#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ০৮
বৃষ্টিস্নাত নিস্তব্ধ রজনী। চৌধুরী মহলের স্টাডি রুমটায় চিন্তিত মুখে বসে আছে আরশিয়ান। তার সামনে বসা তাজরিয়ানের তীক্ষ্ণ এবং দুর্বোধ্য দৃষ্টি নিবদ্ধ ল্যাপটপের স্ক্রিনে । ঝড়ের গতিতে কীবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অনুসন্ধান চালাচ্ছে সে।
ঘরের পরিস্থিতি থমথমে। নৈঃশব্দ্য কয়েক মুহূর্তে পার হতেই আচমকা দরজায় টোকা পড়ে। দু’জনে চমকে তাকায়। কিছু একটা ভেবে আরশিয়ান পারমিশন দিতেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ইশতিরাজ। তার আগমণের পানে দৃষ্টি স্থির রেখে আরশিয়ান বলে উঠে,
–” আমাদের কথা স্মরণ হলো তবে? ”
ইশতিরাজ এবং আরশিয়ান প্রায় সমবয়সী। পারিবারিক বন্ধুত্ব থেকে তাদের পরিচয়। লন্ডনে একত্রে থাকায় সেই সম্পর্ক গাঢ় হয় এবং এখন তারা বেস্টফ্রেন্ড। হুট করে আরশিয়ান এবং তাজরিয়ান দেশে চলে আসলেও কন্সার্ট থাকায় ইশতিরাজ আসতে পারেনি তাদের সাথে। সুযোগ পেতেই সে-ও আর দেরি করেনি। ফিরে এসেছে মাতৃভূমির টানে।
আরশিয়ানের প্রশ্নে স্মিত হাসে ইশতিরাজ। দুজনের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,
–” ফেরার পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বাড়িতেও যাওয়া হয়নি। তন্মধ্যে আবার এক মিনি সাইজের নাগা মরিচ জীবনে যাতনার সৃষ্টি করেছে বন্ধু। ”
আরশিয়ানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। বিরক্তির সুরে বলল,
–” বিপদ শুধু তোদেরই চোখে দেখে? ঘটনা কী খুলে বল। ”
ইশতিরাজ এবং তাজরিয়ান একত্রে চোখমুখ কুঁচকে তাকাল আরশিয়ানের দিকে। ইশতিরাজ মুখ ভার করে ফারজানার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলল। পুরে বিষয়টা বলা শেষ হতেই অভিযোগের সুরে বলল,
–” এক রত্তি মেয়ে অথচ তেজ দেখায় পাহাড়সম। ওর সাহস দেখে রীতিমতো আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সেই গুরুতর অপমান কোনোভাবেই হজম হচ্ছে না। ”
আরশিয়ান ফিক করে হেসে দিলো। কথা বাড়ানোর অভিপ্রায়ে পুনরায় কিছু বলতে নিলে তাজরিয়ান বলে উঠল,
–” স্টপ ইট গাইজ্। ”
দু’জনেই চমকে তাকাল। তাজরিয়ান ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে চুপ থাকার নির্দেশনা দিয়ে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজল। পেন হোল্ডার থেকে একটা কলম নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাগজে কিছু একটা লিখে তা আরশিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আরশিয়ান হাত বাড়িয়ে সেটা নিলে ইশতিরাজও তার পাশ ঘেঁষে বসে পড়া শুরু করল। গুটিগুটি অক্ষরে তাতে লেখা আছে,
–” আমার কোম্পানির নামে তথ্য ফাঁস করার অভিযোগ উঠেছে। পুরো বিষয়টা ইনভেস্টিগেট করে বুঝলাম তথ্যটা সঠিক। আমার অনুপস্থিতির সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সাইবারনেটিক্স এভিনিউ এর সিইও খুব ধূর্ততার সাথে এই কাজটা করেছে। অফিসে নন ট্রেসেবল বেশ কিছু স্পাই ক্যামেরা লাগানো আছে। ওগুলোর সম্পূর্ণ এক্সেস আমার হাতে থাকায় পুরো বিষয়টা এত দ্রুত জানতে পারলাম। ”
চিরকুটটা পড়ে ইশতিরাজ এবং আরশিয়ানের কপাল কুঁচকে আসলো। আরশিয়ান কলম তুলে পুনরায় সেই কাগজে লিখলো,
–” সবই বুঝলাম কিন্তু কাগজে লিখে চিঠি আদানপ্রদানের কারণ কী?”
