।#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
৩২(প্রথমাংশ)
[ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত ]
সূর্যের দাপটে ঝলমলে আলোয় আলোকিত ধরণী। জানালার ফাঁক গলিয়ে আসা তেজস্বী আলো ঘরের পরিবেশকে আরও মনোরম করে তুলেছে। বেলা বাড়তেই ঘুমটা আলগা হয়ে আসলো মেহরিমার। পিটপিটিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই তাজের উন্মুক্ত বক্ষপট নজরে আসলো। মুখ উঁচিয়ে উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই দেখলো তাজরিয়ান জেগে আছে।
মেহরিমা হাত বাড়িয়ে তাজরিয়ানের শক্তপোক্ত দেহখানা জড়িয়ে ধরে তার পেটানো শরীরের উপর একটা পা তুলে দিয়ে আদুরে স্বরে বলল,
–” গুড মর্নিং তাজ। ”
তাজরিয়ান স্বাভাবিক স্বরে বলল,
–” মর্নিং। ”
মেহরিমার ভ্রু কুঁচকে আসলো তাজরিয়ানের বেখাপ্পা প্রত্যুত্তরে। তাজরিয়ানের বুক থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন বোধক চাহুনি নিক্ষেপ করে শুধাল,
–” মুড অফ আপনার? ”
তাজরিয়ান প্রত্যুত্তর করলোনা। মেহরিমার অনাবৃত দেহখানা সুকৌশলে বক্ষের উপর এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিরক্তি মাখা গলায় বলল,
–” ওসব মেয়েলোকের অসুখ। আমি খাঁটি পুরুষ মানুষ। এসব কারণবিহীন উদ্ভট রোগ আমার হয় না। খালি আমায় বদনাম করার ধান্দায় থাকিস তাইনা?
তাজরিয়ানের কথায় মেহরিমার মুখ কালো হয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে তাজের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে তার মুখাপেক্ষী হয়ে মিছে রাগী স্বরে বলে,
–” আপনি শুধু আমায় অপমান করার ধান্ধায় থাকেন তাইনা? আপনার খাপছাড়া উত্তর শুনে সরল মনে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এটাতেও আপনার সমস্যা? ”
মাথাটা সমান্য উঠিয়ে মেহরিমার হালকা রক্তিম হয়ে আসা নাকে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,
–” আমার একমাত্র মার্শম্যালো টাইপের বউজানকে আমি অপমান করতে পারি? তোর স্কিন বোধহয় বেশি সেনসিটিভ হয়ে গেছে মেহু। এজন্যই সহজ উত্তর শুনে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। ”
রাগের চোটে নাকের পাটাতন ফুলে উঠল মেহরিমার। ধড়াম করে মাথাটা তাজরিয়ানের বুকের উপর রেখে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,
–” বউকে অপমান করলে প্রকৃতি কিন্তু ঠিকই বদলা নিবে তাজ। ওই যে রিভেঞ্জ অব নেচার বলে একটা কথা আছে না? আমাকে ভয় না পেলেও এটলিস্ট ওটাকে একটু সমীহ করে চলবেন। ”
তাজরিয়ান চোখমুখ বিকৃত করে কৌতুকের স্বরে বলল,
–” কথায় কথায় বদলা নেওয়ার মতো হিংসুটে মনোভাব পুষে রাখা সুন্দরী রমণীদের কাজ। তুই কি-না নিজের স্বামীকে অন্য একটা বেডি মানুষকে তোয়াজ করে চলতে বলছিস? জাস্ট ইমাজিন তার এবং আমার মধ্যে যদি ইয়ে টাইপ ভাব ভালোবাসা হয়ে যায়। তখুন তোর কী হবে ?”
মেহরিমা হতভম্ব মুখে বলল,
–” রিভেঞ্জ অব ন্যাচার ফিমেল প্রোভার্ব?”
মাথামোটা মেহরিমাকে বোকা বানাতে পেরে হাসিতে আঁটকে তাজরিয়ান বলে,
–” তা নয়তো কী? ”
মেহরিমা চোখমুখ কুঁচকে সমস্ত সমীকরণ মেলানোর পর বুঝতে পারে তাজরিয়ান তাকে বোকা বানিয়েছে এবং মিছেমিছি ভাবে জেলাস করার চেষ্টা করছিল। মেহরিমা রেগেমেগে তাজরিয়ানের মাথার চুলগুলো খামচে ধরে বলে,
–” আপনি খুবই খারাপপপপ তাজ। ”
তাজরিয়ান হাসতে হাসতে মেহরিমার কোমল হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় এনে বলে,
–” সেটা আর নতুন কী? বুঝতে শেখার পর থেকেই এই বুলি আওড়াচ্ছিস অথচ আমার মতো নিরীহ প্রাণী দুনিয়াতে দ্বিতীয়টা নেই। ”
মেহরিমা তাজরিয়ানের কথায় গাল ফুলিয়ে বলে উঠে,
–” আমার সাথে সাথে নিরীহ প্রাণীর সংজ্ঞাটাও অপমানিত হয়ে গেলো। আপনি যদি নিরীহ প্রাণী হোন তাহলে বাঘ মামা অতি শীঘ্রই নিজেকে বিলাই মামী হিসেবে স্বীকৃতি দিবে। যেটা অসম্ভব সুতরাং আপনিও নিরীহ নন। ”
বউয়ের বুদ্ধিমত্তায় তাজরিয়ান কিঞ্চিত খুশি হলো। তার অবাধ্য হাত বিচরণ করতে শুরু করলো মেহুর সর্বাঙ্গে। তাজরিয়ানের এহেনও কান্ডে শিউরে উঠে মেহরিমা। তাজরিয়ান হস্কি স্বরে বলে,
–“আমার অতি আদর দেওয়ার সুফল টের পাচ্ছিস? এই আদর পেয়েই তোর আই-কিউ দিনকে দিন তরতরিয়ে বাড়ছে মেহু অথচ এইটা নিয়ে তোর অভিযোগের শেষ নেই। ঘুম পূরণ হয়েছে? ”
মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায় তাজরিয়ানের বেফাঁস কথায়। খানিক্ষন চুপ থেকে ধীর স্বরে উত্তর দেয়,
–” হয়েছে। একটা কথা বলি? ”
মেহরিমার কথায় লজ্জা লজ্জা ভাবটা স্পষ্ট। সবটা টের পেয়ে মেহরিমাকে নিজের মুখ বরাবর এনে তাজরিয়ান কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
–” এইবার বল বউজান। ”
তাজরিয়ানের মুখোমুখি হয়ে লজ্জায় থিতু হয়ে যায় বেচারি। দৃষ্টি লুকিয়ে তাজরিয়ানের বাহুতে মিছে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
–” আমাদের মাঝে নতুন মেহমানের আগমন ঘটলে কেমন হয়? ”
মেহরিমার বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই মুখাবয়ব পাল্টে যায় তাজরিয়ানের। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মেহরিমাকে পাশে বসিয়ে উৎকন্ঠিত স্বরে শুধায়,
–” তোর লাস্ট মেন্সট্রুয়াল সাইকেলের ডেট কবে ছিলো? ”
তাজরিয়ানের আকস্মিক আচরণে ভড়কে যায় মেহরিমা। কাঁপা কন্ঠে ডেট জানাতেই তাজরিয়ান পুনরায় অস্থির কন্ঠে শুধায়,
–” হতেও পারে ওটা ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং ছিলো। তুই কী টেস্ট করিয়েছিস? মেডিসিন স্কিপ করেছিলি? ”
তাজরিয়ানের চোখমুখে লেপ্টে আছে উৎকন্ঠা। তার কন্ঠস্বর কম্পমান। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে মেহরিমার প্রত্যুত্তরে। লোকটার খুশি হওয়ার কথা থাকলেও তাকে বড্ড বিচলিত লাগছে। খুশির বদলে একরাশ চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তার কপালে। ভয়ে ভয়ে কোনোমতে মেহরিমা জবাব দেয়,
–” ম্.. মেডিসিন স্কিপ ক্ করেছিলাম। ট্ টেস্ট ও করিয়েছি..
