শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-১৯

0
15

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ১৯

সত্যের নিজেস্ব মহত্ত্ব রয়েছে। সত্য কখনোই চাপা থাকে না। মিথ্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে দিকভ্রান্ত হলেও একসময় ঠিকই নিজের পথ খুঁজে নেয়। আরভিদের বলা শেষোক্ত কথাটা কর্ণে পৌঁছানো মাত্র সকলেই বিস্ফোরিত চোখে চাইল। আরশিয়ান তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এসে আরভিদের চিবুক শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

–” ইয়্যু ব্লাডি অ্যাসহোল… কার নামে কী বলছিস? জানের মায়া নেই তোর ? একেবারে কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। সত্যি কথা বল…

আরভিদ নিভু নিভু চোখে চেয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

–” প্ প্রমাণ আছে…। ”

আরশিয়ান হিংস্র থাবা বসায় আরভিদের গলায়। এতে করে তার বলিষ্ঠ হাতের নীলাভ শিরা গুলো স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। কন্ঠে হিংস্রতা ঢেলে দাঁতে দাঁত চেপে আরশিয়ান বলে উঠে,

–” কী প্রমাণ আছে? কোথায় প্রমাণ? কার কাছে আছে? ”

প্রত্যুত্তর দেওয়ার পূর্বে আরশিয়ানের বলিষ্ঠ হাতের চাপে আহত আরভিদ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তার বন্ধ চোখের পাতা লক্ষ্য করে আরশিয়ান রেগেমেগে সজোরে চেয়ারে লাথি বসায়। মুহূর্তের মধ্যে সেটা অদূরে ছিটকে পড়ে। রাগে হুঁশ হারিয়ে আরশিয়ান খেপাটে স্বরে বলে উঠে,

–” ইমিডিয়েট ওর জ্ঞান ফিরা। আমার স্টেটমেন্ট লাগবে। ”

তাজরিয়ান হতবিহ্বল হয়ে তাকাল আরশিয়ানের দিকে। ইশতিরাজ নিজেও বিস্মিত। আরশিয়ানের এমন বিধ্বংসী রাগের সহিত তারা পরিচিত নয়। মাথা ঝাঁকিয়ে ইশতিরাজ গার্ডদের বলল আরভিদকে রুমে নিয়ে যেতে। প্রায় আধঘন্টা চিকিৎসা দেওয়ার পর বাহিরে বেরিয়ে ইশতিরাজ বলে উঠল,

–” মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে ওর জ্ঞান ফিরতে। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ”

চেয়ারের উপর বাদশার ভঙ্গিতে বসে থাকা আরশিয়ান নিরবে শুনলো কেবল। হাতের আঙ্গুলে কালো রঙের ধাতব রিভলবারটা ঘোরাতে ঘোরাতে কিছু একটা ভাবছে সে। এই দৃশ্য দেখে ঘরের সোফা টেনে তাজরিয়ান এবং ইশতিরাজ তার সম্মুখে বসে। কিছুক্ষণ পর তাজরিয়ান বলে উঠে,

–” এটা যদি সত্য হয় তাহলে তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে ভাইয়া? ”

আরশিয়ান শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” আমি আরভিদকে একবিন্দুও বিশ্বাস করিনা। প্রথমত সত্যতা যাচাই-বাছাই করবো অতঃপর যে যার প্রাপ্য শাস্তি পাবে। ”

তাজরিয়ান ফাঁকা ঢোক গিললো। ইশতিরাজ চিন্তিত স্বরে বলল,

–” আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা আবার পুরোপুরি বিষয়টা ফেলে দিতেও পারছিনা। মিস ফারজানা এবং পিচ্চি ভাবির সাথে আরভিদের কিছু একটা কানেকশন তো আছে। ”

আরশিয়ান কোনো প্রত্যুত্তর করলোনা। প্রায় তিন ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরল আরভিদের। চোখ খুলতেই দেখলো তার বেডের পাশের একটা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আরশিয়ান। সর্বদা শান্ত থাকা চোখজোড়ায় খেলা করছে হিংস্রতা।তার নির্মল মুখশ্রী ভীষণ গম্ভীর। আরশিয়ান তার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

–” কোনোরূপ ভনিতা ছাড়া ফাস্ট টু লাস্ট পুরো ইতিহাস খুলে বল। ”

আরশিয়ানের নিরেট স্বর শুনে বেচারা ফাঁকা ঢোক গিলে শুকিয়ে যাওয়া গলাটা ভেজানোর চেষ্টা করল অতঃপর দুর্বল কন্ঠে বলে,

–” ওয়াসীত্বেরা তিন ভাই তন্মধ্যে বড় জনের নাম হলো মাশরাফি ওয়াসীত্ব এবং তার স্ত্রীর নাম ছিলো নাহার ওয়াসীত্ব। তাদের একটি কন্যা সন্তান ছিলো যার নাম নীহারিকা ওয়াসীত্ব। দ্বিতীয় জনের নাম আশরাফ ওয়াসীত্ব এবং উনার স্ত্রীর নাম ইকরা ওয়াসীত্ব। উনাদের সন্তান স্বয়ং আমি। তৃতীয় জনের নাম ছিলো রওশান ওয়াসীত্ব এবং উনার স্ত্রীর নাম আদ্রিতা ইসলাম প্রমি। রাদিয়াহ ওয়াসীত্ব প্রিমা নামে তাদের একটি কন্যা সন্তান ছিলো। ”

