শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-০২

0
17

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ০২

ভারাক্রান্ত মনে মেসে ফিরল প্রিমা। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় আসতেই দেখা হলো বাড়ি ওয়ালার সাথে। বয়স্ক বাড়িওয়ালা তাকে দেখে নাকমুখ কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বললেন,

–” তোমার গত দু মাসের ভাড়া বাকি মেয়ে। পরশু দিনকে ঈদ, খরচাপাতির ব্যপার আছে। টাকা টা জলদি দিয়ে দিয়ো। সম্ভব হলে চলতি মাসের ভাড়াটা ও দিয়ে দিয়ো। এতিম বইলা কম তো ছাড় দেইনি এহন তুমি যদি এমন করো তাইলে তো আমার না খেয়ে মরা লাগবে। ”

একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে ভাড়া থাকে প্রিমা। যার ভাড়া মাত্র ছায় হাজার টাকা। দু’জন শেয়ারে থাকে বিধায় হাফ টাকা ভাড়া লাগে একেকজনের। এই দশ তলা বিল্ডিংয়ের পুরোটা জুড়ে ভাড়াটিয়া রয়েছে। সামান্য ক’টা টাকার জন্য বাড়িয়ালার মৃত্যু ঘটবে না সেটা প্রিমা খুব ভালো মতো বোঝে প্রিমা কিন্তু সে নিরুপায়। হালকা ভেজা চোখে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় প্রিমা বলল,

–” জ্বী আংকেল। ”

বাড়িওয়ালা বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। প্রিমা পাথুরে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শূন্যে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে পঞ্চম তলায় উঠে চিলেকোঠার ঘরটার দিকে গেলো। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই রান্নাঘর থেকে রিনরিনে একটা কন্ঠস্বর বলে উঠলো,

–” এসেছিস তুই? ”

প্রিমা ক্ষীণ স্বরে প্রত্যুত্তর জানিয়ে সোজা বিছানায় বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। পরিশ্রান্ত শরীরটা আর চলছে না। ভেতরটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অনুভূতিহীন প্রাণীর ন্যায় বিমর্ষ চিত্তে ভাবতে লাগলো কত-শত ভাবনা।

প্রিমার ক্ষীণ উত্তর শুনে রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে ঘরে ঢুকলো ফারজানা। ফারজানা ইয়াসমিন তুলি হলো প্রিমার একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী এবং রুমমেট। বয়সে ফারজানা প্রিমার চাইতে বড়। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোটোখাটো বেতনের চাকরি করে এবং একই সাথে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে।

প্রিমা কে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ফারজানা চিন্তিত মুখে ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

–” কী হয়েছে সোনা? ”

প্রিমা বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে ফারাজানার কোলে মাথা রেখে ধীর গলায় প্রশ্ন করল,

–” এতিমের ঈদ বলতে কোনো উৎসব হয় বুবু ? এত বেশি আনন্দ তাদের কপালে সয়? ”

ফারজানার বুকটা কেঁপে উঠলো। চমকে তাকালো প্রিমার দিকে। ছিপছিপে গড়নের লম্বাটে হাড্ডিসার শরীরটা কেমন যেনো নির্জীব হয়ে আছে। মাথার ঘন কালো সুবিশাল রেশমি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে বিছানায় । হলদেটে ফর্সা ত্বকের মেয়েটা দেখতে চমৎকার সুন্দরী অথচ তার ভাগ্যটা অত্যন্ত খারাপ। এইটুকু বয়সের মেয়েটা কতশত স্ট্রাগল করছে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে। ফারজানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহজ কন্ঠে শুধায়,

–” কী হয়েছে বলবি তো নাকি? ”

প্রিমা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। চোখবুঁজে ফারজানার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,

–” তোমার শরীর থেকে মা মা গন্ধ আসছে বুবু। একটু বসবে আমার পাশে ? ”

নির্মল আবদারটা ফেরাতে পারলোনা ফারজানা। আপাতত প্রিমাকে ঘটনা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই তা ঢের বুঝছে সে। ফারজানা বড়দের মতো শাসন করে বলল,

–” উঠে গিয়ে সোজা ফ্রেস হয়ে এরপর খেতে বস। খাওয়া শেষে সকল আবদার পূরণ করা হবে। বেশি কথা শুনতে চাইছি না একদম। জলদি উঠ। ”

কথা শেষ হতেই ফারজানা দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো। প্রিমা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে জানালার দিকে তাকাল। সুবিশাল অন্ধকারাচ্ছন্ন নীলাম্বরের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিড়বিড়িয়ে বলল,

