শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-১৭

0
17

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ১৭

নিকষ কালো আঁধারি রাত পেরিয়ে ধরণীতে দিবালোকের আগমন ঘটেছে। অপরাহ্নের শেষ প্রহরে সূর্য তার দাপট দেখিয়ে সকলকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই কমে যাবে সূর্যের তেজ। ধরণীর বুকে নেমে আসবে গোধুলি বেলা।

শেষ রাতের দিকে গুলিবিদ্ধ ফারজানাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তৎক্ষণাৎ ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং হার্টের জটিলতা থাকায় তার অবস্থা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। ঢাকায় শিফট করার পর উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার ফলস্বরূপ ফারজানার অবস্থা এখন আশঙ্কা মুক্ত।

ঢাকার স্বনামধন্য হসপিটালের ভিআইপি লাউঞ্জে অবস্থান করছে আরশিয়ান, ইশতিরাজ এবং তাজরিয়ান। তিনজনে একত্রিত হয়েছে গতকালের ঘটনা সম্পর্কে খুঁটিনাটিসহ বিস্তারিত আলোচনার করার জন্য। সবাই কে নিরব থাকতে দেখে গরম কফির কাপে ছোট্ট চুমুক বসিয়ে ইশতিরাজ টিটকারির সুরে আরশিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,

–” এ্যাঁই ব্যাটা কন্ট্রোললেস। আমার কানে খবর এসেছে, তুই নাকি হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে ভরা মজলিসে এক অবলা নারীর নিষ্পাপ অধরোষ্ঠ কলঙ্কিত করেছিস। তোর মতো নিরেট ভদ্রলোক এমন কাজকর্ম করতে পারে.. ব্যপারটা মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার। ”

আরশিয়ান খানিকটা অপ্রস্তুত হলো কিন্তু পরক্ষণেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” ফালতু কথা বলার ফলস্বরূপ তোকে বংশের প্রদীপের মাস্টারমাইন্ড বিহীন কলঙ্কিত জীবনযাপন করতে হতে পারে। ট্রাস্ট মি রাজ, সেটা মানতে ও তোর বড্ড কষ্ট হবে।”

দীর্ঘক্ষণ দুঃখের সাগরে ভেসে থাকায় সবকিছু পানসে লাগছিল ইশতিরাজের। থমথমে পরিবেশটা হালকা করতে একটুখানি কৌতুক পূর্ণ কথা বলতে গিয়ে এত ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হতে হবে সেটা বুঝেনি। মুখটা আঁধার করে সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,

–” ব্যাটার নজর ভালা নাহ্। আমার জানা জান্সের সম্পত্তিকে সকল কুনজর থেকে বাঁচার তৌফিক দান করো খোদা। ”

আরশিয়ান সবটা শুনেও না শোনার ভান করলো। এদিকে তাজরিয়ান তিক্ত মেজাজে একের পর এক ফুটেজ চেক করে যাচ্ছে। কিছু একটা মনে পড়তেই কৌতূহল বশত আরশিয়ান তাকে জিজ্ঞেস করল,

–” মেহরিমা হুট করে এত অসুস্থ হলো কীভাবে? আকস্মিক এত সংঘাতিক জ্বর আসার তো কথা না। তুই মেরেছিস নাকি ওকে? ”

বড় ভাইয়ের কথা শুনে মেজাজ সামলাতে দাঁতে দাঁত চেপে তাজরিয়ান বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,

–” এই বজ্জাত বউয়ের জন্য আমার শখের বাসর বিপদে রুপান্তর হয়েছে। এতদিন বউকে পাওয়ার অপেক্ষায় বরবাদ হয়েছি এবার পেয়ে গিয়ে বদনাম কুড়াতে হচ্ছে। শালার দু’দিনের জিন্দেগীতে খোদার ত্রিশটা দিনই অসম্মানিত হতে হয়। ”

