#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৩
সময়কাল রাত দুইটা বেজে এগারো মিনিট। তীব্র গতিতে গেট পেরিয়ে হসপিটালের পার্কিং জোনে এসে থামলো আরশিয়ান এর গাড়িটা। উৎকন্ঠিত আরশিয়ান তখনও ধরতে পারেনি ফোনের অপর পাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার আদ্যপান্ত। শূন্য মস্তিষ্কে কেবল একরাশ চিন্তা নিয়ে ছুটে এসেছে অবিলম্বে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। মধ্যরাতে হসপিটালের ব্যস্ততা যেনো শতগুণ বেড়ে যায়। তখনো কিছু মানুষ নিজের প্রিয়জনের সুস্থতা সুনিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে ছুটছে। লিফটের কাছা- কাছি এসে আরশিয়ান দেখে ডান পাশের লিফট থেকে পরপর দুটো লাশ বের করা হচ্ছে।
অনুমানের ভিত্তিতে যতটুকু বোঝা যায় তার সারমর্ম হলো একজন মহিলা বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন এবং নানান জটিলতার কারণে বাচ্চাকে ও বাঁচানো যায়নি। মৃত মহিলার সাথে উনার স্বামীও ছিলেন। উনার কোলে ফুটফুটে বাচ্চাটা চোখবুঁজে শুয়ে ছিলো। আরশিয়ানর বুকটা ভার হয়ে আসে। হৃৎপিণ্ডের গতি বেসামাল হয়। হকচকিয়ে উঠে কয়েক কদম পেছালে তাজরিয়ান চিন্তিত কন্ঠে শুধায়,
–” ভাইয়া? আর ইয়্যু ওকে? ”
আরশিয়ান অস্ফুটস্বরে বলে,
–” হুঁ।”
আরশিয়ানের অবস্থা বুঝে তাজরিয়ান ধীর স্বরে বলে,
–” ভাইয়া তুমি স্ট্রেস নিয়ো না। আর মাত্র কিছুক্ষণ এরপর আমরা বউমনির কাছে পৌঁছে যাবো। ”
আরশিয়ান উত্তর দেয়না। ওরা চাইলেও সিঁড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি করে উপরে উঠতে পারবেনা কেননা প্রিমার কেবিনটা টপ ফ্লোরে। আবেগের বশে পনেরো তলা পায়ে হেঁটে ওঠাটা বোকামি এবং সেটা আরশিয়ান একদমই করতে চাইনা। ভাবনার মাঝে লিফট আসতেই ওরা চটজলদি উঠে পড়ল।
_
কেবিনের বাহিরে ওয়েটিং এরিয়ায় পাশাপাশি বসে আছে ফারজানা এবং ইশতিরাজ। ফারজানার ক্রন্দনরত মুখশ্রীর দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে ইশতিরাজ। কাঁদলে মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর দেখায়।চোখজোড়া রীতিমতো চকচক করে। ভিজে ওঠা চোখের পাপড়ি গুলো চমৎকার দেখায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা প্রচেষ্টা রীতিমতো ঝড় তুলে ইশতিরাজের বুকে। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে পকেট থেকে রুমাল বের করে সেটা ফারজানার দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশতিরাজ বলে,
–” আপনার চোখের পানিতে হওয়া বন্যা অতি দ্রুত আমার হসপিটালকে তলিয়ে দিবে। একটুখানি দয়া দেখিয়ে যদি কান্নাটা বন্ধ করতেন তাহলে এই অবলা ডাক্তার প্লাস হসপিটালের মালিক ধন্য হতো মিস জানা। ”
ফারজানা কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
–” চুপ করুন নির্লজ্জ লোক। এই পরিস্থিতিতে ও আপনি মজা করছেন? ”
ইশতিরাজ অকপটে বলে,
–” আমি কেবল বাস্তব কথা বলছি। বিগত দুই ঘন্টা যাবত আপনি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন। যতটুকু জানি কেঁদেকুটে রোগী সুস্থ করা যায় না অপরদিকে আপনি অহেতুক কাঁদার বান্দী না..
