ভাঙা পাঁজরে বসন্ত পর্ব-১১

0
13

#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_11

নির্ভানের কথা শুনে পাথরের মূর্তির মতন হয়ে গেছেন তুহিন শিকদার। ওনার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না। মুক্তা শিকদার নিজেও কিছু বলতে পারছেন না। থমথমে চেহারায় তাঁকিয়ে আছেন দুজনের দিকে।

নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরী অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। নির্ভান এমন কিছু বলবে কল্পনাও করেননি। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর নাতির অবস্থা দেখে ওনারা দুজন পা’গ’ল হয়ে গিয়েছিলেন। মেরি চৌধুরী তো অর্ধেক রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছেন। ওনারা ভিরানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। নির্ভান অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেই বাবা কে কল করে বলেছিল ওরা ফিরছে, উনি যেন ওদের রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে সময় মতো পৌঁছে যায়।

ফেরার পথে নির্ভান একটা কথাও বলেনি বাবা মায়ের সাথে। ছেলে কে বুকে আগলে রেখে ঝিম ধরে বসে ছিল। বাড়িতে না গিয়ে গাড়ি এখানে নিয়ে আসতে বলেছিল। আর এখানে এসেই এমন প্রস্তাব রেখেছে তুহিন শিকদারের কাছে।

নির্ভানের চোখ বেয়ে নীরবে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ফের অসহায় গলায় বলে,

“আঙ্কেল কিছু বলুন। আপনারা আমাকে ভরসা করতে পারেন, আমি তুরা কে ভালো রাখবো।”

তুহিন শিকদার স্ত্রীর দিকে তাকান। উনি কিছু বলতে পারছেন না। উনি বরাবর সহজ-সরল, নরম মনের মানুষ। নির্ভানের অবস্থা দেখে আর কথা গুলো শুনে উনি আর কিছু বলতে পারছেন না।
মুক্তা শিকদার বলেন,

“স্যার আপনাদের সাথে আমাদের যায় না। আপনারা এত বড় ঘরের মানুষ আর আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের।”

নির্ভান মুক্তা শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“আমি এখানে অফিসের বস হয়ে আসিনি। আমি এখানে আপনাদের কাছে একজন সাধন মানুষ হয়ে এসেছি। আপনারা আমাকে ফেরাবেন না প্লীজ।”

“আপনি যা বলছেন এটা কিভাবে সম্ভব!”

“আপনারা চাইলেই সম্ভব। আমি বুঝতে পারছি আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি কিন্তু আমি নিরুপায়।”

তুহিন শিকদার একটু ভেবে বলেন,

“মানুষ চাইলে সবই সম্ভব। জীবন দেওয়া ছাড়া এমন কোনো কাজ বোধহয় নেই যা মানুষ পারে না। আমরা যেহেতু মানুষের মধ্যে বসবাস করি তাই আমাদের সেভাবেই চলতে ফিরতে হয়। এখন আমরা তুরা কে যদি আপনার সাথে বিয়ে দেই তখন আশে পাশের সবাই কানাকানি করবে নানান রকম কথা ছড়াবে। টাকা পয়সা আর ধনী ফ্যামিলি দেখে এক বাচ্চার বাবার কাছে আঠারো বছরের মেয়ে কে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

“আঙ্কেল মানুষের কথা ভাবলে কি জীবন চলবে? মানুষের কাজই তো অন্য কে নিয়ে সমালোচনা করা। আমি আপনি একদিন না খেয়ে থাকলে আশে পাশের কেউ এসে খাবার দিয়ে যাবে না। অভাবে পড়লে কেউ দুই টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। আপনি যেই কাজ টাই করবেন কেউ আলোচনা করবে আবার কেউ সমালোচনা করবে। আপনি অন্য ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলেও যারা সমালোচনা করার তাঁরা ঠিকই করবে।”

“আপনার কথা ঠিক আছে কিন্তু

“আঙ্কেল প্লীজ আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।”

