শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-০৩

0
19

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া

পবিত্র ঈদ উল আজহার স্নিগ্ধ সকাল। চৌধুরী বাড়িটা আপাতত নিস্তব্ধ। বাড়ির ছেলেরা সকলেই নামাজে গিয়েছে। বাড়ির বউয়েরা রান্নাঘরে ব্যস্ত। তাজরিয়ান বাসা থেকে বের হতেই মাহিরা চৌধুরী দ্রুত ছুটে যান মেয়ের কাছে। গতকাল সারাটা রাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি উনাদের। মাথা গরম ছেলেটা এই সাত বছরে কতটুকু শুধরেছে তা নিয়ে সকলে যথেষ্ট সন্দিহান। মন সায় না দিলেও একপ্রকার বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির গ্যঁড়াকলে পড়ে মেয়েকে তাজরিয়ানের হাতে তুলে দিয়েছেন উনারা।

আকাশকুসুম চিন্তাভাবনার মাঝে তাজরিয়ানের ঘরের সমনে উপস্থিত হন মাহিরা চৌধুরী। কাঁপা হাতে ভারী পর্দা আবৃত বন্ধ কাঁচের দরজায় নক করেন। উনাকে অবাক করে দিয়ে অপরপক্ষ নিশ্চুপ থাকে। এতে মাহিরা চৌধুরীর চিন্তা তরতরিয়ে বাড়ে। জোরালো শব্দ করেও কোনো লাভ হলো না উপরন্তু তাজরিয়ান দরজাটা লক করে গিয়েছে।

মাহিরা চৌধুরীর হাঁকডাক শুনে নিচ থেকে আফিয়া চৌধুরী এবং তারান্নুম চৌধুরী ছুটে আসেন। মাহিরা চৌধুরী অসহায় সুরে বলেন,

–” আমার মেয়েটা দরজা খুলছেনা আপা। কি হলো ওর….

মাহিরা চৌধুরীর কথায় আফিয়া এবং তারান্নুম চৌধুরী বেশ অবাক হলেন। মাহিরা চৌধুরী কে শান্ত হতে বলে তিনি ছুটলেন ঘরের এক্সট্রা চাবি আনতে। তারান্নুম চৌধুরী চাবি হাতে ফেরত আসলে সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেলেন কিন্তু দরজা খুলে ভেতরকার দৃশ্য দেখে থমকে যান উনারা।

মাহিরা চৌধুরী মেয়ের অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। তারান্নুম চৌধুরী লজ্জায় মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন। আফিয়া চৌধুরী চৌধুরী চোখ বড় বড় করে বললেন,

–” এ কী অবস্থা….

অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটা জানালার ফাঁক গলিয়ে আসা সূর্যের আলোয় আলোকিত। ঘরের মেঝেতে এলোমেলো ভঙ্গিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশকিছু জামাকাপড়। হুঁশ হারিয়ে ফোমের নরম বিছানায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেহরিমা। তার অনাবৃত দেহে কেবল একটা ব্ল্যাঙ্কেট বুক পর্যন্ত টেনে দেওয়া। ফর্সা কাঁধে গলায় যত দূর অব্দিই নজর যায় সবখানেই লালচে কিংবা কালসিটে দাগের চিহ্ন।

মেয়ের অবস্থা দেখে মাহিরা চৌধুরী যেনো নিজের মধ্যে নেই। আফিয়া চৌধুরী পরিস্থিতি বুঝে ঝটপট দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। আজ কতগুলো বছর পর চৌধুরী বাড়ি একটুখানি আনন্দের মুখ দেখেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ঝাপটার আগমন যদি সেসব নিশ্চিহ্ন করে দেয় তবে চৌধুরী পরিবারের ভাঙন নিশ্চিত।

