দ্বিতীয়জন পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
15

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter

“”””শেষাংশ”””

অন্ধকার এক কালো কুঠুরি। ঘন জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে আছে এই কুঠুরি। চারপাশে নীরবতা। বাতাসের শো শো শব্দে গাছের ডাল দুলে উঠছে, ফাঁকেফাঁকে শুকনো পাতার খসখস শব্দ। দূরে কোথাও শেয়ালের দীর্ঘ ডাক আর নিশাচর পাখির করুণ আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায়। চারপাশে কোনো জনমানবের অস্তিত্ব নেই, যেন এই জঙ্গলটাকে মানুষ ভুলে গেছে বহু বছর আগে।

কুঠুরির ভেতর থেকে হালকা আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে। কিন্তু কে? এই নির্জন জঙ্গলের বুকে, এই পরিত্যক্ত কুঠুরিতে?

কুঠুরির নোংরা মেঝেতে আহত অবস্থায় একজন পড়ে আছে। তার পায়ে এবং হাতে লোহার শেকল, লালচে রক্ত দাগ মেঝের সঙ্গে মিশে আছে। লোকটা ধীরে ধীরে শরীর সোজা করে বসার চেষ্টা করল, কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে। পিঠ মেঝের সাথে ঠেকিয়ে সে স্থির হয়ে রইল, নিঃশ্বাস গরগরে শব্দের ন্যায় শোনাচ্ছে।

তার চোখ ধীরে ধীরে ছাদের দিকে ওঠে,পুরনো, ধুলোমাখা ছাঁদ।
হঠাৎ সে অনুভব করল, কোনো অদৃশ্য শক্তি তার চারপাশে ঘুরছে। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু স্পর্শ করছে মনে হচ্ছে।

লোকটা ধীরে ধীরে শেকলগুলোতে চাপ দিয়ে মাথা হেলাল। কল্পনাশক্তি আর বাস্তবের সীমা মিলেমিশে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই নিঃসঙ্গ কুঠুরি তার অতীতের কিছু গোপন সত্য লুকিয়ে রেখেছে, যা যদি বেরিয়ে আসে। তাহলে কেউ নিরাপদ থাকবে না।

হঠাৎ অন্ধকার কুঠুরির দরজা খোলা হলো। এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে এল। চাঁদের আলো ঘরে প্রবেশ করল, আর সেই আলোয় দেখা দিল দীর্ঘ, রহস্যময় এক মানবছায়া। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

ছায়াটির পোশাকের প্রান্তগুলো যেন কক্ষের নোংরা মেঝে আর পুরোনো দেয়ালকে ছুঁয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যেক ধাপের শব্দ মৃদু আওয়াজ তুলছে। ধুলোমাখা মেঝেতে প্রতিধ্বনি ফেলছে।

চাঁদের আলোয় ছায়ার রূপ স্পষ্ট হলো।মানুষটির হালকা ঢেউ খেলানো কেশ, কাঁপা হাত আর রহস্যময় চোখ। কক্ষের বাতাসে ভেসে আসছে হালকা শ্বাসের আওয়াজ, যেন কেউ নিঃশব্দে কষ্ট করে জীবন সংগ্রাম করছে।

—How are you? Abraham?

ছায়ামানব কথাটি ফিসফিস করে বলল। সঙ্গে সঙ্গে সে তার হাতে থাকা ইলেকট্রিক ব্যাপে টান দিলো। এরপর, ধোঁয়া বের হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা আহত মানুষের মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তে ঘরটা ধোঁয়ার স্তরে ঢেকে গেল। লোকটার চোখে জল চলে এলো, নিঃশ্বাস আটকে গেল। এবং শরীরের আগের ব্যথা আরও গভীরভাবে অনুভূত হলো। তবুও অনেক কসরত করে জবাব দিলো,

—তোদের দোয়ায় ভালো আছি, এ্যাডাম।

এ্যাডাম বিদ্রুপের হাসি দিয়ে কপাল চুলকিয়ে হেসে বলল,

—তুই হচ্ছিস আমাদের লোক। তোকে দয়া না দেখালে যে আমাদের পাপ হবে।

আব্রাহাম এক ঝলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। চোখে অস্থিরতা, ঠোঁটে নীরব ঘৃণা। সে স্বল্পশব্দে বলল,

—মিতা বেঁচে আছে?