ফারজানা তাকে মাঝপথে থামিয়ে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
–” কিপ ইয়্যোর মাউথ শাট মিস্টার ব্রেইনলেস ডক্টর।”
ইশতিরাজ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
–” প্রসঙ্গ যখন আপনার তখন আমি মস্তিষ্কহীন এক বেপরোয়া ডক্টর। বি এলার্ট ম্যাডাম। ”
ফারজানা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
–” আপনি এত শেইমলেস কেনো?”
ইশতিরাজ শান্ত কন্ঠে বলল,
–” আপনি বাধ্য করেছেন তাই । ”
ফারজানা কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–” আমার এত খারাপ দিন আসেনি যে আপনাকে বাধ্য করতে যাবো। ”
ইশতিরাজ লম্বা হামি তুলে বলল,
–” আমাকে বাধ্য করেছেন বলেই আপনার খারাপ দিন আসতে চলেছে। ”
ফারজানা আর কিছু বলার পূর্বে একজন নার্স এসে বলল,
–” স্যার.. ইমিডিয়েট পেশেন্টের হাসবেন্ড কে আসতে বলুন। তিনি ভীষণ ডেস্পারেট আচরণ করছেন। উনার অবস্থা বিবেচনা করে আমরা কড়া ডোজের মেডিসিন দিতে পারছিনা। এমন অবস্থা চলমান থাকলে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। ”
ফারজানা থমকে যায়। তার আঁখি জোড়া পুনরায় অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়। নার্স চলে যেতেই কন্ঠে আক্ষেপ নিয়ে ফারজানা বলে উঠে,
–” কী জাদু করেছেন আমার লাড্ডুর ওপর? মেয়েটা এই অসুস্থ অবস্থাতেও উনার নাম জপে যাচ্ছে। আর আপনার দায়িত্বজ্ঞানহীন বন্ধু আজও নিজের দায়িত্ব ভুলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । ”
ইশতিরাজের মেজাজ খারাপ হলো এবার। নিজেকে সামলাতে না পেরে কঠোর গলায় বলল,
–” আপনার লাড্ডুকে জাদুতে বশীভূত হতে বাধ্য করেছিল কেউ? আমার বন্ধু কেমন সেটার বর্ণনা আপনাকে দিতে হবে না। ভুল মানুষ মাত্রই হয় তাই বলে একেবারে গলা চেপে ধরবেন নাকি? না জেনে অপবাদ দিয়ে আপনিও কিন্তু সেই একই ভুল করছেন। ”
ফারজানা প্রত্যুত্তর করলোনা। ওড়নায় মুখ লুকিয়ে কাঁদল কেবল। তার বুকের ভেতরটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে ভয়ে। মেয়েটার গুরুতর অবস্থা দেখে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কঠোর গলায় কথাগুলো বললেও ফারজানার অবস্থা দেখে ভীষণ খারাপ লাগে ইশতিরাজের। তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস এবং মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।
ঘন্টা দুয়েকের কথা বলে জ্বরে কাহিল ইশতিরাজ প্রায় ছয় ঘন্টা ঘুমিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পেরোতেই ক্লান্ত হয়ে ফারজানা ঘুমন্ত ইশতিরাজের মাথাটা বালিশে রেখে পাশ্ববর্তী সোফায় গা এলিয়ে দিতেই নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে। মোটামুটি ঘন্টা চারেক পর একজন নার্স তার কেবিনে নক করে জানায় প্রিমার জ্ঞান ফেরার পর প্যানিক আট্যাক এসেছে এবং সে পাগলের মতো আরশিয়ানকে খুঁজছে। ইশতিরাজ এবং ফারজানা এই কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে।
