#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
২৯…
গাড়ির বহরটা ধীরে ধীরে থামল। বিশাল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাহারাদাররা একসাথে সালাম দিল। গেটের লোহার দরজা শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকতেই মিতার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
চারপাশে এত আলো, এত গাছপালা, ফোয়ারা, মার্বেল পাথরের রাস্তা! সব যেন রাজপ্রাসাদের মতো। ভেতরে ঢোকার পর চোখে পড়ল বিরাট একটা বাড়ি। উঁচু দেয়াল, কাচে মোড়া জানালা, চারপাশে গার্ড টাওয়ার। মনে হলো কোনো সিনেমার সেটে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
আরাভ একদম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটছিল, যেন এসব তার কাছে খুব স্বাভাবিক। মিতা হাঁটতে হাঁটতে চারপাশ দেখছিল, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিল না! এতসব সত্যিই হচ্ছে তার সঙ্গে?
ভেতরে ঢুকতেই একটা বিরাট লবি। সাদা মার্বেলের মেঝে, উজ্জ্বল ঝাড়বাতি, আর নরম আলোয় আলোকিত দেয়াল। কয়েকজন হাউসকিপার, সিকিউরিটি স্টাফ, সবাই সম্মানের সঙ্গে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। মিতা অস্বস্তি বোধ করছিল। নিজের ওড়নাটা শক্ত করে টেনে মুখ আড়াল করল।
— এতসব! কেমন সম্ভব? ধীরে ধীরে বলল সে।
আরাভ তার দিকে তাকাল না, শুধু মুচকি হাসল।
— সম্ভব তো বটেই। এটা আমার ঘর, আমার সম্রাজ্য।
মিতার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তার মনে হলো এই মানুষটা শুধু শক্তিশালী না, বরং ভয়ঙ্কর রহস্যময়। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না, আরাভ তাকে রক্ষা করছে নাকি আটকে ফেলছে!
একজন মহিলা এগিয়ে এল, বয়সে হয়তো চল্লিশের কাছাকাছি, মার্জিত পোশাক, মুখে নরম হাসি। তিনি মিতার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
— ম্যাডাম, আসুন। আপনার জন্য রুম রেডি করা হয়েছে।
মিতা অবাক হয়ে তাকাল। আরাভ চোখের ইশারায় মিতাকে যেতে বলল। মিতা ভাবছে, এত দ্রুত সব ঠিক হলো কীভাবে! মিতার আগমনের খবর তাদের কেউ আগে থেকে দিয়েছিল?তাকে সোজা একপাশের করিডোর ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই করিডোরে নরম কার্পেট, দেয়ালে বড় বড় ছবি, আর মাঝে মাঝে টেবিলে রাখা তাজা ফুল।
অবশেষে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল তারা। দরজা খোলা হলো। ভেতরে ঢুকে মিতার শ্বাস আটকে গেল।
বিরাট একটা রুম। নরম পর্দা, সাদা বিছানা, ঝাড়বাতির আলোয় ঝলমলে ছাদ, আর বড় কাচের জানালা দিয়ে দূরের শহরের আলো দেখা যায়। টেবিলের উপর ফল, পানি, কিছু কাগজপত্র রাখা। সবকিছু নিখুঁত, যেন একজন অতিথির জন্য রাজকীয়ভাবে সাজানো।
মিতা ধীরে ধীরে বিছানার ধারে বসে পড়ল। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট জমে উঠল। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগল
— জীবন আমার থেকে কতকিছু কেড়ে নিচ্ছে। প্রথম স্বামী, তারপর,পরিবার। সবশেষে তো পরিচয় নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে।
চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়ল।
–এখানে আমি কার আশ্রয়ে আছি? এই মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করছে কেন? আদনান যদি সত্যিই আর না থাকে, তাহলে আমার জীবনের মানে কী? কেন আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি? আমাকে কেউ মেরে ফেললে বা কি? আমার তো পিছুটান নেই!
রাত অনেকটা গড়িয়েছে। চারপাশে নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে দূরের সিকিউরিটি গাড়ির এ্যালার্মিং শব্দ ভেসে আসছে।
মিতা বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছে না। জানালার বাইরে শহরের আলো, দূরের হাইওয়ে, আর মাঝে মাঝে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসছে।। সে চুপচাপ সব দেখছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর একেবারে অপর প্রান্তে এসে পড়েছে সে।
হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে ওড়না। বুকের ভেতর টান লাগছে। হঠাৎই আদনানের মুখ ভেসে উঠল চোখে। সেই হাসি, সেই কণ্ঠ, সেই স্বপ্নের কথা,
–মিতা, তুমি আমার জীবনের স্বপ্ন।
এই স্মৃতিগুলো এক এক করে যেন ছুরির মতো বিঁধে যাচ্ছিল বুকের ভেতর। মিতা হঠাৎ মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। শব্দ বেরোলো না, শুধু বুক কেঁপে উঠছিল।
–আদনান, আপনি কোথায় গেলেন? আমার আপনাকে নিয়ে সংসার করার কথা ছিল। আমি তো আপনাকেই ভালোবেসেছিলাম! তাহলে, আপনার আর আমার নিষ্ঠুর পরিণতি কেন হলো? বলতে পারবেন আপনি? এতদিন আপনাকে হারানোর যাতনায় বিদীর্ণ হচ্ছিলাম প্রতিটাক্ষণ। নতুন করে এখন যোগ হলো, পরিবারকে ভুলে যাওয়ার যাতনা। ছোট একজীবনে আর কিছু হারানোর বাকি আছে কি?
