#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
৩৩(প্রথমাংশ)
বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার প্রথম প্রহর। থমকানো পরিবেশের মতোই থমথমে মেজাজে ইশতিরাজের কামরায় জড়ো হয়েছে প্রত্যেকে। সকলের মুখশ্রীতে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এত কড়া প্রটোকল ভেঙে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে পুরো রিসোর্ট তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো ক্লু মিলেনি। এত নিখুঁত ভাবে জলজ্যান্ত একটা মানুষ কে গায়েব করে ফেলা ইম্পসিবল। ঘটনার আদ্যপান্ত জানতে স্পাই ক্যামেরার ফুটেজ চেক করার সিধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সোফায় নিথর ভঙ্গিতে বসে আছে তাজরিয়ান। পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে। তার বুকের ভেতর চলছে প্রলয়ঙ্কারী দাবানল। চোখদুটো জ্বলছে ভীষণ তবুও সে নির্বিকার। স্বচক্ষে নিজের ধ্বংস দেখারঅভিপ্রায়ে হয়তো এতটুকু সাহস জোগাড় করে টিকিয়ে রেখেছে নিজেকে। তার পাশে বসা ইশতিরাজ ফুটেজ চেক করতে ব্যস্ত। আরশিয়ান সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে রেকর্ডেড ফুটেজ গুলো তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করছে।
বিছানায় পাশাপাশি বসে থাকা ফারজানা এবং প্রিমা অনড় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে তাজরিয়ানের ভঙ্গুর পরিণতি। পুরুষ মানুষ ভালোবাসা হারানোর ভয়ে কতটা উন্মাদ হতে পারে সেটা চাক্ষুষে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হতোনা তবে তাজরিয়ানের অবস্থা দেখে খানিকটা ভয় লাগছে তাদের। ছেলেটাকে শ্বাসকষ্টের রোগী মনে হচ্ছে। বসে থাকা সত্ত্বেও শ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় বুকে হাত রেখে চোখমুখ কুঁচকে ফেলছে। নিজেকে আঁটকে রাখতে না পেরে চিন্তিত স্বরে প্রিমা ডাকল,
–” ছোটো ভাইয়া? ”
তাজরিয়ান অনুভূতিহীন চোখে তাকাল অথচ প্রিমা স্পষ্ট অনুভব করলো তার চোখে মিশে থাকা তীব্র অসহায়ত্বের হাহাকার। কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে মনটাকে শক্ত করে নরম গলায় প্রিমা বলল,
–” আমরা মেহুকে জলদিই পেয়ে যাবো ভাইয়া। যদি কেউ তাকে কিডন্যাপ করেও তাহলে নিজের প্রিয় মানুষটাকে বিপদের থাবা থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনাকে লড়াই করতে হবে। যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই যদি ভীতু সৈনিকের ন্যায় আত্নসমর্পণ করেন তাহলে আপনার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকা মেহরিমার কী হবে? ”
প্রিমার কথা শুনে তাজরিয়ানের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। অনায়াসে চোখ দুটো বুঁজে আসলো। পুরো দৃশ্যটা অবলোকন করে আরশিয়ান পেছন থেকে তাজরিয়ানের মাথায় হাত রাখলো।
আচমকা কী হলো কে জানে। তাজরিয়ান চট করে পেছনে ফিরে ছোট্ট শিশুর ন্যায় আরশিয়ানের কোমর জড়িয়ে ধরে হাতের আড়ালে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো। আরশিয়ান থমকে গেলো রীতিমতো। কিছু বলার গিয়েও কন্ঠ রোধ হয়ে আসে তার। চোখের কার্ণিশে জমে উষ্ণ জল। বুকের ভেতর হানা দেয় প্রবল ভয়। কীভাবে সামলাবে এই পাগলা ঘোড়াকে? লাগামহীন ঘোড়াটা যে বড্ড উন্মাদ। সেই কাঙ্ক্ষিত নারী ব্যতীত তাকে আয়ত্তে রাখার সাহস কিংবা সামর্থ্যে যে কারোরই নেই। গভীর শ্বাস টেনে তবুও আরশিয়ান বলে,
–” ভাইয়াকে বিশ্বাস করিস না? আমি এনে দিবো তো মেহুকে। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে ? ”
তাজরিয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে অস্ফুট স্বরে বলে,
–” আমার বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠছে ভাইয়া। আমার পবিত্র ফুলটা কাঁটার আঘাতে অভ্যস্ত নয়। যদি ওই আঘাতেই তাকে জর্জরিত করা হয়.. তখন? ওর ক্ষত-বিক্ষত শরীরের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার সামর্থ্য নেই আমার। ভাবতেই তো দম আঁটকে আসছে.. ওই করুন দৃশ্য আমি সইবো কেমনে ? ”
তাজরিয়ানের আহাজারিতে সকলে বিমুঢ় হয়ে যায়। কারও মুখে রা নেই। ইশতিরাজের চোখজোড়াও পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে আঁটকে রেখেছে কেবল। আরশিয়ান সময় নিয়ে চাপা স্বরে বলে,
–” আগেই হার মানছিস কেনো? কিচ্ছু হবে না মেহুর। ওরা কিছুই করতে পারবে না…
তাজরিয়ান তৎক্ষনাৎ সরে এসে রুদ্ধ কন্ঠে আক্রোশ মিশিয়ে বলল,
–” ওরা কোনো সাধারণ কিডন্যাপারস নয় ভাইয়া। ওরা টে রোরিস্ট। ওরা মানুষ নামের কল ঙ্ক। নির্মমতা রক্তে মিশে আছে ওদের। ওদের জাত, ধর্ম কিংবা বর্ণের কোনো বাঁধা নেই। ওদের কাজই নৃশং সতায় ডুবে থাকা। এতক্ষণ মেহুকে আদৌ বাঁচিয়ে রেখেছে কি-না…
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো তাজরিয়ান। ঠোঁট কামড়ে ধরলো। চোখের ঘনপল্লবে আঁটকে রইল উষ্ণ নোনাপানি। ঘরে উপস্থিত বাকিদের চেহারায় ফুটে উঠে ব্যথাতুর অভিব্যক্তি। একদিকে তাজের পাগলামি অন্যদিকে মেহুর চিন্তা সবমিলিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠে সকলের হৃদয়। কীয়ৎকাল নিঃশব্দে পার হয়। নৈঃশব্দ্যতা ভেঙে আচমকা ইশতিরাজ বলে,
–” তোরা রিসোর্টে ফিরেছিস চারটা বাইশ মিনিটে এরপর তোদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয় লেক পারে। তুই মেহুকে ফেলে ঘরে আসিস এরপর বেরিয়ে মেহু কে আর খুঁজে পাসনি তাইতো? ”
তাজরিয়ান আশান্বিত চোখে চেয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,
–” হুঁ। ”
ইশতিরাজ কপাল কুঁচকে বলে,
–” ফুটেজে দেখাচ্ছে তুই যাওয়ার দশ মিনিট পর মেহু নিজেও ঘরের দিকে গিয়েছে এরপর বাহিরের আর কোনো ক্যামেরায় তাকে দেখা যায়নি। ”
আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