অর্ধকে উত্তর শুনে তাজরিয়ান অধৈর্য হয়ে ধমকে উঠে তাকে। মেহরিমা ভয়ে সিঁটিয়ে যায় বিছানার হেডবোর্ডের সাথে। ভীত চাহুনিতে দেখে তাজের ক্ষ্যাপাটে মুখাবয়ব। মেহরিমাকে পিছিয়ে যেতে দেখে তাজরিয়ান চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। সামান্য এগিয়ে গিয়ে যথাসম্ভব কন্ঠ নরম করে শুধায়,
–” রেজাল্ট কী এসেছে? ”
মেহরিমা অশ্রুসিক্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অভিমানী স্বরে বলে,
–” নেগেটিভ। ”
উত্তরটা শোনামাত্রই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে মাথায় একটা হাত রেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে তাজরিয়ান। অল্প সময়ের জন্য আত্মাটা খাঁচা ছাড়া হয়ে গিয়েছিল তার। চোখ বুঁজে শান্তির সাগরে ভেসে বেড়ানো তাজরিয়ানের হুঁশ ফিরে মেহরিমার নাক টানার শব্দে। বিরক্ত মুখে উঠে বসে মেহরিমার দিকে তীর্যক চাহুনি নিক্ষেপ করে তাজরিয়ান শুধায়,
–” তুই মেডিসিন স্কিপ করেছিস কোন সাহসে? ছোট্ট মাথাটাতে সারাক্ষণ আমার সুখ, শান্তি ইন্না-লিল্লাহ করে দেওয়ার প্ল্যান ঘুরে তাইনা? ”
মেহরিমা ফুঁপিয়ে উঠে জবাব দেয়,
–” মেডিসিন স্কিপ করার সাথে আপনার সুখ শান্তি নষ্ট হওয়ার কী সম্পর্ক? ”
তাজরিয়ানের রাগ উঠে কিন্তু মেহরিমার মুখপানে চেয়ে নিজেকে সামলে নেয়। আরেকটু ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে মেহরিমার চোখে চোখ রেখে সাবলীল কন্ঠে বলে,
— ” প্রেগন্যান্সি কোনো ছেলেখেলা নয় মেহু। এটা একটা বিশাল দায়িত্ব। এক্ষেত্রে মেন্টাল এবং ফিজিক্যাল ফিটনেসটা বাধ্যতামূলক যেটা তোর নেই। হঠকারিতায় কোনো সিধান্ত নিয়ে তোকে হারাতে চাইনা আমি। ”
তাজরিয়ানের অকপট স্বীকারোক্তিতে মেহরিমার কান্না থেমে যায়। থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর কন্ঠে শুধায়,
–” আমার থেকে দুর্বল এবং ক্রিটিকাল কন্ডিশনে থাকা মানুষ এই জার্নি ফেস করছে তাজ। সবাই কী দিনশেষে মরে যাচ্ছে? ”
তাজরিয়ানের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। মস্তিষ্কে চেপে বসলো সুপ্ত রাগ। দাঁতে দাঁত চেপে তাজরিয়ান বলল,
–” সবার আর তোর কেসটা সেম নয় মেহু। এতদিন যাবত আমার সান্নিধ্যে আসছিস অথচ এখনো আমি একটু রাফ হলে পরেরদিন তোর জ্বর উঠে। আমার পাগলামি গুলোতেই এখনো অভ্যস্ত হতে পারিসনি আবার আমার অস্তিত্ব দুনিয়ায় আনার পরিকল্পনা করছিস। ছলনাময়ীর খাতায় নাম লেখাতে চাচ্ছিস নাকি ?”
মেহরিমার অসহ্য লাগে তাজরিয়ানের বাড়াবাড়ি। সেও তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
–” যেকোনো সুস্থ মানুষ আপনার লাভ টর্চারের পাল্লায় পড়লে অসুস্থ হয়ে যাবে। অহেতুক ব্লেম দিবেন না আমাকে। আপনি আসলে ইনসিকিউরড। বাচ্চা আসলে আমি তার সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। আপনাকে সময় কম দিবো.. এটাই আপনার সহ্য হচ্ছে না তাইতো?”