—মিতার প্রসঙ্গ বাদ দে। তোকে আমাদের দরকার। তুই আমাদের কাজ করবি, ব্যস।

—তোদের কত কাজ আমি করে দিলাম। তোদের এই পাপে সাম্রাজ্য গড়তে আমি নিজ হাতে কত পাপ করেছি!

—পাপ করেছিস! হাসালি আমায়, আব্রাহাম। প্রত্যেকটা পাপ গ্রহণ করার পর তুই কড়া গণ্ডায় টাকা বুঝে নিয়েছিস আমার থেকে। এখন এত পূন্যের কথা কেন বলছিস?

এ্যাডাম কথাগুলো বলে আহনাফের দিকে তাকিয়ে ফের বলল,

—সায়মাকে খুনের দায়ে জেলে পরেছিলি তুই। কেউ গিয়েছিল তোকে ছাড়াতে? আমি এ্যাডাম, লাখ টাকা খরচ করে তোকে সায়মা মার্ডার কেস থেকে বেকসুর খালাস করিয়ে এনেছি।

এ্যাডামের কথাগুলো শেষ হতেই সে আহনাফের দিকে সরাসরি তাকালো, চোখে আগুন, ঠোঁটে বিদ্রুপমিশ্রিত ঠেস।

—সায়মাকে মেরেছিস কেন?

আহনাফ ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করল। চোখে অদ্ভুত অন্ধকার, শরীরে জমে থাকা উত্তেজনা।

—তোমরা আদনানকে যে কারণে মেরেছো, আমি ঠিক সেই কারণে সায়মাকে মেরেছি। কত বড় সাহস দেখেছো! মিতাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে!

এ্যাডামের চোখের আগুন আরও ঝলসে উঠল। সে ধীরে ধীরে এগোল। প্রতিটি ধাপের শব্দ মেঝেতে ঘোলা, কিন্তু নিঃশব্দের মতো ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি ফেলল।

—আদনান এবং মিতার নাম আরেকবারও তোর মুখে আনবি না, আব্রাহাম। নয়ত, তোর পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না! লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি তোকে।

—আমি পাপ করেছিলাম, আদনানের মতো সহজসরল ছেলেটাকে তোদের সেই সো-কলড রিসার্চ সেন্টার নামের পাপের সাম্রাজ্যে পাঠিয়ে। ছেলেটাকে মেরে ফেললি। একটা লেইম এক্সকিউজ দেখিয়ে। মেরে ফেলার পরও শান্তি পাইনি। ওর লাশ সুদূর বাংলাদেশের কবরস্থান থেকে তুলে এনে তোদের রিসার্চ সেন্টারের মুখ্য অফিসে কাচভর্তি কেমিক্যালে ডুবিয়ে রেখেছিস।

এ্যাডামের চোখে ক্ষিপ্র আগুন, মুখ কুঁচকে উঠল। বিরক্তিকর সুরে সে আওয়াজ তুলল,

—আদনান ছাড়াও আরও অনেক ছাত্র এবং ছাত্রীদের তুই আমাদের রিসার্চ সেন্টারে এনে দিয়েছিস, টাকার বিনিময়ে ক্রস-ব্রিডিংয়ের গবেষণা করার জন্য। তুই, সায়মা এবং আমি শুধু ভার্সিটিতে পড়তামই না, আমরা তো এশিয়ার কিছু গরীব ও লোভী ছাত্র-ছাত্রীদের টোপে ফেলতাম। পুরনো ব্যাপারগুলো মাটি দে, আব্রাহাম। এখন কাজের দিকে মন দে।

আব্রাহাম খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,

—হানিফকে কি করেছিস?