–” তার মানে মেহু কটেজের ভেতর থেকে গুম হয়েছে? টে রোরিস্টেরা কী সামহাও কটেজের ভেতর অবস্থান করছে? ”
ইশতিরাজ কপাল কুঁচকে শুধাল,
–” সেটা কীভাবে সম্ভব? এরকম হলে এটলিস্ট ফুটেজে কিছু ধরা পড়তো। চারিদিকে প্রচুর কড়া সিকিউরিটি বসানো। কোথাও কোনো হাঙ্গামা হয়নি। আমরা কিছু টের পায়নি…
আরশিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” সবই টাকার খেলা। টাকার বিনিময়ে যারা আমাদের সার্ভিস দিচ্ছে…দ্বিগুণ পেমেন্টের বিনিময়ে তারা অন্যের গোলাম হয়ে যাবে না তার কী গ্যারান্টি আছে? স্পাই ক্যামের ফুটেজ হ্যাক করে দৃশ্য ডিলিট করা হয়নি এই বিষয়ে কীভাবে শিওর হবি তুই? শত্রু পক্ষ তোদের থেকে বড় মাপের হ্যাকার নয় তার নিশ্চয়তা আছে? ”
ইশতিরাজের কপালে দ্বিগুণ চিন্তার ভাঁজ পড়লো। আরশিয়ানের একটা কথাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অতিরিক্ত চিন্তায় তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো রীতিমতো। ফারজানার নির্মল মুখশ্রী দেখে ভয় বাড়লো দ্বিগুণ হারে। ফাঁকা ঢোক গিলে কনফিউজড হয়ে বলল,
–” এখন কী করা উচিত আমাদের?”
তাজরিয়ান মৃতপ্রায় প্রাণীর ন্যায় পড়ে আছে সোফার কর্ণারে। প্রিমা এবং ফারজানা ভীষণ উৎকন্ঠা নিয়ে চেয়ে আছে। আরশিয়ান শান্ত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আচমকা রাজের প্রশ্ন শুনে খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে অতঃপর বলল,
–” ড্রোন দিয়ে আপাতত পুরো রিসোর্টে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তল্লাশি চালাতে হবে। এতে লাইফ রিস্ক থাকবে না প্লাস যদি কোনো গড়বড় থাকে তাহলে তা নজরে আসবে। ”
আরশিয়ানের বুদ্ধিমত্তায় ইশতিরাজ খুশি হলো। বসা থেকে উঠে গিয়ে ড্রোন সেটআপ করতে করতে ধীর স্বরে তাজরিয়ানকে বলল,
–” এই সময়টা ভেঙে পড়ার নয় তাজ। আমি জানি প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়টা কত জঘন্য কিন্তু তুই যদি হুঁশ খুইয়ে বসিস তাহলে আমাদের জন্য মেহুকে খুঁজে বের করা ভীষণ কঠিন হয়ে যাবে। উই নিড আওয়ার বেস্ট ফাইটার। প্লিজ কাম ব্যাক। সম্ভব হলে ফুটেজ গুলো চেক দিয়ে ইনফরমেশন কালেক্ট করার চেষ্টা কর। যদি স্পাই ক্যাম হ্যাক করে থাকে তাহলে আমাদের প্রত্যেকের লাইফ রিস্কে আছে এবং খুব সম্ভবত তারা বিরাট কোনো পরিকল্পনার পসরা সাজাচ্ছে। ”
তাজরিয়ান নাড়ল না। একবার চোখ তুলে তাকালও না। মূর্তির মতো বসে রইল স্তব্ধ হয়ে। অধিক শোকে মানুষ যেমন পাথর হয়ে পড়ে ঠেক তেমনই ছিলো তার অভিব্যক্তি। ইশতিরাজের বুক ফেটে যাচ্ছিল অথচ সে নিরুপায়। হার মেনে সে এগিয়ে গেলো নিজের কাজে। মনে মনে উপরওয়ালার কাছে আর্জি জনাতে ভুললো না।
সময় পেরোলো আরও কিছুক্ষণ। ইশতিরাজ এবং আরশিয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ড্রোনের ধারণকৃত দৃশ্য দেখছিলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আচমকা কিছু একটা দেখে তারা হতবিহ্বল হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাজরিয়ানের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটুকু তার চোখের সামনে মেলে ধরে।তাজরিয়ান নজর ফিরিয়ে সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠে। তার অসার হয়ে আসা দেহখানায় যেনো প্রাণ ফিরে আসে। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে ছুটে যায় নিজ ঘরের দিকে। সেই দৃশ্য দেখে হুহা করে হেসে উঠে ইশতিরাজ। আরশিয়ান হতাশার শ্বাস ফেলে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। পুরো ঘটনার আগামাথা কিছুই বুঝলোনা প্রিমা। সে হতবাক কন্ঠে শুধাল,
–” ছোটো ভাইয়া এভাবে দৌড় দিলো কেনো? আর আপনারাই বা হাসছেন কেনো? মেহুকে পাওয়া গিয়েছে? ”
ইশতিরাজ প্রলম্বিত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে,
–” মেহু বারান্দায় সোফার পেছনে বসে দুঃখবিলাস করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটোখাটো মানুষ বিধায় সোফার আড়ালে এবং কর্ণারে থাকা মেহুকে খেয়াল করেনি তাজরিয়ান। এদিকে আমরা বেহুদা এতক্ষণ টেরোরিস্টদের পিন্ডি চটকে আমসত্ত্ব বানাচ্ছিলাম। ”
ইশতিরাজের কথায় চিন্তা ভুলে হেসে উঠে তারা কেবল আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
–” গালি দেওয়া হলো টেরো রিস্টকে অথচ ব্যথা লাগছে তোর। ব্যপারটা কী? ”
ইশতিরাজ মুখটা কালো করে বলল,
–” নো ব্যপার এন্ড পয়েন্ট টু বি নোটেড.. মারদ কো দারদ্ নেহি হোতা দোস্ত। ”
আরশিয়ান বাঁকা হেসে আড়মোড়া ভাঙার ভাঙিতে হাত দুপাশে মেলতে গিয়ে সুকৌশলে একটা পাঞ্চ বসায় ইশতিরাজের চোয়ালে। বলিষ্ঠ হাতের মধ্যম ডোজ খেয়ে ইশতিরাজের মুখ ফুটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। তা শুনে ভ্রু নাচায় আরশিয়ান। রাজ বিড়বিড়িয়ে বলে,
–” রহম করো খোদা। এসব জালিমের নজর থেকে আমার মানইজ্জত বাঁচিয়ে রেখো। আমি তোমার পুণ্য প্লেটেড পাপী বান্দা। আমার চাওয়া-পাওয়া গুলো একটু সুনজরে দেখো। নির্বিঘ্নে বাসর সম্পন্ন হওয়ার ব্যপারটা আপাতত বিশেষ নজরে দেখার অনুরোধ রইল। আমি আবার বেশি লোভী নই তো তাই সীমিত ইচ্ছেগুলোই জানালাম। বাকিটা তোমার মর্জি। ”
পাশে থাকা আরশিয়ান সবটা শুনে বহু কষ্টে হাসি আঁটকে রাখলো। একপলক গল্পে ব্যস্ত প্রিমা এবং ফারজানার দিকে তাকিয়ে এরপর ইশতিরাজে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
–” তোর চাওয়া-পাওয়ার নমুনা দেখে ফেরেশতারাও লজ্জায় লাল, নীল বেগুনি হয়ে যাচ্ছে ফর শিওর। আমি হলফ করে বলতে পারি শয়তানও তোর থেকে সত্তুর হাত দূরে থাকে কারণ ওরা জানে তুই তাদের গ্রেটেস্ট অলটারনেটিভ। ”
কথাটা শুনে মুখ কালো হয়ে আসে ইশতিরাজের। দুঃখী স্বরে বলে,
–” জীবনের বদনায় এক কেজি দুঃখ, দুই কেজি অপমান আর তিন কেজি বেইজ্জতি ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তি নেই..