এতটুকু বলে থামে আরভিদ। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে পুনরায় বলে,

–” ওয়াসীত্ব লিমিটেড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মাশরাফি এবং আশরাফ ওয়াসীত্ব। রওশান ওয়াসীত্বের স্বতন্ত্র ব্যবসা ছিলো এবং তিনি নিজের স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্যত্র বসবাস করতেন। বলা বাহুল্য রওশান ওয়াসীত্ব শত্রু পক্ষের মেয়েকে বিয়ে করায় তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছিল। এটা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বেশ বিরোধ হয় তবে রওশন ওয়াসীত্ব ছিলেন নির্বিকার। ভীষণ ভালোবাসতেন নিজের স্ত্রীকে তবে কুনজর তাদের সম্পর্কটা শেষ করে দেয়।”

আরশিয়ান কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলে উঠে,

–” জলদিই ক্ল্যাইমেক্স ঝেড়ে কাশ । তোর আজাইরা কাহিনী শুনার টাইম নেই আমার । ”

আরভিদ ফাঁকা ঢোক গিলে পুনরায় বলতে শুরু করল,

–” নাহার ওয়াসীত্ব ছিলেন এতিম। মাশরাফি ওয়াসীত্বের মৃত্যুর পর তার কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় রওশান ওয়াসীত্ব তার দায়িত্ব নেন। এরপর দীর্ঘসময় কেটে যায় এবং উচ্চাভিলাষী নাহার ওয়াসীত্ব নিজের লোভ সামলাতে না পেরে রওশন ওয়াসীত্বকে নিজের জালে ফাঁসিয়ে নেন। চলতে থাকে তাদের পরকীয়া। যেহেতু তারা ভিন্ন বাড়িতে থাকতো তাই এসব বিষয়ে জানাজানি হয়নি কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। ”

তাজরিয়ান এবং ইশতিরাজ ও হতভম্ব চোখে তাকায়। আরশিয়ান বিস্মিত কন্ঠে শুধায়,

–” রওশান ওয়াসীত্বের সাথে নীহার আম্মুর পরকীয়া ছিলো ? ”

আরভিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

–” হ্যাঁ। এই বিষয়টা নিয়ে তিনবছরের মাথায় আদ্রিতা ইসলামের কাছে ধরা খান রওশান ওয়াসীত্ব। শুরু হয় সংসারে অশান্তি। প্রথমবারের মতো আদ্রিতা ইসলামের গায়ে হাত তুলেন রওশান ওয়াসীত্ব। বিষয়টা সম্পর্কে প্রিমা অবগত হতেই সে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। মা কে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও বাবার হাতে মার খায়। রওশন ওয়াসীত্ব তাদের হুমকি ধামকি দিয়ে পরিশেষে বাসা থেকে বের হয়ে যান কিন্তু শর্ট টেমপারড প্রিমা বিষয়টা হজম করতে পারেনি। ”

কথাটুকু শেষ হতেই আরভিদ কাশতে লাগে। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। ইশতিরাজ পাশ থেকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। আরশিয়ান স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর কন্ঠে শুধায়,

–” পরকীয়া করেছে রওশান ওয়াসীত্ব এবং নাহার ওয়াসীত্ব। সেক্ষেত্রে আমার প্রথম স্ত্রী নীহারিকা ওয়াসীত্বের উপর মিসেস প্রিমা আক্রমণ করতে যাবেন কেনো ? ”

আরভিদ পানি খেয়ে অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলতে লাগলো,

–” আদ্রিতা ইসলামকে হসপিটালে এডমিট করার পর রেগেমেগে প্রিমা নাহার ওয়াসীত্বের বাড়ির দিকে যায় কিন্তু সেখানে তিনি ছিলেন না। দারোয়ান দরজা খুলে বিষয়টা প্রিমাকে জানালে সে দ্বিগুণ তেজী কন্ঠে নীহারিকার খোঁজ চায়। নীহারিকা সেসময় ছাদে দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়া খাচ্ছিল। প্রিমা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে নীহারিকাকে জেরা করতে থাকে। নীহা জানায় সে এসব বিষয়ে কিছু জানে না কিন্তু প্রিমা মানতে চায় না। সে অনবরত নাহার ওয়াসীত্ব কে নিয়ে বাজে কথা বলতে থাকে। নীহা ওসব সহ্য করতে না পেরে পাল্টা জবাব দিতে গেলে তাদের মাঝে হাতাহাতি শুরু হয় এবং একটা পর্যায়ে প্রিমার হাতে জোরালো ধাক্কা খেয়ে নীহা ছাদ থেকে পড়ে যায় । শেষমেশ গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত নীহা তীব্র রক্তক্ষরণের জন্য মারা যায়। ”