মেহরিমার কথায় তাজরিয়ান সোজাসাপ্টা বলল,
–” এটাও একটা পয়েন্ট। সব মিলিয়ে মূল কথা হলো আমার কোনো ছানাপোনা লাগবে না। তুই হলেই এই জীবন নির্বিঘ্নে এবং সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাবে। ”
মেহরিমা অবাক চোখে দেখলো তাজরিয়ানকে। তার অকপট স্বীকারোক্তিতে মস্তিষ্কে খুন চেপে বসলো মেহরিমার। দাঁতে দাঁত চেপে জোরালো কন্ঠে বলল,
–” আপনি একটা সাইকো তাজ । ”
মেহরিমার কথা শুনে বাঁকা হাসে তাজ। অভিমানী মেয়েটাকে এক ঝটকায় নিজের কাছে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার শরীরে মিশে থাকা সুমিষ্ট সুবাসটা ভেতরে টেনে নিয়ে গা হিম করা কন্ঠ বলে,
–” সত্যটা উপলব্ধি করতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিস বউজান। আমার অবাধ্য শাসন গুলো জাহান্নামের নিকৃষ্ট শাস্তি তুল্য যন্ত্রণা দিলেও সেটা তোকে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হবে কারণ তোর ফিরে যাওয়ার কোনো পথই আমি অবশিষ্ট রাখিনি সোনা।
_
সূর্যের প্রখর তাপ জানান দিচ্ছে অপরাহ্নের আগমনী বার্তা৷ মোটামুটি এগারোটার দিকে সকলে উপস্থিত হয় নাস্তার টেবিলে। কাকতালীয় ভাবে টাইমিং মিলে যাবে এমনটা কেউ আশায় করেনি। প্রথমে রাজ এবং জানাকে নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায় অতঃপর তাজ আর মেহু আসে। সবশেষে হাজির হয় আরশিয়ান এবং প্রিমা। ওরা টেবিলের কাছে আসতেই সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
–” হ্যাপি বার্থডে মিসেস লাড্ডু। ”
ঘুমের ঘোরে থাকা প্রিমা খানিকটা চমকে উঠে। কী ঘটেছে সেইটা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। আরশিয়ানের হাত ধরে সামনে এগিয়ে এসে ওদের সাথে সংযুক্ত হতেই নানান বাহারের কথায় মেতে উঠে সবাই। সবার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হাসে প্রিমা। আরশিয়ান গম্ভীর মুখে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করে সেই দৃশ্য।
দৃশ্যটা আর কারো চোখে ধরা না পড়লেও ফারজানা দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী সে। পুরুষের চোখের ভাষা বুঝতেও সক্ষম বিধায় শানের দৃষ্টির মানে বুঝতে তার বেগ পেতে হয়নি। মূলভাব বুঝতেই তার অন্তঃকরণ প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। পরিশেষে ভালোবাসার কাঙালিনী তার পরিপূরক খুঁজে পেয়েছে। আড্ডা এবং খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জানার প্লেটের দিকে নজর রাখছিল ইশতিরাজ। মেয়েটা খাওয়াদাওয়ায় বড্ড বেশি ফাঁকিবাজি করে। প্লেটের খাবার আগের মতো দেখে ইশতিরাজ নিচু স্বরে ফারজানার কানে কানে বলে,
–” খাবার শেষ করুন জলদিই নয়তো অন্য মিষ্টির খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবো এন্ড ইয়্যু ওন্ট লাইক ইট মিসেস জানা। বাই দ্যা ওয়ে এটা এডাল্ট কন্টেন্ট যুক্ত কথাবার্তা ছিলো। আপনি একটু কষ্ট করে আসল মিনিং বুঝে নিন কেমন? সরাসরি বলতে আমার শরম করছে। ”
কথাটা বলে মিছে লজ্জা পাওয়ার ভান ধরলো ইশতিরাজ। ফারজানা অবাক চোখে তাকালো তার ভন্ড অভিনেতার দিকে। ইশতিরাজ তখন প্রিমার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সবাই নাস্তা সেরে প্ল্যান সাজাতে লাগলো। সর্বোচ্চ আর একদিন তারা এই রিসোর্টে স্টে করবে তাই অল্প সময়ের মধ্যে আশেপাশের প্রধান দর্শনীয় স্থান গুলো ঘুরে দেখার বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলো। এক পর্যায়ে ইশতিরাজ বলল,
–” আমরা চাইলে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এবং ভাওয়াল রাজবাড়ী ভিজিট করতে পারি। এখান থেকে খুব বেশি একটা দূরত্বে নেই। তোরা…
ইশতিরাজের কথার মাঝে আরশিয়ান গম্ভীর স্বরে বলে,
–” আমরা যাবো না। তোদের জন্য যেটা স্যুইটেবল হয় তোরা সেখানে ঘুরতে যেতে পারিস । ”
ইশতিরাজ বার্গেনিং করতে গিয়েও থেমে গেলো। আড়চোখে প্রিমার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো তার ক্লান্তিতে মুষড়ে পড়া মুখশ্রী তবে এতকিছুর মাঝেও তাকে অসম্ভব রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে। ত্বকের উজ্জ্বলতা যেনো একরাতের ব্যবধানে বেড়ে গেছে। চোখদুটো সামান্য ফোলা থাকলেও দেখতে সুন্দর লাগছে। ইনসিকিউরড আরশিয়ান ঠিক কী কী রিজনে ঘুরতে যাওয়াটা স্কিপ করতে চাইছে সেটা ঢের বুঝলো ইশতিরাজ। বন্ধু তার উপর দিয়ে সরল সোজা হলেও ভেতর ভেতর কতটা হারামি সেসব খবর তার অজানা নয়।
সবটা বুঝে সে-ও অনীহা প্রকাশ করলো ঘুরতে যেতে। মেহরিমার মন এমনিতেই খারাপ ছিলো ইশতিরাজের কথায় মন খারাপের মাত্রাটা আরেকটু বাড়লো। সেটা অবলোকন করে তাজরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
–” হানিমুন মানে হলো নিজেদের অনুভূতি এক্সপ্লোর করা কিন্তু আমার মাথামোটা বউ দর্শনীয় স্থান প্রদর্শন করার চিন্তায় ব্যস্ত। আমার মতো খাঁটি আমিষের পাল্লায় পড়েও এই নিরামিষ মহিলা কিচ্ছু শিখেনি। দিনের আলোতে টিউবলাইট দিয়ে আমার অনাগত ভবিষ্যতে সুখময় শান্তির খোঁজ মিলবে কি-না সন্দেহ ”
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নাস্তা শেষে আরশিয়ান এবং প্রিমা ফিরে গেলো নিজেদের কটেজে। তাজ এবং মেহু বেরোলো দর্শনীয় স্থান গুলো ভ্রমণ করতে। সবাইকে নিজ নিজ গন্তব্যে প্রস্থান করতে দেখে ইশতিরাজ বলল,
–” এই যে মিসেস.. আপনাকে একটু বিরক্ত করি?