তারা দু’জনেই ছুটে যায় প্রিমার কেবিনের দিকে। ফারজানা ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে ইশতিরাজ তাকে কিছুটা সময় দিয়ে অতঃপর কেবিনের ভেতর যায়। ডক্টর বলে ইমিডিয়েট আরশিয়ানের সাথে যোগাযোগ করতে এবং একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে সেই মেডিসিনটা নিয়ে আসতে।
ইশতিরাজ পড়িমরি করে ছুটে যায় ঔষধ আনতে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওটা তাদের ফার্মেসিতে ছিলোনা। বাধ্য হয়ে বাহিরের ফার্মেসিতে ছুটে যায় ইশতিরাজ এবং পথিমধ্যে কল করে আরশিয়ানকে। কথায় আছে বিপদ আসলে সবদিক থেকে আসে। তাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। কল করে খবর দেওয়ার পূর্বেই আচমকা কাছে থাকা একটা ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হয়। ইশতিরাজের ফোনটা অদূরে ছিটকে পড়ে এবং সাথে সাথে ডিসপ্লে ফেটে যায়। হাজার চেষ্টা করেও বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোনটা সচল করতে সক্ষম হয়নি বেচারা।
অতীতে ডুবে থাকা ইশতিরাজ কারও পদধ্বনির আওয়াজ পেয়ে পাশ ফিরে তাকায়। ভালো করে তাকাতেই দেখে আরশিয়ান এবং তাজরিয়ান দ্রুত পায়ে হেঁটে এদিকেই আসছে। ইশতিরাজ খেয়াল করে আরশিয়ানের চিন্তিত মুখাবয়ব। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে পুনরায় আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। ওরা কাছাকাছি আসলে ইশতিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে আরশিয়ানের পানে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্দিহান কন্ঠে শুধায়,
–” তুই এত রাতে গোসল দিছোস কোন সুখে? মিসেস লাড্ডু কাছে থাকলে আলাদা ব্যপার স্যপার ছিলো কিন্..
বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই আরশিয়ান বাজখাঁই গলায় ধমকে উঠে তাকে। আরভিদের উপর এট্যাক করার সময় বেশকিছু রক্ত ছিটকে এসে তার শরীরে পড়ে উপরন্তু শরীর থেকে লাশ পোড়া উটকো গন্ধটা কোনোভাবেই সরছিল না বিধায় গোসল দিতে বাধ্য হয়েছে। এই কথা গর্দভ ইশতিরাজকে জনসম্মুখে কীভাবে বোঝাবে আরশিয়ান?
ইশতিরাজ ধমক খেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–” সমস্যা কী ব্যাটা? কী লুকাচ্ছিস সত্যি করে বল? ওই ছুঁইমুই আপা দেশে আইছে নাকি মামা? ”
আরশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–” আমার বউ আছে এজন্যই স্লাটদের খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজন পড়েনা। তোর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমার ফোনের ব্লকলিস্ট থেকে নম্বরটা খুঁজে নিস। আমার বউ কোথায়? কী হয়েছে উনার?”
ইশতিরাজ হতভম্ব মুখে একবার ফারজানার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলে,
–” এরকম হতচ্ছাড়া বন্ধু থাকলে মিস জানার মতো নিউক্লিয়ার বোমাকে বিয়ে করা অসম্ভব। এই শান ব্যাটারেও বলিহারি, এসব অফার কেউ জনসম্মুখে দেয় তাও আবার ভবিষ্যত বউয়ের সামনে? ধ্যাত্.. বন্ধুটাও ভালোনা আবার বউটাও আমায় বোঝেনা কেবল দুঃখ আমাকে দুষ্টু ইশারায় কাছে ডাকে। বেদনা বেপ্পি তো ঘাড়েই চেপে বসে থাকে। সুখ কী আমার মতো ডেড ড্রপ হ্যান্ডসাম হাঙ্ককে চোখে দেখেনা?”