আরশিয়ান হাসি চাপিয়ে রেখে পুনরায় বলল,
–” বেদনা হিটস ডিফারেন্ট….
চলবে?
#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া_ইমরোজ
৩৩(শেষাংশ)
অল্প সময়ের ব্যবধান কালেভদ্রে অনন্তকালের মতো মনে হয়। তাজরিয়ানের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা তেমনই হয়েছে। ইশতিরাজের ঘর থেকে একদৌড়ে সোজা নিজের কটেজের বারান্দায় এসেছে। এমনভাবে পূর্বে কখনো দৌড়েছে বলে মনে পড়লোনা তার। বারান্দায় এসে সোফাটা এক ধাক্কায় উল্টে ফেলে আড়ালে থাকা মেহরিমাকে থাবা মেরে বুকের খাঁচায় বন্দী করে তাজরিয়ান। আচমকা এমন হওয়াতে ঘুমে বিভোর মেহরিমা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেঁপে উঠে ভীতসন্ত্রস্ত চড়ুই পাখির মতো। বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে হাঁপানো কন্ঠে তাজরিয়ান বলে,
–” বউজান.. ও বউজান। ভয় পাচ্ছিস কেনো সোনা?”
দীর্ঘ সময় কান্নার করার ফলে মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল মেহরিমার। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিলো না বিধায় ফ্লোরেই গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়েছিল। আচমকা আধঘুমন্ত অবস্থায় তাজরিয়ানের হাঁকডাকের ফলে অসুস্থতা ঘিরে ধরে তাকে। পুরো শরীর অনবরত কাঁপতে থাকে। অল্প সময়ের জন্য শ্বাস নিতেও বেগ পোহাতে হয়।
তবে অভিযোগ করার বদলে তাজরিয়ানের বুকে মাথা রেখে তার বাহুতে সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে রাগে দুঃখে কান্না করে ফেলে বেচারি। তাজরিয়ান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বলে,
— ” হুঁশ.. কাঁদে না মেহু। স্যরি সোনা.. আর একটুও বকবো না তোকে। বড্ড বেশি অভিমান হয়েছে? ”
মেহরিমা কথা বলে না। তাজরিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে। তাজরিয়ান অস্থির হয়ে পড়ে। মেহরিমার শারিরীক অবনতি টের পেয়ে দ্রুত তাকে ঘরে নিয়ে যায়। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঝটপট একগ্লাস গ্লুকোজ বানিয়ে আনে। মেহরিমা মুখ ফিরিয়ে নিলে তাজরিয়ান জোরপূর্বক সবটুকু পান করায় অতঃপর বুকের সাথে চড়ুইপাখির মতো নরম শরীরটা জড়িয়ে নিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলে।
মেহরিমা দুর্বল হাতে বাঁধা দিলেও তাজরিয়ান মানতে নারাজ। কীয়ৎকাল পর মেহরিমার ছুটোছুটি বন্ধ হতেই তাজরিয়ান গম্ভীর স্বরে বলে,
–” ওখানে লুকিয়ে বসেছিলি কেনো ?”
