শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-১৬

0
17

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ১৬

বৃষ্টিস্নাত রজনী। মৃদু আলোয় আলোকিত রিসোর্টটা ভয়াল অন্ধকারে ডুবে আছে। চারিদিকে ওঁৎ পেতে বিপদ নামক নিরব ঘাতক। পরপর ছয়টা গুলির শব্দ ছাড়া শত্রুপক্ষের অন্য কোনো পদক্ষেপ এখনো সুনিশ্চিত করা যায়নি।

ফারজানার দেহাবয়ব মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে প্রিমা তৎক্ষনাৎ আঁতকে উঠে ছুটে যেতে চায় কিন্তু আরশিয়ানের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন আঁটকা পড়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। আসন্ন বিপদ টের পেয়ে প্রিমাকে নিজের বক্ষের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বারান্দা থেকে দ্রুতগতিতে ঘরে আসে আরশিয়ান। প্রিমা তখনো হাত ছুটাতে ছুটাতে কাঁপা কন্ঠে বলছিল,

–” আমার বুবু.. কে বাঁচাতে হবে…

আরশিয়ান হাত ছাড়েনি উল্টো ওকে সাথে নিয়ে আলমারির লকারে লুকিয়ে রাখা ধাতব বস্তুটা খুঁজতে ব্যস্ত ছিলো। এক পর্যায়ে প্রিমা পাগলামি শুরু করলে আরশিয়ান তার মুখটা দু’হাতে ধরে শান্ত কন্ঠে বলে,

–” উনি অলরেডি ইনজ্যুরড্। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করবো তাকে বাঁচানোর কিন্তু উনার জন্য আপনার লাইফ রিস্কে ফেলতে পারবোনা আমি। একটু বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ। ”

ম্যাচিউরড খ্যাত প্রিমা বুঝেনি আরশিয়ানের বলা কথাগুলো।শেষ সম্বল বাঁচানোর অভিপ্রায়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে নিজেকে ছুটাতে। ফারজানা কে হারানোর ভয়ে বেচারি হুঁশ খুইয়ে বসেছিল রীতিমতো।

শেষমেশ আরশিয়ানের শক্ত বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে তার হাতে সজোরে কামড় বসায় প্রিমা । আরশিয়ান রিয়্যাক্ট না করে ওর গলা থেকে ওড়নটা সরিয়ে হাতদুটো ধরে বেঁধে ফেলে অতঃপর শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর স্বরে বলে,

–” আম স্যো স্যরি মিসেস প্রিমা। আপনি হুঁশ খুইয়ে বসেছেন বিধায় আমাকে এটা করতে হলো। ”

প্রিমা তখনও ছটফট করছিল। আরশিয়ান যথাযথ চেষ্টা করে নিজের মেজাজ শান্ত রাখতে কিন্তু প্রিমার আহাজারিতে বাধ্য হয়ে জোরালো কন্ঠে ধমক দিয়ে বলে,

–” মিস ফারজানা কে জীবিত দেখতে চাইলে নড়াচড়ার সাথে মুখটাও একদম বন্ধ রাখেন। ”

আরশিয়ানের ধমকে প্রিমার এলোমেলো দৃষ্টি স্থির হলো। অস্থির ভাবটা মুহূর্তের মধ্যে স্থবিরতায় রুপ নিলো। ব্যস্ত আরশিয়ান খেয়াল করলো না তার থমকানো দৃষ্টি। সে দ্রুত গতিতে কিছু একটা টাইপ করে তাজরিয়ান কে পাঠিয়ে দিলো।

_

তৃষার্ত মানুষ আকস্মিক কাঙ্ক্ষিত জিনিসের সন্ধান পেলে যেমন তৎপর হয়ে উঠে তাজরিয়ানের অবস্থাটাও ঠিক তেমনি। ঘায়েল মেহরিমা তার অতিমাত্রায় বেসামাল সত্তা থেকে রেহাই পায়নি। এতদিন বেচারাকে তৃষ্ণার্ত রাখার যথাযোগ্য শাস্তি পেয়েছে মেয়েটা। পরপর তিনবার আদুরে আক্রমণের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার পর চতুর্থ আক্রমণের বেলায় জ্ঞান হারিয়ে তবেই মুক্তি মিলেছে তার অধৈর্য পুরুষের সান্নিধ্যে হতে।

