#নির্বাসিত_ফুল
#কলমে_তানজিলা
২.
আমার শিশুকাল ছিল ভীষণ পীড়াদায়ক। বিষাক্ত, ভয়ের। মারধর, গালিগালাজ, চিল্লাচিল্লিতে বাড়িটা সবসময় মেতে থাকতো। ছোটবেলায় আমার ধারণাই হয়েছিল, বিয়ে হলে মেয়েরা মার খায়। তাই আমি তখন বলতাম, ‘আমি জীবনেও বিয়ে করব না।’ অথচ সে বয়সটাতে বিয়ে জিনিসটা কী, আমি বুঝতাম না।
আমার মা ছিলেন সহজ-সরল গ্রামের মেয়ে। ক্লাস থ্রি নাকি ফোর পর্যন্ত পড়েছেন, অন্যদিকে আমার বাবা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বিবিএড না কী জানি একটা ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। সরকারি চাকরি করতেন। এটা নিয়ে ওনার অহমিকার শেষ নেই। যেকোন বিষয়ে মা পরামর্শ দিলে, কিংবা বাবার কথার অমিল হলেই বাবা মাকে অশিক্ষিত, মূর্খ শালী বলে গালি দিতেন, এছাড়াও আরেকটা খুব খারাপ ভাষা ছিল নিত্যদিনের গালি। ‘আমার টাকা, আমি যা ইচ্ছে করব, কেউ কথা বলতে পারবে না’— এই কথা শুনতে শুনতে কান একদম পচে গেছে আমার। একারণে তখন থেকে আমি পণ করি, বড় হয়ে যে করেই হোক, অনেক টাকা ইনকাম করব।
আমার বাবা মাকে ‘তুই’ করে সম্বোধন করতেন। এবং মায়ের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল, তাকে আপনি বলা। বাবার উচ্চ কণ্ঠস্বর। আস্তে কথা বলতে পারেন না। জনসম্মুখে তার সঙ্গে গেলে এমন ধরণের কথা বলতেন, আশেপাশের মানুষেরা তাকিয়ে মুখ ছিটাকাত। অপমান, লজ্জায় অপদস্ত হতে হতো আমাদের। তবুও যে মা কিভাবে থাকতো। মায়ের ধৈর্য সীমা দেখে অবাক হতাম।
আমি বাবাকে এতটা ভয় পেতাম যে, বাবা বলে ডাকতেও আমার প্রচুর ভয় করত। এতে অনেক বড় দূরত্ব তৈরি হলো। আমার মা খুব অসহায় ছিল। বাড়ি থেকে বিনা পারমিশনে কোথাও যাওয়ার অনুমতি তার ছিল না। বাপের বাড়িও মা যেতে পারেনা। একারণে নানা বাড়ির সঙ্গে তেমন আদ্যখেত নেই আমার। বড় আপার থেকে শুনেছিলাম, আমার নানী মারা যাওয়ার পর মা যখন যাওয়ার জন্য পাগল ছিল, বাবা মাকে বলেছিল, মা গেলেই কী তার নানীকে বাঁচাতে পারবে?
আমি শুনে বাকরুদ্ধ ছিলাম। নানা খুব নরম, সরল মানুষ। মা এমনিতেই খুব কম যেত বাড়িতে। কখনই নিজের স্বামীর বাড়ির কথা ওখানে বলেননি। তখনকার পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক ছিল। মায়ের বড় বোন জানতেন সব, তিনি বলেছিলেন, এসব জানালে তাদের বাবার সম্মান নষ্ট হবে, এছাড়াও সন্তান অর্থাৎ আমাদের জন্য হলেও মানিয়ে নিতে। অবশ্য বড় খালার ভাগ্য ভালো ছিল না, শ্বাশুড়ির অত্যাচারের সংসার তিনিও পার করেছেন। মা এমনিতেই বোকা, সহজ— আমাদের অনেক ভালোবাসতেন। বাবার প্রতিও ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না তার। মারধর শিকার হয়েও বাবা একটু নরমভাবে কথা বললেই মা গলে যেত। আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম, মায়ের একটা রোগ ধরা পড়ল। পিত্তথলিতে পাথর। আমি ওত বুঝতাম না এটা কী।
আমার বাবার দুচোখের বিষ ছিল ডাক্তার। প্রচুর এলার্জি ডাক্তারে, অথচ চাইতেন আমি ডাক্তার হব। মায়ের চিকিৎসা ঠিকমত করেননি তিনি। এভাবেই বছর খানেক পার হলো। আমি নাইনে উঠলাম। মায়ের শরীর বেশি অসুস্থ হলো। ডায়াবেটিকস, প্রেশার আরও কত ধরনের রোগব্যাধি হলো তার। মাঝরাতে হুট করে মায়ের বুকে ব্যথা, কাশি উঠত। মধ্যরাতে আতঙ্কিত হয়ে যেতাম, কেঁদে কেঁদে ডাকতাম, ‘মা, ও মা, মা.. কী হয়েছে?’ মা ওভাবেই আমাকে জড়িয়ে ধরতেন।
আমার বড় আপার সঙ্গে এ নিয়ে বাবার ঝগড়া লাগত। বাবা মাকে গালি দিয়ে বলত, ‘ওদের লাগিয়ে দিচ্ছিস?’
