনো জানে না জাহাজে কি হচ্ছিল? কিছুক্ষণ পরে হুট করে দরজা খুলে গেল। মিতা ভেবেছে ডা. হানিফ এসেছে কিন্তু না এসেছে অন্যজন। মিতা ভয় পেয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে যায়।
দস্যুরা মিতার দিকে এগোয়, মিতাকে বন্দি করে। হঠাৎ চরম ভয়মিশ্রিত অন্ধকারে তার চোখে ধরা দেয় লোহার হাতকড়ি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে সমুদ্রের লালিমায় ভেসে ওঠে তার জীবনের ভয়ংকর অনিশ্চয়তা।
মিতাকে অজ্ঞান অবস্থায় দস্যুবাহিনী তার শরীর শক্তভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল দ্বিতীয় জাহাজে। সমুদ্রের ঢেউ-এর ছন্দে জাহাজের গতি তীব্র, বাতাস ঠাণ্ডা। মিতার চেতনাশূন্য দেহে প্রতিটি ঢেউ-এর দোলা লাগছিল, কিন্তু সে কিছুই উপলব্ধি করতে পারছিল না।
“চলবে”
#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
২৪….
রাতের নীলচে আঁধারে দুলছিল জাহাজ। দূরের জলকণা আছড়ে পড়ছে ধাতব জাহাজে, যেনো নিঃশব্দে কেউ বাজাচ্ছে মৃত্যুর ড্রামসেট। মিতা তখনো অচেতনতার ঘোরে আধা চোখ খোলা রেখে বুঝতে পারছে না, সে কি জেগে আছে নাকি অজানা দুঃস্বপ্নের ভেতরে আটকে আছে।
চোখ খুলতেই বুঝল, চারদিকে সমুদ্রের গর্জন। ঘরটা আর আগের মতো নয়, কাঠের গন্ধে ভরা এক নতুন কক্ষে বাঁধা সে। শিকল এখনো তার পায়ে। জাহাজের দুলুনি যেন তাকে ক্রমাগত মনে করাচ্ছে, পৃথিবী এখানে থেমে নেই। সে চলছে, ভেসে যাচ্ছে অজানা নিয়তির দিকে।
জাহাজের বাইরে ভেসে আসছিল মানুষের চিৎকার, ধাতব অস্ত্রের ঠোকাঠুকির শব্দ। দস্যুদের কর্কশ হাসি ভেদ করে ভেসে আসছিল ঢেউয়ের গর্জন। মিতা ভয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে রাখল নিজেকে। বুকের ভেতর শ্বাস যেন খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ফাঁপরে উঠছে।
হঠাৎ দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে পড়ল এক অচেনা ছায়ামূর্তি। মুখ অর্ধেক ঢাকা, হাতে ঝকঝকে ছুরি, শরীরে সামুদ্রিক লুটেরাদের কালো পোশাক। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে।
মিতা ভেবেছিল ডা. হানিফ হয়তো তাকে নিতে এসেছে। কিন্তু না এ তো অন্যজন। দস্যুদের একজন।
মুহূর্তেই এক ঝটকায় মিতাকে জোর করে ধরে ফেলল। মিতা চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু গলার স্বর ঢেউয়ের গর্জনে হারিয়ে গেল। পরক্ষণেই অন্ধকার ছাপিয়ে গেল তার চোখের দৃষ্টি।
দস্যুবাহিনীর গর্জন, রক্তমাখা চিৎকার থেকে মিতাকে হঠাৎ ছিঁড়ে বের করে আনা হলো। অচেনা হাতে বন্দি মিতা । মিতার চোখে বিস্ময়, বুকের ভেতর ভয়। পা দুটো বাধ্য হলো হাঁটতে।
অন্ধকার করিডর পেরিয়ে মিতাকে নিয়ে যাওয়া হলো এক অচেনা কক্ষে। সেখানে অপেক্ষা করছিল এক নারী।শ্বেতকায়, তীক্ষ্ণ নীল চোখ, গ্রীক ভাস্কর্যের মতো কঠোর গড়ন অথচ সুন্দর মুখ। তার আঙুলে সোনার আংটি, গলায় মুক্তোর মালা ঝলমল করছে।
নারীটি মিতার দিকে এগিয়ে এলো, রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতার দিকে । মিতার শিকল খুলে দিলো। তারপর ইশারায় কাউকে ডাকল মিতাকে গোসল করানোর জন্য। মিতাকে গোসল করালো। জল ঢালার শব্দ যেন হাজার বছরের পাপ ধুয়ে দেওয়ার মতো শোনাল, কিন্তু মিতার অন্তর ততক্ষণে অজানা আশংকায় ভারী হয়ে উঠল।
এরপর সেই নারী মিতার গায়ে পরিয়ে দিলো এক রাজকীয় গাউন। মখমলের মতো নরম, গাঢ় লাল রঙের, যেন রক্তের প্রতীক। চুলগুলো সযত্নে বেঁধে দিলো, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপিস্টিক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিতা নিজেকে চিনতেই পারল না।
মিতার গলা কেঁপে উঠল।
— আমাকে কি… ভোগ করার জন্য পাঠাচ্ছো তোমাদের জলদস্যু প্রধানের কাছে?