তাজরিয়ান চোখমুখ খিঁচিয়ে কোনোমতে মুখে আসা গালিটা আঁটকে লিখলো,
–” আমাদের ফোন, ল্যাপটপ ইভেন বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজের এক্সেস ওদের হাতে আছে। আমাদের সকল পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা প্রতি পদে পদে অবগত হচ্ছে। আমাদের গুপ্ত প্ল্যান সম্পর্কে তারা যেনো বুঝতে না পারে তাই এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।”
ইশতিরাজ ভ্রু কুঁচকে লিখলো,
–” তারা সকলেই জানে তুমি সোস্যাল মিডিয়া এক্সপার্ট প্লাস আমাদের কান্ট্রির অন অফ দ্যা বেস্ট হ্যাকার। তোমার সাথে বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করা কিছুটা বোকামি হয়ে গেলোনা? তারা নিশ্চয়ই এতটা গাধা নয়? ”
তাজরিয়ান বাঁকা হেসে কাগজটা টেনে পুনরায় লিখলো,
–” সাইবারনেটিক্সস এভিনিউ কোম্পানির পরিচালক আমি হলেও বর্তমানে সিইও অন্যকেউ।কোম্পানির সব কাজ সিইওর আন্ডারে থাকে। যদি পুরো কেসে কেউ ফাঁসে তবে সেটা হবে সিইও।সবকিছু জানার পরেও সে নিজেই এই কাজ করেছে।যেহেতু লন্ডনের আইনী ব্যবস্থা খুবই কড়া ধাঁচের তাই সত্যতা সুনিশ্চিত হলে আমার কোম্পানি ধুলোয় মিশে যাবে। যদি শেষ পর্যন্ত কোম্পানি বেঁচেও যায় তাহলে যতটুকু বদনাম ছড়াবে তাতে কোম্পানির ধ্বস নামাটা খুবই কমন ব্যপার। মজার বিষয় হলো তাদের মূল টার্গেট আমার কোম্পানি নয়। আমার কোম্পানিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি ডোবানোর ধান্দায় আছে তারা। ”
তাজরিয়ানের রহস্যময়ী কথায় আরশিয়ান চরম বিরক্ত হলো। পুরো কথা একবারে না বলে এমন সাসপেন্স ক্রিয়েট করার মানে বুঝলোনা। রেগেমেগে দ্রুত হাতে আরশিয়ান লিখলো,
–” তোর কোম্পানিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি ডোবানোর পরিকল্পনা করছে মানে? ”
তাজরিয়ান তার ধৈর্যশীল ভাইয়ের অধৈর্য প্রতিক্রিয়া বেশ ইনজয় করল। বেচারাকে আর ডিস্টার্ব না করে তড়িঘড়ি করে লিখলো,
–” যার তথ্য ফাঁস করা হয়েছে তিনি লন্ডনের অত্যন্ত সফল একজন বিজনেসম্যান। দ্যা মেইন ফ্যাক্ট ইজ, প্রায় মাস ছয়েক পর উনার সাথে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় বাজেটের ডিল হওয়ার কথা চলছে। এই কেলেঙ্কারির ফলস্বরূপ সেটা আঁটকে যেতো এবং আমাদের রাইভাল টিম সেই সুযোগ হাতিয়ে নিয়ে দেশের নামকরা কোম্পানির ট্যাগটা নিজের করে নিতো। ”
এতক্ষণে ইশতিরাজ এবং আরশিয়ানের কপালের ভাঁজ শিথিল হলো। দু’জনে চমকে তকাল একে-অপরের দিকে। পুরে বিষয়টা হজম হতেই আরশিয়ান পুনরায় কাগজে লিখলো,
–” মারাত্মক প্ল্যান সাজিয়েছে কিন্তু এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী? সবদিকেই ফেঁসে যাওয়ার চান্স শতাধিক। ”
তাজরিয়ান পুনরায় বাঁকা হেসে লিখলো,
