শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-২৮

0
17

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৮
#প্রথমাংশ

গাড়ির ভেতর পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। ড্রাইভিং সীটে থম মেরে বসে আছে ইশতিরাজ এবং তার পাশের সীটে লজ্জারুণ মুখে মাথা নত করে বসে আছে ফারজানা। ইশতিরাজ একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে আবার এদিক-ওদিক চোখ ফোরাচ্ছে। তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে সীমাহীন আনন্দ। দু’জনেই নিশ্চুপ অথচ তাদের অভিব্যক্তি হাজারো অব্যক্ত কথার বিবৃতি জানান দিচ্ছে।

কন্সার্টের লাস্ট মোমেন্টে ইশতিরাজ এতবড় গিফট পেয়ে যাবে সেটা কল্পনাতীত ছিলো। প্রথমদিকে রাজ বুঝেনি ফারজানার বলা কথাগুলো। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে তাকে পুনরায় শুধালে ফারজানা যখন ধীর স্বরে একই কথা বলে তখন একমুহূর্তের জন্য ইশতিরাজ এর শ্বাস আঁটকে আসে। হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ তরতরিয়ে বাড়ে। জোরালো কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

–” এক্ষুনি.. এমুহূর্তে এই শওকাতুল ইশতিরাজ চৌধুরী নিজ অস্তিত্বের বৈধ মালিকানা আপনার কাছে হস্তান্তর করবে ম্যাডাম। ”

ইশতিরাজের বলিষ্ঠ বুকের মধ্যিখানে লেপ্টে থাকা ফারজানা প্রত্যুত্তর করেনি। আশেপাশের সবাই আনন্দে উল্লাসে হৈ-হুল্লোড় করে উঠে। কন্সার্টের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। এদিকে স্টেজে দাঁড়ানো ইশতিরাজের টিমমেটরা বুদ্ধি করে মুহূর্তটাকে বিশেষ করার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ডে
চমৎকার একটা গান চালায়।

পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে আলোড়ন তৈরি করে সেই গানের পঙক্তি,

–” আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে,
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে!
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে,
ভরে মন অন্তহীন রঙিন এক উৎসবে!

ফারজানা হুঁশে ছিলোনা। আবেগপ্রবণ হয়ে কী থেকে কী করে ফেলেছে টেরই পায়নি। ইশতিরাজও সময় নষ্ট করেনি। ফারজানাকে বাহুবন্ধনে রাখা অবস্থায় কোনোমতে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। তাদের পিছুপিছু তাজরিয়ান এবং মেহরিমাও আসে।

অতীতের স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে রাজ ফারজানার দিকে তাকায়। মেয়েটা একদম নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে জিভ দ্বরা ঠোঁট ভিজিয়ে অতঃপর কাঁপা কন্ঠে ইশতিরাজ শুধায়,

–” ও..ওটা সত্যি ছিলো? ”

ফারজানার গাল আরক্ত হয়ে উঠে। ধীর কন্ঠে বলে,

–” হুঁ। ”

ইশতিরাজ ঠোঁট কামড়ে হাসে। বেচারা কেনো জানি বিষয়টা হজম করতে পারছে না।আকস্মিক পাওয়া অপ্রত্যাশিত সুখে তার পাগল হওয়ার উপক্রম। বাঁধ ভাঙা খুশিতে আত্মহারা হলে মানুষ বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। ইশতিরাজেরও একই দশা। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে ইশতিরাজ সরব কন্ঠে শুধাল,

–” আকস্মিক এই সিধান্ত নেওয়ার কারণ? ”

ফারজানা একটু থেমে ধীর কন্ঠে বলল,

–” লাইফটা ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল। কখন কী হয়ে যায় জানা নেই। জীবনের অনেকগুলো বছর ভ্রমে কাটিয়েছি এবার একটু সুখী হতে চাই।বহু অপেক্ষার পর জীবন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে।অবজ্ঞায় হারাতে চাইনা সেটা। ”

ইশতিরাজ শুনলো মনোযোগ দিয়ে। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে ফারজানার দিকে তাকিয়ে ভয় মিশ্রিত স্বরে বলল,

–” হোয়াট ইফ..

ফারজানা মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–” খাঁটি বাংলায় কথা বলুন। আপনার ব্রিটিশ একসেন্টের খেজুরে আলাপ বুঝতে আমার এই জনম পেরিয়ে যাবে। ”

ইশতিরাজ হাসলো। বড্ড প্রাণবন্ত সেই হাসি। জানা নির্নিমেষ চেয়ে দেখলো তার সুশ্রী মুখাবয়ব। রাজ জানার অনিমেষ দৃষ্টি দেখে হাসি বন্ধ করে নিজেও তার চোখে চোখ রাখলো। মেয়েটা তার অস্থিরতা কমাতে এই বাড়তি কথাটুকু বলেছে সেটা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। তার পাষাণী যত্নের ভাষা শিখছে তবে। ইশতিরাজ গলা ঝেড়ে স্পষ্ট গলায় বলল,

–” আমার জন্য কোনোপ্রকারের কোনো অনুভূতি জন্মেছে আপনার মনিকোঠায়? নাকি স্রেফ আমার অনুরোধে এই সম্পর্কটাকে সুযোগ দিতে চাইছেন? ”

ফারজানার মনটা ভার হলো। কীয়ৎকাল অপেক্ষা করে অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে ধীর গলায় বলল,

