#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ০৭
আজ প্রিমার অফিসের প্রথমদিন। সকালে দু’টো টিউশনি করিয়ে এখন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে সে। শাড়ি তার জন্মের শত্রু কিন্তু সে তো নিরুপায়। চাকরি বাঁচাতে হলে এই আপদটার সাথে বন্ধুত্ব করতেই হবে। আধঘন্টা প্রচেষ্টার পর অবশেষে শাড়িটা ঠিকঠাক ভাবে পরতে সক্ষম হলো সে।
পরিশেষে কয়েক দফা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করার পর স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিমা। তার সুশ্রী মুখশ্রীতে লেপ্টে আছে একরাশ রাগ এবং বিরক্তি। ফারজানা তার উদ্ভট কর্মকান্ড দেখে সকাল থেকেই হেসে যাচ্ছে। তার টিটকারি মূলক হাসি প্রিমা সইতে না পেরে রাগান্বিত স্বরে বলল,
–” হাসি বন্ধ করে আমাকে সেফটিপিন এডজাস্ট করতে হেল্প করো বুবু। এই দুষ্টু পোশাক খুলে পড়লে আমার সম্মান নিলামে উঠবে সেই খেয়াল আছে তোমার?
প্রিমার কথায় আরেক দফা শব্দ করে হেসে ফেলে ফারজানা। তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলে,
–” লাড্ডু রে তোকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। ”
প্রিমা নাকমুখ কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” তোমাকে বিটকেলের চাচাতো বোন দেখাচ্ছে বুবু। ”
ফারজানার হাসি হাসি মুখশ্রীতে নিমিষেই কপাট রাগ ভর করল। ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” বয়সে তোর ছয় বছরের সিনিয়র হই। সম্মান দিয়ে কথা বলবি প্রিমা। ”
প্রিমা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
–” তাতে কী? তুমি তো সিঙ্গেল। না করতে পেরেছো একটা বিয়ে আর না বানাতে পেরেছো আমায় খালামুনি। সম্মান চাইতে শরম করে না তোমার ? ”
ফারজানা হতবিহ্বল হয়ে শুধাল,
–” সম্মান পেতে হলে জামাই থাকা লাগে? ”
প্রিমা ভাব নিয়ে বলল,
–” অবশ্যই সাথে পাঁচ কিংবা দশ বাচ্চার জননী হওয়া লাগে। তুমিই বলো লাইফে এসব বিশিষ্ট অর্জন না থাকলে কাউকে সম্মান দেওয়া ঠিক?”
ফারজানা রেগেমেগে বিড়বিড়য়ে বলে উঠল,
–” ব্যাটা বদ জামাই। কবরে যাওয়ার বয়স তরতরিয়ে বাড়ছে অথচ তার দেখা নাই। একটা তুমি আর তোমার ছানাপোনাদের অভাবে জুনিয়রদের কাছে প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছি। এসো হে জামাই, জলদি এসে এই অসম্মানের হাত থেকে মোরে বাঁচাও। ”
খাল কেটে কুমির আনার আর্জি এত দ্রুত খোদা কবুল করে নিবে সেটা বোধহয় বেচারি ফারজানা বুঝেনি। দু’জনে আরও কিছুক্ষণ খুনসুটি করে বেরিয়ে পড়লো অফিসের উদ্দেশ্যে। বাসার সামনে থেকে একটা সিএনজি নিয়ে তারা রওনা দিলো গন্তব্যের দিকে। দু’জনে গল্প করছিল মনের সুখে আচমকা বিপরীত দিক থেকে আসা একটা প্রাইভেট কার সজোরে ধাক্কা মারে তাদের সিএনজিতে। তৎক্ষনাৎ সিএনজি উল্টে পড়ে পিচঢালা রাস্তায় । তারা দু’জন কিছু বুঝে উঠার আগেই তীব্র আঘাতে জর্জরিত হয়।