মেহরিমা ভাঙা স্বরে জবাব দেয়,
–” লুকাতে যাবো কোন দুঃখে? আপনার থেকে পালিয়ে নিস্তার পাবো আমি? আমার মতিভ্রম হয়নি যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে যাবো। ”
মেহরিমার কন্ঠে ঝরে পড়ছে অভিযোগ। নাকের ডগাটা কান্নার ফলে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। মুখের সর্বত্র গোলাপি আভা বিদ্যমান। রাগের চোটে ফোঁস ফোঁস করছে রীতিমতো। তাজরিয়ান মুগ্ধ চোখে চেয়ে আনমনে বলে,
–” ঠিক বলেছিস। ”
মেহরিমার নিকট অসহ্য ঠেকে সেই স্বীকারোক্তি। চওড়া মেজাজে বলে,
–” আমি তো আপনার হাতের পুতুল। ঠিক না বললে কখন আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে দিবেন তার নিশ্চয়তা আছে? জানের ভয়ে হলেও তো সঠিকটা বলতে হবে। ”
মেহরিমার তাচ্ছিল্য ভরা মন্তব্য শুনে তাজরিয়ান ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে। প্রশ্ন বোধক চোখে চেয়ে বলে,
–” কী বললি? জানের ভয়? আমার উপস্থিতি তোর জন্য হুমকিস্বরূপ? ”
মেহরিমা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
–” বলার কিছুই নেই তাজ। সত্য সবসময় তেঁতো হয়। প্লিজ এখন ভিক্টিম কার্ড প্লে করবেন না। আমি জানি আপনি আমার ভালোর জন্য সব করেন। আপনি মহান কিন্তু কখনো এটা ভেবে দেখেছেন, আমি কী চাই? আমার কী ইচ্ছে? ”
তাজরিয়ান হাতের বাঁধন আলগা করে উঠে বসে। সরাসরি মেহরিমার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
— ” তুই কী বলছিস তুই জানিস? ”
মেহরিমা নিজেও তড়াক করে উঠে তাজরিয়ান এর মুখোমুখি বসে রক্তাভ চোখে চেয়ে কম্পিত স্বরে বলল,
–” আলবাত জানি। আমি কোনো ছোটো বাচ্চা নই তাজ। আমি একজন এডাল্ট পারসন। নিজের জীবনের সিধান্ত নেওয়ার মতো অধিকার আমারও আছে। আপনার রেস্ট্রিকশন মেনে সবসময় নিজের শখ আহ্লাদ ত্যাগ করতে পারবোনা আমি। ফর গড সেক,আমাকে একটু শ্বাস নিতে দিন। আপনার পাগলামি দিনকে দিন সীমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমি জাস্ট হাঁপিয়ে উঠেছি৷ ”
তাজরিয়ান অপলক চোখে চেয়ে দেখলো তার প্রিয়তমার বিরক্তি প্রকাশ। এবার কেনো যেনো রাগলো না। ভীষণ শান্ত চোখে চেয়ে বলল,
–” মুক্তি চাইছিস? ”
মেহরিমা থমকে গেলো আচমকা। বিস্মিত দৃষ্টি ফেলে হড়বড়িয়ে বলল,
–” ফালতু কথা বলবেন না একদম। আমি এমন কিছুই মিন করিনি। আমি বলেছি একটু নরমাল আচরণ করতে। সব বিষয়ে এক্সট্রিম পজেসিভনেস আমার ভালো লাগে না। খুঁটিনাটি বিষয়ে অনধিকার চর্চা করাটা আমার পছন্দ নয়। তবুও মেনে নিচ্ছি মানিয়ে নিচ্ছি। আপনার সব সিধান্ত শিরোধার্য কিন্তু আমার চাওয়া-পাওয়া মূল্যহীন.. এই ব্যপারটা আমি মানতে পারছিনা। ”
তাজরিয়ান এবারও রিয়েক্ট করলো না। শীতল স্বরে কেবল শুধালো,
–” আমার চাইতেও আমার ঔরসজাত অস্তিত্বের গুরুত্ব বেশি? ”
মেহরিমা যেনো রাগে হুঁশ খুইয়েছে। তাজরিয়ানের কথাটা শোনামাত্রই তেঁতে উঠে বলে,
–” একদম ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না। আপনি খুব ভালোমতো জানেন উত্তর তবে এমুহূর্তে আমার প্রায়োরিটি লিস্টে আপনার অস্তিত্বের অবস্থান শীর্ষে। ”
তাজরিয়ান আচমকা হেসে ফেললো। শ্লেষাত্মক হাসিটা মেহরিমার বুকে ঝড় তুললো। তাজরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল বুঝলি। বড় মানুষ তো এজন্যই বেশি বুঝে ফেলেছি। তোর মতামতকে অগ্রাহ্য করাটা আসলেই উচিত হয়নি। ক্ষমা করে দিস কেমন? ”
খানিকটা থেমে নির্জীব চোখে চেয়ে আবারও বলল,
–” তোর ক্ষোভের পাল্লা হালকা করা যাক। ”
কথাটা বলে একমুহূর্ত অপেক্ষা করলো না তাজ। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড ল্যাম্পটা বন্ধ করে নিজের ভুল শুধরে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। হতবিহ্বল মেহরিমা টের পেলো তাজরিয়ানের স্পর্শে কোনো উন্মাদনা নেই। নেই কোনো ভালোবাসা। যা আছে তা কেবলই উপেক্ষিত শীতলতা। তার প্রত্যেকটা স্পর্শ স্পষ্ট জানান দিচ্ছিলো প্রবল দায়িত্ববোধের। ঘন্টা দুয়েক পর তাজরিয়ান যখন তাকে ছেড়ে উঠে গেলো তখন মেহরিমা আনমনে বলে উঠল,
–” সংসার বাঁচাতে গিয়ে আপনাকে হারিয়ে ফেললাম না তো? ”
যারা চমৎকার মন্তব্য রাখেন তাদের জন্য হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসা এবং সম্মান জানানো হলো। আপনাদের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য। 🖤🥀]
_
সন্ধ্যালগ্ন প্রহর। পাশাপাশি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিল ফারজানা এবং ইশতিরাজ। শেষ রাকাআতে সালাম ফেরাতেই ফারজানার স্নিগ্ধ মুখটা দেখে প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় রাজের অন্তঃকরণ ফারজানা তখন মোনাজাতে মগ্ন ছিলো। ইশতিরাজ জায়নামাজ গুটিয়ে সাইডে রেখে ফ্লোরে বসে থাকে।ক্লান্তিহীন চোখে অপলকভাবে চেয়ে দেখে তার প্রিয়তমাকে।
ফারজানার মোনাজাত শেষ হতেই ইশতিরাজ বাচ্চাদের মতো ফারজানার কোল দখল করে শুয়ে পড়ে। ফারজানা দোয়া পড়ে ইশতিরাজের মাথায় ফু দিয়ে দেয় অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলে,
–” কী হয়েছে জনাবের? ”
ইশতিরাজ বলিষ্ঠ হাতে পেঁচিয়ে ধরে ফারজানার কোমর অতঃপর তার উদরে মুখ গুঁজে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
–” আপনি আমায় ভীষণ বিশ্বাস করেন তাইনা? ”
ইশতিরাজের কান্ডে প্রথমেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল ফারজানা তবে পরবর্তী প্রশ্নে তার ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হয়। ইশতিরাজের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–” জ্বী। হঠাৎ এই প্রশ্ন? ”
ইশতিরাজ খানিকটা থেমে ম্লান স্বরে শুধাল,
–” যদি কখনো জানতে পারেন,যেই হাত আপনি ভরসার সহিত আঁকড়ে ধরেছেন সেই হাত কলুষিত.. তখন কী করবেন আপনি? ”
ফারজানা ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে শান্ত করে ইশতিরাজের বাহুতে হাত রেখে বলল,
–” এই হাতজোড়ার মালিকের মন কতটা স্বচ্ছ সেটা আমার অজানা নয়। আমি কারণ শুনবো, গল্প জানবো অতঃপর নাহয় সিধান্ত নিবো। ”
ইশতিরাজ হতবাক হয়ে ফারজানার কোমর ছেড়ে তার চোখের দিকে তাকাল। ফারজানার স্বচ্ছ, নির্মল এবং কোমল দৃষ্টি দেখে ইশতিরাজের বুক কেঁপে উঠল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল,