–” সত্যি বলতে আমি আপনাকে ভালোবাসিনা তবে ভীষণ শ্রদ্ধা করি এবং আপনার জন্য আমার মনে অগাধ সম্মান রয়েছে। আর…

ইশতিরাজ মোহাচ্ছন্ন স্বরে শুধাল,

–” আর? ”

ফারজানা চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল,

–” আপনার নামে আমার মনের মনিকোঠায় কিছু শিরোনামহীন অনুভূতি জন্মেছে। সেসবের স্পষ্ট উপনাম আমার জানা নেই তাই সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিতে পারলাম না। ”

ব্যস এতটুকু স্বীকারোক্তি যথেষ্ট ছিলো ইশতিরাজের হৃদয় বিগলিত করার জন্য। দুর্গম পথের গন্তব্য খুব নিকটে সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না। ফারজানার দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে ইশতিরাজ বলল,

–” ভালোবাসার দায়িত্বটা আমার জিম্মায় ছেড়ে দেন। আপনি শুধু এই অগোছালো আমিটার দায়িত্ব নেন। বাকি সবকিছু আমি সামলে নিবো স্রেফ এই বেখেয়ালি মানুষটার সমগ্র সত্তা আপনি নিজ দায়িত্বে সামলে নিয়েন। ”

ফারজানা আড়ষ্ট হলো। দুরুদুরু বুকে ভয়মিশ্রিত চাহুনি নিক্ষেপ করে ধীর গলায় শুধাল,

–” আমি চেষ্টা করবো তবে.. যদি কোনো ভুল হয়ে যায়? ”

ইশতিরাজ তার চোখের দিকে তাকিয়ে নিরেট গলায় বলল,

–” আপনার জন্য সাত খুনও মাফ মিস জানা। তাছাড়াও আপাদমস্তক আপনি পুরোটাই আমার সুতরাং আপনার ভুল মানে আমিই আসামি। মানুষ কখনো নিজেকে শাস্তি দিতে পারে?”

ফারজানা হতভম্ব চোখে তাকায়। ইশতিরাজের মুখাবয়ব বড্ড স্বাভাবিক। জানা চোখ ফিরিয়ে নেয়। ভালোলাগায় সিক্ত হয় হৃদয়। প্রত্যুত্তর করার মতো কোনো ভাষা নেই বলে নিরুত্তর রয়। তাকে চুপ থাকতে দেখে ইশতিরাজ কাতর কন্ঠে শুধায়,

–” আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি? ”

ফারজানা একটু অবাক হয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

–” হুঁ। ”

ইশতিরাজ ভীষণ যত্নসহকারে তার হাতটা বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে চোখবুঁজে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেললো। এই অবিশ্বাস্য বাস্তবতা তার নিকট নিছকই সপ্ন মনে হচ্ছে। ফারজানা অনুভব করে ইশতিরাজের হার্টবিট দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সে হকচকিয়ে উঠে বলে,

–” আপনার হার্টবিট অস্….

ইশতিরাজ অস্থির কন্ঠে বলল,

–” আপনাকে পাওয়ার খুশিতে বোধহয় আমি মরেই যাবো মিস জানা। সপ্ন পূরণের সুখানুভূতি এতটা সুখদায়ক কেনো? ”

ফারজানা প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। ইশতিরাজ পাগলামি করছে রীতিমতো। তার মতো কলঙ্কিত নারী কারও সপ্নের রমণী হতে পারে কস্মিনকালেও সেটা ভাবেনি ফারজানা। তারও হৃদয়ে তোলপাড় চলছে তবে পাগলাটে পুরুষের পাগলামির কাছে সেটা তুচ্ছ। ফারজানা সামান্য থেমে বলল,

–” বাসায় যাবেন না? ”

ইশতিরাজ তড়াক করে চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,

–” আগে কাজি অফিসে যাবো এরপর বিয়ে করবো তারপর বাসায় যাবো । ”

ফারজানা হকচকিয়ে উঠে বলে,

–” আমি.. আমি আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ফেলেছিলাম। আপনি সিরিয়াসলি নিয়ে নিচ্ছেন। ”

ইশতিরাজ ফারজানার চোখে চোখ রেখে কন্ঠে আকুতি মিশিয়ে বলল,

–” এই প্রশস্ত বুকে আপনাকে আগলে প্রশান্তির একটা ঘুম দিতে চাই। সারাটাক্ষন চোখের সামনে আপনার জীবন্ত প্রতিকৃতির প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই। আমার অপেক্ষার প্রহরটা আর প্রলম্বিত করবেন না প্লিজ। ”

ফারজানার হৃদয়ে তীব্র অনুভূতির আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বেচারি সামান্য ইতস্তত করে বলে,

–” এভাবে হুট করে কাউকে না জানিয়ে..