নারীর মুখে নিস্তব্ধ হাসি ফুটে উঠল। কোনো উত্তর সে দেয়নি তবুও তার চোখের কোণে লুকোনো অদ্ভুত ইঙ্গিত টের পেলো মিতা।
মিতা কাঁপা গলায় আবার জিজ্ঞেস করল,
— আমাদের জাহাজের কি হলো? হানিফ নামের মানুষটা কোথায়?
নারীটি এবারও কিছু বলল না। কেবল মিতার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
— চুপ… সময় হলে সব জানতে পারবে।
তারপর দরজা খোলার শব্দ। নারীটি ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। মিতাকে একা রেখে গেল ভীতিকর এক কক্ষে।
মিতার বুকের ভেতর হাহাকার আর একটিই প্রশ্ন
“এবার আমাকে কার হাতে সঁপে দেওয়া হলো?”
মিতার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। দরজা আবারও খোলার শব্দ হলো।
কক্ষে প্রবেশ করল এক অচেনা ছায়ামূর্তি। গায়ের ওপর গাঢ় কালো কোট, মুখ ঢাকা অর্ধেক মুখোশে। ভারী বুটের শব্দ যেন প্রতিটি মুহূর্তে মিতার বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরাচ্ছে।
সে ধীরে ধীরে মিতার দিকে এগিয়ে এলো। প্রতিটি পদক্ষেপে মিতার শরীর কেঁপে উঠল।
মিতার চোখ ভিজে উঠল আতঙ্কে। এত বছর সে নিজেকে রক্ষা করেছে, নিজের সতীত্বকে আগলে রেখেছে। মিতার বুকের ভেতর এক ধরনের বীভৎস ভয় জন্ম নিলো। যদি আজ তার সব শেষ হয়ে যায়?
ছায়ামূর্তি আরও কাছে এলো। ভৌতিক কোনো গল্পের চরিত্রের উপস্থিতি অনুভূত হলো তার উপস্থিতিতে। মিতার দৃষ্টি তখন খুঁজছিল বাঁচার পথ। হঠাৎ নজরে পরল ফলের ঝুড়ির ওপরে রাখা একটি ছোট ছুরি।
মিতা কাঁপা হাতে ছুরির হাতলে আঁকড়ে ধরল।
আর কোনো কিছু ভেবে ওঠার আগেই হিংস্রতা ফুটে উঠল তার চোখে।
—কাছে আসবেন না!
মিতার গলা কাঁপছে। কিন্তু ছায়ামূর্তি থামল না।
এক পা… দুই পা… আরেকটু কাছে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ মিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ছুরির দিয়ে গিয়ে আঘাত করল ছায়ামূর্তির বাহুতে।
রক্ত ছিটকে পড়ল গরম স্রোতের মতো।
ছায়ামূর্তি ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল। হাত দিয়ে বাহু চেপে ধরে অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকাল।
সে দৃষ্টি ভয়েরও না, ঘৃণারও না।
মিতার বুক ধকধক করতে লাগল।
তার হাত কাঁপছে , সামনে একজম পুরুষ দাঁড়িয়ে
যে কি না… অচিরেই মিতার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তার সম্ভ্রম কেড়ে নিতে এসেছে।
মিতার হাতের ছুরিটা কাঁপছে। রক্ত টপ টপ করে ঝরছে মানুষটার বাহু থেকে। ছায়ামূর্তি মুখোশে ঢাকা মুখ লুকিয়ে রেখেছে, কিন্তু চোখ…
হ্যাঁ, সেই চোখ!
মিতার দৃষ্টি আটকে গেল।
মিতার নিশ্বাস আটকে গেল বুকের ভেতর।
এ চোখ তো সে আগেও দেখেছে।
এই চোখের দৃষ্টির কারণেই তো সে এতদিন পাগলের মতো সত্যকে খুঁজে ফিরেছে, এতদিন সব বাধা উপেক্ষা করে পথে পথে ঘুরে চলেছে।
মিতার ঠোঁট কাঁপতে লাগল, চোখ ছলছল করে উঠল।
—তুমি…! তুমি…!