তুহিন শিকদার একটু চুপ থেকে আবার বলেন,

“সামনের সপ্তাহে তুরার ভাই তূর্য দেশে ফিরছে। ওকে ছাড়া আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। ও আসুক তারপর আমরা মতামত জানাব।”

নির্ভান অসহায় চোখে তাঁকিয়ে থাকে। এখানে জোরের কিছু নেই, তাঁদের মেয়ে তাঁরা না দিলে জোর করে তো আর তুলে নেওয়া যাবে না। কিন্তু ওর ইচ্ছে করছে তুরা কে এখনই নিয়ে চলে যেতে।

“স্যার আপনি বসুন, আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মুক্তা শরবত বানিয়ে নিয়ে আসো।”

মুক্তা শিকদার কিচেনে চলে যান। তুহিন শিকদার নির্ভান কে সোফায় বসান। নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরীও সোফায় বসেন।
নওশাদ চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“কি হয়েছিল? তুমি কেনো কিছু জানাওনি আমাদের?”

নির্ভান হাঁটুতে কুনুই ঠেকিয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকে। একটু সময় নিশ্চুপ হয়ে থেকে দুই হাতে মুখ ঢেকে রেখেই বলে,

“অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর চার দিন ভিরান চুপ চাপ ছিল। তুরার কথা খুব একটা বলতো না কিন্তু পঞ্চম দিন থেকে ওর পাগলামি আবার শুরু হয়। কিছুতেই থাকবে না ওখানে। আমার একটা কথাও শুনছিল না। খাওয়া দাওয়া টোটালি বন্ধ করে দেয়। ধরতে গেলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠতো। কেউ কোনো ভাবেই ওকে শান্ত করতে পারিনি। রাতের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। হসপিটালে নিয়ে ভর্তি করাই রাতেই। স্যালাইনের উপরেই রাখা হয় দুদিন, মুখ দিয়ে কোনো খাবার খাচ্ছিল না। কেঁদে কে টে লাফালাফি করে আরো অসুস্থ হতে থাকে। কোনো মেডিসিন ওর উপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারছিল না। শেষে ডক্টররা হাল ছেড়ে দিয়ে বলে ভিরান যার কাছে যেতে চাইছে তার কাছে যেন নিয়ে যাই, নাহলে এভাবে চলতে থাকলে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ভিরানের কন্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। ওর গলা দিয়ে এখন আর খুব একটা শব্দ বের হয় না। গলার স্বর একে বারে বসে গেছে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ভিরানের মস্তিষ্ক থেকে তুরা কে ভুলিয়ে দেওয়ার কিন্তু আমি ব্যর্থ। আমি আমার ছেলে কে হারাতে চাই না। ভিরান আর আমার লাইফে তুরা কে এনে দাও।”

তিন জন মন দিয়ে নির্ভানের কথা গুলো শুনছিল। নির্ভান চুপ হওয়ার সাথে সাথেই ড্রয়িং রুম জুড়ে নীরবতা ছেয়ে যায়।

মুক্তা শিকদার লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসেন।
নির্ভান পর পর তিন গ্লাস শরবত খায়। ফ্যানের বাতাস ওকে ঠান্ডা করতে পারছে না। তিরতির করে ঘামছে ফ্যানের নিচে বসে।

নওশাদ চৌধুরী, মেরি চৌধুরী আর তুহিন শিকদারও শরবত খান। নির্ভান মুক্তা শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“গরুর দুধ আছে?”

“আছে কিন্তু ফ্রিজে।”

“ভিরান কে খাওয়াতে হবে। দয়া করে একটু গরম করে দেবেন?”

“গরম করে নিয়ে আসছি এখনই।”

মুক্তা শিকদার আবার কিচেনে চলে যান। নির্ভান তুহিন শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“ওয়াশরুম ইউজ করা যাবে? শাওয়ার নিতে হবে।”

“হ্যাঁ যাবে, চলুন।”

নির্ভান বাবার দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“আমার স্যুটকেস?”

