#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_4
নির্ভান গাড়িতে উঠে বসে ভিরান কে কোলে নিয়েই।
পাশে বসেন নওশাদ চৌধুরী।
নির্ভানের কোল থেকে ভিরান কে নিজের কোলে তুলে নেন নওশাদ চৌধুরী। নির্ভানের ফোন নিয়ে তুহিন শিকদারের ফোনে কল করেন নওশাদ চৌধুরী।
একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। নওশাদ চৌধুরী বেশি কিছু না বলে সরাসরি বাসার এড্রেস জানতে চান।
তুহিন শিকদার বসের কথা শুনে নিজের বাসার এড্রেস বলে দেন।
নির্ভান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেট পেরিয়ে বেরিয়ে যায়। ভিরান এখন আর কাদঁছে না। যখন শুনেছে তুরার কাছে যাচ্ছে তখন থেকেই চুপ হয়ে আছে। বাবার রাগ দেখে হেঁচকি তুলছে শুধু।
বেশি দূরে না হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই দশ তলা একটি ভবনের সামনে এসে রাস্তার ওপর পাশে দাঁড়ায় নির্ভানের গাড়ি।
নওশাদ চৌধুরী ভিরান কে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ান। নির্ভান গম্ভীর থমথমে গলায় বলে,
“ওকে দেখা করিয়ে নিয়ে আসো আমি এখানে ওয়েট করছি।”
নওশাদ চৌধুরী কিছু বলেন না। ভিরান কে কোলে নিয়ে গেটের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখেন তুহিন শিকদার বেরিয়ে আসছেন ভেতর থেকে।
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“স্যার কিছু কি হয়েছে?”
“না না তেমন কিছু হয়নি। আপনি গত কাল আপনার মেয়ে তুরা কে অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন ভিরান তুরা কে দেখেছিল। আজকে তুরার কাছে আসার জন্য কেঁদে কে টে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই তুরার সাথে দেখা করানোর জন্য ওকে নিয়ে এসেছি। যদি অনুমতি দেন তাহলে ওকে একটু তুরার কাছে নিয়ে যেতাম।”
“এসব কি বলছেন স্যার? এমন কথা বলে লজ্জা দেবেন না আমাকে। চলুন ভেতরে চলুন। দাদু ভাই তুমি আমার কাছে আসো।”
ভিরান তুহিন শিকদারের কোলে চলে আসে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি তুরা কে নিয়ে যাব আমাদের সাথে।”
ভিরানের কথা শুনে মুচকি হাসেন তুহিন শিকদার। অফিসে ভিরানের পাকা পাকা কথা শোনেন প্রায় সময়। ভিরানের কথা গুলো ওনার বেশ লাগে। অফিসের সবাই ভিরান কে পছন্দ করে ওর এই কথার জন্যই।
বাইরে যে নির্ভানও আছে তুহিন শিকদার বুঝতে পারেননি। ভেবেছেন ড্রাইভারের সাথে এসেছেন নওশাদ চৌধুরী।
নির্ভান স্টিয়ারিং এর সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে ছেলে কে বকা দেওয়া আর চিৎকার করে কথা বলার জন্য। অপরাধ বোধ হচ্ছে এখন, নিজেকে নিজেরই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিভাবে পারলো ছেলে কে ওভাবে কথা গুলো বলতে? এত রাগ কেন? ছোট মানুষ, অত কিছু কি বোঝে?
______
ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে তিন জন। তুহিন শিকদারের কোল থেকে নেমে যায় ভিরান। সোফায় বসে আছে তুরা। টিভির দিকে তাকিয়ে আছে আর চিপস্ খাচ্ছে।
ভিরান তুরার নাম ধরে ডেকে দৌড় দেয় সোফার দিকে।
চমকে উঠে ডোরের দিকে তাকায় তুরা। ভিরান দৌড়ে এসে তুরা কে জড়িয়ে ধরে। তুরা হা হয়ে ডোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নওশাদ চৌধুরী কে চেনে তুরা, ওর বাবার অফিসের বস ইনি যদিও কয়েক বছর ধরে নির্ভান বস।
“তুরা কেমন আছো তুমি? তোমাকে নিতে এসেছি আমরা।”
তুরা ভিরানের মুখের দিকে তাকায়। তুরার মুখের ভেতর এখনো চিপস্ রয়েছে, এক হাতে প্যাকেট অন্য হাতে দুটো চিপস্ ধরে রাখা।
তুরা মুখের চিপস্ দ্রুত গিলে নিয়ে বলে,
“ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?”
“ফাইন, তুমি কিন্তু আজকে যাবে আমার সাথে।”
তুরা হা করে বাবার মুখের দিকে তাকায়। উনি হয়তো ভিরানের কথা গুলো শুনতে পাননি।
তুহিন শিকদার আর নওশাদ চৌধুরী সোফায় বসেন।
কিচেন থেকে বেরিয়ে আসেন মুক্তা শিকদার। হাতে ট্রের উপর দুটো জুসের গ্লাস।
অফিসের বস আসছেন শুনে নাস্তা পানির ব্যবস্থা করছিলেন এতক্ষণ।
তুহিন শিকদার বসের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ও আমার স্ত্রী মুক্তা শিকদার।”
মুক্তা শিকদার বসের দিকে তাকিয়ে সালাম দেন। নওশাদ চৌধুরী সালামের জবাব দিয়ে বলেন,
“কেমন আছেন?”