সকলে স্তব্ধ হয়ে শোনে পুরো ঘটনা। আরশিয়ান পুনরায় শীতল কন্ঠে শুধায়,

–” এতকিছুর পরেও প্রিমা শাস্তি পেলনা কেনো? আমাদেরই বা কেনো বলা হয়েছে যে নীহা মাথা ঘুরিয়ে ছাদ থেকে পড়ে গেছে? ”

আরভিদ সপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

–” রওশান ওয়াসীত্ব প্রিমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। নিজের সন্তানকে বাঁচাতে এসব ঘটনা রটিয়েছিলেন। আদ্রিতা ইসলামের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নাহার ওয়াসীত্বকে বিয়ে করে নিজের সমস্ত সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে এই কেসটা ধামাচাপা দেন তিনি। ”

বাহ্যিক দিক দিয়ে নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেও ভেতর থেকে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে পড়ে আরশিয়ান। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলে উঠে,

–” কিসের প্রমাণের কথা বলছিলি তুই? ”

আরভিদ তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,

–” ছাদে একটা ক্যামেরা লাগানো ছিলো। ক্যামেরাটা সচল হওয়ায় পুরো ঘটনার ধারণকৃত ভিডিওটা আমার কাছে আছে। রওশন ওয়াসীত্বের কথামতো সেটা প্রকাশ না করলেও নিজের কাছে সেইফলি রেখে দিয়েছিলাম। ”

আরশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,

–” নীহার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন দিয়ে তুই আমাকে জানিয়েছিলি যে ওটা মার্ডার কেস? ”

আরভিদ ভীত কন্ঠে বলল,

–” হ্যাঁ। ”

আরশিয়ান চোখবন্ধ করে মেজাজ সামলে পুনরায় তাকে প্রশ্ন করল,

–” সেই ভিডিওটা কোথায়? ”

আরভিদ আঁটকে আসা কন্ঠে বলল,

–” আমার এক ফ্রেন্ডের কাছে আছে। ** বারে ছাড়া ওর দেখাসাক্ষাৎ পাওয়া কঠিন। ”

আরশিয়ান পকেট থেকে আরভিদের ফোনটা বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

–” তোর সো কল্ড ফ্রেন্ড কে ফোন দিয়ে প্রমাণ আনতে বল। কোনোরূপ চালাকি করার চেষ্টা করলে সোজা টপকে দিবো। ”

আরভিদ তাই করলো। কথা বলে ফিক্সড হলো রাত এগারোটায় প্রমাণ হস্তান্তর করা হবে ** বারে। তথ্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইশতিরাজ কে উদ্দেশ্য করে আরশিয়ান বলে উঠল,

–” কোনো ধরনের আঘাত করার প্রয়োজন নেই। হাত পা বেঁধে অন্ধকার রুমে ফেলে রাখ। কোনো কারণে বাহিরে বের করার দরকার নেই। ওর খাওয়াদাওয়া টোটালি অফ। একফোঁটা পানিও যেনো না দেওয়া হয়। ”

নির্দেশনা দিয়ে তাজরিয়ানকে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো আরশিয়ান। গার্ডদের সবকিছু বুঝিয়ে ইশতিরাজ ও বেরিয়ে পড়লো। সবাই বেরোতেই আরভিদ বাঁকা হেসে বলল,

–” মাস্টারমাইন্ড আরভিদকে আঁটকে রাখার সাধ্য তোদের নেই। সব বিষয়ে তোমরা জিততে পারলেও শয়তানী বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ খেতাবটা কেবল আমারই। আমার জীবনের সুখ কেড়েছ তোমরা আমি তোমাদের জীবনটায় কেড়ে নিবো। ”

_

ম্লান সন্ধ্যার অন্তিম প্রহর। ইশতিরাজের গাড়িটা এসে থেমেছে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির মূল ফটকের সামনে। গাড়ির ভেতরে বসে ফারজানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ইশতিরাজ। শরীরে ক্লান্তির সাথে সাথে বুকটাতে বড্ড তৃষ্ণা জমেছে। শখের নারীর একটুখানি দর্শনই কেবল পারবে এই উত্তপ্ত বুকটায় এক পশলা বৃষ্টির শীতল বর্ষণ নামাতে।

ইশতিরাজের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে পরিশেষে ফারজানা বের হলো। মেয়েটার মুখশ্রীতে লেপ্টে থাকা ক্লান্তির রেশ ইশতিরাজের বুকে ঝড় তুললো রীতিমতো। ফারজানা তার গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ইশতিরাজ সজোরে হর্ণ বাজালো। বেচারি ফারজানা চমকে উঠে বুকে হাত রেখে বড় বড় চোখে তাকাল। ইশতিরাজ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মুখটা সামান্য বাহিরে নিয়ে জোরালো কন্ঠে বলল,

–” আজকে কীসের জানি স্ট্রাইক আছে। এখান থেকে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি আপনাকে লিফট দিতে পারি। ”

ফারজানা চোখ ছোটো-ছোটো করে চেয়ে বলল,
–” নো থ্যাংকস। ”

কথাটা বলেই সামনে এগোতে নিলে ইশতিরাজ তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,

–” এই ত্যাড়া মহিলা? আমার একটা কথাও আপনি শোনেন না কেনো?”

