শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-৩৪

0
14

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
৩৪

সময় বহমান এবং জীবন চলমান। রিসোর্টে তিন দিনের ট্যুর শেষে সকলেই ফিরেছে নিজেদের ব্যস্ত জীবনে। ট্যুর শেষে ফিরতেই আরশিয়ান একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে তাজরিয়ান এর কাঁধে কোম্পানির দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিজেকে ভারমুক্ত করেছে। প্রিমার কন্ডিশন দেখে তাজরিয়ানও নাকচ করতে পারেনি। নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিতে সিইও পদে নিযুক্ত হয়েছে। কর্ম ব্যস্ততা এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানাবিধ সংগ্রামের ফাঁকে সময় কীভাবে পেরিয়ে গেছে কেউ টেরই পায়নি।

প্রিমার প্রেগন্যান্সির তেত্রিশ সপ্তাহ চলমান। উদরটা তুলনামূলক ভাবে স্ফীত হলেও আগের তুলনায় বড্ড বেশি রোগা হয়েছে তার দেহের গড়ন। প্রেগন্যান্সির পুরো জার্নিতে তেমন একটা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়নি তবে শেষমুহুর্তে এসে অসুস্থতা যেনো জেঁকে ধরেছে প্রিমাকে। ইদানীং একটুতেই বড্ড হাঁপিয়ে পড়ে বেচারি। মেজাজ হয়ে উঠে তিরিক্ষি। ডক্টর বলেছেন, ঘুম কম হওয়ার দরুন এসব সমস্যা হচ্ছে তবে প্রিমার মন মানতে নারাজ। নানান প্রকার দুশ্চিন্তা তার ছোট্ট মনে বাসা বেঁধেছে।

সাধারণত সারা রাত জেগে থেকে শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমায় প্রিমা। গতকাল কেনো যেনো একটুও ঘুমাতে পারেনি। আরশিয়ান তাকে ঘুমন্ত ভেবে ভোর বেলা উঠে জগিং করতে বেরিয়েছে। মহাশয় ওয়ার্ক আউট শেষে তবেই ফিরবেন। প্রিমা কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর বিরক্ত হয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসেছে। সাতসকালে তাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে আরিয়ান চৌধুরী চিন্তিত স্বরে বলেন,

–” শরীর ঠিকাছে আম্মা? ”

প্রিমা মলিন মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলে,

–” হুঁ বাবা। ”

আরিয়ান চৌধুরী তার ক্লান্ত মুখশ্রী অবলোকন করে তার মাথায় হাত রেখে বলেন,

–” সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মা। একটু ধৈর্য রাখেন। সৃষ্টিকর্তা সহনশীলদের ভীষণ পছন্দ করেন। ”

প্রিমার বুক ভার হয়ে আসে। বলতে পারে না হৃদয়ে জমে থাকা আশঙ্কার কথা। শুকনো ঢোক গিলে অল্প একটু সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বলে,

–” জ্বী। ”

আরিয়ান চৌধুরী কথা বাড়ালেন না। উনার অভিজ্ঞ চোখজোড়া ঠিকই বুঝলো প্রিমার মনের উৎকন্ঠা। মনে মনে ভেবে রাখলেন, আরশিয়ান ফিরলে তার সাথে কথা বলে নেবেন। মেয়েটা তীব্র মানসিক টানাপোড়নে ভুগছে। যেটা খুবই স্বাভাবিক তবে এটার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে প্রিমা।

উনার চিন্তার মাঝেই উপস্থিত হয় ইশতিরাজ এবং ফারজানা। প্রিমার রেগুলার চেকআপ এর জন্য প্রায়ই আসে তারা। ওদের স্পেশ দিতে হালকা কুশলাদি বিনিময় করে আরিয়ান চৌধুরী প্রস্থান করেন। কয়েক কদম এগিয়ে এসে প্রিমার পাশের সোফায় বসতে বসতে ফারজানা বলে,

–” চোখমুখের এই হাল কেনো তোর? রাতে ঘুমাসনি? ”

প্রিমা ক্লান্ত স্বরে বলল,

–” ইদানীং রাতে ঘুম কম হয়। গতকাল কেনো যেনো একটুও ঘুমাতে পারিনি। উনিও জেগেছিলেন সারাটা রাত। ”

