নির্বাসিত ফুল পর্ব-০৫

0
13

#নির্বাসিত_ফুল
#কলমে_তানজিলা

৫.

ডিভোর্সটা ভুল সিদ্ধান্ত না হলেও সেসময়ে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। যখন ডির্ভোসের কথা ভেবেছিলাম, তখন মাথায় ছিল ফ্রিল্যান্সিং পারি, পেইন্টিংয়ের ছোট বিজনেস পেইজ আছে—এসব দিয়ে নিজেকে চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন। সেসময়ে উত্তেজনায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, বিয়ের পর আমার সব বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ, সংসারের চাপে অত কী করা সম্ভব হয়? কয়েকমাস দূরে! মস্তিষ্কে যেন জঙ ধরেছে। নিয়মিত চর্চা ছাড়া কোনকিছুই হয়না, সেখানে কতগুলো মাস আমি এসবে চোখ বুলিয়েও দেখিনি। সেকেন্ড হ্যান্ড যে ল্যাপটপটা ছিল, সেটাতেও এত সমস্যা! কিছুক্ষণ পর পর স্ক্রিন অফ হয়ে যায়। ডিভোর্সের পর ভেবেছিলাম, ঠিক করব কিন্তু মন সায় দিল না। ঠিক করতে বেশ টাকা লাগতো—সেসময়ে ভেবেছিলাম কিছু একটা করে চালাতে পারব নিজেকে। কিন্তু হলো না। বাস্তবতা আসলেই আমাদের ভাবনা, স্বপ্নের থেকেও কঠিন, আমি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারছি। অথচ পথটুকু কত সোজা ভেবে নিয়েছিলাম।
সেসময়ে গয়নার টাকাগুলো দিয়ে যদি আমি ল্যাপটপটা ঠিকঠাক করতাম, আবারও শুরু করলাম, পেইন্টিং শুরু করতাম তাহলে এখন হয়তো এত দুর্দশা হতো না আমার। কী করার? উচিত কাজ সময়ে হয়না—এটা চিরন্তর সত্য। তার প্রমাণ আবারও পেলাম। ভুলগুলো আমারই।

কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অসুস্থ হয়ে পড়ে রইলাম প্রায় এক সপ্তাহের বেশি। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখলাম না। টাকা কই? এভাবে নিজের দিনকাল কাটতে লাগল। চাকরির খোঁজ চালালাম। পত্রিকা দেখে ওখানের একটা চাকরিতে এপ্লাই করলাম, কিসের চাকরি, কী আমি জানি না অত। কোন একটা কোম্পানির ছিল। ইন্টারভিউ দিলাম কোনরকম।

শিক্ষকতা পেশাটাই আমার মত মেয়েদের জন্য পারফেক্ট ছিল। কিন্তু চাইলেই কী হয়? আমিও কী বোকার বোকা! মানুষ বছর বছর ধরে প্রিপারেশন নিয়েও পায়না, সেখানে আমি কয়েকমাসের ব্যবধানে পাব বলে আশা রাখছিলাম। যাইহোক শেষমেশ আমাকে সেলস ম্যানের জবেই জয়েন করতে হলো। একজন মেয়ে ইনফ্লুয়েন্সার, তারই শোরুম। সাড়ে নয় হাজার টাকা বেতন। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত থাকতে হবে। খাওয়া দাওয়া ফ্রি। তবে আমার শরীরের অবস্থা এমনিতেই নাজুক, এতক্ষণ বোরকা হিজাব পরে থাকতে হবে, এতে বোধহয় আরও দুর্বল হয়ে পড়ব। কিন্তু করার কিছু নেই। দুদিন বাদে পেটে ভাত না জুটলে কে খাওয়াবে? এ সমাজের মানুষ, আপনি খেটে খাবেন—অনেক কথা শোনাবে, কিন্তু দুদিন না খেয়ে থাকবেন, কেউ কথা বলবে না।