মিতা চুপ করে বসে রইল। তার বুকের ভেতরটায় ভাঙা যন্ত্রণা, চোখে অশ্রু নিয়ে সে উঠে বসল। ঘরের ভেতরে চারপাশে তাকাল। দেয়ালের ছবি, আলো, কার্পেট, পর্দা।সবকিছু অচেনা একেবারে, তার জীবনের বাইরের জগৎ।
মিতার মনে হলো, এই সবকিছু আসলে একটা খাঁচা। ঝলমলে, সুন্দর, সাজানো গোছানো বন্দিশালা।
হঠাৎ দরজার বাইরে হালকা শব্দ হলো। মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মিতা কেঁপে উঠল। সে ধীরে ধীরে দরজার কাছে গেল, কান পাতল। সত্যিই, কারো নিঃশ্বাসের শব্দ।
— কে? মিতা খুব আস্তে ডাকল।
কোনো উত্তর এলো না। দরজার ওপারে শুধু নিস্তব্ধতা।
কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। হয়তো পাহারাদার, অথবা হয়তো আরাভ।
মিতা চুপচাপ বিছানায় ফিরে এল। ঘুম তার চোখে আসছে না। সে মনে মনে বলল
–এই মানুষটা কে? কি তার পরিচয়? সে এত ক্ষমতাবান! কেন আমাকে নতুন নামে বেঁধে রাখতে চাইছে? আমাকে বাঁচাচ্ছে, না বন্দি করছে?
চোখের কোণে জল জমে উঠল। সে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে জানালার বাইরের আলো ম্লান লাগছিল। ঘরটা যেন অদ্ভুত নীরবতায় ভরে উঠল।
মিতা শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করল, আর মনে মনে একটাই নাম ডাকল,
“আদনান…”
_____________________
ভোরের আলো জানালার কাচ ভেদ করে ঘরে ঢুকল।সোনালি আলোয় জেগে উঠল মিতা। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে। রাতের কান্নার চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। ঘরের ভেতর সবকিছু নিস্তব্ধ, শুধু বাইরে কোথাও থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে।
মিতা ধীরে ধীরে উঠে বসল। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল সে কোথায় আছে। বিশাল বিছানা, ঝাড়বাতি, পর্দা, আর শহরের দিকে মুখ করা কাচের জানালা। সবকিছু এখনও তার কাছে অবাস্তব মনে হচ্ছিল।
একটু পরেই দরজা হালকা টোকা দিয়ে খুলে গেল। এক মহিলা ভেতরে ঢুকলেন। বয়সে হয়তো ত্রিশের কাছাকাছি, সুশৃঙ্খল পোশাক, মুখে মিষ্টি হাসি। সঙ্গে আরও দু’জন ছিল। হাতে ট্রে। চায়ের কাপ, কিছু হালকা খাবার, আর একগ্লাস পানি।
মহিলা নরম গলায় বললে
— সুপ্রভাত, ম্যাডাম। আমি সেলিন। আমি এই বাড়ির দেখাশোনা করি। আপনার সবকিছু দেখার এবং গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার ।
মিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তার মুখ শুকনো, চোখে অবিশ্বাস।
— আমি, আমি কি এখানে বন্দি?
সেলিন হালকা হাসল।
— না, ম্যাডাম। আপনি আমাদের বসের মহারানী। আমাদের বস বলেছেন আপনাকে রাণীর মতো ট্রিট করতে।
কথাটা শুনে মিতা আরো অস্বস্তি বোধ করল। সে নিচু চোখে ট্রের দিকে তাকাল। চা থেকে ভেসে আসছিল গরম ধোঁয়া, তবুও হাতে চা তুলতে পারল না।
এবার ঘরে ঢুকল আরও দু’জন। কালো স্যুট, গম্ভীর মুখ, হাতে ফাইল। তারা সেলিনকে কিছু নির্দেশ দিল তুর্কি ভাষায়। তারপর সোজা মিতার সামনে দাঁড়াল।
— ম্যাডাম, আপনার জন্য কিছু কাগজপত্র সাইন করতে হবে। বসের নির্দেশ।
মিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।
— কী কাগজ?
ওদের একজন ফাইল খুলে ধরল।
— আইডেন্টিটি রেকর্ড। আপনি এখন থেকে আয়েশা শেখ। এখানে আপনার নতুন এন্ট্রি পাসপোর্ট, স্পেশাল গেস্ট স্ট্যাটাস, আর কিছু প্রাইভেট কন্ট্রাক্টের কপি আছে।
মিতা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। হাতে তুলে নিল নতুন নীল কভার পাসপোর্টটা। ভেতরে স্পষ্ট লেখা—Ayesha Sheikh। ছবি তারই, কিন্তু নাম অন্য।
মিতার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে ভাঙা গলায় বলল,
— আমি মিতা। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আপনারা কেন আমাকে এভাবে…
তখনই দরজার বাইরে পদশব্দ শোনা গেল। সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। রুমের ভেতরে ঢুকল আরাভ। কালো শার্ট, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ।
সে একদম সোজা মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ভয় পেও না। তোমাকে কেউ বাধ্য করছে না। কিন্তু মনে রেখো, মিতা নামটা এখন মৃত মানুষের মতো পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। তুমি যদি আবার সেই নাম ব্যবহার করো, তোমার জীবন বিপদে পড়বে।
মিতা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়ল।
আরাভ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল।
— এখানে তোমার কারো থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার ওয়াইফ। সবাই তোমাকে সেইভাবেই দেখবে।
তারপর সেলিনকে ইশারা করল।
— ওকে রেডি করো। আজ বিকেলে বাইরে যেতে হবে।
মিতা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল
— কোথায়?