কথাটা বলার সাথে সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ইশতিরাজ ততক্ষণে প্রিমার পাশের সোফায় গিয়ে বসেছে। প্রিমার কথা শুনে আচমকা তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একেই ফার্স্ট প্রেগ্ন্যাসি তার উপর ট্রিপলেট.. সবটা সামলাতে বেশ হিমসিম খাচ্ছে বেচারি। তুলনামূলক ভাবে একটু বেশিই সাফার করতে হচ্ছে। ছয় মাস পেরোনোর পর প্রিমার অবস্থা খনিকটা নাজুক হয়ে পড়ে। তখন থেকে রেগুলার চেকআপের জন্য এই এপার্টমেন্টে হাজিরা দিতে হয় ইশতিরাজকে। যার ফলস্বরূপ এই কয়েকমাসে প্রিমার সাথে সম্পর্কটা আরও গাঢ় হয়েছে তার। মেয়েটার ভঙ্গুর অবস্থা দেখলে রাজেরই খারাপ লাগে।

মনের ভাবনাকে সাইডে রেখে ইশতিরাজ পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলো। গলা খাঁকারি দিয়ে মজার ছলে বলল,

–” এই যে লাড্ডু বিবি..

প্রিমা ঠোঁট উল্টে সরু চোখে তাকাল ইশতিরাজের দিকে অতঃপর বলল,

–” ভালো হচ্ছে না কিন্তু..

ইশতিরাজ হেসে ফেলল। ব্যাগ থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্রটা বের করে বলল,

–” তোমার মন খারাপ থাকলে আমারও ভালো লাগে না রুপানজেল। আমি চাই তুমি সবসময় হাসিখুশি থাকো। লাইফে আপস এন্ড ডাউন আসে.. আসবে.. এটা ভবিতব্য তবে ফাইট ব্যাক করতে জানতে হবে। আমি চাই আমার বাঘিনী বোন সর্বত্র বিজয় অর্জন করুক। যাইহোক.. ওই হাঁদারামটা কই? ”

ইশতিরাজের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল প্রিমা আর ফারজানা। লাস্টের লাইনটা শুনে ফিক করে হেসে দেয় দুজনেই। ইশতিরাজ হাসতে হাসতে প্রিমার পরীক্ষা করে দেখে স্বভাবিকের তুলনায় প্রেশার কিছুটা বাড়তি। নিমিষেই তার হাসি ধপ করে নিভে যায়। ফারজানা আড়চোখে তা লক্ষ্য করে শঙ্কিত চোখে তাকায়। ইশতিরাজ পরিস্থিতি সামলাতে বলে,

–” কী নিয়ে এত টেনশন করছো রুপানজেল? তুমি জানো, সামান্যতম টেনশন তোমাদের অনাগত সন্তানদের উপর কতটা বাজে ইফেক্ট ফেলবে? প্লিজ নিজের প্রতি একটু যত্নবান হও। ডেলিভারির আর টু উইকস বাকি মাত্র। এপর্যায়ে এসে ভেঙে পড়লে ক্ষতিটা আলটিমেটলি তোমারই হবে৷ আরশিয়ান ভীষণ টেনশনে থাকে তোমাদের নিয়ে। ওর দুনিয়াটা তছনছ করে দিয়ো না। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড এন্ড বি স্ট্রং ওকে? ”

প্রিমা বার কয়েক লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ইশতিরাজের কথায় কিছুটা হলেও তার মনের জোর বাড়ে। আলাপচারিতার মাঝেই আরশিয়ানের আগমন ঘটলো। প্রিমা দৃষ্টিপাত করলো তার প্রিয় পুরুষের পানে।সদর দরজায়
সবে পা রেখেছে শান। দেখে মনে হচ্ছে জিম শেষে শাওয়ার নিয়ে তবেই ফিরেছে। তার পরনে রয়েছে হোয়াইট কালার টিশার্ট এবং ব্ল্যাক ট্রাউজার।

প্রিমা রুষ্ট চোখে তাকাল। লোকটার সৌন্দর্য দিনদিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। প্রিমার হয়েছে যতো জ্বালা। সৌম্য সুদর্শন স্বামীর চিন্তায় ইনসিকিউরড পারসন হয়ে যাচ্ছে ইদানীং।প্রিমার ধ্যান ভাঙলো আরশিয়ানের ডাকে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে বলছে,

–” এত সকালে উঠেছেন যে? ঘুম হয়নি? শরীর খারাপ লাগছে?”

প্রিমা মৃদু রাগ দেখিয়ে ধীর স্বরে বলল,

–” ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। একা ঘরে একটুও ভালো লাগছিলো না তাই বাইরে এসেছি। ”

আরশিয়ান কপাল কুঁচকে বলল,

–” আমাকে কল দেননি কেনো? একটা কল দিলেই এসে পড়তাম। রাতে তো একদমই ঘুমাতে পারেননি এখনও যদি না ঘুমিয়ে বসে থাকেন তাহলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। রুমে চলুন এখুনি…

এতক্ষণ বসে বসে স্বামী-স্ত্রীর মোহাব্বত দেখছিলো ইশতিরাজ তবে এত আহ্লাদ তার সহ্য হলো না। মাঝে বাগড়া দিয়ে বলল,

–” বন্ধু..রোমান্টিকতা দেখি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ব্যপার কী মনু? ইদানীং কোন ব্র্যান্ডের হারবাল ইউজ করছিস? এক ঝটকায় এত উন্নতি বাহ্ বাহ্ বাহ্..