এক্সিডেন্ট হওয়ার মিনিট খানেকের মাথায় রাস্তার লোকজন জড়ো হয়ে কার ড্রাইভারের উপর চড়াও হয়। কালো কাঁচ আবৃত বুলেটপ্রুফ গাড়িটা থেকে একজোড়া শিকারী দৃষ্টি নিশ্চুপ ভাবে কেবল পুরো পরিস্থিতি অবলোকন করছিল । আশেপাশের কোলাহলে তার কোনো ভাবাবেগে নেই। আগন্তুক শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে রেখে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সম্মুখে পড়ে থাকা সিএনজিটার দিকে৷ কিছুক্ষণের মাঝে লোকজন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভেতর থেকে দু’টো মেয়েকে বের করে আনে। একজন হুঁশে থাকলেও অন্যজন কিছুটা নেতিয়ে পড়েছে।
ছোটোখাটো উচ্চতার, নিটোল ফর্সা এবং গোলগাল চেহারার শাড়ি পরিহিতা এক মেয়ের কোলের উপর জ্ঞানহীন মেয়েটার মাথা ধরে রেখে পাগলের মতো আহাজারি করছে। অস্থির কন্ঠে বলছে,
–” লাড্ডু? এ্যাঁই লাড্ডু? উঠ না সোনা৷ কিচ্ছু হয়নি তো। চোখ খুলে দ্যাখ? ”
ছেলেটার কানে অস্পষ্ট ভাবে আঘাত হানে সেই আর্তনাদের স্বর। আশেপাশের গুটিকয়েক লোকজন তামাশা দেখতে ব্যস্ত, কেউবা ভিডিও ধারণ করছে, ক’জন মাস্তান গোছের লোকজন যা তা বলে গালি দিচ্ছে ড্রাইভারকে। তন্মধ্যে ভিড়ের মাঝে কিছু সুযোগসন্ধানী লোকজন সাহায্যের নামে এগিয়ে এসে কলুষিত হাতে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সেই কোমলমতি নারীর শরীর। দৃশ্যটা চোখে পড়তেই রাগে শক্ত হয়ে আসে সেই পুরুষের চোয়াল। সিটবেল্ট খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে, ঠান্ডা পানির বোতল হাতে বেরিয়ে আসে সেই আগন্তুক।
কলো রঙের মার্সিডিজ গাড়িটা থেকে একজন সুদর্শন যুবক কে বেরিয়ে আসতে দেখে সকলে খানিকটা থমকে যায়। চোখ ধাঁধানো সুন্দর সেই পুরুষ কে দেখামাত্র ক’জন চিনে ফেলে তাকে। এই ব্যক্তি আর কেউ নয় বরং লন্ডনের বেস্ট হার্ট সার্জন এবং সিঙ্গার শওকাতুল ইশতিরাজ চৌধুরী। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে আরেক দফা চমকে যায়। ইশতিরাজ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেই আহত মানুষ দুটোর দিকে।
এক্সিডেন্টে দু’জনেই মোটামুটি আঘাতপ্রাপ্ত তবে মাথায় তীব্র আঘাত পাওয়ায় প্রিমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দুর্বল চিত্তের ফারজানা পুরো বিষয়টাতে মারাত্মক প্যানিকড হয়ে গেছে। প্রিমাকে হসপিটালে নেওয়ার কথা তার মাথাতেই আসেনি। ইশতিরাজ ফারজানার সন্নিকটে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে তার দিকে পানির বোতল টা এগিয়ে দেয়। ফারজানা ওকে গাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছে। এসব বড়লোকের ভাবসাব তার ঢের জানা আছে। তীব্র রাগে হুঁশ খুইয়ে ফারজানা বোতলের সবটুকু পানি ইশতিরাজের মুখে ছুঁড়ে মেরে রাগান্বিত স্বরে বলে,
