নির্বাসিত ফুল পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
14

#নির্বাসিত_ফুল
#কলমে_তানজিলা

৭. (শেষ পর্ব)

মনটা যখনই একটু খুশি হতে শুরু করে তখনই মন খারাপ শুরু হয়। দিনকাল ভালো গিয়েও ভালো যাচ্ছে না। অকারণে মন খারাপ থাকে। আপার থেকে জানলাম, বাবা সুস্থ হয়েছেন। বাড়িতে গিয়েছেন। মায়ের সঙ্গে অনেক জঘন্য কাজ করেছেন উনি। তবুও মায়ের তার প্রতি অভিযোগ ছিল না, ক্ষমা করে দিয়েছেন। সেখানে আমি ধরে রেখে কী করব? সেদিন যদি বাবা আমাকে বাড়িতে এনে কথা গুলো বলতেন, তাহলে হয়তো এতটাও কষ্ট পেতাম না।

সেসব কথায় গেলাম না। আলোর কাজের পরিমাণ বাড়ছে। অল্প সময়ে মেয়েটা কঠোর পরিশ্রম করেছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকাগুলো আমি অযথা খরচ করছি না। এটা রেখেছি সামনে কাজে লাগাব। আলোর মত আরও মেয়ে খুঁজব। এভাবে কেটে যায় কয়েকটা মাস। সেদিনটা আমার বিয়ের তারিখ। হঠাৎ মনে পড়ল, প্রাক্তন স্বামীর কথা। আরেকটা বিয়ে করেছে। বেশ সুখেই আছে নিশ্চয়ই। প্রায় একবছর আগে দেখা হয়েছিল, সেদিন ঘটেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা। যা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল।

সময়গুলো দ্রুত কাটছিল। মায়ের কথা মনে পড়তো খুব। ইশ, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন। মা না থাকার আফসোস —পৃথিবীর সমস্ত কিছু না থাকার আফসোস..
মায়ের কথার সঙ্গে মনে পড়ল, আমার শ্বাশুড়ির কথা। কেমন আছেন মানুষটা? রোগা শরীরটা নিয়ে এখনও খেটে চলছেন? অনেকগুলো বছর হয়েছে, ইচ্ছে করল ওনার সঙ্গে দেখা করার। সময় করে গেলাম একদিন সেই বাড়িতে। প্রাক্তন শ্বাশুড়ি মায়ের জন্য অনেক ফলমূল কিনলাম। এলাকা পা রাখতে দেখলাম, সব কত পরিবর্তন হয়েছে। গেট দিয়ে ঢুকতেই নজর পড়ল—আমার প্রিয় গাছগুলোর উপর। দু তিনটে মরে গেলেও বাকিগুলো বেঁচে আছে। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। উনি আমার কথা রেখেছেন, আমার গাছগুলোকে যত্নে রেখেছেন। আমি কী বলে ডাকব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। রান্নাঘরে তিনি। গন্ধ উঠেছে। ডিভোর্সের পরেও মা বলাটা শোভা পায়না। তৎক্ষণাৎ কারোর দুর্বল কণ্ঠ শুনতে পারলাম। আমার সেই শ্বশুরের। তখনই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে চিনলেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন?’
আমার কণ্ঠস্বর পরিচিত লাগল তার। তিনি সন্দিহান কণ্ঠে বললেন, ‘সৌমি?’
আমি মাথা নাড়ালাম, ‘জি।’
অবাক চোখে দেখছিলেন আমাকে। তারপর গেলেন শ্বশুরের কাছে। আমি একটু চিন্তিত হলাম, লোকটা আমার কণ্ঠ নিশ্চয়ই শুনেছে, তবে বেড়িয়ে এল না কেন? কিছুক্ষণ বাদে শ্বাশুড়ি এলেন। আমাকে বললেন, ‘বসো। হঠাৎ কী মনে করে এলে?’
আমি বসলাম, ফলমূলগুলো তাকে দিয়ে বললাম, ‘জানি না, আপনার কথা মনে পড়ছিল। তাই এলাম।’