–” শুনো আম্মা? তোমার মেয়ে একা নয়। উপরওয়ালা বোধহয় আমার প্রতি একটুখানি সদয় হয়েছে। খুব সম্ভবত একটু শান্তি, একটু স্বস্তি আমার কপালে রেখেছেন তিনি। ”

খাওয়াদাওয়া শেষে দু’জন পাশাপাশি শুয়ে পড়লো। পায়ের কাছটায় রয়েছে বিশাল খোলা জানালা। ঘরটা ছোট্ট হলেও ভীষণ সুন্দর। ফারজানা বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত সুরে শুধাল,

–” কী হয়েছে আজকে? ”

প্রিমা হার মেনে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। এই একটা মানুষের কাছেই তার কঠিন ব্যক্তিত্ব নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ভেতরকার বাচ্চামি সত্তাটা অকপটে বেরিয়ে আসে। সবটা শুনে ফারজানা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

–” সময়ের পরিবর্তন হলেও কিছু মানুষের মন মানসিকতা এখনও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। মেয়ে মানুষ মানেই পণ্য, মেয়ে মানুষ মানেই ভোগের সামগ্রী.. এই জঘন্য ভাবনা তাদের অপ্রকৃতস্থ মস্তিষ্ক থেকে কখনো যাবেনা। ”

প্রিমা নিরুত্তর রইল। এসবের চিন্তা এখন আর তাকে বিরক্ত করে না। চলার পথে এমন মুখোশধারী হায়েনা দেখে সে অভ্যস্থ। তার চিন্তাটা ভিন্ন জায়গায়। ফারজানা পুনরায় শুধাল,

–” এই টিউশনি টা তো গেলো এবার কী করবি? টিউশনি করাতে করাতে তোর শরীরটা একেবারে ভেঙে গেছে। অন্য উপায় খুঁজলে হয়না প্রিমা? ”

প্রিমা ম্লান হেসে বলল,

–” আমাদের উপায় বলতে কিছু থাকেনা বুবু। ভাগ্য আমাদের নিরুপায় করে দেয় প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে। ”

ফারজানা কৌতূহলী কন্ঠে শুধাল ,

–” আমি যতটুকু জানি তুই এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিস তাইনা? ”

প্রিমা ম্লান হেসে বলল,

–” হুঁ। ”

ফারজানা কিছু একটা ভেবে বলল,

–” আমার অফিসের সিনিয়র অফিসারের একজন পিএ লাগবে। তুই মোটামুটি সব দিক দিয়েই পার্ফেক্ট। আমি তোর জন্য সুপারিশ করি? যদিওবা ইন্টারভিউ তে টিকলে তবেই নিবে।”

প্রিমা কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল ,

–” উনার পার্সোনালিটি কেমন? ”

ফারজানা হালকা হেসে বলল,

–” উনি মেয়ে মানুষ। একটু বদমেজাজি তবে মনের দিক দিয়ে বেশ ভালো। ”

প্রিমার বুকের ভারটা বোধহয় কমে আসলো। সে ধীর কন্ঠে বলল,

–” আমি ইন্টারভিউ দিবো। দেখা যাক কী হয়। ”

কে জানতো এই একটা পদক্ষেপ তার জীবনের মোড় এক নিমিষেই পাল্টে দিবে। অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায় কথাটা তার বেলায় অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় এই সত্যটা বোধহয় টের পায়নি প্রিমা।

_

সময় পেরিয়েছে তার নিজেস্ব গতিতে। আজ চাঁদ রাত। চৌধুরী বাড়ির সকলেই উপস্থিত রয়েছেন খাবার টেবিলে। আজকে বাড়ির কর্তারাও উপস্থিত আছেন। টেবিলের মাথায় বসেছেন বাড়ির সবচেয়ে বৃদ্ধ সদস্য তৌকির আফজাল চৌধুরী। তার পাশে বসেছেন চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে আরিয়ান ইয়াসার চৌধুরী এবং উনার স্ত্রী আফিয়া চৌধুরী। উনাদের পাশের চেয়ারটা দখল করেছেন চৌধুরী বাড়ির মেজো ছেলে আজমল তাজওয়ার চৌধুরী এবং উনার স্ত্রী তাজকিয়া তারান্নুম চৌধুরী। তাদের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসেছেন বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্র আরহাম মেহমেত চৌধুরী এবং উনার স্ত্রী মাহিরা চৌধুরী।

