যেখানে মন হারায় পর্ব-০১

0
13

#যেখানে_মন_হারায়(সূচনা পর্ব)
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

“এক থাপ্পড় মেরে চাপা ভেঙে ফেলব বেয়াদব মেয়ে।তুই নাকি আমার নামে বিচার দিয়েছিস?”

পুরুষালী গমগমে কণ্ঠস্বর কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই রুহানির কদম থমকে গেলো।শুকনো ঢোক গিলে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। এই ভয়’টাই পাচ্ছিল।সে এমন ভাব করল যেন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার কথা তার কানেই পৌঁছালো না।সামনের দিকে আর এক পা ফেলতেই তার হাত দুটো খোঁপ করে ধরে ফেলল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা।ফের গম্ভীর কণ্ঠে শুধোয়,

“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি রুহা।”

রুহানি পিটপিট করে চোখ খুলে ছোটো চাচার বড়ো ছেলের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে মিনমিনে কণ্ঠে বলল,

“মুরসালীন ভাই আপনার কী মাথার তাড় ছিঁড়ে গেছে?আমি আপনার নামে কার কাছে বিচার দিতে যাব বলেন?”

“তোর বাপের কাছে আমার নামে কান ভাঙিয়েছিস কেন?”

রুহানি আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বলে,

“বাবার কাছে আপনার নামে কান ভাঙিয়েছি?এত বড়ো একটা অপবাদ দিতে আপনার বুক কাঁপল না?বয়স হওয়ার সাথে সাথে কী জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে আপনার?ডাক্তার দেখাবেন মুরসালীন ভাই?”

“চুপ বেয়াদব!কী বলেছিস চাচার কাছে?”

রুহানি ভয়ে ভয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল।সর্তক চোখ চারপাশে বুলিয়ে বলে,
“আগে আমার হাত ছাড়ুন তারপর বলব।”

মুরসালীন হাত ছেড়ে দিতেই রুহানি কাঁধের কলেজ ব্যাগ শক্ত করে আঁকরে ধরে বাড়ির বাইরে দৌঁড় লাগিয়ে চিৎকার করে বলল,

“বলেছি আপনি এলাকার বিবাহিত মেয়েদের বিরক্ত করেন মুরসালীন ভাই।ভালো হয়ে যান বুঝলেন?”

মুরসালীন গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইল রুহানির প্রস্থানের পথে।মেয়েটা দিন দিন এত ফাজিল হচ্ছে..!সে রাগে দাঁত চাপল।রুহানি শেখ রায়হা তার বড়ো চাচা কামরুল শেখের ছোটো মেয়ে।দেখতে যেমন মিষ্টি ঠিক তার উল্টো কাজ কর্ম এবং কথা বার্তা।এইযে সেই সু-দূরে বাবাকে কল করে শুধু শুধু তার নামে বিচার দিয়েছে।কারণ একটাই,মুরসালীন গত কালকে ক্লাস থেকে তাকে বের করে দিয়েছিল।মুরসালীন রুহানির কলেজের সিনিয়র লেকচারার।ফালতু ছেলে মেয়েদের সাথে মিশে মিশে বাঁদর হচ্ছে।আবার ক্লাসে কিছু বললেই নাটক শুরু করে দেয়।সে বিরক্তকর চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির বাইরে হাঁটা ধরলো।

শেখ বাড়ির বড়ো ছেলে কামরুল শেখ এবং তার’ই ছোটো মেয়ে চঞ্চল রুহানি।বাবার বড্ড আদুরের,শুধু বাবার নয়, ভাই আর চাচারও ভীষণ আদুরের সে।আর ঐযে গম্ভীর রোবট মশাই,উনি হচ্ছেন রুহানির ছোটো চাচার বড়ো ছেলে মুরসালীন শেখ আবেশ।সবার সাথে হাসি তামাশা করলেও রুহানির সাথে সব সময় ঝগড়ায় লেগে থাকবে।উনিশ থেকে বিশ হলেই শুরু হবে এদের বিশ্বযুদ্ধ।
বাড়ির সকলেই এই নিয়ে কপাল চাপড়ান তিন বেলা।মুরসালীন চুপ থাকতে চাইলেও বাঁচাল রুহা সেটা কিছুতেই হতে দেয় না।মুরসালীনকে খেঁপিয়ে যেন সে খুব মজা পায়।

সকাল ১০:১৫ মিনিট।ক্লাসরুমের একদম শেষের সিটে বসেছে তিন বান্ধুবী!মুরসালীনের ভাষায় ‘তিন বাঁদর।’
রুহানি চোখ উল্টে শুধোয়,
“দেখিস,ঐ ধোলাইখালের শেখ এখন ঢুকবে তারপর সেই গলা নামিয়ে বলবে, ‘Silence please’!”