আরশিয়ান পুনরায় ভ্রু কুঁচকে একই প্রশ্ন শুধালে ইশতিরাজ মাঝপথে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠে,

–” তোর নাম আরশিয়ান না রেখে আহাম্মক রাখা উচিত ছিলো। বিবাহিত হওয়ার পরও বউয়ের সাংঘাতিক জ্বরের কারণ হতে পারিসনি ব্যাটা । শেইম অন ইয়্যু মিস্টার আরশিয়ান ইসফার চৌধুরী। ”

হুট করে বিষয়টা মস্তিষ্কে খেলে যেতেই ভীষণ বিব্রত হলো আরশিয়ান। নির্লজ্জ তাজরিয়ান মৃদু বিষম খেলো। ওদের দুভাই কে জব্দ করতে পেরে মনে মনে বাঁকা হাসলো ইশতিরাজ কিন্তু তার হাসি কে দুঃখে রুপান্তর করতে আরশিয়ান বলে উঠল,

–” অবিবাহিত থেকেও তোর শতশত অভিজ্ঞতা অর্জনের কথাটা মিস ফারজানার কানে দিতে হবে দেখছি। ”

ইশতিরাজ হকচকিয়ে উঠল। ঠোঁট দ্বারা জিভ ভিজিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

–” ওরে হতচ্ছাড়া প্রেমটা শুরু হওয়ার আগেই বানচাল করার চেষ্টা করছিস কেনো? লাড্ডুর আম্মা এম্নেই পাত্তা দেয় না উপরন্তু যদি আমার দুষ্টু মনোভাব বুঝে যায় তাহলে কী আর মুরগী খাঁচায় ধরা দিবে? ”

আরশিয়ান শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না৷ তার মস্তিষ্ক ডুবে আছে ভিন্ন চিন্তায়। কীয়ৎকাল পেরোতেই আচমকা তাজরিয়ান বলে উঠল,

–” পাজল সলভ্ড। ”

ইশতিরাজ এবং আরশিয়ান হকচকিয়ে তাকিয়ে একসাথে বলে উঠল,

–” মাস্টারমাইন্ড কে?”

তাজরিয়ান বাঁকা হেসে বলল,

–” তোমার এক্স চাচা শ্বশুর উর্ফে মিস্টার আশরাফ ওয়াসীত্ব।

আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে শুধাল,

–” প্রি প্ল্যানড এট্যাক ছিলো? ”

তাজরিয়ান ঠোঁট কামড়ে হেসে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,

–” নাহ্। জেলাস আরভিদ মাতাল হয়ে এসেছিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে হাতে থাকা পিস্তলের ইচ্ছাকৃত প্রয়োগ করেছে। প্রথমত গুলিটা চালিয়েছে মিস ফারজানার উপর অতঃপর রিসোর্টের দু’টো লাইট নষ্ট করেছে। পরিশেষে আমাদের গার্ড তাড়া করতে নিলে কেয়ারটেকার সহ তাদেরও মেরে ফেলেছে। ”

ইশতিরাজের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসলো। কন্ঠে রাগ চেপে ক্ষুব্ধ স্বরে শুধাল,

–” মিস ফারজানা একজন আউটসাইডার। উনার সাথে শত্রুতার কোনো কারণ আমি দেখছিনা তাহলে উনাকে গুলি করলো কেনো? ”

তাজরিয়ান চিন্তিত স্বরে বলল,

–” আমারও প্রশ্ন সেম জায়গায়। অবিশ্বাস্য ব্যপারটা হলো আরভিদ মিস ফারজানা কে জেনেশুনে টার্গেট করেছে। ট্রিগার প্রেস করার সময় উচ্চস্বরে বলছিল, ” আমার কাজে বাঁধা দিয়েছিস এবার মর শালি। ”

আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে শুধাল,

–” আমি যতটুকু জানি আরভিদ খুব একটা শার্প শুটার নয় উপরন্তু সে যদি মাতাল হয়ে থাকে তাহলে তার টার্গেট মিস হওয়ার চান্স নাইন্টি পার্সেন্ট বেড়ে যায়। ওর এক্যুইরেটলি শুট করাটা আমাকে চমকে দিচ্ছে। মিস ফারজানার সাথে আরভিদের কিছু একটা সম্পর্ক অবশ্যই আছে। খুব সম্ভবত মিসেস প্রিমার সাথেও …। ”

আরশিয়ানের বলা কথাটা বাকি দুজনের মস্তিষ্কে আঘাত করলো। তাজরিয়ান শান্ত গলায় বলে উঠল,

–” মাতাল বলতে ড্রাগ অ্যাডিকটেড বুঝিয়েছি। আরভিদ মস্তিষ্কের সচলতা বাড়াতে রেগুলার ড্রাগস নেয়। ওসব ড্রাগস মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা খুব দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। ভাইয়ার এক্সিডেন্টের পর ওর খোঁজ রাখতে গিয়ে এসব জানতে পেরেছি। ”

আরশিয়ান কিছু একটা চিন্তা করে বলল,

–” ব্যপারটা যেনো আপাতত কোনোভাবেই মিডিয়ায় লিক না হয়। পরিস্থিতি সামলানোর জন্যে লোকজনদের কাজে লাগিয়ে দে। আমি কোনো ধরনের হতাশামূলক নিউজ চাচ্ছি না। ”

তাজরিয়ান এবং ইশতিরাজ একে-অপরের দিকে একবার তাকিয়ে বাঁকা হেসে সমস্বরে বলল,

–” হয়ে যাবে। ”

আরশিয়ান চৌকস দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা ভেবো বিড়বিড়িয়ে বলল,

–” এবার ঘুঘুর ফাঁদে পা দেওয়ার সময় এসেছে। ”

আরও কিছু আলাপআলোচনার মাঝে আকস্মিক দরজায় নক পড়ার শব্দ হতেই তারা থেমে যায়। ইশতিরাজের পিএ দরজাটা খুলে সামান্য মুখ বাড়িয়ে বলে,

–” মিসেস প্রিমা ম্যামের জ্ঞান ফিরেছে। উনি পাগলাটে আচরণ করছেন। আপনারা যদি একটু আসতেন…

বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আরশিয়ান। লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রিমার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো। তার সাথে এগিয়ে গেলো বাকিরাও। কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই আরশিয়ান দেখলো একজন নার্স শক্ত হাতে প্রিমাকে ধরে রেখেছে। প্রিমা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলছে,

–” আমি বুবুর কাছে যাবো… ছাড়ুন আমার হাত..

নার্সটা বিচলিত সুরে ভদ্রভাবে বলছে,

–” ম্যাম..আপনি নিজেই অসুস্থ। একটু ধৈর্য রাখুন। ডক্টর আসুক। আপনার চেক-আপ শেষে আমরা আপনাকে দেখা করার অনুমতি দিবো। এভাবে জোরাজোরি করে নিজের ক্ষতি করবেন না প্লিজ…

প্রিমা নাছোড়বান্দা। টানাটানির এক পর্যায়ে ক্যানোলা সরে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। হাত নিঃসৃত রক্তিম তরলে ভেসে যাচ্ছে সাদা কম্ফোর্টারটা। আরশিয়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোনোরূপ দ্বিধা ছাড়া প্রিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। প্রিমা একটু থামে অতঃপর মুখ তুলে আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

–” বুবুর সাথে দেখা করতে চাই। ”

আরশিয়ান নিরব দৃষ্টিতে ওর পানে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

–” উনি পাশের কেবিনেই আছেন। একটু পর আমি নিয়ে যাবো। নিজের কী অবস্থা করেছেন? ”

