#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_9
তুরা ঘুমিয়ে আছে অথচ ওর চোখ অর্ধেক খোলা রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে তাঁকিয়ে আছে।
তুরা যখন ঘুমালো তখন চোখ পুরোপুরি বন্ধ ছিল, একটু পর থেকেই একটু একটু করে খুলতে খুলতে অর্ধেক খুলে গেছে। যে কেউ দেখলে বলবে এই মেয়ে তাঁকিয়ে আছে।
তুরার তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে ঘুমোনো দেখেই নির্ভানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। স্বচক্ষে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখেনি এভাবে ঘুমোতে।
নিজের অজান্তেই নির্ভান হাত বাড়ায় ফোনের স্ক্রিনে। হাতের আঙ্গুল দুটো ভি শেপ করে তুরার অর্ধ মেলে রাখা চোখ দুটো বন্ধ করে দিতে চায়। ফোনের স্ক্রিনে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিলেও তুরার চোখ বন্ধ হয় না। নিজের বোকামিতে নিজেই হাসে আবার। এভাবে কি কোনো দিন কারো চোখ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব?
নির্ভানের মস্তিষ্ক ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেও মন চাইল না। কিছু সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত তুরার মুখের দিকে।
তাঁকিয়ে থাকতে থাকতে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে নির্ভানের জানা নেই। এতক্ষণ যেন নিজের মধ্যেই ছিল না। হারিয়ে গিয়েছিল অন্য এক জগতে।
ফোনের লাইন কে টে দেয়। বড় লাইট টা রিমোট দিয়ে অফ করে চোখ বন্ধ করে নেয়। অন্যের মেয়ের দিকে এভাবে তাকানো নিষেধ।
চোখ বন্ধ করে রাখলেও চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না।
শুয়ে থেকেও ভালো লাগছে না। ছেলে কে আলগোছে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে। গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দুই পাশে দুটো কোল বালিশ দিয়ে দেয় গায়ের সাথে ঠেকিয়ে।
নিঃশব্দে বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়।
ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় বেলকনিতে। চারো দিকে নজর বুলায়, আকাশে উড়ো সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। অল্প কিছু তারা ঝলমল করছে। বাগানের দিকে চোখ পড়তেই দেখে জোনাকি পোকা উড়ছে। পেঁচার ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে।
দুই হাতে বেলকনির গ্রিল ধরে মুখ তুলে আবার আকাশের দিকে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে,
“আল্লাহ আমার সুহানা কে ভালো রেখো। আমার ছেলেটার মন মস্তিষ্ক থেকে তুরার ভূ/ত বের করে দাও।”
অদৃশ্য কেউ একজন ফিসফিস করে বলে,
“তুরা কে তুমি আপন করে নাও, আমি খুব খুশি হব নির্ভান।”
ফট করে পেছন ফিরে তাকায় নির্ভান। উহু কেউ নেই আশে পাশে। এটা নির্ভানের মনের ভুল। বেতের চেয়ারে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। যত দ্রুত সম্ভব তুরার কাছ থেকে দূরে সরাতে হবে ভিরান কে।
___________
অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে নির্ভান। ছেলের কথা মনে পড়ছে খুব। অন্য দিন গুলোতে এই সময় ওর কাছেই থাকতো।
ফোন হাতে তুলে নেয়। তুহিন শিকদারের কাছ থেকে গত কাল মুক্তা শিকদারের নাম্বার নিয়েছিল।
ইতস্তত বোধ হলেও ছেলের সাথে কথা বলার ইচ্ছে দমন করতে ব্যার্থ হয়। কল করেই ফেলে নাম্বার টায়।
রিসিভ হয় একটু পরেই।
নির্ভান সালাম দিয়ে বলে,
“আন্টি ভিরান কি করছে?”
“খেলছে।”
“খেয়েছে?”
“একটু আগেই খাওয়া শেষ হলো।”
“ভিডিও কল দিচ্ছি, ভিরানের কাছে একটু দিন।”
“আচ্ছা।”
মুক্তা শিকদার তুরার রুমে আসেন। ভিরান বেডের উপর বসে তুরার সাথে হুড়োহুড়ি করে খেলছে। একজন আরেক জন কে কাতুকুতু দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে।
মুক্তা শিকদার ভিরানের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“ভিরান তোমার আব্বু কল করেছে কথা বলো।”
“দাও।”
ফোন মুখের সামনে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে হাসি মুখে বলে,
“পাপা কেমন আছো?”
নির্ভান হেসে বলে,
“ভালো আছি পাপা, তুমি কেমন আছো?”