আরাভ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল
— আমার জগতে। সবাই আজ প্রথমবার তোমাকে দেখবে। Mr. A এর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে।
বিকেলের দিকে পুরো বাড়িটা যেন নতুন করে জেগে উঠল। করিডোরে ব্যস্ততা, সিকিউরিটি টিম বারবার ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দিচ্ছে, গাড়িগুলো সারি করে রাখা হলো। মনে হচ্ছিল কোনো ভিআইপি অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি চলছে।
মিতা নিজের ঘরে বসে ছিল। সেলিন আর কয়েকজন মহিলা তাকে তৈরি করছিল। নতুন পোশাক, হালকা রঙের লং ড্রেস, সাথে মাথায় ওড়না। গয়না খুব বেশি নয়, কিন্তু যতটুকু ছিল তাতেই একধরনের মার্জিত আভিজাত্য ফুটে উঠছিল।
সেলিন আয়নায় তার চুল ঠিক করতে করতে হাসল
— আপনাকে খুব সুন্দর লাগছেন, আয়েশা ম্যাম
মিতা চমকে তাকাল আয়নার দিকে। সে কি সত্যিই আয়েশা? রাতরাতি নিজের পরিচয় বদলে ফেলার দৃশ্য সহ্য হচ্ছে না মিতার। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। আরাভ ভেতরে এল। কালো স্যুট, টাই, জুতা পরনে তাকে দেখতে প্রায় তূর্কিশদের মত লাগছিল। তার চেহারায় যেন শক্তি আর রহস্যের প্রতীক ফুটে আছে ।
এক পলক মিতার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ধীরে বলল,
— রেডি তো?
মিতা কিছু না বলে মাথা নিচু করল।
আরাভ তার হাত ধরে বেরিয়ে এলো। লম্বা করিডোর পেরিয়ে তারা নেমে এল লবিতে। নিচে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক ডজন লোক। কেউ বডিগার্ড, কেউ কনসালটেন্ট, কেউ তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। সবাই একসাথে মাথা নত করল।
— গুড ইভনিং, Mr. A। গুড ইভনিং, আয়েশা ম্যাম।
মিতার বুক ধড়ফড় করে উঠল। এতোগুলো মানুষ তাকে আয়েশা ম্যাম বলে সম্বোধন করছে!
গাড়ির বহর আগেই প্রস্তুত ছিল। সবার চোখের সামনে আরাভ দরজা খুলে মিতাকে আগে বসাল। তারপর নিজে পাশে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
শহরের অভিজাত এলাকা, ঝলমলে রাস্তা, উঁচু বিল্ডিং পেরিয়ে বহর এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনে-পেছনে গার্ডদের গাড়ি, এদের বহর দেখে বোঝা যাচ্ছিল এরা এক বিশেষ শক্তির বহর।
প্রায় আধঘণ্টা পর তারা পৌঁছাল এক বিশাল রেস্টুরেন্টে। বাইরে আগেই সারি করে দাঁড়িয়ে ছিল স্টাফরা। সবাই সম্মানের সঙ্গে মাথা নিচু করল।
ভেতরে ঢুকতেই আলো ঝলমলে হলরুম চোখে ধরা পরল। কাচের দেয়াল, সাজানো টেবিল, গ্লাসে চকমকে আলো।সবকিছু রাজকীয়। কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ উঠে দাঁড়াল আরাভকে দেখে।
— ওয়েলকাম, Mr. A। ওয়েলকাম, ম্যাম।
মিতার বুক কেঁপে উঠল। এই প্রথম সে একেবারে ভিন্ন পরিচয়ে জনসমক্ষে এসেছে। এখানে সবাই তাকে Mr. A-এর স্ত্রী মনে করছে, আর মিতা সেই মিথ্যা সয়ে যাচ্ছে, প্রতিবাদ করতেও পারছে না।
আরাভ হালকা হাসি নিয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে রাখল। ধীরে গলায় বলল,
— ভয় পেয়ো না। এখন থেকে সবাই তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবেই দেখবে।
হলরুমের ভেতরে লম্বা ডাইনিং টেবিল সাজানো। একে একে সবাই বসছে। টেবিলের মাঝখানে কাচের ফুলদানি, মোমবাতির আলো, ঝলমলে ঝাড়বাতি। মিতা যেন অচেনা এক দুনিয়ায় বসে আছে।
তার ডানদিকে আরাভ, চারপাশে প্রভাবশালী কয়েকজন পুরুষ-নারী। কারও চেহারায় কৌতূহল, কারও চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
প্রথমে পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক। খাবার আসছিল, ওয়েটাররা মাথা নিচু করে পরিবেশন করছিল। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি দেশের একজন বড় ব্যবসায়ী বলে মনে হচ্ছিল, মিতার দিকে তাকালেন। কণ্ঠটা নিচু হলেও দরাজ গলা বলল,
— স্যার, আমরা তো দীর্ঘদিন ধরেই আপনাকে চিনি। কিন্তু আগে কখনো তো আপনার স্ত্রীর কথা শুনিনি। হঠাৎ করে আমাদের সামনে হাজির করলেন!
কিছুক্ষণের জন্য থামলেন, তারপর একটু মুচকি হেসে বললেন,
— ম্যাডাম, আপনি আসলে কোন পরিবার থেকে এসেছেন?
