শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-২৫

0
17

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৫
#অংশঃ০১

হাতের ফাঁক গলিয়ে সময় কখন বেরিয়ে যায় বোঝা বড় দায়। হসপিটালে আরও তিনদিন থাকার পর প্রিমাকে ছাড় দেওয়া হয়। আরশিয়ান যখন হন্য হয়ে ফ্ল্যাট খুঁজছিল তখন দেবদূতদের মতো চমৎকার একটা প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় ইশতিরাজ।

হসপিটালের পাশেই তার আটতলা বিশিষ্ট বাসা রয়েছে। প্রত্যকেটা ফ্লোরে আছে তিনটা করে ফ্ল্যাট । ইশতিরাজ যেই ফ্লোরটাতে থাকে সেটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। ইশতিরাজের প্রস্তাব টা শুনে আরশিয়ান দ্বিরুক্তি করেনি বরং সানন্দে রাজি হয়। আরশিয়ান প্রিমার সাথে আফিয়া চৌধুরী এবং আরিয়ান চৌধুরীও সেই একই ফ্ল্যাটে শিফট হোন। ফারজানা নিজের শখের চিলেকোঠা ছেড়ে হাজির হয় ইশতিরাজের ফ্ল্যাটে।

সময় পেরোনোর সাথে সাথে সবকিছু নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে। ফারজানার সান্নিধ্যের পাশাপাশি আরিয়ান চৌধুরী এবং আফিয়া চৌধুরীর অতিরিক্ত যত্নের ফলস্বরূপ প্রিমার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। শারীরিক অসুস্থতা অনেকটা কমে এসেছে। তবে এতকিছুর মাঝে আরশিয়ান এবং তার সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রথমদিকে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও প্রিমা পরবর্তীতে একেবারে নিশ্চিুপ হয়ে যায়। আরশিয়ানের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিত তাকে ভাবায় না। একই ঘরে একসাথে থাকলেও দু’জনে নিজেদের আলাদা জগতে বাস করে।

আরশিয়ান শত চেষ্টা করেও প্রিমার মন গলাতে পারেনি। উল্টো দিনকে দিন মেয়েটা আরও নির্লিপ্ত হয়ে উঠছে। জোরজবরদস্তির সংসারের বেদনা বেশ ভালোই টের পাচ্ছে আরশিয়ান। তবে দিনশেষে তার হৃদয়ে একরাশ শান্তি বিরাজ করে। ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে প্রিমার অভিমানী মুখটা দেখতেই মনটা চনমনে হয়ে উঠে। নানান ওজুহাতে প্রিমার পাশাপাশি থাকার মুহূর্ত গুলো বেশ ইনজয় করে সে। টুকিটাকি খুনসুটি করার সময় প্রিমার রাগী দৃষ্টি দেখে আনমনে হাসে।

প্রিমার প্রেগন্যান্সির চৌদ্দ সপ্তাহ চলমান। মানসিক পরিবর্তনের পাশাপাশি তার শারীরিক পরিবর্তন ও ঘটেছে। হালকা স্বাস্থ্য কিছুটা ভারী হয়েছে। মেদহীন উদর বেশ খানিকটা স্ফীত হয়েছে। মেয়েটাকে বেশ আদুরে দেখায়। বহু কষ্টে লোভী আরশিয়ান নিজেকে কড়া শাসনে রাখে। মাঝেমধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রিমা কে একটুখানি জড়িয়ে ধরলে মেয়েটা ভীষণ রাগ দেখায়। আরশিয়ান নিরুপায় হয়ে ফিরে আসে। কী আর করার। পাপ যখন করেছে শাস্তি তো পেতেই হবে।

আরশিয়ান একটু আধটু কাছাকাছি গেলেও ডীপলি কখনোই প্রিমাকে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। কেননা প্রিমার মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভবনা ছিলো প্রবল।এজন্যই ডক্টর অন্তরঙ্গতার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। মিসক্যারেজ হওয়া থেকে বাঁচাতে প্রতি সপ্তাহে একটা করে ইনজেকশন দেওয়া হতো প্রিমা কে।বেচারি একদম কাহিল হয়ে পড়তো সেই বিষাক্ত মেডিসিনের প্রভাবে। বেচারা আরশিয়ান তার যান্ত্রণা দেখে নিজেও আঁতকে উঠতো কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা তার।

_

রোদেলা দুপুর। অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতেই আরশিয়ান দেখলো প্রিমা চুল ছেড়ে বেলকনির সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। খুব সম্ভবত চুল শুকাচ্ছে। প্রিমার কেশরাশির দিকে তাকাতেই আরশিয়ানের বুক চিরে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস। প্রেগন্যান্সির ভয়াবহ সিম্পটমের দেখা না মিললেও বেচারির চুলগুলোর দশা হয়েছে বেহাল। ঘন, সিল্কি এবং শাইনি চুলগুলো একদম নির্জীব হয়ে গেছে। আরশিয়ান চোখ ফিরিয়ে হাতের ব্যাগটা সাইডে রেখে শার্টের বোতাম গুলো আনবাটন করতে করতে শুধাল,

–” চুল পুরোপুরি শুকায়নি? রোদের তেজ অনেক। অসুস্থ হয়ে পড়বেন কিন্তু। ”

প্রিমা চোখ বন্ধ করে বসেছিল। আরশিয়ানের কথা শুনে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে অতঃপর অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আরশিয়ান কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো প্রিমা বেডে বসে আছে। হুট করে তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো। ভেজা টাওয়েলটা প্রিমার হাতে দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে মাথাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নাটুকে স্বরে বলল,

–” আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। মাথাটা একটু মুছে দেন। ”

আরশিয়ানের অনাবৃত দেহে কেবল একটা ট্রাউজার রয়েছে। গোসল সেরে বেরোনোর ফলস্বরূপ সৌম্য দেহের সর্বত্র পানির অস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান। প্রিমা আলতো হাতে টাওয়েলটা তুলে নিয়ে আরশিয়ান এর শরীরে থাকা পানিগুলো আলতো করে মুছে দিয়ে অতঃপর মাথা মুছে দিতে লাগলো। আরশিয়ান ভীষণ অবাক হলো। সে ভেবেছিল প্রিমা হয়তো নাকচ করবে। অপ্রত্যাশিত যত্ন টুকু পেয়ে শানের আহ্লাদী মনটা নেচে উঠলো। নাটুকে ভাবটা বজায় রেখে কন্ঠে মেকি ক্লান্তির ভাব এনে বলল,

–” আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কিন্তু এই ভেজা চুল নিয়ে ঘুমালে সাইনাসের সমস্যা বাড়বে । আমি কী আপনার পায়ের উপরে আমার মাথাটা অল্প সময়ের জন্য রাখতে পারি? ”

প্রিমা ভীষণ শান্ত কন্ঠে বলল,

–” রাখুন। ”

আরশিয়ান পুনরায় হকচকিয়ে উঠে। ফাঁকা ঢোক গিলে সামান্য এগিয়ে প্রিমার কোমর জড়িয়ে ধরে তার উরুতে মাথা রাখে। মিষ্টি একটা সুবাসে তার মনপ্রাণ উচ্ছ্বসিত হয়। লোভ সামলাতে না পেরে প্রিমার স্ফীত পেটে আলতো করে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দেয়। প্রিমা একটু কেঁপে উঠে অস্ফুটস্বরে বলে,

–” কী করছেন…।”

আরশিয়ান মৃদু হেসে বলে,

–” আদর করে দিচ্ছি। ”

প্রিমা নিজেকে সামলে নির্লিপ্ত স্বরে শুধায়,

–” ভীষণ ভালোবাসেন ওদের তাইনা? ”