ফারজানা জুসের গ্লাসে চুমুক বসিয়ে বলল,
–” দুঃখিত.. আমি একজন বিবাহিত নারী সেজন্যই শত-শত নারীর হার্টথ্রোবকে টিজিং এর পারমিশন দিতে পারলাম না। ”
সুক্ষ্ম খোঁচাটা টের পেতেই মুখ কালো হয়ে যায় ইশতিরাজের। কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে বলে,
–” শত-শত নারীর হার্টথ্রোবের হার্টে কেবলমাত্র আপনার দখলদারিত্ব চলে ম্যাডাম। ”
ফারজানা প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না শুধু স্মিত হাসলো। ইশতিরাজ বলে উঠল,
–” বাগানের দিকটায় যাবেন? ”
সারাদিন শুয়ে বসে বড্ড বিরক্ত হচ্ছিল ফারজানা তাই ইশতিরাজের কথায় ঝটপর রাজি হয়ে গেলো। দু’জনে ধীর পায়ে নৈঃশব্দ্যে মুহূর্তটা উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যায় সুবিস্তীর্ণ গাছপালায় আচ্ছাদিত বাগানের দিকে। বাগানের ট্রিম করে রাখা ঘাসগুলো বড্ড পরিচ্ছন্ন এবং মনোরম। ফারজানা লোভ সামলাতে না পেরে বলল,
–” ঘাসের উপরে বসি? ”
ইশতিরাজ কিছু একটা ভেবে বলল,
–” বসা যায়। ”
সম্মতি পেয়ে ফারজানা খুশি হয়। ইশতিরাজ অল্প সল্প পর্যবেক্ষণ শেষে ফারজানাকে নিয়ে বসে পড়ে।বাগানের এই সাইডটা থেকে লেকের চমৎকার একটা ভিউ পাওয়া যায়। রোদ থাকা সত্ত্বেও ঘন গাছপালার জন্য সেটার আঁচ নিচ অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। ফারজানা রীতিমতো বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে চারপাশ আচমকা তার কোলের উপর ইশতিরাজ মাথা রেখে শুয়ে পড়লে কিঞ্চিত চমকে উঠে ফারজানা। ভ্রু কুঁচকে কিছু বলার পূর্বে রাজ বলে উঠে,
–” আপনি আপনার প্রিয় দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত তাই আমি আমার প্রিয় মানুটার মুগ্ধ দৃষ্টি আরও নিকটতর হতে দেখার উপায় খুঁজে নিলাম। ভুল কিছু করেছি? ”
ফারজানা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইশতিরাজ সেই দৃশ্য দেখে কাতর কন্ঠে বলল,
–” ভালোমানুষি মেইনটেইন করা অনেক কঠিন একটা কাজ ম্যাডাম। আপনি উল্টোপাল্টা কাজ করলে আমি মুখোশ ছেড়ে বেরুতে বাধ্য হবো। আমি যদি খুব ভুল না হই তাহলে আপনি এখনো প্রস্তুত নন আমাকে একান্ত ভাবে নিজের মালিকানা বুঝিয়ে দিতে। ”
ফারজানা অল্প সময় নিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–” বিয়েতে মত দেওয়ার সাথে সাথে আমার সমগ্র সত্তার মালিকানা আমি আপনার নিকট হস্তান্তর করেছি। মনের মধ্যে বিন্দুমাত্র শঙ্কা থাকলে আমি আপনাকে গ্রহণ করতাম না জনাব। অতীত ভুলে যাওয়ার অভিপ্রায়ে আপনার জীবনে নিজেকে জড়ায়নি আমি। একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানটাকে সপ্নের ন্যায় রঙিন করে তুলতে এই সিধান্তে উপনীত হয়েছিলাম। সময় সাপেক্ষ আপনার জন্য অনুভূত হওয়া অনুভূতিগুলো গাঢ় হতে হয়তো সময় লাগবে তবে এটার সাথে মালিকানা বুঝে নেওয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
ইশতিরাজ ফাঁকা ঢোক গিলে কাতর গলায় বলল,
–” সম্মতি দিয়ে বেসামাল করে আবার বাঁধা দিবেন না তো? আমি একবার ধৈর্য হারালে হয়তো আপনার বাঁধা মানতে সক্ষম হবো না। বুঝেশুনে নিজের সর্বনাশের নথিপত্রে স্বাক্ষর কইরেন.. আমি কিন্তু হাসবেন্ড হিসেবে একদমই ভালো নই। ”
ফারজানার মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো। অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
–” নির্দিষ্ট এক স্বাক্ষরের বিনিময়ে অলরেডি আমি একান্ত ব্যক্তিগত ভাবে আপনার সম্পদে পরিণত হয়েছি জনাব। সম্পদ যেহেতু আপনার তাই মর্জিও আপনার। অহেতুক এভাবে অনুমতি চেয়ে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না। ”
ইশতিরাজ অতি সুখে চোখ বুঁজে শুয়ে রইল। নিজের প্রিয়তমার মুখে এহেনও স্বীকারোক্তি শোনার সৌভাগ্য ক’জন পুরুষের হয়? মানুষ সত্যি বলে, কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। ফারজানাকে নিজের করে নেওয়ার জার্নিটা এতটাও সহজ ছিলোনা তবে সে হার স্বীকার করেনি বলেই হয়তো আজকে এই সুখানুভূতি তার হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। কীয়ৎকাল সেভাবেই পার হলো। আচমকা ফারজানা বলল,
–” আপনার অতীত সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন ছিল্..
বাকি কথা বলার পূর্বে ইশতিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” আজকে নয় সুরঞ্জনা। অন্য কোনো দিন এই বিষয়ে আলোচনা করি? ”
ফারজানা থেমে যায়। অতীতের প্রসঙ্গ আসতেই ইশতিরাজের পাল্টে যাওয়া মুখাবয়ব তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে রীতিমতো। লোকটা কেমন নির্জীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অথচ ফারজানা স্পষ্ট টের পাচ্ছে সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে রাগ, ক্ষোভ এবং আকাশস্পর্শী ঘৃণা। ফারজানা কথা ঘুরাতে বলল,
–” আপনি আমার থেকে যথেষ্ট বড় তবুও আপনি সম্বোধন করেন কেনো? ”
ইশতিরাজ খানিকটা সময় নিয়ে গমগমে সুরে বলল,
–” ভালো লাগে তাই। ”
ফারজানা মুখটা কালো করে বলল,
–” আজীবন এই আপনি সম্বোধনটাই চলবে? ”
ইশতিরাজ আকস্মিক তার চোখের পানে দৃষ্টি তাক করে বলল,
–” খুব বিশেষ এক সময়ে আপনি ডাকটা তুমিতে রুপান্তর হবে। আপনি টের পাবেন তবে অনুভূতি প্রকাশের অবকাশ থাকবে না কেবল সম্বোধনের সূচনালগ্নের রঙিন দৃশ্যটা আজন্মকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ”
ফারজানা অভিভূত হয়ে শুনে তার কথা। তবে প্রত্যুত্তর করে না। নিরবে নিভৃতে স্মৃতির পাতায় সংরক্ষণ করে রাখে সেই মহেন্দ্রক্ষণ।
চলবে?