কিন্তু বাকিটা উচ্চারণ করার আগেই তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল আতঙ্ক আর অবিশ্বাসে।
যেন ভাষাহীন বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল কক্ষজুড়ে।
ছায়ামূর্তির ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখার দেখা মিলল।
সে কিছু বলেনি। শুধু রক্তাক্ত বাহু বুকের কাছে চেপে ধরে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল মিতার চোখের গভীরে।
মিতার ভেতর তখন ঝড়।
সে কি সত্যিই মিতার ভাবনার মানুষ? নাকি অন্য কেউ?
আর যদি হয়ও, তবে সে এখানে কেন? দস্যুদের সঙ্গে কেন?
মিতার ভেতর দ্বিধা, তবু পা দুটো যেন নিজের ইচ্ছায় এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।
ধীরে ধীরে, কাঁপতে কাঁপতে লোকটার এসে দাঁড়াল মিতা। দু’জনের মাঝখানে মাঝে কেবল চার আঙুলের গ্যাপ। মিতার হাত উঠল। লোকটার মুখ ঢেকে রাখা কালো কাপড়টা সে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল।
এক মুহূর্তেই হঠাৎ কাপড়টা সরিয়ে নিতেই
চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল সেই মুখ।
মিতার চোখ বিস্ফারিত। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। ঠোঁট থেকে বেরোল নিঃশ্বাসভরা একটা শব্দ
—তুমি…!
লোকটা নীরবে তাকিয়ে রইল মিতার চোখের গভীরে।
একটি শব্দও বলল না।
শুধু নিঃশব্দে, সেই পুরনো পরিচিত দৃষ্টি দিয়ে মিতাকে বিদ্ধ করে রাখল।
মিতার বুকের ভেতর ঢেউয়ের মতো ধাক্কা মারছে একের পর এক অনুভূতি।
ভয়। বিস্ময়। আর আকুলতা।
চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল।
মনে হলো, এতদিন ধরে সে যে উত্তর খুঁজেছে, তা যেন আজ বাস্তবে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মিতার মনে মনে বলছে,
–আল্লাহ, এটা কি সত্যি? এ চোখ আমার চেনা।
এই দৃষ্টিই তো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে অন্ধকারের ভেতর থেকে অন্ধকারে।
এই চোখের কারণে আমি খুঁজেছি সত্যকে।
কিন্তু, যদি এ-ই হয় সেই মানুষ? তবে কি সকল রহস্যের জট খুলবে?
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। হাতের আঙুলগুলো এখনও রক্তের উষ্ণতায় ভিজে আছে।
মিতার মনে হলো, পৃথিবী থেমে গেছে।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কেবল তাকিয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই। কোনো ব্যাখ্যা নেই।
মিতা বহু কষ্টে শুধালো
—“তুমি কি সত্যিই সে ? যাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি?
মিতার কথা শেষ হবার পর সে ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করল।তার কণ্ঠ যেন গাঢ় রাত্রির সুর, যেন এক অদৃশ্য আফিম মেশানো নিশ্বাস,যা হৃদয়কে কাঁপিয়ে দেয়,
—আমায় আঘাত দিলে?
ভেবেছিলে আমি তোমাকে গ্রাস করতে এসেছি?
না মিতা ; আমি এসেছি তোমার হারানো নিশ্বাস হতে।
তুমি জানো না, তোমার প্রতিটি অশ্রু, প্রতিটি নিঃশ্বাসের ওপরে আমার দাবি আছে।
তুমি যদি চাও আমাকে হত্যা করতে পারো,
কিন্তু জেনে রেখো
তুমি যতবার ছুরি চালাবে,
ততবার তোমার ভেতরেই জন্ম নেবে আমার অস্তিত্ব।
লোকটা কাছে ঝুঁকে এল।
তার রক্তমাখা বাহু থেকে ঝরে পড়া লাল বিন্দুগুলো যেন মিতার গাউনের কিনারায় পড়ে নতুন এক রক্তিম নকশা আঁকছে।
মিতার চোখ কাঁপছে। সে ঠোঁটের কোনে কামড়ে ধরে ফিসফিস করে
—তুমি… কে?
লোকটার ঠোঁটে রহস্যময় মুচকি হাসি,
যেন হাজার বছর ধরে জমা রাখা এক অব্যক্ত ভালোবাসা ফুটে উঠল
—আমি সেইজন,
যে প্রতিটি প্রার্থনায়, প্রতিটি শূন্যতায়, প্রতিটি অভিশাপে তোমাকে খুঁজেছি।
আমি সেইজন,
যার নাম তুমি জানো, অথচ বিশ্বাস করোনি।
“চলবে”
[বলুন তো কে হতে পারে?]