ইশতিরাজ তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়,

–” গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে এখান থেকে কাজি অফিস প্রায় ঘন্টাখানেকের দূরত্বে। আরশিয়ানদের আসতে হাইয়েস্ট ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে। আমরা পৌঁছানোর আগেই তারা পৌঁছে যাবে ফর শিওর। আমার খুব কাছের কিছু বন্ধুবান্ধবও আসবে। আর কাউকে লাগবে? আপনি বললে আমার সমস্ত ফ্যানদের ও ডেকে নিবো তবে ওদের কাজি অফিসের বাহিরেই অবস্থান করতে হবে। ছোট্ট রুমে ক’জনের বেশি আঁটবে না৷ ”

কথাগুলো কৌতুকপূর্ণ শোনালেও ইশতিরাজের কন্ঠে ছিলো উদ্বেগ। ফারজানা বুঝতে পারে এই পাগল লোকটা তাকে আশ্বস্ত করার জন্য যা-কিছু করতে পারে। খুশিতে তার চোখ ভরে উঠে। কথায় আছে নারী রূপবতী না হলেও সমস্যা নেই তবে সৌভাগ্যবতী না হলে ইহকাল জাহান্নামে পরিণত হয়। ফারজানা নরকতুল্য দিনগুলো পার করে এসেছে আজ সৌভাগ্যের সুফলও অনুভব করছে।ইশতিরাজকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারজানা দু’হাতে চোখ মুছে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” আমি আপনাকে বিয়ে করবো তবে আমার একটা শর্ত আছে। ”

ইশতিরাজের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,

–” কিসের শর্ত? ”

ফারজানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” গান ছাড়ার কথাটা জাস্ট আপনার পিছু ছোঁড়ানোর জন্য বলেছিলাম। আমি জানতাম না গান আপনার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সিঙ্গিং প্রফেশন নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই কারণ আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। কাইন্ডলি আপনি আবার ফিরে আসুন। ”

ফারজানার কন্ঠে অপরাধ বোধের ছাপ সুস্পষ্ট। ইশতিরাজ খুব ভালোমতো টের পেয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে সে বলে উঠল,

–” আপনি প্রফেশন ছাড়তে বলেছিলেন সিঙ্গিং নয়।আপনি যদি সরাসরি গানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন তাহলে হয়তো আমি এত সহজে সিধান্তে উপনীত হতে পারতাম না। একটা সময় আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিলো সঙ্গীত সুতরাং সুখের সময় ওটাকে ত্যাগ করা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে যেতো। প্রফেশনটা আমার কাছে খুব একটা ম্যাটার করেনা। মূল কথা হলো আমি কখনো এই প্রফেশনে আসতেই চাইনি। শানের জোরাজোরি আর নিজের শখ থেকে এসেছিলাম এ-ই আরকি। ”

সামান্য থেমে আবারও ইশতিরাজ বলে উঠল,

–” আমি অলরেডি মাইন্ডসেট বানিয়ে ফেলেছি উপরন্তু সব ঘোষণা দেওয়া শেষ। এখন যদি আমি পুনরায় ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাক করি তাহলে আমার ব্যক্তিগত জীবন সমালোচনায় আসবে যেটা আমি চাইনা। গান আমি ছেড়ে দিবো ব্যপারটা এমন না। আপনি যখন বলছেন তখন টুকটাক রেকর্ডিং করে আমার পেজেও পোস্ট করবো। চলবে? ”

ফারজানা বুঝলো ইশতিরাজের কথাগুলো। কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করলো,

–” আপনি হ্যাপি থাকতে পারবেন তো? পরে আফসোস করবেন না তো? ”

ইশতিরাজ স্মিত হেসে ফোনে কিছু একটা টাইপ করতে করতে বলল,

–” আপনি যখন বৈধ অধিকারের তকমা পেয়ে আমার বুকের বাঁ পাশে অবস্থান করবেন তখন না-হয় আপনি নিজেই পরিমাপ করে নিয়েন আমার সুখের সীমানা।আফসোস শব্দটা আমার জীবনবৃত্তান্তে এক্সিস্ট করেনা আর কখনো সংযুক্ত ও হবে না। ডোন্ট ওয়ারি। ”

ফারজানা শিউরে উঠে রীতিমতো। শব্দগুলোর মানে কতটা গভীর সেটা আদৌ জানে ইশতিরাজ? তার বুক কাঁপছে। এত সুখ কপালে সইবে তো? মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠলো অযাচিত চিন্তায়৷ ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে দেখলে ভয় পায় সেটা আজ অব্দি কাউকে বোঝাতে পারেনি ফারজানা।

_

কাজি অফিসের সামনে এসে থামলো আরশিয়ানের গাড়িটা। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে আরশিয়ান বেরিয়ে এসে প্রিমাকে বের হতে সাহায্য করে।বেচারি ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। আরশিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে আগলে ধরে কাজি অফিসের দিকে হাঁটা দেয়।

সন্ধ্যার দিকে আচমকা দু’বার বমি হয় প্রিমার। প্রেগ্ন্যাসির খুবই স্বাভাবিক সিম্পটম এইটা তবে বমির পরপরই ভীষণ রকমের মাথাব্যথা শুরু হয় বেচারির। আরশিয়ান ডক্টরকে কল করে জানালে ডক্টর বলেন কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে। সমস্যা বাড়লে হসপিটালে নিয়ে আসার পরামর্শও দেন তিনি।

আরশিয়ান বুদ্ধি করে ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি এপ্লাই করে অতঃপর প্রিমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে। আলতো হাতে প্রিমার মাথায় ম্যাসাজ করে দিলে মেয়েটা একটু স্বস্তি পায় তবে ব্যথার তীব্রতা তাকে ঘুমাতে দেয় না। কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর শানের বুকে মুখ লুকিয়ে কতক্ষণ কাঁদে বেচারি। এরকম অসহ্য যন্ত্রণা তার কখনোই অনুভূত হয়নি।