তারান্নুম চৌধুরী ও বিড়বিড়িয়ে দোয়া ইউনুস পড়ছেন। ছেলের এমন অমানবিক আচরণে উনিও হতবাক। কী বলবেন কী করবেন কিছুই বুঝে পাচ্ছেন না তিনি। আফিয়া চৌধুরীর ফিসফিসিয়ে বললেন,

–” কী খেয়ে এমন ছেলে পেটে ধরেছিলি তারা? ”

তারান্নুম চৌধুরী অসহায় কন্ঠে বললেন,

–” আপনার দেবর ডায়েট চার্ট তৈরি করে দিয়েছিল আপা। তাকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে । ”

আফিয়া চৌধুরী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

–” তোর ছেলের নাম তাজরিয়ান না রেখে তান্ডব রাখা উচিত ছিলো। নতুন করে কোন অশনি বিপদ ধেয়ে আসছে উপরওয়ালা জানেন। ওসব কথা ছাড় এখন দোয়া ইউনুস পড়। ”

তারান্নুম চৌধুরী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,

— ” তাজরিয়ান আসার পর থেকে সমানে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছি আপা এরপরও কেনো যেন বিপদ টলানো যাচ্ছেনা। ”

তাদের কথোপকথনের মাঝে মাহিরা চৌধুরী স্থির কন্ঠে বললেন,

–” আপনারা বাহিরে যান আমি ওকে ফ্রেশ করিয়ে নিয়ে আসছি। ”

মাহিরা চৌধুরীর কথার বিপরীতে আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেলেননা। বুকে ভয় চেপে নিরবে প্রস্থান করলেন৷ উনাদের যেতে দেখে মাহিরা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের দিকে অগ্রসর হোন৷

নামাজ শেষে বাড়ির ছোটো ছেলেরা বাসায় ফিরেছে। বড়রা সোজা উপস্থিত হয়েছেন কোরবানির মাঠে। সবকিছু তদারকি করে উনারা চলে আসবেন এরপর বাকি কাজ ছোটরা করবে। যেহেতু দীর্ঘ সময়ের কাজ তাই ভারী খাবার খেয়ে অতঃপর আরশিয়ান, তাজরিয়ান এবং তুরাব বেরুবে। তারা টেবিলে এসে বসতেই দেখল মেহরিমা দুর্বল হাতে একটু একটু করে খাবার মুখে দিচ্ছে। চোখমুখ কিছুটা ফোলা এবং মুখশ্রীতে একরাশ বিষন্নতা দৃশ্যমান। আরশিয়ান একপলক ওর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় শুধাল,

–” মেহু পরি? কেমন আছো পিচ্চি? শরীর ভালো? জ্বর কমেছে ? ”

মেহরিমা রক্তাভ চোখদুটো তুলে আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল,

–” ভালো আছি ভাইয়া। শরীর ভালো আছে। জ্বর নেই। ”

আরশিয়ান স্মিত হেসে পকেট থেকে হাজার টাকার পাঁচটা নোট বের করে মেহরিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

–” ঈদ মোবারক মেহু পরি। এই নাও তোমার সালামি। মন খারাপ করে থেকো না কেমন? ”

তাজরিয়ান ট্যারা চোখে একবার তাকাল। তুরাব ভ্রু কুঁচকে মুখে দু’টো পিঠা পুরে বলল,

–” এত পার্শিয়ালিটি ধর্মে সইবে না ভাইয়া। আমি যে বাড়ির ছোটো পুত্র সেদিকে কারোরই নজর নেই দেখছি। ”

আরশিয়ান গম্ভীর গলায় বলল,

–” আমি কাম চোর আর বদমেজাজি মানুষদের সালামি দিই না। ”

তাজরিয়ান এবং তুরাব একবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার আরশিয়ানের দিকে তাকাল। সবটা দেখেও আরশিয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নাস্তা খেতে লাগলো। তুরাব উপায় না পেয়ে এবার মেহরিমার দিকে ঝুঁকে বলল,