ফলমূলগুলো হাতে করে বললেন, ‘এসব আনতে গেলে কেন?’
‘আপনার জন্য।’
আমি মুখটা খুললাম। তিনি এসে বসলেন, ‘দাঁড়াও চা আনি।’ আমি নাকচ করলাম, ‘পরে খাবো। আগে কথা বলি।’ তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিনকাল কেমন যাচ্ছে আপনার? আগের থেকে শুকিয়েছেন।’
তিনি মলিন হাসলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি দেখি আগের থেকে বেশ সুন্দর হয়ে গেছো সৌমি।’
আমি হেসে ফেললাম। উনি বললেন, ‘বেশ ভালই আছো!’
‘জি আল্লাহ্ রহমতে।’
তিনি নিষ্প্রভ হেসে জানতে চাইলেন, আমি কী করছি বর্তমানে। বিয়ে করেছি কিনা। আমি জানালাম। তিনি প্রসন্নমুখে বলেন, ‘যাক, জেনে ভালো লাগল। সুখে থাকো।’
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘আপনারাও তো বেশ ভালই আছেন!’
ওনার মুখের জ্বলজ্বল ভাবটা কমলো, ‘আর ভালো থাকা।’
আমি একটু টিটকারী করলাম, ‘আপনার ছেলে আবার বিয়ে করেছে। নিশ্চয়ই এখন মনের মতো বউ এসেছে আপনাদের ঘরে।’
তিনি বলেন, ‘না রে মা!’
তখনই আবারও সেই দুর্বল কাপা কণ্ঠে, ‘কে.. কে এসেছে?’
উনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘সৌমি! সৌমি এসেছে।’
আমি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলি, ‘ওনার কী হয়েছে? ঘর থেকে কেন জানি বেরোচ্ছেন না!’
আমার কথা শুনেও ভেতরে থাকার লোক তো উনি না। শ্বাশুড়ির মুখটা ক্রন্দন হলো। নাক টেনে বললেন, ‘কী আর বলি! উনি আজ বিছানায় পড়ে দেড়বছর।’
আমি চমকে উঠলাম, ‘কীহ! কিভাবে? কী হয়েছে ওনার?’

ওনার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরল। রোদন গলায় বললেন, ‘আল্লাহ কেন যে আমাদের থেকে মুখ ফিরাই নিছে। সাইফ আর ওর বাবা মোটরসাইকেলে এক্সিডেন্ট করে। তারপর থাকি ওর বাপের এই অবস্থা!
‘এক্সিডেন্ট তো সাইফেরও হয়েছে। সে তো সুস্থ আছে।’
‘ওর মাথায় হেলমেট ছিল, ঘাসের উপর পড়ছিল, আর ওর বাপ রাস্তাতে। সাইফ একটু আঘাত পেয়েছিল।’
আমি ‘ওহ’ বললাম ছোট করে। বেশ ভাবিয়েছে বিষয়টা। আমি দুঃখ প্রকাশ করলাম, ‘জেনে খুব খারাপ লাগল। আমি কখনোই আপনাদের খারাপ চাইনি।’
তিনি মুখটা মুছলেন। আমার জানতে ইচ্ছে করল, সাইফের বউ কোথায়, কেমন? আমার থেকে ভালো? যদিও মানুষটার প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই, যা করেছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বৌমা নেই?’
‘না।’
‘কেমন সে?’— জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। তিনি মলিন মুখে বলেন, ‘আর বলিস না রে। সংসারে অশান্তির কারণ। দুইদিন পরপর বাপের বাড়ি যায়, কাজ তো নাম নাই। বাপের টাকার ফুটানি দেখায় খালি। দিন রাত সাইফের সাথে ঝগড়াঝাটি করে। ওর জ্বালায় সাইফ বাড়িতেই থাকতে পারেনা। বাড়িতে অভাব ধরছে, মেয়েটার পিছনেই অর্ধেক টাকা চলে যায়। কিছু হইলেই খালি বড়লোক বাপের হুমকি দেয়!’

আমি শুনে হতবাক হয়ে রইলাম। মনে কেন জানি একটা স্বস্তি এল, বুঝুক ঠ্যালা! আমি ওনার হাত ধরলাম, ‘মন খারাপ করবেন না। ধৈর্য রাখুন, আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন।’
তিনি আমার হাতের উপর হাত রাখলেন। কেঁদে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি, আমাদের মাফ করে দিও।’
আমি তাকে বলি, ‘আরেহ,আপনি মাফ চাইছেন কেন? আমার কারোর প্রতি কোন অভিযোগ নেই। আমি ভালো থাকতে পারছি, এটাই আমার জন্য অনেক।’
তারপর উঠলাম, ‘আজ চলি।’
উনি মানলেন না, ‘সেকি এখনই যাচ্ছো কেন?’
ক্ষীণ হেসে শুধালাম, ‘আপনাকে দেখতে এসেছিলাম। ভীষণ মনে পড়ছিল। দেখা হয়েছে। এখন যাই।’
‘কিছু খেলে না তো।’
‘অন্য আরেকদিন।’
যাওয়ার আগে গাছগুলোকে দেখে বললাম, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আমার গাছগুলো যত্নে রেখেছেন।’
এগিয়ে গেলাম। পিছন ফিরে বললাম, ‘ভালো থাকবেন মা, চলি।’
মা বলায় ওনার মুখটা অসহায়ের মতো দেখা গেল। এগিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিলেন। আমি চললাম নিজের পথে।

জীবনটা কী বিচিত্র। কালকে আমার যা ছিল না, তাদের ছিল। আজ আমার আছে, তাদের নেই। আসলেই, আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সুখের খোঁজে ছেড়েছিলাম সংসার। এখন সুখ, টাকা, সুস্থতা সবই আছে আমার।