ঠিক তখনই দরজা দিয়ে ঢোকে মুরসালীন।হাতে মার্কার,মুখে পাথরের মতো গাম্ভীর্য।সে ক্লাসরুমে প্রবেশ করেই ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
“ক্লাস স্টার্ট হয়ে গেছে।Letecomers will write an extra page.”

সবাই চুপ করে যায়।কিন্তু রুহানি ও তার দুই বান্ধুবী মুখ চেপে হাসি আঁটকে রাখার চেষ্টা করে।জান্নাত ফিসফিস করে বলে,

“এই লোকের সাথে এক বাড়িতে থাকিস কী করে?”

জান্নাত বলল,
“শালা গম্ভীর হলেও হ্যান্ডসাম।সাবধানে কথা বল।”

রুহি মুখ বাঁকায়।দাঁত বের করে মুরসালীনের দিকে তাকিয়ে ভেঁঙায়।বলে,
“ফালতু লোক একটা।সব সময় ঘেউঘেউ করে মাথার ঘিলু ঘেঁটে দেয়।”

মুরসালীন আচমকা রুহানির দিকে তাকিয়ে শুধোয়,
“মিস রুহানি,সামনে আসুন।”

রুহানি আঁতকে ওঠে।শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“আমি স্যার?মানে আমি তো ঠিকঠাক’ই বসেছিল…”

“তুই ঠিকঠাক কবে ছিলি,তা তোর বাপ মাও জানে না রুহা!”

পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ে।সকলের জানা মুরসালীন আর রুহানি কাজিন।রুহানি বলল,
“স্যার আমি তো আপনারই ছোটো,মানে,আপনি তো আমার..আমার..”

মুরসালীন ভ্রুকুঁচকে বলে,
“কী?বল,তুই কী বলতে চাস?আমি তোর কাজিন,তো?এটা ক্লাস তোর বাড়ি নয় যে বেয়াদবি করবি।”

রুহানি মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে,
“বাড়ি গেলেও যন্ত্রণা তুই আর কলেজে এলেও মীরজাফর তুই।”

মুরসালীন গম্ভীর হলো,সিরিয়াস মুখ ভঙ্গি করে বলল,
“আপনি ক্লাসে আরেকটা কথা বললে পরের বার আপনাকে বোর্ডে দাঁড়িয়ে পড়াতে বলব।let’s show them how funny you are.”

রুহানির লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসে।অপমান আর অপমান।এই বজ্জাত আজীবন শুধু অপমানই করে গেলো।মুরসালীন সবার দিকে তাকিয়ে বলে,

“Now silence students.Or,should I call your cousins to discipline you all?”

সবাই চুপ করে গেল।মুরসালীন আড়চোখে রুহানির দিকে তাকিয়ে আবার ক্লাসে মন দিলো।এই মেয়ের সাথে কথা বললেই মাথা গরম হয়।

ক্লাস চলছে।মুরসালীন স্যার ক্লাস নিতে ব্যস্ত।লেকচার দিচ্ছে সে।রুহানি পেছনের ব্রেঞ্চে,চোখের পাতা এক করে ঘুমের রাজ্যে পা রাখতেই হঠাৎ মুরসালীন বলে ওঠে,
“মিস রুহানি শেখ রায়হা!টেবিলটা কী আপনার বিছানা?”

রুহানি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে।ঘুম জড়ানো মাতাল কণ্ঠে বলে,
“জি স্যার..মানে না স্যার!মানে হ্যা,কিন্তু না..”

“স্যাটআপ!আপনি আজ হোমওয়ার্কের বদলে সবাইকে বোর্ডে দাঁড়িয়ে লেকচার দিবেন।”

রুহানি চোখ বড়ো বড়ো করে বলে,
“স্যার,আমি তো শিফট নাইট গার্ড না যে সবাইকে জাগিয়ে রাখব।”

মুরসালীন ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসি টানে।
“আপনি জাগলেই তো বেঁচে যাই মিস রুহানি।আপনার নাক ঢাকায় পুরো ক্লাস ঝিমায়!”