প্রিমা উত্তর দেয় না। মুখ লুকায় আরশিয়ানের বক্ষে। তার খোলা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে লেপ্টে আছে মুখে। আরশিয়ান ভীষণ যত্ন নিয়ে ওগুলো সরিয়ে দেয়। এরমধ্যে ইশতিরাজ এবং তাজরিয়ান প্রবেশ করে কেবিনে। প্রিমার রক্তাক্ত হাতটা দেখে ইশতিরাজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে।

কৌতূহলী চোখে আরশিয়ান এবং প্রিমাকে অবলোকন করতে থাকা নার্সকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে পাশ্ববর্তী ট্রে থেকে হেক্সিসলের বোতল এবং তুলা নিয়ে প্রিমার পানে এগিয়ে যায়। হাতটা ধরার আগে আরশিয়ানের দিকে তাকাতেই সেও নিরবে সম্মতি প্রদান করল। ইশতিরাজ প্রিমার ক্ষতবিক্ষত হাতটা ধরতেই প্রিমা সেদিকে ফিরে তাকাতে চাইল কিন্তু আরশিয়ান তার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

–” ওদিকে তাকাতে হবে না। ”

প্রিমা তাকায় না। ব্যথা পাওয়ার ভয়ে খামচে ধরে আরশিয়ানের শার্টের কিছু অংশ। আরশিয়ান হাত বুলিয়ে দিতে থাকে তার মাথায়। ইশতিরাজ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো প্রথমে প্রিমার হাতের ক্যানোলা লাগানো অংশটুকু হেক্সিসলে ভিজিয়ে নেয় অতঃপর উপরের প্লাস্টার টুকু সরিয়ে ফেলে। প্রিমা ব্যথা পেয়ে কিঞ্চিত নড়ে উঠতেই আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে সর্তক কন্ঠে বলে,

–” ব্যথা পাচ্ছেন উনি।”

ইশতিরাজ চকিতে তাকায় আরশিয়ানের দিকে। তার অবস্থা দেখে মিটমিটিয়ে হেসে ক্যানোলাটা আলতো করে টান দিয়ে খুলে নিয়ে রক্তক্ষরণ আটকানোর জন্য ইনসার্শন সাইটে তুলা চেপে ধরে।জেলাস আরশিয়ান কাজ শেষ হতেই ইশতিরাজ এর হাত থেকে প্রিমার হাতটা নিজের দখলে নিয়ে নেয়।

পুরো দৃশ্যটা দেখে হাসলো ইশতিরাজ। তার মন বলছে আরশিয়ানের গায়ে দ্বিতীয় প্রেমের হাওয়া লাগলো বলে। আরশিয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে থাকা প্রিমা কে একবার দেখে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকলো,

–” মিসেস লাড্ডু? ”

আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালেও প্রিমা তার বুক থেকে মুখ তুলে উঁকি দিয়ে ভীষণ আগ্রহ ভরা চোখে ইশতিরাজের দিকে তাকাল। প্রিমার বাচ্চাদের মতো চাহুনি দেখে স্মিত হেসে ইশতিরাজ বলল,

–” আপনার বুবুর চিকিৎসার দায়ভার আমি নিয়েছি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না কেমন? আপনার বুবু অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে আপনার সাথে পুনরায় টাইম স্পেন্ড করবে কিন্তু তার জন্য আপনাকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে।”

প্রিমা মুখ ফুটে কোনো শব্দ করলো না কিন্তু ওর টুকুর টুকুর চাহুনি জানিয়ে দিলো সে পরবর্তী কথা শুনতে আগ্রহী। ইশতিরাজ হালকা হেসে পুনরায় বলল,

–” আপনার বুবুর ছোটোখাটো একটা অপারেশন হয়েছে। উনাকে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচাতে সিভিলিয়ানদের থেকে দূরে রাখতে হবে। আপাতত ডাক্তারদের রক্ষণাবেক্ষণা থাকবেন তিনি। অতটুকু সময় আপনাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আল্লাহর কাছে উনার জন্য সুস্থতা প্রার্থনা করতে হবে এবং নিজেকেও টেনশন মুক্ত রাখতে হবে। পারবেন না? ”