আরশিয়ান স্মিত হেসে বলে,

–” আমার অস্তিত্বের অংশ তারা। তাদের তো ভালোবাসতেই হবে। ”

প্রিমা তাচ্ছিল্য হেসে শুধায়,

–” সন্তানদের নিজের কাছে রাখার জন্যই এত নাটক সাজিয়েছেন বুঝি? ”

আরশিয়ান মাথা তুলে অবাক কন্ঠে শুধাল,

–” কী বললেন? ”

প্রিমা শান্ত চোখে চেয়ে কঠোর গলায় বলল,

–” ভুল কিছু বলেছি? আমাকে আঁটকে রাখার একমাত্র কারণ ওরা সেটা খুব ভালোমতো জানি আমি। অবশ্য সন্তানের ভাগ কে না চায়? ”

আরশিয়ান থম মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল,

–” প্রথমত আমি নিঃস্বার্থভাবে আপনাকে চাই অতঃপর আমাদের পরিণয়ের প্রাপ্তি হিসেবে আমাদের সন্তানদের চাই। প্রায়োরিটি লিস্টের সর্বত্র জুড়ে কেবল আপনার নাম বিদ্যমান ওয়াইফি। ”

প্রিমার চোখজোড়া অশ্রুতে ভিজে উঠে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে কাঁপা স্বরে বলে,

–” এসব কথা আপনার মুখে একদমই মানাচ্ছেনা।দুইমাস আগেও যেখানে নিজেকে ভিন্ন নারীর স্বামী দাবি করেছিলেন সেখানে ঝট করে আমার নাম এসে যাওয়ার ব্যপারটা যে পুরোটাই নাটক সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার। ”

আরশিয়ান হাল ছেড়ে দিলো। হতাশার শ্বাস ফেলে শুধাল,

–” আর কী কী বুঝেছেন প্রেম? ”

প্রিমার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়াচ্ছে। মুখে লেপ্টে আছে একরাশ রাগ এবং জেদ। সে ফুঁসে উঠে বলল,

–” বুবুর চাকরি কেড়ে নেওয়ার রিজন দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন আপনি। আমার অসুস্থ মস্তিষ্ক ব্যপারটা ধরতে না পারলেও সুস্থ হওয়ার পর বুঝেছি ওসব জাস্ট মেকি হুমকি ছিলো। আপনি এমন ব্যক্তিত্বের মানুষ নয়। শুধুমাত্র নিজের সন্তানদের আঁটকে রাখার জন্য নিজেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তিত্বের মানুষ প্রমাণ করতে চেয়েছেন আপনি। ”

আরশিয়ান পলকহীনভাবে চেয়ে থেকে বলল,

–” আমার দেওয়া একটা হুমকিও অহেতুক কিংবা বৃথা ছিলোনা। আপনাকে আঁটকে রাখতে চাওয়ার প্রয়াস করতে গিয়ে ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে হুঁশ খুইয়ে বসেছি অথচ আপনার একটুও মায়া হচ্ছে না। ”

প্রিমা একটু থমকালো। ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,

–” আপনার অযৌক্তিক কথাবার্তা শুনতে চাইছি না একদমই। আপনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানানোর আছে। বলবো? ”

আরশিয়ান চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে থেকে বলল,

–” বলুন ওয়াইফি। ”

প্রিমা টলমল চোখের অশ্রু আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

— ” পারিপার্শ্বিক সবকিছু বিবেচনা করে আমি একটা সিধান্ত নিয়েছি। আমার পক্ষে সেই দিনের জঘন্য অপমানটা ভোলা সম্ভব নয়। সবকিছু ভুলে এই সংসারে মনোনিবেশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব উপরন্তু আমি চাইনা যে আমার অনাগত সন্তানেরা আমাদের কোল্ড ওয়ার দেখে বড় হোক। সুতরাং এই অসুস্থ সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো বোকামি ব্যতীত কিছুই নয়। আপনার সন্তানদের আপনার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আমি এই দায়িত্ব নামক সম্পর্ক থেকে ইস্তফা নিতে চাই। ”

আরশিয়ান হতবিহ্বল কন্ঠে শুধাল,

–” কীসব বলছেন আপনি? আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়ন চলছে ঠিকই কিন্তু এটা অসুস্থতা নয়। আপনার কী মুড সুইং হচ্ছে? বড্ড অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন আপনি। ”

প্রিমা ক্রন্দনরত স্বরে কঠোরতা মিশিয়ে বলল,

–” একদম যুগোপযোগী সিধান্ত নিয়েছি। আপনার মতো ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সাথে লড়াই করা আমার কাম্য নয়। আপনি নামক অন্যের স্বামীটাকে গ্রহণ করার সামর্থ্য আমার নাই সুতরাং দিস্ ইজ দ্যা বেস্ট ডিসিশন। ”

আরশিয়ান কন্ঠে আকুতি মিশিয়ে বলল,

–” আমার কৃতকর্মের জন্য আমি অনুতপ্ত। আমার চোখেমুখে লেপ্টে থাকা অসহায়ত্ব আপনার নজরে আসছে না? গ্লানির অগ্নিতাপে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ঝলসে যাচ্ছি অথচ সেই দৃশ্যটা আপনার হৃদয় স্পর্শ করতে পারছেনা। আল্লাহর ওয়াস্তে একটু বোঝার চেষ্টা করুন। বিশ্বাস করুন আমার বলা একটা বর্ণও মিথ্যা নয়। ”

প্রিমা বিছানার চাদর খামচে ধরে চাপা গলায় বলল,

–” আপনার করা অপমান আমার বিবেকের ঘরে মস্ত বড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। সুবিচারের সামর্থ্য হারিয়েছে বিধায় অনর্থের পথ বেছে নিয়েছি।

আরশিয়ান হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় অতঃপর প্রিমার বাড়ন্ত পেটটার দিকে তাকিয়ে ব্যকুল কন্ঠে বলল,

–” আমার বিষয়টা বাদ রাখলাম নাহয় কিন্তু আমাদের সন্তানদের কথাটা এটলিস্ট চিন্তা করুন। ”

প্রিমা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল। এভাবে তর্ক বহুদূর পর্যন্ত যাবে। আরশিয়ানকে শেষ একটা সুযোগ দেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রিমা ভাঙা কন্ঠে শুধায়,

–” ভালোবাসেন আমায় আরশিয়ান ? ”

আরশিয়ান হকচকিয়ে উঠে নিরুত্তর রয়। প্রিমা রাগ সামলাতে না পেরে চেঁচিয়ে বলে,

–” নীরবতার ভাষা খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত এবার আক্ষরিক স্বীকারোক্তি চাইছি। ভালোবাসেন আমায়? ”

আরশিয়ান ফাঁকা ঢোক গিলে প্রিমার অশ্রুভেজা আঁখি জোড়ায় নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে সল্প স্বরে জবাব দিলো,

–” না। ”

জবাব টা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই অশ্রুসজল চোখদুটো ধীর গতিতে বন্ধ করে ফেলল প্রিমা। বুকটা অসহনীয় ব্যথায় নিষ্পেষিত হচ্ছে। বুকের বাঁ পাশটা ডলে মৃত্যুসম যন্ত্রণাটা কমানোর চেষ্টা করল অথচ ব্যথা কমার বদলে এর তীব্রতায় তার সুশ্রী মুখশ্রী নিমিষেই নীলাভ বর্ণ ধারণ করল।

কী আশ্চর্য সে কী মারা যাচ্ছে? সামান্য একটা স্বীকারোক্তি আদৌও মানুষকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে? উত্তর মিললো না স্রেফ ধীর লয়ে চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে আসলো প্রিমার। অল্পবিস্তর ভারী হওয়া শরীরটা ছেড়ে দিলো নরম গালিচার সফেদ বিছানায়। বন্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অক্ষিকোটরে জমাটবদ্ধ আক্ষেপ মিশ্রিত যন্ত্রণা সূচক উষ্ণ নোনাপানি।

চলবে?