ইশতিরাজের কথায় আরশিয়ান কপাল কুঁচকে তাকাল। প্রিমা থতমত খেয়ে গেছে.. ফরজানা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আরশিয়ান দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

–” চোরের মন পুলিশ পুলিশ। মস্তিষ্কে সারাক্ষণ হারবালের নাম ঘুরঘুর করছে কোন দুঃখে?মেশিনে ডিস্টার্বেন্স আছে? রিপেয়ারিং দরকার? সময় করে একবার দেখা করিস। সকল ডিস্টার্বেন্স একদম মূল থেকে নির্মূল করে দিবো। ”

আরশিয়ানের কথায় ফাঁকা ঢোক গিললো ইশতিরাজ। মনে মনে গুটিকয়েক গালি দিয়ে জোর পূর্বক হেসে বলল,

–” তুই দেখি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস। আই ওয়াজ জোকিং দোস্ত। হে হে হে…

আরশিয়ান কথা বাড়ালো না। শ্যেন দৃষ্টিতে একবার তার দিকে তাকিয়ে বলল,

–” উনার প্রেশার ঠিকাছে? ”

ইশতিরাজের হাসিটা কমে আসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” প্রেশারটা একটু বাড়তি। নাস্তা সেরে একবার হসপিটাল থেকে ঘুরে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

খবরটা শুনে আরশিয়ানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে নাস্তা তৈরী হতে হতে হসপিটালে যাওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিতে প্রিমাকে নিয়ে আস্তে ধীরে রুমের দিকে যায়।ওদের প্রস্থানের পানে চেয়ে ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

–” আপনার মতো অসভ্যকে বিয়ে করাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। মানুষ টাকা পয়াসা হারায়, ঘরের চাবি হারায় অথচ আপনি সবখানে মাথার ঘিলু আর মানইজ্জত হারিয়ে বসেন।

ইশতিরাজ দুঃখী স্বরে বলল,

–” বউ গো…একটু সভ্য বানিয়ে দাও না আমায়। হয়ে যাও আমার এসিস্ট্যান্ট। প্রতি ঘন্টায় নিয়ম করে কড়া ডোজের আদর দিলেই আমি সভ্য হয়ে উঠবো আশাকরি। ”

লজ্জায় ফারজানার মুখের আদল পাল্টে গেলো। একটা মানুষ এতোটা নির্লজ্জ হইতে পারে তার জানা ছিলো না। ফারজানা অস্ফুটস্বরে বলে,

–” আল্লাহ উনাকে একটু সংযম দিন আর আমায় রেহাই দিন। ”

ইশতিরাজ সেই চাওয়া শুনে বাঁকা হাসলো৷ আড় চোখে তাকিয়ে খানিকটা খোঁচা মেরে ফারজানাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–” এই যে প্রাইভেট ফার্মের মুরগী, শুনো? ”

ইশতিরাজের সম্বোধন শুনে রাগে ফারজানার নাকের পাটা ফুলে উঠল। বিক্ষুব্ধ চাহুনিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” ওহে সরকারি ফার্মের অদরকারী মূলা.. বলুন কী বলিতে চান। ”

অপমানে ইশতিরাজের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠল।
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে ফারজানার কাছ ঘেঁষে বসে মিছে অভিমান দেখিয়ে বলল,

–” রাগ করছো কেনো জানেমান। আমি তোমাকে একটু কাছে কাছে রাখার জন্য এত আয়োজন করছি। বউ যদি পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হয় তাহলে আমার কত সুবিধা হবে সে-ই খেয়াল আছে? রাজি হয়ে যাও না…

ফারজানা বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল,

–” আপনার সুবিধা হলো, আমাকে সারাক্ষণ হাতের নাগালে পাবেন। এক্সট্রা সুবিধা হলো মন চাইলেই যখন তখন চেপে ধরে আদরযত্ন করতে পারবেন অথচ সম্মানের ভয়ে আমি প্রতিবাদটুকুও করতে পারবো না। আপনার অসৎ উদ্দেশ্য বুঝেছি বলেই রাজি হচ্ছি না। ”