ফারজানা ক্লান্ত স্বরে বলল,

–” এই ইউজলেস লোক? শুনবো না জেনেও বারবার অপমানিত হতে আসেন কেনো? ”

ইশতিরাজ তার ক্ষীণ স্বর অবলোকন করে চিন্তিত কন্ঠে শুধাল,

–” কী হয়েছে আপনার? অসুস্থ দেখাচ্ছে কেনো? ”

ফারজানা ফাঁকা ঢোক গিললো। শরীরটা আসলেই ভালো ঠেকছে না। ঘুমের মেডিসিন চলছে তন্মধ্যে এত কাজের চাপ শরীর কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে ধীর কন্ঠে বলল,

–” তেমন কিছু না। অহেতুক কথা বাড়াচ্ছেন আপনি। সরুন সামনে থেকে। ”

ইশতিরাজ সরলো না বরং দাঁড়িয়ে থেকে অপলকভাবে চেয়ে থাকলো ফারজানার বিরক্তিমাখা চেহারাটার দিকে।ফারজানার অপ্রস্তুত দৃষ্টি দেখে তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে ইশতিরাজ গম্ভীর স্বরে বলল,

–” চুপচাপ গাড়িতে না উঠলে আমি কতটুকু নির্লজ্জ হতে পারি সেটার ইন্সট্যান্ট প্রুফ দিবো। আপনি কী তা দেখতে চান? ”

ফারজানা কটমটে দৃষ্টিতে তাকাল। ইশতিরাজ পুনরায় অপলকভাবে দেখতে থাকলো তার প্রিয়তমাকে। তাকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারজানা তাকে পাশ কাটিয়ে গাড়িতে উঠার সময় ইশতিরাজের পায়ে হালকা পাড়া দেয়। বেচারা ইশতিরাজ লাফিয়ে উঠে পা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

–” এই যে মিস দৃষ্টিহীনা মহিলা..গিনিপিগ হিসেবে অলওয়েজ আমাকেই চোখে দেখেন নাকি? ”

ফারজানা হাসি আঁটকে কোনোমতে বলে,

–” এই যে মিস্টার চরিত্রহীনা পুরুষ.. অপলকভাবে তাকানোর জন্য অলওয়েজ আমাকেই পান নাকি? ”

ইশতিরাজ ধরা পড়ে থতমত খেয়ে বলল,

–” যে-ই না চেহারা নাম রাখসে পেয়ারা। আ…

ফারজানা মাঝপথে ইশতিরাজ কে থামিয়ে রাগী স্বরে বলল,

–” গাইতে পারে না একটা সং তার আবার একশোটা ঢং। নাটক কম করেন পিও। ”

ইশতিরাজ অপমানটা হজম করে কোনোমতে বলে,

–” আই সোয়্যার মিস লাড্ডুর আম্মা একদিন এসব অপমানের বদলা আমি..

ফারজানা আবারও তাকে থামিয়ে হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,

–” ট্রাস্ট মি মিস্টার লম্বু চৌধুরী আপনি ফেব্রুয়ারি মাসের একত্রিশ তারিখ ছাড়া জীবনেও এই অবাস্তব প্ল্যান ফুলফিল করতে পারবেন না। ”

ইশতিরাজ ভ্রুকুটি করে তাকাল। ফেব্রুয়ারি মাস তো ২৮ কিংবা ২৯ দিনে হয়। একত্রিশ তারিখ তো নাই এ-র মানে ফারজানা কী বুঝাতে চাইল? সে কোনোদিনই এই মহিলাকে উচিত জবাব দিতে পারবে না? ইশতিরাজ গাড়িতে উঠে বসে মুখ ফুলিয়ে বলল,

–” মুরগী যতই সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াক না কেনো দিনশেষে তাকে নিজ খোপে ফিরে আসতেই হয়। কথাটা মাথায় রাখিয়েন। ”

ফারজানা দুষ্টমির ছলে বলল,

–” যেসব মুরগীর ব্যক্তিগত শিয়াল থাকে ওরা কখনোই আর খোপে ফেরে না। ”

ফারজানার হেয়ালি সুরে বলা কথাটা শুনে ইশতিরাজ গাড়ি ব্রেক করলো। আকস্মিক হার্ড ব্রেক করায় ফারজানার ভয় পেয়ে গেলো। অস্ফুস্বরে বলে উঠল,

–” পাগল নাকি আপনি? হাইওয়েতে কেউ গাড়ি ব্রেক করে? ”

ইশতিরাজ শক্ত হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

–” কী বললেন একটু আগে? মুরগীর ব্যক্তিগত শিয়াল না কী যেনো? কেউ আছে আপনার জীবনে?”