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৫
#অংশঃ০২

ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। বেডের পাশে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে আরশিয়ান। বিছানায় নিস্তেজ ভঙ্গিতে শুয়ে আছে প্রিমা।কোনোপ্রকার নড়চড় নেই কেবল চোখজোড়া আধখোলা রয়েছে। তার পাশে বসে গম্ভীর মুখে প্রেশার মাপছে ইশতিরাজ। কাজটা শেষ হতেই আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

–” ব্লাড প্রেশার বেড়েছে । প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ”

কথাটা শুনে প্রিমা চোখবুঁজে ফেললো। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। আরশিয়ান মলিন কন্ঠে শুধাল,

–” কোনো মেডিসিন দেওয়া লাগবে? ”

ইশতিরাজ দু’জনের মুখাবয়ব অবলোকন করে অতঃপর জবাব দিলো,

–” না কিন্তু পেশেন্টের সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ”

আরশিয়ান সন্দিহান চোখে চাইলে ইশতিরাজ চোখের ইশারায় তাকে আশ্বাস্ত করলো। আরশিয়ান বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল,

–” আমি ড্রয়িংরুমে আছি। কিছু লাগলে আওয়াজ দিস। ”

ইশতিরাজ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আরশিয়ান বেরিয়ে যেতেই ইশতিরাজ ভীষণ আদুরে কন্ঠে প্রিমাকে বলল,

–” রুপাঞ্জেল? আমরা কী বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি? খোলা হাওয়ায় হয়তো ভাল্লাগবে আপনার । ”

প্রিমা চোখ মেলে চাইল। কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার কিন্তু এমুহূর্তে মাইন্ড ডাইভার্ট করাটা ভীষণ জরুরি তাই সে ধীর কন্ঠে বলল,

–” ঠিকাছে কিন্তু আপনি ডাকটা পরিহার করলে সুবিধা হয়। বয়সে আপনি আমার অনেকটা বড়। সম্পর্কের দিক দিয়ে বলতে গেলে আপনি আমার বড় ভাইয়ের মতো। এই জঘন্য আপনি ডাকটা বড্ড বেমানান লাগছে। ”

ইশতিরাজ অনুসন্ধানী চোখে চেয়ে তার মাইন্ড রিড করার চেষ্টা করলো। প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বলল,

–” এটা সময়সাপেক্ষ ব্যপার রুপাঞ্জেল। আমি হেল্প করবো উঠে বসতে? ”

প্রিমা একটু বিভ্রান্ত হয়ে তাকালো অতঃপর কী ভেবে যেনো একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। ইশতিরাজ যত্নের সাথে তার হাতটা ধরে তাকে বেলকনির সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালো। আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। একটু আগেও কাঠফাটা রোদ্দুর ছিলো কিন্তু এখন আকাশে মেঘের রাজত্ব চলছে। বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। ইশতিরাজ প্রিমাকে বসিয়ে তার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল,

–” ঘন্টাখানেকের জন্য মনে করুন আমি আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট এন্ড আম নট গননা জাজ্ ইয়্যু ফর এনিথিং। এই যে মস্তিষ্কের ভেতর যেই না বলা কথা গুলো ঘুরপাক খেয়ে আপনাকে বিরক্ত করছে কিংবা হার্ট করছে সেগুলো নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন। আপনার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর আজ আমি আপনাকে দিবো।আপনি কী এই আলোচনা পর্বে যেতে চান?”

প্রিমার স্তব্ধ হয়ে নিষ্পলক ভাবে চেয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলো। বিগত কায়টা মাস যাবত নানাবিধ প্রশ্নের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বড্ড বেশি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে বেচারি। বাধ্য হয়ে ইশতিরাজের কথা শুনে সম্মতি জানিয়ে বলল,

–” জ্বী। ”

ইশতিরাজ প্রিমার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত কন্ঠে শুধাল,

–” আজকে কী এমন ঘটলো যে আপনি এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন? কী নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে আপনার মনের মধ্যে ? ”

প্রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবটা খুলে বলল অতঃপর শেষ প্রশ্নের জবাবে আর্দ্র স্বরে বলল,

–” মানুষটার চমৎকার ব্যক্তিত্ব আমাকে একপ্রকার বাধ্য করেছিল অতীতের ভয়াবহ তিক্ততা ভুলে ভ্রান্ত ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে। স্টিল আই লাভ হিম ব্যাডলি কিন্তু উনার বলা কথাগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিনা। উনার অনুতপ্ততা দেখে একপর্যায়ে নিজের ভেতরকার সমস্ত দ্বিধা বাদ দিয়ে সম্পর্কটা মন থেকে মেনে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আজ উনার আচরণ আমাকে রীতিমতো হতাশ করে দিয়েছে। ”

সামান্য থেমে প্রিমা আবারও বলল,

–“যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেটা কেবল গিল্ট, দায়বদ্ধতা কিংবা সন্তানের দোহাই দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহসিকতা আমার নেই। ভালোবাসা বিহীন সংসারের মেকি যত্নের চেয়ে একাকীত্ব বেছে নেওয়াটা বোধহয় উত্তম কিন্তু এই আসামি নামক স্বামীর সাথে দূরত্ব বাড়লেই বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়।”

ইশতিরাজ খুব সতর্কতার সাথে প্রিমার বলতে থাকা প্রত্যেকটা বাক্য মার্ক করে রাখছিল। সে কথা বলা শেষ করতেই ইশতিরাজ ধীর কন্ঠে শুধাল,

–” অতীতের পুরো বিষয়টা মন মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে অতঃপর সুযোগ দেওয়ার সিধান্ত নিয়েছিলেন নাকি শানের অনুতপ্ততা দেখে আকস্মিক এই সিধান্তে উপনীত হয়েছেন? ”

প্রিমার কপালে ভাঁজ পড়লো। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

–” বিগত দুই মাস যাবত আমি উনাকে অবজার্ভ করছিলাম। আমার বারংবার মনে হয়েছে যে উনি এক্সট্রিম লেভেলের অনুতপ্ত। প্রায়শই দেখতাম রাত এর বেলা আমার হাত জড়িয়ে ধরে কান্না করতেন। অস্ফুটস্বরে স্যরি বলতেন। কতদিন তো আমার পা ধরেও স্যরি বলেছেন তবে এসবকিছু আমি ঘুমিয়ে পড়লে করতেন। কেনো জানি মনে হতো যে উনি কোনোভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ্যে আনতে চাইছেন না। অতীত আমি একদমই ভুলতে পারিনি কিন্তু উনার অবস্থা দেখলে ভেতরটা কেঁপে উঠতো। একবার মনে হয় এসব শুধু সন্তানের জন্য করছেন আবার মনে হয় সবকিছু কেবল গিল্ট থেকে করছেন পরক্ষণে মনে হতো হয়তো এতদিনে একটু হলেও ভালোবাসা জন্মেছে এজন্যই আজ উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু উনি….