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
তুহিন শিকদার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ও ভিরান চৌধুরী, স্যারের নাতি।”
ভিরানের দিকে আবার দৃষ্টি দেন মুক্তা শিকদার। তিনি প্রথম থেকেই জানেন ভিরান আর নির্ভানের জীবন কাহিনী। ভিরান কে অনেক দেখার ইচ্ছে ছিল ওনার কিন্তু কখনও দেখতে পাননি, আজকেই প্রথম দেখছেন। পুরো চৌধুরী পরিবারের জন্য অনেক মায়া হয় ওনার বিশেষ করে ভিরান আর নির্ভানের জন্য।
নওশাদ চৌধুরী কিছু খেতে না চাইলেও জোর করে ওনাকে জুস খেতে দেন মুক্তা শিকদার।
তুরা ভিরান কে নিজ হাতে জুস খাইয়ে দেয়। ভিরান অল্প খেয়ে আর খায় না বাকি টুকু জোর করে তুরা কে খাইয়ে দেয় নিজেই।
তুরা কে কাছে পেয়ে ভিরানের মুখ থেকে হাসি দূর হচ্ছে না। বার বার তুরার নরম গালে চুমু খাচ্ছে আবার ওর গালে তুরা কে চুমু দিতে বলছে। একবার গলা জড়িয়ে ধরছে আবার বুকে মাথা রেখে চুপ হয়ে বসছে।
ভিরানের কর্মকাণ্ড দেখে তিন জন হাসছেন।
নওশাদ চৌধুরী তুহিন শিকদারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আপনার একটাই মেয়ে?”
“ছেলে আছে, পড়াশোনার জন্য স্পেনে রয়েছে বর্তমানে। সামনের মাসে দেশে ফিরবে।”
“ওহ।”
মুক্তা শিকদার বলেন,
“স্যার ডাইনিং টেবিলে আসুন।”
“না না কি বলছেন এসব! এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যস্ত হবেন না।”
তুহিন শিকদার বলেন,
“স্যার আজকে প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন, না খেয়ে যেতে পারবেন না। অল্প সময়ের মধ্যে খুব বেশি কিছু করতে পারিনি।”
“কিচ্ছু করতে হবে না তুহিন সাহেব, ব্যস্ত হবেন না আপনারা। শুধু মাত্র ভিরানের জন্য এসেছি।”
“তা বললে হবে না স্যার, প্লীজ আসুন।”
অনেক জোরাজুরির পরেও নওশাদ চৌধুরী খেতে রাজি হন না।
মুক্তা শিকদার অল্প অল্প নাস্তা বেড়ে ড্রয়িং রুমেই নিয়ে আসেন। জোরাজুরিতে না পেরে শেষে অল্প অল্প খান।
তুরা ভিরান কে খাইয়ে দেয়। খাওয়ার সময় একটুও দুষ্টামি করে না ভিরান, চুপ চাপ খায়। খাওয়ার মাঝে মাঝে অদক্ষ হাতে তুরা কেও খাইয়ে দেয়।
খাওয়া দাওয়া শেষে ভিরান কে নিয়ে যখন নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাবেন তখন ভিরান আর তুরা কে ছারে না। তুরা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি তুরা কে নিয়ে যাব আমাদের বাড়িতে।”
নওশাদ চৌধুরী বলেন,
“দাদু ভাই তুরার বাড়ি এটাই, তুরা আমাদের সাথে যাবে না। তুমি চলো আমরা পরে আরেক দিন আসবো।”
“না, তুরা কে আমি আজকেই নিয়ে যাব। ওকে আমি আমার পাপার কুইন বানাব। তুরা চলো পাপা ওয়েট করছে আমাদের জন্য।”
ভিরানের কথা শুনে তুহিন শিকদার আর মুক্তা শিকদার অবাক হয়ে গেছেন। দুজনেই হা হয়ে তাকিয়ে আছেন তুরা আর ভিরানের দিকে। ভিরান ওনাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুরা কে আমার পাপার কুইন বানাব। তুরা কে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ওকে আমরা নিয়ে গেলাম তোমরা কান্না করো না। তুরা চলো।”
তুরা আস্তে আস্তে বলে,
“এসব তুমি কি বলছো ভিরান? আমি কোথাও যাব না তুমি যাও তোমার দাদু ভাইয়ের সাথে।”
“না না আমি তোমাকে নিয়েই যাব। আমরা তো তোমাকে নেয়ার জন্যই এসেছি। তুমি আমার পাপার ওয়াইফ হবে তারপর আমরা তিন জন একসাথে ঘুমাব রাতে।”
তুরার মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তুহিন শিকদার আর মুক্তা শিকদারের চোখ মুখও যেন কেমন হয়ে গেছে। নওশাদ চৌধুরী পরিস্থিতি সামাল দিতে বলেন,
“ভিরান বাচ্চা মানুষ তাই এমন উল্টা পাল্টা বলছে। তুরা কে ওর কাছে ভালো লেগেছে তাই এমন জেদ করছে। আপনারা কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”
মুক্তা শিকদার বলেন,
“ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি স্যার।”
“ভিরান চলো এখন, তোমার টিউটর তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বোধহয়।”
“আমি তুরা কে ছাড়া যাব না। তুরা পাপার ওয়াইফ হবে আমার মাম্মি হবে। তুরা চলো, তুমি উঠছো না কেন?”