হুমকিও দিতেন, পড়াশোনা বন্ধ করবেন, টাকা দেবেন না। তবুও আপা বলত কারণ আপার পড়াশোনা শেষ। আমারও ইচ্ছে হতো কিছু বলতে, কিন্তু আপা থামিয়ে দিত, ‘তুই ছোট মানুষ, কিছু বলিস না। তোর পড়ালেখার এখনও অনেক বাকি।’
আমি চুপ থাকতাম। এমনিতেও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলতাম না। এভাবেই মায়ের সমস্যা বাড়ল। বছরে এক দুবার ডাক্তারের কাছে যেত। ডাক্তাররা যে টেস্ট দেয়, বাবার কাছে এটা অপছন্দনীয়। টাকা মারার ফন্দি, হুদাই খালি টেস্ট দেয়—এটাই তার মন্তব্য। আমি বুঝতাম না, শরীরের অবস্থা কেমন, এটা টেস্ট না করলে ডাক্তার মুখ দেখে বুঝবে?
এভাবে বছর ঘুরল মায়ের অসুস্থতায়। অসুস্থ অবস্থাতেও সকালে উঠে রান্না বসাতে হত, বাবা ব্যাঙ্গাত্মক করে বলত, ‘ঢং বাদ দে। কী বালের রোগ হইছে তোর? আন্দজি মরিস তুই।’
এসব চোখের সামনে না দেখলে, কেউ যদি শোনাত—আমি কখনও বিশ্বাস করতাম না। মা আমার ঘরে এসে কাদত। শেষ একটা কথা বলতেন, ‘ভালো করে লেখাপড়া কর মা।’ আমি শুধু তাকিয়ে দেখতাম। জীবন, বাস্তবতা কতটা কঠিন।
এখানে আমি মায়েরও দোষ দেব। তিনিও কম ছিলেন না। কেন এত ধৈর্য রাখতেন, কেন এত সরল, কেন এত ভীতু? অবশ্য প্রশ্নটা আমার জানা, মা যেতে পারেননি সন্তানের কথা ভেবে। আমাদের কী হবে, আমাদের ভবিষ্যতের কী হবে। অথচ মা এটা ভাবলেন না, তার পরিণতি কী হবে?
আবারও মা অসুস্থ হলো, তবে এবার যেন সেন্সটাই নেই হলো। লিভারে সমস্যা দেখা পড়ল। ডাক্তার বাবাকে বলেছিল, মা বড়জোর দুই তিনবছর বাঁচবে। কিন্তু বাবা আমলে নিলেন না। ডাক্তাররা ওই রকম ভয় দেখায়।
এক দুবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। কিন্তু ডাক্তারদের টেস্ট দেওয়ায়, বাবা অতিষ্ঠ হয়ে যেতেন। যখন যায়, তখনই কেন টেস্ট দেয়? টাকা খাবে খালি!
অথচ বুঝতে চাইতেন না, তিনি বছরে যান ই এক দুবার। টেস্ট না করালে মায়ের কন্ডিশন জানা যাবে কিভাবে?