–” আদিখ্যেতা দেখাতে হবেনা। বড় লোকের বিগড়ে যাওয়া পোলাপানের কর্মকান্ড সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা আছে আমার। আপনি চলে যান এখান থেকে নয়তো আমার হাত উঠে যাবে। ”
ইশতিরাজের শান্ত মস্তিষ্ক ধপ করে গরম হয়ে গেলো। এইটুকু একটা মেয়ে তার মতো একজন মানুষ কে অপমান করছে ব্যপারটা হজম করতে পারলোনা। মেজাজ হারিয়ে শক্ত গলায় বলল,
–” ডাফার কোথাকার, তুমি জানো আমি কে? ”
ফারজানা অল্পবিস্তর চিনে লোকটাকে। ক’দিন আগে তার এক কলিগের ফোনে এই বদ লোকের একটা কন্সার্টের ক্লিপ দেখেছে। পুরো দৃশ্যটা স্মরণে আসতেই ফারজানা রাগান্বিত স্বরে বলে,
–” স্টেজে উঠে কিছুক্ষণ বাঁদরের মতো লাফালাফি করে পরক্ষণে গরুর মতো হাম্বা হাম্বা করা পাবলিক কে চেনার প্রয়োজনবোধ করছিনা একদমই। ”
ভয়ানক রাগটা এবার মস্তিষ্কে চেপে বসলো ইশতিরাজের। কথা না বাড়িয়ে জ্ঞানশূন্য প্রিমা কে এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নিয়ে, শক্ত করে ফারজানার হাত টেনে ধরে নিয়ে গেলো গাড়ির কাছে। ফারজানা পুরো ব্যপারটা বুঝে হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে ইশতিরাজ আরও শক্ত করে চেপে ধরে। দু’জনকে গাড়িতে বসিয়ে ছুটে যায় হসপিটালের দিকে৷
_
মাথায় বেশ আঘাত লেগেছে প্রিমার। কেবিনের ভেতর তার চিকিৎসা চলছে। ফারজানা চিন্তিত মুখে বসে আছে ওয়েটিং রুমে। ড্রেসিং করানোর দৃশ্যটা দেখা তার পক্ষে পসিবল ছিলনা বলেই বাহিরে বেরিয়ে এসেছে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একজন নার্স এবং ইশতিরাজ বেরিয়ে আসলো। ফারজানা ছুটে গিয়ে নার্স কে প্রশ্ন করল,
–” প্রিমা কেমন আছে? ”
নার্স ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–” উনার নাম প্রিমা? রিপোর্ট কার্ডে নামের জায়গায় তো লাড্ডু দেওয়া আছে। ”
ফারজানা এবার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইশতিরাজের দিকে। গমগমে আওয়াজে বলল,
–” বোধবুদ্ধিহীন লোক কোথাকার । মানুষের নাম কখনো লাড্ডু হয়? ওটা কেনো লিখিয়েছেন রিপোর্ট কার্ডে? ”
ইশতিরাজ হাতের ইশারায় নার্স কে চলে যেতে বলল। ফারজানার চোখে চোখ রেখে তার দিকে দু পা এগিয়ে গিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধায়,
–” উনাকে ভর্তি করানোর সময় আপনি হুঁশে ছিলেন? দায়িত্ব পালন করার সময় বাচ্চাদের মতো কেঁদেকুটে হার্টবিট বাড়িয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে বিলাপ করছিলেন বসে বসে। আমাকে অহেতুক দোষারোপ করে লাভ আছে? ”
ফারজানা কথার পৃষ্ঠে আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে গেলো। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
–” প্রিমা ঠিক আছে? আমি ভেতরে যেতে পারবো?”