আর প্রেম?
সেও এসেছিল,
যদিও আমার পক্ষ থেকে সেটা প্রেম বলা যায়না। ভালো লাগা জন্মাতে শুরু করেছিল মাত্র। নতুন ভাবে জীবন শুরু করার কথা ভেবেছিলাম তখনই। একটা বছর আগের কথা। নিচ তলায় নতুন ভাড়াটিয়া আসে। ছোট পরিবার, বাবা, মা আর দুজন ভাই। ছোটোজন রংপুরের কলেজে পড়ার দরুণ, ওখানে থাকতো। বড়জন কাজের জন্য পরিবার নিয়ে এসেছে।
তারপর একদিন, বৃদ্ধ এক মহিলা এলেন। নতুন ভাড়াটিয়া আন্টিটা। পরিচিত হলেন। আশ্চর্যের বিষয় তিনি আমাকে কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন কিংবা কথা বলেনি। কেন আমি একা থাকি, কেন কেউ নেই— এমন কিছুই বলেননি। খুব সাধারণ কথাবার্তা বলেছেন। বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেছে। তিনি মূলত লবণ নিতে এসেছিলেন। যাওয়ার আগে তার বাসায় ডাকলেন আমাকে। আমি সময় করে যাব, বললাম। তারপর কদিন যেতে হঠাৎ কলিং বেজে উঠল সকাল সকাল। আমি দরজা খুলতেই চশমা পড়া ছেলেকে দেখলাম, হাতে বাটি। আমাকে দিয়ে বললেন, ‘আম্মু পাঠিয়েছে।’
ক্ষীরের সুন্দর গন্ধ আসছিল। তিনিই আন্টির বড় ছেলে। আমি অপ্রস্তুত ছিলাম। নিয়ে নিলাম। তারপর সেদিন বিকেলে বাটিটা ফেরত দিতে তাদের কলিং বেল বাজালাম। ওই ছেলেটাই দরজা খুলল। আমি বাটিটা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আন্টি নেই?’
‘আম্মু শুয়েছে। কোন বিশেষ প্রয়োজন?’
‘নাহ।’
ইতস্তত বোধ হচ্ছিল। তিনি দরজা লাগাতে যাচ্ছিলেন তখন বললাম, ‘পেঁয়াজ হবে?’
উনি আটকে গেলেন, ‘জি?’
আমি ভীষণ ইতস্তত বোধ করলাম, ‘পেঁয়াজ।’
তিনি বলেন, ‘একটু দাঁড়ান।’
তারপর দিলেন আমাকে। আমি যাব তখনই লজ্জিত হয়ে বলেন, ‘দুঃখিত, আপনাকে ভেতরে ডাকতে মনে ছিল না।’
‘সমস্যা নেই।’

সত্যি বলতে তার থেকে লজ্জা পেয়েছি আমি। আগে কখনও কারোর বাড়িতে গিয়ে চাইনি। ওইদিন আন্টিটা বেশ ফ্রিভাবে কথা বলেছিল, আমার থেকে লবণ নিয়েছিল। বলেছিল, আমার কিছু লাগলে তার কাছে আসতে। তাই ভাবলাম, যেহেতু বাড়ির পাশেই আছেন, তার থেকেই নেই। পরে দিয়ে দেব। এসময়ে বাজারে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তারপর আমি বাড়িতে এলাম। কয়েকদিন কেটে যায়। সেদিন আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। হেঁটে যাচ্ছিলাম, তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে ছেলেটা এল। আমাকে বলল, ‘আপনি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা না?’
‘জি।’
সে হেসে বলল, ‘কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
তিনি আবারও হাসলেন। বললেন, ‘আপনার নামটাই জানা হয়নি। জানতে পারি কী?’
আমি বলি, ‘সুবাসিনী।’
ছেলেটা চমৎকার হাসল, ‘আরেহ বাহ! একটুর জন্য মিলতে মিলতে মিলল না।’
আমি ভ্রু কুচকে বলি, ‘সরি?’
সে আবারও হাসল, ‘আমি প্রথম।’
আমি হ্যাবলার মত জিজ্ঞেস করি, ‘কিসে প্রথম?’
হাসি মুখে জবাব দিল, ‘আমার নাম প্রথম।’
তারপর থেমে, ‘তোমার নাম সুবাসিনী, আমার নামটা প্রথম থেকে প্রতাপ হলেই মিলেই যেতো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস। কী যেন নামটা?’
‘সুভাষিণী’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এটা। শেষে অপূর্ণতা পায়।’
‘আমার নাম সুভাষিণী নয়, সুবাসিনী’
‘ওই একই তো।’
ছেলেটা হাসছে। আমার ভালো লাগছে না কথা বলতে। আমি বললাম, ‘আচ্ছা চলি, আমার দেরি হচ্ছে।’
বলে এক সেকেন্ড দাড়ালাম না। অনেকটা পথ গিয়ে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা এখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে। এদিকে তাকিয়ে। আমার মনে হলো, ছেলেটা কি ছ্যাচড়া?