–” আমরা প্রথমত যোগাযোগ করবো সেই বিজনেসম্যানের সাথে। তাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে কোম্পানির সিইও কে হাতের নাগালে নিবো। কার জন্য কাজ করছে তথ্যটা বের করতে পারলে সেটা প্রুফসহ পুলিশের হাতে দিবো। এতে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি এন্ড সাইবারনেটিক্স এভিনিউ দুটোই সেফ থাকবে। ”
ইশতিরাজ কাগজটা টেনে পুনরায় লিখলো,
–” আমাদের সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস তাদের পর্যবেক্ষণে তাহলে যোগাযোগ করবে কীভাবে? সেই বিজনেসম্যান কনভিন্স হবে সেটার নিশ্চয়তা আছে? কোম্পানির সিইও আগেই টের পেয়ে গেলে সব খেলা ভেস্তে যাবে। তখন কী করবে? ”
তাজরিয়ান দু’পাশে ঘাড় নাড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে পুনরায় কাগজে লিখলো,
–” নাটক হলো সব সমস্যার সমাধান। আমি আজকে রাতের ফ্লাইটে লন্ডনে যাচ্ছি। যাওয়ার পর আমাদের ডিভাইসের এক্সেস সম্পূর্ণ আমার হাতে নিয়ে নিবো এবং তারা সেটাই জানবে যেটা আমরা চাইবো। এরপর বিজনেসম্যান ব্যটাকে হাতে না নিয়ে আসা অব্দিই আমি সবকিছু সম্পর্কে অজ্ঞাত এমন একটা নাটক চলমান রাখবো। তারপর গতানুগতিক ধারায় সব চলবে। ”
ইশতিরাজ খুশি আঁটকে রাখতে না পেরে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
–” ইয়্যু আর জিনিয়াস তাজ। ”
তাজরিয়ান কেবল হাসলো। সবকিছু ঠিক থাকলেও আরশিয়ানকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাজরিয়ান ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে ডাকল,
–” ভাইয়া? ”
আরশিয়ান স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় কাগজে লিখলো,
–” সাবধানে থাকিস। আমার মনটা কু ডাকছে। মনে হচ্ছে খুব বড় একটা ঝড় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। দেশের সেরা বিজনেসম্যানের ট্যাগ লাগবে না আমার। আমার কাছে সব থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তুই। তিন বেলা দু’মুঠো ডাল ভাত খেতে বেঁচে থাকতে হলেও আপত্তি নেই কিন্তু কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি তোকে হারাতে নারাজ। বুঝেছিস আমার কথা? ”
তাজরিয়ানের স্বচ্ছ চোখজোড়া খুশিতে চকচক করে উঠলো। সবকিছু ছাপিয়ে তার জন্য চিন্তা করাটা তাজরিয়ানের মনে দাগ কেটে যায়। স্মিত হেসে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
–” আল বি অলরাইট ভাইয়া। তোমরা কথা বলো, আমার প্যাকিং এখনো বাকী প্লাস সবাইকে জানাতে হবে । ”
আরশিয়ান সম্মতি দিলো। তাজরিয়ান বের হতেই ইশতিরাজ কৌতুকের স্বরে বলল,
–” নিজের বাচ্চা পালার বয়সে আধবুড়ো পোলাপান কে বাচ্চার মতো ট্রিট করছিস। বলি, তোদের সমস্যা কী? অন্যের বাচ্চার প্রতি এত যত্নশীল ক্যান? নিজেরা বিয়েশাদি করে দু’চারটা পোলাপান নিচ্ছিস না কেনো? ”
আরশিয়ান ম্লান হেসে গম্ভীর গলায় শুধাল,