ফারজানা বিরক্ত হয়ে সরু চোখে চেয়ে বলল,

–” সেই কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে নাকি? এসব জিজ্ঞেস করার মতো সম্পর্ক আমাদের মাঝে নেই। ডোন্ট ক্রস ইয়্যোর লিমিট। ”

ইশতিরাজ সজোরে স্টিয়ারিঙে একটা ঘুষি বসিয়ে বলল,

–” জোরপূর্বক কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমায় বাধ্য কইরেন না মিস জানা। আপনার সব অবাধ্যতা গ্রহণ করি বলে অগ্রাহ্য আচরণও মানবো এই ধারণা মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলুন। ইশতিরাজ ইজ নট অ্যা গুড বয় বাট হি ইজ অ্যা মনস্টার। কিপ দ্যাট ইন ইয়্যোর মাইন্ড ওকে ডিয়ার?”

ফারজানা নিজেকে সামলে ইশতিরাজের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,

–” কীসব বলছেন আপনি? এত জটিল কথা বুঝিনা। সহজ ভাষায় স্পষ্ট ভাবে কথা বলুন। ”

ফারজানার চোখে চোখ পড়তেই ইশতিরাজের মস্তিষ্কে জ্বলতে থাকা আগুন নিমিষেই নিভে গেলো। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ফারজানার চোখে চোখ রেখে মোহনীয় কন্ঠে বলে উঠল,

–“আমার স্পষ্ট বাক্য শোনার সক্ষমতা আদৌ আপনার আছে ? আই সোয়্যের আমার অস্পষ্ট স্বরে বর্ণিত অস্ফুট অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের কারণেই এতগুলো দিন, এতটা সময় নির্বিঘ্নে আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন।”

খানিকটা থেমে ইশতিরাজ ঘোর লাগা কন্ঠে আবারও বলে উঠল,

–” ট্রাস্ট মি! একবার যদি আমার অনুভূতির সবটুকু নিংড়ে আপনার সম্মুখে প্রকাশ করি তবে লজ্জা শোকে আমৃত্যু দৃষ্টি লুকিয়ে চলতে হবে আপনাকে। ”

ফারজানা হতভম্ব চোখে তাকাল ইশতিরাজের দিকে। বেচারি ভাবতেও পারেনি ইশতিরাজ মনে মনে এসব ধারণা পোষণ করছে। হসপিটালে কাটানো মুহূর্ত গুলো আচমকা তার চোখে ভেসে উঠল। ফারজানা হসপিটালে থাকাকালীন পুরো সময়টা ইশতিরাজ ছুটিতে ছিলো। কেবল তার কেবিনের আশেপাশেই তাকে দেখা যেতো। নার্সের বদলে প্রত্যেকটা কাজ ইশতিরাজ নিজ দায়িত্বে করতো।

তারা খুনসুটিতে মেতে থাকতো পুরোটা সময়। স্বভাবতই ইশতিরাজ খানিকটা জোকার টাইপের মানুষ। ফারজানা ভাবতো তার সাথে দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া করতে এবং আরশিয়ানের কথা রাখতেই বোধহয় এত ঘনঘন যাতায়াত করে তার কেবিনে কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পুরো ঘটনাই উল্টো।

ফারজানাকে থমকে বসে থাকতে দেখে স্মিত হাসলো ইশতিরাজ। কথাটা বলতে পেরে ভীষণ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বিরাট একটা পাথর সরে গেছে। ফারজানা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমতী মেয়ে। ইঙ্গিতের স্পষ্ট ছাপ ধরতে তার সময় লাগবে না। মনের সুখে সে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল,

–” বাড়াবাড়ি মন জ্বালাতন করছে যখনই,
আমি কোনো আর চেষ্টার সীমানা রাখিনি!

আর কী বোঝাবো বল?
বলছে ফুলের দল, তুই আমারই।
আর কী কারণ চাস?
বলছে বন্ধু বাতাস, তুই আমারই!

ইশতিরাজের সম্মোহিত গানের কন্ঠে ফারজানা শিউরে উঠল। লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে কোনোমতে বলল,

–” আপনার ইঙ্গিত আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি। এক্ষেত্রে আমার প্রত্যুত্তর হবে না বোধক। আশাকরি আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না। ”

ইশতিরাজ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ভাবলেশহীন কন্ঠে শুধাল,

–” উত্তর না বোধক হওয়ার কারণ? আসলেই ব্যক্তিগত কেউ আছে নাকি ? ”

ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” থাকলে কী করবেন? ”

ইশতিরাজ হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,

–” আল্লাহ সেই কাঙ্ক্ষিত বান্দাকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে নিজের কাছে ডেকে নিবেন আর আমি কেবল আজরাইলের ভূমিকা পালন করবো। ”

ফারজানা হকচকিয়ে তাকায়। হাসতে হাসতে এরূপ ঠান্ডা মাথার হুমকি শুনে তার কথা আঁটকে আসে। ইশতিরাজ ভ্রু নাচিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

–” ব্যক্তিগত কেউ আছে নাকি?”

