ভাঙা পাঁজরে বসন্ত পর্ব-২১

0
14

#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_21

নির্ভান ডোর লক করে বেডের দিকে এগিয়ে আসে। তুরা জড়সড় হয়ে মুখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে নির্ভানের দিকে। নির্ভান কিছু সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তুরার মুখের দিকে। তুরার দিক থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না আজ। তুরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে এদিক ওদিক।

“ওদিকে কেনো গেছ? এদিকে আসো।”

তুরা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,

“আমি চেঞ্জ করবো না আপনার কাছে।”

“করলে সমস্যা কি?”

“না।”

“এখন নাহয় মা করিয়ে দেবে, আগামী কাল সকালেই তো সবাই চলে যাবে তারপর থেকে তো আমাকেই করিয়ে দিতে হবে।”

“তখন আমি একাই করতে পারব, এটা ভারী ড্রেস তাই একা পারবো না।”

“তাহলে তো আজকে আমিই করাবো নয়তো এমন সুযোগ আর পাবো না।”

“আপনি এমন করতে পারেন না।”

“কেমন করেছি আমি?”

বলতে বলতে বেডে উঠে বসে। তুরার দিকে এগিয়ে হাত বাড়াতেই তুরা বলে,

“আপনি তো এমন ছিলেন না? কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেনো আজকে?”

“আগে ছিলাম না কিন্তু এখন থেকে এমনই থাকব। জীবনে দ্বিতীয় বার যেন আফসোস করতে না হয় তাই নিজেকে পরিবর্তন করেছি। এখন দূরে না সরে কাছে আসো দেখি।”

নির্ভান তুরার সামনে বসে মুখোমুখি হয়ে। তুরা কম্পিত স্বরে বলে,

“ভিরান কে নিয়ে আসুন।”

“কেন?”

“ও আমাদের সাথে ঘুমাবে।”

“কিন্তু ভিরান তো ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই।”

“তো কি হয়েছে? তাও নিয়ে আসুন।”

“কাপছো কেন এভাবে?”

তুরা বলে না কিছু। ওর ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে এই রুম থেকে আর নির্ভানের সামনে থেকে পালিয়ে যেতে।
নির্ভান হাত বাড়িয়ে তুরার দুই হাত ধরে। টেনে এনে উঁচু করে ধরে নিজের সম্মুখে। একটু ঝুঁকে পড়ে ওষ্ঠ ছোঁয়ায় তুরার দুই হাতের উল্টো পিঠে। নির্ভানের ওষ্ঠের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে ওঠে তুরা। হৃদযন্ত্র শব্দ তুলছে জোরে জোরে। নির্ভানের হাতের সাথে ওষ্ঠ জোড়া ছুঁইয়ে রেখেই চোখ তুলে তাকায় তুরার মুখের দিকে। তুরা হাত টেনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। নির্ভান শক্ত করে ধরে আছে। তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই আবার চুমু খায় দু হাতে। পুনরায় কেঁপে কেঁপে ওঠে তুরা। নির্ভান সোজা হয়ে বলে,

“স্ট্রেঞ্জ, এত কাপাকাপি করছো কেন? এমন তো নয় যে আজকে আমরা প্রথম একসাথে রাত্রি যাপন করব।”

“ঘুমাবো আমি।”

“আজকে আমাদের বাসর রাত ভুলে গেছ?”

তুরা থেমে থেমে বলে,

“বিয়ের দিন রাত হয় বাসর রাত।”

“আমি বাসি বাসর রাত করব।”

“আমি ঘুমাবো, ছাড়ুন আমার হাত।”

“চেঞ্জ করবে না?”

“না, কিছু করতে হবে না।”

নির্ভান মুচকি হেসে বলে,

“ভয় পাচ্ছ?”