প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে মিতার গলা শুকিয়ে গেল। সে কাঁপতে কাঁপতে হাত দুটো টেবিলের নিচে চেপে ধরল। গলা শুকিয়ে গেলেও মনে মনে শুধু একটা কথাই বারবার উচ্চারণ করল
–আমি মিতা, আমি আয়েশা নই। আমি Mr. A এর কিছু না।
কিন্তু ঠোঁট দিয়ে কিছু বের হলো না।
এরই মধ্যে আরাভ তার কাঁধে হাত রাখল। সেই হাতের দৃঢ় চাপ যেন বলল
–চুপ থেকো। সব সামলাচ্ছি আমি।
তারপর সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
— আমার স্ত্রী সম্পর্কে জানার দরকার আপনাদের নেই। জানার দরকার শুধু এটুকুই,আমার স্ত্রী এখন থেকে আমার সবকিছু।
ভদ্রলোক অস্বস্তি নিয়ে হেসে বললেন
— না, মানে… কোনো অসুবিধা নেই স্যার, আমরা তো বন্ধু এবং বিজনেস পার্টনার তাই জানতে ইচ্ছে হলো।
আরাভ এবার ধীরে গ্লাসটা টেবিলে নামাল। তারপর সবার দিকে তাকাল। তার চোখের শীতল দৃষ্টি পুরো টেবিলে নীরবতা নামিয়ে আনল।
— আমি কারও কাছে ব্যাখ্যা দিই না। আপনারা আমার আমন্ত্রণে এসেছেন, আমার রেস্টুরেন্টে খাচ্ছেন। এই পর্যন্তই। আর আমার স্ত্রীর ব্যাপারে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস যেন আর কেউ না করে।
তার গলার ধারালো জবাবে যেন পুরো হলরুম জমে গেল। কেউ আর সাহস পেল না কোনো কথা বলার।
মিতা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বুকের ভেতরে কাঁপন থামছিল না। একদিকে ভয়, অন্যদিকে নিরাপত্তাবোধ কেউ তাকে প্রশ্ন করতে পারছে না, কারণ পাশে আছে Mr. A।
ডিনার শেষে অতিথিরা একে একে বিদায় নিল। মিতা নিশ্চুপ বসে ছিল, যেন একটা পাথরের মূর্তি। তার চোখে শুধু আতঙ্ক আর চাপা ক্ষোভ।
আরাভ বিন্দুমাত্র হেলদোল না করে সবার সঙ্গে হাত মেলাল, মৃদু হাসল, তারপর মিতার হাত ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল।
বাইরে রাত হয়ে গেছে। শহরের কৃত্তিম আলো ঝলমল করছে, গাড়ির বহর একসাথে এগোতে লাগল। সামনের গাড়িতে গার্ড, পিছনেও গার্ড। মাঝের গাড়িটায় বসে আছে তারা দুজন।
ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা। গাড়ির ভেতর শুধু গানের শব্দ। মিতা জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল, কিন্তু চোখ ভরে আসছিল কান্নায়।
হঠাৎ সে ঘুরে তাকাল। গলার স্বর কাঁপছিল, কিন্তু কথাগুলো বের হলো বজ্রপাতের মতো,
— কেন আমাকে এভাবে জোর করে পরিচয় চাপিয়ে দিচ্ছেন? কেন সবাইকে বললেন আমি আপনার স্ত্রী? আমি তো মিতা! আমি তো কারও আয়েশা নই!
আরাভ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁটে কোনো হাসি নেই, চোখে কোনো রাগও নেই।
মিতা আবার ফুঁসে উঠল
— আপনি জানেন এটা আমার কাছে কতটা অপমানজনক? এখন আমার পরিচয় সবার চোখে মিথ্যে হয়ে গেছে। আপনি কিভাবে আমার নাম, আমার পরিচয় বদলে দিতে পারেন?
তার গলার স্বর ভেঙে কান্নায় মিশে গেল।
আরাভ ধীরে গা এলিয়ে দিল সিটে। তারপর নিচু গলায় বলল,
— তুমি যদি নিজের আসল পরিচয় জানাতে, তুমি হয়তো আজ এই গাড়িতে বসে থাকতে পারতে না।
মিতা থমকে গেল। আরাভ এবার সরাসরি তার চোখের দিকে তাকাল। ঠাণ্ডা অথচ শক্ত কণ্ঠে বলল
— তোমাকে আমি আয়েশা বানিয়েছি, কারণ এটাই তোমার নিরাপত্তা। এটাই তোমার বেঁচে থাকার উপায়। আমার পরিচয়ে ঢেকে গেলে কেউ তোমাকে আঘাত করার সাহস পাবে না।
মিতা ফুঁপিয়ে উঠল
— কিন্তু এতে আমি মিথ্যে হয়ে যাচ্ছি!
আরাভ ধীরে তার হাতটা ধরে রাখল।
— না। তুমি মিথ্যে নও। তুমি এখন আমার সুরক্ষার ভেতরে। এই দুনিয়ায় বাঁচতে হলে কখনও কখনও নিজের নামও ত্যাগ করতে হয়। আর মনে রেখো, তুমি এখন আমার স্ত্রী। আর এই পরিচয়ের চেয়ে নিরাপদ কিছু নেই তোমার জন্য।
মিতার বুক কেঁপে উঠল। কান্না থামছিল না। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল গালে। ভেতরে ভেতরে সে চিৎকার করতে চাইছিল
—”আমি এখনও আদনানের!”