—মরে গেছে, শালা।

শব্দগুলো ঘরে প্রতিধ্বনি করল। ধোঁয়া এখনও মেঝেতে ঘোলা, বাতাস ভারী হয়ে আছে।

—কে মারল ওকে?

—মিতাকে সব জানিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাই ওকে শেষ করে দিয়েছে। এত বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এত বড় সাম্রাজ্যকে হানিফের মতো কীটের জন্য ধ্বংস হতে দেই কি করে?

ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। শেকলগুলোতে আব্রাহামের হাত কাঁপতে লাগল। প্রতিটি শব্দ যেন একটি ধারালো ছুরি হয়ে মেঝেতে, কল্পনায় এবং আব্রাহামের মনের ভেতরে ঘা কেটে দিচ্ছিল।

—ক’জনকে মারবি তোরা? একদিন সব সত্যি মিতা জানতে পারবে। সেদিন তোদের পালানোর কোনো পথ থাকবে না, এ্যাডাম।

এ্যাডামের ঠোঁটের এক কোণে হালকা বিদ্রূপমিশ্রিত হাসি ফুটে উঠল। সে ধীরে ধীরে আব্রাহামের দিকে এগিয়ে আসে, কণ্ঠে উত্তেজনা:

—হানিফ জানাতে চেয়েছে, তাই ওকে সরিয়ে দিয়েছে। আর কে জানাতে চাইবে মিতাকে? তুই জানাবি ওকে?

শব্দগুলো ঘরের চারপাশে প্রতিধ্বনি করে, যেন প্রতিটি কোণে ভয়, অস্থিরতা, এবং অদৃশ্য হুমকি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আব্রাহামের বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিলো

— আমার আর মিতার মাঝে যে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে তাকেই দুনিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে আব্রাহাম।

কথাগুলো পুরো ঘরজুড়ে বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করল। আব্রাহাম এবং এ্যাডাম দুজনে তাকালো দরজার দিকে। দেখল হুডি পরিহিতা এক ভয়ংকর মানবকে। Mr. A ওরফে আরাভ শেখকে।

__________________

—মিতাকে আমি আদনানের কাছ চড়া দামে কিনতে চাইলাম। আদনান বেচল না। তার বউটাকে নাকি সে ভীষণ ভালোবাসে। অথচ আমি, তার বউয়ের ছবি দেখে, মাতাল হয়ে গেলাম। ওর বউটাকে আমার যে করেই হোক চাই—ই চাই। আদনান সরাসরি দেবে না। আমি বুঝে ফেললাম। তাই আদনানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলাম।
তারপর তো, প্ল্যান মোতাবেক মিতা রাশিয়ায় চলে এলো পড়াশোনা করতে। তোকে আর সায়মাকে রাখলাম মিতাকে দেখেশুনে রাখার জন্য। কিন্তু, তোরা আমার সঙ্গে গাদ্দারি করলি। তোরা যদি সত্যিই ওর খেয়াল রাখতি তাহলে ও নির্বাণের খপ্পরে পড়ত কি করে? ওই শালা তো মরার আগে প্যাচ লাগিয়ে মরল।
তো, সে যাই হোক। মিতাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, তুই মিতাকে অন্য চোখে দেখিস। এখন বল তো—তখন আমার কেমন লেগেছিল! নয়বছর ধরে যাকে পাওয়ার জন্য এত পাপ করেছি, সেই তাকে তোর মতো একটা ছোটশ্রেণীর মানুষ চোখে হারাচ্ছে। সেদিন মিতা সামনে ছিল বলে, নয়ত তোর কাটা মাথা দিয়ে আমি ফুটবল খেলতাম।
নিজেকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমি চলে এলাম। কিন্তু ওই বিচ সায়মা কও করল! মিতার তালে তাল মিলিয়ে ওকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। বাংলাদেশে গিয়ে এই মেয়ে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে শঙ্খচূড় সাপ বের করে আনল। আমি যদি সেদিন হানিফকে দিয়ে ওকে কিডন্যাপ না করাতাম, তাহলে এতদিনে আমার সব বিজনেস ধ্বংস হয়ে যেত। এবং মিতাকে আমি পেতাম না।
তুই জানিস, এই মিতাকে বোঝানোর জন্য মিথ্যা সাজানো বানোয়াট ঘটনাকে সত্য নাটক হিসেবে রুপান্তর করলাম।
আমি আমার একটা শীপের মায়া ছেড়ে দিয়েছি শুধুমাত্র মিতার জন্য। যাতে সে নিজ চোখে দেখতে পায় ওকে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে, আমি ওকে আমার শীপে উদ্ধার করে এনেছি। তারপর আরও একটা ঘটনা সাজালাম। প্রশাসনের লোকের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এবার তাকে নিয়ে সমুদ্র থেকে সোজা হেলিকপ্টারে ঢুকে তুরস্কে পৌঁছালাম। সেখানে নাটকীয় ঘটনা ঘটল। অথচ মিতার কাগজপত্র আমি আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলাম। মিতা সেদিন ঘোরের মধ্যে সব মেনে নিল। নিজের পরিচয় বদলে ফেলল, যাতে ওর পরিবার বাংলাদেশে সুরক্ষিত থাকে।
একটা শীপের দাম কত জানিস? মিতাকে পাওয়ার জন্য আমি শীপের মায়া ছেড়ে দিয়েছি। আর সেখানে তোর জানের কত মূল্য, আব্রাহাম?