ইশতিরাজের থেকে কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না পেয়ে আরশিয়ান পুনরায় ব্যস্ত কন্ঠে শুধাল,
–” কোনো আট্যাক হয়েছে? ওটা কীসের শব্দ ছিলো? তোর ফোন কোথায়? উনি ঠিক আছেন? ”
ইশতিরাজ আফসোস মাখা কন্ঠে বলল,
–” জ্ঞান ফেরার পর আচমকা মিসেস লাড্ডুর প্যানিক আট্যাক হয়। উনি বারবার তোর খোঁজ করছিল তাই মেডিসিন নিতে গিয়ে তোকে কল করি কিন্তু আনফরচুনেটলি তখুনি একটা ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হয় আর আমার ফোনটা মরে যায়। ”
আরশিয়ান অস্থির কন্ঠে শুধায়,
–” আমি কী উনার সাথে দেখা করতে পারি? ”
ইশতিরাজ তেঁতো মুখে বলে,
–” এটা বাসর ঘরের গেইট না মামা যে তোমারে টাকার জন্য আঁটকায় রাখবো। ভাব নেওয়া বাদ দিয়ে বউয়ের কাছে যাও। ”
আরশিয়ান রক্তিম চোখে একপলক তাকিয়ে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে চলে যায়। আচমকা ইশতিরাজের চোখ পড়ে তাজরিয়ানের দিকে। বেচারাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ইশতিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
–” কী কাহিনী করেছিস সেটা কাল সকালে ইন ডিটেইলসে জানাবি। আপাতত এদিকটা আমরা সামলে নিবো তুই বাসায় গিয়ে রেস্ট কর।মেহুকে সময় দে। ইদানীং বাহিরে বেশিই ব্যস্ত থাকছিস। ”
তাজরিয়ান ম্লান হেসে বলল,
–” বিশাল বড় কাঁটা সরিয়ে ফেলেছি ভাই এবার হয়তো ভাইয়ার লাইফটা একটু ইজি হয়ে যাবে। আসি তাহলে। ”
ইশতিরাজ চোখ ছোটো-ছোটো করে কিছু একটা ভেবে বলে,
–” দেখেশুনে যাস। ”
তাজরিয়ান সম্মতি জ্ঞাপন করে বেরিয়ে পড়ে। ইশতিরাজ এগিয়ে এসে ফারজানার পাশে ধপ করে বসে পড়ে। ফারজানা বিরক্ত হয়ে বলে,
–” আপনি এত লাগামহীন কথাবার্তা বলেন কেনো?এই পরিস্থিতিতেও মানুষ এমন কথা বলতে পারে জানা ছিলোনা। নিজের পরিবারের কেউ হলে এতটা ভাবলেশহীন থাকতে পারতেন। ”
ইশতিরাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ম্লান হেসে বলল,
–” আপনারা বুদ্ধিমান হলে আমাকে জোকার সাজতে হতো না। ”
ফারজানা ভ্রু কুঁচকে বলে,
–” মানে? ”
ইশতিরাজ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–” বিপদ আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। পিচ্চি ভীষণ অসুস্থ কিন্তু আপনার কিংবা আমার চিন্তা কী সেটা নিরাময় করে দিতে পারবে? আপনি যে হারে প্যানিক করছিলেন তাতে কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাকেই ভর্তি করা লাগতো যেটা এই পরিস্থিতি সাপেক্ষে কেবলই একটা এক্সট্রা ঝামেলা। এই পরিস্থিতিটা সন্তর্পনে এড়িয়ে যেতে আপনাদের মাইন্ড ডাইভার্টের চেষ্টা করছিলাম। অন্যায় করে ফেলেছি?”
ফারজানা নিজের ভুলটা বুঝলো। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” স্যরি। ”
ইশতিরাজ প্রত্যুত্তর করলোনা। ফারজানা পুনরায় বলল,
–” স্যরি বলছি তো। এবার রাগটা ঝেড়ে ফেলুন। ”
ইশতিরাজ চট করে তার মুখোমুখি হয়ে বলল,
–” চলুন কাজি অফিসে যায়। স্যরির বদলে এভাবে তিন কবুল বললে সত্যি রাগ ঝেড়ে ফেলবো। রাজি?