–” শুন, তুই একটা ল্যাদা বাচ্চা মানুষ। এত টাকা তুই সামলে রাখতে পারবি? তার চেয়ে বরং আমাকে দুইভাগ দে আর তুই একভাগ রাখ৷ বড়দের কথা শুনলে ফেরেশতারা নেকি দেয় বুঝলি? ”

মেহরিমা কথা বাড়ালো না। হাতের মুঠে থাকা নোট গুলো তুরাবের হাতে দিয়ে দিলো চুপচাপ। এতক্ষণ মজা করলেও মেহরিমার কান্ডে তুরাব ভীষণ অবাক হলো। মজার মুড নিমিষেই গায়েব হয়ে চেহারায় সিরিয়াসনেস আসলো। অস্থির কন্ঠে মেহরিমার মাথায় হাত রেখে বললো,

–” কি হয়েছে মিউমিউ? কেউ কিছু বলেছে? কারও কথায় কষ্ট পেয়েছিস?”

তুরাবের আদুরে স্বরে মেহরিমার কান্না পেয়ে গেলো। এত এত জটিলতা ওর একদমই ভালো লাগছেনা। অসহ্য লাগছে সবকিছু। চিৎকার করে কান্না করতে মন চাইছে কিন্তু চাইলেই কী সব সম্ভব হয়? সাত বছর আগের ভুলটা সে পুনরায় করতে চাইছে না। ভুল তার ছিলো তাই সে শাস্তি পাচ্ছে। এমনটা ভেবে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে মেয়েটা কিন্তু আদৌ কী এতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কমে?

তুরাব পুনরায় প্রশ্ন করার আগে সেখানে উপস্থিত হয় মাহিরা চৌধুরী। মেয়েকে খাবার নিয়ে নড়াচড়া করতে দেখে উনার ভেতরটা কেঁপে উঠে। তুরাব কে থামাতে গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন,

–” চুপচাপ নাস্তা খাও সবাই। একটাও বাড়তি কথা শুনতে চাইছিনা আমি৷ ”

চৌধুরী বাড়ির অবস্থা থমথমে। একরাশ রাগ চেপে মেয়েকে নাস্তা তুলে খাওয়াচ্ছেন মাহিরা চৌধুরী। তার পাশে অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন তারান্নুম চৌধুরী। আফিয়া চৌধুরী বসে বসে দোয়া ইউনুস পড়ছেন। নিরবতা ভেঙে কন্ঠে ক্ষোভ ঢেলে অসহায় সুরে মাহিরা চৌধুরী তাজরিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–” সাত বছর আগের শোধ তুলতে আমার অসুস্থ মেয়েটার উপর এভাবে অত্যাচার করতে পারলে? ”

তাজরিয়ান গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে ভ্রু কুঁচকে মাহিরা চৌধুরীর দিকে তাকালো। জিজ্ঞেসু কন্ঠে বলল,

–” আমার জানা মতে তোমার মেয়ের সাথে আমি কিছুই করিনি ছোটমা । অজান্তেই যদি কোনো পাপ করে থাকি তাহলে একটু স্মরণ করিয়ে দাও। ”

মাহিরা চৌধুরী এমন ভাবলেশহীন কথায় তাজ্জব হয়ে গেলেন। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে খানিকটা জোর গলায় বললেন,

–” অসভ্যের মতো কথা বলো না তাজরিয়ান। তুমি ভালো মতো জানো আমি কিসের কথা বলছি। ”

তাজরিয়ান ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো। সামনের চেয়ারে বসে থাকা মেহরিমার গলার কাছটা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু মাথা সহ পুরো গলা জুড়ে ওড়না পেঁচিয়ে রাখায় তা আর সম্ভব হলো না। আনমনে কিছু একটা মনে পড়তেই বিড়বিড়িয়ে বলল,

–” তোমার ননীর পুতুল মার্কা মেয়ের সাথে আমি কিছুই করিনি। যা করার আমার বউয়ের সাথে করেছি। অহেতুক অপবাদ দিয়ে আমার কন্ট্রোললেস ক্যারেক্টার কে বদনাম করো না ছোটমা। ”

সবাইকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা ঝেড়ে গম্ভীর স্বরে তাজরিয়ান বলল,

–” সাত বছর আগের বিষয়টা নিয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র প্রতিশোধ স্পৃহা নেই। যদি থাকতো তাহলে আজ সকালে তোমার মেয়ের বীভৎস লাশ খুঁজে পেতে। যেটা স্বয়ং আমি ভুলে গিয়েছি অহেতুক সেই কথা বলে অনর্থ ডেকে এনো না।”

তাজরিয়ানের ঠান্ডা হুমকি শুনে মাহিরা চৌধুরী ভয় পেলেন। তিনি ঠিক ভেবেছিলেন, এই সাইকোপ্যাথ ছেলে জীবনেও শুধরাবে না। বহু প্রচেষ্টার পর মেহরিমা কে পেয়েছেন তিনি। তার একমাত্র বুকের মানিক মেহরিমা । পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে তিনি মেয়েকে হারাতে পারবেন না।

মাহিরা চৌধুরী দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলানোর চেষ্টা করলেন। উপস্থিত সকলে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগে মাহিরা চৌধুরী পুনরায় বললেন,

–” অনেক হয়েছে আর নয়। তোয়াজ করছি বলে মাথায় উঠে যাচ্ছো একেবারে। তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিচ্ছে, আমার মেয়ে তোমার সংসার করবেনা। শীঘ্রই তোমাদের আলাদা হওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি। ”

ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সকলে ফাঁকা ঢোক গিলে তাজরিয়ানের দিকে তাকাল। আরশিয়ান ও দম আঁটকে তাকিয়ে রইল তাজরিয়ানের দিকে। তাজরিয়ান বাঁকা হেসে ভীষণ শান্ত সুরে হেসে হেসে বলল,

–” তোমার মেয়ে না চাইলেও আমি তোমার মেয়ের সাথে সংসার করতে ভীষণ আগ্রহী ছোটমা। রইল প্রসঙ্গ আলাদা হওয়ার ? প্রারম্ভে চৌধুরী বাড়ির বউয়েরা লাল কাপড়ে চৌকাঠ মাড়িয়ে সংসার জীবনে প্রবেশ করে এবং সমাপ্তিতে সাদা কাফন জড়িয়ে চৌকাঠ পেরিয়ে সাংসার ছেড়ে আসল ঠিকানায় পৌঁছায়। ইশারা যথেষ্ট নাকি বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হবে? ”

উপস্থিত সকলের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। এত শান্ত স্বরে এরূপ ভয়ংকর হুমকি শুনে তাদের বেহুঁশ হওয়ার দশা। মাহিরা চৌধুরী টু শব্দ করতে পারলেন না। তাজরিয়ান ন্যাপকিনে হাত মুছে পুনরায় শীতল স্বরে বলল,

–” তোমার মেয়ে আমার বউ হলেও ভরা মজলিসে আমাদের ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে প্রশ্ন তোলার লাইসেন্স আমি তোমায় দিইনি ছোটমা। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি কাউকে জবাবদিহি করতে ইচ্ছুক নই। আশাকরি পরবর্তীতে আমাকে এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে না। ”

মাহিরা চৌধুরী থমকে দাঁড়ালেন। তার সন্তানের বিষয়ে কথা বলার অধিকার তার নেই? তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে অন্যায় দেখেও তাকে চুপ থাকতে হবে? প্রশ্ন গুলো মাথায় আসতেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,

–” আমার মেয়ে তোমার বউ বলে তার উপর অমানুষিক অত্যাচার করার লাইসেন্স আমরা তোমাকে দেইনি তাজ। ”

তাজরিয়ান এতক্ষণ ভদ্রতা বজায় রাখলেও এবার ব্যর্থ হলো। রাগে মেজাজ হারিয়ে উচ্চ স্বরে বলল,