আরাভের কথাগুলো শেষ হবার পর। আব্রাহাম কিছুটা সময় নিয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল,

–মিতা, তোর পাপ এবং কালো অধ্যায়ের কথা জানলে কি করবে? জানিস?

আব্রাহামের চোখে ক্ষোভের আগুন, কণ্ঠে নড়েচড়ে ওঠা উত্তেজনা। ঘরটা নীরব, কিন্তু শব্দগুলো প্রতিধ্বনি করে শেকলগুলো, মেঝের পুরোনো কাঠ—সব মিলিয়ে ঘরটা যেন আরও ভীতিকর হয়ে উঠল।

আরাভের চোখেমুখে হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে।

—মিতাকে আমার কালো অধ্যায় জানাবে এমন মানুষদের আমি দুনিয়ায় রাখব কেন? প্রথমে গেল নির্বাণ, এরপর হানিফ। আর আজ, তুই যাবি, আব্রাহাম।

আব্রাহামের দেহ নিস্তব্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে রইল। শ্বাসের শব্দ থেমে গেল। ধুলো, রক্ত এবং শেকলের ধাতব শব্দ মিলিয়ে এক নিঃশব্দ হত্যার দৃশ্য তৈরি হলো। Mr. A ধীরে ধীরে পেছনে হেঁটে গেল, চোখে অমোঘ নীরবতা।

ঘরটা আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো, তবে সেই নীরবতা কেবল মৃত্যু এবং অদম্য শক্তির সাক্ষী হিসেবে রইল।

—মেরে ফেললে!

এ্যাডামের চোখে অবিশ্বাস, কণ্ঠে শিরশিরানি।

এ্যাডাম আরাভকে প্রশ্ন করল। আরাভ ওর ঠোঁটের কোণে আব্রাহামের শরীর থেকে ছিটকে আসা রক্ত মুছতে মুছতে বলল,

–হ্যা, ফেললাম। মিতার চোখে আমি আমার জন্য কেবল ভালোবাসা দেখতে চাই, এ্যাডাম। যেই মিতার চোখে আমার জন্য ঘৃণার জন্ম দিতে চাইবে, তাকে আমি সরিয়ে দেব।

আরাভের চোখে অশান্ত আগুন, হাসিতে এক অমোঘ, সাইকো আভা। এ্যাডামের দেহ কাঁপতে লাগল।
শ্বাস আটকে গেছে। মনে হলো, এই মুহূর্তে তার জীবন শেষ হতে চলেছে।