“ভালো, এই যে দেখো তুরা। নাও তুরার সাথে কথা বলো।”
“না না আমি তো তোমার সাথে কথা বলার জন্য কল করেছি। তুমি কথা বলো তুরার কাছে দিতে হবে না।”
ভিরান তুরার মুখের সামনে ধরে রাখে ফোন।
তুরা ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মুক্তা শিকদার অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছেন ভিরানের দিকে। উনি দুদিন ধরে ভিরান কে যত দেখছেন তত অবাক হচ্ছেন। এই ছেলে যদি বড় মানুষ হতো তাহলে ওনার মেয়ে কে তুলে নিয়ে চলে যেত।
নির্ভান একবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে আবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এই ছেলে কে নিয়ে আর পারা যায় না।
তুরা হাত দিয়ে নিজের সামনে থেকে ফোন সরিয়ে দেয়।
ভিরানের মুখের দিকে ঘুরিয়ে ধরে বলে,
“তুমি কথা বলো।”
“বলেছি তো, এখন তুমি বলো। পাপা তো তোমার কিং হয়, জিজ্ঞেস করো তোমার কিং কেমন আছে।”
মায়ের সামনে এমন কথা শুনে লজ্জায় কাঁথার নিচে মাথা ঢুকিয়ে দেয় তুরা। নির্ভান শকড হয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনে।
মুক্তা শিকদার হা হয়ে গেছেন ভিরানের কথা শুনে। গত কাল থেকে তুরা কে ওর বাপের কুইন বানাচ্ছে, আর আজকে ওর বাপ কে তুরার কিং বানিয়ে দিল।
এই ছেলের যাকেই পছন্দ হবে তাকেই বাপের বউ বানিয়ে দেবে দেখা যায়।
নির্ভানের ছেলের সাথে কথা বলার সখ মিটে গেছে। কল কে টে দিয়ে অফ লাইন হয়ে যায়।
ফোন রেখে দুই হাতে মুখ ঢেকে টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে থাকে।
ভিরান ফোন মুক্তা শিকদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“কে টে গেছে।”
মুক্তা শিকদার বলেন,
“কা’টবে না!”
“তুরার সাথে তো কথা বলল না।”
“তুরার সাথে কেনো কথা বলবে? তোমার সাথে কথা বলার জন্য কল করেছিল তো।”
“নানা ভাই তো কল করে তোমার সাথে কথা বলে, তাহলে পাপা কেনো তুরার সাথে বলবে না?”
মুক্তা শিকদার ভিরানের নরম গাল আলতো হাতে টেনে দিয়ে বলেন,
“তুমি তো দেখছি ভীষণ পাকা আর বুদ্ধিমান ছেলে। নানা ভাই কল করে আমার সাথে কথা বলে সেটাও নোটিশ করেছো দেখছি। এত কিছু মনে রাখো কিভাবে?”
ভিরান মিষ্টি করে হেসে বলে,
“আমার সব কিছুই মনে থাকে নানু।”
মুক্তা শিকদার হাসেন। ভিরান কে ওনার ভীষণ ভালো লেগেছে। ভিরানের কথা গুলো শুনতে বেশি ভালো লাগে। একটা চার বছরের বাচ্চা ছেলে এত কথা বলতে পারে আগে কোনো দিন দেখেননি। শুধু যে কথা বলে তানা, একটা জিনিস একবার দেখলে ভোলে না আর। ব্রেন অনেক ভালো। বড় হলে জীবনে ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে। বাবার চেয়েও বড় কিছু করে দেখাবে।
___________
অন্য দিন গুলোর মতন আজকেও নির্ভান গাড়ির ভেতরে বসে অফিসের কাজ করছিল। জানালার কাঁচে ঠকঠক আওয়াজ হয়। নির্ভান চোখ তুলে তাকায়, একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয়।
মহিলা বলেন,
“কয়েক দিন ধরে খেয়াল করছি আপনি রোজ সন্ধ্যার পর গাড়ি নিয়ে এসে এখানে বসে থাকেন। কেনো বসে থাকেন এখানে? বাড়ি ঘর নেই নাকি?”
বিরক্ত হয় নির্ভান, তবুও নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে বলে,
“কাজ আছে তাই বসে থাকি। আপনাকে কি ডিস্টার্ব করেছি আমি? নাকি আমার এখানে বসে থাকা নিয়ে বিরক্ত আপনি?”
মহিলা বুঝতে পারেন নির্ভান ওনার কথায় বিরক্ত হচ্ছে। উনি তো সন্দেহের কারণে এখানে এসেছে। কয়েক দিন ধরেই দেখছেন নির্ভান এখানে গাড়ি পার্ক করে বসে থাকে। কখন চলে যায় একদিনও দেখতে পারেননি। ওই টাইমে ওনার হাজব্যান্ড বাড়িতে আসে, হাজব্যান্ড কে খাইয়ে বেলকনিতে আসতে আসতে নির্ভান চলে যায়।
কোন মতলবে এখানে এসে বসে থাকে এভাবে? আবার কি কি যেন করছে ল্যাপটপে। কোনো জঙ্গি সংগঠনের কোনো সদস্য নয় তো? এই সব সংগঠনের সাথে এমন তাগড়া টগবগে যুবকরাও জড়িত থাকে। উপর থেকে দেখে ভদ্র ঘরের সন্তান মনে হয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে শ’য়’তা’নের কারখানা।
মহিলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বলেন,
“এখানে আপনার কি কাজ?”