ইশতিরাজ পুরো বিষয়টা এক ঝটকায় বুঝে গেলো। বুক ভরে শ্বাস টেনে স্মিত হেসে প্রিমাকে বলল,

–” আরশিয়ানের প্রসঙ্গে পরে আসছি প্রথমত আপনার বিষয়ে কিছু কথা বলা যাক। শানের অনুতপ্ততা আপনাকে যেমন সংসারে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করছে পরক্ষনে ঠিক তেমনই অতীত আপনাকে মারাত্মক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আপনি রীতিমতো এই দুইটা বিষয়ের মাঝে অসহায় ভাবে ফেঁসে আছেন। সারাজীবন আত্মসম্মান বজায় রেখে কঠোর সিধান্ত নেওয়া আপনিটা শানের প্রতি শক্ত হতে পারছেন না বলে মাঝেমধ্যে নিজের প্রতি রাগ হয় আপনার। সব মিলিয়ে একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে আপনি সিধান্ত নিয়েছিলেন যদি শান ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দিবেন। যদি শান নাকচ করে তবে তার সন্তানদের দায়িত্ব তাকে বুঝিয়ে দিয়ে একাকীত্বকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিবেন। আমি যদি খুব ভুল না হই তাহলে বাচ্চাদের প্রতিও আপনি ভীষণ বিরক্ত। সহজ ভাষায় বললে আপনি তাদের একদমই চান না। ভুল কিছু বললাম? ”

প্রিমা রীতিমতো কেঁপে উঠলো। ভয়মিশ্রিত চোখে তাকাল ইশতিরাজের দিকে। তার বলা শেষোক্ত কথাটা একদম সত্য কিন্তু শুনতে বড্ড বিদঘুটে লাগলো। প্রিমা ইতিউতি চেয়ে কাঁপা স্বরে বলল,

–” বিশ্বাস করুন.. আমি ওদের ভালোবাসতে চাই কিন্তু যখনই মনে পড়ে সেদিনকার অপমানের কথা আমি রীতিমতো অন্যরকম ঘোরে চলে যায়। আমার পাগল পাগল লাগে। আমি আজীবন সবার কাছে একটু ভালোবাসায় চেয়েছিলাম কিন্তু কেনো জানি সবাই কেবল আমায় করুনা করে কিংবা দয়া দেখায়। আম্মুর কাছেও একটুখানি ভালোবাসার আবদার করেছিলাম কিন্তু উনি আমার শত প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণ করে ফাঁকি দিয়ে পালালেন। আমি টের পেয়েছিলাম নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাউকে আগলে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হলে কতটা ভয়ানক যন্ত্রণা হয় এজন্যই পরবর্তী থেকে নিজেকে কঠোর নিয়মে আবদ্ধ করে নিয়েছি। আমার যেটা লাগবে সেটা যদি সামনের জন না এনসিউর করতে পারে তবে আমি ইফোর্ট দেয় না। উনি যদি আমাকে ভালোবাসতে নাই পারে তাহলে এই ভিত্তিহীন সংসারে আমার অস্তিত্বের পরিচয় কী হবে জানেন? সবাই জানবে আমি উনার সন্তানের জননী অথচ কেউ জানবেনা এই সন্তানেরা আমাদের ভালোবাসা নয় বরং উনার ভুলবশত…
আমি এই ব্যপারটা মানতেই পারিনা আবার ভুলতেও পারিনা। আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। আমি কীভাবে ওদের ভালোবাসবো বলুন? আপনি-ও কী আমাকে ভুল বুঝবেন? ”

প্রিমার চোখে ভয়মিশ্রিত আকুতি মিশে আছে। সবটা শুনে ইশতিরাজ তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে নরম গলায় বলল,

–” রুপাঞ্জেল? মনে করুন আপনার সামনে আপনার বড় ভাই বসে আছে। তার একমাত্র কন্সার্ন আপনার সুস্থতা এবং হ্যাপি লাইফ। আপনি সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মনের যত অযাচিত দুশ্চিন্তা আছে সমস্তটা আমায় বলুন এবং বিশ্বাস রাখুন। আপনার বলা একটা কথাও এই ঘরের বাহিরে কখনো যাবে না। ওয়েল.. লেটস জাম্প ইনটু দ্যা কনভারসেশন। আপ… ”

প্রিমার অশ্রুসিক্ত চোখজোড়ার অপলক চাহুনিতে থমকে গেলো ইশতিরাজ। মেয়েটা একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই বাচ্চা মেয়েটা কী ভয়ংকর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠল ইশতিরাজের। নিজের কথা কাউকে বোঝাতে না পারার মতো অসহায় অনুভূতি দ্বিতীয়টা নেই। নিজেকে সামলে ইশতিরাজ পুনরায় বলল,

–” আপনার ভুলটা কোথায় জানেন রুপাঞ্জেল? আপনি জোরপূর্বক অতীত ভুলার প্রচেষ্টায় আছেন। এজন্যই বিষয়গুলো আপনার মস্তিষ্কে খুব বাজে ভাবে গেঁথে গেছে। আপনি দিনরাত ওভার থিংক করে অযাচিত ভাবনা গুলোকে সত্য ভেবে বসে আছেন যেটার সাথে বাস্তবতার সম্পৃক্ততা নেই।”

প্রিমা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধাল,

–” সবাই বলে সবটা মেনে নিয়ে অতীত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত অথচ আপনি বলছেন উল্টোটা। আসলে কী করা উচিত? ”

ইশতিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহজ গলায় বলল,

–” ইন্ট্রোভার্ট মানুষেরা ডিপ্রেশনে ভুগে বেশি। কেনো জানেন? কারণ সাংঘাতিক ভাবে কষ্ট পেলও তারা রিয়েক্ট করে না বরং নিরব হয়ে যায়। অনুভূতি চেপে রাখার বিষয় নয় এই সহজ কথাটা মানুষ বুঝে না। আপনি যত বেশি অনুভূতি দমিয়ে রাখবেন তত বেশি আপনার দমবন্ধ লাগবে। এক পর্যায়ে আপনি ওভার থিংক করবেন শেষপর্যায়ে আপনি ডিপ্রেসড হবেন এরপর সব শেষ। মানুষ সবজান্তা শমসের নয় সুতরাং কেউ আপনাকে হার্ট করলে পরিস্থিতি বুঝে রিয়েক্ট করুন। সামনের জনকে বোঝান আপনার ব্যপারটা ভালো লাগেনি। যখন আপনি নিজের ফ্রাস্ট্রেশন বের করে ফেলবেন তখন মন খারাপ থাকলেও মানসিক অশান্তিটা আর থাকবেনা। ফেসবুক কিংবা ইন্সটাগ্রাম রিলসে কুল ভাইবের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে নিজের অনুভূতি, আক্ষেপ, অভিমান মনের মধ্যে দমিয়ে রেখে নিরব হয়ে যেতে এপ্রিশিয়েট করে অথচ এটাই একসময় মরণঘাতী রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ”

প্রিমা খুব ভালোমতো রিলোট করতে পারলো বিষয়টা। সেদিন যখন আরশিয়ান তাকে কথাগুলো বলে তখন মন চাইছিল চিল্লিয়ে প্রতিবাদ করতে। তার বুকে আছড়ে পড়ে অঝোর ধারায় কেঁদে নিজের কষ্টটা হালকা করার অভিপ্রায় জেগেছিল মনে কিন্তু নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে না পারার জড়তা তাকে আঁটকে দিয়েছিল। প্রিমা অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

–” সত্যি? ”

ইশতিরাজ তাকে আশ্বাস্ত করে বলল,

–” ইয়েস রুপাঞ্জেল। আপনার বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে চান নাকি আমরা এবার আরশিয়ান এবং আপনাদের সম্পর্কের বিষয়টার দিকে আগাবো? ”