আরাভ ধীরে ধীরে এ্যাডামের দিকে এগিয়ে এল। আরাভের হাসি ভয়ঙ্কর, রহস্যময়। এ্যাডাম বুঝতে পারল, তার প্রতিটি নিঃশ্বাস আরাভের নিয়ন্ত্রণে।
ঘরটা নীরব, শুধু Mr. A-এর নিঃশব্দ শক্তি এবং রক্তের গন্ধ। এ্যাডামের ভয়, আতঙ্ক এবং মৃত্যু সব মিলিয়ে ঘরের অন্ধকারকে আরও গভীর ও দমবন্ধ করা করে তোলে।
_____________

এ্যাডামকে মেরে ফেলেছে আরাভ। তারপর, তাদের লাশকে নিজ হাতে টুকরো টুকরো করে পুরো জঙ্গলে ছড়িয়ে দিলো আরাভ। পুরো জঙ্গল তখন অমাবস্যায় ঢাকা। আরাভ তিমিরে ঢাকা এই জঙ্গলে চষে বেড়াচ্ছে আর আব্রাহাম এবং এ্যাডামের দেহাবশেষের টুকরোগুলো ছরিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। অদূর থেকে ভেসে আসছে কিছু হিংস্র জন্তুর আগমনের আভাস। আজ আবারও কিছু হিংস্র পশুকে ধরা হবে আরাভের রিসার্চ সেন্টারের জন্য। এটা সেই জঙ্গল, যেখানে একবার ভাল্লুককে খাঁচায় বন্দি করেছিল।

চমৎকার পরিকল্পনা, নির্দয় নিখুঁততা এবং তিমির জঙ্গলের মধ্যে আরাভ যেন এই জঙ্গলের রাজা। চারপাশে রাতের অন্ধকার, পশুর হুংকার এবং রক্তাক্ত মাটি। সব মিলিয়ে সৃষ্টি করছে অমাবস্যার রাতের দমবন্ধ করা দৃশ্য।

_______________

— আপনার বিজনেসটা কিসের Mr. A?

মিতার গলায় মুখ গুঁজে পরে থাকা আরাভ মিতার সঙ্গে আরেকটু ঘনিষ্ঠে এসে বলল,

— তোমাকে কাল আমার অফিসে নিয়ে যাব। তৈরি হয়ে থেকো।

কথাটি বলেই আরাভের নরম ছোঁয়া আর মিতার অস্থির হৃদস্পন্দন এই মুহূর্তকে আরও ঘনিষ্ঠ ও মধুর করে তুলল।

পনেরোদিন হয়েছে মিতাকে নিয়ে আবারও রাশিয়ায় শিফট হয়েছে আরাভ। সায়মার মার্ডার কেইস ডিসমিস হয়ে গেছে তাই মিতাকে নিয়ে আর কোনো ভয় নেই। আরাভ মিতাকে নিয়ে ছুটল ওর রিসার্চ সেন্টারে। রিসার্চ সেন্টারে ঢুকতেই মিতার চোখে পরল বড় একটা ক্যমিকেল ভর্ডত কাচের দিকে। কাচটা সম্পূর্ণ খালি। মিতাকে কাঁচের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাভ বলল,

— এখানে কাজ চলছে মিতা। নতুন ক্যামিকেল আসবে। তখন এই জাড়ে ভর্তি হয়ে থাকবে কেমিক্যালে।

মিতা আরাভের দিকে তাকিয়ে আরেকবার সেই জারটার দিকে তাকালো। যেন বহুচেনা কিছু রয়ে গেছে এখানটায়।

আরাভ অতিদ্রুত মিতাকে নিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। মিতাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রিসার্চ সেন্টার দেখালো। মিতা দেখল এখানে মানবদেহের ঔষুধ নিয়ে গবেষণা করা হয়। অথচ টের পেলো না এই মানবদেহের ঔষধ রিসার্চের আড়ালে কত ভয়ানক এবং অবৈধ ব্যবসা এবং অবৈধ রিসার্চ চলছে পশুপাখিদের নিয়ে। মিতা যদি একটিবার টের পেত। কাচের সেই জার থেকে আদনানের শরীরটাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছি সমুদ্র উপকূলে। যাতে মিতা আজ এই রিসার্চ সেন্টারে এলে আদনানের অক্ষত লাশ দেখতে না পায়।