“আমি এখানে ইন্টার ভিউ দিতে আসিনি, আমাকে বিরক্ত না করলেই আমি খুশি হব। আমাকে কাজ করতে দিন প্লিজ, আপনি আসুন।”
মহিলা যায় না, চড়াও গলায় বলেন,
“আশে পাশে আরও অনেক জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে বসে থাকুন। এই ভবনের সামনে থেকে সরুণ।”
“আশ্চর্য, আপনি এমন করছেন কেন?”
কথা বলার মাঝেই মহিলার হাজব্যান্ড চলে আসে। ওয়াইফ কে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে বাইক থেকে নেমে এগিয়ে আসতে আসতে নাম ধরে ডাকেন।
মহিলা এগিয়ে গিয়ে সব কিছু বলেন ওনার হাজব্যান্ড কে। মহিলার হাজব্যান্ড সব শুনে উল্টো ওনার উপরেই রেগে যান। ঝাড়ি দিয়ে বউ কে ভেতরে যেতে বলে বলেন,
“তুমি জানো উনি কে? আমাকে তো একবার বলতে পারতে ওনার বিষয়ে। তোমার এই আগ বাড়িয়ে ঝামেলা বাঁধানোর স্বভাব যাবে না তাইনা?”
“কে উনি?”
“ভেতরে চলো বলছি। মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি তো হয়নি কিছুই, সব সময় বোঝো এক লাইন বেশি। আর কাকে কাকে বলেছো এমন উল্টা পাল্টা কথা?”
মহিলা গাল ফুলিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়।
নির্ভান জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে কাজে মনোযোগী হয়ে গেছে আবার। আগামী কাল বিকেল তিন টায় অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট ওর আর ভিরানের।
আজকেই তুরার সাথে ভিরানের শেষ সময় অতিবাহিত হচ্ছে।
ভিরান বাদে বাকি সবাই জানে ওরা দুজন আগামী কাল অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। ভিরান কে আগামী কাল জানানো হবে।
______________
সকাল থেকেই তুরা তুরা করে গলা শুকিয়ে ফেলেছে ভিরান। নির্ভান এটা সেটা বলে কোনো রকম শান্ত করে রাখছে। একবার তুরার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছে।
মেরি চৌধুরী আর নওশাদ চৌধুরী ছেলে কে বোঝানোর ব্যার্থ চেষ্টা করছেন গত কয়েক দিন ধরে। কিন্তু নির্ভান নিজের কথায় স্থির আছে এখনো। একবার যখন বলেছে অস্ট্রেলিয়া যাবে মানে যাবেই। ভিরানের মাথা থেকে তুরার ভূ’ত নামাবেই।
ছেলে কে রেডি করিয়ে নিজেও রেডি হয়ে নেয়। প্যাকিং করে রেখেছে সকালেই।
বাবা মা আর ছেলে কে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে এয়ারপোর্টের দিকে।
গাড়ি উল্টো রাস্তায় যেতে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে ভিরান।
“এটা তুরার বাড়ির রাস্তা না, তুরার বাড়ির রাস্তা ওই দিকে।”
নির্ভান ছেলে কে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,
“তুরা ওই দিকে ঘুরতে গেছে আগে ওকে নিয়ে আসি।”
“সত্যি গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“ওকে নিয়ে সারা দিন ঘুরবো তাহলে, ইয়ে খুব মজা হবে।”
নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কি সুন্দর করে মিথ্যে কথা বলছে বাচ্চা টা কে।
তুরার কাছ থেকে দূরে গেলেই কি তুরা কে ভুলে যাবে?
নির্ভান যা চাইছে তা কি হবে?
_____
ছেলে কে উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতর প্রবেশ করে নির্ভান। ইমিগ্রেশনের জন্য যখন এগিয়ে যায়, তখন ভিরান যেন বুঝতে পেরে যায় বাবার মতলব।
বাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলে,
“তুমি মিথ্যে বলেছো, ভেতরে তুরা নেই। ছাড়ো আমাকে আমি তুরার কাছে যাব।”
আশে পাশের সবাই ভিরানের চিৎকার শুনে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিরান একপ্রকার লাফালাফি শুরু করেছে বাবার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।
নির্ভান কোনো ভাবেই আর ভিরান কে শান্ত করতে পারে না। হঠাৎই হাত ফসকে ছুটে যায় ভিরান। ছাড়া পেতেই সবাই কে ঠেলে ঠুলে দৌড় শুরু করে বাইরের দিকে। নির্ভান স্যুটকেস ফেলে ছেলের পেছনে ছুটে যায়। এতক্ষণে এসে কি সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে নাকি?
এয়ারপোর্টের অধিকাংশ মানুষ তাঁকিয়ে দেখছে বাবা ছেলে কে।
চলবে………..