বছর দুয়েক পর মা হুট করে জ্বর হলো। অসম্ভব রকমের। মায়ের চোখ হলুদ হলো। জন্ডিস ধরা পড়ল। বাবা তাকে এলোপ্যাথি চিকিৎসার পরিবর্তে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিতে লাগলেন। মাকে বলতেন, ‘পাথরের চিকিৎসা করে পাথর গেছে? উল্টো সমস্যা বেড়েছে।’
তার কোন বন্ধুর জন্ডিস ভালো হয়েছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করে। আপার সাথে বাবার এ বিষয়ে ঝগড়া হলে, বাবা বলতেন, ‘তুই নিয়ে যা তাহলে।’ মাকে আমরা বোঝালাম, এসব চিকিৎসা নিও না। কিন্তু মা নিরুপায় ছিল। মা বুঝত, তার অবস্থা বেশি ভালো নয়। বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। ডাক্তারের কথামত সব করতে লাগলেন।
কিন্তুভালো হওয়ার বদলে মা একদিন বিছানায় পড়ল। তার কোন সেন্স নেই। শরীরে কোন জোর নেই। তাকে নেয়া হলো মেডিকেলে। দুদিন হলেই জ্ঞান না এলে নেয়া হলো আইসিইউতে। মায়ের জ্ঞান ফিরল ঠিকই, কিন্তু পরেরদিনই আমাদের থেকে দূরে। অনেক দূরে চলে গেলেন। যেখান থেকে তিনি কখনও ফিরে আসবেন না। আল্লাহ তাকে বোধহয় শেষ দেখাটুকু করিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে।
মজার বিষয়, এখানেও বাবা দোষ দিলেন ডাক্তারকে। আইসিইউতে নিলেই মানুষ মারা যাবে। মানুষকে মেরে ফেলা হয়—এমন আজগুবি কথা বলতে লাগলেন।
মা মারা যাওয়ার সময় আমি পাগলের মতো কেঁদেছিলাম। সেন্সলেস ছিলাম বটে। এত কান্না আমি আগে কাদিনি। তারপর বুঝলাম, আমার এ কান্না চিরজীবনের। মা বিহীন জীবন সন্তানদের জন্য যেন জীবন্ত জাহান্নাম। আপার বিয়ের কথা না চললে বাবা তিনমাসেই ঘরে বউ তুলতেন। কিন্তু পারেননি, আপার কারণে। মা মারা যাওয়ার পর আপাও বাবার প্রতি কঠোর হলো, যখন জানল এক বছর না হতেই তিনি নতুন কাউকে ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আপার কথা ছিল, আমি আরেকটু বড় হই। তারপর বাবাকে বিয়ে দেয়া হবে নাহয়। কিন্তু তিনি কী অধৈর্য! একা থাকতে নাকি ভয় লাগে!
আপার বিয়ের একমাস না হতেই আমাদের না বলেই হুট করে বউ নিয়ে ফিরলেন। আমি বুঝলাম, মা যে স্বামীর প্রতি এত ভালোবাসা রেখেছিল—লোকটা তাকে কোনদিনই ভালোবাসে নি। একটা বছরও যে মানুষটা অপেক্ষা করতে পারেন না, যাইহোক সে কখনও ভালোবাসেনি মাকে। ৩৬ বছর সংসারের মায়া, ভালোবাসা ছেড়ে কিভাবে পারলেন বুঝ হলো না! তিনি পেলেন সঙ্গী। আমি হলাম একা। মা বিহীন জীবন যে কেমন হয়, হারে হারে টের পাচ্ছিলাম। মায়ের কবরে গিয়ে অভিযোগ করতে লাগতাম। মা শুনল না।
৩৬ বছরের সংসার। বলে কী শেষ করা যাবে? আমার ইচ্ছে আছে, মায়ের জীবনটা নিয়ে বই লেখার। এর মধ্যে সতেরোটা বছর আমার দেখা। নাদান বাচ্চার বয়সটা বাদ দিলেও এগারো, বারো বছর হবে। যবে থেকে বুঝ হয়েছে, দেখছি। এত ছোটবেলার স্মৃতি নাকি মানুষের মনে থাকেনা, অথচ আমি কেন ভুলতে পারিনা? কেন ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ভুলে যাইনি? এর ব্যাখ্যা আমি এখন বুঝি। একারণে ছোট বাচ্চাদের সামনে বাবা মায়েদের উচিত নয় ঝগড়াঝাঁটি করা। মানসিকভাবে প্রভাব ফেলে।