–” আমার ভয় করছে। ভুল বুঝবেন না তো? যদি ভেঙে পড়েন? আপনার চোখে এতদিন শিরোনামহীন অনুভূতি দেখেছি… ওই চোখজোড়ায় আতঙ্ক দেখার সাধ্যি আমার নেই। ”
ফারজানা তার দিকে ঝুঁকে কপালে আলতো করে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল,
–” ঝটপট বলে ফেলুন। মনে করুন আপনার সামনে বিচারক নয় বরং আপনার পক্ষের উকিল বসে আছে।”
ইশতিরাজ উঠে বসল। ফারজানার চোখে চোখ রেখে নোংরা অতীতের ভয়ংকর বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব প্রায়। ফারজানার পাশে বসে বেডের সাথে হেলান দিয়ে ইশতিরাজ বলতে শুরু করল,
–” আমার আম্মা ছিলেন শ্যামস্নিগ্ধা। রঙের দিক দিয়ে শ্যামলা হলেও তিনি ছিলেন অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারিণী তবে এই রুপই উনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ ১৯ বছরের সংসারে বাবা নামক প্রাণীটা একটুও সম্মান কিংবা ভালোবাসা দেয়নি আমার মা’কে। কেবল নিজ চাহিদা আর স্বার্থে ব্যবহার করে গেছে। ”
কথাগুলো বলতে গিয়ে ইশতিরাজ এলোমেলো হয়ে যায়। তার কন্ঠে প্রতীয়মান হয় কম্পন। জড়িয়ে আসে কথা। সবটা বুঝতে পেরে ফারজানা তাকে সামলে উঠার জন্য খানিকক্ষণ সময় দেয়। নিজে উঠে গিয়ে ঘরের লাইট বন্ধ করে। টেবিলের উপর থাকা ক্যান্ডেল হোল্ডারে পরপর ছয়টা ক্যান্ডেল জ্বালাতেই ঘরটা মোহনীয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে। থম মেরে বসে থাকা ইশতিরাজের পানে একবার তাকিয়ে এক গ্লাস পানি এনে তার সামনে ধরে। ইশতিরাজ বাক্য ব্যয় না করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটুকু সাবাড় করে। ফারজানা তার পাশে বসে তার বাহুতে মাথা রেখে এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–” আমি আছি তো…
ইশতিরাজের বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ম্লান হেসে ফারজানার হাতের পৃষ্ঠে মৃদু চুম্বন এঁকে দিয়ে পুনরায় বলে,
–” তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ”
অনাকাঙ্ক্ষিত সম্বোধনে ফারজানা চমকালো ভীষণ তবে মুখ ফুটে এক শব্দও উচ্চারণ করলোনা। দম ফেলে ইশতিরাজ পুনরায় বলতে শুরু করল,
–” আমার আম্মা ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান তবে গায়ের রঙ কিছুটা চাপা হওয়ায় সুপাত্রের সন্ধান মিলছিলো না। মিললেও নানা জানের কাউকে পছন্দ হচ্ছিলো না। আমার লোভী দাদা মশাই এই সুযোগ লুফে নিতে ভুল করেননি। তার বিলেত ফেরত সুদর্শন ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখেন নানা জানের কাছে। বাবা দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিলেন তার উপর পেশায় ছিলেন ডক্টর। সবমিলিয়ে নানা জানের ভীষণ পছন্দ হয় উনাকে। নিজের একমাত্র মেয়েকে অজান্তেই তুলে দেন এক নরপশুর হাতে। ”
এতটুকু বলে সামান্য থামলো ইশতিরাজ। ফারজানার মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,
–” আম্মার বিয়ের সময় দাদা মশাই যৌতুক হিসেবে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে নিয়েছিলেন বাবার নামে। নানা জান বিশেষ আপত্তি করেননি কারণ উনি ভাবতেন বাবা একজন দায়িত্ববান পুরুষ। নানার এই ধারণা পাল্টে যায় যখন উনি জানতে পারেন আমার আম্মা বিয়ের প্রথম রাতেই তার স্বামী নামক আসামির দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন। আম্মার অবস্থা শুনে ছুটে আসেন নানাজান। বিচারসভা বসে। আম্মা লজ্জায় সেই আসরে উপস্থিত হননি। বাবা নামক ব্যক্তিটা ছলের আশ্রয় নিয়ে নানান বানোয়াট কথা বলে পার পেয়ে যায় সেবার । দাদা মশাই এর চতুরতা তাকে সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয়। তবে তাদের আপোষের পেছনের কারণটা ছিলো বড্ড ভয়াবহ।
নানা জানের সম্পত্তির উইল ছিলো কিছুটা অদ্ভুত।সেখানে উল্লেখ ছিলো, যদি উনি কাউকে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার পূর্বে মৃত্যু বরণ করেন তবে সম্পূর্ণ অর্থ সম্পদ ফান্ডে চলে যাবে। আম্মার মাধ্যমে বাকি অর্ধেক সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার তাগিদে তারা নানা জানকে আশ্বস্ত করে। এরপর আম্মার জীবনে কিছু স্বাভাবিক দিন পার হয়। স্বামীর ভালোবাসা কিংবা যত্ন না থাকলেও মারামারি অথবা গালিগালাজের সম্মুখীন হতে হয়নি উনাকে। বাবা ছিলেন ভবঘুরে। ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করলেও পেশা হিসেবে সেটা গ্রহণ করেননি। সংসারের প্রতি মোহমায়া ভুলে নিজের মতো দিন দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি আর শ্বশুর বাড়ির যাঁতাকলে পিষ্ট হতো আমার আম্মা।
নিয়তি বোধহয় একটু সদয় হয়েছিলো। বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। চৌধুরী বাড়ির প্রথম প্রদীপ ছিলাম বলে বেশ খাতির যত্ন পেতাম। আম্মাকেও কাজের মহিলা থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। তবে আমার জন্মের পর বাবার মাঝে বিশেষ কোনো পরিবর্তন না আসলেও কিছুটা দায়িত্ববান হয়েছিলেন তিনি। আফসোস কোথায় জানো? আমার মুখ তাকিয়ে হলেও আমার মা’কে তিল পরিমাণ সম্মান কিংবা ভালোবাসা উনি দিতে পারেননি। ”
ইশতিরাজের গলার স্বর ভারী শোনায়। ফারজানা দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে বলে,
–” বেশি কষ্ট হলে বাকিটুকু থাক। পরবর্তীতে নাহয় আবার শুনাবেন।”
ইশতিরাজ তাকে কোলের উপর বসিয়ে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলে,
–” মানুষ ভাবে আমি ভীষণ স্ট্রং কিন্তু আদতে আমি একজন উইক হার্টেড পারসন। বহুকষ্টে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আজ বলতে না পারলে জীবনে আর কখনো এই সত্য কনফেস করতে পারবো কি-না জানা নেই। আমি জানি আমার ভঙ্গুর অবস্থা তোমায় কষ্ট দিচ্ছে… তবে এই কথাগুলো কারও সাথে শেয়ার করতে না পারার ব্যর্থতায় আমি রোজ গুমরে মরি। আজকে আমায় থামিয়ো না প্লিজ। এই জঘন্য যন্ত্রণার দায়ভার বইতে বইতে আমি ক্লান্ত এবার সবটা তোমার নিকট হস্তান্তর করে আমি অবসর নিবো। ”
ফারজানা স্পষ্ট টের পায় ইশতিরাজের উন্মাদনা। দম আঁটকে আসে তার। এই প্রাণোচ্ছল লোকটা এরকম দগদগে ঘা বয়ে বেড়াচ্ছে সেটা আন্দাজও করতে পারেনি ফারজানা। ইশতিরাজের মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে দিয়ে ফারজানা ধীর কন্ঠে বলে,
–” আমি শুনছি..