তুরা চুপ হয়ে থাকে। নির্ভান তুরার হাত থেকে ব্রেসলেট খুলে দেয়। একটু উঁচু হয়ে ক্রাউন খুলতে খুলতে বলে,

“এত ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। আমি তোমার হাজব্যান্ড, অন্য কেউ না।”

তুরা এবারেও কিছু বলে না। নির্ভান সকল জুয়েলারি খুলে দেয়। চুলের ক্লিপ গুলো একটা একটা করে খুলে দেয়। বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলে,

“এদিকে আসো।”

তুরা এগিয়ে আসে আস্তে আস্তে। নির্ভান চুল গুলো হাত খোঁপা করে দেয়। চুল বাঁধার অভ্যাস টা হয়েছিল সুহানার চুল বেঁধে দিতে দিতে। যখন থেকে জানতে পেরেছিল সুহানার ক্যান্সার হয়েছে আবার লাস্ট স্টেজে রয়েছে তারপর থেকে নিজেই সুহানার সব কিছু করে দিত। সুহানার কাছ থেকে দূরে সরতো না। বিয়ের পর থেকে সুহানার সাথে ভীষণ অবিচার করেছিল, মেয়ে টা কে সময় দিত না। খুব বেশি ভালোবাসা বা আদর যত্নও করতো না। যত টুকু প্রয়োজন ঠিক তত টুকুই। সেই আফসোস এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কেনো মেয়ে টা কে একটু বেশি বেশি ভালোবাসেনি, আদর যত্ন করেনি? সময় দেয়নি?

তুরা বারণ করলেও শোনে না। রুমের লাইট অফ করে রুম অন্ধকার করে দেয়। তারপর গাউন খুলে সফট ড্রেস পরিয়ে দেয়। রুমের লাইট অন করতেই দেখে তুরার মেকআপ করা গাল আরো লাল হয়ে গেছে। মেয়ে টা এত লজ্জা পায় যা বলার বাইরে। বিয়ের এত গুলো দিন পেরিয়ে গেছে তবুও নির্ভান ওর ধারে কাছে আসলেই গুটিয়ে যায়। হার্টবিট বেড়ে যায়, জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে। অদ্ভুত একটা মেয়ে। এই মেয়ে কি সারা জীবন এমনই থাকবে নাকি?

তুরার মেকআপ রিমুভ করতে সাহায্য করে তারপর ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।
রুমে ফিরে এসে নিজের ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়।

ওয়াশরুম থেকে তুরা কে রুমে এনে বেডে বসিয়ে দিয়ে বলে,

“ঘুমিয়ে পড়ো আমি ভিরান কে নিয়ে আসছি।”

তুরা মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়ে এক পাশে। নির্ভান ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ভিরান কে গেস্ট রুমে শোয়ানো হয়েছে। তূর্য ভিরান কে নিজের সাথেই রাখতে চেয়েছিল কিন্তু নির্ভান রাখে না। ঘুমন্ত ছেলে কে কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে। নির্ভানের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায় তুরা। নির্ভান ভিরান কে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে ডোর লক করে এসে মেইন লাইট অফ করে নাইট ল্যাম্প অন করে শুয়ে পড়ে। কাত হয়ে ছেলে আর বউ কে জড়িয়ে ধরে একসাথেই। তুরা ভিরান কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয় আবার। নির্ভান চোখ বন্ধ করে বলে,

“শুধু ছেলে কে ধরলেই হবে, ছেলের বাবা কে ধরতে হবে না?”

ফট করে চোখ মেলে তাকায় তুরা। কিছু সময় নির্ভানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যত টুকু পারে নির্ভানের গায়ের ওপর তুলে দেয় হাত। নির্ভান তুরার হাত টা ধরে চুমু খায় হাতে। নিজের গালে চেপে ধরে বলে,

“তুমি সব সময় ভালো থাকো, সুস্থ থাকো আর আমাদের সাথেই থাকো।”