পুরো ক্লাস শব্দ করে হেসে ওঠে।মিথিলা ফিসফিস করো বলে,
“স্যার বোধহয় আজ ভীষণ রেগে আছে,রুহা বেশি কথা বলিস না।”

রুহানি হেঁটে বোর্ডের সামনে এলো।ঘাড় বাঁকা করে উঁচিয়ে তাকাল গম্ভীর মুরসালীনের দিকে।তারপর পিছু ঘুরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“স্টুডেন্টস,আজ আমরা শিখবো কিভাবে একজন গম্ভীর স্যারের মতো মানুষকে পাঁচ মিনিটে পাগল বানানো যায়।”

মুরসালিন ধমকে ওঠে,
“Enough, Ruhani!ফাজলামো হচ্ছে ক্লাসে?এখনই বেরিয়ে যান আমার ক্লাস থেকে।”

রুহা যেন মনে মনে খুশি হলো।অন্তত এই বজ্জাতের ক্লাস তো করতে হবে না।সে মনে মনে মুখ ভেঙ্গিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো।মুরসালীন বিরক্তকর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল।সময় প্রায় শেষ,ক্লাস শেষ হয়ে যাবে একটু পরেই।
….
একদম কোচিং শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরল রুহানি।ড্রয়িংরুমে নাসরিন বেগম শাশুড়ির মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন।আফনান ফ্লোরে বসে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে আর ইলমা বেগম ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন।হয়তো কামরুল শেখের সাথে।রুহানি ভেতরে প্রবেশ করে কাঁধের ব্যাগ সোফার এক কোনায় রেখে ঠাস করে বসে পড়ল।ইলমা বেগম কানে ফোন রেখেই দু’গ্লাস পানি নিয়ে এলেন।এক গ্লাস মেয়েকে দিয়ে আরেক গ্লাস টি-টেবিলের উপর রাখলেন।খানিকক্ষণ পর মুরসালীন এলো বাইরে থেকে।পানির গ্লাস নিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলো।রুহানি নিজেও ভাবল এখন গোসল না দিলে শরীর দিয়ে পঁচা ঘামের গন্ধ বের হবে।

সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে, যেন আকাশ আপন হাতে আঁকছে গোধূলির এক অপূর্ব ছবি। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে, তার শেষ কিরণগুলো ঝিলমিল করে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। হালকা বাতাসে গাছের পাতাগুলো মৃদু কাঁপছে, যেন প্রকৃতি নিঃশব্দে বিদায় জানাচ্ছে দিনের ব্যস্ততাকে।

পাখিরা একে একে ফিরে আসছে নীড়ে, তাদের ডাকে একটা শান্ত ছন্দ জেগে উঠছে। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুরেলা ধ্বনি, মনটা হঠাৎ করে নরম হয়ে আসে। চারপাশে একটা নরম নীলচে ছায়া নেমে আসছে, যেন আলোর সঙ্গে অন্ধকারের মায়াবী খেলা।

বাড়ির উঠোনে বসে থাকা কেউ হয়তো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অনুভব করছে এই নরম নিস্তব্ধতাকে, এই সন্ধ্যাটা যেন ক্লান্ত মনকে একটু আরাম দেয়ার জন্যই এসেছে।

সন্ধ্যার পর ড্রয়িংরুমে জড়ো হয়েছেন সবাই।নাবিল রুহানির কোলে মাথা রেখে সোফায় শুয়ে আছে।ছোটো বোন মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে।সামনেই দাদির সাথে মুরসালীন বসে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে।হঠাৎ করে রান্না ঘর থেকে ইলমা বেগম বললেন,
“রুহা নাহারের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

রুহানি আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বলল,
“গায়ে হলুদ কবে?”

দাদি সামনে থেকে আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“গুয়ায় হলুদ?কার পাছায় কী হইল?গুয়ায় কেও হলুদ দেয়?”

নাবিল নাক মুখ কুঁচকে ফেলল।রুহানি হতভম্ব হয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছিঃ, কী বলো এসব?”

“তুই’ই তো কইলি কার নাকি গুয়ায় হলুদ।”

“ওটা গায়ে হলুদ, গুয়ায় হলুদ আবার কখন বললাম?”

#চলবে…?