#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
৩২(শেষাংশ)
অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরনো গোডাউন। উঁচু ভেন্টিলেটরের ফাঁক গলিয়ে আসা সোনালি আলোকছটায় কিঞ্চিত আলোকিত হয়ে রয়েছে চারপাশ৷ ভ্যাপসা গন্ধে ম-ম করছে বদ্ধ ঘরটা। ধুলোবালি আছন্ন ঘরটায় সুস্থির ভাবে শ্বাস নেওয়ায় দুষ্কর ব্যপার অথচ ফ্লোরের এক কোনায় পড়ে আছে চেতনাশূন্য প্রিমার হাড্ডিসার দেহখানা।
খানিকক্ষণ সময় পেরোতেই কারও আগমন ঘটে। সেই ব্যক্তি হুংকার ছেড়ে নির্দেশ দেয় প্রিমার জ্ঞান ফেরাতে। আগন্তুকের কথা মোতাবেক হাফ বালতি পানি ছুঁড়ে ফেলা হয় প্রিমার মুখশ্রীর উপর তবে সেটা মুখাবয়ব ছাপিয়ে দেহের অন্যত্রে ছিটকে পড়ে।স্পষ্ট হয়ে ওঠে মেয়েলি সৌন্দর্য। কয়েক জোড়া লোলুপ দৃষ্টি আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে অবলোকন করে সেই দৃশ্য।
চেতনাশূন্য প্রিমা কিচ্ছুটি টের পায়নি তবে দুই দফা পানির অপ্রতিরোধ্য আক্রমণে তার সংবিৎ ফিরে আসে৷ পিটপিটিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে। চেতনাশূন্য মস্তিষ্ক কার্যকর হতেই অসহনীয় এক ব্যথা গ্রাস করে ফেলে তার সমগ্র চিত্ত। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে প্রিমা। তার অবস্থা দেখে সম্মুখে দাঁড়ানো আগন্তুকের মুখে ফুটে উঠে কৌতুকপূর্ণ হাসি। চওড়া গলায় উচ্ছ্বাস ঢেলে বলে ,
–” রাদিয়াহ মামুনি?
যন্ত্রণায় কাতর প্রিমা পলক ফেলে সামনে তাকাতেই হতভম্ব স্বরে বলে উঠে,
–” আশরাফ ওয়াসীত্ব? ”
প্রিমার সম্বোধনে শব্দ করে হেসে উঠেন আশরাফ ওয়াসীত্ব। হাতের ইশারায় তার ভাড়াটে গুন্ডাদের পিছিয়ে যেতে বলে প্রিমার বিস্মিত আঁখি জোড়ার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেন,
–” হ্যাঁ মামুনি আমিই। চিনতে পারছো না? উম্..ইট’স ওকে কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখো তো ওই রক্তস্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষটাকে চেনো কি-না। ”
কথাটা বলেই আশরাফ ওয়াসীত্ব সরে দাঁড়ালেন। প্রিমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি গিয়ে পড়লো বাঁ পাশে।দেখলো একটা কাঠের চেয়ারে শক্ত করে বেঁধে রাখা রয়েছে আরশিয়ানের জ্ঞানশূন্য রক্তাক্ত দেহখানা। সেই নির্মম দৃশ্য দেখে প্রিমা হকচকিয়ে উঠে। নিজেকে সামলাতে না পেরে বহুকষ্টে মেঝে থেকে ক্ষতবিক্ষত শরীরটা টেনে তুলে প্রিমা তবে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। নিরুপায় হয়ে ক্ষীণ স্বরে শানকে ডাকতে গিয়ে টের পায় তার কন্ঠনালি ভেদ করে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। শুকনো ঠোঁটজোড়া জিভ দ্বারা ভিজিয়ে আলতো করে ঢোক গিয়ে গলার জোর বাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,
–” শুনছেন্ আ..
বাকি কথা বলার পূর্বেই আশরাফ ওয়াসীত্ব এগিয়ে এসে প্রিমার চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে বলেন,
–” তোমার স্বামী কিছুই শুনছে না রাদিয়াহ মামুনি। একটু পর নিঃস্বাস ও নিবে না। তুমি চিন্তা করো না…
প্রিমা ব্যথায় ছটফটিয়ে উঠে রীতিমতো। আশরাফ ওয়াসীত্বের কথা শুনে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে অতঃপর তার পা জড়িয়ে ধরে বলে,
–” যথেষ্ট আঘাত করা হয়েছে উনাকে। ইহজীবনে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাটাও অসম্ভব উনার পক্ষে । দোহাই লাগে আল্লাহর প্রাণটা কেড়ে নিয়েন না…..
আশরাফ ওয়াসীত্ব অপ্রকৃতস্থের মতো হাসলেন শুধু।
প্রিমার আহাজারি চলতে থাকলো। কিছুক্ষণ পর আশরাফ ওয়াসীত্ব তার পালিত গার্ডদের নির্দেশ দিলেন,
–” জ্ঞান ফেরাও আমার জামাই বাবাজীর। জীবনে কত উপহার পেয়েছি তার থেকে.. বিনিময় স্বরুপ কিছু-মিছু দিতে না পারলে আমার মানসম্মান অক্ষত থাকবে? ”
প্রিমা বুঝে উঠতে পারে না আশরাফ ওয়াসীত্বের পরিকল্পনা। উৎকন্ঠা বুকে চেপে নির্নিমেষ নজরে চেয়ে থাকে শানের দিকে। হতেও পারে এটাই তাদের অন্তিম দৃষ্টির মিলন। শেষ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলোনা প্রিমা।
মায়াময়ী দৃষ্টিতে তাকাল তার প্রিয়তমের ক্ষতবিক্ষত মুখপানে। আনুমানিক আধঘন্টার ব্যবধানে জ্ঞান ফিরে আসলো আরশিয়ানের। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই তার সামনে ভেসে উঠলো এক ভয়াল চিত্র।
বেকায়দায় ফ্লোরে বসে আছে প্রিমা। তার হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা।বেচারির ক্লান্ত চোখ জোড়ায় লেপ্টে আছে রাজ্যের ক্লান্তি এবং অসহায়ত্ব। দুর্বল শরীরটা টলমল করছে। তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বাঁকা হেসে দাঁড়িয়ে আছে আশরাফ ওয়াসীত্ব।
পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই আরশিয়ান শঙ্কিত হয়ে পড়লো। উৎকন্ঠার পাশাপাশি ক্ষোভে ফেটে পড়লো। আশরাফ ওয়াসীত্ব তার ছটফটানি দেখে শব্দ করে হেসে উঠলেন অতঃপর প্রিমাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বললেন,
–” উফ্ শান্তিইইইইইইইইইইই……
আরশিয়ান সহ্য করতে পারলো না সেই দৃশ্য। অস্ফুটস্বরে হুংকার দিতেই বিকট একটা শব্দ শোনা গেলো। ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবন করতে কীয়ৎকাল সময় লাগলো সকলের। কিছু সময় পেরোতেই রক্তের সুক্ষ ধারা এসে স্পর্শ করলো শানের ক্ষতবিক্ষত নগ্ন পায়ের পাতা।
এতেই যেনো আরশিয়ানের হুঁশ ফিরে। শুকনো ঢোক গিলে হতভম্ব চোখে তাকায় সম্মুখের রক্তাক্ত দৃশ্যের পানে। অজানা অদৃশ্য কেউ কানের নিকট ফিসফিসিয়ে বলে ,
–” সমাপ্তি রেখায় এসেও গল্পটা অসমাপ্ত রয়ে গেলো। শিরোনামহীন অনুভূতিরা সুখের বদলে শোকের কাফনে আবৃত হলো। নিয়তি নিষ্ঠুর বলেই হয়তো সূচনাটা রঙিন ছিলো। ”
আরশিয়ানের ছটফটানিতে ঘুমন্ত প্রিমা হকচকিয়ে উঠে বসে। ধাতস্থ হয়ে কপাল কুঁচকে তাকায় ঘুমের ঘোরে বিড়বিড়িয়ে আবোলতাবোল কথা বলতে থাকা আরশিয়ানের পানে।শীত তাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে অবস্থান করেও স্বেদজলে চুপ চুপে হয়ে উঠেছে বেচারার পুরো শরীর। প্রিমার ঘুম আছন্ন চোখ জোড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আরশিয়ানের দিকে ঝুঁকে আলতো কন্ঠে বলে,
–” কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেনো? ”
প্রিমার ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আরশিয়ান। শ্বাস ফেলতে থাকে এলোমেলো ভাবে। বারংবার পলক ঝাপটে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে। চিন্তিত প্রিমা তার কাঁধে হাত রাখলে আরশিয়ান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। প্রিমা একটু হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। আরশিয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
–” এত অস্থির হয়ে পড়েছেন কেনো? চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন আমরা কটেজে। সকাল বেলা নাস্তা সেরে ঘরে ফিরে ঘুমিয়েছিলাম.. মনে করার চেষ্টা করুন? কোনো খারাপ সপ্ন দেখেছেন? পানি খাবেন একটু? ”
প্রিমার কথা শুনে সমস্তটা মনে পড়ে আরশিয়ানের তবে খারাপ সপ্নের কথা শুনে তার বুক কেঁপে উঠে আবার। প্রিমাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে অস্ফুটস্বরে বলে,
–” প্রেম আমার.. শুধুই আমার। আমি কাউকে ছিনিয়ে নিতে দিবো না। নিয়তিকেও সুযোগ দিবো না। যারাই তাকে কেড়ে নিতে আসবে সকলের বিপরীতে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হবো আমি। ”
আরশিয়ানের বলা একটা কথাও প্রিমার কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। সে তো তার প্রিয় মানুষকে শান্ত করতে ব্যস্ত। আরশিয়ানের হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ স্বাভাবিক হয়ে আসতেই প্রিমা ধীর কন্ঠে বলে,
–” ব্যথা পাচ্ছি আমি। বাঁধনটা একটু আলগা করুন প্…
প্রিমা আরকিছু বলার পূর্বে আরশিয়ান আলতো করে সরে আসে অতঃপর ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
–” আম সো স্যরি। আর ইয়্যু ওকে? ”
আরশিয়ান বেজায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরার ফলে প্রিমা অল্প সল্প ব্যথা অনুভব করছিল।শক্তি সামর্থ্যে বলীয়ান আরশিয়ান এর ভার সামলে নেওয়া দুর্বল চিত্তের প্রিমার জন্য কিছুটা কষ্টসাধ্য বটে। নিজেকে সামলে নিয়ে বেড সাইড টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা আরশিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রিমা বলে,
–” ইয়্যু ডোন্ট নিড টু বি স্যরি। আমি একদম ঠিক আছি। আপনার কী হয়েছে? ”
আরশিয়ান প্রত্যুত্তর করলোনা। গ্লাসের পানি এক চুমুকে শেষ করে শান্ত চোখে প্রিমার দিকে তাকালো তবে সেই শান্ত ভাবটা বেশিক্ষণ টিকলো না। সপ্নে দেখা সেম আউটফিটটা প্রিমার পরণে দেখে অস্থির কন্ঠে আরশিয়ান সেটা সরিয়ে নিতে নিতে বলল,
–” এই পরিচ্ছদ আমার চোখে অসহ্য ঠেকছে.. খুলে ফেলুন তো…
আরশিয়ানের আচরণে প্রিমা হতবিহ্বল হয়ে যায়। তার লজ্জা পাওয়া উচিত নাকি চিন্তিত হওয়া উচিত সেটা নিয়েও দ্বিধায় পড়ে যায় প্রিমা। আরশিয়ানের বলিষ্ঠ বাহু খামচে ধরে অপ্রতিভ স্বরে বলে,
–” আপনি পাগলামি করছেন মিস্টার চৌধুরী। এভাবে..