সময় পেরোনোর সাথে ব্যথা কমে আসলেও শরীরটা একদম নেতিয়ে পড়ে। সবে একটু ঘুমিয়েছিল প্রিমা। আকস্মিক আরশিয়ানের কথায় তার ঘুমের ঘোর ভাঙে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে রীতিমতো হা করে তাকিয়ে ছিলো আরশিয়ান। প্রিমা অবাক কন্ঠে শুধায়,

–” আপনার এক্স ওয়াইফ কবর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে নাকি? এমন ফাটা চোখে ফোনের দিকে তকিয়ে আছেন কেনো? ফোনের ব্যাটারি ডেড হয়ে যাবে আপনার অদ্ভুতুড়ে দৃষ্টি দেখে৷ ”

আরশিয়ান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলে,

–” নীহা কবর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করে থাকলেও আপনার তীক্ষ্ণ কথা শোনার ভয়ে সেইটা ক্যান্সেল করে দিবে ফর শিওর। একেকটা কথা একেবারে কলিজা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়।আম্মুরেও বলিহারি তিনবেলা জ্ঞানের সাথে সামান্য মধু খাওয়ালে কী এমন হয়? ”

লাস্টের কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বলেছিল আরশিয়ান তবে প্রিমা ঠিকই শুনতে পায় সেসব। তার মনটা একটু খারাপ হয় তবে পরক্ষণে আবার জিজ্ঞেস করে,

–” ওমন স্থবির দৃষ্টিতে কী দেখছিলেন আপনি। ”

আরশিয়ান হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,

–” আপনার বোন আর আমাার মানুষ কাম ছাগল দোস্ত বিয়ে করতে যাচ্ছে। দে আর অন দ্যা ওয়ে টু কাজি অফিস। আমাদেরকে ও ইনভাইট করেছে। ”

প্রিমা স্তব্ধ কন্ঠে বলে,

–” কীহ্! ”

দুজনেই মোটামুটি ভালোই শকড হয়েছিল। শান প্রিমাকে চিন্তিত কন্ঠে শুধায়,

–” এই অবস্থায় আদৌ আপনি যেতে পারবেন ?”

প্রিমা ধীরেসুস্থে বলে,

–” আপনি হেল্প করলে পসিবল হবে তবে বুবুর এরকম একটা বিশেষ দিনে উপস্থিত থাকতে না পারলে আফসোস থেকে যাবে। মানুষ দুটো ভীষণ স্পেশাল আমার কাছে। উনাদের কেমিস্ট্রি নিয়ে আগেই সন্দেহ হয়েছিল তবে এটা সত্যি সংঘটিত হবে সেটা বুঝিনি। ”

আরশিয়ান আর কথা বাড়ায়নি। বউ সমেত সোজা হাজির হয়েছে বন্ধুর পাগলামিতে সায় জানাতে। ভেতরে ঢুকতেই তারা দেখে কাজির সামনের চেয়ারে বর এবং বঁধু বসে আছে। আশেপাশে চোখ বুলাতেই কয়টা পরিচিত মুখের দেখা মিলে।রাজ মূলত তার ক্লোজ ফ্রেন্ডসদের ইনভাইট করেছে। এক পাশে তাজরিয়ান এবং মেহরিমাকেও দেখা গেলো।

প্রিমা এবং আরশিয়ান এন্ট্রি নিতেই ইশতিরাজ বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে। মেহরিমা এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনিময় করে। প্রিমাররা কাছাকাছি আসলে ইশতিরাজ চিন্তিত কন্ঠে শুধায়,

–” পিচ্চির কী হয়েছে দোস্ত। এই অবস্থা কেনো ওর?

আরশিয়ান সবটা খুলে বললে ইশতিরাজের বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ফারজানার দিকে তাকাতেই দেখে মেয়েটা অশ্রুপূর্ণ চোখে প্রিমার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশতিরাজ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

–” সুস্থতা এবং অসুস্থতা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। মন খারাপের কিছু নেই সবটা আবার ঠিক হয়ে যাবে। ”

ইশতিরাজের কথায় ফারজানা নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রিমা এগিয়ে এসে ফারজানার পাশে বসে। প্রিমার দিকে নিবিড় মনোযোগ থাকায় আরশিয়ানের হাতে থাকা কালো রাঙা ব্যাগটা রাজ লক্ষ্য করেনি। আরশিয়ানকে সেটা টেবিলের উপর রাখতে দেখে ইশতিরাজ কৌতূহলী কন্ঠে বলে,

–” শাদি মোবারক লাড্ডু এনেছিস নাকি দোস্ত? ”

আরশিয়ান উত্তর দেয় হা। ব্যাগ থেকে সিঁদুর রাঙা একটা দোপাট্টা বের করে একটা কোণা প্রিমার হাতে দিয়ে আরেক কোণা নিজে ধরে ফারজানার মাথার উপর দেয়। দৃশ্যটা দেখে ইশতিরাজের চোখ চকচক করে উঠে। আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দেয়। আরশিয়ান বিনিময়ে স্মিত হাসে।

ফারজানা অবাক চোখে আরশিয়ানের দিকে তাকালে শান তার মাথায় হাত রেখে কন্ঠে নমনীয়তা মিশিয়ে বলে,