ফারজানা হতভম্ব হয়ে তাকায়। ইশতিরাজ হো হো শব্দ করে হেসে বলে,
–” এমনিতেই আধপাগল.. এই বিরহের জ্বরে এবার ফুল পাগল হয়ে গেছি। ডোন্ট মাইন্ড ওকে? ”
ফারজানা রয়েসয়ে ব্যপারটা হজম করে ধীর কন্ঠে বলে,
–” আপনার চিন্তাভাবনা চমৎকার। হিউম্যান সাইকোলজি বেশ ভালো বুঝেন আপনি। ”
ফারজানার চোখের দিকে তাকিয়ে ইশতিরাজ বলল,
–” একটা সুযোগ দেন। আপনার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টাও বেশ ভালোমতো বুঝে নিবো। অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না। ”
ফারজানা থমকে যায়। কথা আঁটকে আসে রীতিমতো। ইশতিরাজ ম্লান হেসে বলে,
–” জোরাজোরি করছি না। এক্সট্রা প্রেশার নেওয়ার কিছু নেই। ঘুমাবেন না? ”
ফারজানা কিছুটা সময় নিয়ে বলে,
–” ঘুম আসছে না। ”
ইশতিরাজ স্মিত হেসে বলে,
–” তাহলে আর কী। পাগলের পাগলামি সহ্য করুন। বাই দ্যা ওয়ে.. ওয়েদার কিন্তু দারুণ। ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চায়ের স্বাদ আস্বাদন করা যাক? ”
ফারজানা নিরবে সায় জানিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইশতিরাজের মনের মনে কোঠায় এক অবাধ্য ইচ্ছা জন্মালো। এই সময়টাকে আঁটক না রাখতে পারার আক্ষেপটা খুব সন্তপর্ণে লুকিয়ে গেলো।
_
প্রিমার কেবিনে ঢুকে মিনিট কয়েকের জন্য আরশিয়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রিমার চেহারাটা ভীষণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখের কার্ণিশে শুকিয়ে যাওয়া জলরাশীর ছাপ স্পষ্ট। তার হাড্ডিসার শরীরটা দেখে আরশিয়ানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।
কিছুক্ষণ পর পর প্রিমা কিছু একটা বিড়বিড়িয়ে বলে যাচ্ছে। মেডিসিনের প্রভাবে অর্ধ অচেতন মেয়েটা মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠছে অজানা কারণে। আরশিয়ান কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে প্রিমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। আচমকা প্রিমা চোখ মেলে তাকায়। আরশিয়ানকে দেখা মাত্রই ফুঁপিয়ে উঠে।
আরশিয়ান অবাক হয় ভীষণ। প্রিমার ঘোলাটে দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে মেয়েটা আপাতত নিজের মধ্যে নেই। মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার অবক্ষয় এবং চরম অসুস্থতার ফলস্বরূপ ভ্রমের মধ্যে আছে। মেয়েটা কাঁপা হাতে তার হাতটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে অনবরত। প্রিমার অস্থিরতা অবলোকন করে আরশিয়ান সতর্ক কন্ঠে বলে,
–” ব্যথা পাবেন কিন্তু। ”
প্রিমার ভাবান্তর নেই। তার ফুঁপানো স্বর এখন শব্দযুক্ত কান্নায় রুপ নিয়েছে। অস্ফুটস্বরে গুঙিয়ে উঠে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা।আরশিয়ান বাধ্য হয়ে প্রিমার হাতের সেলাইনটা আলগা করে খুব সাবধানে ক্যানোলাটা সেইফলি সিকিউর করে দেয় অতঃপর তার রুগ্ন শরীরটা আলতো করে নিজের কোলের মধ্যে নিয়ে শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে। প্রিমাও দুর্বল হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।
এক নিমিষেই আরশিয়ানের বুকে চলমান ঝড়টা ঠান্ডা হয়ে যায়। মস্তিষ্কের যাবতীয় চিন্তা সরে গিয়ে শিথিল হয়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা বিশাল সোফা দেখতে পেয়ে ধীর পায়ে প্রিমাকে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। আস্তেধীরে সোফায় বসে প্রিমাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে আরশিয়ান শান্ত কন্ঠে বলে,