প্রিমা ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অসহায় কন্ঠে শুধাল,

–” এই অসহ্য অনুভূতি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়? আমি ওভার থিংক করতে চাইনা। এই দুঃখের সাগরে ভেসে মৃত্যুসম যন্ত্রণা উপভোগ করতে চাই না। শান্তির খোঁজ কোথায় পাবো? কী করলে এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পারবো? ”

প্রিমার ছটফটানি উপলব্ধি করতে পেরে ইশতিরাজের বুক ভার হয়। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধায়,

–” আপনার কী করতে মন চায় রুপাঞ্জেল? সব যুক্তি-তর্ক, ঠিক-ভুল, এবং ন্যায়, অন্যায়ের দ্বিধা ভুলে আপনার মন এবং মস্তিষ্কের ইচ্ছেরা কী চায়? ”

প্রিমা শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বলল,

–” উনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মন চায়। উনার সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও আমি কেনো উনার ভালোবাসা হতে পারলাম না সেই উত্তরটা চাই। আমি জীবিত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে অন্য নারীর স্বামী দাবি করার অপরাধে উনাকে আজীবন কেবল আমাতে আসক্ত থাকার মতো ভয়াবহ শাস্তি দিতে মন চায়। আমার প্রাপ্য অধিকারকে উদ্দেশ্য আদায়ের নাম দেওয়ার জন্য আমার সান্নিধ্য পাওয়ার অভিপ্রায়ে নিদারুণ যন্ত্রণায় তাকে তড়পাতে দেখতে চাই। সত্যি বলতে আমার চাহিদার অভাব নেই সেই সাথে এসব পূরণ হওয়ার ও কোনো সম্ভাবনা নেই। ”

ইশতিরাজ অভিভূত হয়ে শুনলো তার কথাগুলো। লাস্টের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে শুধাল,

–” সম্ভাবনা নেই কেনো? ”

প্রিমা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

–” সম্ভাবনা নেই কারণ মানুষটা রিক্ত। প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভূতি, প্রথম স্ত্রীর তরে নিজের সর্বস্ব লুটিয়ে আমার জন্য কেবল দায়িত্বশীলতা অবশিষ্ট রেখেছে।

ইশতিরাজ শব্দ করে হেসে ফেললো। প্রিমা অবাক চোখে চাইল। ইশতিরাজ তার চাহুনি দেখে নিজেকে সামলে বলল,

–” দুঃখিত আমি হাসতে চাইনি তবে আপনার কথা শুনে হাসি চাপিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। আরশিয়ান আমার নিজের ভাই না। তার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই ইভেন আমাদের সম্পর্কটাও মাত্র আট বছরের তবুও কেনো জানি ওর মুখ দেখলে মনের খবর বুঝতে পারি। ওর কথা শুনলেই এক ঝটকায় সমস্যা বুঝে যায়। আমার কাছে আরশিয়ান স্রেফ একটা খোলা বই। যার প্রত্যেকটা অধ্যায়ের সাথে আমি খুব ভালোমতো পরিচিত। দুনিয়ার সবাই কে ফাঁকি দিতে পারলেও এই রাজের কাছে বান্দা একদম ধরাশায়ী। আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে। তবে সেই পর্বে যাওয়ার আগে একটা ঘটনা শেয়ার করি? আপনি মেন্টালি স্ট্রং থাকলে বলবো নয়তো পরবর্তীতে আলোচনা হবে এই বিষয়ে।”

ইশতিরাজের সাথে কথা বলার পর প্রিমার মনটা একটু স্থির হয়েছে। বুকের ওপর চেপে বসা পাথরটা সরেছে। লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে শান্ত স্বরে বলল,

–” জ্বী ভাইয়া বলুন আমি শুনছি। ”

ইশতিরাজ বুক ভরে শ্বাস টেনে বলতে শুরু করে এক জঘন্য অতীতের বর্ণনা।

_

আরশিয়ান অ্যাভারেজ পর্যায়ের স্টুডেন্ট ছিলো। পড়াশোনার প্রতি তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না কারণ ছোটোবেলা থেকেই তার একমাত্র নেশা ছিলো নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তার এই মনোভাবটা আরিয়ান চৌধুরী বুঝেছিলেন বলেই শান যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠে তখন তাকে জোরপূর্বক নিজের কোম্পানিতে ইনক্লুড করেন। তিনি চাননি শান অন্য কোথাও নিজের পরিশ্রম কিংবা মেধা ব্যয় করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করুক। যথারীতি আরশিয়ান নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে। ওয়াসীত্বদের কুকর্ম ফাঁস করে দেওয়ায় মূলত আরশিয়ান প্রিমার চাচার টার্গেটে আসে। সময় নিজের মতো পার হয়। আরশিয়ান যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট তখন তার পরিচয় হয় নীহারিকার সাথে। তাদের প্রথম দেখা হয় সিলেটে। বেড়াতে গিয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে নীহা। আগ্রাসী বন্যায় তার একজন বান্ধবী নিখোঁজ ছিলো। বেচারি আতঙ্কে পুরোপুরি থমকে গিয়েছিল। আরশিয়ানেরা যখন ত্রাণ নিয়ে উপস্থিত হয় তখন নীহা তাদের সবটা খুলে বলে এবং অনুরোধ করে তার বান্ধবীর খোঁজ এনে দিতে।

আরশিয়ানদের গ্যাংটা ছিলো মূলত সাতজনের তন্মধ্যে চারজন ছেলে এবং তিনজন মেয়ে ছিলো। আরশিয়ান ব্যতীত বাকিরা পার্টনার ছিলো বিধায় তারা একসাথেই এসেছিল। নীহার কথা শুনে সকলে দুঃখ পায় তবে আরশিয়ানের মুগ্ধ দৃষ্টি আঁটকে যায় নীহার কোমল আচরণে। মেয়েটা দেখতেও চমৎকার সুন্দরী ছিলো। কিছু একটা ভেবে সে নীহাকে অফার করে তাদের সাথে আসতে। বাড়ির অন্যরা প্রথমে অনুমতি দিতে না চাইলেও নীহা তার বাসায় জানিয়ে আরশিয়ানদের সাথে বেরিয়ে পড়ে। ঘন্টা সাতেক ধরে খুঁজেও কোনো হদিস না পেয়ে নীহা ভেঙে পড়ে কিন্তু এরপর আসলে কারও কিছু করার ছিলোনা। ত্রাণ দেওয়া শেষ হতেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বাধ্য হয়ে নীহাও তাদের সাথে আসে। নীহার মন ভালো করার জন্য মেয়েরা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিল। কথায় কথায় তার ভার্সিটির কথা জিজ্ঞেস করলে আরশিয়ান জানতে পারে নীহা তার ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। আরশিয়ান ওসব শুনেও নির্বাক থাকে। যথারীতি নীহাকে নামিয়ে দিয়ে আরশিয়ান বাসায় চলে যায়। এরপর আরও সময় পার হয়। ফাইনাল এক্সামের একমাস আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটস কালেক্ট করতে আরশিয়ান ভার্সিটিতে আসে। আচমকা তার এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে মেডিকেল সেন্টারে নিলে আরশিয়ান খেয়াল করে পাশ্ববর্তী বেডে নীহা অচেতন হয়ে পড়ে আছে এবং তার পাশে দু’জন বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে।