“গাড়িতে রয়েছে, ড্রাইভার কে বলছি এখনই দিয়ে যাবে।”

নির্ভান ঝুঁকে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে।
তুহিন শিকদার একদৃষ্টে তাঁকিয়ে থাকেন নির্ভানের দিকে। নির্ভানের অবস্থা উনি বুঝতে পারছেন কিন্তু মেয়ে কে কিভাবে তুলে দেবেন ওর হাতে? ওনারা তো নির্ভান দের মতো বিত্তশালী না। উনি ওদের অফিসের সামান্য ম্যানেজার। আবার দুজনের বয়সের গ্যাপ তেরো বছর। তার উপর নির্ভানের একটা বাচ্চা আছে।

সব দিক থেকেই আকাশ পাতাল ফারাক। এমন একটা অবস্থায় এই বিয়ে কিভাবে সম্ভব? তূর্য জীবনেও রাজি হবে না। বোনের বিয়েই দেবে না এখন, সেখানে এক বাচ্চার বাবার কাছে তো আরো দেবে না। তারপরেও সব কিছু পেরিয়ে বিয়ে টা হয়ে গেলেও মানুষের মুখ বন্ধ করা যাবে না। তাঁরা সামনে পেছনে বলবে “পয়সা ওয়ালা ছেলে পেয়ে বড় দান মে’রেছে। এক বাচ্চার বাপ অর্ধ বুড়ো লোকের সাথে কচি মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। টাকা পয়সা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি।

ড্রাইভার স্যুটকেস দিয়ে যায়। নির্ভান স্যুটকেস খুলে ভেতর থেকে ট্রাউজার টিশার্ট বের করে কিন্তু টাওয়েল নেই ভেতরে। বিভা টাওয়েল দিতে ভুলে গেছে বোধহয়।

তুহিন শিকদার নতুন একটা টাওয়েল নিয়ে আসেন রুম থেকে। দুদিন আগেই এনেছেন এখনো ইউজ করা হয়নি।

নির্ভান ড্রয়িং রুমের সাথে থাকা ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। তুহিন শিকদার ভেতরের টায় যেতে বললেও নির্ভান যায়নি।
_________

শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখে মুক্তা শিকদার দুধ গলিয়ে গরম করে নিয়ে এসেছেন।
নির্ভান স্যুটকেস থেকে ভিরানের মেডিসিন সহ প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে তুরার রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ওর পেছন পেছন বাকি চার জন। রুমের সামনে এসে গলা খাঁকারি দেয়। আস্তে ধীরে প্রবেশ করে ভেতরে।

তুরা ভিরানের শিয়রে বসে আছে। কেঁদে কে টে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। অন্যের কষ্ট দেখলে ওর ভীষণ কষ্ট লাগে। ভিরানের অবস্থা দেখে ওর বুকের ভেতর টা ফেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ।
তুরার দিকে তাঁকিয়েই বেডের কাছে এসে দাঁড়ায়।
ওর ছেলের জন্য অন্য একজন মেয়ে কেঁদে কে টে নিজের এই অবস্থা করবে তা অপ্রত্যাশিত।

তুরা বেড থেকে নেমে ওর মা কে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকে। নির্ভান সহ নওশাদ চৌধুরী, মেরি চৌধুরী আর তুহিন শিকদার তাকায় ওর দিকে।
মুক্তা শিকদার মেয়ে কে শান্ত করার চেষ্টা করে বলেন,

“কাদছিস কেন? চুপ কর।”

তুরা কাদতে কাদতে বলে,

“ভিরান কে দেখে কষ্ট হচ্ছে। ও ছোট মানুষ, কত কষ্ট পাচ্ছে।”

“সুস্থ্য হয়ে যাবে কয়েক দিনেই। কান্না না করে দোয়া কর ওর জন্য।”