তুরা কোনো কথা না বলে নির্ভানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নির্ভান চিৎ হয়ে ভিরান কে নিজের বুকের ওপর তুলে নেয়। তুরা কে নিজের ডান হাতের বাহুতে শুইয়ে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। ঘাড় ঘুরিয়ে তুরার মাথায় ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। তুরা মুখ তুলে তাকাতেই ললাটে ছোঁয়ায় আবার। সাথে সাথেই মুখ নামিয়ে নেয় তুরা। নির্ভান সিলিং এর দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে বলে,

“ঘুমাও।”

তুরা নির্ভানের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ভিরান বাবার বুকের ওপর শুয়ে ভারী শ্বাস ফেলছে। নির্ভান ছেলের পিঠে হাত বুলায়। ছেলের মাথায় চুমু খায়। বুকে চেপে ধরে আরো।
_______________

সকালে নির্ভান আগে ওঠে শোয়া থেকে। ভিরান কে তুরার বুকে শুইয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বের হয় নিচে যাওয়ার উদ্যেশ্যে।
ড্রয়িং রুমে আসতেই সুহানার বাবার সাথে দেখা হয়। ভদ্র লোক বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ করছেন। নির্ভান কে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,

“ভিরান ঘুম থেকে ওঠেনি?”

“না।”

“তুরা?”

“দুজনেই ঘুমিয়ে আছে।”

দুজন সোফায় বসে। সোফায় আগে থেকেই মুক্তা শিকদার, মেরি চৌধুরী আর সুহানার মা বসে আছেন। তিন জন গল্প করছেন নিজেদের মধ্যে। নির্ভান কে দেখে তিন জন ওর দিকে তাকায়। মেরি চৌধুরী বলেন,

“তুরা আর ভিরান ওঠেনি?”

নির্ভান দুদিকে মাথা নাড়ায়।

মেড কফি নিয়ে আসে দুজনের জন্য। আর মধ্যে আবার
তূর্যও ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসে। নিজেও বসে সোফায়। মেড আবার ওর জন্য কফি নিয়ে আসে। তূর্য সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলে ওর ঘুম হয়না রাতে। গত কালকে সারা দিন দৌড়াদৌড়ি করেছে আবার রাতে ঘুম হয়নি। মাথা ভার ভার হয়ে রয়েছে এখন।

সকালের নাস্তা সেরে সোফায় বসে সবাই। তূর্য তুরা কে কোলে করে এনে সোফায় বসায়। নিজেও বসে বোনের পাশে। ভিরান তূর্যের কোলে উঠে দুই পা তূর্যের কোমরের দুই দিকে দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে রাখে দুই হাতে। ঝুলে আছে দেখে তূর্য ধরে রাখে নিচ থেকে।

সুহানার মা তূর্য আর ভিরানের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভিরান যে তুরার পুরো পরিবার কে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। এর আগে যত বার ভিরানের কাছে এসেছেন ভিরান ওনাদের পিছু ছাড়তো না, আর এবার ডেকেও নিজেদের কাছে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে তূর্যের কাছ থেকে। বাবার চেয়ে তূর্যের কাছেই বেশি থাকছে।
তূর্য কে ওনার কাছে ভীষণ লাগে লেগেছে। ছেলে টা ওনার নাতি কে ভীষণ ভালোবাসে। কি সুন্দর সব সময় কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তুরা দের ফ্ল্যাটে যাওয়ার পরেও দেখেছেন তূর্য ভিরানের জন্য কত কিছু করেছে। নিজের হাতে খায়ানো, গোছল করানো থেকে শুরু করে কিন্ডারগার্ডেনে নিয়ে যাওয়া সবই করেছে তূর্য। আগে নির্ভান যা যা করতো এখন তূর্যও প্রায় সেসবই করে। বাবা আর মামা কে যা যা করায় ভিরান, তা অনেক বাচ্চারা মা কে দিয়েও করাতে পারে না। বিভার মেয়ে নিদ্রা কেও ভীষণ আদর করে। এই দুজন তূর্যের পেছন ছাড়ে না।

বিভার মেয়ে নিদ্রাও তূর্যের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুই হাত প্রসারিত করে দিয়ে কোলে নিতে বলে। বিভা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“একজন মানুষ একসাথে কত জন কে কোলে নেবে? তুমি বড় মামার কোলে ওঠো।”