ইশতিরাজ কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে বলতে শুরু করল,
–” আমার বয়স আনুমানিক যখন দশমাস তখন নানাজান গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বলা চলে একপ্রকার মৃত্যুশয্যায় ছিলেন তিনি। আম্মা খবর পেয়ে ছুটে যেতে চান কিন্তু উনাকে আঁটকে দেওয়া হয়। শর্তস্বরুপ বলা হয়, যদি আম্মা বাকি অর্ধেক সম্পত্তি নিজের নামে ট্রান্সফার করতে না পারেন তবে আব্বার সংসারের মায়া উনাকে ত্যাগ করতে হবে। আম্মা প্রথমে রাজি হননি.. ফলস্বরূপ আমার দাদিজানের নিকৃষ্ট নির্যাতনের স্বীকার হোন। বাবার মুখের দিকে চেয়েছিলেন মুক্তির আশায় কিন্তু উনি কোনো পদক্ষেপ নেননি উল্টো আমাকে কোলে তুলে ঘরে এসে ঘুৃমের জগতে বিভোর হয়ে যান।
নানান পারিপার্শ্বিকতা চিন্তা করে আম্মা বাধ্য হয়ে রাজি হোন। দুর্বল শরীরে কঠোর মার কতক্ষণ সহ্য করা যায়? দিন তিনেক পর ক্ষতবিক্ষত শরীরটা নিয়ে আম্মা ছুটে যান নানাজানের কাছে। আমার নানাজান ছিলেন ধূর্ত মানুষ। সমাজে বিদ্যমান সম্মান এর কথা ভেবে মেয়ের গায়ে ডিভোর্সি তকমা লাগতে না দিলেও মেয়েকে দূর থেকেই সেইফ রেখেছিলেন তিনি। তবে সেদিনকার মারের দাগ গুলো দেখে নিজের ভুলটা স্পষ্ট ভাবে বুঝেছিলেন। আম্মার থেকে সবটা শুনে নানাজান বাকি সম্পত্তি রাতারাতি আমার নামে লিখে দেন এবং শর্ত দেন যে আমার ভবিষ্যত সন্তান ছাড়া এই সম্পদের মালিকানা কেউই পাবে না।
এমন অদ্ভুত উইল শুনে আমার বংশের লোকজন বেজাশ ক্ষিপ্ত হয় তবে তারা ধৈর্য হারায়নি। তাদের ধারণা ছিলো আমি সাবালক হওয়ামাত্র বিয়ে দিয়ে এই উইলের ঝামেলা মিটিয়ে নিবেন। তবে সকলের একটা চাপা ক্ষোভ থেকে গিয়েছিল আমার মায়ের প্রতি। সকলেই অদ্ভুত ভাবে আম্মাকে একঘরে করে দেয়। আম্মা মনোবল হারানোর বদলে ভীষণ খুশি হয়েছিল তাতে। এরমধ্যেই শোনা যায় দুঃসংবাদ। আমার নানাজান ইন্তেকাল করেন। আম্মা ভীষণ ভেঙে পড়েন এই ঘটনায়। তবে সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।
দিন পেরোতে থাকে। বাড়তে থাকে চৌধুরী বংশের কালো টাকার পাহাড়। তারা প্রত্যেকে নানান ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলো। আমাদের পরিবার জয়েন্ট ফ্যামিলি হওয়ায় সকলে একত্রে বসবাস করতো। মজার বিষয় হলো, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার আম্মা আরও বেশি অবহেলিত হতে থাকে। দাসীর থেকেও জঘন্যভাবে ট্রিট করা হতো উনাকে। আমার বয়স যখন সাতবছর তখন আমাকে বোডিং স্কুলে দিয়ে দেওয়া হয় ফলস্বরূপ আম্মা একা হয়ে পড়ে। এই সময়ের সুযোগ নিয়ে আমার আম্মার উপর নির্দয় ভাবে নির্যাতন চালাতো তারা। আমি বাসায় গেলেও আম্মা এসব কখনো শেয়ার করতেন না উল্টো নিরবে সয়ে যেতেন সবকিছু। ভাবতেন এক দিন বাবা মুখ ফিরিয়ে তাকাবে। একটু হলেও উনাকে ভালোবাসবে। তবে সেসব কিছু দিবাস্বপ্ন হয়ে থেকে যায়।
আমার বয়স যখন বারো বছর তখন আমার দাদি মারা যায়। আম্মার উপর অত্যাচার করার মতো একটা মানুষ কমে তবে বাবা ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেন। তিনি আম্মাকে দোষারোপ করতেন। বলতেন, আম্মার অবহেলার জন্য দাদি ছেড়ে গেছে। আম্মা সরব কন্ঠে প্রতিবাদ করলেও সেসবে কর্ণপাত করেনি বাবা। এই ঘটনার পর উনাদের মাঝে দূরত্ব বাড়ে। আগে মাস অন্তর বাসায় ফিরলেও এরপর থেকে বছরের পর বছর বাহিরে থাকতেন। আম্মা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন অবজ্ঞার জীবনে। সময় পেরিয়ে যায় তার আপন গতিতে। আমি স্পষ্ট বুঝতাম আম্মার অবস্থা তাই নিজের বাড়ির মানুষ গুলোর প্রতি অগাধ ক্ষোভ জন্মে আমার মনে। আম্মার হৃদয়বিদারক কথা, শরীরের কালশিটে দাগ সবকিছু আমার ভেতরটা পুড়িয়ে ছারখার করে দিতো কিন্তু ও-ই সময় আমার করার কিছুই ছিলো না। পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কিংবা সেই রাজ্য ত্যাগ করার সক্ষমতা ছিলো না বলেই আজ আমি এতিম।