ইশতিরাজ মাথা নাড়িয়ে বলে,
–” বেশি আঘাত পাননি। মাত্র তিনটে সেলাই পড়েছে মাথায়। দেখা করতে পারবেন। ”
ফারাজানার বুকটা কেঁপে উঠে। মনি মারা যাওয়ায় পর থেকে ছোট্ট প্রিমা কে বুকে আগলে মানুষ করেছে সে। প্রিমা তার কাছে সন্তান তূল্য। সে হড়বড়িয়ে ছুটে যায় কেবিনের দিকে। ইশতিরাজ এক পলক সেদিকে তাকিয়ে বলে,
–” স্ট্রেঞ্জ। চার্ম কমে গেলো নাকি আমার? পিচ্চি সাইজের নাগা মরিচ আমায় ইগনোর করছে ব্যপার কী? ”
প্রিমা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য তাকে সেলাইন দেওয়া হয়েছে। মাথায় গোল করে সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো। ফারজানার বুকটা ভার হয়ে আসলো। চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
–” আমার কলিজার টুকরা, দ্রুত সুস্থ হয়ে যা। আল্লাহ তোকে এত কষ্ট কেনো দেয়? তোর সমস্ত কষ্ট আমার হোক, আমার সমস্ত সুখ তোর হোক। আল্লাহ তোর আয়ু বাড়িয়ে দিক। ”
নৈঃশব্দে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে ইশতিরাজ। হাতে তার দু’টো অন টাইম কাপ ভর্তি কফি। পাশের টেবিলে সেগুলো রেখে গলা খাঁকারি দিলো সে। ফারজানা পেছনে ফিরে রাগান্বিত স্বরে বলল,
–” চোখে উকুন পড়েছিল? মস্ত বড় একটা সিএনজি চোখে পড়েনি আপনার? আদৌ প্রাইভেট কার চালাতে জানেন নাকি কোনো লোকাল বাসের হেল্পার আপনি? আপনার জন্য আমার বাচ্চাটা এত সাফার করছে। ”
কথাগুলো বলে ফোঁপাতে ফোপাঁতে আবারও প্রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ফারজানা। ইশতিরাজ থমকানো চোখে দেখে ফারাজানার মমতাময়ী রুপ। তার কঠিন হৃদয়ের কোথাও একটা ফাটল ধরে। আনমনে সে বলে উঠে,
–” ক্রন্দনরত চোখে জ্বলে উঠা ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ নারীর সৌন্দর্য সাংঘাতিক মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ”
ফারজানার বলা কথাগুলোর প্রত্যুত্তরে ইশতিরাজ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–” আপনাদের সিএনজি রং সাইড দিয়ে অতিরিক্ত ফোর্সে আসছিল। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করে হার্ড ব্রেক করেছিলাম বিধায় আপনাদের হাড্ডি-গুড্ডি এখনো সহিসালামত আছে। দ্যাট ওয়াজ নট মাই ফল্ট। ”
ফারজানা রেগে তেড়ে আসে ইশতিরাজের দিকে। আঙ্গুল উঁচিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
–” আপনার চোখ নষ্ট। আপনি কম দেখেন। আপনি মোটেও দক্ষ ড্রাইভার নয়। ”
আঙুল উঁচিয়ে কথা বলায় ইশতিরাজের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে। অদ্ভুত কারণে সে তার বিধ্বংসী রাগটা প্রকাশ করতে পারছেনা। চট করে ফারজানার হাতটা ধরে টেবিলের উপর থাকা ট্রে থেকে ল্যানসেট ট্রিগার নিয়ে ফারজানার হাতের আঙ্গুলে প্রেস করে। মুহূর্তে ব্যথাতুর শব্দ করে উঠে ফারজানা। সে হাত সরিয়ে নিতে চাইলে ইশতিরাজ আরও শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। আঙ্গুলের ডগা থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে সেটা গ্লুকোজ মিটারের স্ট্রিপে রেখে কিছু একটা পরীক্ষা করে। ফারজানা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। ইশতিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–” আমার চোখ একদম পার্ফেক্ট আছে। মানুষ কিংবা মুরগী দুটোই সঠিক ভাবে পরখ করতে পারি। ড্রাইভিংয়ে দক্ষ না হলেও ডাক্তার হিসেবে বেশ দক্ষ আমি । এটা জাস্ট নমুনা ছিলো, প্রমাণ চাইলে অবশ্যই জানাবেন। ”
