নির্বাসিত ফুল পর্ব-০১

0
12

#নির্বাসিত_ফুল
#পর্ব_১
#কলমে_তানজিলা

ডিভোর্সের কথা বলতেই শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনেই বাবা সরাসরি বললেন, ‘ডিভোর্সের পর আমার বাড়িতে উঠতে পারবি না, তোর কোন দায়িত্ব আমি নেব না।’ ভরা লোকের সামনে বলায় খটকা লাগলেও আমি মোটেও অবাক হইনি। তিনিও ছিলেন আমার স্বামীর মতোই এক স্বৈরাচার, জালিম। যার পরিণতি হিসেবে কম বয়সে মা-বিহীন জীবন কাটাতে হয়েছে।

ভাগ্যিস আমার ইনকাম সোর্স ছিল, নাহলে পড়ে থাকতে হতো দুনিয়ার জাহান্নামে। আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। ভরা আসরে বললাম, ‘আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবেনা, আমার দায়িত্ব আমি নিজেই নিতে পারব।’
শুনে বাবার মুখটা আরও থমথমে হলো। দেখে বোঝা যাচ্ছে আমার উপর ভীষণ রেগে। আমি সেসবে পাত্তা দিলাম না। ওনার রাগ ধুয়ে, উনি পানি খাক। পাশ থেকে কেউ বলল, ‘বাবার উপরে কিভাবে কথা বলতেছে দেখছেন? বেয়াদপ মেয়ে। এইসব মেয়েদের সংসার টিকে না।’

কথা শুনে আমার মোটেও খারাপ লাগল না। আমি হাসলাম ক্ষীণ। সেটাতেও আমার দোষ হলো। শুনতে হলো, ‘দেখ, আবার নির্লজ্জের মত হাসতেছে।’
আমি কাউকে কৈফিয়ত দিলাম না। বাইর থেকে নাহয় ভালোই দেখল, কিন্তু ঘরের ভেতরের কথা জানবে কিভাবে? না জেনেই কী সুন্দর তারা মন্তব্য করছে। করুক। এতে শান্তি পেলে, করুক তারা। আমি আমার সিদ্ধান্ত কোনভাবেই পরিবর্তন করব না। আমার মা যে ভুল করেছিল, আমি সেই ভুল করব না।

আমার বিয়ের সবে আটমাস হবে। হ্যা, মাত্র আটমাস। একবছরও হয়নি। বিয়ের প্রথমে ভালোই চলছিল, মানুষটাকেও ভালোই মনে হয়েছিল। কিন্তু দেড়মাস পেরোতেই হুট কথা কাটাকাটিতে সে আমাকে থাপ্পড় মারল। তখনও ছিলাম নতুন বউ, গায়ে লেগেছিল বেশ। কিন্তু নিজেকে মানিয়ে নিলাম এই সান্ত্বনা দিয়ে—সংসারে ওই একটু আধটু এমন হয়। আমার শ্বাশুড়ি আম্মা দেখে বুঝতে পারছিলেন, আমাদের মাঝে কিছু হয়েছে। আমি তাকে জানালাম, সে জানাল—এসব ধরে রাখতে নেই, সংসারে এগুলো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আমিও মেনে নিলাম। তারপর এভাবে ধীরে ধীরে কাটতে লাগল। সে আবারও আমার গায়ে হাত তুলল। এইবার আমি চুপ করে মেনে নিলাম না, মুখে যা বলার বলুক! গায়ে হাত তুলবে কেন? রাগ করে তার সঙ্গে বিছানায় আলাদা করলাম। দুদিন হলেই শ্বাশুড়ি বললেন, এভাবে চললে স্বামীর মন অন্যদিকে যাবে। তারপর পূর্বের মত এবারও মেনে নিলাম।

আমার শ্বাশুড়ি থেকে বেশি জ্বালাত আমার শ্বশুর। হ্যাঁ, ঠিক বললাম। মানুষ শুনলে হয়ত অবাক হবে। সবসময় খুঁত ধরত। তরকারি রান্না করলে, একদিন স্বাদ নেই, কোনোদিন লবণ হয়নি, কোনদিন ঝাল বেশি হয়েছে আবার আরেকদিন রান্নাই পারিনা। অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলাম তবে শ্বাশুড়ি মা ই নাহয় রান্না করবে, আমি শিখে নেব। শ্বাশুড়ির আপত্তি না থাকলে ঘোর আপত্তি ছিল শ্বশুরের—এইভাবে সংসার করব? শাশুড়ি এক হাতে সব করেছেন, আরও কত কী!

