ভাঙা পাঁজরে বসন্ত পর্ব-২০

0
14

#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_20

নির্ভান ফজরের পর পরই ঘুম থেকে উঠে যায়। ভিরান কে ছেড়ে পাশ ফিরে তুরার দিকে তাকায়। তুরা আগের মতো এক ভাবেই ঘুমিয়ে আছে।
দুজনের মাঝখান থেকে উঠে ভিরান কে আস্তে করে তুলে তুরার পাশে শুইয়ে দেয়। নয়তো দেখা যাবে গত কালকের মতো ঘুম থেকে উঠে চিৎকার করে বলবে, “আমি এখানে কেন?”

বেড থেকে নেমে হেলে দুলে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
__________

পেরিয়ে যায় অনেক গুলো দিন। তুরা এখন অনেক টা সুস্থ হয়ে উঠেছে। বাম হাত টা ঠিক হয়ে গেছে, মাথার ক্ষতও ঠিক হয়ে গেছে। শুধু ডান পা টাই এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। ঠিক হলেই কৃত্রিম পা বানাতে দেবে।

তুরা এখন একা একাই শোয়া থেকে উঠে বসতে পারে, একা একা শুতেও পারে। নড়া চড়াও করতে পারে। বেডের এপাশ থেকে ওপাশে একা একাই যেতে পারে।

ভিরান এখনো প্রায় সময় আম্মু না ডেকে তুরা বলে ডেকে ওঠে। তুরা ডাকার অভ্যাস কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারছে না নির্ভান।

নির্ভান আর তুরার সম্পর্ক সেই আগের মতোই রয়ে গেছে এখনো। নির্ভান তুরার কাছাকাছি আসলেই তুরা নার্ভাস হয়ে যায়। যতই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুক পারে না। নির্ভান ওর কাছে আসলে বা জড়িয়ে ধরলে কি যেন হয় ওর। অদ্ভুত অনুভূতিতে শরীর শিড়শিড় করে ওঠে। লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুইয়ে যায়। গাল দুটো লাল আভায় ছেয়ে যায়। নির্ভানের অবশ্য ভালোই লাগে তুরা কে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে আর লজ্জা দিতেও।

আজ স্পেশাল একটা দিন। নির্ভান আর তুরার বিয়ের রিসেপশন পার্টি। পার্টির আয়োজন করা হয়েছে চৌধুরী বাড়িতে। অস্ট্রেলিয়া থেকে বিভা ওর মেয়ে আর হাজব্যান্ড এসেছে। ইতালি থেকে ভিরানের নানা-নানি এসেছেন। ভিরানের মামা ব্যস্ত তাই সে আসেনি।

তুরা এই মুহূর্তে বসে আছে পার্লারে। ওকে সাঁজানো হচ্ছে পার্টির জন্য। ওর পাশে বসে আছে ভিরান, তাকিয়ে আছে তুরার দিকেই। ফেয়ারি টেল কুইনের মতো সাঁজানো হচ্ছে কি না সেটাই দেখছে। তুরার গাউন ভিরান নিজে পছন্দ করেছে। হোয়াইট বার্বি গাউন। গাউন পরার পর থেকে তুরা কে সত্যি সত্যিই রূপকথার রানীর মতো লাগছে।

নির্ভান মাত্র এসে পার্লারের ভেতর প্রবেশ করে। ভিরান কে তৈরি করিয়ে তুরার সাথে পার্লারে রেখে গিয়েছিল নিজে তৈরি হয়ে আসার জন্য। তূর্য অপেক্ষা করছে পার্লারের ভেতর বসে। নির্ভান তূর্যের পাশে এসে বসে। নির্ভানের পরনে হোয়াইট স্যুট-প্যান্ট, ভিরানের পরনেও তাই। দুই বাপ ব্যাটা সেম ড্রেস পরেছে, গেটআপ, ড্রেসআপ একই রকম দুজনের।

বেশ সময় নিয়ে সাঁজানো হয় তুরা কে। মেকআপ আর হেয়ার স্টাইল কমপ্লিট। সব শেষে তুরার মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয় হোয়াইট স্টোনের ক্রাউন। তুরা কে এবার পুরোপুরি ফেয়ারি টেল কুইনের মতোই লাগছে। এক বিন্দু কমতি নেই কোথাও। ভিরান খুশি হয়ে চেয়ার থেকে নেমে তুরার হাত ধরে বলে,

“তুরা তোমাকে একদম ফেয়ারি টেল কুইনের মতো লাগছে।”

