#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_2
ভিরান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“মেডিসিন নিয়ে আসো তুরা ব্যাথা পেয়েছে তুমি দেখছো না?”
ছেলের উপর ভীষণ রাগ উঠলেও নির্ভান ছেলে কে ধমক তো দূরে থাক একটু জোরেও কথা বলতে পারে না। তবুও বিরক্তি নিয়ে বলে,
“আমি এখানে হসপিটাল বা ফার্মেসী খুলে বসিনি ভিরান, এটা আমার অফিস।”
“ফাস্ট এইড বক্স তো আছে? ওটা নিয়ে আসো।”
“লাঞ্চ করতে হবে, লাঞ্চের পর মিটিং আছে চলো এখন আমার সাথে।”
“আমি তুরা কে ছেড়ে যাব না, তুরা কে নিয়ে চলো।”
“ভিরান জেদ না করে চলো আমার সাথে।”
ভিরান তুরার এক হাত চেপে ধরে বলে,
“তুরা কে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না পাপা। তুমি লাঞ্চ করে মিটিং শেষ করে আসো, আমি তুরার সাথে এখানেই থাকব।”
“বার বার তুরা তুরা করছো কেন? ও তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়, ওকে আপু বলে ডাকো।”
ভিরান নাক মুখ কুঁচকে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“তুরা আমার আপু না, তুরা আমার আম্মু।”
তুরা আর নির্ভান একে অপরের দিকে তাকায়। তুরা দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ভিরানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ডোরের দিকে এগিয়ে যায়। পেছন পেছন ভিরান যেতে নিলে নির্ভান ভিরানের হাত টেনে ধরে কোলে তুলে নেয়।
ভিরান বাবার কোলে চড়ে বাবা কে ডোরের দিকে যেতে বলে,
“পাপা তুরা কে আটকাও, তুরা চলে গেল। তোমার ওয়াইফ চলে গেল।”
নির্ভান বলে না কিছু আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। তুরা চলে যায় দৃষ্টির আড়ালে।
ভিরান বাবার কোল থেকে নামার জন্য ছোটাছুটি করে বলে,
“পাপা ছাড়ো আমাকে, তুরা চলে গেল। আমি তুরা কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব।”
নির্ভান ছেলে কে শান্ত করার জন্য বলে,
“পাপা তুমি না গুড বয়, তুমি তো বুঝদার ছেলে। তুরা আমাদের সাথে কেনো যাবে? তুরা তুরার বাড়িতে যাবে ওর বাবা মায়ের কাছে। এখন চলো আগে আমরা লাঞ্চ করবো তারপর মিটিং।”
ভিরান অভিমানী স্বরে বলে,
“তুরা কে ছাড়া আমি খাব না। তুরা কে এনে দাও, আমার তুরা কে চাই।”
“দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তুমি তুরার মধ্যে কি দেখলে? এর আগে কয়েক জন কে তো দেখানো হয়েছিল তুমি সবাই কে রিজেক্ট করেছ।”
“ওদের ভালো লাগেনি আমার। তুরা ওদের সবার থেকে আলাদা। তুরা সুন্দর করে কথা বলে, দেখতে কিউট, পরীর মতো। ফেয়ারি টেল মুভি তে দেখা কুইন গুলোর মতন সুন্দর। তুরা কে আমি তোমার কুইন বানাবো পাপা, ওকে এনে দাও তুমি। তুরা তোমার ওয়াইফ।”
ছেলে কে বেডে বসায় নির্ভান, নিজেও বসে পাশে। ছেলে কে বোঝানোর জন্য বলে,
“তুরা আমার ওয়াইফ না পাপা, তুরা অনেক ছোট। তুরা তোমার পাপার কুইন হতে পারবে না।”
“কে বলেছে তুরা ছোট? তুরা অনেক বড়, অনেক লম্বা। তুরার হাইট তোমার কাঁধ পর্যন্ত।”
“পাপা তুরার বয়স কম। ওর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। চলো আমরা লাঞ্চ করবো, লেট হয়ে যাচ্ছে।”
ভিরান শোনে না বাবার কথা। অভিমানে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নির্ভান হাজার ডাকলেও ফিরে তাকায় না। জেদী ছেলের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায় নির্ভান। ছেলে টা এতো জেদী হয়েছে পুরো ওরই কার্বন কপি। এখন নির্ভান নিজের জেদ কমালেও ছেলের জেদ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নির্ভান চৌধুরী বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বয়স একত্রিশ বছর। হাইট ছয় ফুট, উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ। মাথা ভর্তি ঘন কালো সিল্কি চুল, দুই গাল ভর্তি ঘন কালো চাপ দাড়ি। ছোট বেলা থেকেই গম্ভীর চুপ চাপ রাগী জেদী মানুষ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলার অভ্যাস নেই। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছিল সমবয়সী সুন্দরী রূপসী এক মেয়ে কে। বিয়ের পর দুজনের সংসার জীবন ভালোই কা’টছিল। বিয়ের বছর পেরোনের আগেই বাবা হওয়ার সুসংবাদ পেয়েছিল।