কিন্তু ঠোঁটের কাছে গিয়ে শব্দ আটকে গেল।
ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ হবার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত মিতার পা কাঁপছিল।।
ঘরের বাতি কমিয়ে রেখেছে । জানালার দিয়ে মৃদু সোনালি আলো দূরে শহর জুড়ে ঝলমল করছে। সে মেঝেতে নরম ওড়না ছুঁয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে বসলো বিছানায়। আজকের ড্রেস এখনও শরীর জড়িয়ে আছে । আংটি? আংটিটার কথা মনে পরতেই। মনের মধ্যে কিছু ঝাপসা স্মৃতি এবং চোখ ছলছল করছিলো।
তারপর সে রাতেও আর ঘুম আসেনি মিতার। ঘণ্টা দুটো কেটে গেল, তিনটের কাটা, মিতার চোখ শহরের সৌন্দর্য দেখছে। কখনো কখনো দরজার পেছন থেকে হালকা পদধ্বনি শুনে সে কেঁপে উঠে। গোটা বাড়িটা যেন কয়েদিখানা। নিরাপত্তার জোরদার এখানে সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু যখনই আরাভের কথা মনে আসে, সে খুঁজে পায় নিরাপত্তার খোঁজ। নিরাপত্তা? পরক্ষণেই মনে হয়, নতুন এক ধরণের বন্দিত্বে আঁটকে পরেছে ?
মিতা সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করে কিন্তু মেলাতে পারেনা ।
ভোরের আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে সোনালি রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। সারা রাত জেগে থাকার পরেও মিতার চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। মুখ ফ্যাকাশে, চোখ লালচে।
সে ধীরে ধীরে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। বাইরে বিশাল বাগান, ফোয়ারার শব্দ, গাছের ডালে পাখিদের ডাক। চারদিকে যেন শান্তির রাজ্য, অথচ তার ভেতরে চলছে অশান্তি এবং যুদ্ধ।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। মিতা চমকে তাকাল। সেলিন ঢুকল, হাতে সকালের নাস্তার ট্রে।
— গুড মর্নিং, আয়েশা ম্যাম। আশা করি ভালো ঘুম হয়েছে।
মিতা কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে ট্রেটা বিছানায় রাখতে ইশারা করল। সেলিন যেন বুঝতে পারল তার অবস্থা, মৃদু হাসল আর চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর করিডোরে ভেসে এলো পায়ের শব্দ। মিতার বুক ধড়ফড় করে উঠল। দরজাটা ধীরে খুলল, আরাভ ভেতরে ঢুকল।
আজ তাকে ভিন্ন রকম লাগছে। স্যুট-পরা আগের রাতের কাটকাট কথা বলা রাজকীয় মানুষটা নেই, বরং হালকা গায়ে রঙের শার্ট, বুকের কাছে খোলা দুটো বোতাম, চুল সামান্য এলোমেলো। তাকে একেবারে অন্যরকম লাগছিল ।
আরাভ মিতার দিকে তাকাল, চোখে কোনো চাপ নেই, শুধু শান্ত দৃষ্টি।
— সারারাত ঘুমাওনি, তাই না?
মিতা ঠোঁট কামড়ে তাকাল জানালার বাইরে। উত্তর দিল না।
আরাভ ধীরে ঘরে হাঁটতে হাঁটতে বলল
— আমি জানি তুমি ভেতরে ভেতরে অনেকটা ভেঙে পড়েছ। তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার সবকিছু কেড়ে নিচ্ছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে বাঁচানোর জন্যই এভাবে করছি।
মিতা এবার রাগে ফেটে পড়ল,
— বাঁচানো? এটা কি বাঁচানো? আমার নাম, পরিচয়, সবকিছু বদলে ফেলে আমাকে তুমি তোমার স্ত্রী বানিয়ে দিলে! সবাই আমাকে আয়েশা বলে ডাকে, অথচ আমি মিতা! আমি মিথ্যা পরিচয়ের আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চাই না! আপনার ছায়া হয়ে বাঁচতে চাই না।
কথাগুলো বলার সময় মিতার গলা কেঁপে উঠল। চোখে জল টলমল করছিল।
আরাভ এক মুহূর্ত নীরব রইল। তারপর এগিয়ে এসে ধীরে বলল
— যদি আমি তোমাকে আমার ছায়া বানিয়ে রাখি, তার মানে এই না যে তোমার আসল সত্তা মুছে গেছে। তুমি মিতা হয়েই থাকবে তবে কেবল আমার কাছে। মিতা শুধু আমার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে তোমাকে আয়েশা হতে হবে।
তারপর একেবারে নিচু গলায় যোগ করল
— তুমি যদি চাও, আমি আজই তোমাকে মুক্ত করে দিতে পারি। দরজা খোলা আছে। কিন্তু বাইরে বেরুলে কে তোমাকে বাঁচাবে, ভেবেছো? তোমার পরিবারের কি হবে ভেবেছো?