তুরা মিষ্টি করে হাসে। ভিরান দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাবা কে ডেকে নিয়ে আসে। তুরা ডোরের দিকেই তাকিয়ে ছিল। নির্ভান তুরা কে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ওর দৃষ্টি স্থির তুরার দিকে। আশে পাশের কোনো কিছুই যেন আর খেয়াল নেই। ভাবতেই পারেনি তুরা কে এই সাঁজে এত বেশি ভালো লাগবে। ওর ধারনা কল্পনার বাইরে ছিল তুরার এই রূপ। ভিরান যেমন চেয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই সাঁজানো হয়েছে তুরা কে।
ভিরান বাবার হাত ঝাঁকিয়ে বলে,

“পাপা তুরা কে নিয়ে চলো।”

নির্ভান নিজেকে স্বাভাবিক করে এগিয়ে এসে কোনো কথা ছাড়াই তুরা কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। তিন জন একসাথে এগিয়ে যায় ডোরের দিকে। পেমেন্ট করা হয়েছে আগেই।

পার্লারে থাকা সকল মানুষ তিন জনের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য বসা থেকে উঠে ওদের সাথে বাইরের দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে তখনো তাকিয়ে আছে সবাই, কানাকানি করছে এটা ওটা। তুরার ভাগ্য নিয়ে কথা বলছে, মেয়েটার ভাগ্য আসলেই অনেক ভালো।

তুরা কে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে নির্ভান। ওর পাশে বসে ভিরান। তূর্য ফ্রন্ট সিটে উঠে বসে। গাড়ি ছুটে চলে চৌধুরী বাড়ির দিকে। তুরা লজ্জায় নির্ভানের দিকে তাকাচ্ছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিরান ননস্টপ বাবা আর মামার সাথে কথা বলছে। মায়ের রূপের প্রশংসা করছে দুজনের কাছে।

“আম্মু এদিকে তাকাও।”

তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

“বলো।”

“এদিকে তাকিয়ে থাকো।”

তূর্য মুচকি হেসে ওঠে। নির্ভান নিজেও মৃদু হেসে ওঠে। ওর বাম হাতের মুঠোয় তুরার ডান হাত টা শক্ত করে ধরে রাখা। তুরা মুখ তুলে তাকাতেই দেখে নির্ভান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দ্রুত গতিতে মাথা নত করে নেয় তুরা। নির্ভান সকলের অগচরে বাম হাত টা তুরার পেছন দিকে দিয়ে কোমর চেপে ধরে নিজের আরো কাছে টেনে আনে। আরেকটু চাপ প্রয়োগ করলেই তুরা নির্ভানের ভেতরে ঢুকে যাবে বোধহয়। তুরার হাসফাঁস লাগছে। নির্ভানের হাত দ্রুত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। নির্ভান হাত সরায় না। তুরার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে ভীষণ। সামনেই বড় ভাই বসে আছে, দেখে ফেললে কি হবে?

তুরা মনে মনে চাইছে ভিরান যেন নির্ভান কে ডাকে কিন্তু ভিরান ডাকছে না। ও চুপ করে বসে থেকে কি যেন ভাবছে এখন। তুরা মুখ তুলে নির্ভানের মুখের দিকে তাকায় আবার। নির্ভান সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরা নির্ভান কে খোঁচা দিতেই নির্ভান ওর দিকে তাকায়। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”

তুরা নিজেও ইশারায় বোঝায় হাত সরিয়ে নেওয়ার জন্য। নির্ভান কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না করে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ে করা বউ ওর, হাত কেনো সরিয়ে নেবে?

তুরা নির্ভানের রিয়াকশন দেখেই বুঝতে পারছে এই লোক হাত সরাবে না। নিজেও সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো আবার। বাইরে অন্ধকার অন্ধকার হয়ে গেছে। মাগরিবের আযান হয়েছে আধা ঘন্টা আগে।

আজকে প্রথম শশুর বাড়িতে যাচ্ছে তুরা। ওদের দুজনের বিয়ের তৃতীয় মাস চলছে এখন। কিছু দিন পর তিন মাস পেরিয়ে যাবে।

তুহিন শিকদার আর মুক্তা শিকদার আগেই চলে গেছেন চৌধুরী বাড়িতে।

গাড়ি প্রবেশ করে চৌধুরী বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে। অনেক মানুষ এগিয়ে আসে গাড়ির কাছে। তূর্য নেমে দাড়ায়। নির্ভান ভিরানের পাশের ডোর খুলে দেয়। ভিরান গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে এসে সামনে দাঁড়ায় মামার পাশে। নির্ভান নিজেও নেমে ঘুরে এসে দাঁড়ায়। ডোর খুলে তুরা কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।