–” বিবাহিত নারীর শরীরে দু /চারটা দাগ থাকা যদি অত্যাচার হয় তাহলে বুঝতে হবে পৃথিবীর সব নারী তার স্বামীর কাছে অত্যাচারিত। ”

আফিয়া চৌধুরী এইপর্যায়ে এগিয়ে এসে মাহিরা চৌধুরী কে থামাতে চাইলেন। তাজরিয়ানের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললেন,

–” মাহিরার বহু প্রতীক্ষার ফল মেহু। এজন্যই মেহু কে নিয়ে ওর চিন্তাটা নিছকই কম নয়। তুই রাগিস না বাবা। মেহু টা অসুস্থ, ওকে নিয়ে ঘরে যা। ”

মাহিরা চৌধুরী বাঁধা দিয়ে বললেন,

–” মোটেও না আপা। আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে এই সাইকোপ্যাথ। ”

তাজরিয়ানের চোখজোড়া ধপ করে জ্বলে উঠল। উপস্থিত সকলে ভড়কে গিয়ে পুনরায় তাজরিয়ান কে দেখল। আরশিয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাজরিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বলল,

–” মেহু কে নিয়ে রুমে যা। ছোট মায়ের মাথা ঠিক নেই। ডোন্ট বি ইনসেইন। তোর কোথাও যেতে হবেনা, ওকে সময় দে। তোদের মধ্যে বোঝাপড়া হওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ”

মেহরিমার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকাতেই মস্তিষ্কে চেপে বসা রাগটা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। সময় নষ্ট না করে মেহরিমার হাত চেপে ধরে ওকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো তাজরিয়ান। মাহিরা চৌধুরী ওদের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” তোমারা ভুল করছো। ”

আরশিয়ান মাহিরা চৌধুরী কে সোফায় বসিয়ে তার হাতে এক গ্লাস পানি ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” তুমি বাড়াবাড়ি করছো ছোটমা। ”

মাহিরা চৌধুরী উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে নিলে আরশিয়ান বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,

–” তুমি অতিরিক্ত ভয় পেয়ে অগ্রহণযোগ্য আচরণ করছো। সাত বছর আগে যে পরিস্থিতিতে ওদের বিয়েটা হয়েছে তাতে এত সহজে সব মিটে যাবে তা আশা করাটা বোকামি ছিলো তবে তাজরিয়ানের পাল্টানো রুপ অসম্ভব ব্যপারটাকে সম্ভব করেছে। ওদের চেষ্টা করতে দাও ছোটমা, সমস্যা হলে আমরা তো আছি তাইনা? এখন তুমি যদি ওদের মধ্যে সমস্যা হতে যাও তাহলে কী করে হবে? আমাদের মেহু ভীষণ সুখী হবে ছোটমা তুমি মিলিয়ে নিয়ো৷ ”

মাহিরা চৌধুরী সায় জানিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। আরশিয়ান আর তুরাব ও নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো । নিজেদের ঘরে প্রবেশ করতেই তাজরিয়ান শব্দ করে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। তা শুনে ভয়ে মেহরিমার বুক ধুকপুক করতে লাগলো। দরজা বন্ধ করে তাজরিয়ান পেছনে ফিরে এগোতে লাগলো। মেহরিমা পেছাতে পেছাতে সোজা বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়লো।

তাজরিয়ান তার পাশে বসে মেহরিমাকে টেনে তার কোলে বসালো। মেহরিমার গলায় পেঁচানো ওড়নাটা আলতো করে সরিয়ে দিয়ে কাঁধ এবং গলার দাগগুলো দেখলো। মেহরিমা লজ্জারুণ ভীত মুখটা নামিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রইল কেবল। তাজরিয়ান আলতো হাতে দাগগুলো ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

–” তোর তুষারের ন্যায় ফর্সা পেলব ত্বকে আমার দেওয়া স্পর্শ গুলো ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে বউজান।”