ইশতিরাজের কথায় মনটা ভার হয়ে আসলো প্রিমার। কান্না চেপে কোনোমতে বলল,

–” একটুও দেখা করতে পারবো না? ”

ইশতিরাজ ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে আন্তরিকতার সুরে বলল,

–” অবশ্যই পারবেন। রোজ তিনবেলা ফোনে আপনার সাথে উনার কথা বলিয়ে দিবো আমি। চলবে? ”

ম্লান হেসে মাথা নাড়ায় প্রিমা। আরশিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় ইশতিরাজের দিকে। বিনিময়ে ইশতিরাজ হালকা হেসে তাজরিয়ানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আরশিয়ান আগেই বলেছিল কিছু একটা বলে ফারজানার সাথে প্রিমার দেখা হওয়াটা আটকাতে। বেচারি অলরেডি শকে আছে। আরশিয়ান একদমই চায় না এই বিষয়টা প্রিমাকে আরও হার্ট করুক কিংবা ওর মনে ছাপ ফেলে যাক।

ওরা বেরোতেই প্রিমার হাতের হালকা রক্তভেজা তুলাটা ডাস্টবিনে ফেলে সেখানটায় একটা অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয় আরশিয়ান। প্রিমার ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখদুটো দেখে তারও ক্লান্তি বোধ বেড়ে যায়। দু’হাতে ভর প্রয়োগ করে বেডের ধারণক্ষমতা পরীক্ষা করে নিজেও উঠে বসে বেডে। কোনোরূপ ইতস্ততা ছাড়া প্রিমাকে বুকে নিয়ে পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।

_

প্রিমার কেবিন থেকে বেরিয়ে ইশতিরাজ গেলো রাউন্ডে। এদিকে বউয়ের শূন্যতা অনুভব করাই কাজে বিন্দুমাত্র মনোযোগ বসাতে পারলোনা তাজরিয়ান। বিরক্ত হয়ে ল্যাপটপটা রেখে এগিয়ে গেলো বউয়ের কেবিনের দিকে। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো তার বউটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাজরিয়ানের পছন্দ হলোনা বিষয়টা। কেবিনের দরজা লক করে বেডের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ঘুমকাতুরে স্বরে ডেকে উঠল,

–” বউজান? ও…. বউজান? ”

শরীরটা দুর্বল হওয়ায় একটু চোখ বুঁজে শুয়ে ছিলো মেহরিমা। আপাতত জ্বর নেই তার। শরীরের ব্যথাও কমে এসেছে অনেকটা। দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু শুয়েছিল। চোখটা লেগে আসতেই তাজরিয়ানের ডাকটা কানে আসলো। চোখ মেলে তাকিয়ে ধীর স্বরে জবাবা দিলো,

–” হুঁ? ”

তাজরিয়ান ঘুমহীন লাল টকটকে চোখদুটো বউয়ের পানে নিবদ্ধ করে হতাশ কন্ঠে বলল,

–” তোর জামাই ভীষণ ক্লান্ত। একটু পতিসেবা কর তো। ”

মেহরিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,

–” আমি বেড থেকে নেমে যাচ্ছি। আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। আসলেই ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। ”

তাজরিয়ান ভ্রু কুঁচকে বেডে উঠে মেহরিমার উপর আধশোয়া হয়ে রাগী স্বরে শুধাল,

–” তুই কী আমাকে ওজনের খোঁটা দিলি খরগোশের ছাও? ”

বিকৃত নামে ডাকায় মেহরিমার রাগ হলো। সে নিজেও চড়া গলায় বলল,

–” দিলাম তো। আপনার লজ্জা করেনা হাতির মতো ওজন নিয়ে খরগোশের ছাও এর উপর জোর দেখাতে ? ”