ফারজানার ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
–” আপনি কী আমায় মুরগী বললেন? কসাই কোথাকার। আর কিসের প্রমাণ দেখাবেন আপনি ? ”
ইশতিরাজ বাঁকা হেসে বলল,
–” যাক কিছু একটা অন্তত সঠিক বুঝলেন। ডাক্তারি পেশায় নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে ফ্রি-তে আপনার ওপেন হার্ট সার্জারি করে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই তবে কৃতজ্ঞতা সরূপ আপনি চাইলে আপনার হার্ট টা ডোনেট করতে পারেন। ”
ফারাজানার সাহস নিমিষেই ফুরিয়ে গেলো। মুখ দিয়ে কোনোপ্রকার কথা বেরোলো না। ইশতিরাজ গ্লুকোজ মিটারের রেজাল্ট পরখ করে বলে উঠল,
–” গুডলাক! ডায়াবেটিস নেই। আপনি চাইলে মিষ্টি খেয়ে এই তেঁতো জিহবায় কিছুটা মিষ্টতা আনতে পারেন। ”
ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করল সেই অপমান। কিছুক্ষণের মাঝে প্রিমার জ্ঞান ফিরে আসতেই সে জানাল তার ডিসচার্জ চায়। ইশতিরাজ বাধ্য হয়ে সমস্ত ফর্মালিটিস পূরণ করে ডিসচার্জের ব্যবস্থা করল। একটা প্রেসক্রিপশন প্রিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–” মেডিসিন গুলো টাইমলি নিবেন। গাফেলতি করলে সুস্থ হতে ব্যপক সময় লাগবে। ”
প্রিমা প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিল। আকস্মিক তার চোখ আটকাল নামের দিকে। নাক মুখ ফুলিয়ে রেগে ফারজানার দিকে তাকাতেই বেচারি কাচুমাচু করে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফাঁকা ঢোক গিলল। ইশতিরাজ পুরো বিষয়টা অবলোকন করে ভেতরে ভেতরে বেশ মজা পেলো। পরক্ষণে গলা খাঁকারি দিয়ে বিনয়ের সুরে বলল,
–” যেহেতু ভুলবশত একটা ভুল হয়েই গেছে তাই গ্লানিবোধ মেটাতে আমি আপনাদের গন্তব্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাইছি। আপনাদের আপত্তি আছে? ”
ফারজানা তৎক্ষনাৎ মানা করতে চাইলেও প্রিমার সম্মতিসূচক প্রত্যুত্তর মানতে বাধ্য হলো। ইশতিরাজ তাদের অফিসের নিচে ড্রপ করে দিয়ে চলে গেলো। তারা মোটামুটি দশ মিনিট লেট। দু’জনের বুকে একরাশ ভয় চেপে, চিন্তিত মুখে ভেতরে প্রবেশ করল। তারা ভেতরে আসতেই রিসেপশনিস্ট ব্যস্ত কন্ঠে সিইওর রুমে যাওয়ার তাগাদা দিল।
_
কাঁচ ঘেরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত কেবিনে বসে মনোযোগের সহিত ফাইলের ভুল-ভ্রান্তি গুলো পর্যবেক্ষণ করছে আরশিয়ান। আচমকা দরজায় টোকা পড়লে ফাইলে দৃষ্টি রেখেই গমগমে আওয়াজে বলে,
–” কাম ইন। ”
ফারজানা এবং প্রিমা চোরের মতো মুখভঙ্গি করে ভেতরে প্রবেশ করে। আরশিয়ান ফাইলে মুখ গুঁজে রেখে গম্ভীর কন্ঠে শুধায়,
–” সলিড কোনো এক্সকিউজ থাকলে বলুন। ”
প্রিমা এবং ফারজানা একে-অপরের দিকে তাকায়। আরশিয়ানের রাগান্বিত স্বর তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না কারোরই। আরশিয়ান কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে তাদের মুখ তুলে তাকাল। প্রিমার ব্যান্ডেজে মোড়ানো মাথা এবং ফারাজানা আঘাতপ্রাপ্ত মুখশ্রী দেখে তার চোখের দৃষ্টি নমনীয় হয়ে আসলো। নম্র কন্ঠে বলল,
–” প্লিজ টেক ইয়্যোর সিটস। ”