মেহমেত চৌধুরীর পাশ ঘেঁষে বসেছে উনার একমাত্র মেয়ে মেহরিমা এবং তার পাশের চেয়ারটা দখল করে বসেছে বাড়ির ছোটো সাহেব এবং বাড়ির মেজো পুত্রের কনিষ্ঠ সন্তান তাসাওয়ার তুরাব চৌধুরী। টুংটাং চামচ নাড়ার শব্দ আসলেও খাওয়াতে কারও মনোযোগ নেই। বাড়ির প্রত্যেকে বিষন্ন চিত্তে বসে আছে। ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে ফাঁকা পড়ে থাকা চেয়ার দুটোর দিকে।

সকলের বিমর্ষ ভাবটা লক্ষ্য করে তুরাব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিবেশ হালকা করতে মেহরিমার উদ্দ্যেশে বলে উঠলো,

–” কী রে ননির পুতুল? হুট করে জ্বর বাঁধালি কেমনে? ”

তীব্র জ্বরে আক্রান্ত মেহরিমা নিশ্চুপ ভঙ্গিতে লেপ্টে আছে বাবার বুকের সাথে। মেহমেত চৌধুরী উনার আদুরে ছানাকে খুব যত্নের সহিত আগলে রেখেছেন। বাচ্চা মেয়েটা জ্বরে একদম কাহিল হয়ে পড়েছে। মেহমেত চৌধুরী মাছ বেছে বেছে মেয়ের প্লেটে দিচ্ছেন। মেহরিমা দুর্বল হাতে লোকমা বানিয়ে তা মুখে পুরছে। তুরাবের কথায় চোখ ছোটো-ছোটো করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

–” বাইক এক্সিডেন্টে করে জ্বর বাঁধাইনি এতটুকু নিশ্চিত। ”

মেহরিমার জবাবে বিষম খেলো তুরাব। ওদের সম্পর্কটা বেশ মজার। দু’জনে সারাক্ষণ একে-অপরের পেছনে পড়ে থাকে। গত বছর বাইক এক্সিডেন্ট করে তুরাবের বেহাল দশা হয়েছিল। খোঁচা টা সেদিকে ইঙ্গিত করে ছোঁড়া তা বেশ বুঝতে পারলো তুরাব। সে কিছু বলার পূর্বে তারান্নুম চৌধুরী ছেলেকে ধমকে বললেন,

–” খাওয়ার সময় এত কথা বলতে হয় না তুরাব। ”

মায়ের ধমকে চুপসে গেলো তুরাব। মেহরিমার মুখটা কালো হয়ে আসলো। চোখদুটো অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে আসায় আগে চোখ নামিয়ে ফেললো। তারান্নুম চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ওভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। মেয়েটা এমনিতেই জ্বর বাঁধিয়ে বসেছে। মনে মনে অনুতপ্ত হলেও বাহিরে প্রকাশ করার মতো ভাষা খুঁজে পেলেননা তিনি।

খাবার টেবিলের থমথমে অবস্থার নিষ্পত্তি ঘটলো কলিংবেলের আওয়াজে। সকলেই উৎসুক চোখে তাকালেন মেইন দরজার দিকে। তুরাব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

–” আমি দেখছি। ”

ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই চোখগুলো রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেলো তুরাবের। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো দু’টো চেনা পরিচিত মুখশ্রী দেখে হতবাক সুরে বলল,

–” ভাইয়া? ”

তুরাবের চিল্লানোর শব্দে চৌধুরী বাড়ির বাকি সদস্যরা এদিকে দৃষ্টিপাত করেন। দরজা পেরিয়ে দু’জন লম্বাটে পুরুষের আগমনে থমকে যান উপস্থিত প্রত্যেকে। আফিয়া চৌধুরী এবং তারান্মুম চৌধুরী বিস্মশে হতভম্ব হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বাকিদের অবস্থাও প্রায় একই।

তাজরিয়ান এবং আরশিয়ানের আকস্মিক আগমনে সকলে হতভম্ব এবং আনন্দিত । দু’জনে এগিয়ে এসে তাদের মা কে জড়িয়ে ধরে। মুহূর্তের মধ্যে চৌধুরী বাড়িতে আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাকিদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে ওরা দু’জন ফ্রেশ হতে নিজেদের কক্ষে যায়। নিজ কক্ষে যাওয়ার পূর্বে নিজ বঁধু’র ভীতসন্ত্রস্ত এবং চমকিত মুখশ্রী অবলোকন করতে ভুলে না তাজরিয়ান। বাঁকা হেসে বিড়বিড়িয়ে বলে,

–” তুমি ভয় কেন পাও প্রাণ সজনী আমায় দেখিয়া
তোমায় প্রেম সোহাগে রাখব আমার বুকে জড়ায়া..