–” সম্পর্কে আপনি আমার বড় হলেও বয়সে আমি আপনার ঢের বড়। আমি অলওয়েজ আপনাকে ছোটো বোন হিসেবে দেখে এসেছি। আজকে এই বিশেষ মুহূর্তে একজন বড় ভাই হিসেবে বলছি, যদি কখনো আপনার মনে হয় শান্তির জন্য জড়ানো সম্পর্কটা আপনার কাছে সাফোকেশনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু একটাবার আমাকে জানাবেন বাকিটা আপনার ভাই দেখে নিবে। কখনোই নিজেকে এতিম ভাববেন না। এই পৃথিবীতে রক্তের চেয়েও বড় সম্পর্ক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় আত্মিক সম্পর্ককে। আশাকরি আমি আপনাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। “।

আরশিয়ানের কথায় ইশতিরাজ ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলে,

–” ব্যাটা হতচ্ছাড়া। বিয়ের হওয়ার আগেই সেটা ভাঙার ট্রিপস এন্ড ট্রিকস শেখাচ্ছে। আনরোমান্টিক বেডারেও বলিহারি.. ঠেসে ধরে দু’চারটা আদুরে চুমু দিলে সাফোকেশন তো হবেই তাই বলে জানা ওকে ছেড়ে টইটই করে ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠবে? ”

ফারজানা কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। আরশিয়ান সেটা দেখে মৃদু হেসে বলে,

–” এই দোপাট্টাটা বহু বছরের পুরোনো। এইটা মূলত রাজের আম্মুর। আপনার হবু হাসবেন্ডের শখ ছিলো….. তার বউ এই সিঁদুর রাঙা ঘোমটা পরে তার জন্য তিন কবুল বলবে। আপনাকে পাওয়ার ধান্দায় সব ভুলে বসবে জানতাম তাই আসার সময় চিরুনী অভিযান চালিয়ে অতঃপর খুঁজে এনেছি। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। ”

ফারজানা আবেগাপ্লুত হয়ে মাথা নাড়িয়ে সল্প স্বরে ধন্যবাদ জানায়। ইশতিরাজের অপেক্ষার প্রহর শেষ করে কাজি উপস্থিত হোন। ইশতিরাজের ক’জন ফ্রেন্ড উনাকে আনতে গিয়েছিল। কাজিকে আসতে দেখে ফারজানার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে। তার হাতের তালু ঘামতে থাকে। শ্বাস আঁটকে আসে। ইশতিরাজ সবটা দেখে নিশ্চুপ থাকে। কথায় আর কোনো সান্ত্বনা দিতে চাইনা সে। এমুহূর্তে সান্ত্বনা দেওয়া উচিতও নয়। কিছু অনুভূতি অনুভব করতে দেওয়া উচিত।

কাজি এসে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে ফারজানাকে কবুল বলার জন্য বলা হলো। মেয়েটা আতঙ্কিত হয়ে ফুঁপিয়ে উঠে। এপর্যায়ে ইশতিরাজ নিজেও ঘাবড়ে যায়। আরশিয়ান তাদের পেছনেই ছিলো। দুটোর অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে এগিয়ে এসে পুনরায় ফারজানার মাথায় হাত রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলে,

–” বড় ভাইয়াকে বিশ্বাস করে থাকলে নিঃসন্দেহে কবুল বলে ফেলুন। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এই বাঁদরটা আপনাকে ভালো রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। ”

ফারজানা আরেকটু সময় নিয়ে কবুল বললো। রাজ একটা লম্বা স্বস্তির শ্বাস টেনে সীমাহীন আনন্দ বুকে চেপে রেখে নিজেও কবুল বলে। ব্যস ,দু’টো মানুষ মুহূর্তের মাঝে আবদ্ধ হয়ে যায় একটা পবিত্র সম্পর্কে। পৃথিবীর সমস্ত অপূর্ণতার গল্পকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পরিশেষে তাদের গল্প পূর্ণতা পেলো।

চলবে?

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৮
#শেষাংশ

পূর্ণতা অপার সুখানুভূতি বয়ে আনে। নিজের প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে পেয়ে যাওয়ার অনুভূতি কতটা সুন্দর সেটা কেবল একজন অপেক্ষমাণ মানুষই বোঝে। পরিশেষে ইশতিরাজের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে তিন কবুলের স্বীকারোক্তি জপে জানা নামক সুখ পাখি তার বক্ষপিঞ্জরায় আবদ্ধ হলো।

প্রিয় মানুষকে পেয়ে যাওয়ার সীমাহীন আনন্দে ইশতিরাজ স্তব্ধ হয়ে যায় রীতিমতো। কবুল বলার পর রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় তার হাত কেঁপে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। মস্তিষ্ক ঘোষিত প্রাপ্তির আনন্দে বুকের ভেতর অনুভূতির আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাইন করার পর অতিশয় আনন্দে চকচক করতে থাকা চোখদুটো মেঝেতে নিবদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে কেবল।

ইশতিরাজের অনুভূতির তীব্রতা টের পেতেই শানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। পাশে দাঁড়ানো প্রিমা কে আরেকটু নিবিড়ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

–” একসাথে ভীষণ সুন্দর লাগছে না ওদের? ”

কালিমালিপ্ত চোখদুটো তাদের দিকে নিক্ষেপ করে প্রিমা ক্লান্ত স্বরে বলে,

–” পূর্ণতার চিত্রায়ন একটু বেশিই সুন্দর লাগে দেখতে। ”

আরশিয়ান পুনরায় হাসে। বহুদিন পর প্রাণোচ্ছল হাসি দেখতে পাওয়া যায় তার মুখে। প্রিমা এক ঝলক দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,