শুধু কী এতটুকুতেই আটকে ছিলেন? নাহ্। ফজরের আজান দিলেই, নামাজ পড়তে যাবেন, ঠিক তখনই আমাদের ঘরের সামনে এসে দরজায় ঢোল বাজাতে শুরু করতেন। নিজের ছেলে নামাজ না পড়লেও আমি ফজরে উঠতে দেরী করলেই হয়ে যেতাম জাহান্নামী। কেমন বউ আনল ঘরে?
যেদিন ওনার নামাজ থেকে ফেরার আগে উঠতে না পারতাম, সেদিন এসেই আবার জানালায় ঢোল বাজাতে লাগতেন। উনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়তেন, এটাই ভালো দিক। কখনও মিস করবেন না। ঝড়, বৃষ্টি যাই হোক। এটা নিয়ে ওনার অহংকারের শেষ ছিল না, নিজেকে জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়েছিলেন। যেন আল্লাহ ওনাকে জান্নাতের টিকিট দিয়ে রেখেছিলেন। আমি আমার মতই ছিলাম। কাউকে দেখিয়ে নামাজ পড়ার মানে নেই। ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পূর্বেই আমি নামাজ পড়ে নিতাম।
এছাড়াও শ্বশুরের ছিল বিশাল জমিজামা। ধান চাষ করেন সেখানে। জমি দেখে আসা, আইল ঠিকঠাক করা, পানি ঠিকঠাক যাচ্ছে কিনা–প্রতিদিন হলেও আমাকে এক দুবার যেতেই হতো। আবার ধান কাটা শেষে, ধান সিদ্ধ- শুকানোতেও কাজ করা লাগতো। অবশ্য শ্বাশুড়িই বেশি করতেন, এ কথা আমি অস্বীকার করব মা। রাস্তার মাঝে ধান শুকানো, ধানে পা দেয়া, বাও দেয়া সব জনসম্মুখে করত হতো–ওড়না কোনদিক থেকে কোন দিকে যেত.. কড়া রোদে কাজের সময় ওত ঠিকঠাক থাকা যায়? নিজের যথাসম্ভব চেষ্টা করতাম আমি। অথচ বিয়ের সময় শ্বশুর খুজেছিলেন—খাঁটি পর্দাশীল মেয়ে লাগবে! পর্দা ছাড়া চলা যাবে। এই হলো পর্দার নমুনা! জমিতে যাও, মানুষের সামনে ধান শুকাও, এখানে তাদের পর্দা লাগবে না!
আমি বুঝতে পারতাম আমার শ্বাশুড়ি জীবনটাও বেশি সুখকর ছিল না। তবে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তিনিও আমার মায়ের মতো ভুল করছেন। এ বিষয়ে তাকে কিছু বলিনি আমি।

বিয়ের তখন চারমাসে পড়ল। আমার স্বামীর সঙ্গে তর্ক লাগল একদিন, ধান শুকানো নিয়ে। আমি বললাম, রাস্তায় ওত মানুষ যাওয়া আসা করে, তাকিয়ে দেখে। এছাড়াও আমার রোদে সমস্যা হয়, মাথা ব্যথার সমস্যা। একটা লোক নিলে ভালো হয়।
সে বলেছিল, তার মা আগে করেনি? তাহলে আমার এত সমস্যা কেন? এটা নিয়েই লাগল তর্ক। সেদিনও নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে আমার হাতে হাত তুলেছিল। এইবার আগের তুলনায় বেশীই ছিল।

আমি কেঁদেছিলাম। অনেক কেঁদেছিলাম। কেঁদে খাবার দাবার ছেড়ে দিলাম। শ্বাশুড়ি মায়ের বোধহয় খারাপ লেগেছিল, ছেলেকে বকলেন। এরপর তিনি খাবার এনে আমাকে পরামর্শ দিলেন, ‘বাচ্চা নেও। বাচ্চা নিলে ঠিক হয়ে যাবে সব।’
আমি শুনলাম শুধু। সে এসে শুধু জিজ্ঞেস করল, খাইনি কেন? উত্তর না দেয়ায় আমাকে গালি দিল। সেদিন রাতে অনেক ভাবলাম। নিজের অতীত নিয়ে ভাবলাম। হ্যাঁ, কিছুটা হলেও আমার মায়ের জীবন দেখতে পারছিলাম নিজের ভবিষ্যতে। যদিও আমার মায়ের জীবন ছিল আরও করুণ, কষ্টের, অত্যাচারের। ছোটবেলায় বাবা মায়ের মাঝে ঘুমাতাম, মধ্যরাতে উঠে দেখতাম মা কাদঁছে, বাবা এসে চুলের মুঠি ধরে একের পর এক থাপ্পর, ঘুষি মারছে। ভয়ে ওভাবেই মুখ চেপে থাকতাম আমি।
ছোটবেলা থেকে মায়ের ভয়ঙ্কর জীবনের সাক্ষী ছিলাম আমি। বড় হয়ে শুধু ভাবতাম, মা এত ধৈর্য শক্তি নিয়ে কীভাবে থাকতো? মায়ের উত্তর ছিল, ‘তোরা, সন্তানেরা।’