_____________

মিতা মা হতে চলেছে। নয়মাস চলছে। নতুন জীবনকে বুকে ধারণ করার আনন্দের সঙ্গে ভয়ও জেগেছে। প্রায়ই সে আরাভের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলে

— এই পৃথিবীতে আমার কেউ রইল না, শুধু আপনাকে ছাড়া। যদি আমি মরে যাই, তবে আপনি আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখবেন।

আরাভ চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলে। মিতাকে বুকের মাঝে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। নিঃশব্দে তার মনে এক অদ্ভুত অঙ্গীকার জন্ম নেয়

— আমি তোমার গল্পের নায়ক, আমি তোমার গল্পের খলনায়ক।
তোমার প্রথমজনকে দূরে সরিয়েছি। হয়ে গেছি তোমার দ্বিতীয়জন।
দুঃখ দিয়েছি তোমায়। আর এখন তোমাকে সুখের সাগরে ভাসাচ্ছি।
আমি তোমার দ্বিতীয়জন, আমি তোমার জীবনের চিরন্তন সত্য।
তোমার চোখের জলের কারণ আমি,
আর তোমার ঠোঁটের হাসির কারণও আমি।
যা দুঃখ দেবার আমি দিয়েছি, যা সুখ দেবার আমি দেব।
আর কারো অধিকার নেই তোমার ওপর। কারণ আমি তোমার জীবনে এক এবং অদ্বিতীয়।

মিতা আরাভের বুকের ওপর মাথা রেখে হালকা শ্বাস ফেলল। তার চোখে শান্তি, আর মুখে লাজুক হাসি। আরাভ তার হাত আরও শক্ত করে ধরল, যেন প্রতিটি স্পর্শে বলতে চায়

“আমি সবসময় তোমার সঙ্গে আছি।”

মিতা চোখ বন্ধ করে আরাভের স্পর্শ অনুভব করল। সব ভয়, সব অস্থিরতা, সব অন্ধকার দূরে সরে গেছে। শুধু আছে আরাভ এবং তার সন্তানকে তার স্বপ্ন ।

আরাভ জানে, এই শান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে তার সেই অন্ধকার রহস্য, যা মিতা কখনো জানতে পারবে না। আদনানের মৃত্যু, সব অবৈধ রিসার্চ, এবং তার নিজের নৃশংস সিদ্ধান্ত। কিন্তু মিতার সামনে আছে কেবল ভালোবাসা এবং ভালো মানুষের মুখোশ ।

তার চোখে কেবল মিতার হাসি। আর তার বুকে মিতার নিঃশ্বাস ব্যস এটুকু। এখন আর কিছু চায় না সে।

আরাভ মনে মনে ভাবল,

“যে ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারে, তাকে আমি সরিয়ে দিয়েছি। সকল রহস্যকে আমার হৃদয়ে গোপনে রেখেছি। ”

মিতা চোখ খুলল, আরাভের দিকে তাকাল। আরাভের মুখে মৃদু হাসি, কিন্তু মিতা জানে না, এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার রহস্য। আরাভের হাত তার হাত ছুঁয়েছে, প্রতিটি স্পর্শে গোপন অন্ধকারের ছায়া লুকিয়ে আছে।

মিতার চোখে শুধু ভালোবাসা, আর আরাভের চোখে নিঃশব্দে লুকানো সেই অন্ধকার, যা কখনো প্রকাশ পাবে না।

মিতার হাসি শুধুমাত্র তার জন্যই। মিতা কখনো জানবে না, যে অন্ধকারে তার জীবন ভাসছে, সেই অন্ধকারের মাঝেই লুকিয়ে আছে তার দ্বিতীয়জনের সব নিয়ন্ত্রণ।

সমাপ্ত