ফারজানা মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বলে,

–” দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত ভীষণ জঘন্য এক অতীত বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আমার পক্ষে কাউকে একসেপ্ট করা সম্ভব নয়।”

ইশতিরাজ সহজ কন্ঠে বলল,

–” অতীতের সাথে দু’চারটা বাচ্চাকাচ্চা বহন করলে আরও ভালো হতো মিস জানা। বিনা পরিশ্রমে কয়েকটা ট্রফি পেয়ে যেতাম তাহলে। যাইহোক আপনাকে কোনোকিছু একসেপ্ট করতে হবে না জাস্ট কবুল বলতে হবে। পারবেন না? ”

ফারজানা কোনো প্রত্যুত্তর করল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহিরে তাকাল। বুকের ভেতর অসহনীয় ঝড় চলছে। মস্তিষ্কে ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। নিশ্চিন্তে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে ফেললো ফারজানা। তার দিকে এক পলক তাকিয়ে ইশতিরাজ মুচকি হাসলো কেবল।

_

আরভিদের বলা সেই বিখ্যাত *** বারে অবস্থান করছে আরশিয়ান এবং তাজরিয়ান। ড্রিংকস কাউন্টার থেকে সামান্য দূরে থাকা একটা সিটিং জোনে বসে অপেক্ষা করছে সেই কাঙ্ক্ষিত যুবকের।

পুরো জায়গাটা জুড়ে ঝলমলে আলোর তীব্রতা বিদ্যমান। ডান্স ফ্লোরে মাতাল হয়ে কিছু উচ্চশ্রেণির মানুষ নিজেদের খেয়াল খুশিমতো নাচানাচিতে ব্যস্ত। কেউ আবার নিজেদের মধ্যে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছে। কিছু মানুষ তো নির্লজ্জতার সীমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

তাজরিয়ান ক্ষুব্ধ মেজাজে বসে আছে। আরশিয়ানের মেজাজের হাল ও খুব একটা সুবিধার না। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পরিশেষে একজন যুবক টলতে টলতে তাদের সামনে উপস্থিত হয়। আঙ্গুল উঁচিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে বলে,

–” আরভিদ পাঠিয়েছে আপনাদের? ”

আরশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

–” মেমোরি কার্ড? ”

ছেলেটা আলগোছে হেসে ধপ করে সামনের সোফায় বসে পড়ে। ওয়েটার কে ডেকে ড্রিংকস সার্ভ করতে বলে অতঃপর পকেট থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত মেমোরি বের করে আরশিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ছোঁ মেরে সেটা হাতে নিয়ে আরশিয়ান তাজরিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–” এট ফার্স্ট ভিডিওটা চেক করে বল এটা রিয়েল নাকি এডিটেড। ”

তাজরিয়ান নির্দেশ মোতাবেক নিজের কাজ শুরু করে। সময় যত পেরোয় তত বেশি আরশিয়ান অস্থির হয়ে উঠে। উৎকন্ঠায় গলা শুকিয়ে আসে তার। বাধ্য হয়ে ওয়েটারকে ডেকে বলে,

–” নরমাল জুস হবে? ”

ওয়েটার মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই আরশিয়ান তার অর্ডার কনফার্ম করে। ওয়েটার যেতেই তাজরিয়ান একবার আরশিয়ানের অস্থির মুখশ্রী অবলোকন করে ধীর কন্ঠে বলে,

–” ভিডিওটা রিয়েল ভাইয়া। ”

আরশিয়ান ফাঁকা ঢোক গিলে ল্যাপটপটা সামনে টেনে নেয়। পজ ভিডিওটা অন করতেই তার হাসফাস লাগতে শুরু করে। এরমাঝে ওয়েটার জুসের গ্লাস বাড়িয়ে দিলে নির্বিঘ্নে সেটা পান করে আরশিয়ান। ওয়েটার তাজরিয়ানের দিকে আরেকটা গ্লাস বাড়িয়ে দিলে সে নাকচ করে।

আরভিদের বলা কথা এবং ভিডিও দুটোই হুবহু এক। কোথাও এক চিমটি পার্থক্য নেই। প্রিমা রেগেমেগে নীহাকে ধাক্কা দেওয়ার দৃশ্যটা দেখে রাগে আরশিয়ানের কপালের শিরা ফুলে উঠে। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে সে। ভাইয়ের অবস্থা দেখে তাজরিয়ান সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে।

আধঘন্টা পেরোতেই নিজের ভেতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন টের পায় আরশিয়ান। শরীরের বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখে হতবাক হয়ে যায় সে। গন্ডগোলের আভাস পেয়ে আরশিয়ান অস্থির কন্ঠে বলে,

–” আমি আসছি। ”

তাজরিয়ান প্রশ্ন করার পূর্বে আরশিয়ান ছুটে যায় ওয়াশরুমের দিকে। আরশিয়ানকে ছুটে বেরুতে দেখে সেই ওয়েটার কাউকে ফোন দিয়ে বলল,

–” কাজ হয়ে গেছে স্যার এবার ফাইনাল টোপ দেওয়ার পালা। ”

ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতে থাকে আরশিয়ান। নিজের ভেতরকার অবাঞ্ছনীয় অনুভূতি দমাতে না পেরে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। নিজেকে আরেকটু সুস্থির করতে মাথায় পানি দেয় কিন্তু অস্থিরতা কমার বদলে সময়ের সাথে আরও বাড়তে থাকে।