বউজান ডাকটা শুনে তড়িৎ গতিতে তাজরিয়ানের দিকে তাকাল মেহরিমা। অস্ফুটস্বরে বলল,

–” নষ্ট পুরুষ কোথাকার। ”

তাজরিয়ান শব্দ করে হেসে ফেললো। পাঞ্জাবির উপরের বোতাম গুলো উন্মুক্ত করে বাঁকা হেসে বলল,

–” তুই চাইলে এই নষ্ট হৃদয়ে তোর পরিশুদ্ধ অধরোষ্ঠের পবিত্র চুম্বন এঁকে দিয়ে আমায় শ্রেষ্ঠ পুরুষ বানিয়ে দিতে পারিস বউজান। বিশ্বাস কর আমি একটুও বাঁধা দিবো না। ”

মেহরিমা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বেসামাল। তাজরিয়ান দুহাতে মেহরিমা কে আগলে নিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো। মেহরিমা ব্যথাতুর শব্দ তুলে বলল,

–” মেরে ফেলবেন নাকি? ”

তাজরিয়ান ফট করে উত্তর দিলো,

–” তুই সম্মতি দিলে তোকে আদরে আদরে দম আঁটকে আসার মতো অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি । ”

মেহরিমা প্রত্যুত্তর করলো না। গতকাল থেকে আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে। চৌধুরী বাড়ির সবচেয়ে রাগী ছেলেটা.. যাকে দেখলে মেহরিমা ভয়ে থরথর করে কাঁপত আজ সেই ছেলেটা তার স্বামী। বদরাগী ছেলেটার সাথে সংসার জীবনে পদার্পন করতে যাচ্ছে সে। সকলের অতিরিক্ত আহ্লাদী হলেও মেহরিমা মোটেও ন্যাকা ধরনের মেয়ে নয়। সবটা ভেবে ভেতর থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

তাজরিয়ান উঠে গিয়ে পোশাক পাল্টে স্রেফ একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আসলো। মেহরিমা চোখমুখ খিঁচিয়ে অন্যপাশ ফিরে শুলো। তাজরিয়ান বাঁকা হেসে মেহরিমার পাশ ঘেঁষে শুয়ে তাকে নিজের দিকে ফেরলো। মেহরিমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে নেশালো কন্ঠে বলল,

–” বউ তার একমাত্র স্বামীর সাথে দূরত্ব বাড়ালে মৃত্যু সেই অবাধ্য বউদের গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এরপর সেসব বেয়াদব বউয়েরা সোজা কবরে গিয়ে ল্যান্ড করে এবং হাজারো সাপ, বিচ্ছু, পোকামাকড়, টিকটিক ওদের সুশ্রী সুন্দর দেহাখানা খেয়ে ফেলে। এবার তুই বল স্বামীর দু/চারটা আদুরে কামড় খাওয়া ভালো নাকি সাপের ছোবল খাওয়া ভালো? ”

তাজরিয়ানের কথায় মেহরিমার সারা শরীর শিউরে উঠলো। তাজরিয়ান কত বড় মাপের ম্যানুপুলেটিভ পারসন তা আর বুঝতে বাকি নেই মেহরিমার। কীয়ৎকাল নিশ্চুপ থেকে আকস্মিক মেহরিমা শুধাল,

–” গতকাল রাতে আমাদের মধ্যে কিছু হয়েছে? ”

সবে চোখটা লেগে এসেছিল তাজরিয়ানের। মেহরিমার কথায় বিরক্ত গলায় বলল,

–” তুই সকালে উঠে কিছু টের পেয়েছিস? ”

মেহরিমা আমতা আমতা করে বলল,

–” না কিন্তু গলার দাগগুলো আর.. জামাকাপড়..