–” এত অস্থিরতার কারণ কী ওয়াইফি? ”
প্রিমা অস্ফুটস্বরে কিছু একটা বলে যা আরশিয়ানের বোধগাম্য হয় না। সে আর প্রশ্ন পর্বে না গিয়ে প্রিমা কে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েটার পালকের ন্যায় শরীরটা থেমে থেমে কেঁপে উঠছে।
আতঙ্কিত হয়ে আরশিয়ানকে শক্ত করে ঝাপটে ধরছে বারবার। আরশিয়ান অবাক হলেও কিছু বললো না। সমস্যাটা গভীর এটা বুঝতে আর বাকি নেই তার। প্রিমার সান্নিধ্যে এসে ক্লান্ত আরশিয়ানের চক্ষুদ্বয় ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। বহুদিন পর এতটা শান্তি অনুভব করছে সে। তবে সমস্যা হলো সোফাটা বড় হলেও এখানে শোয়ার মতো স্পেস নাই অন্য দিকে বেডটাও ভীষণ ছেটো এবং দুর্বল। দুজনের ভার বহন করার সামর্থ্য সেটার নেই।
দীর্ঘক্ষণ কিছু একটা ভেবে প্রিমাকে বুকে রেখেই ইশতিরাজের নম্বরে কল করে আরশিয়ান। বেচারা ইশতিরাজ গরম চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছিল মাত্র। বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করে বলে,
–” কী সমস্যা তোর? ”
আরশিয়ান চোখমুখ কুঁচকে ধীর স্বরে বলে,
–” একটা শক্তপোক্ত কিন্তু নরম ফোমের কম্ফোর্টেবল বেডের ব্যবস্থা করে দে জলদিই। ”
ইশতিরাজ বিষম খেয়ে বলে উঠল,
–” তোর বউ অসুস্থ ব্যাটা। তোর মতো জলহস্তীকে সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই বেচারি। তুই কী ওরে হালকা ওপর ঝাপসা করে আজরাইলের সাথে পরিচয় করাতে চাইছিস নাকি ? ”
আরশিয়ান ধমকে উঠে বলে,
–” নির্লজ্জ ভাবনার গাড়িতে ব্রেক লাগা বেয়াদব। এত কিছু এক্সপ্লেইন করার মুড নেই আপাতত। তুই ব্যবস্থা কর জলদিই নয়তো মিস ফারজানার সাথে তিন কবুল পড়ার সপ্নটা ভুলে যা। লাস্ট বাট নট দ্যা লিস্ট.. বেড সেটআপ করতে আসা একটা বান্দাও যেনো ভুলক্রমে সোফার পাশটায় না তাকায়। আই নিড প্রাইভেসি। ”
সার্কেলের সব থেকে ভদ্র বন্ধুর মুখে এরূপ কথাবার্তা শুনে ইশতিরাজ এবার হকচকিয়ে গেলো। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–” এইটা হসপিটাল.. তোর সুপার ডিলাক্সের হানিমুন স্যুইট নয় ব্যাটা। এখানে বেড কোত্থেকে হাজির করবো আমি? মগের মুল্লুক নাকি? ”
প্রিমার কাঁধে থুতনি রেখে আরশিয়ান ধীর কন্ঠে বলল,
–” এতকিছু জানার কিংবা বোঝার প্রয়োজনবোধ করছিনা রাজ। আমি জানি এইটা আমার বন্ধুর হসপিটাল। যেটার বর্তমান মালিকানায় সে নিজে আছে সুতরাং আমার এই ছোট্ট আবদার পূরণ করা আহামরি কোনো ব্যপার নয়। তাইনা? ”
ইশতিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে মুখে আসা ভয়ংকর গালি গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। খট করে কল কেটে দিয়ে পড়িমরি করে ছুটে বন্ধুর আবদার পূরণ করতে। আরশিয়ান কল কেটে পাশে থাকা একটা চাদর প্রিমার শরীরে জড়িয়ে দেয়। তার ব্যক্তিগত মানুষকে কেউ এলোমেলো অবস্থায় দেখুক সেটা একদমই চাইনা সে। প্রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে ধীর স্বরে সম্মোহনী কন্ঠে ডাকল,
–” প্রেম? ”
প্রিমা অস্ফুটস্বরে বলল,
–” হুঁ…
আরশিয়ান তার পিঠে হাত রেখে বলল,
–” কী হয়েছে আপনার? এত প্যানিক কেনো করছেন জান?