বৈঠক শেষে আমি ঘরে গেলাম। এখানে আর থাকছি না। ডির্ভোসের কথা রেশ ধরে মারবে না, ঠিক আছে? ঘরে আসতেই বুকটা হাহাকার করে উঠল। এ ঘরে যেদিন পা রেখেছিলাম, অনেক স্বপ্ন ছিল স্বামীকে নিয়ে। অথচ কী হলো? এই জীবন, এই সংসার আমি চাইনি। আমি তো চাইছিলাম সুখের সংসার হবে আমার, আপার মত। ডিভোর্সী ট্যাগ যে আমার গায়েও একদিন লাগবে, আমি কল্পনা করিনি।
নিজের জিনিসপত্র গুছাতে লাগলাম। সেসময় আমার স্বামী ঘরে এল। কিছুক্ষণ এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কিছু বললাম না, নিজের মতো গুছাছিলাম। সহসা সে এগিয়ে এলে, চটজলদি বললাম, ‘খবরদার কাছে আসার চেষ্টা করবে না।’
আর কোন মায়ায় পড়তে চাইনা। সে তেড়ে আসতে চাইলে তাকে কেউ ডাকল। গলাটা আমার শ্বাশুড়ির। সে গেল। আমি গোছগাছ করলাম। আমার আর্টের সামগ্রীগুলো নিলাম। আঁকাআঁকি আমার অনেক পছন্দ। স্কুল – কলেজে টাকা জমিয়ে অনেক রঙ তুলি কিনেছি। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে আঁকতাম। তারপর শখের বশে পেইজ খুললাম। গ্রুপগুলোতে দিতাম। জানতে পারলাম, এগুলো সেল করাও যায়। আমারও ইচ্ছে ছিল, টাকা ইনকাম করার। আমিও সেল পোস্ট দিলাম। প্রথমদিকে সেল না হলেও আস্তে আস্তে আমি সফলতা পাই। কাষ্টমাইজ পেইন্টিং শুরু করলাম। অবশ্য এখন অনেকদিন যাবৎ আঁকা হয়না।
যখন আমি অনার্সের জন্য ভর্তি হয়েছিলাম কারমাইকেল কলেজে, হলে থাকতাম। অবশ্য আমার পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স হয়েছিল কিন্তু বাবার জেদের বলি হয়ে গেছিলাম। ভার্সিটিতে ভর্তি ডেট ছিল যেদিন, একদিন আগে— মায়ের বিষয় নিয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া লেগেছিল। কখনও মায়ের মৃত্যুর দায়ভার তিনি নিতে চান না। অবহেলায়, অত্যাচারে মেরেছেন, স্বীকার করতে নারাজ! সেবারে আমি চুপ থাকিনি, মা হারানোর পর যেন মুখে বুলি ফুটতে শুরু করেছিল আমার। আফসোস হতো, এ সাহস আমি আগে দেখাতে পারিনি কেন?
সেই ঝগড়ার পরে বাবা কথা বলা ছাড়েন। আমিও বাড়িয়ে গিয়ে কথা বলিনি। আপা ভর্তির বিষয় বললে, তিনি রাগে নাকচ করলেন, ‘ওর বেয়াদপ মেয়েকে আমি পড়ব না। ওর কোন বাবায় পড়াবে, দেখব আমি।’
আমিও কিছু বলিনি। তার সঙ্গে কথা বলতেও রুচিতে বাঁধত। বুড়ো বয়সে তার ন্যাকামো দেখতাম। বাবার দ্বিতীয় বউয়ের বেশ ডিমান্ড ছিল। আমার মাকে কোনোদিন ভালো সাবান-শ্যাম্পু কিনে দেয়নি, সেখানে এই নতুন মহিলাটাকে তিনি দামী সাবান, পন্স ক্রিম কিনে দিতেন। মাসে মাসে জামা। এদিকে আমার মা? আমার মাকে সবসময় খোটা দিতেন, ‘তোর সন্তানকে দিলাম! তোর সন্তানকে দিলাম!’ এমনই হয়, প্রথম জনকে অবহেলায় মারে, দ্বিতীয়জনকে আটকাতে নিজের সবটা দেয়। এই মহিলার রঙ চংও কম ছিল না। একটু কথা কাটাকাটি হলেই চলে যেতেন। ফিসফিস করে কথা লাগাতেন। তা নিয়ে শুরু হতো বাড়িতে অশান্তি!