প্রিমার বলা কথাটা শুনে আরশিয়ান থমকে যায় তবে ততক্ষণে প্রিমার পরনে থাকা নাইট স্যুটটা ঠাঁই পেয়েছে টাইলসের মেঝেতে। ঘোরর মাঝে কী করে ফেলেছে সেটা ভেবেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় আরশিয়ান। চোখের সামনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে কিছুটা চমকালেও সেটা লুকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
–” দুঃখিত একটু বেশিই পাগলামি করে ফেলেছি বোধহয় তবে এটা অপ্রীতিকর কোনো বিষয় নয়। আমাদের সম্পর্কটাই এসবকিছু অত্যন্ত স্বাভাবিক। আপনার মতের বিরুদ্ধে কখনোই কিছু হবেনা তবে হুটহাট অনিচ্ছাকৃত ভাবে কোনো মুহূর্ত তৈরী হলে সেটা স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার সক্ষমতা আপনার থাকা উচিত। আস্তেধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন কেমন? ”
প্রিমা বুঝলো একটু বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলেছে সে। কিছু বলার পূর্বেই আরশিয়ান সযত্নে শুভ্র নির্মল ব্ল্যাঙ্কেটটা তার অনাবৃত শরীরে জড়িয়ে দেয়। প্রিমা চোখমুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে লজ্জারুণ মুখশ্রী লুকানোর চেষ্টা করে। মুগ্ধ চোখে সেই দৃশ্য দেখে আরশিয়ান স্বাভাবিক কন্ঠে পুনরায় বলে,
–” লাজরাঙা মুখখানা লুকিয়ে লাভ নেই। আমি দেখে ফেলেছি। যাইহোক মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। চুলগুলো একটু টেনে দিবেন? ”
লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া প্রিমা কোনো জবাব দেয়না। বেচারিকে লজ্জায় ফেলে আর নাজেহাল করলো না আরশিয়ান৷ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল। কীয়ৎকাল সময় নিয়ে নিজেকে সামলে প্রিমাও শুয়ে পড়লো আরশিয়ানের পাশে। জড়তা কাটিয়ে আলতো করে তার মাথা ম্যাসাজ করে দিতে থাকলো তবে ব্যপারটা বিশেষ পছন্দ হলো না শানের। প্রিমার দিকে ফিরে হালকা লালচে বর্ণের আঁখি জোড়ার করুন চাহুনি নিক্ষেপ করে অনুরোধ এর সুরে বলল,
–” একটু জড়িয়ে ধরি আপনাকে? ”
আরশিয়ান অশান্ত ভাবটা স্পষ্ট টের পেলো প্রিমা বিধায় নাকচ করলো না। আরশিয়ানের মাথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–” এত দুশ্চিন্তা করছেন কেনো? অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো। নিজেকে সামলান নয়তো বলুন কী হয়েছে। এই সাসপেন্স আমার ভাল্লাগছে না। ”
আরশিয়ান কথাটা এড়িয়ে গিয়ে ধীর স্বরে বলল,
–” আমার শান্তির ঠিকানায় পৌঁছে গেছি.. স্বস্তি এমনিতেই ধরা দিবে এবার। ”
আরশিয়ানের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা ধরতে পেরে প্রিমার মুখে লাজুক হাসি ফুটলো। আরশিয়ানের কর্মকান্ডে তাকে বিস্মিত করে তুলছে। প্রিমা কথা না বাড়ালো না। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে আরশিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। ঘুম পূরণ হয়ে যাওয়া প্রিমা জেগে রইল তবে আরশিয়ান অল্প সময়েই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো।
কীয়ৎকাল সময় পেরোতেই প্রিমা খেয়াল করলো আরশিয়ান অল্পবিস্তর কাঁপছে। প্রথমদিকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে দেখে প্রিমা ঘাবড়ে যায়। আরশিয়ানের অসুস্থতা তাকে চিন্তিত করে তুলে। স্পঞ্জ বাথ দেওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলে প্রিমার বুকের সাথে আরেকটু মিশে গিয়ে আরশিয়ান ভারিক্কি স্বরে বলে,
–” ডোন্ট মুভ প্রেম..
আরশিয়ানের কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় না প্রিমা। তার শরীরের তাপমাত্রা তরতররিয়ে বাড়তে দেখে প্রিমা চিন্তিত স্বরে বলে,
–” সাংঘাতিক জ্বর এসেছে আপনার। দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নিলে কোনো অঘটন ঘটে যাবে। আমাকে একটু ছাড়ুন। স্পঞ্জ বাথ দিতে হবে আপনাকে। এতে যদি জ্বর না কমে তাহলে রাজ ভাইয়াকে খব….
আরশিয়ান তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে,
–” চুপচাপ শুয়ে থাকুন। কিচ্ছু হবে না আমার। এসব চুনোপুঁটি জ্বর আমায় বেকাবু করতে পারবে না। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে…
আরশিয়ান খামখেয়ালি করলেও প্রিমা স্পষ্ট টের পাচ্ছে জ্বরের মাত্রা। জ্বরের উত্তাপে প্রিমা স্বেদজলে সিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আরশিয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস প্রিমার পেলব ত্বকে দহন সৃষ্টি করছে। আরশিয়ানের নির্বিকার ভাবটা মানতে না পেরে ইশতিরাজকে কল দিলো প্রিমা। অপর পাশ থেকে সবটা শুনে ইশতিরাজ বলল,
–” ডোন্ট ওয়ারি রুপানজেল। ওই হতচ্ছাড়ার ভাল্লুক জ্বর এসেছে। একটু পর দেখবে শরীর ঘামিয়ে জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। তোমার শান্তি আর আমার কোয়ালিটি টাইম নষ্ট করার ধান্দা এসব। ওই বান্দরকে বেশি লাই দিয়ো না বুঝলে? ”
চিন্তা মাঝেও ফিক করে হেসে দেয় প্রিমা। ইশতিরাজ আরও কিছু টুকটাক নির্দেশনা দিয়ে কল কেটে দেয়। প্রিমা পাক্কা গিন্নীর মতো সামলে নেয় সবটা। অল্প সময়ের মধ্যে আরশিয়ানের শরীরের তাপমাত্রা কমে আসে। প্রিমা স্বস্তির শ্বাস ফেলে আরশিয়ানের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে মনে মনে বলে,
–” আমার সমস্ত আয়ু আপনার হোক। আপনার সমস্ত দুর্ভোগ আমার হোক। সৃষ্টিকর্তা ভীষণ ভালো রাখুক আপনাকে। আজীবন আমার সভ্য চৌধুরী হয়েই থাকুন। ”
_
গোধুলী লগ্নের শেষ প্রহর। ভ্যাপসা গরম অনুভূত হতেই ঘুমটা আলগা হয়ে আসে আরশিয়ানের। পাশ ফিরে চোখ মেলতেই দেখে প্রিমা অনুপস্থিত। ভ্রু কুঁচকে পুরো ঘরে চোখ বুলাতে গিয়ে তার নজর আঁটকায় বারান্দায় দৃশ্যমান প্রিমার শাড়ির আঁচলের দিকে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে আড়মোড়া ভেঙে প্রিমার বালিশে মুখ গুঁজে মেয়েলি সুঘ্রাণটা খুব সন্তপর্ণে নিজের ভেতর টেনে নেয় আরশিয়ান। বিড়বিড়িয়ে বলে,
–” অপূর্ব….
কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে বেলকনির দিকে পা বাড়ায় আরশিয়ান।রেলিঙের উপর গা এলিয়ে বৃষ্টিস্নানে ব্যস্ত প্রিমার লতানো দেহাবয়ব দেখে থমকে যায় বেচারা। প্রবল তৃষ্ণা অনুভব করলো অকস্মাৎ। ফাঁকা ঢোক গিলে প্রিমার বৃষ্টিসিক্ত অধরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আনমনে শুধায়,
–” অবেলায় বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো? যদি অসুখ করে? ”
আকস্মিক প্রশ্নে কিছুটা চমকালো প্রিমা। বৃষ্টির তোড়ে ঝাপসা হয়ে আসা চক্ষু পল্লব মেলে অনিমেষ নেত্রে চেয়ে থাকলো শানের দিকে। প্রিমার তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে আরশিয়ান এগিয়ে এসে আলতো করে নিজের উষ্ণ বক্ষে প্রিমার শীতল দেহখানা জড়িয়ে নেয়।
প্রিমা আবারও চমকায়। কাঁধের কাছটায় আছড়ে পড়া আরশিয়ানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তাকে বিচলিত করে তোলে। আরশিয়ান টের পেলো সমস্তটা। তার স্পর্শের শিহরণে থরথর করে কাঁপতে থাকা মেয়েটাকে আরেকটু জ্বালাতন করতে প্রিমার কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে বলে,
–” আমার জ্বরতপ্ত বক্ষপটে কলমিলতার ন্যায় নুইয়ে পড়লেন কেনো? ”
আরশিয়ানের প্রশ্নে লজ্জায় সিঁটিয়ে গেলো প্রিমা। আরশিয়ানের শক্তপোক্ত বাহুডোর খামচে ধরে চোখ খিঁচিয়ে লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে মিনমিনে স্বরে বলল,
–” আপনি আগলে নিবেন জেনে..