নির্ভান ঘুমন্ত ছেলে কে আস্তে আস্তে কুসুম গরম দুধ খাওয়াতে থাকে। যদিও ভিরান মুখ দিয়ে খাচ্ছে না।
নাসোগ্যাস্ট্রিক টিউব এর মাধ্যমে নাক দিয়ে পাকস্থলীতে দুধ যাচ্ছে।

ছেলে কে খাওয়ানো শেষ করে ছেলের পাশেই বসে রইলো নির্ভান। এখনো ঘুম থেকে উঠছে না কেন? প্লেন থেকে নামার পরেও তাকিয়ে ছিল ভিরান। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে ঘুমিয়ে গিয়েছে, এখনো ওঠেনি।
টেনশনে ছেলের ফ্যাকাশে চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল।
_________

নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরী নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান রাত সাড়ে বারোটার পর। রাতের খাবার সবাই এখানেই খেয়েছে। যদিও নির্ভান, নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরী খেতে চাননি। তিন জন কে জোর করেই খাওয়ানো হয়েছে।
খাবার টা সবচেয়ে বেশি নির্ভানের প্রয়োজন ছিল। গত তিন দিন ধরে প্রায় না খাওয়াই আছে। জান টা বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে জোর করে অল্প অল্প খেয়েছে।

আজকে নির্ভান এই ফ্ল্যাটেই থাকবে। ছেলে কে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে না আবার এই অবস্থায় একা রেখেও যেতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে এখানে।

নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরী কে এখানেই থাকতে বলেছিলেন তুহিন শিকদার কিন্তু ওনারা থাকেননি ফিরে গেছেন নিজ বাড়িতে।

ভিরান ঘুম থেকে উঠেছিল। চোখ মেলে চোখের সামনে তুরা কে দেখেই শুঁকনো মলিন মুখে হাঁসি ফুটে উঠেছিল। দুর্বল আর বসে যাওয়া গলায় ফ্যাস ফ্যাসে স্বরে বির বির করে ডেকেছিল “তুরা।”

তুরা অনেকক্ষণ ভিরান কে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল। ভিরান ছাড়ছিল না তুরা কে। দুর্বল হাতে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে সমান তালে।

দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখেছে নির্ভান।
কয়েক দিন পর আজকে বাবার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল ভিরান। বির বির করে ওষ্ঠ জোড়া নাড়িয়ে ডেকেছিল “পাপা।”

ভিরান আজ ভীষণ খুশি হয়েছে। তুরা কে কাছে পেয়েই সুস্থ হয়ে গেছে যেন অনেক টা। আশা করা যায় দুদিনের মধ্যে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠবে।

তুরা ভিরানের সাথে শুয়ে আছে। তুরা কে বলে এসেছে রাতে ভিরানের কোনো সমস্যা হলে ওকে যেন ডাকে।
আজকে তুরা আর ভিরানের সাথে মুক্তা শিকদার ঘুমাবেন।

তুহিন শিকদার নির্ভান কে তূর্যের রুমে ঘুমোতে বললেও নির্ভান যায়নি ওই রুমে।

সবাই শুয়ে পড়েছে। নির্ভান ড্রয়িং রুম অন্ধকার করে সোফায় শুয়েছে। মনের মধ্যে এখন কিছুটা শান্তি লাগছে ছেলের মুখে হাঁসি দেখে আর পাপা ডাক শুনে।
ঘুমে চোখ দুটো জ্বলছে।

ঘুমোনোর আগে উপরের দিকে তাকিয়ে বির বির করে বলে,

“হে পরওয়ারদিগার, যদি তুরা আমাদের কপালে লিখা থাকে তবে দ্রুত ওকে আমাদের জীবনে দিয়ে দাও। আর যদি না লিখা থাকে তবে ওর প্রতি টান, ভালোবাসা আর আশা সবকিছু আমার ছেলের মন থেকে মুছে দাও, সাথে আমার মন থেকেও। এই ভয়ংকর মায়া আর বাড়িয়ে দিও না।”

চলবে………