এই কারণে আমার পাবলিক পড়া হলোনা। ন্যাশনাল ভর্তি হলাম। রংপুর কারমাইকেল কলেজে। ওখানে আমার রুমমেট অধিকাংশ সময় ল্যাপটপ দেখতো। আমি জিজ্ঞেস করলাম একদিন। সেদিনই ফ্রিল্যান্সিং শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমিও আগ্রহ হলাম, টাকা ইনকামের জন্য। কিন্তু আমার যে ল্যাপটপ নেই। তারপর আমি টাকা বাঁচিয়ে শিখে ফেলেছিলাম। আপাকে জানালাম, আপা ওর মোহরানার টাকা জমিয়ে রেখেছিল। তা দিয়ে আমাকে সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ কিনে দিল। তারপর শুরু হলো।
কিন্তু বিয়ের পর সব বন্ধ হয়ে গেল। সারাদিন কাজ করা শেষে, বাকি যে সময়টুকু পেতাম, স্বামীর কাছে থাকার চেষ্টা করতাম। আমি চাইতাম, আমার সুখের সংসার হোক। বিয়ের সময় মিথ্যে বলা হয়েছিল নাকি প্রতারণা হয়েছে জানি না আমি—বিয়ের আগে ওরা শহরে থাকতো, কিন্তু একমাস হতেই ওদের নিজস্ব বাড়িতে শিফট হলো, যেটা শহর থেকে কয়েক কিলো দূরে। একবারে গ্রামও নয়, শহরও নয়।
সব স্মৃতি চেপে রেখে ব্যাগ গুছে, রেডি হয়ে বেরোতেই দেখলাম। বাবা এখনো যায়নি। আমার মনে আশা জাগল— হয়তো আমাকে নিয়ে যাবেন। যতই হোক, বাবা তো। পিতৃস্নেহ জেগে উঠবে, এক্ষুনি হয়তো শাণিত গলায় বলবে, ‘চল বাড়ি!’
কিন্তু নাহ। আমার তাকানোতে তিনি কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘তোর মত বেয়াদপ মেয়ের জায়গা আমার বাড়িতে নেই। আমার টাকা পয়সা কোন কিছুই..
এসব কথা শুনতে আমার কান পচে গেছিল। চাইলেই এসব বাড়িতে গিয়ে বলতে পারতেন, কিন্তু না! সকলের সামনে আমাকে আরও ছোট করলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার বাড়ি ছাড়া আমার থাকার জায়গা নেই? আপনার টাকা ছাড়া আমি কী ভিক্ষা করে খাব? আপনার সাহায্য ছাড়া মরে যাব? গেলাম! তবুও আপনার বাড়িতে যাব না।’
বলে পা বাড়ালাম। কিন্তু একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। পিছনে তাকিয়ে বললাম, ‘ভুলে যাবেন না, এসব আমার মায়ের গড়া। আমার মায়ের মোহরানা আছে।’
বলে এগোলাম, শ্বাশুড়ীকে বললাম, ‘আমার গাছগুলোকে দেখিয়েন। নাহলে অবহেলায় ওরাও মারা যাবে।’ আর এক মিনিটও দাড়ালাম না। বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আসার আগে আমার স্বামী ও শ্বশুরের মুখটা দেখলাম। তারা যেন নিশ্চিত ছিল, যে মেয়ের বাবাই তাকে গ্রহণ করেনি, সে মেয়ে যাবে কোথায়? দুদিন বাদে ঠিকই আসবে।
আমি বড় আপাকে কল করে জানালাম। আপা বাবার উপর রাগ হলেন, ‘উনি আর চেঞ্জ হলো না! বেয়াদপ লোক। বাবা বলতেও ইচ্ছে করেনা।’
তারপর আপা আমাকে বললেন, ‘ময়না, তুই আমার বাড়িতে আয়।’
আমি জানতাম আমাকে আপার বাড়িতেই যেতে হবে। আপার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা অনেক ভালো। সত্যি বলতে, বাপের বাড়ির থেকে, শশুর বাড়িতেই আপা বেশি সুখী। আপা বেশি রাগী, কিন্তু দুলাভাই! একদম ঠান্ডা। আপা রাগ হলে, তিনি চুপচাপ শুনেন, তারপর বলবেন, ‘তুমি শান্ত হোও।’
এছাড়াও আপার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি তারাও কম নয়। সাধারণত শশুর বাড়িতে মেয়েদের বেড়ে খাওয়াতে হয়, কিন্তু আপার শ্বাশুড়ি তাকে বেড়ে খাওয়ায়। আপাকে উঠানটুকু ঝাড়ু দিতে দেয়না, তার শ্বশুর। নিজেই ঝাড়ু দেন। আপা যেহেতু পর্দা করতেন। আপার শ্বশুর বাড়ির প্রশংসা করে শেষ হবেনা।
আমি আপার বাড়িতে গেলাম। আপা সব শুনে শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিয়েছিস?’