তাজরিয়ান ধপ করে মেহরিমার উপর গা এলিয়ে দিয়ে হামি তুলে অস্পষ্ট সুরে বলল,

–” খরগোশের ছাও যদি হয় বউ,
তাহলে কী আর লজ্জা শরম করে কেউ? ”

তাজরিয়ানের আকস্মিক কান্ডে মেহরিমা বেশ ব্যথা পেলো। নিজের উপর থেকে ওর ভারিক্কি শরীরটা সরাতে সরাতে বলল,

–” এমনিতেই আধমরা হয়ে আছি এবার কী পুরোপুরি মেরে ফেলতে চান নাকি? উঠুন এখান থেকে বজ্জাত লোক। ঘুমের ঘোরে আপনার হাডুডু খেলা এই দুর্বল বেড সইতে পারবে না।”

তাজরিয়ান মেহরিমার গলায় মুখ ডুবিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

–” শোকে মরার চেয়ে সুখে মরা অনেক ভালো। বিরক্ত করিস না বউ আমি ভীষণ ক্লান্ত। ঘুমে ব্যঘাত ঘটালে তোর স্বস্তি কেড়ে নিবো। প্রক্রিয়াটা অবশ্য পছন্দ হবে না তোর কিন্তু আমি তো ছাড় দেবো না। ”

তাজরিয়ানের কথায় বেশ রাগ লাগলো মেহরিমার। স্মরণে আসলো গতকাল রাতের কথা। নিষ্ঠুর লোকটার নির্মম অত্যাচার গুলো মনে পড়তেই রেগেমেগে তাজরিয়ানের কাঁধে জোরালো কামড় বসিয়ে মেহরিমা বলল,

–” উঠুন বলছি। এক্ষুনি উঠেন নয়তো আপনাকে আস্ত রাখবো না আমি। ”

কন্ট্রোললেস তাজরিয়ান এতক্ষণ বউয়ের সান্নিধ্যে নিজেকে শান্ত রাখলেও এবার তার মেজাজ বিগড়ে গেলো। অধৈর্য হয়ে মেহরিমার হাতদুটো এক হাতের মুঠোয় পুরে অন্য হাতে তার চিবুক ধরে হিসহিসিয়ে বলল,

–” শান্তি দিচ্ছি.. ভালো লাগছেনা তোর? শাস্তি চাস? সহ্য করার ক্ষমতা আছে? জ্ঞান হারালে থাবড় দিয়ে হুঁশে আনবো এবার এরপরও একচুল ছাড় দিবো না। ”

মেহরিমা ফাঁকা ঢোক গিলে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে বলল,

–” স্যরি তাজ ভাই। ভুল হয়ে গেছে। আর পাকনামি করবো না। ”

রাগটা শান্ত হতে গিয়েও আবার দপ করে জ্বলে উঠল। বেসামাল হয়ে মেহরিমার অধরোষ্ঠে হামলা চালালে বেচারি বাঁচার তাগিদে ছটফটিয়ে উঠে। এতে দুর্বল বেডটা ক্যাচ ক্যাচ জাতীয় শব্দ তুলে নিজের অপারগতা প্রকাশ করে। তাজরিয়ান থেমে গিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বলে,

–” শালার বেডটাও দেখি আমার বাসরের বিপক্ষে। আমার বাসর নিয়েই সবার এত বিপত্তি ক্যান ভাই? ”

মেহরিমা শ্বাস টেনে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। তাজরিয়ানের পুনরায় বউয়ের সান্নিধ্যে আসতেই কেবিনের দরজায় কড়া পড়ার শব্দ শোনা গেলো। এতে তাজরিয়ানের মেজাজ বিগড়ালো। দরজা খুলে কাউকে না দেখে রেগেমেগে বউকে কোলে তুলে বেডে একটা লাত্থি বসিয়ে বলল,

–” আমার বাসরে বাঁধা সৃষ্টি করা সব কয়টা বদের হাড্ডির চরম বদহজম হোক। আমীন আমীন আমীন। ”