একপর্যায়ে আরশিয়ান বুঝতে পারে সে একদমই স্বাভাবিক নেই এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে।বিষয়টা টের পাওয়া মাত্রই এলোমেলো পা ফেলে বাহিরের দিকে ছুটে যায় আরশিয়ান। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে হাঁটার সময় আচমকা এক লাস্যময়ী নারী তার পথ আঁটকায়। অর্ধ অচেতন আরশিয়ান তাকে সরাতে পারে না বিধায় সেই নারী আরশিয়ানের কাছাকাছি ঘেঁষতে চায়। নিয়ন্ত্রণহীন আরশিয়ান কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। মেয়েটা তার হাত দিয়ে আরশিয়ানের কপাল স্লাইড করলে তীব্র নেশার ঘোরেও আচমকা আরশিয়ানের ভ্রু কুঁচকে আসে। মেয়েটার হাত ঝাড়া মেরে ফেলে তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,

–” ইয়্যু ডোন্ট স্মেল লাইক মাই প্রেম। ”

আরশিয়ানের ধাক্কায় হাই হিল পরিহিত রমণী ফ্লোরে মুখ থুবড়ে পড়ে। আরশিয়ানের শেষোক্ত কথাটা শুনে রাগান্বিত স্বরে বলে,

–” শ্লা জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক আছে। ”

আরশিয়ানকে হেলেদুলে আসতে দেখে তাজরিয়ান অবাক হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। আরশিয়ানকে শক্ত হাতে ধরে চিন্তিত কন্ঠে শুধায়,

— ” ভাইয়া? আর ইয়্যু ওকে? কি হয়েছে তোমার?”

আরশিয়ান অস্পষ্ট স্বরে বলে,

–” ড্রিংকসে মে বি নেশা জাতীয় কিছু মেশানো ছিলো তাজ। ”

তাজরিয়ান বুঝে নেয় বাকিটা। এখানে ড্রিংকস করা খুবই নরমাল কিন্তু যারা নেশা জাতীয় দ্রব্যে অভ্যস্ত না তাদের জন্য সরাসরি হার্ড ড্রিংকস সামলে ওঠাটা কিছুটা কষ্টকর। সে কথা না বাড়িয়ে আরশিয়ানকে নিয়ে ছুটলো বাড়ির দিকে।

_

অফিসের কাজ শেষে সবে আয়নার সামনে বসেছিল প্রিমা। আচমকা দরজায় নক করার শব্দে সেদিকে না তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,

–” আসুন। ”

ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে আরশিয়ানকে ধরে রাখা তাজরিয়ান ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রিমা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

–” কী হয়েছে উনার। এই অবস্থা কেনো? ”

তাজরিয়ান কেনো যেনো আজ দৃষ্টি মেলাতে পারলোনা প্রিমার সাথে। সল্প স্বরে উত্তর দিলো,

–” ড্রিংকস করার জন্য এমন হয়েছে। ”

আর কোনো বাড়তি কথা না বলে হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করলো তাজরিয়ান। প্রিমা অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবার আরশিয়ানের দিকে তাকাল। সর্বদা ফিটফাট থাকা মানুষটাকে আজ বড্ড এলোমেলো দেখাচ্ছে। চোখমুখের অবস্থা করুন। কেমন যেনো অস্থির আচরণ করছে। প্রিমা তার সান্নিধ্যে গিয়ে বাহু স্পর্শ করে ধীর কন্ঠে বলল,

–” শুনছেন? ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসুন।”

আরশিয়ান ঘোর আছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অস্ফুটস্বরে বলল,

–” তুমি করিয়ে দাও না। ”

প্রিমা চমকাল। কী বাচ্চামি আবদার তার কন্ঠে । নিজেকে সামলে আরশিয়ানের এক হাত টনে ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে প্রিমা বলল,

–” এখানেই বসুন। আমি জামাকাপড় নিয়ে আসছি। আমি কিছু সময়ের জন্য বেলকনিতে দাঁড়াব। আপনি তখন পাল্টে নিয়েন কেমন? ”

আরশিয়ান কথা বললো না কেবল অনিমেষনেত্রে দেখল প্রিমাকে। নাইট স্যুট পরিহিত প্রিমার সুদীর্ঘ কেশরাশি পিঠের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাঁটার তালে সেগুলো নিজের আনন্দে নেচে যাচ্ছে আবার মাঝেমধ্যে প্রিমার চোখমুখ লেপ্টে গিয়ে তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে। প্রিমা তার ড্রেস বের করতে গেলে আরশিয়ান টলমল পায়ে এগিয়ে এসে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।

আচমকা আরশিয়ানের পুরুষালি বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হতেই প্রিমা আঁতকে উঠে। হাতজোড়া অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলস্বরূপ কাপড়গুলো ফ্লোরে অবস্থান করে। আরশিয়ান তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ভীষণ আদুরে কন্ঠে বলে,

–” শার্টটা আনবাটন করতে হেল্প করছো না কেনো ওয়াইফি? ”