তাই এই ভুল আমি করব না। বাচ্চা হলে পরবর্তীতে দেখা যাবে আমাকেও বলবে– বাচ্চার কথা ভেবে হলেও সংসার করো। আমি এই জালে পা দিলাম না। একটা নিষ্পাপ জীবন, এই টক্সিক সম্পর্কে আনতে চাইনা। আমার শিশুকাল যেমন গিয়েছে, তেমন আমি নিজের সন্তানকে দেব না।
দেখতে দেখতে ওর গায়ে হাত তোলা অভ্যাসে পরিণত হলো। এখন ছোট খাটো বিষয়েও একটা হলেও থাপ্পড় মারবেই। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছাড়লাম। তিন চার দিন বাদে সে নিতে এল, বাবা তাকে বুঝাল– সে বলল আর হবেনা। মানিয়ে চলে এলাম।

কিন্তু অভ্যাস কী ছাড়তে পারে? একমাস না যেতে সে চুলের মুঠি ধরে লাথি মারলো। শ্বাশুড়ি না থাকলে ওইদিন আমার মৃত্যু থেকে কেউ আটকাতে পারত না। আমি বাকবিরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম। শ্বাশুড়ি আমাকে শাণিত গলায় বললেন, ‘এখনও কেন বাচ্চা নেওনি। যত দ্রুতসম্ভব বাচ্চা নাও। বাচ্চা হলে ছেলে মানুষের মন নরম হয়।’
আমি আবারও বাড়ি ছাড়ি। যাই আমার বড় বোনের বাড়িতে। আপা সেসময় প্রেগনেন্ট ছিল। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আপা শুনে খুব রেগে যায়। আমাকে পাঠাবে না পণ করে। এক সপ্তাহ, দু সপ্তাহ গেল। তারপর একদিন আমার শশুর শাশুড়ি এসে হাজির হলেন। আমাকে নিয়ে যেতে। আমার আপা নাকচ করে দেন, আমাকে দেবেন না। এর জন্য বাবা আপাকে কল করে শাসিয়েছিল। সেদিন ওনারা ফেরত গেলেন। আবারও এক সপ্তাহ বাদে এলেন। শাশুড়ি জানালেন, তার ছেলে আমার জন্য শোক পালন করছেন। অনেকদিন হলো আর নয়, নাহলে স্বামীর মন অন্যদিকে চলে যাবে। পরে পস্তাতে হবে। আপার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যথেষ্ট ভালো ছিলেন। ওনারা দৃঢ় গলায় বেশ কথা বললেন, যা আমার বাবা বলতে পারেনি। এভাবে আমি আবার এলাম। গাড়িতে আমার শশুর বেশ কথা শোনালেন আমাকে, শত ঝগড়া, মার খেয়েও আমার শাশুড়ি কখনও এভাবে বাড়ি ছেড়ে যায়নি, অথচ আমি দু দুবার ছেড়েছি! এ যেন ঘোর অন্যায় করে ফেলেছি আমি।

শশুর বাড়িতে আসার পর, আমার স্বামীকে দেখলাম। এলোমেলো চুল, দাড়ি বড়বড় হয়েছে। এসেই অস্বস্তি লাগল। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর আমিও স্বামীর ভালোবাসায় অতীত ভুলে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। কিন্তু এত আবেগ, ভালোবাসা টিকল না।