ইশতিরাজ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। হাসির দমকে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো তার। ফারজানা আকস্মিক থেমে গেলো। একদৃষ্টিতে দেখতে থাকলো তার প্রিয় পুরুষটাকে। খানিকক্ষণ পর ইশতিরাজ হাসি থামিয়ে বলল,

–” ওয়ার্ক প্লেসে পার্সোনাল হোমওয়ার্ক করার সুযোগ পেলে মন্দ হয় না। এনার্জি পাওয়া যাবে অনেক। কাজের ক্ষেত্রে একঘেয়েমি কাজ করবে না। মন ফুরফুরা থাকবে। মস্তিষ্ক চাঙ্গা থাকবে ফলে সেবা দান করার সময় কোনো ভুলচুক হবে না। দিনশেষে দেশের মানুষ ভালো থাকবে এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে। আপনি যদি আমার অফার রিজেক্ট করেন তাহলে একাধারে প্রেমদ্রোহী, দেশদ্রোহী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে আপনাকে। ”

ফারজানা আর সহ্য করতে না পেরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। একটা কুশান তুলে ইশতিরাজের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,

–” অসভ্য ম্যান…

ইশতিরাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

–” অনলি ইয়্যোর্স জানেমান…

_

অফিসে যাওয়ার জন্য সকাল বেলা শাওয়ার নিয়ে বেরুল তাজরিয়ান। দুরন্ত পায়ে হেঁটে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই দেখলো প্রতিবিম্বে ভেসে উঠেছে মেহরিমার লাস্যময়ী প্রতিচ্ছবি। সিঁদুর রাঙা লাল শাড়িতে এলোমেলো সাজে বড্ড আবেদনময়ী দেখাচ্ছে তাকে। তাজরিয়ান ফাঁকা ঢোক গিললো কিন্তু পরক্ষণেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।

রিসোর্টের সেই ইন্সিডেন্টের পর তাজরিয়ান নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অবাধ্য শাসনে আঁটকে রাখে না মেহরিমাকে। জোরাজোরি করে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। একান্ত সময় গুলোতেও তার আচরণ থাকে বড্ড শীতল। মেহরিমা পাগল হয়ে উঠেছে তার রাগ ভাঙাতে অথচ তাজরিয়ান পাহাড়ের ন্যায় অটল। শেষমেশ হাজার ব্যর্থ চেষ্টার পর কাল রাতে তার বাচ্চা বউটা চমৎকার এক কার্ড প্লে করেছে। ইন্ডাইরেক্টলি তাকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে নিজের প্রতি। এতে বিদ্যুৎের গতিতে কাজ হয়েছে তবে কঠোর তাজরিয়ান তা বুঝতে দেয়নি।

রাতের বেলাটা কোনোরকমে পার করলেও দিনের বেলার পর্যাপ্ত আলোটাই যেনো সর্বনাশের মূল হলো। তাজরিয়ান পারলোনা চোখ ফেরাতে। এতদিন মুখ ফিরিয়ে রাখলেও এবার বাধ্য হলো মেহরিমার সান্নিধ্যে যেতে।

সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে মেহরিমা। মনমেজাজ বড্ড খারাপ তার। কতগুলো মাস হয়ে গেলো অথচ তাজের কোনো পরিবর্তন নেই। স্বাধীনতার স্বাদ বড্ড তেঁতো ঠেকছে। ভালো চাইতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে বেচারি। বিছানা থেকে নামতে নিলে আচমকা একটা পুরুষালি হাত এক ঝটকায় তাকে আগলে নিলো। মেহরিমা হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাজের বুকে। অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠলেও তাজরিয়ান ছাড়লো না উল্টো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে।

বহুদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে মেহরিমা মোমের মতো গলে গেলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত স্বরে বলল,

–” আম স্যো স্যরি তাজ। ”

তাজরিয়ান তখন উন্মাদের মতো মেহরিমাকে নিজের করে নিতে ব্যস্ত৷ তার পরনের এলোমেলো শাড়িটা ততক্ষণে ঠাঁই পেয়েছে মেঝেতে। আকস্মিক মেহুর কথায় কিছু সময়ের জন্য থেমে গেলো। হাঁপানো কন্ঠে তাজরিয়ান বলল,

–” নট একসেপ্টেড। ”

মেহরিমা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। তাজরিয়ানের কাঁধে মুখ গুঁজে বলল,

–” আর কখনো আপনার বিরোধিতা করবো না। এটাই লাস্ট টাইম। ভুল হয়ে গেছে.. মাফ করেন দিন প্লিজ। ”

তাজরিয়ান এক ধাক্কায় মেহরিমাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে তার উপর আধশোয়া হয়ে ঝাঁঝাল স্বরে বলল,

–” কীসের স্যরি? কেনো মাফ চাইছিস? তোর লাইফ সুতরাং ডিসিশন তোরই হওয়া উচিত। আমি তো সাইকো। অহেতুক বেশি বুঝি। তোকে জ্বালায়..