এ জবে আমার অসুবিধা হতো। কারণ আমি ছিলাম চাপা স্বভাবের মেয়ে। এখানে সর্বদা মানুষের সঙ্গে প্রসন্নমুখে কথা বলতে হতো, কিছু মানুষ আজাইরা কথা হজম করতে হতো। তবে কয়েকমাস করতে করতে আমার সমস্যাগুলো দূর হলো। অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তারপর আর খারাপ লাগছিল না তেমন। শোরুমের ওনার আপুটাও বেশ ভালো ছিলেন। কয়েকদিন এসেছিলেন, পরিচিত হলাম। তারপর আমার গল্পটা শুনলেন। তিনিও আমাকে অনুপ্রেরণা দিলেন, ভেঙে না পড়তে। আমিও ঠিক করে নিলাম, এ জব ছাড়ব না। যাইহোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আরেকটা পার্মারেন্ট জব না পাব—ততদিন এটাই করব। পাশাপাশি আমার পুরাতন কাজগুলোও শুরু করব।

মাসের প্রথম স্যালারি থেকে অর্ধেকই বাড়ি ভাড়া গেল। যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং খাওয়া দাওয়া আমি নিয়ম মাফিক চললাম। সেখান থেকে কিছু টাকা আমি সঞ্চয় করলাম। ল্যাপটপটা এবার ঠিকঠাক করবই করব। মাস্টার্সের পড়া শুরু করলাম, একটা বছর গ্যাপ পড়বে যেহেতু সামনেই পরীক্ষা, আমার পড়া কিছুই হয়নি।
সেদিন অনেক দিন পর আমার আঁকাআঁকির সমগ্রী গুলো খুললাম। রঙ গুলো জমে আছে। বিজনেস পেইজেও পোস্ট করলাম, কিন্তু রিচ হলো না। তবুও থেমে থাকলাম না। অবসর সময় খুব কম পেতাম, জব শেষে আমার পড়াশোনা ছিল। তাই ছুটির দিনগুলোতে আমি রেস্ট টেস্ট না নিয়ে পেইন্টিং শুরু করলাম। দেখলাম, আমার আকার হাত খারাপ হয়েছে। এসব নিয়মিত প্র্যাকটিস না থাকলে এমনই হয়। তবুও হাল ছাড়লাম না। সূরা নাজমের একটা আয়াত ৩৯ আছে না, ‘আর মানুষ তাই পায়, যা সে চেষ্টা করে’ যখনই হতাশ হতাম, কুরআনের আয়াত গুলো পড়তাম, আবারও যেন বেড়ে উঠার শক্তি পেতাম। আমার আত্মবিশ্বাস, এখন কষ্টের মধ্যে থাকলেও একসময় আল্লাহ আমাকে অফুরন্ত সুখ দেবেন। ততদিন আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাব।

এভাবে চারটে মাস গেল। টিউশনি পেয়েছিলাম। ক্লাস নাইন-টেনের। কিন্তু সাবজেক্টগুলোতে সমস্যা হচ্ছিল। সাইন্সের ছিল। ইন্টার পর্যন্ত সাইন্স পড়েছিলাম, অত মনে নেই। যদিও বই পড়ে ধরতে পারছিলাম, কিন্তু নিজের বিবেক সায় দিল না। চাইলেই পড়াতে পারতাম কিন্তু মনে হলো অভাবের তাড়নায় কারোর স্বপ্ন না ভেঙে ফেলি। পারদর্শী টিচার প্রয়োজন। তাই বাদ দিলাম। যেমন তেমন করে পড়িয়ে নিজের অভাব ঠিকই ভরতে পারব কিন্তু নিজের নফসের কাছে হেরে যাব। আমার প্র্যাকটিসের প্রয়োজন। যা মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছিল না।

প্রতিমাসে আমি বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করলাম। সেই টাকা দিয়ে ল্যাপটপ টা মেরামত করতে নিয়ে গেলাম। মনে হলো, এইতো আমার ভাগ্য খুলছে। অনেকদিন বাদে কাজগুলো শুরু করলাম, কিন্তু পারছিলাম না। যখনই হতাশা ঘিরে ধরছিল, নামাজ পড়ে দোয়া করছিলাম। আবারও চেষ্টা চালালাম। এভাবে করে করে হচ্ছিল যেই, সেই আবারও সমস্যা দেখা দিল ল্যাপটপে। ক্রিন কেমন ঝিরঝির করছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসে এক সমস্যা, একারনেই দেখেশুনে কেনা উচিত ছিল।