ফারজানা তার কাঁধে উষ্ণ নোনাপানির আভাস টের পায়। বুকটা মুচড়ে উঠে তার। অবহেলা আর অবজ্ঞার দহন কতটা ভয়াবহ সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইশতিরাজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলে,
–” জন্ম মৃত্যু বিয়ে.. এই তিনটা বিষয় সৃষ্টিকর্তার হাতে থাকে। আপনি কিংবা আমি হাজার চেষ্টা করেও নিয়তির লিখন খন্ডাতে পারবোনা। প্লিজ নিজেকে দোষারোপ করবেন না। ”
ইশতিরাজ উত্তর দিলো না। তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিলো। লম্বা শ্বাস ফেলে পুনরায় বলতে শুরু করল,
–” ঈদের দিন ছিলো সেদিন। বাসায় ভর্তি মেহমান তবে আমি ছিলাম বাহিরে। ঈদের আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত ছিলাম তবে আসন্ন শঙ্কাটা আঁচ করতে পারিনি।ঈদ পবিত্র একটি উৎসব অথচ এই সুদিনে ঘটে যায় এক অশুভ ঘটনা। যথারীতি আমার নিকৃষ্ট পিতা সেখানে ছিলেন তবে তিনি নিজের স্ত্রীর সম্মান বাঁচাতে পারেননি। আমার বড় ফুপুর হাসবেন্ডের কুনজর পড়েছিল আম্মার উপর ফলস্বরূপ তিনি নিজ বাড়িতে নিজের ঘরে নিজের ঘরের মানুষ দ্বারা কলঙ্কিত হোন। আম্মা অভিযোগ জানিয়েছিলেন কিন্তু কেউ গ্রাহ্য করেনি উল্টো তারা আম্মাকেই দোষারোপ করে।
আম্মাকে জঘন্য ভাবে মারধর করে আমার ফুপু। একজীবনে হাজার লাঞ্ছনা, অপমান, অবজ্ঞা সহ্য করা মানুষটা নিজের সম্ভ্রমহানীর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেনি। মারার পর ড্রয়িংরুমেই ফেলে রাখা হয় আম্মাকে। কেউ না আসেনি তার কাছে। আম্মা সারাটারাত আর্তনাদ করেছে, জ্বরে কাতরেছে তবে শেষ মুহূর্তে বোধহয় সৃষ্টিকর্তার একটু দয়া হয়েছিল। আমার আম্মাকে খুব বেশি কষ্ট উনি দেননি। পরদিন সকালে আমার আম্মার একতরফা সংসারের সমস্ত দায়িত্ব শেষ হয় এবং মুক্তি মেলে চিরতরে। জাহিলের স্ত্রীর তকমাটা মুছে যায়। সাদা কাফনে মোড়ানো হয় তার অবিচল দেহ। ডক্টরের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হয় তার।
খবরটা আমার কানে পৌঁছানো মাত্র উন্মাদের মতো উপস্থিত হই বাড়িতে তবে…ততক্ষণে আমার আম্মা এই দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে হারিয়ে গেছে বহুদূরে। আমি যখন স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় আমার আম্মার খাটিয়ার পাশে বসে ছিলাম তখন বাড়ির সদস্যরা ব্যস্ত ছিলো ভর্ৎসনা শুনাতে। আমার বড় ফুপু এবং তার স্বামী তখন ভিক্টিম সাজতে ব্যস্ত তবে সমস্ত সত্য শোনার পর আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। পশু কুরবানি করার জন্য বেশ কিছু ধারালো অস্ত্র রাখা ছিলো ডাইনিং টেবিলের উপর। সেখান থেকে একটা তুলে নিয়ে গিয়ে পরপর দুইটা কোপ বসিয়ে ছিলাম ওই নরপশুর বুকে।
ফুপু তাকে ধরতে আসলে এক কোপে তার হাতের কব্জি আলাদা করে ফেলি। দুজনকেই পরপর কয়টা আঘাত করে মৃত্যুর ঘাটে নামিয়ে দিই। সকলে বহু চেষ্টা করেছিল থামানোর কিন্তু সম্ভব হয়নি। আমি বাড়ির একমাত্র প্রদীপ হওয়ায় দাদার বেশ আদরের ছিলাম। তিনি চাননি আমি মার্ডার কেসে ফেঁসে যায় ফলস্বরূপ ভীষণ তাড়াহুড়ো করে আমায় লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের মৃত্যু এখনো অমীমাংসিত কেস আর আমি ফেরারি আসামি।
কথা শেষ হতেই ইশতিরাজ থেমে যায়। ক্ষানিকটা সময় পেরোলে ও ফারজানার সাড়া না পেয়ে তাকে নিজের সম্মুখে নিয়ে আসে। অনুভব করে মেয়েটা কেমন যেনো স্তব্ধ হয়ে আছে। ইশতিরাজ তাকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাকলে ফারজানা স্তম্ভিত স্বরে শুধায়,
–” আম্মাকে কেনো ভালোবাসেননি উনি? একসাথে থাকলে পশুর প্রতিও তো মায়া জন্মায়। আম্মা তো উনার অর্ধাঙ্গিনী ছিলো তাহলে?”