মিতা তাকিয়ে রইল তার দিকে। বুক ধকধক করছে। এই মানুষটা ভয়ঙ্কর, অথচ তার কথায় আসন্ন বিপদের সংকেত আছে। যা মিতার ভেতরে দ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে দিল।
মিতা আর কিছু বলল না। শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের আলো দেখতে লাগল, যেন নিজের ভেতরের উত্তর খুঁজছে।
_______________
দুপুরের দিকে বিশাল বাগানে গাড়িগুলো সারি বেঁধে দাঁড়াল। বডিগার্ডরা একে একে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কালো স্যুট, সানগ্লাস, ইয়ারপিসে ফিসফিস করে নির্দেশ দিচ্ছে।
মিতার বুক ধড়ফড় করছে। সে এখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সাদা শাড়ি পরনে। ঘাড়ে পরে আছে চুলের খোপা, মুখে প্রায় কোনো সাজসজ্জা নেই। অথচ, চমৎকার দেখাচ্ছিল তাকে।
এই সময় দরজায় কড়া নাড়ল সেলিন।
— ম্যাডাম, সময় হয়ে গেছে। সবাই নিচে অপেক্ষা করছে।
মিতা থমকে গেল। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে মনে হলো, এটা তো মিতা নয়! অন্য কেউ। আয়েশা।
মিতা সেলিনকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় খেয়াল চারপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে, সম্মানের ভঙ্গিতে মাথা নত করছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাভ, আগের মতোই কালো স্যুটে।
সে হাত বাড়াল।
— চলো, আয়েশা।
মিতা দ্বিধা নিয়ে হাত রাখল। বুকের ভেতর দম আটকে আসছিল।
সিঁড়ি থেকে নামতেই চারপাশে ফ্ল্যাশলাইট ঝলসে উঠল। ক্লিক… ক্লিক… ক্লিক… ক্যামেরার শব্দে পুরো হলরুমে ভরে গেল। স্থানীয় মিডিয়ার সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে আছে দূরে, কিন্তু সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আরাভের সিকিউরিটি।
একজন রিপোর্টার চিৎকার করে প্রশ্ন করল
— Mr. A, আপনার পাশে যে মহিলা, উনি কি সত্যিই আপনার স্ত্রী?
— হ্যাঁ। উনি আমার স্ত্রী, আয়েশা শেখ।
চারদিকে গুঞ্জন উঠল। ক্যামেরাগুলো আরও ব্যস্ত হয়ে উঠল। সবাই মিতার ছবি তুলতে চাইছে।
মিতা ভয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা আরও আড়াল করে ফেলল। ভেতরে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল
—আমি আয়েশা নই, আমি মিতা।
কিন্তু চারপাশের সেই অসংখ্য চোখ, সেই ভয়ংকর বাস্তবতা তার গলা আটকে দিল।
আরাভ তার হাত শক্ত করে ধরে রাখল।
এমনসময় ব্লু রঙা স্যুট পরা একটা লোক এসে দাঁড়ালো মিতা এবং আরাভের সামনে। লোকটাকে দেখে আরাভ হেসে জিজ্ঞেস করল,
— What’s up, bro?
— all ok. Hey, how are you, mita? Oops sorry! I mean how are you, Ayesha sheikh? My would be sister-in-law.
বহুল আকাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা পেয়ে মিতা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল মানুষটাকে,
— এ্যাডাম, তুমি?
“চলবে”
#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
৩০……
মিতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ্যাডাম স্পষ্টভাবেই তার নাম বলে ফেলল,
— How are you, Mita? Oops… sorry! I mean Ayesha Sheikh.
চারপাশের ফ্ল্যাশলাইট, মানুষের চাপা গুঞ্জন সবকিছু হঠাৎ থমকে গেল যেন।
আরাভের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটল,
সে ধীরে ধীরে এডামের দিকে ফিরল। এ্যাডামের কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
— মিতা নামটা আর কখনও উচ্চারণ করিস না।
চারপাশের সিকিউরিটিরা এক মুহূর্তে টানটান হয়ে উঠল। হলরুমে নীরবতা নেমে এলো।
আশেপাশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এ্যাডাম মুচকি হেসে বলল,
— Relax, bro. It was just a slip of tongue. But funny thing is… she really looks like someone I used to know.
আরাভ এবার কণ্ঠ নামিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল—
— সে সামওয়ান লাইকের মত কেউ না। সে আমার স্ত্রী। আর এর বাইরে ওকে নিয়ে তোর কিছু ভাবার দরকার নেই।
অনুষ্ঠানের বাকি সময়টা মিতা অস্থিরতায় কাটাল।
যেখানেই চোখ যায়, মনে হচ্ছিল এ্যাডাম ওর ওপর নজর রাখছে।
কখনও ভিড়ের মাঝে, কখনও সাইডের কর্নারে।প্রতিবারই সে তাকাত, আর এ্যাডামের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেত।
একেকটা দৃষ্টি যেন না বলা অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল মিতার দিকে।
আরাভ পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু বুঝতে পারছিল।
তার তীক্ষ্ণ চোখ বুঝে ফেলেছিল মিতার অস্থিরতা,
আরাভ কোনো কথা বলল না, শুধু এক হাতে মিতার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রাখল, যেন মনে করিয়ে দিল,
“তুমি আমার, আর কারো না।”
অনুষ্ঠানের উজ্জ্বল আলো, অতিথিদের হাসি আর ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এল।
সুরের তান স্তিমিত হলো, আর একে একে অতিথিরা বিদায় নিতে শুরু করল।
চওড়া মার্বেল ফ্লোরে পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, সোনালি ঝাড়বাতির আলো ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতার দিকে নামছিল।
বিলাসবহুল বাড়িটা ফাঁকা হতে শুরু করল।
শুধু রইল কয়েকজন দেরি করে যাওয়া অতিথি, আর সিকিউরিটির গম্ভীর উপস্থিতি।
মিতা বুঝল, সময় ফুরিয়ে আসছে।
এ্যাডামের সঙ্গে কথা বলতেই হবে তাকে, যেভাবেই হোক।
বাড়ির ড্রইংরম তখন প্রায় খালি।
অতিথিরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে, কর্মচারীরা সব গুছিয়ে নিচ্ছে।
দূরে সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাদের চোখও এখন ভারি হয়ে এসেছে ক্লান্তিতে।
মিতা সোফায় বসে ছিল, কিন্তু চোখ বারবার অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
ঠিক তখনই পেছনের নীরবতা ভেঙে এক পরিচিত গলা শোনা গেল
— একা বসে আছো যে? Mr. A কোথায়?