এইভাবেই দিনগুলো কাটছিল। তারপর কয়েকদিন ওর আবারও প্রথমের সঙ্গে দেখা। দু তিনদিন পরপর যাওয়ার সময় তার সঙ্গে দেখা হতো। সে হেসে বলত, ‘আরে, সুবাসিনী যে!’
প্রথমের মধ্যে রসিক একটা ভাব ছিল। সবসময় হাসত। এভাবে দু তিনদিন থেকে প্রতিদিনের রূপ নিল। আমার বেশ বিরক্ত লাগত। তাই আমি সময় বদলে আরও সকাল সকাল বেরোতে শুরু করি। তিনচারদিন পর ওর সঙ্গে আবারও দেখা, বলল, ‘ইদানিং, তোমার দেখাই পাওয়া যায়না সুবাসিনী!’
আমি বানিয়ে বলি, ‘কোচিং হয় তো, তাই তাড়াতাড়ি যেতে হয়।’ তারপর সেও আমাকে অনুকরণ করে সকালে বেরোয়। মাঝেমধ্যে গেটে দাঁড়িয়ে যেন আমার অপেক্ষা করে। আমার এসব পছন্দ ছিল না। বুঝতাম, ও আমার প্রতি আগ্রহী। ও কখনোই আমাকে পছন্দ করে, ভালো লাগে, বিয়ে—এ সম্পর্কিত কথা বলেনি। স্কুল কেমন যাচ্ছে, দিনকাল, আমি কেমন আছি—এসবই ছিল প্রথমের নিত্যদিনের প্রশ্ন। তবে, আমি যেচে গিয়ে বলতে যেতাম আমি ডিভোর্সী? অপেক্ষায় ছিলাম, এমন একটা ইঙ্গিত বা বললেই বলে দেব। কিন্তু ছেলেটা সাধারণ কথা ছাড়া কিছুই বলতো না। তাই সিদ্ধান্ত নেই, বাসা বদলে ফেলব। তবে এ সময় হলো না, চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। এদিকে ধীরে ধীরে প্রথমও ‘আপনি’ সম্বোধন থেকে ’তুমিতে’ এসেছে। আমি আপনি করেই বলি।

আপা করল কয়েকদিন পর। যেসব কথাবার্তা হয়, সেগুলো বলল। কথা শেষ করে আপা কল কাটছিল না। যেন কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু সংকোচের কারণে বলছে না। আমি বললাম, ‘কিছু বলবি আপা? নির্দ্বিধায় বলতে পারিস।’
আপা ভীতু গলায় বলে, ‘রাগ করবি না তো?’
আমার মনে হলো আপা আবারও বাবার কাছে যেতে বলবেন। আমি বললাম, ‘বল আপা। করব না।’
আপা বলল, ‘কয়েক বছর হয়ে গেল সৌমি। এভাবে একা কতদিন থাকবি আর? এখন বিয়ে করা দরকার তোর।’

আমি অপ্রস্তুত ছিলাম আপার কথার জন্য। শান্ত গলায় বলি, ‘আপা আমি বিয়ে নিয়ে ভাবি নি। আমার ইচ্ছেও করেনা। যখন মন চাইবে, ভেবে দেখব। আমার আরও সময় দরকার।
আপা বলে, ‘সৌমি, এভাবে হয়? কতগুলো বছর হয়েছে? তোর বয়সও দিনদিন বাড়ছে। এটাই সময় বোন। তুই চাকরি করছিস, যথেষ্ট ম্যাচিউর। নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে কর।’
আমি প্রত্যুত্তর করিনা। আপা বলে, ‘দেখ নির্দিষ্ট একটা বয়স থাকে বিয়ের। সময় থাকতে ভাব, নাহলে পরে আফসোস লাগবে। আমি তোর ভালো চাই।’
আমার উত্তর না পেয়ে আপা বলল, ‘কিছু বলছিস না যে?’
‘হুম, বল শুনছি।’
আপা আবার বলে, ‘যে মানুষটা তোর সঙ্গে অন্যায় করে নতুন বউ নিয়ে শান্তিতে থাকছে, তবে তুই কেন থাকবি না? এমন তো নয় স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবি। এমন হলে আমি কখনই বিয়ের কথা বলতাম না তোকে। তোর পরিস্থিতি ওমন নয় সৌমি, তাই নতুনভাবে সব শুরু কর রে সময় থাকতে।’
সাইফ বিয়ে করেছে, আপার থেকে জানতে পারলাম। আপার কথা অবশ্য ভুল নয়। আমি তাকে বললাম, ‘আচ্ছা আপা ভেবে দেখব।’