প্রিমা এলোমেলো ভাবে বলল,
–” হুমকি.. আর ভিদ্.. আপনি। ”
আরশিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ল। তার বুকের উপর নেতিয়ে পড়ে থাকা প্রিমার মুখে হাত বুলিয়ে ধীর স্বরে ডেকে বলল,
–” প্রেম? এই প্রেম? তাকান আমার দিকে। একটু বুঝিয়ে বলুন কী হয়েছে? ”
প্রিমা বিরক্ত হয়ে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
–” আরভিদ আপনাকেও মেরে ফেলবে। কেড়ে নিবে আমার থেকে যদি আমি মিথ্যা স্বীকারোক্তি না দেই।”
আরশিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। প্রিমার ঠোঁটে আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,
–” হুঁশ.. কিচ্ছু হবে না।”
প্রিমা দুর্বল হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–” আমি সাদা শাড়ি পরবো না। আমি বিধবা হতে চাই না। ”
আরশিয়ান প্রিমাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
–” অলক্ষুণে কথাবার্তা বলে না প্রেম। তাকিয়ে দেখুন এই যে আপনার সাথে একদম মিশে আছি আমি। ”
প্রিমা তাকাল না। ঘোর আছন্ন প্রিমা কেবল শান্ত হয়ে আরশিয়ানের টিশার্টের কিছু অংশ মুঠোবন্দি করে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। মেডিসিন এবার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে বোধহয়।
কিছুক্ষণ পর ক’জন মানুষ এসে হসপিটালের বেডটা সরিয়ে দিয়ে মোটামুটি বড়সড় একটা বেড এনে রাখল। উপরে একটা ম্যাট্রেস এবং তার উপর একটা টপার দিয়ে খুব সুন্দর মতো বেডটা সেটআপ করে দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল। আরশিয়ান বাঁকা হেসে প্রিমাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রিমাকে শুইয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করার জন্য সরে দাঁড়াতেই প্রিমা আঁতকে উঠে তার টিশার্ট খামচে ধরল। আরশিয়ান অবাক হয়ে দেখল ভঙ্গুর প্রিমাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে আহ্লাদ ঢেলে বলল,
–” এখানকার ডক্টর এবং নার্সদের নজর ভালো না প্রেম। আমি দরজাটা বন্ধ করে আসি কেমন? ”
প্রিমা তবুও ছাড়তে চাইলোনা। আরশিয়ান তাকে আশ্বস্ত করে চটজলদি গেইট বন্ধ করে আসলো।প্রিমার হাতের ক্যানোলার সাথে সেলাইন এটাচড্ করে দিয়ে হাতটা একটা বালিশের উপর রাখল। সবশেষে বেডের অপর পাশে শুয়ে বুক ভরে শ্বাস টেনে প্রিমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। কী মনে হতেই অল্প একটু উঠে প্রিমার চোখেমুখে এলোপাথাড়ি চুম্বন এঁকে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
–” থ্যাংকস ওয়াইফি। ”
সামান্য একটু ঝুঁকে ঘুমন্ত প্রিমার উদরে আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,
–” বাবা ভীষণ পঁচা তাইনা? স্যরি বাবারা। আর ভুল হবে না। আপনার মাম্মামকে বেশি জ্বালাতন করবেন না কেমন? বাবার অগোচরে মাম্মাম এর খেয়াল রাখার দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের। বেশি অপেক্ষা করাবেন না । জলদিই চলে আসুন কেমন? ”
বিগত দুমাস যাবত বিগড়ে থাকা মস্তিষ্কে শান্তি নেমে এসেছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আরশিয়ানের। প্রিমার সান্নিধ্যে এসে সবকিছু রঙিন মনে হচ্ছে। আরশিয়ান জানে প্রিমা ঘোরের মাঝে আছে বলেই এতটা সুযোগ পাচ্ছে সে। হুঁশে ফিরলে রীতিমতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে সবটা ঠিকঠাক করতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই শান্তিটুকু ভীষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। প্রিমার গলায় আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে আরশিয়ান ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
–” স্মৃতির সিন্দুকে তালাবদ্ধ থাকুক এই মাহেন্দ্রক্ষণ।”
চলবে?