আরশিয়ানের নিঃশব্দে হাসলো। প্রিয়তমা স্ত্রীকে শক্ত বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে তার চুলের ভাঁজে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভীষণ সম্মোহনী কন্ঠে ডাকল,
–” আরিস্মিতা? ”
প্রিমা বিস্মিত হলো আকস্মিক সম্বোধন। শানের বক্ষ হতে মাথা তুলে সন্দিহান চোখে চেয়ে প্রশ্নবোধক কন্ঠে শুধাল,
–” আপনি কী আমায় ডাকলেন? এই শব্দটা বড্ড অপরিচিত ঠেকছে..
আরশিয়ান তার চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভীষণ শান্ত সুরে বলল,
— ” এই শব্দের অর্থ হলো মনোমুগ্ধকর। আমার মুখনিঃসৃত প্রশংসা বাক্য শোনার অপেক্ষায় ছিলেন আপনি। সেটার অবসান ঘটাতেই এই তুচ্ছ আয়োজন। ”
প্রিমা খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল। প্রাণোচ্ছল হাসির দেখা মিললো তার ওষ্ঠপুটে। বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বাস নিয়ে আরশিয়ানের বুকে পুনরায় মুখ গুঁজে বলল,
–” সম্বোধনটা বড্ড বেশি পছন্দ হয়েছে আমার। আপনার নামের সাথেও কিঞ্চিৎ মিল আছে সেটা খেয়াল করেছেন? আরশিয়ানের বঁধু আরিস্মিতা.. কী চমৎকার শোনায় বাক্যটা। ”
আরশিয়ানের ঠোঁটের কোণে আবারও স্মিত হাসি ফুটে উঠে। জেনে-বুঝেই তো বহু কসরতের পর নামটা খুঁজে বের করেছে তবে প্রিমার রিয়াকশনে ভীষণ অবাক হয়েছে আরশিয়ান। ক’দিন পরে যেই মেয়ে তার বাচ্চাদের মা হবে সেই মেয়েটাই এখন বাচ্চামি করছে। অবশ্য প্রেগন্যান্সির টুয়েলভ উইক থেকেই প্রিমার মুড সুয়িং এবং উদ্ভট আচরণের নমুনা দেখছে আরশিয়ান। অতি ম্যাচিউর মেয়েটা মাঝেমধ্যে এমন কাজ করে যেটা কল্পনারও বাইরে থাকে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে প্রিমার শরীরে লেপ্টে থাকা ভেজা শাড়ির ফাঁক গলিয়ে উত্তপ্ত হাতে প্রিমার কোমর জড়িয়ে ধরে আরশিয়ান বলল,
–” ভীষণ চমৎকার শোনাচ্ছে বাক্যটা তবে এবার আপনার পরিচ্ছদ পাল্টে নেওয়া উচিত। অসুস্থ হয়ে পড়বেন নয়তো। ”
সুখের সাগরে ভাসতে থাকা প্রিমা নাকমুখ কুঁচকে ভীষণ বিরক্ত কন্ঠে বলল,
–” এই অসাধারণ ঝুম বৃষ্টি ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। পরিচ্ছদ পাল্টানোর কথা শুনে আলসেমি কাজ করছে। একটু পরে যাই? ”
আরশিয়ান বেশ বুঝলো প্রিমার টালবাহানা। তাকে জড়িয়ে ধরে জোর খাটিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” অযুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। এই সময়টা অনেক বেশি সেনসিটিভ প্রেম। আমি যথেষ্ট কনসিডার করেছি তবে আপনারও বোঝা উচিত। ভালোলাগা যদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন কী করবেন? ”
আরশিয়ানের শাসন নীরবে শুনলো প্রিমা। একটুও খারাপ লাগা কাজ করলোনা উল্টো সুখানুভূতির রেশ ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে। আরশিয়ান তাকে ওয়াশরুমে রেখে আলমারির কাছে এসে জরুরি জিনিসপত্র নিতে নিতে বলল,
–” আপনার যদি বেশি অলসতা কাজ করে তাহলে একটু আওয়াজ দিয়েন। বাকি দায়িত্বটা নাহয় আমি পালন করবো। সময় কম জলদিই ভেবেচিন্তে সিধান্ত জানান প্রেম। ”
আরশিয়ানের কথায় লজ্জায় জবুথবু হয়ে গেলো প্রিমা। প্রস্তাবটা নাকচ করে ভদ্র মেয়ের মতো নিজের কাজ সেরে বের হলো। আরশিয়ান তখন কফি ধোঁয়া ওঠা কফির মগে যাবতীয় ইনগ্রিডিয়েন্টস দিতে ব্যস্ত। প্রিমা বেরিয়ে আসতেই সেই দৃশ্য দেখে বলল,
–” আমারও এককাপ কফি চাই। ”
আরশিয়ান কফির মগে ছোট্ট চুমুক বসিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–” আপনার জন্য ক্যাফিন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মন খারাপ করতে হবে না। আমি আপনার জন্য গ্রিন টি বানিয়েছি। হোপফুলি এইটা আপনাকে রিলিফ পেতে সাহায্য করবে। ”
প্রিমা হতাশার শ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে আরশিয়ানের পাশে বসে। গ্রিন টির কাপটা হাতে নিয়ে কিছু বলতে গেলে আচমকা আরশিয়ানের ফোন বেজে উঠে। কলার আইডি দেখে কলটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে শঙ্কিত কন্ঠে হাঁপানো স্বরে তাজরিয়ান বলে উঠে,
–” মেহু নাই ভাই… আমার মেহুকে পাচ্ছিনা। শ্বাস টানতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার অক্সিজেন কোথায় হারালো ভাই? আমি যে মরে যাচ্ছি তাকে ছাড়া। আমার কলিজাকে জলদি এনে দাও ভাইয়া নয়তো এই বিয়োগের ব্যথার বিরহে বিনাশ ঘটবে আমার অস্তিত্বের…
চলবে?