সেদিন সারারাত ভাবলাম। বিয়ে করব? বিয়ের কথা মাথায় আসতে সর্বপ্রথম, প্রথমের কথাটাই মাথায় এল। ছেলেটা আমাকে পছন্দ করে। আগে যদিও এরকম কিছু ভাবিনি তার সঙ্গে। কিন্তু এখন ভাবতে লাগলাম। সবসময় হেসে কথা বলে, আমাকে হাসনোর চেষ্টা করে। খালি কথা বাড়াতে চায়। একটুখানি সফট কর্ণাট তৈরি হলো শুধু। ভাবলাম প্রথমের সঙ্গে কথা বলব। আমার সম্পর্কে জানাবো। ছেলেটা অদ্ভুত, আমাকে এমন কিছু জিজ্ঞেস ই করেনা যে আমি বলতাম তাকে। একা কেন থাকি—প্রশ্ন বললেই তাকে বলে দিতাম। কিন্তু সে শুধু কেমন আছি, দিনকাল কেমন এসবই!
পরেরদিন আমি তার অপেক্ষা করলাম। পেলাম না। দুদিন বাদে দেখা হলো তার সঙ্গে। সে আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘আরে সুবাসিনী যে! এতদিন ব্যস্ততার কারণে দেখাই হলো না। কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম না। আমার বুকটা ধড়পড় করছিল, কীভাবে শুরু করব। তার দিকে তাকাতে সে সংকোচ নিয়ে আমাকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে? ইম্পর্ট্যান্ট।’
আমি মাথা নাড়ালাম। ও বলল, ‘একটা ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টে বসে বলি?’
প্রথম ইতস্তত বোধ করছিল। আমি না করিনি। যেহেতু তাকে জানাতে চাই। প্রথমের দিকে তাকালাম, ছেলেটা হাসছে না। চিন্তিত, উদ্বিগ্ন অনেকটা। ও বলবে আমায়?

একটা ক্যাফেতে বসে অর্ডার দিয়ে ও আমাকে বলল, ‘সুবাসিনী আমি..
থেমে গেল। ইতস্তত বোধ করছিল। আবারও বলতে শুরু করে, ‘আমি জানি না, তুমি কিভাবে নেবে, তবুও বলতে চাই..
ওর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠছিল। আমার মনে হলো ও আমাকে প্রপোজ করবে। তখনই চোখ যায় দুজন মানুষের উপর। আমার প্রাক্তন স্বামী এবং একটা মেয়ে। নতুন বউই হবে। দেখে যেন থমকে যাই। কতদিন পর দেখা হলো? পুরোনো দিনের স্মৃতি গুলো চোখে ভেসে উঠছিল। আমি প্রথমকে বলি, ‘বাইরে কথা বলি, প্লীজ।’
বলে দ্রুত উঠে হন্তদন্ত হয়ে ওর পাশ কেটে বেরিয়ে পড়ি। কী জানি পড়ল, বুঝলাম না। তখন সাইফের ডাক, ‘এইযে শুনছেন। আপনার কী পড়েছে।’
আমার অস্থির লাগল। দেখলাম আমার আইডি কার্ডটা পড়েছে। আমি পিছনে ঘুরলাম, সাইফ এগিয়ে এসে দেবে তখনই চোখ বুলালো আইডি কার্ডে। আমার ছবি স্পষ্ট। বিড়বিড় করল, ‘সুবাসিনী রহমান সৌমি।’ হতবিহ্বল দৃষ্টি। এরপর আমার দিকে তাকাল। আমার শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। তীক্ষ্ণ গলায় ও প্রশ্ন ছুড়ল, ‘আমাকে দেখে পালাচ্ছিলে কেন সৌ-মি’

নামটা টেনে বলল। আমি প্রত্যুত্তর করিনা। তখনই প্রথম এল বিল পে করে। এসেই আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, এভাবে এলে কেন?’
আমি উত্তর দেব, তখনই সাইফ সন্দিহান কণ্ঠ বলল, ‘তোমার নতুন প্রেমিক নাকি সৌমি?’
আমি থমথমে খেয়ে যাই। মানুষগুলো দেখছে। প্রথম আমার দিকে ভ্রু কুচকে বলে, ‘তোমরা একে অপরকে চিনো?’
সাইফ হেসে বলল, ‘চিনবে না কেন?’
আমি চোয়াল শক্ত করে প্রথমকে বলি, ‘অন্য কোথাও চলুন।’
প্রথম সম্মতি জানালো। তখনই সাইফ হেসে তাচ্ছিল্য করে প্রথমের পানে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কত নম্বর সৌমি? এইসব করার জন্যই আমাকে ছেড়েছিলে তাইনা?’
আমি ওর জবাব দিতে ধরলাম, তখন প্রথম বলে, ‘ছেড়েছিলাম, মানে? সুবাসিনী, উনি কী বলছেন?’
সাইফ রগড় সুরে বলে, ‘সু-বা সি-নী? বাহ।’
আমার দিকে এগিয়ে, ‘তোমার প্রেমিককে জানাও নি, তোমার ডির্ভোস নিয়ে?’
প্রথম বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল, ‘কিহ!’
সেই তালে সাইফ বলল, ‘জি..’
তারপর আমাকে কটাক্ষ করল, ‘বোরকা পড়ে এসব করে বেড়াও! ভাগ্যিস তোমার থেকে জান ছুড়েছে। তোমার মত নোংরা মেয়েদের থেকে এর থেকে কী আশা করা যায়?’
আমার চোখ ভিজে গেল। কতগুলো মানুষ! আমি শুধু একটা কথাই বলি, ‘নিজের মতো সবাইকে নর্দমার কিট ভাবা বন্ধ করুন।’