মিতা চমকে ঘুরে তাকাল। দেখল। এ্যাডাম দাঁড়িয়ে আছে।
ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এলো, মার্বেলের মেঝেতে তার জুতার শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল।
এডাম থেমে গেল একদম মিতার সামনে।
নিচু গলায় বলল,
— আমি ঠিকই ভেবেছিলাম তুমি-ই মিতা।
মিতার বুক ধড়ফড় করছে, হাতের আঙুলগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিছু বলার আগেই সে অনুভব করল, এ মুহূর্ত থেকে আর এড়ানো সম্ভব হবে না।
এ্যাডামের চোখে মৃদু নরম ভাব, কিন্তু ভেতরে লুকানো অনুভূতির ঢেউ। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মিতার চোখে চোখ রেখে বলল,
— কতগুলো বছর পর তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো? তোমার আমার ওপর রাগ কি কমেছে?
মিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোমার প্রতি রাগ কমার মতো কোনো কারণ এখনও খুঁজে পাইনি, এ্যাডাম।
এ্যাডাম হালকা হাঁসল, যেন অতীতের ক্ষোভ চাপিয়ে রাখতে চাইছে।
হাত দুটো পেছনে ধরে রাখছে, চোখে উদাসীন ভাব।
— দেখো মিতা, তুমি তখন শুধু আমার ক্লাসমেইট ছিলে, শুধু ভার্সিটিতে একজন সহপাঠী। তুমি অযথাই আমার ওপর রাগ ঝাড়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে। অথচ আমি এমন কিছুই করিনি যার কারনে হলেও তোমার সামান্যতম রাগের স্বীকার হতাম আমি।
— ভার্সিটি চত্বরে সবার সামনে আমাকে প্রেম নিবেদন তুমি করেছিলে, এ্যাডাম? ভুলে গেছো সেদিনের কথা? রোজ ভার্সিটিতে আমাকে ফলো করতে। সবকিছু ভুলে গেছো?
মিতার কথা শুনে এ্যাডাম ডানহাত তুলে কপাল চুলকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— তুমি ব্রোয়ের কাছে আসল ব্যাপারটা জানতে চাইলে ভালো হত, মিতা। কারণ, তোমার কোনো প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই।
তারপর সে সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
মিতার চোখে বিস্ময়। অপজিট সোফায় বসে থাকা এ্যাডাম যেন তার পুরোনো স্মৃতিকে জীবন্ত করে তুলল।
— তারমানে, তুমি বলতে চাইছ, সেসব দিনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মিথ্যে ছিল?
— এ্যাডাম?
হঠাৎ আরাভের কণ্ঠ কানে ভেসে এলো।
মিতা চুপ করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। আরাভ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
মিতার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। মনে হলো, এ মুহূর্তে তার পুরনো অতীত এবং নতুন বাস্তবতার মধ্যে এক অবরুদ্ধ স্থিতি তৈরি হয়ে গেছে।
— মিতা, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা ছিল। চলো?
আরাভ কথাটি বলে ধীরে মিতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মিতা তার বাড়ানো হাতে তাকিয়ে রইল, চোখ ভর্তি অস্থিরতা নিয়ে বলল,
— আমার কিছু প্রশ্নের জবাব চাই, Mr. A?
— তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেব আমি। কিন্তু এখানে নয়, প্লিজ, কাম উইথ মি।
আরাভের অনুনয় শুনে মিতা আরও একবার এ্যাডামের দিকে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে আরাভের বাড়িয়ে দেয়া হাতের ওপর হাত রাখল। আরাভের হৃদয় যেন মিতার এতটুকু স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল।
আরাভ তাৎক্ষণিকভাবে মিতার হাতটা শক্ত করে ধরল।
মুহূর্তের মধ্যে দুজনের হৃদয়ের ছন্দ যেন এক হয়ে গেল।
মিতা আরাভের পাশে হাঁটতে লাগল, হাতে হাত রেখে।
মৃদু বাতাস, সোডিয়ামের আলোয়ে, সবকিছু যেন দিনের আলোর মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
মিতা আরাভের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি পেরোল।
শেষে তারা ছাদের দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছাল।
আরাভ ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।
মিতার চোখ মুহূর্তে বড় হয়ে গেল।
ছাদ! পুরো ছাদ যেন স্বপ্নের এক রাজ্য।
প্রতি কোণে ছোট ছোট ক্যান্ডেল জ্বলছে, নরম সোনালী আলো বাতাসের সঙ্গে নাচছে। বেলুনলাল, সোনালী, গোলাপী হালকা বাতাসে অচেতনভাবে দুলছে।
ছাদের কোণাগুলোতে ছোট ছোট fairy light ঝিলমিল করছে, যেন তারা রাত্রির আকাশ থেকে ঝরে পড়েছে।
মৃদু বাতাস বেলুনগুলো নড়াচড়া করাচ্ছে, আর ক্যান্ডেলের নরম আলো প্রতিফলিত হয়ে দেয়াল, এবং মেঝেতে সোনালি আলো ফেলছে।
ছাদের সীমানায় শহরের দূরবর্তী আলো ফিকে হয়ে মিশে গেছে, আর অন্তরালে যেন শান্তির এক নিঃশব্দ সঙ্গীত বাজছে।
মিতা আরাভের পাশে দাঁড়িয়ে, চোখে অস্থিরতা আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
— এ্যাডামকে দেখে তোমার মনে কিছু প্রশ্ন জ্বালাতন করছে তাই না, মিতা?