চৌধুরী বাড়িতে যেনো আনন্দের ঢল নেমেছে। সারা বাড়িতে ঈদের আমেজ লক্ষণীয়। সকলেই ডাইনিং রুমে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে । তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পরিশেষে ওরা দু’জন নেমে আসে। তাজরিয়ান এসে সোজা মেহরিমার সামনের চেয়ারটা দখল করে। তা দেখে মেয়েটা অস্বস্তি গাঁট হয়ে বসে থাকে। স্থান ত্যাগ করার কথা তারা মাথায় আসেনি। সে কেবল তার পরিণতির কথা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে।

গল্প আড্ডার ফাঁকে দুজনে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। তৌকির আফজাল সকলকে তাড়া দিয়ে বলেন,

–” সবাই যে যার রুমে যাও। কালকে ঈদ উল আজহা। সকলকে সকালে উঠে নামাজে যেতে হবে। এসে আবার পশু কোরবানির ব্যপার আছে। দাদু ভাই তোমরা নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত এখন গিয়ে রেস্ট নাও। ছোটো বউমা? মেহু গিন্নী কে দ্রুত ওর রুমে দিয়ে এসো। ”

দাদুর কথা শুনে তাজরিয়ান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে শুধাল,

–” আমার বউ অন্য ঘরে যাবে কেনো ? ”

তাজরিয়ান কথায় ছোটো-খাটো একটা বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো । উপস্থিত সকলে পুনরায় হতভম্ব মুখে তাজরিয়ানের মুখের দিকে তাকায়। মেহরিমার নতজানু দেহখানা আকস্মিক কেঁপে উঠে। তাজরিয়ান সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীর কন্ঠে শুধায় ,

–” কী আশ্চর্য। সবাই এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? আমার বউ আমি চাইবো না ? ”

তাজরিয়ানের বাবা আমতা আমতা করে বলে,

–” আব্বু আমরা এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করবো কেমন? তখন তো মেহরিমা ছোটো ছিলো। ছোটো মানুষ বিয়ের কী বোঝে? আপাতত…..

তাজরিয়ান মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–” তখন বুঝতো না বলেই তোমাদের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। এখন নিশ্চয়ই বিয়ে, স্বামী, সংসার সবটাই বুঝে? না বুঝলে সমস্যা নেই। বউ আমার সুতারাং বোঝানোর দায়িত্বটা নাহয় আমিই নিলাম। ”

তাজরিয়ানের একরোখা কথায় সকলে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সাইকোপ্যাথ ছেলেটাকে বোঝাতে পারাটা দুঃসাধ্য ব্যপার। কখন কোন কথায় রেগে গিয়ে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠে তার ঠিকঠিকানা নেই। সাত বছরে কতটা শুধরেছে কে জানে? তারান্নুৃম চৌধুরী মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছেন। এ কোন বিপদ হলো?

তাজরিয়ানের কথা শুনে মাহিরা চৌধুরীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। মেয়েটা তার বড্ড আদরের। সাত বছরের আগের ঘটনায় মেয়েটা যথেষ্ট মুষড়ে পড়েছিল। বহুকষ্টে মেয়েটাকে সেই পরিস্থিতি থেকে বের করেছেন। অসুস্থ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে তাজরিয়ান কে বললেন,

–” আব্বু, মেহু তো অসুস্থ। ভীষণ জ্বর মেয়েটার। ও নাহয় একটু……

চাচির কথা শুনে তাজরিয়ান চটপট হাত বাড়িয়ে মেহরিমার কপাল ছুঁয়ে দেখল। আকস্মিক কপালে তাজরিয়ানের পুরুষালি হাতের ঠান্ডা স্পর্শে মেহরিমা আঁতকে উঠল। তাজরিয়ান এক পলক মেহরিমা কে দেখে বলল,

–” আপনি চিন্তা করবেননা ছোটোমা আমার এলোমেলো ভঙ্গিতে শোয়ার অভ্যেস নেই। আমি সুন্দর মতো দু’টো কম্বল পেঁচিয়ে দিবো ওর শরীরে। কোনো প্রকার অসুবিধা হলে আমি দেখবো সমস্যা নেই। ”

তাজরিয়ানের এহনও উত্তরে উপস্থিত সকলে হতাশ চোখে আরশিয়ানের দিকে তাকালো। আরশিয়ান ব্যস্ত হাতে টাইপ করছিল। সবাইকে তাকাতে দেখে ছোট্ট করে বলল,