ইশতিরাজ ম্লান হেসে বলে,
–” শুনেছিলাম বাবা অন্য কাউকে পছন্দ করতো ইভেন ভীষণ রকমের ভালোবাসতো তবে দাদা মশাই নিজের স্বার্থ বিবেচনা করতে গিয়ে তাকে বাধ্য করে নিজের প্রথম প্রেমকে ভুলে যেতে। আব্বা নাকচ করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে দাদা মশাই সেই মহিলাকে তুলে এনে নৃশংস ভাবে খুন করে এবং গুম করে ফেলে। ওই মহিলাকে কোথায় কবরস্থ করা হয়েছে এই সত্যটা জানার জন্য আব্বা বাধ্য হয়ে আম্মাকে বিয়ে করে এবং বংশের প্রদীপ এনে দেয়।
লোকমুখে শুনেছি, বাবা সেই কবরের কাছে টিনের ঘর তুলে সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরখানেক সময় থাকতেন। ”
ফারজানা শিউরে উঠে বলে,
–” কী আশ্চর্যের বিষয় তাই না? আম্মা উনার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও উনার ভালোবাসা পেলোনা অথচ ওই নারী প্রেমিকা হওয়ার পরও আব্বার সমগ্র হৃদয় জুড়ে কেবল তারই বসবাস ছিলো। ”
ইশতিরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
–” এটার জন্য বাবাকে বিরাট মূল্য চুকাতে হয়েছে।
ফারজানা চোখ তুলে অবাক কন্ঠে শুধায়,
–” কীসের মূল্য? ”
ইশতিরাজ অনুভূতিহীন কন্ঠে বলে,
–” আম্মার মৃত্যুর পর বাবার সাথে একটা বারও কথা বলেনি আমি। ইভেন উনার মৃত্যুর আগেও আমাদের মাঝে কোনোপ্রকারের কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। উনি ভীষণ অনুতপ্ত ছিলেন। মৃত্যু শয্যায় থাকার সময় নানানভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন কিন্তু আমি রেসপন্স করিনি। উনার শেষ চাওয়া ছিলো, আমি যেনো উনার দাফনকাজে অংশগ্রহণ করি অথচ আমি দেশেই যায়নি। উনার মুখটা শেষ বারের মতো দর্শন করিনি। আমার কাঁধে উনার লাশের খাটিয়া উঠেনি। অবহেলার দহন কতটা নির্মম সেটা একটু হলেও অনুভব করিয়েছি আমি উনাকে। ”
ফারজানা হতভম্ব চোখে দেখে তার পাষাণ পুরুষকে। কতটা ঘৃণা জমলে মানুষ এতটা আতাত হয় সেটা স্পষ্ট টের পেলো ফারাজানা। ইশতিরাজের চোখে মুখে লেপ্টে থাকা বিষন্নতা জানান দিচ্ছে তার ভেতরে চলমান তান্ডবলীলার। ফারাজানা কোনো কিছু না ভেবে ইশতিরাজের গ্রীবাদেশে হাত রেখে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে ধীর স্বরে বলে,
–” তাদের কর্মের তুলনায় আপনার প্রদানকৃত শাস্তি অতি নগন্য। আমি আপনাকে একদমই ভুল বুঝতে পারছিনা উল্টো আমার গর্ব হচ্ছে আপনার প্রতি। ”
ফারজানার স্বীকারোক্তিতে ইশতিরাজের বুকের উপর থেকে দুশ্চিন্তার পাহাড়টা সরে যায়। নিজেও ফারজানার গালের দুপাশে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে,
–” ভালোবাসি…
ফারজানা কেঁপে উঠে কিঞ্চিত। প্রত্যুত্তর করতে পারে না। ওদিকে ইশতিরাজের নেশাতুর দৃষ্টি আঁটকে যায় ফারজানার কম্পনরত অধরে। ইঞ্চি খানেকের দূরত্ব ঘুচিয়ে ইশতিরাজ আলতো করে আঁকড়ে ধরে তার প্রেয়সীর অধরোষ্ঠ। সময়ের পরিক্রমায় বাড়তে থাকা ইশতিরাজের উগ্র চুম্বনে তার বক্ষস্থলে গুটিয়ে থাকা ফারজানা রীতিমতো ছটফটিয়ে উঠে।
মস্তিষ্ক শ্বাস আঁটকে আসার সংকেত পাঠালে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরানোর চেষ্টা করে ইশতিরাজকে। ভ্রুক্ষেপহীন ইশতিরাজ নির্বিকার ভাবে তার প্রগাঢ় স্পর্শ লেপ্টে দিতে থাকে ফারজানার রক্তাভ ওষ্ঠে। বেচারির নিঃশ্বাস আঁটকে আসতে দেখে আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে সরে এসে স্পষ্টভাবে ঘোর লাগা কন্ঠে ইশতিরাজ ব’লে উঠে,
— ” তোমার লাগামহীন হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ আমার সংযমকে বাঁধনছাড় করে দিচ্ছে সুরঞ্জনা। আমার সমস্ত ধৈর্য ভেঙে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে তোমার নৈসর্গিক সৌন্দর্য। আমি নিরপেক্ষ থাকি কিভাবে? ”
ইশতিরাজের তুমি সম্বোধনে ভালোলাগার আবেশ ছেয়ে যায় ফারজানার হৃদয়ে।সুযোগ বুঝে কথার ভাঁজে খুব সন্তপর্ণে ফারজানার শাড়ির আঁচলটা আলগা করে ফেলে ইশতিরাজ। মন্থর ল’য়ে মুখটা নামিয়ে কাঁধের পাশে মুখ গুঁজে দিতেই শিউরে উঠে ফারজানা। হাতের মুঠোয় খামচে ধরে রাজের চুলের অংশবিশেষ। রাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। শায়িত ফারজানার চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সুবিন্যস্ত ভাবে শার্টের বাটন খুলতে থাকে। ফারজানা সলজ্জিত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিলে ইশতিরাজ হাস্কি স্বরে বলে,
–” লজ্জা পেয়ো না জানা। ফার্স্ট টাইমে ওয়াইল্ড আচরণ করতে চাইছিনা বাট ইফ…
ইশতিরাজ বাক্য সমপন্ন করার আগে ফারজানা একটা কুশান ছুঁড়ে মেরে অস্ফুটস্বরে বলে,
–” নির্লজ্জ প্রাণী..
ইশতিরাজ বাঁকা হেসে ফারজানার দিকে এগিয়ে যায়। বেচারি তার ইনটেনশন বুঝে দূরে সরে যেতে নিলে ইশতিরাজ তার উপর আধশোয়া হয়ে বসে অতঃপর চোখে চোখ রেখে বলে,
–” আমাদের বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় রাতটাকে স্পয়েল করার চেষ্টা করলে আমি এটাকে আরও বেশি ইন্টারেস্টিং এন্ড এক্সাইটেড বানানোর পরিকল্পনা এক্সিকিউট করবো। ডোন্ট ফোর্স মি টু ডু দ্যাট হানি। ইয়্যু কান্ট হ্যান্ডেল দ্যাট ফেজ রাইট নাও।
ফারজানা শিউরে উঠে রাজের কথায়। গলার পাশটায় তার আদুরে আক্রমণ অনুভব করতেই মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠে বেচারি।সময়ের সাথে রাজের স্পর্শ গাঢ় হলে ফারজানা আবছা ভাবে বাঁধা প্রদানের চেষ্টা করে। বুদ্ধিমান রাজ মুহূর্তের মাঝে ধরাশায়ী করে ফেলে ফারজানাকে।
অনাবৃত উদরে মৃদুভাবে মুখ ডুবিয়ে হালকা শ্বাস টানতেই ঠকঠক করে কেঁপে উঠে ফারজানা। বেচারির কম্পন টের পেয়ে স্মিত হাসে ইশতিরাজ। রাত বৃদ্ধির সাথে সাথে গাঢ় হতে থাকে রাজের আদুরে স্পর্শ। ঘায়েল ফারজানা নিভু নিভু চোখে চেয়ে থাকে তার অধৈর্য্য পুরুষের দিকে। শেষ রাতের দিকে ক্লান্ত ইশতিরাজ তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,
–” নিজ অস্তিত্ব নিয়ে যদি থাকো সন্দিহান। আমার আঁখি যুগল হবে তোমার একমাত্র অভিধান। সংশয় থাকলে এই প্রণয়পূর্ণ চোখজোড়ার প্রেমমাখা দৃষ্টিতে চোখ রাখবে আশাকরি অতটুকু যথেষ্ট তোমায় আশ্বস্ত করতে। ”
চলবে?