নিদ্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“না, আমি ছোট মামার কোলেই উঠব। মামা কোলে।”

কি আর করার। এক হাতে ভিরান কে ধরে রেখে অন্য হাত বাড়িয়ে নিদ্রা কে কোলে তুলে নেয়। নিদ্রাও তূর্যের গলা জড়িয়ে ধরার জন্য ভিরান কে ঠেলছে। ওর জন্য গলা জড়িয়ে ধরতে পারছে না।

দুজন একসাথে কোলে উঠে বেচারা তূর্যের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। গত তিন দিন ধরে এই দুজন কে নিজের কাছে রাখতে রাখতে বেচারার বিয়ে-সাদি বউ-বাচ্চার সখ মিটে গেছে।
ভিরান একটু শান্ত প্রকৃতির ছেলে হলেও নিদ্রা ভীষণ দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে। বাবা-মা নিজের মামা কে ছেড়ে একটু পর পর তূর্যের গলায় ঝুলে যায়। আর দুষ্টামি তো আছেই আনলিমিটেড।

তুরা জড়সড় হয়ে আছে। চোখ কোণা করে নির্ভানের দিকে তাকাতেই দেখে নির্ভান আগে থেকেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় তুরা।

সোফার এক পাশে চুপ চাপ বসে থাকা নির্ভানের খালাতো বোন জিনিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তূর্যের দিকে। গত কাল এই বাড়িতে আসার পর প্রথম দেখেছে তূর্য কে। তখনই ভালো লেগে গেছে ওর কাছে।
নিদ্রার সাথে কথা বলতে বলতে তূর্যের নজর পড়ে জিনিয়ার ওপর। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নেয় জিনিয়া, দৃষ্টি স্থির করে ফোনের স্ক্রিনে।
তূর্যের কপাল ভ্রু কুঁচকে যায়। গত কাল থেকে খেয়াল করছে এই মেয়েটা ওর দিকে তাকায় একটু পর পর। তূর্য তাকাতেই চোখ নামিয়ে নেয় নয়তো সরে যায় অন্য দিকে। সমস্যা কি এই মেয়ের?
একটু পরেই জিনিয়া আবার চোখ তুলে তাকায় দেখে তূর্য এখনো তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে বাইরের দিকে এগিয়ে যায়। ওর মা পেছন থেকে ডেকে বলে,

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”

“বাইরে থেকে আসছি।”

মেরি চৌধুরী বলেন,

“তোর বদ রাগী ছেলে টা আসলই না শেষ পর্যন্ত।”

“আর বলো না আপা। এদের দুই বাপ ব্যাটা কে নিয়ে আমি আছি মহা বিপদে।”

“কেনো খালামণি কি হয়েছে?”

বিভার কথা শুনে সেদিকে তাকিয়ে বলেন,

“গত কাল সকালে আসার সময় দুই বাপ ব্যাটা ঝগড়া বাঁধিয়ে আসলো না একজনও। এখন দুজনেই বার বার কল করছে দ্রুত বাড়িতে যাওয়ার জন্য।”

“আগামী এক মাস বাড়িতে যাবে না। দুজন থাকুক একসাথে।”

“এক জন আরেক জন কে মে’রে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে। বাপ ব্যাটা দুজনই বজ্জাত। এই দুজনের জ্বালা আর ভালো লাগে না। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে বনবাসে চলে যাই।”

“মেয়ে টা কে বিয়ে দিয়ে তারপর যেও।”

বিভার কথা আর বলার ধরন দেখে সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জিনিয়ার মা বলেন,

“বিয়ে! এই মেয়ে একটা ছেলে কেও পছন্দ করে না। ছেলে পক্ষ ওকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে কিন্তু এই মেয়ে কোনো ছেলে কেই পছন্দ করে না। একে নিয়ে আছি আরেক বিপদে।”

চলবে…………….