বলে প্রস্থান করে নির্জন স্থানে যাই। কান্না পাচ্ছে। এই নোংরা মানুষটার সঙ্গে কেন আমার দেখা হলো। নিজেকে সামলে দেই। মানুষ কতটা নিচে নামলে, এভাবে অপবাদ দিতে পারে। এমন নোংরা লোকের সঙ্গে একসময় থাকতাম। ভাবতেই ঘৃণা লাগল। তখনই এল প্রথম। চোখ মুখে কঠোর দৃঢ়তা। আমাকে বলল, ‘লোকটা যা বলল, সত্যি?’
আমার গলায় কথা আটকে যাচ্ছিল। আমি ওকে বোঝাতে চাই, ‘আসলে.. ও
‘আমি শুধু আমার কথার উত্তর চাই। তুমি ডিভোর্সী?’
আমি মাথা নাড়ালাম, ‘হ্যা।’
তৎক্ষণাৎ ও মুখটা কুচকে বলল, ‘ছিহ, তুমি ডির্ভোসী! ছিহ!’
আমি ওর প্রতিক্রিয়াটা দেখলাম শুধু। ‘ছিহ, তুমি ডির্ভোসী’— এমনভাবে উচ্চারণ করল, যেন আমি নর্দমার কিট। আবারও বলল, ‘একটা ডিভোর্সী মেয়ের জন্য, আমি..কিভাবে! ইয়াক!’

বলে থুথু ফেলল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। প্রথম রাগান্বিত গলায় ঘৃণা ছুঁড়ে বলে, ‘আমাকে আগে জানাওনি কেন? লজ্জা করে না, বোরকা পড়ে এসব করতে? আবার শিক্ষকতা করো। ভাব নাও!’
আমি চুপ করে শুনলাম, দেখলাম। ও বলল, ‘আসলেই তোমাদের মত ডিভোর্সী মেয়েগুলো এমন নোংরাই হয়। আল্লাহ জানে আগে কী করেছো! আমি বিশ্বাস করতে পারছি, তোমার মত মেয়েকে চিনতেই পারলাম না! ছ্যাহ!’
নিজের অপমান আর সহ্য হলো। শুধু এতটুকুই বললাম, ‘এখন চিনেছেন নিশ্চয়ই? তবে চলি। আল্লাহ হাফেজ।’
খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে চলতে লাগলাম। অথচ বুকের ভেতর যে তোলপাড় উঠেছে, দেখানোর সাধ্য নেই। কাদতে কাদতে ফিরলাম আমি। ভাগ্যটা এমনই। এজন্য আমি বেশি আনন্দিত থাকতাম না। সেদিন আবারও কাদলাম। প্রথম কিভাবে ঘৃণাত্মক গলায় বারবার বলছিল, ডিভোর্সী। কেন? ডিভোর্স হলে মেয়েরা ময়লা আবর্জনা হয়ে যায় নাকি? যেভাবে মুখ ছিটকে থুথু ফেলছিল, আমাকে কথা বলার সুযোগটুকু দিল না।

আমি নিজেকে শক্ত করতে লাগলাম। বোঝালাম যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। আল্লাহ ভালোর জন্যই করেছে। যে মানুষটা ডির্ভোস শব্দটাকে এত সংকীর্ণ ভাবে দেখতে পারে, তার সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ভাবছিলাম আমি! পরবর্তী পরিণতি কী হতো? আবারও ভুল মানুষকে বেছে নিচ্ছিলাম। একবার জীবনে ভুল মানুষের আগমনে জাহান্নাম হয়েছিল, আবারও একই ভুল করতে করতে বেঁচে গিয়েছি। প্রথমের সেদিনের প্রতিক্রিয়াতে বোঝা গেল, সে ডিভোর্সী মেয়েদের নিয়ে কেমন ভাবনা রাখে। নয়তো ওর প্রতিক্রিয়া সেই– ছেলেটার মত হতো, শোরুমে থাকতে যে ছেলেটা আমার পছন্দ করেছিল। ওই ছেলের মুখে শুধু বিস্ময় ছিল কিন্তু প্রথমের চোখে মুখে বিস্ময়ের থেকে বেশি ঘৃণা, ক্ষোভ।
আমি নিজেকে ধাতস্থ করে নিলাম। একারণে অবিবাহিত ছেলেদের কখনও বিয়ে করব না। ভবিষ্যতে করলে নিজের মতন মানুষকে দেখেই করব। যদিও যেটুকু আগ্রহ জন্মেছিল এখন আগ্রহটা একদম মরে গেছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আগে বারলাম। অহেতুক মানুষগুলোর জন্য নিজেকে কষ্ট দেব না।