সবেমাত্র ফ্রেস হয়ে অসুস্থ মেহরিমাকে নিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল তাজরিয়ান। আকস্মিক ভেসে আসা গুলির বিকট শব্দে তার ধ্যান ভাঙে। ঘুম আছন্ন মস্তিষ্ক প্রথমে ধরতে পারেনি ব্যপারটা কিন্তু পরবর্তী গুলির তীক্ষ্ণ শব্দটা তার কানে আসতেই তৎক্ষনাৎ নতজানু মেহরিমার শরীরটা কম্ফোর্টারে পেঁচিয়ে ফ্লোরে আছড়ে পড়ে।

তাজরিয়ানের যন্ত্রণা মিশ্রিত আদুরে স্পর্শে ক্ষতবিক্ষত মেহরিমা সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাতুর শব্দ করে ওঠে। তাজরিয়ান চিন্তিত গলায় শুধায়,

–” এ্যাঁই বউজান? বেশি ব্যথা পেয়েছিস? ”

তাজরিয়ানের অনাবৃত বক্ষে মাথা ঠেকিয়ে চোখবুঁজে মেহরিমা। অতিরিক্ত ব্যথায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে তার। জ্বরের তীব্রতা তার শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে যেনো। আচমকা ফ্লোরে পড়ায় সারা শরীরের অসহ্য যন্ত্রণাটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মেহরিমাকে নিভু নিভু চোখে তাকাতে দেখে তাজরিয়ান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শুধায়,

–” পেইন কিলার নিয়েও ব্যথা কমেনি? ”

মেহরিমা ক্ষীণ স্বরে ভাঙা কন্ঠে উত্তর দেয়,

–” অ..সহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তাজ্..

তাজরিয়ানের বুকটা ধ্বক করে উঠে। নিজের দিকটা দেখতে গিয়ে বেচারির উপর বড্ড জুলুম করে ফেলেছে সে। এরমাঝে আরেকটা গুলির আওয়াজ ভেসে আসতেই তাজরিয়ান হকচকিয়ে উঠে। মেহরিমার অর্ধ অচেতন দেহটাও কিঞ্চিত নড়ে উঠল। তাজরিয়ান মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে সতর্ক কন্ঠে বলল,

–” ভয় নেই। আমি এখানেই আছি। জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি তোকে স্পর্শ করার পূর্বে তাকে আমি নামক বিধ্বংসী জলোচ্ছ্বাসের সাথে লড়াই করতে হবে। আমি যাবো আর আসবো। যাত যাই কিছু হয়ে যাক এখান থেকে একফোঁটা ও নড়বি না কেমন? ”

মেহরিমা দুর্বল হাতে তাজরিয়ান কে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তাজরিয়ান সেটার তোয়াক্কা করলো না। বেডের নিচ থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বেড সাইড ড্রয়ার থেকে তার প্রিয় বস্তুটা বের করলো। খুব সাবধানে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বিছানা হাতড়ে ফোনটা হাতে তুলল। ফোনের পাওয়ার বাটনে ক্লিক করতেই দেখলো আরশিয়ানের পাঠানো একটা মেসেজ স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। মেসেজটা ক্লিক করতে নিলে পরপর আরও তিনবার গুলির শব্দ শোনা গেলো। এপর্যায়ে তাজরিয়ানের মনে ক্ষীণ আতঙ্ক খেলে গেলো। কোনোমতে ঝুঁকে মেসেজটা ওপেন করতেই দেখলো তাতে লিখা,

–” এটা কেমন এট্যাক, অপরপক্ষে কতজন আছে, তাদের উদ্দেশ্য কী আমরা কিছুই জানি না।ইতোমধ্যে মিস ফারজানা গুলিবিদ্ধ। খুব সম্ভবত ওদের নেক্সট টার্গেট আমরা কিন্তু এত সহজে ধরা দেওয়া যাবে না। আমরা ধরা পড়লেও গার্লসদের সেইফলি সরিয়ে ফেলতে হবে এখান থেকে। আমি যদি খুব ভুল না হই তাহলে ওরা বাহিরের ইমার্জেন্সি এক্সিটে ওঁৎ পেতে আছে। মিসেস প্রিমাকে মেইন ডোরের কাছে রেখে আমি এক্সিট ডোরের দিকে হামলা করে ওদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছি। তুই মেয়েদের নিয়ে সেইফলি বারিয়ে পড়। আমি আর ইশতিরাজ বাকিটা দেখছি। মিসেস প্রিমার একটু খেয়াল রাখিস।”