তাজরিয়ান আড়মোড়া ভেঙে হাস্কি স্বরে বলল,

–” ওগুলো তোর শাস্তি ছিলো আর জামাকাপড়…

মেহরিমা বিরক্ত হয়ে শুধাল,

–” কিসের শাস্তি? অর্ধেক কথা বলে থেমে গেলেন কেনো? ”

হুট করে গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো তাজরিয়ানের। রাগের মাথায় ওসব করলেও পরবর্তীতে জ্বরপীড়িত, দুর্বল মেহরিমার অবস্থা দেখে দ্রুত ওকে স্পঞ্জ বাথ দিতে বাধ্য হয়। ধৈর্যহীন তাজরিয়ানের পুনরায় সেসব পরিয়ে দেওয়ার কথা মাথাতে আসেনি। শেষ রাত পর্যন্ত জলপট্টি দিয়ে পরবর্তীতে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছে মাত্র। সেসব চেপে গিয়ে তাজরিয়ান দুষ্টু হেসে বলল,

–” নবীন বরণে শাড়ি পরার শাস্তি। তোর জামাকাপড় সরিয়েছি কারণ আমার হিংসে হচ্ছিল।”

মেহরিমা অবাকের শীর্ষে পৌঁছে বলে,

–” কিসের হিংসা?”

তাজরিয়ান একটুখানি মেহরিমার দিকে এগিয়ে ওকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

–” আমি ব্যতীত আমার বউকে অন্য কিছু এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছিল ব্যপারটা আমার ভালো লাগেনি। ”

মেহরিমা অবাক সুরে বলল,

–” আপনি পাগল? ”

তাজরিয়ান বাঁকা হেসে বলল,

–“তোর ধনুকের ন্যায় বাঁকানো অপরুপ মেয়েলি সৌন্দর্যের পাগল আমি। ”

মেহরিমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। তাজরিয়ান সেটা অনুভব করে বলল,

–” আপাতত ঘুমাতে চাইছি বউজান। কাঁপা-কাঁপি করে আমার সংযমের দেওয়ালে আঘাত হানলে আগামী একসপ্তাহ পর্যন্ত অবিরত কাঁপতে থাকার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবো। ”

মেহরিমা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তাজরিয়ান তা দেখে ফাঁকা ঢোক গিলে বিড়বিড়িয়ে বলল,

–” ব্রেইনলেস মহিলা কোথাকার। ”

অতঃপর নিঃশব্দ কিছু মুহূর্ত কাটলো। মেহরিমা আকস্মিক শুধাল,

–” সত্যি সাত বছর আগের ঘটনাটা আপনি মন থেকে মুছে ফেলেছেন? ”

তাজরিয়ান কিছু একটা ভেবে বলল,

–” সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ভুলে গিয়েছি তবে সাত বছর ধরে ঘটাতে থাকা ঘটনা গুলো খুব যত্ন করে মার্ক করে রেখেছি আমি। প্রত্যেকটা ভুলের জন্য খুব আদুরে শাস্তি পেতে যাচ্ছিস তুই। ”

মেহরিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,

–” মানে? ”

তাজরিয়ান কঠোর গলায় বলল,

–” মানেটা হলো, আমার কথার অবাধ্য হওয়া, অন্য ছেলের সাথে কথা বলা, সেজেগুজে অন্যের সামনে যাওয়া.. আরও কতকিছু । ”

তাজরিয়ানের কথায় মেহরিমা ফাঁকা ঢোক গিলে শুধাল,

–” ভালোবাসেন আমায়? ”

তাজরিয়ান নাকচ করে বলল,

–” আমি তোকে একদমই ভালোবাসি না। ”

মেহরিমার কেনো যেনো কথাটা ভালো লাগলো না। বুকের ভেতরে অদ্ভুত যন্ত্রণা হলো। নিজেকে সামলে পুনরায় শুধাল,

–” তাহলে ধরে বেঁধে সংসার করতে চাইছেন কেনো?”