বিয়ের আটমাসে পা পড়ল। আবারও বাড়ির ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া লাগাল সে। অকথ্য ভাষায় গালি দিল। আমি অধৈর্য পড়লাম, যখন সে আমার মৃত মাকে গালি দিল। আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না, প্রথমবারের মতো ওর গালে চড় বসালাম। ব্যস, এটাই চোখে পড়ল আমার শ্বশুরের। স্বামীর গায়ে হাত তোলা, এ যেন বড় পাপ হয়ে গেল। অথচ স্ত্রীর গায়েও হাত তোলা যে পাপ, সেটা তারা দেখলেন না। শ্বশুরের মুখের উপর কথাটা বললে, তিনিও আমাকে বেয়াদপ, বেহায়া বলতে ছাড়েননি। সেদিনও আমার ভাগ্যে মার জুটতো, যদি না আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। দরজার ওপারে শিয়াল হায়না গুলো হিংস্র হয়ে উঠছিল। আমি বুঝলাম, এমন মানুষের সঙ্গে ভালোবাসা আবেগ ধরে লাভ নেই। নাহলে মায়ের পরিণতি আমার হতে দেরি নেই।
পরেরদিন অর্থাৎ আজকে আমার বাবাকে ডাকা হলো। সঙ্গে আমার সৎ মাও এলেন। আপাও আসতেন, কিন্তু তার প্রেগন্যান্সির আটমাস চলে। এখনকার রাস্তাও খারাপ।

এখানে বৈঠক বসল। আমি এলাম। আবারও একই কথাগুলো বলা হলো। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হবে, মন্যমিলন হবে। এসব মেনে সংসার করতে হবে। শেষে আমার দোষ ধরা হলো, যাইহোক স্বামীর গায়ে হাত তোলা আমার উচিত হয়নি। আমি সেদিন কোন আবেগকে রাখলাম না, বলে ফেললাম, ‘আমি আর পারব না, এ সংসার আমি করব না।’
আমাকে তখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তবে কী চাইছ তুমি?’
আমি বুকে পাথর রেখে বললাম, ‘আমি ডিভোর্স চাই। আমার পক্ষে ওনার সঙ্গে সংসার সম্ভব নয়।’

ডির্ভোস কথাটা শুনে সবাই যেন চমকে উঠেছিল। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। শাশুড়ি এসে বললেন, ‘তুমি কী পাগল হয়েছে? সামান্য বিষয়ের জন্য তালাক চাইছ? তালাক মানে বোঝো?’
আমি হেসে বললাম, ‘সামান্য?’
তিনি প্রত্যুত্তর করলেন না, চোখ নামিয়ে ফেলেন। আমি শ্বাশুড়ির দোষ দেইনা, তিনি যথেষ্ট ভালো মানুষ বলেই আমার মনে হয়েছে। তবে ঐযে আগের যুগের মানুষ, এভাবে তারও ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে। এখন অভ্যস্ত হয়েছেন উনি।

আমার বাবা হুংকার দিয়ে উঠলেন। কিন্তু আমি অটল রইলাম, বললাম, ‘কোনভাবেই আমি এ সংসার করব না। আমাকে কেউ এখানে আটকাতে পারবে না।’
ওপাশে মহিলারা ফিসফিস করলেন। বাবা তেড়ে চড় মারতে এলে আমি সহ্য করলাম না। দৃঢ় গলায় বললাম, ‘আমার গায়ে একটাও হাত তুলবেন না। অনেক সহ্য করেছি। যে জীবন আমার মা পেয়েছিল, সেই জীবনে আমি থাকব মা।’
ব্যস, বাবার আগুন জ্বলে গেল। মাকে যে অত্যাচার, জুলুম, অবহেলায় মেরেছেন এ কথা তিনি কখনও স্বীকার করেননা। বলেন, মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আল্লাহ নিয়ে গেছে।
বাবাকে শান্ত হতে বললেন বাকিরা। তাকে নিয়ে বসালেন, এভাবে রাগারাগি করা যাবেনা। আমাকেও বোঝাতে এলেন কয়েকজন। তবুও আমি সিদ্ধান্ত বদলাম না। তখনই বাবা বললেন, তিনি আমাকে বাড়িতে থাকতে দেবেন না, আমার দায়িত্ব নেবেন না।

সেসময়ে নিজের উপর একটা বিষয়ের জন্য গর্ব হয়েছিল। ভাগ্যিস আমার ইনকামের সোর্স আছে অনালাইনে। ফ্রিল্যান্সিং জানতাম, বেশ বেশি না হলেও মোটামুটি মানের ইনকাম হতো আমার। এছাড়াও ছোটখাটো আর্টের বিজনেস ছিল আমার। সেই জোরে আমি বলতে পেরেছি, ‘আমার দায়িত্ব আমি নিজেই নিতে পারব।’

চলবে।