রাগ ঝেড়ে বউকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো তাজরিয়ান। এসব ছোটোখাটো বাঁধার জন্য নিজের এতবড় ক্ষতি হতে দিতে পারে না সে।

_

কেবিনে বসে ফারজানার ফাইলগুলো চেক করছিল ইশতিরাজ। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে তার শরীরটা। নির্ঘুম চোখজোড়া ঘুমে তলিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু বক্ষপটে জন্মানো অস্থিরতা কোনোভাবেই কমছে না। কাঙ্ক্ষিত চোখজোড়ার রাগান্বিত দৃষ্টি দেখার ইচ্ছে জমেছে মনিকোঠায়। একটুখানি কথা শোনার প্রবল তৃষ্ণা জন্মেছে মনে। ব্যাড বয় খ্যাত ইশতিরাজের এমন বেহাল দশা দেখলে যেকোনো পরিচিত মানুষ ফিট খেতো নির্ঘাত। তার ভাবনার মাঝে একজন নার্স কেবিনে নক করে বলল,

–” স্যার। ফারজানা ম্যামের জ্ঞান ফিরছে। দ্রুত আসুন। ”

সব ক্লান্তি ভুলে ইশতিরাজ ঝড়েরবেগে ছুটে গেলো আইসিইউর দিকে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো ফারজানা ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আশেপাশে। জ্ঞান ফিরতেই খানিকটা অস্থির হয়ে পড়েছিল সে। দায়িত্বরত চিকিৎসক সেটা সামলে নিয়েছেন। এখন তার কন্ডিশন স্ট্যাবল। ঘন্টা দুয়েক পর তাকে ভিআইপি কেবিনে শিফট করা হবে।

ইশতিরাজ বুকে একরাশ উচ্ছ্বাস চেপে এগিয়ে গেলো ফারজানার কাছে। মেয়েটা নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। ইশতিরাজ সামান্য ঝুঁকে বলে উঠল,

–” সজ্ঞানে দুরছাই করলেও শত্রুর গুলি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে সোজা আমার কোলে উঠে বসেছিলেন আপনি। এরপরও আমায় আন্তরিকতার সাথে মিষ্টিমুখে ধন্যবাদ জানাবেন না মিস লাড্ডুর আম্মা?”

সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া ফারজানার কর্ণকুহরে কথাগুলো পৌঁছানো মাত্র এই অসুস্থ অবস্থাতেও ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো তার। লম্বা শ্বাস টেনে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে শুকিয়ে আসা কন্ঠনালি খানিকটা ভিজিয়ে ধীর কন্ঠে শুধাল,

–” একটু আগে কোথায় ছিলেন আপনি? ”

ইশতিরাজ বিভ্রান্ত হয়ে বলে,

–” আমার কেবিনে। হঠাৎ এই প্রশ্ন? ”

ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে ক্লান্ত কন্ঠে বলে,

–” আপনার হাঁটুতে থাকা ব্রেইনটা অসাবধানতা বশত ওখানেই কোথাও পড়ে গেছে বোধহয়। জলদিই গিয়ে খুঁজুন ওটা। ”

ইশতিরাজ হতভম্ব কন্ঠে শুধায়,

–” আপনি কী আমায় ব্রেইনলেস বললেন?”

ফারজানা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” না তো। আমি বলেছি আপনি একজন বুদ্ধিহীন মস্তিষ্ক হারিয়ে ফেলা গর্দভ লোক। ”

ইশতিরাজ আফসোসের সুরে বলে,

–” এত বড় অপমান? 🙂

ফারজানা হাসি আঁটকে কোনোমতে বলল,

–” যাক… শেষপর্যন্ত এটলিস্ট আপনার চামড়ার সেন্সর ঠিকমতো কাজ করছে। অপমান বা সুনাম বার্তা ঠিকঠাক মতো ডিটেক্ট করতে পারছে দেখে ভালো লাগলো। ”

চলবে?