–” তাজরিয়ান বাহ্যিক দিক দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক বলিষ্ঠ পুরুষ হলেও ভেতর থেকে একদমই বাচ্চা স্বভাবের।খুব কাছের মানুষ ছাড়া ওর খামখেয়ালি ভাব-ভঙ্গি কারো কাছে প্রকাশ পায় না। ছোটোবেলা থেকে ডানপিটে হলেও আমার কাছে সর্বদা শান্তস্বভাবের ছিলো। আস্তেধীরে কীভাবে যেনো এটাচমেন্ট তৈরী হয়ে গেলো। বয়সে মাত্র বছর পাঁচেক এর ছোটো হলেও তাজ আমার কাছে সন্তানের মতো। আমার নিজের সন্তান থাকলেও প্রায়োরিটি লিস্টে সবার আগে ওর নামটাই থাকতো। বাই দ্যা ওয়ে মিস ফারজানা কে স্টক করছিস? ”
ইশতিরাজ জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে চোরা কন্ঠে বলল,
–” শ্লা। তোর কাছে কোনো সিক্রেট লুকায়িত থাকে না কেনো? কোনো আকাম-কুকাম করলে সবার আগে তোর কাছেই ধরা খাই। এখন মনে হচ্ছে তোর জন্য ভন্ডামি বাদ দিয়ে বসে থাকতে হবে। ”
আরশিয়ান হেসে ফেলল। ফোন থেকে সিমটা খুলে সেটা ভেঙে ডাস্টবিনে ফেলতে ফেলতে বলল,
–” সিনিয়রদের সব বিষয়ে অবগত থাকতে হয়। মিস ফারজানার বিষয়ে সিরিয়াস না হলে এগোতে যাস না। যতটুকু দেখেছি, বুঝেছি এবং শুনেছি বেশ সফটহার্টেড পারসন উনি। টাইম পাসের উদ্দেশ্য থাকলে তোর টাইপের কাউকে খুঁজে নিস। ”
ইশতিরাজ শীতল স্বরে বলল,
–” তাহলে আর এপথে পা বাড়াচ্ছি না। অবগত করার জন্য দোয়া করে দিলাম। একত্রে তিন সন্তানের পিতা হও বন্ধু । চল দাবা খেলি এখন। ”
আরশিয়ান কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো। রামছাগল কে হাজার বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। ইশতিরাজের কথায় সম্মতি দিয়ে বহুদিন পর দু’জনে দাবার বোর্ড নিয়ে বসলো।
_
একরাশ মন খারাপ নিয়ে তাজরিয়ানের ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে মেহরিমা। তাজরিয়ান নিশ্চুপে শুয়ে থেকে মেহরিমার মেঘাচ্ছন্ন মুখটা দেখছে। চোখে ছলছল করছে নীরব অশ্রু। কান্না আঁটকে রাখার ফলে নাকের ডগাটা লাল হয়ে আছে। মেয়েটা খুব আগ্রহ নিয়ে তার জন্য শাড়ি পরেছে কিন্তু তার এই সাজসজ্জা তাজরিয়ান কে খুশি করার বদলে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সিল্কের শাড়িটা বারংবার সরে গিয়ে মেয়েলি সৌন্দর্য উন্মুক্ত হচ্ছে। আলমারির উঁচু স্ট্যান্ড থেকে হাত বাড়িয়ে তাজরিয়ানের শার্ট নামানোর সময় ফর্সা নির্মেদ কোমর অনাবৃত হয়ে তাজরিয়ানকে উস্কানিমূলক ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে পুরো দৃশ্যটা হজম করলেও শেষপর্যন্ত নিজের সংযম ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো তাজরিয়ান।
শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মেহরিমার দিকে। আলমারির ড্রয়ার থেকে তাজরিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ বের করতে ব্যস্ত ছিলো মেহরিমা। আকস্মিক কাঁধে কারোর উষ্ণ নিঃশ্বাসের আভাস পেয়ে থমকে গেলো। তাজরিয়ান আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে নাক ডোবাল তার চুলে। শক্তপোক্ত পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতজোড়া নেমে আসলো তার হাতে। মেহরিমার কোমর অব্দিই বিস্তৃত স্ট্রেইট চুলগুলো তাজরিয়ানের বড্ড পছন্দের। লম্বা একটা শ্বাস টেনে তাজরিয়ান ফিসফিসিয়ে বলল,
–” আমাকে বেসামাল করতে এত আয়োজন? এখন যদি অধৈর্য হয়ে ছুঁয়ে দিই তখন কী হবে? সামলাতে পারবি এই প্রলয়ঙ্কারী বিধ্বংসী ঝড়ের নির্মম তান্ডব?”
মেহরিমা পেছনে ফিরে তাজরিয়ান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
–” আমি কোনোরূপ দ্বিরুক্তি করবোনা। আপনি থেকে যান প্লিজ। এই দূরত্ব আমার ভালো লাগছেনা। আমি আপনাকে হারাতে চাইনা তাজ। ”
তাজরিয়ানের বুকে আদুরে ছানার ন্যায় লেপ্টে আছে মেহরিমা। ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে সেই কখন থেকে অথচ তাজরিয়ান নির্বিকার। মেহরিমার কথা শোনার পর থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। তার বেলাগাম হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ স্পষ্ট শুনছে মেহরিমা। একপর্যায়ে নীরবতা ভেঙে মেহরিমা বলল,
–” কী হলো? ”
তাজরিয়ান কাঁপা স্বরে বলল,
–” এই স্বীকারোক্তি আমার হৃদয়ে তুমুল ঝড় তুলেছে মেহু। আমি.. আম্
আচমকা বহুল প্রতীক্ষিত কিছু পেয়ে গেলে মানুষ যেমন আত্মহারা হয়ে পড়ে তাজরিয়ানের দশা ঠিক একইরকম। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে মেহরিমার কপালে আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে ধীর কন্ঠে তাজরিয়ান বলে উঠে,
–” আজ বাঁধা দিসনা মেহু। আমার যাওয়াটা জরুরি। আমাদের পুরো পরিবারের সম্মান জড়িত এটার সাথে। মৃত্যু যদি পথের বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় তবে তাজরিয়ানকে আটকানোর সাধ্যি নেই কারোর।”
মেহরিমা হু হু করে কেঁদে উঠল। তাজরিয়ান বুকে মুখ গুঁজে দু’পাশে মাথা নেড়ে আঁটকে আসা কন্ঠে বলল,
–” অলক্ষুণে কথাবার্তা বলছেন কেনো? মায়াদয়াহীন লোক কোথাকার। আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না তাজ। আমি ভীষণ অভিমান নিয়ে দূরে চলে যাবো।”
এতক্ষণ অনুভূতির জোয়ারে ভাসলেও এবার তাজরিয়ানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–” কার সাথে দূরে চলে যাবি? ”
তাজরিয়ানের কথায় নিজের মাথায় জোরেশোরে একখানা বাড়ি দিতে মন চাইলো মেহরিমার। সাইকোপ্যাথের সামনে কেউ আবেগ সূচক কথাবার্তা বলে? তারই দোষ, এখন মাথা নষ্ট লোকটা রেগেমেগে উদ্ভট কোনো কান্ড না করলেই হয়। প্রত্যুত্তর না পেয়ে মেহরিমার নতজানু শরীরটা বুক থেকে সরিয়ে তাকে সামনে দাঁড় করিয়ে শুধাল,
–” তুই কারো উপর ক্রাসড্? কাউকে পছন্দ করিস?”