তাজরিয়ান সহজ গলায় বলল,

–” কারণ তুই আমার অপ্রকৃতস্থ মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক ধরনের অপরিবর্তিত চাহিদা। আমার স্বস্তির জন্য, শান্তির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য তোকে লাগবে। ”

মেহরিমা কাঁপা স্বরে শুধাল,

–” আপনার ভাষ্যমতে ভালোবাসা আর চাহিদার মধ্যে পার্থক্য কী? ”

তাজরিয়া স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো,

–” ভালোবাসা হলো ক্ষণিকের মোহ। যখনই অপরপক্ষ তোকে পূর্ণাঙ্গ রুপে জেনে যাবে তখনই তোর প্রতি তার ভালোবাসা স্যাটেলাইটের মতো মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। চাহিদা হলো আমৃত্যুর সঙ্গী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের চাহিদা অক্ষুণ্ণ থাকে। নিঃশ্বাস বিলীন হওয়ার পূর্বে মানুষের চাহিদা কখনো বিলীন হয়না। ”

তাজরিয়ানের বীভৎস কথাবার্তার বিপরীতে বলার মতো আর কিছুই খুঁজে পেলনা মেহরিমা। চোখবুঁজে চুপচাপ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।

_

সন্ধ্যার শেষ প্রহরে নিচে নামল তাজরিয়ান এবং মেহরিমা। অসময়ে ওদের দু’জনকে নামতে দেখে ড্রয়িংরুমে আড্ডারত সকলেই সেদিকে তাকাল। তাজরিয়ান ব্ল্যাক পোলো টিশার্ট এবং ধূসর রাঙা একটা ট্রাউজার পরেছে। মেহরিমার পরনে আছে হালকা নীল রঙের একটা আরামদায়ক শাড়ি। দু’জনকে পাশাপাশি এতটাই চমৎকার লাগছে যে উপস্থিত প্রত্যেকে মা শা আল্লাহ বলে উঠলেন।

তারা এগিয়ে এসে সোফায় বসতেই শুনতে পেলো আরশিয়ান এবং তার দাদা ও বড় চাচার কথোপকথন। তার দাদা তৌকির আফজাল চৌধুরী আরশিয়ান কে বলছেন,

–” দাদু ভাই? আর কত বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকবে? মরে গেলে তোমার হাতের মাটি আদৌ কপালে জুটবো তো? ”

আরশিয়ান নিশ্চুপ। তার বাবা আরিয়ান চৌধুরী বলে উঠলেন,

–” তুই বিয়ে না করলে আমরা তোকে জোর করবো না তবে এবার দেশে ফিরে আয়। দোহাই লাগে আল্লাহর… আমাদের আর অশান্তি দিস না। ”

আরশিয়ান এবারেও নিশ্চুপে বসে রইল। আরিয়ান চৌধুরী শেষ পর্যন্ত বললেন,

–” তোকে বসুন্ধরার ব্রাঞ্চে বসতে হবে না। তুই বরং উত্তরার ব্রাঞ্চে বস। আমাদের আর একলা করিস না বাবা। আমরা ভীষণ ক্লান্ত। তোর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বুঝলেও এখন আমরা নিরুপায়। শেষ বয়সটা সন্তানের সাথে কাটাতে চাওয়াটা অন্যায়?”

আরশিয়ান হাতে থাকা কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে বলল,

–” আর ফিরবো না লন্ডনে। ”

ছোট্ট একটা বাক্য রীতিমতো আনন্দের বন্যা বইয়ে দিলো চৌধুরী বাড়িতে। এবারের ঈদটা যেনো একটু বেশিই সুন্দর তাদের জন্য। ভবিষ্যতের অপ্রিয় বাস্তবতা জানলে বোধহয় ছেলেকে এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতেন না আরিয়ান চৌধুরী। মানুষ যতোই চেষ্টা করুক না কেনো, ভাগ্যের লিখন খণ্ডানো অসাধ্য ব্যপার।

চলবে?