সেদিন আপার কল এল। আপা ডাকছেন আমাকে। অনেকদিন যাওয়া হয়না। ব্যস্ততার কারণে কথাও কম হয়। আমি বললাম কাল পরশুর মধ্যে যাব।
পরেরদিন, কাজ শেষে আমি ডাক্তারের কাছে যাই। শরীর ভালো ঠেকছিল না। সিরিয়াল ধরে বসে থেকে বেশ দেরী হলো বাড়ি ফিরতে। কিছু টেস্ট দেখিয়েছিলেন, সেসব করে রিপোর্ট দেখিয়ে ঔষুধ কিনে নিয়ে আসলাম। মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখা হলো একজন আন্টির সঙ্গে। উনি আমাকে আড়চোখে দেখলেন। সন্দিহান বললেন, ‘এত রাতে বাড়ি ফিরছ?’
আমি সাবলীল ভাবে জানালাম, ‘কাজ করতে করতে একটু বেশি দেরী হয়েছে।’
বলে দ্রুত প্রস্থান করলাম। মহিলাটা বোধহয় উপরতলায় থাকে। তারপর আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আপার বাড়ি যাওয়ার। খালি হাতে যেতে অস্বস্তি বোধ লাগছিল। বাচ্চাদুটো আছে, ওদের জন্যই কিনেছি কিছু।
সকালে হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। সচরাচর এটা বাজে না, বাড়ীওয়ালা না এলে। ভাবলাম তিনি বোধহয় এসেছেন, গেট খুলতেই গতরাতের আন্টিকে দেখলাম। উনি হাসলেন। হাতে খাবার। আমি প্রসন্নমুখে ভেতরে নিয়ে এলাম। উনি এসে বসলেন। তাকে চা, পানি, নাস্তা দিলাম। উনি কথা বলতে শুরু করলেন আমার জবের। আমিও তার সঙ্গে বললাম, আমি কিসের জব করি। প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে, ভালোই হয়।
উনি চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘তুমি একা থাকো কেন?’
আমি ক্ষীণ হেসে বললাম, ‘কারণ একাকীত্বই একমাত্র সঙ্গী, যে কখনও প্রশ্ন করে না, অভিযোগ করে না। নীরবতার ভাঁজে কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখে।’
তিনি আমার কাব্যিক কথা বুঝলেন না। আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কেউ নেই?’
আমি মন্থর গলায় বললাম, ‘মা মারা গেছেন।’
‘আর বাবা?’
‘দুনিয়াতে কিছু মানুষের সব থেকেও কিছু নেই—আমিও এমন একজন।’
তিনি কী বুঝলেন, আমি জানিনা। দুঃখী গলায় বললেন, ‘ওহ, আবার বিয়ে করে তোমাদের দেখে না, তাইনা? এমনই করে।’
আন্টির ভাবনা পুরোপুরি সত্য নেয়, দ্বিতীয় বিয়ের পর বাবা আমাদের ছুঁড়ে ফেলেননি। তাই মিথ্যে অপবাদ তার উপর দিলাম না। সোজাসুজি বললাম, ‘না, কারণটা অন্য। আমি ডিভোর্সী। তাই।’
উনি হতবিহ্বল হয়ে বলেন, ‘কিহ! তোমার বিয়েও হয়েছিল? ডিভোর্স! কেন? কেন হয়েছিল?’

আমি বুঝিনা, মানুষ কেন অন্যের ব্যক্তিগতবিষয় জানতে চায়। বোঝে না, এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। না চাইতেও বলে ফেললাম। উনি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ওহ্।’ তারপর থেমে, ‘তুমি কিন্তু চাইলে আরেকবার সুযোগ দিতে পারতে। তাড়াহুড়ো করে ফেলছ।’
‘এতবার মার খেয়েও তার কাছেই ফিরে গেছিলাম। সুযোগ কম দিয়েছিলাম?’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘কী করবা বলো? এখন দেখ, কী কষ্টটা করছ। তোমাদের মতো মেয়েদের সাথে এসব জব যায়? তবুও করতে হচ্ছে, তাও অভাব পূরণ হচ্ছে না। এই কষ্টটা সংসারে করতে, তাহলেমানুষের সামনে দিনরাত থাকতে হতো না।’