বুকে ভয় থাকলেও মাথামোটা মেহরিমা কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করে বসলো,
–” থাকলে কী করবেন? ”
তাজরিয়ানর ঠান্ডা মস্তিষ্কে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। মেহরিমার চুলগুলো হাতের মুঠোয় এনে শক্ত করে টান দিয়ে ধরে বলল,
–” তোর সামনে বসিয়ে রেখে ওর পুরো শরীর কয়েক খন্ডে বিভক্ত করবো। খণ্ড গুলোকে টুকরো টুকরো করে এসিড নিক্ষেপ করে গলাবো। অতঃপর ওর বাবা-মায়ের কাছে এসিডে মিশ্রিত তরলীকৃত দেহাবশেষ পাঠাব। শেষ কৃতকার্যের জন্য অতটুকু এনাফ না? ”
ব্যথায় মেহরিমার জান যায় যায় অবস্থা উপরন্তু তাজরিয়ানের কথা শুনে গা গুলিয়ে উঠলো তার।কোনোরূপ বাক্য ব্যয় না করে একটা জোরালো ধাক্কায় মেহরিমাকে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলল তাজরিয়ান। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে জরুরি জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
প্রায় ঘন্টাখানেক শাওয়ার নেওয়া শেষে ঠান্ডা মাথায় ওয়াশরুম থেকে বেরোলো তাজরিয়ান। রাগটা অল্পবিস্তর শান্ত হলেও মস্তিষ্কে খুন চেপে বসেছে। ইমিডিয়েট তার মেডিসিন নেওয়া দরকার। কথাটা মনে পড়তেই আর দেরি করলো না। গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন নিয়ে চুপচাপ সোফায় বসে কিছুক্ষণ চোখবুঁজে পড়ে রইল। আচমকা মৃদু শব্দে ফোনের এলার্ম বেজে উঠতেই চোখ মেলে তাকাল তাজরিয়ান। হুট করে তার চোখ আটকালো বিছানায় সেই একই ভঙ্গিতে পড়ে থাকা মেহরিমার দিকে। মেয়েটা বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে এমন ভাবনা তার মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই ভেতর থেকে বুক চিরে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস।
কয়েক পা এগিয়ে মেহরিমার সন্নিকটে দাঁড়াতেই বুঝলো, মেয়েটা কেঁদেকুটে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাজরিয়ান ওকে ঠিকঠাক মতো শুইয়ে দিয়ে ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিলো। মেহরিমার দিকে সামান্য ঝুঁকে কয়েকটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলল,
–” ভুল করেও এমন ভুল করিস না যেটার জন্য আমৃত্যু তোকে পস্তাতে হয়। আমি প্রেমিক ভালো হলেও অপ্রেমিক হিসেবে জানোয়ার সমতূল্য।আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলিস না বউজান। ”
চৌধুরী বাড়িতে শোকের ছায়া নেমেছে। তাজরিয়ানের মা তারান্নুম চৌধুরী থেমে থেমে বিলাপ করে কাঁদছেন। মাত্র ক’টা দিন হলো তাজরিয়ান দেশে ফিরেছে এরমধ্যে আবার তাকে বিদায় জানাতে বুক ভার হয়ে আসছে সবার। তুরাব মন খারাপ করে তাজরিয়ানের ব্যাগপ্যাক গুলো গাড়িতে তুলছে অন্যদিকে বুকে হাত গুঁজে রক্তাভ চোখে তাকিয়ে আছে আরশিয়ান। তাজরিয়ান সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চৌধুরী মহল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত নিজের ব্যক্তিগত কক্ষের দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তাজরিয়ান।
চলবে?