কেটে যায় একটা মাস। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সাইফ দ্বিতীয় বিয়েতেও আমার নামে মিথ্যে বলেছে। আমি ভালো চরিত্রের ছিলাম না, অনেক ছেলেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক—এসব রটিয়েছে। ও কত নোংরা কুৎসিত মনের! আমি এর মধ্যে বাসা চেঞ্জ করার প্রস্তুতি নেই। প্রথমের সঙ্গে সেদিনের পর দেখা হয়নি। তাকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি। আমি হাসলাম, মানুষের ভালোবাসাও বড্ড আজব জিনিস! আমি কখনও তাকে বলেছি, আমার জন্য অপেক্ষা করতে। অথচ ও কী সুন্দরভাবে সব দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিল!

সেদিন বাড়ি চেঞ্জ করার জন্য মালামাল উঠেছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেসময়ে দেখা মিলল প্রথমের। আমি ওর দিকে শুধুমাত্র একবার তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেই। নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে উঠি। ও এগিয়ে এসে ডাকে খুব শান্ত গলায়, ‘সুবাসিনী?’
না শোনার ভান করলাম। আবারো ডাকে। এবার শুনলাম, ‘ জি বলুন।’
ও বলল, ‘সেদিনের ব্যবহারের জন্য আম সরি। এতোটা হাইপার হয়ে গেছিলাম, না বুঝে তোমাকে অনেককিছু বলে ফেলেছি।’
আমি ক্ষীণ গলায় ‘ইটস ওকে।’ বলে কাজে লাগি। ও আবারও ডাকে, ‘একটু শোনো।’
‘আর কিছু?’
‘আমি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি সুবাসিনি। তোমার সঙ্গে জীবন কাটাতে চাই। সেদিন এটা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারপর যা হলো!’
আমার হাসি পেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, আমি ডিভোর্সী।’
ও থমথমে গেল। বলল, ‘সেসবের জন্য ক্ষমা চাইছি। আমরা কি এক..
কথা শেষ না হতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ কী মনে করে এসব বলছেন? জানাবেন?’
তৎক্ষণাৎ বলল, ‘আমি সেদিন ভেঙে পড়েছিলাম। তোমাকে মনে পড়ছিল। তাই খোঁজ নিয়েছি আমি, সত্যিটা জেনে আমার নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছিল। কিভাবে তোমার মুখোমুখি হব ভাবতে পারছিলাম না। তারপর মায়ের থেকে জানলাম, তুমি বাড়ি ছেড়ে দিয়েছ। তাই আর থাকতে পারলাম না।’
আমি ছোট করে বললাম, ‘ওহ ভালো।’
‘রেগে আছো?’
‘সরি? আপনার উপর ঠিক কি কারণে রেগে বসে থাকব?’

ও চুপ থেকে বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে..
তার আগে আমি বললাম, ‘দেখুন প্রথম, আপনি আবেগে ভাসছেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সবকিছুর মাঝে এটা সত্য আপনি অবিবাহিত এবং আমি তালাকপ্রাপ্তা নারী। আমি বাস্তবতার কঠোর রূপ দেখেছি। তাই আপনার সঙ্গে আমার যায় না। আমরা দুজনে দু মেরুর মানুষ। আজ নয়তো কাল আপনার আফসোস কিংবা মনে গেঁথেই থাকবে আমার আগেও বিয়ে হয়েছিল, আপনার হয়নি। সেটা হোক বিয়ের একদিন, একমাস, কিংবা এক বছর পর।আমি আমার মতোই একজন মানুষকে চাই, যদিও এই মুহূর্তে আমার বিয়ের ইচ্ছে নেই। আপনাকেও আমি সাজেস্ট করব, অবিবাহিত মেয়েকেই বিয়ে করুন।
আরেকটা কথা সেদিন আপনি আমাকে বলেছেন, কেন আপনাকে জানাইনি। উত্তরে বলব—আপনি কিন্তু কখনোই আমাকে সেরকম প্রশ্ন করেননি, যার মাধ্যমে আমি আপনাকে জানাব। তবুও ধরে নিলাম আমার দোষ। এর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, ক্ষমা চাইছি।