–” মা শা আল্লাহ। নজর না লাগুক। ”

আরশিয়ান শুনলো না সেসব। তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা তাজরিয়ান এবং মেহরিমাও হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে সদ্য বিবাহিত দম্পতির দিকে। বাকিরা হাসাহাসি করছে, দুষ্টু কথাবার্তা বলছে.. হাসিঠাট্টার স্বরে ছোট্ট ঘরটা গমগম করছে।

আমেজ পূর্ণ পরিবেশে খুশির মাত্রা বাড়াতে দুষ্টু মেহরিমা হাতে ছোট্ট একটা পান্ডা ছাপানো আয়না হাতে এগিয়ে এসে নব দম্পতির সামনে ধরে বলল,

–” রাজ ভাই.. কাকে দেখতে পাচ্ছেন বলুন তো। ”

আয়নাটা বড্ড ছোটো। দু’জনের সম্পূর্ণ মুখশ্রী দৃশ্যমান হয়নি তবে চোখাচোখি হয় অনায়াসে। রাজ মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সংক্ষিপ্ত স্বরে বলে,

–” আমার সুরঞ্জনাকে দেখতে পাচ্ছি। ”

ইশতিরাজের সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে ফারজানার চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠে। ইশতিরাজ স্থির দৃষ্টিতে দেখে সেই দৃশ্যটুকু। ইশতিরাজের কথায় পুরো ঘরটায় উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ওঠার প্রবল শব্দ শোনা যায়। মেহরিমা নিজেও মুখে হাত রেখে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো অতঃপর ফারজানা কে শুধাল,

–” আপাই.. আপনি কাকে দেখতে পাচ্ছেন বলুন তো। ”

ফারজানা প্রশ্নটা শুনে আয়নার দিকে তাকায়। রাজ তখনও তার দিকের অনিমেষনেত্রে চেয়ে আছে।জানা চোখ সরায় না বরং রাজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলে,

–” আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটাকে। ”

আরেকদফা উল্লাসিত প্রতিধ্বনি শোনা যায়। রাজ খানিকটা অবাক হয়। এত সহজ স্বীকারোক্তি সে আশা করেনি। ভালোলাগায় সিক্ত হয় অন্তস্তল। ওদের স্বাভাবিক হতে দেখে আরশিয়ান ফাজলামি করে বলে,

–” কিরে ব্যাটা! আমরা নতুন বউয়ের মুখ দর্শন করবো না নাকি? তোর ঘোমটা তোলার অপেক্ষায় বুড়ো হতে হবে মনে হচ্ছে । ”

হাসির রোল পড়ে গেলো ঘরটায়। ইশতিরাজের বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করলো। ফারজানার মুখোমুখি হলে আদৌ নিজেকে সামলাতে পারবে কি-না সেটা নিয়ে বড্ড বেশি দ্বিধায় আছে বেচারা।ওইদিকে সবার কথা শুনে ফারজানা লজ্জায় গুটিয়ে যায়। দু’জনের নির্বিকার প্রতিক্রিয়া দেখে বাকিরা রীতিমতো জোরাজোরি শুরু করে। বাধ্য হয়ে রাজ এগিয়ে এসে ফারজানার সামনে দাঁড়ায়। ফারজানা তখনও বসে আছে। বেচারির কম্পন টের পেয়ে ইশতিরাজ তার হাতদুটো ধরে তাকে দাঁড় করায়।

ফারজানা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশতিরাজ খানিকক্ষণ অপলকভাবে চেয়ে থাকে আস্তেধীরে ফারজানার দোপাট্টার কার্ণিশে হাত রাখে। বিষয়টা টের পেতেই ফারজানা সিঁদুর রাঙা নেটের দোপাট্টার ভেতর থেকেই চকিতে চোখ রাখে ইশতিরাজের মোহনীয় দৃষ্টিতে। ব্যস, ইশতিরাজ হারিয়ে ফেলে তার ধৈর্য। আলতো করে ঘোমটা তুলে জানার মুখটা নির্মোচন করে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় অতঃপর হাতের আঁজলায় ফারজানার দীপ্তিময় মুখটা আগলে নিয়ে কপালে আলতো চুম্বন এঁকে দেয়। বেসামাল রাজ কারও তোয়াক্কা না করে একের পর এক স্পর্শ এঁকে দেয় ফারজানার ছোট্ট মুখশ্রীর সর্বত্রে। বাকিরা হতভম্ব চোখে চেয়ে হেসে ফেলে। প্রিমা দৃশ্যটা দেখে মুখ লুকায় আরশিয়ানের বাহুতে। তাজরিয়ান বেচারা বউয়ের চোখে হাত রেখে ধমকে বলে উঠে,

–” বড় ভাইয়ের পাগলামি দেখতে নেই বউজান। আমি চাই না তুই অল্প বয়সে পেকে যা। ”

মেহরিমা শেষের কথাটা শুনে রেগেমেগে তাজের পায়ে পাড়া দেয়। তাজরিয়ান ব্যথাতুর শব্দ করে মেহরিমার চোখ ছেড়ে দিতেই বেচারি কটমটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসয়ে বলে উঠে,

–” আমার যে অল্প বয়স সেটা সারাদিন মনে থাকলেও রাতে কেনো মনে থাকে না আপনার? একদম আমার কাছে আসবেন না তাজ ভাই নয়তো আপনার কর্মকান্ড দেখে আমি অকালপক্ব হয়ে যাবো। ”