তার কথায় স্পষ্ট প্রকাশ পেল। কতটা সংকীর্ণ ভাবে দেখছেন জবটাকে। আমি কিছু বললাম না। যার যেমন ভাবনা। আন্টি চলে গেল। বিষয়টাতে আমার রাগ লাগল না। তবে ভাবাচ্ছিল বেশ। আসলেই আমি যেভাবে বেড়ে উঠেছি, এসব কাজ আমার সঙ্গে যায়না। ভুল করেও কখনও কল্পনা করিনি। কিন্তু আজ! আজ আমাকে করতে হচ্ছে। মনটায় বিষণ্ণ হয়ে গেল। সেদিন মনটা এমনই রইল। এভাবেই আপার বাড়িতে গেলাম। আপার বুঝতে দেরী হলো না। জিজ্ঞেস করল। আমি বলতে চাইলাম। শেষে বলতেই হলো। আপা সব শুনল। আমাকে আশ্বাস দিল, ‘মন খারাপ করিস না। দেখিস একদিন অনেক বড় জায়গায় যাবি তুই, আমার বিশ্বাস। হাল ছাড়িস না।’

দুলাভাইও একই কথা বলেন। দুলাভাইকে আমি আমার ল্যাপটপের কথা জানালাম। উনি তাকে দিতে বললেন। আমি ল্যাপটপ তাকে দিলাম। কেটে যায় আরও কদিন। এর মধ্যে দুলাভাই একদিন কল করে জানতে চাইল, ‘আগে কোথা থেকে ঠিক করেছ?’
আমি তাকে এড্রেস বললাম। এরপর উনি কাগজগুলো চাইলেন। বুঝে উঠলাম না ঠিক। দিলাম ওনাকে। সপ্তাহ খানেক বাদে আপা দুলাভাই দুজনে আসলেন। দুলাভাই জানালেন, যেখানে ঠিক করতে দিয়েছিলাম, তারা অরজিনাল কিছু একটা খুলে নিয়েছে, ডুপ্লিকেট লাগিয়েছে। এজন্য ভালো দোকান এসব ঠিক করতে দিতে হয়। আমার কী ওত জ্ঞান আছে! সেবার আমাকে টাকা দিতে হলো না, দুলাভাই ঠিক করে এনে দিলেন। কিছু সতর্কতা ছিল তাতে।
যাইহোক একটা বোঝ কমলো অন্তত। জব, পড়াশোনা শেষে যেটুকু সময় পেতাম মন দিয়ে কাজ করতাম। একসময় আমার কাজগুলো আগের মতোই হতে লাগল। চাপ অনেক ছিল, তবুও নিজেকে সামলে নিতাম। বিশ্বাস রাখতাম, আমি পারব। একটা মানুষের সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানসিক অবস্থা। মানসিকভাবে অসুস্থতা তাকে শারীরিকভাবেও অসুস্থ্ করে ফেলে। তাই ব্যর্থ হলেও ভেঙে পড়া আমি ছেড়ে দিলাম। মনে আশ্বাস রাখলাম, কিছু না হলেও আমার আপা আছে। এভাবেই দিনকাল কাটল।
হঠাৎ একদিন চোখ পড়ল ক্যালেন্ডারে। সময় কতটা পেরিয়ে গেছে! আমার ডির্ভোসের দেড় বছর হতে চলল প্রায়। আর দেড় মাস পরেই হবে। এখনও সেই ছোটখাটো জবটাই করছি। কোচিংয়ে অফার পেয়েছিলাম, কিন্তু টাকা কম, ক্লাসও বেশি। মনটাও সায় দিল না, যদি আগের মতো হয়? দেখা গেল, এই জবটাও ছাড়লাম, ওখান থেকেও বাদ দিল। তখন?