শান্তি আমি অনেক অনেক স্ট্রাগল করার পরে পেয়েছি, এমনও দিন গেছে সুখের অভাবে আমি আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিতে চেয়েছিলাম। এ সুখটুকু আমি হারাতে চাইনা। এখন আপনি আবেগে রয়েছেন, তাই এমন বলছেন। আবেগ কাটলে বাস্তবতা বুঝবেন। আপনার জন্য শুভকামনা রইল। ভালো থাকবেন ইন শা আল্লাহ্।’

বলে আমি চললাম। প্রথম তাকিয়ে রইল। নতুন বাড়িতে শিফট করে আবারও পুরনো স্মৃতি ভুললাম। জীবনে নিজের মানসিকতার মানুষ পেলে তবেই বিয়ে করব, নয়তো না। কিন্তু প্রথমবারের মত ভুল করব না। কারণ এইবার ভুল করলে বাঁচার আশাটুকু আর থাকবে না। এ জীবনই খুশি আছি। আর কী লাগে? আল্লাহ, চাইলে জীবনে কাউকে পাঠাবেন নয়তো না। তাতে আফসোস নেই।

এটাই ছিল সেই একবছর আগের সাইফের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং আমার জীবনে একজনের আগমনের ঘটনা। আমি সেদিন ভেবেছিলাম সাইফ সুখেই আছে। কিন্তু আজকে শ্বাশুড়ি মায়ের থেকে সাইফের বিবাহিত জীবনের সম্পর্কে শুনে ভীষণ স্বস্তি পেয়েছি।
প্রথম মানুষটার অধ্যায় আমি ভুলে দিয়েছি। তাকে সেদিনের পর থেকে দেখিনি। জীবনে শুধু ভালবাসি বলে সংসার বাঁধলেই সুখী হওয়া যায়না, বাস্তবতারও হিসাব আছে। ভালোবাসা স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু সংসার টিকিয়ে রাখতে লাগে ত্যাগ, ধৈর্য, বোঝাপড়া আর দায়িত্বের ভার। যেখানে এ বাস্তবতা অনুপস্থিত, সেখানে ভালোবাসার শিখাও নিভে যায়।

নিজের অতীতের ঘটনা গুলো পড়ে পড়ে হাত বুলিয়ে দেখছিল সুবাসিনী। খিলখিল হাসছিল। অক্ষরগুলো ছুয়ে ছুয়ে যেন আবারও উপলব্ধি করতে চাইছিল সময়গুলোর। প্রাণবন্ত হাসি বেরিয়ে আসছিল। একসময় কী জীবন ছিল তার! বর্তমানে একদম পাল্টে গেছে। সুবাসিনী অবশেষে একজন উদ্যোক্তা হয়েছে। আলোর মতন আরও পাঁচটি অসহায় মেয়েকে কাজের ব্যবস্থা করেছে। দিনদিন সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। শহরে ছোট একটা দোকান দিয়েছে। তাতে বেশ ভালোই আয় আসছে। অপর দিকে এখন শুরু করেছে, সেই পেইন্টিংয়ের। এটাও বড় হচ্ছে। চাকরিতে ভালো যাচ্ছে দিনকাল। আর কী লাগে জীবনে? বেঁচে থাকার জন্য এতটুকু সফলতাই কী যথেষ্ট নয়?

সুবাসিনীর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে একদম শেষ পৃষ্ঠায় গেল। ফকফকা সাদা পৃষ্ঠা। হাতে কলমটা তুলে নিল, লিখলো—

‘আমি সেই নির্বাসিত ফুল,
যা রাস্তার ধারে পায়ে পিষ্ট হয়েও আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। পথিকের চোখে আমার কোন রঙ নেই, নেই কোন মূল্য।
তবু আমি জানি—
প্রতিটি পাতার ভাঁজে জমে থাকে সংগ্রামে বেঁচে থাকার গল্প। সুবাসিনীর গল্প, যার নামে সুবাসে ভরপুর থাকলেও সে ছিল নির্বাসিত।

জীবন যতই পদদলিত করুক, আমি মাটির বুক চিরে আবারও আলো দেখবোই। কারণ আমার অস্তিত্বটাই কষ্ট রোধের। আমাকে ভাঙছে অনেকবার, বুঝেছে—প্রতিটি ভাঙাতেই নতুন কোনো রেখা জন্ম নেয়। ভাঙার শব্দটার মধ্যেই আমি শিখেছি দাঁড়াতে। আঘাত যত গাঢ়, ফিরে উঠা তত দৃঢ় হয়।
আমি আর ভাঙিনি, ভাঙা ভুলে গেছি। আমার ভাঙন এখন কেবল ইতিহাস, আর ইতিহাসই আমার শক্তি। তাই এখন যত আঁচড় পড়ুক, ততই অন্তর্দেহে শক্তি বাড়ে। মাটির বুক ভেদ করে যখনই সূর্যের আলো খেলে, আমি উঠি, সুবাস ছড়াই, আর বলি—হ্যাঁ আমি সেই নির্বাসিত ফুল সুবাসিনী।’

(সমাপ্ত)