আমি হ্যাঁ বললাম। ও বলল, ‘ঠিকাছে। আমি তোর সঙ্গে আছি। তুই এখানেই থাক। সামনে আমার ডেলিভারী, তুই থাকলে ভালোই হবে।’
আমি মাথা নাড়ালাম। আপাতত এখানে থাকি। তবে দ্রুত নিজের ব্যবস্থা করতে হবে। চাকরি খুঁজতে হবে। অনেকদিন হলো ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করা হয়না। ল্যাপটপেও সমস্যা। পেইজটাও পড়ে আছে। আবারো এক্টিভ করতে হবে সব।
এভাবেই সময়গুলো কেটে গেল। একদিন শুনলাম, আপার শ্বশুরকে বাবা কল করে বলেছে, আমাকে কেন রেখেছে এখানে?
আপার শ্বশুর বরাবরই ভালো মানুষ। তিনি বলেছেন, ‘কেমন বাবা আপনি? নিজের মেয়েকে বের করে দিতে বলছেন?’
বাবা থতমত খেয়ে বলেন, ‘ওকে রাখলে, ও শশুর বাড়িতে যাবে না।’
আপার শশুর বলেন, ‘ও এমনিতেও যাবেনা।’
এই বলে কেটে দেন। আমি একটুকুও অবাক হইনা। বাবার কাছে মেয়েদের ডির্ভোস অনেক বড় বিষয়। যাইহোক, সংসার ধরে রাখা উচিত। বারবার মায়ের উদাহরণ পেশ করবেন। কিন্তু আমার কাছে অত্যাচারিত, নির্যাতনের সংসারের গেলে বিচ্ছেদ ই ভালো। আর্থিক কষ্ট হলেও মনখুলে বাঁচা যাবে।
দেখতে দেখতে আমাদের ডির্ভোসের সময় ঘনিয়ে এল। আমার শশুর বেশ ভালোই ছিলেন, হাসিখুশি। দেনমোহর বেশি না। অধিকাংশ সোনা, গয়না দিয়ে পরিশোধ করেছিল, সেগুলো শ্বাশুড়ির কাছেই আছে। আনাই হয়নি। শীঘ্রই নিয়ে আসব আমি, ছাড় দেব না। ডিভোর্সের আগ মুহূর্তে আমি বেহায়া হলাম। স্বামীর দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মনে একটু আশা এল। মানুষটা আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলুক, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না সুবাসিনী। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কোনোদিন তোমার গায়ে হাত তুলব না।’
যাইহোক, তার প্রতি আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না। আমার ভাবনার এমন কিছুই হলো না। নিজেকে সামলে নিলাম। চোখের জলটুকু পড়তে দিলাম না। নিজেকে বললাম, ‘মায়ের মৃত দেহটার কথা মনে কর সুবাসিনী। আবেগী হলে তোরও ওমন পরিণতি হবে।’
চোখ বন্ধ করতেই মায়ের লাশটা ভেসে উঠল। নিজেকে শক্ত করলাম। নির্দ্ধিধায় সই করলাম। মনটা যেন বলল, ‘মুক্ত জীবনে স্বাগতম সুবাসিনী’
চলবে~