তাজরিয়ানের আকস্মিক ধাক্কায় মেহরিমা কোমরে কিঞ্চিত ব্যথা পায়। মুহূর্তের মধ্যে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। তাজরিয়ানের অভিমানী কথা গুলো শুনে চোখ মেলে তাকিয়ে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে,

–” আই ওয়াজ রং..

তাজরিয়ান খানিকটা শান্ত হয়। সামান্য একটু ঝুঁকে এসে মেহরিমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর স্বরে বলে,

–” তুই এত অবুঝ কেনো সোনা? কেনো বুঝিস না নিজের ভালোটা? তুই কতোটা উইক সেটা জনিস না? প্রেগন্যান্সি অনেক বড় একটা দায়িত্ব যেটার জন্য তুই একদমই প্রস্তুত না। তুই কেনো ভাবিস আমি বাচ্চা চাই না? প্রত্যেকটা পুরুষ চায় নিজের ঔরসে জন্মানো একটা অস্তিত্ব কিন্তু তোকে হারিয়ে আমার কোনোকিছুই চাইনা। সেটা যতোই মূল্যবান কিংবা আকাঙ্ক্ষিত হোক। ”

মেহরিমা বুঝলো তাজরিয়ানের কথা গুলো। কিছু একটা ভেবে ভয়ও পেলো। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কেঁপে উঠলো তার। তাজরিয়ান একদৃষ্টিতে দেখছিলো তার পিচ্চি বউটাকে। বড্ড বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বেচারিকে। দীর্ঘ দূরত্বে সে নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছে।

যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য ততটুকু মেহরিমা ভোগ করেছে। এরপর বাচ্চার প্রসঙ্গে আবদার করা কিংবা জেদ ধরার চেষ্টা করার সাহস পাবে না সে। কথাগুলো ভেবে মনেমনেই হাসলো তাজরিয়ান। মেহরিমা উপর সম্পূর্ণ ভার তার উপর ছেড়ে দিয়ে তার বুকে মুখ গুঁজে তাজরিয়ান বলল,

–” যা তুঝে মাফ কিয়া.

গানের সুর টেনে মজার ছলে বলল তাজ। ওদিকে তাজরিয়ানের ভারে আঁতকে উঠে মেহরিমা চাপা গলায় বলল,

–” সরু ন্ প্লিজ। আল্লাহ গো.. দম বন্ধ হয়ে গেলো আমার। ”

তাজরিয়ান ডিগবাজি খেয়ে পাশে শুয়ে মেহরিমাকে নিজের উপর টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

–” আমার ভার সইতে পারিস না আবার আমার বাচ্চার আম্মা হতে চাস। হ্যাভ সাম শরম মেহু..

মেহরিমা জোরেশোরে শ্বাস ফেলছে। একমুহূর্তের জন্য সত্যি ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। তাজের কথা শুনে ভয়কে সাইডে রেখে সাহস করে বলল,

–” একটা কথা বলার ছিলো..

তাজরিয়ান হাস্যোজ্জ্বল স্বরে বলল,

–” কী কথা বউজান? ”

তাজরিয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বুঁজে মেহরিমা ভয়ার্ত গলায় আমতা আমতা করে বলল,

–” আপনি প্রেগন্যান্ট..

তাজরিয়ান মজার মুডে ছিলো। আচমকা ভুলভাল কথা শুনে বলল,

–” বেডা মানুষ ডিম পাড়তে পারে? গাধী কোথাকার। মজা করছিস ভালো কথা এটলিস্ট যৌক্তিক কিছু বল। বাই দ্যা ওয়ে ফালতু জোক ছিলো। ”

মেহরিমা ভয়ের চোটে ভুল কথা বলে ফেলেছে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে ধীর গলায় বলল,

–” আম প্রেগন্যান্ট তাজ । ”

তাজরিয়ানের মুখের হাসিটা ধপ করে নিভে যায়। চোখ দু’টো অজান্তেই বড় বড় হয়ে যায়। বিস্মিত হয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে মেহরিমাকে মুখোমুখি বসিয়ে হড়বড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

–” কীসব বলছিস? মাথা ঠিক আছে? এটা কীভাবে সম্ভব? আমি.. আমি যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছি। কেমনে কী..