শো রুমের জবটাতে আপুটা স্যালারি বাড়িয়েছে আড়াইহাজার টাকা। খাওয়টাও ফ্রি। খাটুনি বেশি, তবে এখন আগের মতো খারাপ লাগেনা। তাই কোচিংয়ের জবটা করলাম না। সময়ের তালে আমার মাস্টার্সের পরীক্ষা এল। প্রিপারেশন একদম খারাপ নয়, আবার খুব বেশি ভালো বলা যায়না। মোটামুটি হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যেন আরেকটা বোঝ কমলো। এখন ফাঁকে ফাঁকে চাকরির জন্য পড়তে লাগলাম। চাপ ছিল অনেক, কিন্তু নিজেকে ভেঙে পড়তে দেইনি। স্থির শান্ত মনে সামলে নিতাম সব। আমার আয় বাড়ল। প্রথম প্রথম অল্প সংখ্যক হলেও আস্তে আস্তে বাড়তে লাগছিল। আমি বেশি আনন্দিত হইনি, কারণ যখনই একটু খুশি হই, দুঃখ গুলো ছুটে আসে।

কিভাবে কিভাবে যেন সময়গুলো চলে যাচ্ছিল। এতটা দ্রুত যেতে লাগল আমি টেরও পেলাম না। দুটো বছর চলে গেল! ভাবতেও ভীষণ অবাক লাগে আমার। দুটো বছর! এইতো সেদিন না আমি ডিভোর্স নিয়েছিলাম? যাইহোক, এখন অবস্থা ভালোই আছে আমার। পেইন্টিং টুকটাক সেল হয়, ফ্রিল্যান্সিং এ বেশ ভালই মোটামুটি মানের আয় হচ্ছে। একটু টানাপোড়েন তো আছেই! তবে ভালোই কাটছে দিনকাল। মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে, সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি।
সেদিন হঠাৎ অনেকদিন পর হোয়াটস অ্যাপ এর নোটিফিকেশন আসল। দুলাভাই ছবি পাঠিয়েছেন। ঢুকতেই দেখলাম, সম্ভবত কোন চাকরির। আবারও সেই শিক্ষকতার। আমার একটুকুও আগ্রহ জন্মালো না, যদিও আমি এর পড়াশোনা করছিলাম। তবুও দুইবারের ব্যর্থতার কষ্টগুলো চোখের সামনে ভেসে আসছিল। আমি ঠিক করেছিলাম আরও একবছর পরের পরীক্ষাটি দেব।

কিছুক্ষণ পর আপা কল করল। আমি রিসিভ করতেই আপা বলল, ‘সৌমি, কেমন আছিস বোন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই কেমন আছিস? পিচ্চি দুটো?’
আপা বলল, ‘সবাই ভালো আছে রে। ছোটটার জ্বর হয়েছে! ভাবছিলাম তোর কাছে যাব, কিন্তু বাচ্চাটার অসুস্থতার কারণে যাওয়াই হলো না।’
আমি বললাম, ‘বাবুর খেয়াল রাখ আপা। পরে একদিন আসিস।’
আপার সঙ্গে আরও অনেক কথা হলো। তারপর বলল, ‘তোর ভাইয়া হোয়াটস অ্যাপ পাঠিয়েছে দেখছিস?’
আমি হ্যাঁ বললাম। আপা আমার নির্লিপ্ততায় বুঝে গেল যেন। বলল, ‘ওটার প্রিপারেশন না।’
আমি অনীহা প্রকাশ করলাম, ‘পরের বছর দেব আপা।’