নীহার শুকনো মুখ আর হাড্ডিসার শরীরের অবস্থা দেখে আরশিয়ান ভীষণ অবাক হয়। কৌতূহল দমাতে না পেরে পাশে দাঁড়ানো মেয়ে গুলোকে জিজ্ঞেস করে নীহার কথা। তারা জানায় খাবারের অনিয়মের ফলে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শান মাথা ঘামায়নি। সে নিজের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ে। পরদিন অফিস যাওয়ার পথে দেখে রাস্তায় ছোটো খাটো একটা ভীড় জমেছে। সে কৌতূহল বশত এগিয়ে গেলে দেখতে পায় একটা বেঞ্চে বসে নীহা বমি করছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ক’জন মানুষ। দায়িত্ববোধ এড়াতে না পেরে সামনে এগিয়ে গিয়ে আরশিয়ান তাকে রেসকিউ করে এবং গাড়িতে বসিয়ে জানতে চায় তার এই অবস্থা কেনো। নীহা শান্ত স্বরে জবাব দেয়। তার বাড়ির মানুষজন ভীষণ স্ট্রিক্ট। প্রয়োজনীয় খরচের বাহিরে একটা টাকাও দেয়না বিধায় তাকে টিউশনি করাতে হয়। একদিন টিউশনি মিস গেলে টাকা কেটে নিবে বিধায় অসুস্থ শরীরেও তাকে ছুটতে হয়েছিল। আরশিয়ান তাকে খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে নীহা মিনমিনে স্বরে জানায় মেসের খাবার সে খেতে পারেনা। শান অবাক হয়ে তাকে বাহিরে খাওয়ার কথা বললে নীহা জানায় খরচের জন্য বাসা থেকে খুবই সীমিত টাকা পাঠানো হয়।

আরশিয়ান নিশ্চুপ হয়ে যায়। সনামধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো মেয়ের ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত টাকা পয়সা না দেওয়ার ব্যপারটা তাকে ভাবিয়ে তুলে। সে কৌতূহলী হয়ে নীহাকে তার পরিবারের ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে নীহা ওয়াসীত্ব পরিবারের সদস্য। সে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। নীহা আরও জানায় তার বাবা মারা যাওয়ার পর তারা একপ্রকার পরগাছার মতো বেঁচে আছে।

আরশিয়ানের ভীষণ খারাপ লাগে। সে দোষীকে শাস্তি দিয়েছিল কিন্তু তার জন্য কিছু নিরপরাধ মানুষকে ও ভুগতে হচ্ছে। সহমর্মিতা থেকে সে নীহাকে একটা জবের অফার দেয়। নীহা বাধ্য মেয়ের মতো কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেটা একসেপ্ট করে। নীহার জবটা বড্ড সিম্পল ছিলো। সে বাসায় বসে অফিসের স্টাফদের কাজকর্ম মনিটর করতো এবং দিনশেষে রিপোর্ট আরশিয়ানকে জানাতো। এভাবে আস্তেধীরে সময় পার হতে থাকে। শান এবং নীহার মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এর মাঝে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ভার্সিটিতে ক’দিন ছুটি দিলে নীহা তার বাসায় যায়। নীহার কাজকর্ম দেখে নাহার তাকে প্রশ্ন করলে নীহা সরল গলায় সবকিছু খুলে বলে।

সবটা শুনে নাহারের চোখজোড়া খুশিতে চকচক করে উঠে। তার বুঝতে বাকি থাকেনা আরশিয়ান নীহার প্রতি দুর্বল। তিনি তৎক্ষনাৎ সবটা আরভিদের বাবাকে জানান। তারা একটা মিটিং বসিয়ে নীহাকে বোঝায় আরশিয়ান তার বাবার খুনি। নীহার মাঝে প্রতিশোধপরায়ণা সত্তা জেগে উঠে এবং সে তাদের কথামতো আরশিয়ানের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দি আঁটে।

খুব অল্প সময়ের মাঝে নীহা নিজের দুঃখ শুনিয়ে তার মনে জায়গা করে নেয়। নীহা মূলত তার মায়ের অনাদরে বড় হয়েছে। নাহারের নীহাকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিলোনা। নীহা তার কাছে কেবল একটা উটকো ঝামেলা ছিলো যার পেছনে টাকা গুণতে সে নারাজ ছিলো। নাহারের অবজ্ঞা নীহাকে বাধ্য করে টাকার বিনিময়ে নিজের সম্ভ্রম বিলাতে। এসব কিছুই আরশিয়ান জানতোনা উল্টো তাকে বলা হয়েছে নীহা তার বাবার পাওনাদারের কাছে এবিউজ হয়েছে। এগুলো শুনে আরশিয়ান রীতিমতো অপরাধ বোধে জর্জরিত হয়। সবটা বিবেচনা করে সে নীহাকে নিজের জীবনের সাথে জড়ানোর সিধান্ত নেয়। শান কেবল ভিক্টিম নীহার দুঃখের জীবনে সুখের কারণ হতে চেয়েছিল। অন্যদিকে নীহা শানের এই সরলতার সুযোগ নিয়ে অফিসের বিভিন্ন তথ্য বাহিরে পাচার করে বিশ্বস্ত এমপ্লয়িদের নাম খারাপ করতো।

আরশিয়ানের বিজনেসে যখন আপস এন্ড ডাউন চলছে তখন নীহা উপস্থিত হয় নতুন দুঃসংবাদ নিয়ে।মূলত হাজার চেষ্টা করেও আরশিয়ানদের বিজনেসে কাঙ্ক্ষিত ঝামেলা বাঁধাতে পারছিলো না নীহা তাই সবাই মিলে প্ল্যান করে নীহা শানকে বিয়ে করবে অতঃপর কায়দা মাফিক সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে আরশিয়ানের নামে বিরাট এক অপবাদ দিয়ে সরে আসবে। নীহা কেঁদেকুটে জানায় তার বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সে শানের কথা জানালে তাকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আরশিয়ান হতভম্ব হয়ে যায়। কী করবে বুঝতে না পেরে নীহার কথার ফাঁদে পা দিয়ে সেদিনই কাজি অফিসে বিয়ে সেরে ফেলে। নীহাকে নিয়ে বাসায় গেলে সবাই রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যায়। বিয়েটা মোটামুটি সবাই মেনে নিলেও আফিয়া চৌধুরী এবং আরিয়ান চৌধুরী মন থেকে মানতে পারেননি।

আরশিয়ান নিজ দায়িত্বে তার বাবা মাকে বোঝায়। বাসার সবাইকে কনভিন্স করে। নীহাকে রীতিমতো মাথায় তুলে রাখে। একমুহূর্তের জন্য নীহা নিজেই অবাক হয়ে যায়। আরশিয়ান যেদিন পুরোপুরি নীহার কাছে নিজেকে সঁপে দেয় সেদিন তার বাবার বিষয়ে পুরোটা খুলে বলে। নীহা বুঝতে পারে তার মা তাকে কেবল নিজের জেদ পূরণের জন্য ব্যবহার করছে। আরশিয়ানের ব্যবহার এবং পরিবারের সকলের অমায়িক আচরণ নীহার মনে দাগ কেটে যায়। তার দিন কাটছিল সপ্নের মতো কিন্তু বিয়ের একমাসের মাথায় তার প্রাক্তন তাকে বিরক্ত করতে শুরু করে। নীহা হাজার কান্নাকাটি করেও মাফ পায় না উল্টো তার সাথে অন্তরঙ্গ হতে বাধ্য হয়। এরপর নীহা এত বেশি গ্লানিবোধে ভুগছিল যে আরশিয়ানের সান্নিধ্যে আসাটা সহজ ভাবে নিতে পারতোনা। নীহার অবস্থা বুঝে আরশিয়ান তাকে কখনোই ফোর্স করেনি উল্টো বাসার জন্য তার মন খারাপ ভেবে নীহার পরিবারের সাথে কথা বলার প্রস্তাব রাখে।