মেহরিমা মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে বলে উঠে,

–” জানি না আমি.. হয়ে গেছে। গতকাল টেস্ট করিয়ে শিওর হয়েছি। ”

তাজরিয়ান বিস্ময়ে কথা বলতেও ভুলে যায়। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। কীভাবে রিয়েক্ট করা উচিত, কী বলা দরকার কিংবা কী করবে কিছুই বুঝছে না। স্রেফ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে মেহরিমার দিকে। আবেগের তাড়নায় আচমকা মেহরিমার অনাবৃত উদরে হাত রেখে বলল,

–” তোর পেট তো এখনো সমতলই আছে মেহু। ওর এক্সজিসটেন্স আমি অনুভব করতে পারছি না। ও কী ঘুমাচ্ছে এখন? ”

তাজরিয়ানের বোকা বোকা কথায় মুখ তুলে তাকাল মেহরিমা। তাজরিয়ানের কম্পনরত হাতের উপর হাত রেখে বলল,

–” আপনি পাগলামি করছেন। ভ্রুনের অস্তিত্ব এত দ্রুত বোঝা যায় না তাজ। ”

তাজরিয়ান হুঁশে ফেরে। নিজের ইমোশন সামলাতে দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। মেহরিমা তার কাঁধে হাত রাখলে আকস্মিক তাজরিয়ান আবেগপ্রবণ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,

–” আম হ্যাপি মেহু.. আমার সন্তান আসছে। আমি বাবা হবো। ক’দিন পর আমার কোলে একটা ছোট্ট কোমল অস্তিত্ব থাকবে যে কি-না একসময় আমাকে বাবা বলে ডাকবে। তুই বুঝতে পারছিস? কত সুন্দর ব্যপারটা? ”

মেহরিমা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে তাজের কথায়। তাকে জড়িয়ে ধরে আনমনে ভাবে, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।

_

চেঞ্জিং রুমে বিরস মুখে বসে আছে প্রিমা। সে বলেছিল ফ্রক পরাতে কিন্তু তাতে ঘোর বিপত্তি প্রকাশ করে আরশিয়ান। জোর করে ম্যাটার্নিটি ড্রেস পরায় বেচারিকে। প্রিমা মুখ ফুলিয়ে রাখলেও সেটা গ্রাহ্য করেনা উল্টো ফ্লোরে বসে প্রিমার ফোলা ফোলা পায়ে কম্ফোর্টেবল স্নিকার্স পরিয়ে দেয়।

কাজ শেষ হতেই প্রিমাকে পাজাকোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে আরশিয়ান । তাকে বিছানায় বসিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুলগুলো সেট করতে থাকে। তা দেখে বিছানায় আধশোয়া হয়ে প্রিমা বিড়বিড়িয়ে বলে,

–” এ্যাঁহ্.. রঙঢঙের শেষ নাই। নিজে সাজবে সাকিব খান আর আমারে বানিয়ে রাখবে সখিনা বিবি। বেডা জাতটাই আসলে হিংসুটে….

আরশিয়ান আড়চোখে নিজের অভিমানী বউকেই দেখছিলো। প্রিমাকে বিড়বিড় করতে দেখে মৃদু হাসে আরশিয়ান। প্রেগন্যান্সির লাস্ট কয়মাসে প্রিমার মাঝে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ঘনঘন মুড সুয়িং হয় তার। আরশিয়ান বিপাকে পড়লেও খুব ভালো মতো সামলে নিয়েছে সবটা। কেনো জানি প্রিমার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিরক্তি কিংবা ক্লান্তি কাজ করেনা তার৷

আচমকা ব্যথাতুর আওয়াজ শুনে আরশিয়ানের ধ্যান ভাঙে৷ হাতের হেয়ার কম্বটা ফেলে ততক্ষণাৎ
প্রিমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

–” কী হয়েছে প্রেম? বাবু কিক মেরেছে? পেইন হচ্ছে? ”

প্রিমা তলপেটে হাত রেখে চোখমুখ খিঁচিয়ে বলে,

–” আপনার মতোই জল্লাদ হয়েছে আপনার ছানা পোনা৷ একটুও বুঝে-না আমার দুঃখ। খালি কষ্ট দেয়। ”

আরশিয়ান ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নরমাল পেইন শুনে তার কলিজায় পানি আসে। প্রিমার পাশে বসে তার উদরে হাত রাখতেই টের পায় তার অনাগত সন্তানদের অনুপস্থিতি। বড্ড বেশি ছটফট করছে তারা। ব্যথার তীব্রতায় ক্ষণে ক্ষণে চোখমুখ কুঁচকে আর্তনাদ করে উঠছে প্রিমা। আরশিয়ান উদরে হাত বুলিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে,