–” তাজরিয়ানের কথায় আমি কোনো ভুল দেখেছি না কিন্তু তোমাদের আচরণে অবাক হচ্ছি। ”

উপস্থিত সকলে আরেক দফা হতাশ হলো। তাজরিয়ান আড়মোড়া ভেঙে হামি দিয়ে বলল,

–” আমার বউ দিতে তোমরা এমন টালবাহানা শুরু করছো কেনো? সতটা বছর সময় দেওয়ার পরও এই হাল? আমি বুড়ো হয়ে গেলে ওকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটছো নাকি? আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমার বউয়ের ব্যপারে আমি একচুল পরিমাণও ছাড় দিবো না কাউকে । ”

সবার কথায় মেহরিমার মাথা ব্যথা দ্বিগুণ হারে বাড়লো। অসুস্থ মেয়েটা অত চিন্তা সহ্য করতে পারলোনা। আকস্মিক বমি করে ভাসিয়ে ফেললো ফ্লোর। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখার কারণে মেহমেত চৌধুরীর বুকের কাছটায় বমি মেখে যা তা অবস্থা হলো।

তাজরিয়ান এক লাফে উঠে এসে মেহরিমা কে ধরে। তাজরিয়ানের স্পর্শে মেহরিমার ছোট্ট শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। বেচারি ঘোলাটে চোখে একবার তাজরিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আকস্মিক এমন হওয়াতে তাজরিয়ান অস্থির কন্ঠে শুধায়,

–” বউজান? ও বউজান? ”

আরশিয়ান সবার দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখে চোখে কিছু একটা বুঝালো। সকলে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে নিশ্চুপে তা শুনলো। তাজরিয়ান কারও কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে মেহরিমা কে কোলে তুলে সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। উপরে উঠতে উঠতে ঝাঁঝাল স্বরে বলল,

–” এই তুরাব? জলদি এসে ওর চেক-আপ করে আমাকে রিপোর্ট জানা। ”

তুরাব একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। বর্তমানে ইন্টার্নি করছে। বড় ভাইয়ের কথা শুনে তুরাব ছুটলো তার ঘরের দিকে। মেহরিমার চেক-আপ করে জানা গেলো বেচারি দুর্বলতা এবং অসুস্থতার জন্য জ্ঞান হারিয়েছে।

তুরাব প্রয়োজনীয় মেডিসিন তাজরিয়ান কে বুঝিয়ে দিলো৷ একপর্যায়ে সকলে মেহরিমা কে রেখে তাজরিয়ানের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। মাহিরা চৌধুরী এবং মেহমেত চৌধুরী কিছুটা নাখোশ হলেও আরশিয়ান তাদের বোঝালো ।

ঘর ফাঁকা হতেই তাজরিয়ান গভীর দৃষ্টিতে বিছানায় নিস্তেজ ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা মেহরিমার দিকে তাকালো। এসির রিমোট খুঁজে কুলিং মুড চালু করে দিলো। নিমিষেই হুড়মুড়িয়ে এসির ঠান্ডা বাতাস ঘরটাকে কোল্ড স্টোরেজ বানাতে তৎপর হলো। তাজরিয়ান বাঁকা হেসে মেহরিমার শরীরের কম্বলটা সরিয়ে সাইডে ফেললো৷ মেহরিমার পাশে শুয়ে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই সুমিষ্টঘ্রাণ উন্মাদের মতো নিজের ভেতর টেনে নিতে লাগলো।

ঠান্ডায় জমে আসা মেয়েটার নতজানু শরীরটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ অতঃপর কিছু একটা মনে পড়তেই মেহরিমার কাঁধে সূচালো দাঁতের প্রয়োগ করলো। পুরো গলা জুড়ে রক্তাভ চিহ্ন এঁকে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,

— ” আমার সম্পদ অন্য পুরুষকে দেখানোর দুঃসাহস কী করে হলো বউজান? তাজরিয়ান নামক বদ্ধ উন্মাদ কে এত সহজে কী করে ভুলে গেলি? ”

প্রত্যুত্তর না পেয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তাজরিয়ান। বাঁকা হেসে পুনরায় বলল,

–” ডোন্ট ওয়ারি বউজান, বদনাম কুড়াতে আমি আবারও ফিরে এসেছি। এবার স্রেফ বদনাম কুড়িয়ে ক্ষান্ত হবো না বরং তোর রুহ্ অব্দিই কব্জায় নেওয়া ব্যবস্থা করবো। আমার অনুপস্থিতিতেও তুই কেবল আমার ঘোরে ডুবে থাকবি। ”

চলবে?