তাজরিয়ান ফুঁসে উঠে খ্যাপাটে দৃষ্টিতে তাকায়। যেনো বলতে চাইছে,

–” একবার হাতের কাছে পাই। অকালপক্বের শ্রেণিবিভাগ প্র্যাক্টিক্যালি বুঝিয়ে দিবো। ”

মেহরিমা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ইশতিরাজদের দিকে তাকায়। বেচারা বউকে জড়িয়ে ধরে নৈঃশব্দে কাঁদছে। ফারজানার চোখেও ভীড় করেছে অশ্রুরা৷ আবেগঘন মুহূর্তটা কিছুক্ষণ পরই কেটে যায়। রাত হয়েছে অনেক। সকলেই ক্লান্ত মোটামুটি। প্রিমা তো শরীরের সবটুকু ভার শানের উপর ছেড়ে দিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে।

আকস্মিক সিধান্তটা সুন্দর একটা পরিণতির মাধ্যমে সমাপ্ত হলো। অন্তিম মুহূর্তে সকলে শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজ গন্তব্যের দিকে। তাজ এবং মেহু বেরিয়ে পড়লো চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্য। রাজ এবং জানা গেলো একসাথে। শান এবং প্রিমাও বেরোলো তাদের পরপরই।

_

নিস্তব্ধ রজনী। মধ্যরাত হওয়ায় রাস্তা বেশ ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দু’একটা দূরপাল্লার যানবাহনের দেখা মিলছে। বাকিরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলেও আরশিয়ানের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে শ্লথ গতিতে। রাস্তাটা ভীষণ সুন্দর। আরশিয়ান লক্ষ্য করেছে প্রিমা বেশ মনোযোগ দিয়ে আশপাশটা দেখছে। এত রাতে গাড়ি থামিয়ে জায়গাটা এক্সপ্লোর করা পসিবল নয় বিধায় আরশিয়ান যথাসম্ভব ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে।

অসুস্থতার ধকলে বেচারি একদম নেতিয়ে পড়েছে। মুখটা বড্ড শুকনো দেখাচ্ছে। আরশিয়ান ভাবলো কালকেই একবার ডক্টরের কাছে যাবে। একসপ্তাহ পরে নরমাল চেকআপের ডেট হলেও আরশিয়ান ভরসা পাচ্ছে না। অদ্ভুত এক ভয়ে বুক মুচড়ে উঠছে বারংবার। আরেকবার প্রিমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আরশিয়ান ড্রাইভিং-এ মনোনিবেশ করলো।

বাহিরের দিকে মনোযোগী হওয়ার ভান ধরলেও প্রিমা মূলত চোরা দৃষ্টিতে আরশিয়ানের সুর্দশন চেহারাটা অবলোকন করছিল। লোকটা দিনদিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। আজকে খুশির ঠেলায় একটু বেশি গ্লো করছে বোধহয়। মনে মনে শ’খানেক বকা দিলো জিম ট্রেইনারকে। এমনিতেই সুঠাম দেহের অধিকারী আরশিয়ান। রেগুলার জিম করার ফলে দিনকে দিন আরও বলিষ্ঠ হয়ে উঠছে তার বাহ্যিক অবয়ব। রাস্তায় বের হলে আরশিয়ানের দিকে ঘুরেফিরে তাকায় মেয়েরা। তার পাশে প্রিমাকে দেখলে আবার চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। সাংঘাতিক রাগ হয় প্রিমার কিন্তু মুখ ফুটে বলার মতো কিছুই পায় না। এই শ্যামবর্ণের অসম্ভব সুদর্শন মানুষটা রীতিমতো তার অশান্তির কারণ হয়ে যাচ্ছে অথচ বেডা নির্বিকার।

প্রিমার ধ্যান ভাঙে চোখের উপর তীব্র আলোর ঝলকানি পড়ায়। নিভু নিভু দৃষ্টিতে দেখে একটা ট্রাক তীব্র বেগে ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। প্রিমার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে। আর্তনাদ করার সময়টুকু পায় না বেচারি আচমকা গাড়ি টার্ন নেওয়ায় হেলে পড়ে ডান পাশে। অনুভব করে একটা বলিষ্ঠ শরীর আগলে নিয়েছে তাকে যেনো আসন্নবর্তী বিপদ ছুঁতে না পারে তার অস্তিত্ব। পরক্ষণে বিকট শব্দে কেঁপে উঠে আশপাশ। কিছু বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়ে যায় সবটা।

খানিকক্ষণ পর আতঙ্কিত চোখ মেলে আশেপাশে তাকায় প্রিমা। মস্তিষ্ক কাজ করছিল না একদমই। চোখ বুঁজে শুকনো ঢোক গিলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ভারিক্কি শরীরটা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। বুকটা ভয়ে মুচড়ে উঠছে তার। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ শুনতে পেলো এক উৎকন্ঠিত স্বর,

–” প্রেম? এ্যাঁই প্রেম… ঠিকাছেন আপনি? ”

আরশিয়ানের অশান্ত স্বর প্রিমাকে স্বস্তি দিলো। বড্ড বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মৃত্যু সন্নিকটে দেখলে মানুষ নির্বিকার থাকবেই বা কীভাবে। প্রিমাকে নিরুত্তর দেখে আরশিয়ান সরে এসে নিজের সীটে বসে পুনরায় অধৈর্য কন্ঠে শুধায়,

–” ওয়াইফি? আর ইয়্যু ওকে? স্পিক আপ ড্যামিট।”