সবাই তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। ক্যামেরা গুলো ওদের দিকেই ফোকাস করা। সামনের রাস্তা খালি করে দেয় সবাই। নির্ভান তুরা কে কোলে নিয়ে আগায় স্টেজের দিকে। ওর পাশে পাশে হেঁটে চলেছে ভিরান।
তিন জন কে এত দারুন লাগছে যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না কেউ। তুরার যে একটা পা নেই সেটা বোঝাই যাচ্ছে না। গাউনের নিচে আড়াল হয়েছে দুটো পা। লাইটের আলোয় আলোকিত পুরো চৌধুরী বাড়ি।

স্বচক্ষে সব কিছু দেখেও সকলের মনে হচ্ছে টিভিতে মুভি দেখছে সবাই। তিন জন জনের চারো দিকে লাল সাদা বেলুন ছড়িয়ে আছে। ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে অনেকেই। তিন জন হাঁটতে হাঁটতে স্টেজের ওপর উঠে আসে। নির্ভান তুরা কে বসিয়ে দেয়, নিজেও বসে ছেলে কে কোলে নিয়ে। ভিরান তুরার এক হাত ধরে রাখে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলে তিন জনের দিকে তাকিয়ে আছে। পর পর শুধু ক্যামেরা ক্লিক হচ্ছে আর ফ্ল্যাশ লাইটের আলো চোখে মুখে লাগছে। তুরা লজ্জায় জড়সড় হয়ে আছে। এত মানুষ ওকে দেখছে তাতে ওর কেমন যেন লাগছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। নির্ভান বুঝতে পারছে তুরার অনুভূতি। ভিরানের হাতে ধরে রাখা তুরার হাতের ওপর হাত রাখে নির্ভান। ভরসা স্বরুপ স্ত্রীর হাত টা একটু চেপে ধরে সাথে মুঠো বন্দী হয়েছে ভিরানের হাতও।

ভিরানের মুখ থেকে হাসি দূর হচ্ছে না। ও যে কতটা খুশি হয়েছে তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না।
সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তুরা, নির্ভান আর সুহানার পরিবার। সুহানার বাবা মা খুশি হয়েছেন নির্ভান মুভ অন করায়। তাঁরা তো প্রথম থেকেই চাইতেন নির্ভান আবার নতুন ভাবে জীবন শুরু করুক।
দেরি হলেও মুভ অন করেছে এতেও তাঁরা ভীষণ খুশি।
__________

খাওয়া দাওয়া পার্টি শেষ করে রুমে প্রবেশ করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়। নির্ভানের রুম টা কে বাসর ঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। টাটকা ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রুমে। তুরা কে বেডে বসিয়ে রেখে আবার বাইরে গেছে নির্ভান।

পাঁচ মিনিট পর আবার ফিরে আসে। তুরা এখনো আগের মতোই বসে আছে। ভিরান একটু আগেই ঘুমিয়ে গেছে তূর্যের কোলে। সারা দিন লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমও জেঁকে ধরেছিল।

তুরার বাবা মা ভাই নিজ ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে চাইলেও নির্ভান জানিয়ে কেউ কোথাও যেতে পারবে না। আজকে সবাই ওদের বাড়িতেই থাকবে।

তুরা নির্ভানের দিকে তাকায়। নির্ভান রুমে আসার পর থেকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তুরা দৃষ্টি নামিয়ে নেয় আবার। মিন মিন করে বলে,

“আমি চেঞ্জ করব, আম্মু কে আসতে বলুন।”

“চেঞ্জ করবে ভালো কথা কিন্তু শাশুরি কেনো আসবে?”

“এত ভারী গাউন আমি একা একা কিভাবে চেঞ্জ করব? আম্মু সাহায্য করবে আমাকে।”

“তুমি কেনো চেঞ্জ করবে? আর শাশুরি কেনো সাহায্য করবে?”

“তাহলে কে করবে?”

“আজকে আমাদের বাসর রাত, সেই হিসেবে চেঞ্জ করাবো আমি।”

“এ্যাহ্?”

“এ্যাহ্ নয় হ্যাঁ। আমি চেঞ্জ করাবো তোমাকে।”

“এই না।”

“কিসের না? দাঁড়াও ডোর লক করে আসছি।”

নির্ভান ডোরের দিকে এগিয়ে যায় লক করে আসার জন্য। তুরা তুরার হাসফাঁস অবস্থা, অস্বস্তিতে পিছিয়ে যায়। নির্ভান সত্যি সত্যিই ওকে চেঞ্জ করিয়ে দেবে?

চলবে……………