দু’জনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বসে পড়লো। ফারজানা শর্টকাটে পুরো ঘটনা খুলে বলতেই আরশিয়ানের কড়া মেজাজ কিছুটা নরম হলো। ফারজানা কে কাজে যেতে বলে প্রিমাকে থাকতে বলল। ফারজানা বেরিয়ে যোতেই ভীষণ শান্ত সুরে আরশিয়ান বলল,
–” মিস অধরা ইসলাম প্রিমা? ”
ব্যথায় কাতর প্রিমা সল্প স্বরে জবাব দিল,
–” জ্বী? ”
আরশিয়ান তার ব্যথাতুর চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
–” আপনার জন্য মিস ফারাজানা আমাদের কাছে বিশেষ ভাবে সুপারিশ করেছিলেন। আপনার ইন্টারভিউ নেওয়ার পর আমরাও সন্তুষ্ট হই তবে একজন সিনিয়র অফিসারের আন্ডারে পিএ পোস্টে জব করার জন্য আপনি যথেষ্ট কোয়ালিফাইড না। আপনার কাজ শিখে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করা বাকি। কাজে একটু ভুল মানে কোম্পানির লস। এই সমস্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে একটা সিধান্ত নেওয়া হয়েছে। ”
প্রিমা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশিয়ানের দিকে। কথাগুলো শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। দিনশেষে আবারও কী নিয়তি তাকে ঠাকাবে? এবার ভাগ্যের বোধহয় একটুখানি দয়া হলো। আরশিয়ান তার ভয় কে মিথ্যে করে দিয়ে বলল,
–” আমরা সম্মিলিত ভাবে সিধান্ত নিয়েছি আপনি আপাতত আমার পিএ হিসেবে কাজ করবেন। প্রতিদিনের শিডিউল তৈরি, মিটিংয়ের ডেট ফিক্সড করা, প্রেজেন্টেশনের স্লাইড রেডি করা, এডিটিং, ফাইল রিচেক সহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেহেতু আপনার কমিউনিকেশন স্কিল ভালো তাই যেকোনো ডিলের ক্ষেত্রে আপনাকে সাথে নেওয়া হবে। কোনোপ্রকার কোনো সমস্যা হলে ম্যানেজার আপনাকে হেল্প করবে। মেইন ফ্যাক্ট হলো, আপনার বেতনের স্কেল পরিবর্তন করা হয়েছে। আপনি ডিটেইলস চেক করে আমাকে সিধান্ত জানান। ”
কথাগুলো বলেই আরশিয়ান তার দিকে একটা চুক্তিপত্র এগিয়ে দিল। প্রিমা ঘোলাটে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখল, বেতনের সংখ্যাটা নেহাত কম নই তবে যতটা পরিশ্রম যাবে তার তুলনায় অতি নগন্য। সে ম্লান হেসে কলম তুলে সাইন করে দিল। আরশিয়ান তা দেখে খানিকটা অবাকই হলো। এত কম বেতন হওয়া সত্ত্বেও তার আপত্তি না দেখে কিংবা কোনোপ্রকার কথা না বাড়ানোর প্রসঙ্গটা তাকে ভাবিয়ে তুলল। প্রিমা ফাইলটা আরশিয়ানের দিকে এগিয়ে দিতেই আরশিয়ান গম্ভীর স্বরে বলল,
–” আপাতত বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। আপনাকে তিনদিনের ছুটি দেওয়া হলো তবে জয়েন করার পর ওভারটাইম করে সেটা পুষিয়ে দিতে হবে নয়তো বেতন কাটা পড়বে। আপাতত আপনাকে কিছু ফাইল দিচ্ছি, ওগুলো বাসায় নিয়ে গিয়ে সবগুলো হিসেবে নির্ভুল ভাবে চেক করে আমাকে জানাবেন। ”
প্রিমা পুনরায় শীতল স্বরে বলল,
–” ওকে স্যার।
রিনরিনে রোবোটিক কন্ঠটা কানে আসতেই আরশিয়ান থমকাল। কিছুটা থেমে আবারও বলল,
–” আপনি আপাতত আসতে পারেন। অফিসের গাড়ি নিচে আছে। আমি ইনফর্ম করে দিচ্ছি, উনি আপনাকে সেইফলি পৌঁছে দিবেন। ”
কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। ধন্যবাদ জানিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারো ধপ করে বসে পড়ল প্রিমা। আচানক মাথাটা ঘুরিয়ে উঠেছে তার। আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে হালকা গলায় বলে,
–” আর ইয়্যু ওকে মিস প্রিমা?”