তুরা ভিরান কে কোল থেকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলে,
“ভিরান তুমি এখন বাড়িতে যাও আমরা পরে আবার দেখা করব।”
“না না তুমি এখনই যাবে আমার সাথে। পাপা এখানে আসো তোমার ওয়াইফ কে কোলে তুলে নিয়ে যাও।”
শেষের কথা গুলো চিৎকার করে বলে ভিরান।
উপস্থিত চার জন হতভম্ভ।
লজ্জায় ম’রি ম’রি অবস্থা তুরার। এ কোন ফ্যাসাদে ফেঁসে গেছে? এই ছেলে ওর পিছু কেনো ছাড়ছে না?
নওশাদ চৌধুরী ভিরান কে জোর করে নিজের কাছে নেয়ার চেষ্টা করেন। ভিরান শক্ত করে তুরা কে আঁকড়ে ধরে গলা ফাটিয়ে কাদতে শুরু করে।
এ কোন মুসীবত?
ভিরান চিৎকার করে কাদতে কাদতে বলে,
“তুরা কে ছাড়া আমি যাব না, যাব না, যাব না। তুরাম্মা চলো আমার সাথে।”
ভিরানের মুখে এমন সম্বোধন শুনে স্তব্ধ তুরা সাথে বাকি তিন জন। নাতি কে ছেড়ে দেন নওশাদ চৌধুরী। ভিরান চার হাত পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে তুরা কে। তুরা কে শক্ত করে ধরে রেখে বলে,
“তুরাম্মা চলো আমাদের সাথে। আমার পাপা অনেক ভালো তোমাকে অনেক ভালোবাসবে আদর করবে।”
তুরা ফ্যাল ফ্যাল করে বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ওনারাও কেমন করে যেন তাঁকিয়ে আছেন।
নওশাদ চৌধুরী অনুরোধের স্বরে বলেন,
“ভিরান দুপুরে ঘুমায়নি, তুমি ওকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও, আমি নিয়ে চলে যাই।”
“আমি ঘুমাব না, আমার পাপার ফেয়ারী টেল কুইন আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। আমাদের প্যালেসের কুইন হবে তুমি।”
নওশাদ চৌধুরী বলেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি যা বলবে তাই হবে। এখন তোমার তুরা কে নিয়ে ঘুমিয়ে যাও, তুরার ঘুম পেয়েছে এখন।”
“পাপার কুইন তোমার ঘুম পেয়েছে?”
মাথা নাড়ায় তুরা। ভিরান বলে,
“পাপার কাছে চলো, পাপা তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে।”
তুরা বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ওনাদের দুজনের চোখ মুখ গম্ভীর থমথমে হয়ে গেছে।
তুরার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে।
মুক্তা শিকদার তুরা আর ভিরান কে নিয়ে তুরার রুমে আসেন। বিছানা ঠিক করতে করতে বলেন,
“ওকে দ্রুত ঘুম পাড়িয়ে দে নিয়ে চলে যাক। ঘুম পাড়াতে পারবি তো?”
তুরা ঠোঁট উল্টে বলে,
“কিভাবে ঘুম পাড়াতে হয় আমি তো জানি না আম্মু।”
“বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মৃদু ভাবে চাপড় দিতে থাকবি তাহলে ঘুমিয়ে পড়বে দ্রুত।”
“আচ্ছা।”
মুক্তা শিকদার বেরিয়ে যান রুম থেকে। ভিরান যত দ্রুত ঘুমাবে ততই ভালো। এই ছেলে যা শুরু করেছে না ঘুমালে জীবনেও যাবে না।
তুরা নাইট ল্যাম্প অন করে বড় লাইট অফ করে দেয়।
ভিরান কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। ভিরান তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“পাপা কে ডাকো আমরা তিন জন একসাথে ঘুমাব। পাপা নিচে ওয়েট করছে আমাদের জন্য। পাপার লম্বা হাত, আমাদের দুজন কে একসাথে জড়িয়ে ধরতে পারবে।”
তুরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এই ছেলে যেভাবে কথা বলছে মনে হয় না আজকে রাতে ঘুমাবে। ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে তুরা নিজেই ঘুমিয়ে যাবে।
চলবে…………