তাজরিয়ান থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে ঘরের এবং বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে, জানালার পাশে আলমারি রেখে সেটাও সেইফলি ব্লক করে তার ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো। ঝড়ের গতিতে কীবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে রিসোর্টের ক্যামেরা এক্সেস মুহূর্তের মাঝে ছিনিয়ে নিলো। বেশ ভালোমতো সব সাইডে পরীক্ষা করে দেখলো একটা কাকপক্ষী ও আশেপাশে নেই। কেবল গেটের কাছটায় তিনটে গার্ডের লাশ পড়ে আছে এবং গার্ডেন এরিয়ায় ফারজানার নিথর দেহটা বুকে আগলে নিয়ে থমকে বসে আছে ইশতিরাজ।

দৃশ্যটা তাজরিয়ানকে বড্ড অবাক করলো কিন্তু এখন ভাবনাচিন্তার সময় নেই। সময় নষ্ট না করে সে চটজলদি কল দিলো আরশিয়ান কে। অপর পাশ থেকে অতিদ্রুত তা রিসিভ হলো। তাজরিয়ান শর্টকাটে সবটা খুলে বলতেই আরশিয়ান বলল,

–” জলদিই মেহুকে নিয়ে নিচে আয়। আমাদের বেরোতে হবে। ”

তাজরিয়ান একহাতে মেহরিমার নিস্তেজ দেহটা আগলে নিতেই বেচারি ভাঙাচোরা কন্ঠে বলল,

–” আ..মি কোত্থাও যেতে পারবোনা। আপনি যা.ন।”

বাহিরে কেউ না থাকলেও ঘরের মধ্যে আগন্তুকদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল তাই তাজরিয়ান ভেবেছিল একহাতে মেহরিমাকে সামলাবে আর অন্য হাতে পিস্তল রাখবে কিন্তু আচানক মেহরিমার ভঙ্গুর কন্ঠে তার হৃদয় বিচলিত হয়ে উঠে। এরপরও সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাজরিয়ান বলে,

–” বুকে সাহস রাখ। একটুখানি কষ্ট করলে আমরা দু’জন সেইফলি বের হতে পারবো বউজান। ওদিকে ভাইয়ারা অপেক্ষা করছে। সময় কম হাতে…”

ফারজানা বহু কষ্টে একটা ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,

–” আমার পা দুটো অবস হয়ে গেছে তাজ ভাই। বিন্দুমাত্র শক্তি পাচ্ছি না উঠে দাঁড়ানোর। আমার জন্য অপেক্ষা কইরেন না।আপনি চলে যান প্লিজ। ”

মেহরিমার মাদার তেরেসা মার্কা কথায় তাজরিয়ানের মস্তিষ্ক এক ঝটকায় গরম হয়ে গেলো। প্রথমত পিস্তলটা কোমরে গুঁজে এরপর মেহরিমাকে ভালোমতো কম্ফোর্টারে পেঁচিয়ে এক ঝটকায় পাজাকোলে তুলে নেয়। দীপ্ত কদম ফেলে বাহিরে বেরোতে বেরোতে বলে,

–” বালের বাসরই বিড়ম্বনা বাঁধাইলো। ”

_

তাজরিয়ানের থেকে সমস্ত তথ্য পেয়ে প্রিমাকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিচে নেমে এসেছে। গার্ডেন এরিয়ায় আসতেই আরশিয়ান হকচকিয়ে যায় ইশতিরাজের কান্ডে। লন্ডনের অন অফ দ্যা বেস্ট সার্জন পেশেন্টের চিকিৎসা বাদ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছে ব্যপারটা হজম করতে কষ্ট হলো তার। অবিশ্বাস্য চাহুনি নিক্ষেপ করে ইশতিরাজের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেই সে ঘুরে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

–” দোস্ত দ্যাখ না। আমার জানা কথা বলছে না। এমনি সময় তোতাপাখিটা মোটেও চুপ থাকে না অথচ আজ আমি কাকুতি মিনতি করছি দেখে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে চোখবুঁজে শুয়ে আছে। ”