আপা দৃঢ় গলায় বললেন, ‘পরের বছর মানে! তুই তো এমনিতেও চাকরির জন্য পড়ছিস, তাহলে পরীক্ষা দিতে সমস্যা কোথায়? চেষ্টা না করলে পারবি?’
আপার জন্য সেবার আবেদন করলাম। এটা মূলত ছিল ‘সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তর আওত্তাধীন বিভিন্ন সেনানিবাসে ক্যান্টনমেন্ট দ্বারা পরিচালিত স্কুল কলেজের শিক্ষক নিয়োগ’।কলেজ এবং মাধ্যমিকের আমার হবেনা, তাই প্রাইমারি অর্থাৎ জুনিয়র শিক্ষক পদে আবেদন করলাম। প্রিপারেশন নেয়া ছিল, প্রস্তুতি ভালোভাবে নিলাম।
প্রিলিমিনারী পরীক্ষা ভালো হলো। অকস্মাৎ বিষয় আমি উত্তীর্ণ হলাম। কেটে যায় কয়েকটা দিন। একে একে বাকী পরীক্ষাগুলোও হয়। ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়েই আমি দেই। কিন্তু কোন আশা রাখিনি।
সময়ের সাপেক্ষে কেটে যায় দিনগুলো। ইদানিং একটা ছেলে বারবার শপিং করতে আসে। আসাটা স্বাভাবিক হলেও অস্বাভাবিক বিষয় হলো আমার কাছেই সর্বদা আসে, অন্যদের থেকে নেয়না। হেসে হেসে ইনিয়ে বিনিয়ে বিভিন্ন কথা বলবে। আমি তার উদ্দেশ্য ঠিকই বুঝেছি। ছেলেটাকে দেখে যতদূর মনে হলো, অনার্স পড়ছে। একদিন কথাও হলো। ছেলেটাই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ইনডাইরেক্ট বলল, ‘জীবনে কিছু মানুষ থাকে, যাদের সঙ্গে সময় কাটালে সময় ফুরোয় না। আপনি আমার কাছে তেমনি একজন।’
তারপর আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কী একাই থাকেন?’ বুঝলাম ছেলেটা আমার পিছু নিতে নিতে বাড়ি অব্দি। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে।
আমি ভণিতা ছাড়াই বললাম, ‘জি ডিভোর্সের পর আমি একাই থাকি।’
ছেলেটা চমকে তাকাল। বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনি ডির্ভোসী?’
আমি মাথা নাড়ালাম, ‘জি।’

ছেলেটা থমকে দাঁড়িয়ে রইল। আমার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ তীব্র হর্নের শব্দে ধ্যান ভাঙল ছেলেটার। আমাকে কোনরকম বলল, ‘আমি আসি।’
বলে তৎক্ষণাৎ গায়েব হয়ে গেল। আমি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসলাম। মানুষও পারে!
আমি বাড়িতে এলাম। বাড়িতে ঢুকেই দেখি মালপত্র। আমার সম্মুখের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। আমি নিজের ঘরে গেলাম। কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। সামনে ধর্মীয় উৎসব। তাই বেশি ব্যস্ত থাকছি। দুলাভাইয়ের কল পেলাম হঠাৎ। আমি রিসিভ করে সালাম দিলাম। দুলাভাই বললেন, ‘সৌমি, রেজাল্ট দেখেছ?’
আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের রেজাল্ট ভাইয়া?’
তখন ভাইয়ার থেকে আপা ফোন কেড়ে বললেন, ‘ময়না, আজকে যে ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের যে পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। তুই দেখিস নি?’
‘না।’
‘দেখে আমাকে জানা।’
‘পরে দেখব আপা, এখন ভীষণ ব্যস্ত আছি।’
‘ঠিকাছে।’

কল কেটে দিলাম। আমার ভালো লাগছিল না। এ পরীক্ষা নিয়ে আমি মোটেও আশাবাদী নই। ব্যস্ততার মাঝেও ভুলেই গেলাম দেখার কথা। সেদিন ফেরার পথে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হলো। অপরাধীর মত আছে। আমি বেরোতেই আমাকে বলল, ‘আমি দুঃখিত, এতদিন আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য। না জেনেই আপনাকে বিরক্ত করে ফেলেছি। ক্ষমা চাচ্ছি।’
আমি ছোট করে, ‘ইটস ওকে’ বললাম। ছেলেটা চলে গেল। আমিও আমার পথ ধরলাম।
পরেরদিন আপা আবারও কল করে মনে করিয়ে দিলেন। আমিও অনাগ্রহ নিয়ে দেখলাম। দেখে যেন থমকে গেলাম। বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। আমার ভাগ্যটা এমন কেন? আমি ধপ করে বসে রইলাম। চোখ মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ বাদে আবারও দেখলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! এটাকেই কী তবে বলে, ব্যর্থতার মাঝে সফলতা?
চলবে~