–” এত নড়াচড়া করে না বাবা। আম্মু ব্যথা পাচ্ছে তো। এইতে আর মাত্র কয়টা দিন এরপর বেরিয়ে এসে যতখুশি ফুটবল খেলবে আপাতত একটু শান্ত থাকো প্লিজ৷ ”

আরশিয়ানের কথায় কাজ হলো। মিনিট খানেকের মাথায় শান্ত হয়ে এলো তাদের নড়াচড়া। ব্যথার তীব্রতায় প্রিমার মুখশ্রী ঘামে ভিজে উঠেছিল। বাচ্চারা শান্ত হতেই প্রিমা ক্লান্ত স্বরে ক্ষোভ ঢেলে বলে,

–” মীরজাফর পেটে ধরেছি আমি। আমার একটাও কথা শুনে না অথচ আপনি বলা মাত্র কেমন শান্ত হয়ে গেলো। উফ্ কী যন্ত্রণা। ”

আরশিয়ান অসহায় চোখে তাকাল কেবল। প্রিমা চুপচাপ চোখ বুঁজে শুয়ে রইল। শরীর খারাপ লাগছে তার তবে আরশিয়ানকে কিছুই জানালো না। প্রিমাকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আরশিয়ান মৃদুস্বরে বলল,

–” শুয়ে পড়লেন যে? নাস্তা সেরে বেরুতে হবে তো।”

প্রিমা অল্প একটু চোখ খুলে ক্লান্ত স্বরে বলল,

–” ক্লান্ত লাগছে সেই সাথে ভীষণ ঘুমও আসছে। একটুখানি রেস্ট করেনি এরপর যাবো। ”

আরশিয়ান কথা বাড়ালো না। মেয়েটা সারারাত ঘুমাইনি। এখন একটু ঘুমালে হয়তো তার ভালো লাগবে। ঘড়ির সময়টা একবার দেখে নিয়ে আরশিয়ান বলল,

–” সকাল সাতটা বাজে। নয়টার মধ্যে ডক্টর চেম্বারে চলে আসবেন সুতরাং আপনার হাতে সময় আছে দুই ঘন্টা। এরপর আমি ডেকে দিবো.. ঠিকাছে? ”

প্রিমা সম্মতি জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো৷ আরশিয়ান তার পাশে বসে আলতো হাতে ম্যাসাজ করে দিতে থাকলো তার কাঁধে, পিঠে আর কোমরে। মাঝেমধ্যে দু’একটা ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলো। হুট করে অফিশিয়াল কল আসায় আরশিয়ান গেলো ড্রয়িং রুমের দিকে। প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বলার পর আকস্মিক কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনে দৌড়ে ঘরের দিকে আসলো। ভেতরে ঢুকতেই আরশিয়ানের পদযুগল থমকে গেলো। ভেতরকার দৃশ্য দেখে তার পৃথিবী দুলে উঠল রীতিমতো । অস্ফুটস্বরে বলল,

–” প্রেম..

প্রিমা বেকায়দায় পড়ে আছে মেঝেতে। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ফ্লুইড মিশ্রিত র ক্ত আর ভাঙা কাঁচের টুকরা। হাঁপড়ের ন্যায় উঠানামা করছে তার বক্ষপট। প্রিমার তীক্ষ্ণ আর্তনাদে উপস্থিত হয়েছে সকলে। ইশতিরাজ উৎকন্ঠিত হয়ে আরশিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে বলে,

–” তুই থম মেরে দাঁড়াই আছিস এখানে। শী ইজ ডায়িং ম্যান…

আরশিয়ানের যেনো হুঁশ ফেরে। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে প্রিমার রক্তাক্ত দেহের পাশে। তার অবিচল দেহটা আঁকড়ে ধরে থেমে থেমে বলে,

–” তুমি আমায় ফাঁকি দিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারো না প্রেম..

তখনো জ্ঞান ছিলো প্রিমার। রক্তমাখা হাতে শানের শার্টের কলার ধরে সে ধীর স্বরে অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,

–” একটু বুকে..র সাথে জড়িয়ে রাখুন না আম্ আমায়। খ্ খুব বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। আর্ বোধহয় বেশি সময়্ বাকি নেই। মরে যা…

আর বলতে পারলো না প্রিমা। পুরো শরীরে আচমকা তীব্র ঝাঁকুনি বয়ে গেলো। চোখদুটো স্থির হলো একই সাথে গোটা শরীর শক্ত হয়ে আসলো। আরশিয়ানের কলার আঁকড়ে রাখা হাতটা ধপ করে পড়ে গেলো। শুরু হলো খিচুঁনি। অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে থাকলো পুরো শরীর। আরশিয়ান তখনও অনুভূতিহীন চোখে চেয়ে দেখছে সম্পূর্ণ দৃশ্য। তার প্রাণভোমরা একটু একটু করে নিথর হয়ে যাচ্ছে অথচ সে ভ্রুক্ষেপহীন।

ঘরটা ভরে উঠে কান্নার গুঞ্জনে। ইশতিরাজ অশ্রু লুকিয়ে হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। এম্বুলেন্সে খবর দিয়ে ঘরে ঢুকে ভেতরকার দৃশ্য দেখে তার কলিজা কেঁপে উঠে। অস্ফুটস্বরে ডাকে,

–” রুপানজেল..