ইশতিরাজের কথায় আরেক দফা অবাক হলো আরশিয়ান। নিজেকে সামলে কোনোমতে বলল,

–” আবেগ সাইডে রেখে একটু বিবেক খাটিয়ে চিন্তা কর। মিস ফারজানা গুলিবিদ্ধ। আপাতত উনার ট্রিটমেন্ট দরকার। বেঘোরে থেকে নিজের দায়িত্ব ভুলে যাস না রাজ। শী নিডস আ ডক্টর…

ইশতিরাজ নিজেকে সামলে ফারজানার ক্ষতস্থানের দিকে তাকাতেই পুনরায় আঁতকে উঠল। অসহায় কন্ঠে আর্তনাদের সুরে বলল,

–” আই কান্ট….. ক্ জ আ ই লাভ হার। ”

আরশিয়ান বুঝলো ইশতিরাজ হুঁশে নেই। সে হাঁটু গেড়ে বসে ইশতিরাজের মাথায় হাত রেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

–” হুঁশে আয় ব্যাটা। লাশের সাথে সংসার করার ইচ্ছে আছে নাকি? উনাকে আজীবন নিজের বক্ষপিঞ্জরে রাখতে হলে আগে ট্রিটমেন্ট দিয়ে সারিয়ে তুলতে হবে। দেরি করিস না বেশি। এমনিতেই অনেকটা রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। ”

এবার যেনো ভ্রম থেকে বেরিয়ে আসলো ইশতিরাজ। হকচকিয়ে উঠে ফারজানার পালস্, হার্টবিট এবং নিঃশ্বাস চেক করতে লাগলো। ইশতিরাজের কান্ডে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল আরশিয়ান। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিমার দিকে তাকাতেই দেখলো সে এখনো অদূরে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তার অনিমেষ নেত্রজোড়া ফারজানার রক্তাক্ত দেহাবয়বের পানে আবদ্ধ। আরশিয়ান কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে প্রিমার হাতের বাঁধনটা খুলে ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে দিয়ে বলল,

–” উনার কিচ্ছু হবে না ইন শা আল্লাহ। ওদিকে তাকাতে হবেনা। আপনি আসুন আমার সাথে। ”

সৌভাগ্যক্রমে গাড়ির চাবিটা রাতেই আরশিয়ান নিয়ে নিয়েছিল বিধায় ঝামেলা ছাড়া গাড়ি পার্কিং এরিয়া থেকে বের করে এনে হর্ণ দিল কয়েক দফা। ইশতিরাজের উদ্দেশ্য চিল্লিয়ে বলে উঠল,

–” তোর ভবিষ্যত বউ কে নিয়ে আয় ব্যাটা। ”

ইশতিরাজ হম্বিতম্বি করে ফারাজানাকে কোলে দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগলো। এরমধ্যে দেখা গেলো তাজরিয়ান ও মেহরিমাকে নিয়ে এগিয়ে আসছে। দুজনে গাড়ির ভেতর উঠে বসতেই আরশিয়ান গুগল ম্যাপ দেখে গাড়ি ছুটালো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

_

গ্রামীণ জায়গা হওয়ায় চিকিৎসার মান ততটা উন্নত নয়। হসপিটালে নেই অভিজ্ঞ চিকিৎসক, দেওয়া হয়না রোগীদের সঠিক চিকিৎসা, ভিআইপি সেবার মান ও খুব একটা ভালো নয়। অনভিজ্ঞ হাতে নিজের কলিজার দায়ভার দিতে নারাজ ইশতিরাজ। হসপিটালের সমস্ত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের কেরিয়ার কে রিস্কে ফেলে ফারজানার অপারেশনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে সে।

ফারজানার কন্ডিশন গুরুতর। গুলিটা লেগেছে তার হার্টের ঠিক উপরে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং দুর্বল হার্টের রোগী হওয়ায় বেচারির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। গুলিটা বের করে মোটামুটি একটা স্ট্যাবল কন্ডিশনে আসলে ফারজানাকে ঢাকায় নেওয়ার সিধান্ত নেওয়া হয়েছে। মেহরিমা আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে আলাদা কেবিনে শিফট হয়েছে তাজরিয়ান। ওটি রুমের বাহিরে সিটিং জোনে বসে আছে প্রিমা এবং আরশিয়ান।

ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে অনুভূতিহীন ভঙ্গিতে বসে থাকা প্রিমার দিকে তাকিয়ে আরশিয়ান ডেকে উঠল,

–” মিসেস প্রিমা? ”

মেয়েটা ভাবলেশহীন ভাবে চোখ তুলে তাকাল। আরশিয়ানের বুকটা কেঁপে উঠল সেই দৃষ্টিতে। প্রিমার শীতল হাতজোড় নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল,

–” নিশ্চুপ আছেন কেনো? কষ্ট হচ্ছে খুব? কাঁদবেন একটু? ”

প্রিমা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না কেবল স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরশিয়ান চিন্তিত স্বরে ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

–” এই মেয়ে। কী হয়েছে আপনার? রিয়্যাক্ট করছেন না কেনো? ”

আরশিয়ানের আকস্মিক আচরণে প্রিমার সমগ্র শরীর কেঁপে উঠল। জমিয়ে রাখা অশ্রুকণা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। কন্ঠনালি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসলো আর্তনাদ। শ্বাসপ্রশ্বাস।হয়ে উঠল অস্বাভাবিক। এলোমেলো ভাবে শ্বাস টানতে টানতে প্রিমা কোনোমতে বলল,

–” আ.মি কেঁদেছি.. ক্ কথা বলেছি। আমার বুবু আর বাঁচবে না। আমি সবার খু… নী….

অসমাপ্ত কথাটা বলতে বলতেই প্রিমার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসলো। আরশিয়ান চিল্লিয়ে স্ট্রেচার আনতে বললে দু’জন নার্স এগিয়ে এসে প্রিমাকে ইমার্জেন্সিতে নিলো। প্রিমার চোখজোড়া তখনও আধখোলা অবস্থায় রয়েছে। একটুখানি শ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টায় ছটফট করছে বেচারি। আরশিয়ান অস্থির হয়ে উঠল সেই দৃশ্যটা দেখে।

ডক্টর চেকাআপ করে জানালেন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং শকের কারণে এমনটা হয়েছে। তিনি দ্রুত জরুরি মেডিসিন এবং অক্সিজেন দেওয়ার কথা বলে অন্য পেশেন্ট দেখতে চলে গেলেন। নার্সরা এটা সেটা করলেও অক্সিজেন দিচ্ছে না দেখে আরশিয়ান কড়া গলায় বলল,

–” আপনারা অক্সিজেন দিচ্ছেন না কেনো ওকে? ওর ছটফটানি আপনাদের চোখে পড়েছে না? ”

শিক্ষিত, শহুরে উপরন্তু বড়লোকের সাথে বিবাদ এড়াতে নার্স আমতা আমতা করে বলে উঠল,

–” অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। ”

আরশিয়ান তাদের লুকোচুরি দেখে হুংকার ছেড়ে বলল,

–” নেই মানে? মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা না করলে আপনাদের মহান হসপিটালের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিবো আমি। আপনাদের প্রত্যেকের জীবনবৃত্তান্ত বের করে লাইসেন্স ক্যানসেল করার ব্যবস্থা করবো। নিজের সৌভাগ্যের দোয়ার কে সিল গালা হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে চাইলে ইমিডিয়েট অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করেন। ”

নার্সেরা পড়িমরি করে ছুটলো নিজের চাকরি বাঁচাতে। আরশিয়ান ব্যথাতুর দৃষ্টিতে অবলোকন করছিল অক্সিজেনের অভাবে কালচে হয়ে যাওয়া মুখটা। তার দৃষ্টি আরও অস্থির হয় যখন প্রিমার পালস ড্রপ করতে শুরু করে। মনিটরের স্ক্রিন পর্যবেক্ষণ করতেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।

উপায়ন্তর না পেয়ে দিগ্বিদিক হারিয়ে এক অভাবনীয় সিধান্ত নিয়ে ফেলো আরশিয়ান। প্রিমার বেডের দিকে এগিয়ে তার দিকে সামান্য ঝুঁকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রথমবার সেই নরম কোমল অধর জোড়ায় নিজের পুরুষালি ওষ্ঠের নরম স্পর্শ এঁকে দেয়। অচেতন প্রায় প্রিমার নিঃসাড় দেহটা কিঞ্চিত কেঁপে উঠে। বহুল কাঙ্ক্ষিত বিষয়াবলির সূচনা ঘটে বড্ড অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে।

চলবে?