আরাভ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মিতার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিল।
তার স্পর্শে মিতা খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল।
সে সরে যেতে চাইলে আরাভ বাধা দেয়নি। শুধু তাকিয়ে রইল মিতার দিকে।
মিতা খানিকটা দূরত্ব রেখে ধীরে ধীরে বলল
— আপনি আমাকে কবে থেকে চেনেন, Mr. A?”
আরাভ হালকা মুচকি হাসি দিল।
— রাশিয়ায় যখন এলে, ঠিক তার পরদিন সকাল থেকে।
— মানে?
— মানে খুবই সোজা। তোমাদের বিল্ডিংয়ের অপজিটের বিল্ডিংয়ে আমি আর এ্যাডাম থাকতাম। তুমি খুব সম্ভবত সেদিন খুবই আপসেট ছিলে। তোমার বিষাদময়ী চেহারা দেখে আমার যে কি হলো?
আমি সেদিন এ্যাডামের ভার্সিটিতে গেলাম এ্যাডামের পরিচয়ে শুধু তোমাকে একবার দেখব বলে। সম্ভবত সালোয়ার কামিজ বলে তোমাদের ভাষায়। সেদিন বটল গ্রীন রঙা একটা ড্রেস এবং সাদা ওড়নায় তোমায় দেখে আমি অন্য জগতে বিচরণ করলাম। খোলামেলা পোশাকে কতশত মেয়েকে দেখেছিলাম কিন্ত তোমাকে দেখার পর যেই ফিলটা পেলাম সেটা আর কোথাও পাইনি। কোনো প্রি-প্ল্যান ছাড়াই তোমাকে প্রোপোজ করে বসলাম৷ তুমি তো রিজেক্ট করলে আমার হৃদয় ভেঙে চুরমার হলো। প্লাস এ্যাডামের মত ভদ্র ছেলে বদনাম হলো। ভার্সিটিতে রটে গেল এ্যাডামের মত ভদ্র ছেলে কিনা একটা এশিয়ান মেয়ের জন্য অভাবনীয় কান্ড করে বসল! ভাবলে এখনও হাসি পায় আমার। এ্যডামের সে কি রাগ হলো আমার ওপর? আমি ওর রাগের তোয়াক্কা না করে প্রায় সময় তোমার সামনে যেতাম কিন্তু তুমি প্রতিবার আমার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে। মাঝেমধ্যে আমার তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করত, আমি এ্যডাম নই। আমি আরাভ। যে তোমাকে ভালোবাসে। বলা হয়ে উঠেনি। সাহস জুটাতে পারতাম না যে।
মিতা আরাভের কথাগুলো শুনে অবাক হলো। আরাভের কথাগুলো কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো তার। তাছাড়া এ্যাডাম যদি তাকে সত্যি ভালোবাসত তবল স্বীকার করত। সেই প্রথমদিন থেকে দেখে আসা এ্যাডামের পরিচয়ে পরিচয় দেয়া আরাভের কথাবার্তা, মিতার প্রতি তার ভালোবাসা সবই সত্যি মনে হচ্ছে আজ। পার্থক্যের বিচার করতে পেরেছে আজ সত্যিকাট এ্যাডামের সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে।
আরাভের মিতার হাত ধরে বলল,
— বিশ্বাস করো মিতা, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার ভালোবাসায় কোনো কলঙ্ক নেই। তোমাকে কেবল আমি চেয়েছি। এ্যাডাম তোমাকে কখনো চায়নি? পরিচয়ের ব্যাপারটা যদি তোমাকে আগে খোলাসা করে বলতাম, তাহলে তুমি আজ ভুল বুঝতে না।
মৃদু ক্যান্ডেলের আলো ছাদের চারপাশে আলো ছড়াচ্ছে। গোলাপী ও সোনালি বেলুনগুলো হালকা দুলছিল। দূরের শহরের আলো ঝলমল করছিল। মিতার দৃষ্টি শুধুই আরাভের দিকে।
আরাভ ধীরে ধীরে এক হাঁটু ভেঙে বসলো, হাতে একটি ছোট ভেলভেট বক্স। বক্সের ভেতরে জ্বলজ্বলে একটি ডায়মন্ডের আংটি।
আরাভ মিতার দিকে তাকাল, চোখে শান্তি, আর সাথে গভীর অনুভূতি নিয়ে বলল,
— Mita… I love you. I have always loved you. And I want to spend the rest of my life proving it to you. Will you… marry me?
মিতার নিশ্বাস আটকে গেল। তার হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করতে লাগল। সে তাকিয়ে রইল, আংটি, আর আরাভের চোখের প্রজ্বলিত ভালোবাসার দিকে। চারপাশের সবকিছু যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুধুই তারা দুজন রইল ছাদের সেই জাদুকরী মুহূর্তে।
আরাভের কণ্ঠ ধীরে ধীরে নরম হয়ে গেল, এখন কেবল ফিসফিসানী শোনা যাচ্ছে,
— হ্যাঁ বলো মিতা। আমাকে তোমার সেই মানুষ হতে দাও, যে তোমাকে রক্ষা করবে, সযত্নে ভালোবাসবে, এবং তোমার পুরো জগৎ হয়ে থাকবে।
“চলবে”