প্রায় মিনিট দশেক সময় পেরোলো। এম্বুলেন্স এসে হাজির হলো বাড়ির দোরগোড়ায়। ওয়ার্ড বয়রা স্ট্রেচার নিয়ে আসলেও আরশিয়ানের হাত থেকে প্রিমাকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো। ইশতিরাজ এগিয়ে এসে আরশিয়ানকে মৃদু ধাক্কা দিতেই সে কেঁপে উঠে। হুঁশে ফিরে প্রিমার দিকে এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিল্লিয়ে বলে,

–” প্রেম? এ্যাঁই প্রেম? উঠো না ওয়াইফি। খুব রাগ হয়েছে? আচ্ছা… আর পরাবো না এই ম্যাটার্নিটি ড্রেস। ফ্রক পরবে তুমি? কোনটা পরবে? ব্লু কালারটা দিবো? কথা বলো.. এ্যাঁই.. কথা বলছো না কেনো তুমি? আমি কিন্তু ডাকছি তোমায়…

উপস্থিত সকলে এই দৃশ্য দেখে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ইশতিরাজ নিজেও ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেললো। আরিয়ান চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন,

–” প্রিমাকে হসপিটালে নিতে হবে আব্বু। ছাড়ো ওকে। দেরি হয়ে যাচ্ছে বাপ…

আরশিয়ান ছাড়লো না৷ উল্টো প্রিমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে অপ্রকৃতস্থ জেদি বাচ্চার মতো দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,

–” আমি ছাড়বো না উনাকে। ছাড়লেই উনি আমায় ফাঁকি দিয়ে পালাবেন। বড্ড নিষ্ঠুর রমণী আমার প্রেম। আমি একটু দূরে গেলে ওমনি অজানাই হারিয়ে যাওয়ার পায়তারা করেন তিনি।

ইশতিরাজ বুঝলো আরশিয়ান শকের মধ্যে আছে। বাধ্য হয়ে আরশিয়ানের হাত দু’টো পেছন থেকে ব্লক করে ওয়ার্ড বয়দের কমান্ড দিলো,

–” ম্যাম কে স্ট্রেচারে তুলো। হারি আপ..

আরশিয়ান চিল্লিয়ে উঠে। ছাড়া পেতে চায় ইশতিরাজের থেকে কিন্তু পারে না। প্রিমাকে তার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্ট্রেচারে তুলতে দেখে আরশিয়ান আর্তনাদ করে বলে,

–” আমার থেকে দূরে নিয়ে যাস না ওকে.. মরে যাবো আমি। সৃষ্টিকর্তা বরাবরই আমার প্রতি নিষ্ঠুর। আঁকড়ে ধরে না রাখলে উনাকে আমার থেকে কেঁড়ে নিবেন তিনি। ছেড়ে দে আমাকে.. যেতে দে আমার প্রেমের কাছে। একটু দয়া কর আমার উপর…

আরশিয়ানের আচরণ আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে উঠেছে। উন্মাদের মতো আচরণ করছে রীতিমতো। ইশতিরাজ সর্বশক্তি খাঁটিয়েও ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। আরশিয়ান দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়ে যায় যার ফলস্বরূপ ভাঙা কাঁচের টুকরা বিঁধে তার পায়ে। ইশতিরাজ নিজেও দৌড় দেয় তার পিছু। উপস্থিত সকলে ও তাদের অনুসরণ করে।

লিফট বন্ধ থাকায় সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে আরশিয়ান। কতবার পড়ে যেতে নিয়েছে তার কোন হিসেবে নেয়। শেষপর্যন্ত মূল ফটকে উপস্থিত হতেই দেখে এম্বুলেন্স গেট পেরিয়ে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। আরশিয়ান হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পড়ে রাস্তায়। হাঁপাতে হাঁপাতে তার পিছু এসে উপস্থিত হয় রাজ। আরশিয়ানের কাঁধে হাত রাখতেই সে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বলে,

–” আমার অভিমানিনী চলে গেছে ভাই। নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে আমাকে..

চলবে?