ভিরান কে জন্ম দেয়ার দুই মাস আগে নির্ভানের ওয়াইফ সুহানার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে।
হুট করে একদিন নাক মুখ দিয়ে র’ক্ত এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে সুহানা। ডক্টর দেখিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা টেস্ট করার পর ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য কয়েক দিনের মধ্যেই দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। সুহানা তখন ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে ছিল। সেদিনের আগে কোনো রকম অসুস্থতা বা ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা যায় নি। দেশের বাইরে নিয়ে গেলেও সুহানা কে সুস্থ করে আর দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ছেলে কে জন্ম দেয়ার পনেরো দিন পর জীবনের মায়া ত্যাগ করে চিরো দিনের জন্য চলে যায় সুহানা। জীবিত মানুষ দেশের বাইরে নিয়ে গেলেও ফিরে আসে কফিনে নিয়ে।
স্ত্রী কে হারিয়ে শক্ত হৃদয়ের গম্ভীর নির্ভান চৌধুরী পাথর হয়ে যায়। ছেলে কে নিয়েই গড়ে ওঠে ওর পুরো দুনিয়া।
আস্তে আস্তে সময় গড়ায়। দুই পরিবারই চেয়েছিল নির্ভান যেন আবার বিয়ে করে। জীবন কে নতুন ভাবে সাজায়। তবে কেউ নির্ভান কে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর জন্য তখন রাজি করাতে পারেনি।
ছেলে, বাবা-মা আর বিজনেস নিয়েই নির্ভানের দিন পেরিয়ে এত দূর এসেছে।
গত কয়েক মাস ধরে হুট করে ভিরানের মাথায় বাবা কে বিয়ে করানোর ভূ’ত চেপেছে। ভিরান কেনো এমন বলছে বা করতে চাইছে তার কোনো উত্তর কেউ পায়নি এখনো। জিজ্ঞেস করলেও ভিরান কিছু বলে না। বার বার এক কথা ওর পাপার জন্য ওয়াইফ নিয়ে আসবে। ছেলের জেদের কারণে বেশ কয়েক জন মেয়েও দেখা হয়েছে তবে তাদের মধ্যে থেকে কাউকেই পছন্দ হয়নি ভিরানের। আজকে হুট করে তুরা কে পছন্দ হয়েছে। এখন জেদ ধরে বসে আছে ওকেই নিজের বাবার ওয়াইফ বানাবে।
নির্ভান ছেলে কে আবার ডেকে বলে,
“পাপা চলো মিটিং এর সময় হয়ে আসছে তো।”
ভিরান ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায়। অভিমানী স্বরে বলে,
“যাব না আমি, খাব না আমি। আমার তুরা কে চাই।”
“তুমি না বুঝদার ছেলে পাপা, এত জেদ করছো কেন? তুরা কে ওর বাবা-মা আমাদের সাথে যেতে দেবে না।”
“তাহলে ওর বাবা-মায়ের কাছ থেকে তুরা কে কিনে নিয়ে চলো।”
ছেলের কথা শুনে হতাশার শ্বাস ছারে নির্ভান।
ছেলে কে বোঝানোর জন্য বলে,
“তোমাকে যদি কেউ পছন্দ করে আর সে তোমাকে কিনে তার কাছে নিয়ে যেতে চায় তাহলে কি আমি তোমাকে তার কাছে বিক্রি করে দিব? দিব না তো, ঠিক তেমনি তুরার বাবা মাও তুরা কে বিক্রি করবে না।”
“বিক্রি না করলে চেয়ে নিয়ে যাব।”
“তাও দেবে না। এখন চলো আমার সাথে, এই বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো।”
ছেলে কে কোলে তুলে নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায় নির্ভান।
______________
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে কারো সাথেই কথা বলছে না ভিরান। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিচ্ছে না। নির্ভান ফ্রেস করিয়ে দেয়ার জন্য রুমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ভিরান যায় না। সোফার এক কোণায় রাগ করে বসে রইলো।
ভিরানের দাদা নওশাদ চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“দাদু ভাইয়ের কি হয়েছে? মুড অফ কেন?”