প্রিমা জবাব দিল না। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এসেছে তার। প্রিমার অবস্থা দেখে আরশিয়ান দ্রুত ফারজানা কে খবর পাঠাল। খবর পেতেই ফারজানা যেনো উড়ে আসলো৷ আরশিয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফারজানা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
–” এই কন্ডিশনে উনাকে কেনো নিয়ে এসেছেন? শী নিডস রেস্ট। আমাকে রিপোর্ট সহ ইনফর্ম করলেই হতো। ”
ফারজানার ওসব কথা আদৌ কানে ঢুকলো কিনা কে জানে। সে তো প্রিমা কে নিয়ে আহাজারিতে ব্যস্ত। প্রিমা শরীরের ভার ছেড়ে সম্পূর্ণ নিস্তেজ ভঙ্গিতে গা এলিয়ে বসে রইল আরামদায়ক চেয়ারটাতে। ফারজানা তাকে উঠাতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। প্রিমা বেশ লম্বাচওড়া মানুষ তার উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে। অসুস্থ ফারাজানার পক্ষে তার ভার বহন করা সম্ভব না কথাটা বুঝতে পারা মাত্রই লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আরশিয়ান। তার অভ্যন্তরীণ জেন্টলম্যান সত্তা বলে উঠল,
–” মেয়েটা গতকাল তোকে সমস্ত বিপদ থেকে বাঁচিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। ঋণ শোধ করার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করিস না ব্যাটা। নিজের দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে পড়া কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয়। ”
অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে ফর্মাল শার্টের উপরকার ব্লেজারটা খুলে স্লিভদুটো কুনুই পর্যন্ত গুটিয়ে ফেলল। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে সামান্য ইতস্তত করে শান্ত সুরে ফারাজানা কে জিজ্ঞেস করল,
–” আমি কী উনাকে নিচ পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করব? ”
ফারজানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই আরশিয়ান ফোঁস করে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে ভীষণ সাবধানে প্রিমার পালকের ন্যায় হালকা শরীরটা পাজাকোলে তুলে নিল। সহসা প্রিমার অচেতন মাথাটা গিয়ে ঠেকল তার বুকের বাঁ পাশে। প্রিমার নড়বড়ে চুলের খোপাটা খুলে গিয়ে ঝর ঝর করে হাঁটুর নিচ অব্দিই লম্বা চুলগুলো আরশিয়ানের শক্তপোক্ত শরীরটার সাথে লেপ্টে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আচমকা আরশিয়ান থমকাল।
প্রিমার শরীর থেকে ভেসে আসা ভীষণ চেনা পরিচিত সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত সুবাসটা তার পুরুষালী মনকে বিভ্রান্ত করে তুলল। অদ্ভুত এক আবেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আরশিয়ানকে। মোহে আছন্ন আরশিয়ান কেবল বশীভূত প্রাণীর ন্যায় রোবোটিক ভঙ্গিতে হেঁটে চলল লিফটের দিকে। ওদিকে আরশিয়ানের কোলে অচেতন প্রিমাকে দেখে অফিসের সকলে ফাটা চোখে তাকিয়ে রইল। অনেকে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বলেই ফেলল,
–” প্রথমদিনেই সোজা কোলে চড়ে বসেছে? ক’দিন গেলে তো বোধহয় ঘরের বউয়ের তকমা ছিনিয়ে নিবে। থার্ড ক্লাস স্ট্যান্ডার্ডের মেয়েদের দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। ”
চলবে?