প্রিমা স্থির দৃষ্টিতে নিশ্চুপ ভাবে চেয়েছিল। কথা বলতে গিয়েও কেনো যেনো তার গলার স্বর আঁটকে আসছিল। আরশিয়ানের পাগলামি দেখে কোনোমতে কাঁপা হাতে তার বাহুর শার্ট খামচে ধরে বলল,

–” প্ পানি। ”

আরশিয়ান দ্রুত এদিক-ওদিক খুঁজতে থাকে পানির বোতল। সবটা লন্ডভন্ড হয়ে আছে। আকস্মিক এত বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাবে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি আরশিয়ান। সাবলীল গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সে। হঠাৎ একটা ট্রাক এলোমেলো ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসে। আরশিয়ান ভাবার সময় পায়নি তেমন একটা। দ্রুত গাড়ির স্টিয়ারিং ডান পাশে ঘুরায়। ট্রাকটা একদম বাঁ পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়ে সজোরে আছড়ে পড়ে পিচঢালা রাস্তায়।

আরশিয়ানের গাড়িটা যখন দিক হারিয়ে শক্তপোক্ত গাছের সাথে ধাক্কা খাওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নিজের সিট বেল্টটা খুলে প্রিমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আরশিয়ান। যেনো ভাঙা কাঁচের টুকরো প্রিমাকে ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে। পানির বোতল হাতে আসতেই তৎক্ষনাৎ সেটা প্রিমার দিকে বাড়িয়ে দেয় আরশিয়ান। পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে প্রিমা ধীর স্বরে বলে,

–” ঠিক আছি আমি। কোথাও ব্যথা পায়নি। আপনি ঠিক আছেন? ”

আরশিয়ান উত্তর দেয় না। প্রিমার কথা শুনে বুকে হাত রেখে হেডরেস্টে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখবুঁজে লম্বা লম্বা শ্বাস টানতে থাকে কেবল। উৎকন্ঠায় কলিজা হাতে আসার উপক্রম হয়েছিল তার। অতিরিক্ত ভয়ে শ্বাস আঁটকে আসছিল। মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যেতো আরশিয়ান বোধহয় মরেই যেতো। মানুষ মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আসলে নাকি স্বার্থপর হয়ে যায় অথচ আরশিয়ানের নিজের কথা মাথাতেই আসেনি। শুধু মনে হয়েছে পাশের সীটে অবস্থানরত তার রাগান্বিতাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে। সে সক্ষম কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

আরশিয়ানের অবস্থা দেখে প্রিমা আস্তেধীরে হাত বাড়িয়ে আলতো করে আরশিয়ানের হাত ধরে ফ্যাসফেসে কন্ঠে বলে,

–” উই আর অলরাইট। ”

আরশিয়ান রক্তিম চোখ মেলে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে প্রিমাকে। বেচারা থরথর করে কাঁপছে। প্রিমা স্পষ্ট টের পায় তার বাড়ন্ত হার্টবিট। কতটা ভয় পেয়েছে সেটা আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। প্রিমা তার পিঠে হাত বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

–” আমরা একদম ঠিক আছি জনাব। আপনি ঠিক আছেন?

আরশিয়ান নিরুত্তর রয়। প্রিমা টের পায় তার কাঁধের অংশটা উষ্ণ নোনাপানিতে টইটম্বুর হয়ে উঠছে। শান কাঁদছে.. কথাটা ভেবেই প্রিমার বুকটা মুচড়ে উঠলো। সে আরেকটুখানি শক্ত করে আরশিয়ানকে জড়িয়ে ধরে তার গলার পাশে আলতো করে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

–” অযথা ভয় পাচ্ছেন আপনি। সবটা ঠিক আছি।আমরা ঠিক আছি। গুরুতর কিছুই হয়নি। কাঁদছেন কেনো আপনি? ”

আরশিয়ান অস্ফুটস্বরে বলে,

–” আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমার দম আঁটকে আসছিল প্রেম। আপনার কিছু হলে আমি মরেই যেতাম। আমায় ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। আমি সইতে পারবোনা দূরত্বের বিরহ। আমার আত্মার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে আপনার অস্তিত্ব। আপনি বিহীন আমিটা কেবল অনুভূতিহীন মৃত লাশের মতো। ”

প্রিমা হকচকিয়ে উঠলো। খেয়াল করলো আরশিয়ান মনের ভুলেও একবার বাচ্চাদের কথা উল্লেখ করেনি বরং তার সেইফটি নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি ঘিরে ধরলো প্রিমাকে। হুট করে মনে পড়লো ক’দিন আগে স্বীকারোক্তি চাওয়ার ঘটনাটা। আকস্মিক তার মনে হলো,

–” ভালোবাসার আক্ষরিক স্বীকারোক্তির তুলনায় অনুভাবিত অনুভূতি বেশি তৃপ্তিদায়ক। আরশিয়ান অস্বীকার করলেও তার কর্মকান্ড স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সত্যতা। ভালোবাসি বলতে সবাই পারে কিন্তু অনুভব করানোর ক্ষমতা ক’জনের আছে? মানুষ হয়তোবা তার জীবনে হাজারবার শোনে শব্দটা কিন্তু ক’জন জীবনে এই বিশেষ অনুভূতি অনুভবের সুযোগ পায়?
যারা এই চমৎকার অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছে তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবতী। ”

চলবে?