“দুপুর থেকে পা’গ’ল বানিয়ে রেখেছে আমাকে। মিটিং টাও ঠিক মতো করতে দেয়নি আজ।”
“কেনো কি হয়েছে?”
“জিজ্ঞেস করো তোমার দাদু ভাইয়ের কাছেই। আমি ফ্রেস হতে গেলাম।”
নির্ভান চলে যায় রুমের দিকে, এক প্রকার পালিয়ে গেল এখান থেকে। এখানে থাকলে ছেলের আজগুবি সব কথা শুনতে হবে।
নওশাদ চৌধুরী নাতির পাশে বসেন। নাতির এক হাত মুঠো করে ধরে বলেন,
“দাদু ভাই কি হয়েছে বলো আমাকে?”
“পাপার অফিসে আজকে তুরা কে দেখেছি আমি। ওকে আমার পছন্দ হয়েছে ভীষণ। তুরা অনেক সুন্দর করে কথা বলে, ওকে দেখতেও অনেক বেশি সুন্দর আর কিউট একদম ফেয়ারি টেল মুভি তে দেখা কুইন গুলোর মতন সুন্দর তুরা। পাপা কে বললাম তুরা কে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু পাপা ওকে নিয়ে আসেনি। আমাকেও আর তুরার কাছে যেতে দেয়নি। তুরা হারিয়ে গেছে। আমি তুরা কে চাই, ওকে আমি পাপার কুইন বানাবো, তুমি তুরা কে এনে দাও নয়তো আমি আর খাব না পড়াশোনাও করবো না।”
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে ভিরান। নির্ভানের উপর ভীষণ ভীষণ রেগে আছে। অফিস থেকে বের হওয়ার পর নির্ভানের সাথে একটা কথাও বলেনি।
দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
“দাদু ভাই চলো না তুরা কে নিয়ে আসি।”
“তুরার বাড়ি কোথায় জানো কিছু?”
“নো।”
“তুরার বাবার নাম?”
“তোমার ছেলের জন্য কিছুই জানতে পারিনি। তোমার ছেলের জন্য তুরা দুবার করে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে। তোমার ছেলে তুরা কে মেডিসিন দেয়নি।”
“তুরা কে মেডিসিনও দেয়নি?”
“নো।”
“আমার ছেলে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে।”
“তুরা কে এনে দাও।”
“আগামী কাল আমি তোমার পাপার অফিসে যাব, তারপর তুরা কে খুঁজে বের করে তোমার পাপার কুইন বানিয়ে নিয়ে আসবো ওকে!”
“সত্যি?”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
_______________
বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে তুরা। ওর মা মুক্তা শিকদার ওর দুই পা ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন।
ডক্টর দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছে ওকে।
মুক্তা শিকদার দশম বারের মতন মেয়ে কে জিজ্ঞেস করেন কিভাবে পড়েছিল?
তুরা দুপুরের সেই মুহূর্ত কল্পনা করে। কল্পনায় নির্ভান কে দেখেই গা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মু আমি আর জীবনেও আব্বুর অফিসে যাব না, কোনো দিনও না।”
চলবে…………..