নীহা সঙ্গে সঙ্গে সেটা নাকচ করে দেয়। সময় পেরোতে থাকে কিন্তু নীহাকে কোনো পদক্ষেপ নিতে না দেখে নাহার তাকে ইমার্জেন্সি বাসায় ডাকে। নীহা প্রথমে রাজি না হলেও একপর্যায়ে রাজি হয়।প্রসঙ্গটা আরশিয়ানকে জানালে সে দ্বিরুক্তি করেনা। সকাল বেলা উঠে রেডি হওয়ার সময় আচমকা নীহা অসুস্থ হয়ে পড়ে। সন্দিহান নীহা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতেই জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। আরশিয়ান খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় অন্যদিকে নীহা ঘাবড়ে যায়।

আরশিয়ানকে বিষয়টা কাউকে জানাতে নিষেধ করে। তার মায়ের সাথে বোঝাপড়া করে এরপর সবাইকে জানাবে বলে সিধান্ত নেয়। আরশিয়ান একটু নাখোশ হলেও মেনে নেয়। এরপর নীহা গেলেও আর ফিরে আসেনি। কাউকে জানানো হয়নি সেই সুখবর।

আরশিয়ান ব্যপারটা মানতে পারেনি। নীহা তার জীবনে আসা প্রথম নারী ছিলো। নিজের সমস্তটা বিলিয়ে দিয়েছিল সেই এক নারীর পদচারণায়। সমস্তটা দিয়ে ভালোবেসেছিল নীহা নামক কলঙ্কিত নারীকে। তার ভালোবাসার তীব্রতা নীহাকেও বাধ্য করেছিল খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে কিন্তু শেষ অব্দি সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। এই ধাক্কাটা মানতে পারেনি আরশিয়ান। গম্ভীর ছেলেটা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনি। ফ্যাল ফ্যাল করে নীহার নিথর মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। এতটাই থমকে গিয়েছিল যে তার মুখ থেকে শব্দ বেরোয়নি। নীহাকে যখন দাফন করা হয় তখন আইসিইউর কাঁচ ঘেরা ঘরটায় অন্তিম শ্বাস টানছিল আরশিয়ান। ডক্টররা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু শেষপর্যন্ত উপরওয়ালা আফিয়া চৌধুরীর কোলে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দেন।

আরশিয়ান সুস্থ হওয়ার পরও চরম অসুস্থতায় ডুবে যায়। বাধ্য হয়ে তাকে বাহিরে পাঠিয়ে দেন আরিয়ান চৌধুরী। বাবা মায়ের অসহায় স্বর আরশিয়ানকে বাধ্য করে দেশ ছাড়তে। বাহিরে গিয়ে তার ট্রিটমেন্ট শুরু হয়। ভ্রমের জীবন থেকে আস্তেধীরে বেরিয়ে আসে আরশিয়ান। নীহা তাকে ঠকালেও শানের ভালোবাসায় একটুও খাদ ছিলোনা। শুদ্ধ পুরুষের ভালোবাসা হয় নিখুঁত এবং তা কেবল সৌভাগ্যবতী নারীর কপালেই জোটে। নারী অসুন্দর হোক কিংবা ছলনাময়ী….সে যদি ভাগ্যবতী হয় তবে দুনিয়াবি জীবনের সমস্ত সুখ তার পদচারণে থাকে।

_

অতীতের বর্ণনা দিয়ে থামলো ইশতিরাজ। প্রিমার দিকে তাকাতেই দেখলো তার চোখজোড়ায় লজ্জা মিশ্রিত ঘৃণা ফুটে উঠেছে। ইশতিরাজ ধীর স্বরে ডাকল,

–” লিটল এঞ্জেল? ”

প্রিমা চোখ তুলে তাকাতেই তার অশ্রুসজল আঁখি হতে বেহায়া অশ্রুরা গড়িয়ে পড়লো। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো। ইশতিরাজ তা দেখে হতাশ কন্ঠে বলল,

–” কান্না আঁটকে রাখতে নেই রুপাঞ্জেল। ”

ব্যস এই এক কথায় প্রিমা শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠল। প্রিমার খারাপ লাগা বুঝতে পেরে ইশতিরাজ তাকে একটু সময় দিলো সামলে যেতে। কিছুক্ষণ পর ইশতিরাজ শান্ত আবার বলল,

–” আপনাকে অতীত বলার কারণটা কী জানেন?”

প্রিমা নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধাল,

–” কী? ”

ইশতিরাজ আলতো হেসে বলল,

–” আরশিয়ান আপনাকে কেনো ভালোবাসেনা বা বাসলেও কেনো স্বীকার করছে না সেটা বোঝাতে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হয়েছে। জাস্ট ইমাজিন.. একটা চমৎকার বুঝদার ছেলে তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে প্রথমত মেন্টালি আনস্টেবল হলো অতঃপর তার স্ত্রীকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে আট বছর একাকীত্ব এবং পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে রইল। একজন সুস্থ সবল এবং প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য নারীসঙ্গ বিহীন থাকা এতোটাও সহজ নয়। তার ভালোবাসার টানটা কতটা শক্তপোক্ত হলে সে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রীর সান্নিধ্যে যাওয়া থেকে বিরত থাকে সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। এবার আপনিই বলুন, সেই অভাগা পুরুষ যখন জানতে পারে তার প্রথম স্ত্রী একজন ছলনাময়ী ছিলো এবং তার জীবনে এসেছিল কেবল তাকে ধ্বংস করতে তখন তার অনুভূতি কেমন হবে? যে পুরুষটা শর্ত বিহীন একজন কলঙ্কিত নারীকে নিজের জীবনে ঠাঁই দেওয়ার পর জানতে পারে সেই নারী তার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অন্য পুরুষের সান্নিধ্যে গেছে এবং তার সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে তখন তার ভালোবাসা নামক শব্দে আদৌ বিশ্বাস থাকবে? ”

এতক্ষণ দুঃখের সাগরে ভাসলেও এবার প্রিমার অকেজো মস্তিষ্ক একটু সচল হয়। ইশতিরাজের কথাগুলো ধরতে পেরে তার বুকটা কেঁপে উঠে। সে হড়বড়িয়ে প্রশ্ন করে,

–” আপনি বলতে চাইছেন আরশিয়ান আমাকে ভালোবাসে কিন্তু স্বীকার করতে এবং মানতেই উনার যত বাঁধা? ”

প্রিমার বুদ্ধিমত্তা দেখে ইশতিরাজের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে সায় জানিয়ে আমুদে কন্ঠে বলল,

–” এক্স্যাক্টলি। আপনি নিজেই চিন্তা করুন বিয়ের পর আরশিয়ানের জন্য আপনি স্রেফ একটা দায়িত্ব ছিলেন।তার প্রথমদিকের আচরণের সাথে এখনকার আচরণের কোনো মিল আছে? যদি কেবল দায়িত্ব হতেন তাহলে শান আপনাকে স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা দিতো? যদি কেবল দায়িত্বই হতেন তাহলে আপনাকে নিজের কাছে রাখার জন্য আরশিয়ান ডেস্পারেট হতো?আপনি দাবি করতেই পারেন আরশিয়ান এসব তার বাচ্চার জন্য করছে কিন্তু আপনি কী জানেন শুধুমাত্র আপনাকে পাওয়ার জন্য আরশিয়ান মিস জানার সামনে হাতজোড় করে আপনাকে চেয়ে এনেছে? স্রেফ দায়িত্বের জন্য পুরুষ মানুষ কখনো মাথা ঝুঁকায়না রুপাঞ্জেল। তার আচরণ বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন আপনার বিশুদ্ধ পুরুষ আপনার ভালোবাসায় রীতিমতো তলিয়ে গেছে শুধু স্বীকারোক্তি দিতেই তার আজন্মের ভয়। প্রকাশ্যে যত্ন নিতেও তার মধ্যে ইনসিকিউরিটি কাজ করবে যেটা একদমই নরমাল। আপনি যেমন ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন আপনার হাসবেন্ড ও তেমন নিজের কৃতকর্মের জন্য সাফার করছে। ”