প্রিমার শীর্ণকায় দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠে। আরশিয়ানের দিকে ফিরে বিভ্রান্ত কন্ঠে বলে,

–” কীসব বলছেন আপনি। আম্ মি…

আরশিয়ান তার কোমল ওষ্ঠে আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে তাকে চুপ করায় অতঃপর অধৈর্য কন্ঠে বলে,

–” উইল ইয়্যু হেল্প মি অর নট? ”

প্রিমা বুঝলো আরশিয়ান পুরোপুরি হুঁশ হারিয়েছে। এতক্ষণ টলমল করলেও এখন কেমন জানি শক্ত ইমারতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নেশা জড়ানো চোখদুটোতে স্পষ্ট নিষিদ্ধ ঘোর টের পাচ্ছে প্রিমা। দমটা আঁটকে আসে তার। কাঁপা হাতে আরশিয়ানের শার্টটা আনবাটন করতেই আরশিয়ান সেটা ছুঁড়ে মারে অদূরে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে প্রিমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নরম তুলতুলে ফোমের বিছানায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় প্রিমা আছড়ে পড়ে বিছানায়। আরশিয়ান অধৈর্য হাতে কোমরে থাকা বেল্টাটা খুলতে থাকে। প্রিমা তার উদ্দেশ্য টের পেয়ে শুকনো ঢোক গিলে। আরশিয়ান নিজের কাজ শেষ করে প্রিমার পাশে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

–” ভয় কেনো পাচ্ছো আমাকে? ”

আরশিয়ানের অবাধ্য হাতে প্রিমার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের বক্ষের সাথে মিশিয়ে নেয়। বেচারি আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে উঠে। আরশিয়ান তার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে অস্পষ্ট সুরে বলে,

–” তোমার সর্বস্ব জু্ড়ে অধিপত্য বিস্তারের অধিকার আমায় দিবে প্রেম? ”

আরশিয়ান হাতজোড়া অনুমতির অপেক্ষা না করেই নিজের অধিকার বুঝে নিতে ব্যস্ত হয়। কাহিল প্রিমা আরশিয়ানের অনাবৃত বক্ষে মাথা রেখে বলে,

–” আপনি ভুল করছেন। পরে আফসোস করবেন না তো? ”

অধৈর্য আরশিয়ান প্রিমার কাঁধের টিশার্টটা সরিয়ে সেখানটায় মুখ ডুবিয়ে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,

–” উঁহু। ”

প্রিমা মিছে বাঁধা প্রদান করে বলে,

–” ভীষণ বিশ্বাস করে আপনার কাছে নিজের আমানত সঁপে দিচ্ছি। আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবেন না তো? ”

প্রিমার মোহে ডুবে থাকা আরশিয়ান ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

–” নেভার এভার মাই প্রিসিয়াস ওয়াফি। ”

প্রিমা আর বাঁধা দিলো না। আরশিয়ানের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিলো তাকে। ভবিষ্যতের কথা ভুলে নিজেও সায় জানালো আরশিয়ানের পাগলামিতে। রাত পেরিয়ে ভোরের শেষ প্রহরে থামলো আরশিয়ানের লাগামহীন উন্মাদনা।

নেশার ঘোরে থাকা উন্মাদ আরশিয়ানকে সামলাতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে প্রিমাকে। অত্যন্ত যত্নশীল মানুষটার নতুন রুপে বেশ চমকেছে প্রিমা। সারাটা রাত চোখের পাতা একটুও বন্ধ করতে পারেনি উপরন্তু শরীরের অসহনীয় ব্যথাটা তাকে বেকাবু করে দিচ্ছে।

নবাগত সূর্যের নরম আলো ঘরে প্রবেশ করতেই ক্লান্ত শরীরটাই চাদর পেঁচিয়ে ধীরেসুস্থে উঠে বসলো প্রিমা। আরশিয়ানের দিকে একপলক তাকাতেই দেখলো বেচারা উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। সিল্কি চুলগুলো তার কপাল দখল করে রেখেছে। অনাবৃত শরীরে কেবল কোমর অব্দিই একটা চাদর টেনে দেওয়া।

প্রিমা সামান্য ঝুঁকে আরশিয়ানের সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে খিলখিলয়ে হাসলো। কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে আলতোভাবে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

–” এই পাথুরে হৃদয়ের মেয়েটা আপনাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসে জনাব। ”

ঘুমে মগ্ন আরশিয়ান শুনলনা সেই স্বীকারোক্তি। প্রিমা উঠে গেলো নিজের কাজে। অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায় প্রবাদটা প্রিমার জন্য একদম উপযুক্ত। সুখের চাদরে লেপ্টে থাকা প্রিমার সপ্নগুলো খুব দ্রুতই বিচূর্ণিত হতে চলেছিল কিন্তু বেচারি টের পায়নি।অস্থায়ী সুখে অভ্যস্ত হওয়ার পরিণাম এতটা দুর্বিষহ হবে জানলে বোধহয় প্রিমা সুখের দারপ্রান্তে পদধূলি ফেলতো না।

চলবে?