প্রিমা কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করল,

–” সবটা বিশ্লেষণ করে শেষপর্যন্ত ব্যপারটা হলো এই যে মিস্টার আরশিয়ান ইসফার চৌধুরীর মনে আমার জন্যে হিউজজজজ ফিলিংস আছে তবে উনার প্রকাশ করতে ভয় হয়। আমি যে সংসারটা ছাড়ার সিধান্ত নিয়েছিলাম সেটা তাহলে পরিবর্তন করা উচিত? ”

প্রিমার বাচ্চামিতে ইশতিরাজ হাসলো। নারীর মন বোঝা বড় দায়। এই কিছুক্ষণের আলাপে একবার প্রিমা কেঁদেছে একবার বিষন্নতায় ডুবেছে কখনো তেজ দেখিয়েছে আবার কখনো অভিমান প্রকাশ করেছে। সবশেষে এখন উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে উদ্ভট প্রশ্ন করছে। ইশতিরাজ গলা খাঁকারি দিয়ে সহজ গলায় বলল,

–” আমি কখনোই আপনাকে আত্মসম্মানের সাথে আপোষ করতে বলবো না। আপনার যদি মনে হয় অতীতের কারণে বিচ্ছেদের সিধান্ত নেওয়া উচিত তাহলেও আমি আপনাকে সাপোর্ট করবো আবার আপনার যদি মনে হয় আরশিয়ানকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে পুরো বিষয়টা আরও ভালোভাবে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে অতঃপর সিধান্ত নেওয়া উচিত তাহলেও আমাকে পাশে পাবেন। সর্বোপরি আমি চাই আপনি হঠকারিতা নয় বরং মেন্টালি স্ট্রং হয়ে নিজের ভালোর জন্য যেটা বেস্ট হয় সেই সিধান্তে উপনীত হোন। ”

সামান্য থেমে ইশতিরাজ আবারও বলল,

–” আপনার মাঝে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যেটা আমার ক্লিয়ার করা উচিত ওয়েট কিছু শোনায় আপনাকে। ”

কথাটা বলেই ইশতিরাজ একটা অডিও রেকর্ডার প্লে করে যেখানে সেদিনকার গাড়ির কনভারসেশনটা শেনা যায়। আরশিয়ান অকপটে তার দোষ স্বীকার করে এবং বলে সে প্রিমাকে জেনে-বুঝেই কাছে টেনেছে কিন্তু পরবর্তীতে আরভিদের কথার ফাঁদে পা দিয়ে প্রিমাকে ভুল বুঝে অপবাদ দিয়েছে। প্রিমার মনে হলো তার মস্তিষ্ক থেকে বিশাল একটা চিন্তার পাহাড় নামলো। ইশতিরাজ রেকর্ডিং অফ করে বলল,

–” মানুষ একা বাঁচতে পারেনা। একাকীত্বের যন্ত্রণা কতটা ভয়ানক এটা আপনাকে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। দিনশেষে প্রত্যেকটা মানুষের একজন ব্যক্তিগত মানুষের প্রয়োজন হয়।আপনার যদি মনে হয় আপনি শান এবং আপনার বাচ্চাদের ছেড়ে ভালো থাকবেন তাহলে বিচ্ছেদের সিধান্তটা একদম উপযুক্ত। আবার আপনার যদি মনে হয় আরশিয়ানের সান্নিধ্য এবং বাচ্চাদের ছাড়া দূরে থাকলে আপনার আত্মসম্মান বজায় থাকলেও মানসিক শান্তি জানালার ফাঁক গলিয়ে পালাবে তাহলে এই সংসারে থেকে যাওয়াটা আপনার জন্য উত্তম সিধান্ত। সুযোগ দেওয়া মানে আত্মসম্মানের সাথে আপোষ করা নয় বরং সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে সামনের জনকে নিজের ভুল শুধরে নিতে বাধ্য করা। আমি শুধু পসিবিলিটি বললাম বাকিটা আপনার সিধান্ত। ”

মানুষ কতটা বুদ্ধিমান হলে এতটা চমৎকার ভাবে সবকিছু বিশ্লেষণ করতে পারে সেটা জানা নেই প্রিমার শুধু এতটুকু অনুধাবন করলো আরশিয়ান ভীষণ লাকি। এরকম বন্ধু কপাল গুণে পাওয়া যায়। ইশতিরাজ দিকে তাকিয়ে প্রিমা সল্প স্বরে বলল,

–” আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করবোনা কেবল মোনাজাতে বসে খাস দিলে দোয়া করবো উপরওয়ালা যেনো আপনার সমস্ত নেক ইচ্ছা পূরণ করে। মস্তিষ্ক চলমান জটিলতা গুলোর পাকাপোক্ত সমাধান হয়েছে এবং আমি আমার সিধান্ত নিয়ে ফেলেছি। ”

বহুদিন পর প্রিমার মুখে সেই পুরনো আত্মবিশ্বাসের দেখা মিলেছে। একদিক দিয়ে ইশতিরাজ খুশি হলো কিন্তু পরক্ষণে উশখুশ করে শুধাল,

–” আমি কী জানতে পারি ? ”

প্রিমা স্মিত হেসে বলল,

–” আপনার প্রাণপ্রিয় বন্ধু এতদিন দায়িত্ব পালন করেছে বউ হিসেবে আমারও কিছু দায়িত্ব আছে তো নাকি? বুড়ো বয়সে আর কয়টা বিয়ে করবে? বিয়ের লাড্ডু যখন খেয়েছি তখন হজম তো করতেই হবে।তবে এবার আপনার বন্ধুকেও বোঝাবো বউকে ভালোবাসিনা বলার সাইড ইফেক্ট। ”

ডিপ্রেশন ইজ নট অ্যা জোক বিষয়টা আবারও প্রমাণিত হলো। একটু আগেই প্রিমার অবস্থা ছিলো ডু অর ডাই। নির্জীব একটা মানুষ ঘন্টাখানেক কথা বলার মধ্যেই কেমন চনমনে হয়ে উঠেছে সেটা দেখে পুনরায় স্মিত হাসি ফুটে উঠল ইশতিরাজের মুখে। ইশতিরাজ দুষ্টু কন্ঠে বলল,

–” বেশি জ্বালালে কিন্তু আমি বন্ধুকে নিয়ে ট্যুরে উড়াল দিবো। ”

প্রিমা মুখ ভেঙিয়ে বলল,

–” হাত দুইটা কিন্তু আসছে তিনটা ছানা। দু’জনকে গছিয়ে দিয়ে আমি ঘুমের দেশে লং ট্যুর দিবো।”

ইশতিরাজ শব্দ করে হেসে ফেললো। আচমকা তার ফোনটা বেজে উঠলো। গুরুত্বপূর্ণ কল দেখে রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে কিছু একটা শুনতেই রাজ রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলো। হাত থেকে ছিটকে ফোনটা পড়ে সাথে সাথে ডিসপ্লে ব্ল্যাক হয়ে গেলো। হতভম্ব মুখে প্রিমার দিকে চেয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

–” শী ইজ নো মোর.. স্পট ডেথ! ”

চলবে?