যেখানে মন হারায় পর্ব-১২+১৩

0
12

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

১২.
দুপুরের নামাজের পর শেখ বাড়িটা কেমন ভার হয়ে এলো।রুহা নামাজ পড়ে চুপ করে বসে ছিল নিজের ঘরে।একটু পর খাবার দেয়া হবে বলেই সে ভাবল একেবারে নিচে নামবে।হঠাৎ গুটি গুটি পায়ে বাহার বাবু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।রুহা সেদিকে তাকিয়ে নীরব চোখে দেখল বাচ্চাটার কাণ্ড।বাহার বাবুর গায়ে শীতের লম্বা হাতার মোটা গেঞ্জি আর প্যান্ট।বাচ্চাটা খালাকে দেখেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

“কালা,কালা।”

রুহা বিছানা থেকে নেমে বাহার বাবুকে কোলে নিয়ে সোফায় বসল।বাহার বাবুর গাল টেনে দিয়ে বলল,
“কালা কিরে?খালা বলতে পারিস না?”

বাহার বাবু রুহার চুল টেনে ধরে বলল,
“তুমি কাইতো না?”

“খাব।”

তখন ঘরে প্রবেশ করলেন ইলমা বেগম ও কামরুল শেখ।রুহা মা বাবাকে দেখে অন্যদিকে দৃষ্টি সরালো।ইলমা বেগম হাতের শাড়ি বিছানার উপর রেখে পিছু ঘুরলেন।কামরুল শেখ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আজ তোকে দেখতে আসবে।আশা করবো তাদের সামনে আমায় লজ্জিত করবি না।”

রুহা অবাক চোখে বাবার দিকে তাকায়।বুকটা কেমন কেঁপে উঠল এহেন কথা শুনে।সে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“কী?”

“আজ তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।”

রুহা বাহার বাবুকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।অশান্ত কণ্ঠে বলল,
“কী বলছো বাবা?পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে মানে?তুমি জানো আমি মুর..”

“ঐ ছেলের নাম আর একবার তোর মুখে শুনলে আমি তোকে ত্যাজ্য করবো রুহা।”

রুহা ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকায়।গাল বেয়ে পড়ছে চোখের পানি।ইলমা বেগম ঠোঁট চেপে কান্না আঁটকাবার বৃথা চেষ্টা করলেন।কামরুল শেখ দরজার দিকে পা বাড়ালে রুহা বলে,
“আমি সুখে থাকি সেটা কী তুমি চাও না বাবা?তুমি কেন ঐ মানুষটাকে সহ্য করতে পারো না?তার দোষ কী বলো?আমায় ভালোবেসেছে,এটাই কি তার দোষ?”

কামরুল শেখ চোয়াল শক্ত করলেন।ধমক দিয়ে উঠলেন তিনি,
“আমার মুখের উপর কথা বলবি না।বাবা মা কখনো সন্তানদের খারাপ চায় না।”

“তুমি তো চাইছো বাবা।আমি তো মুরসালীন ভাই ছাড়া অন্য পুরুষের সংসার করার কথা ভাবতেও পারি না।”

কামরুল শেখ হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে রুহার গালে চড় মেরে বসলেন।হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
“কী যোগ্যতা আছে ওর?করে তো দুই টাকার চাকরি,আর তুই ওর পেছনেই কুকুরের মতো পড়ে আছিস?”

রুহা বাবার পা জড়িয়ে ধরল।মাথার ওড়না পড়ে গেছে মেঝেতে।ইলমা বেগম আঁচল চেপে ধরলেন মুখে।রুহা বাবার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
“বাবা তুমি আমাকে এই ঘরে বন্দি করে রাখো,আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দাও তবুও আমাকে অন্যত্রে বিয়ে দিয়ো না।আমি মুরসালীন ভাইকে খুব ভালোবাসি,ও আব্বু আমি অন্য কারোর সংসার করতে পারব না।”

রুহা বাবার পা আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল একরাশ হাহাকার নিয়ে। গলা শুকিয়ে গেছে, চোখ ফুলে লাল। বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রতি শব্দের সঙ্গে।

“বাবা, তুমি তো সবসময় বলো আমি তোমার চোখের মণি, তোমার প্রাণের টুকরা। তবে আজ কেন আমায় এত পর করে দিচ্ছো? আমি কারো দাসী নই যে তুমি তোমার মান ইজ্জতের জন্য অন্যের হাতে তুলে দেবে। আমি মানুষ বাবা, আমারও অনুভূতি আছে, আমারও স্বপ্ন আছে। তুমি কেন দেখতে পাও না আমি কতটা ভেঙে যাচ্ছি এই ভেবে যে মুরসালীন ভাই ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী বলতে হবে? তুমি কি আমার বুকের কান্নাটা শুনতে পাও না? বাবা, তোমাকে ছেড়ে আমি বাঁচতে পারব না, কিন্তু উনাকে ছাড়া তো আমি মরেও শান্তি পাব না।”

কথাগুলো ছিঁড়ে আসছিল দমকা কান্নার মধ্যে। ইলমা বেগম বুক চাপড়ে কেঁদে উঠলেন,
“হায় আল্লাহ! মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না।”

কামরুল শেখের মুখে কোনো কোমলতা দেখা গেল না। বরং তাঁর চোখে আগুন ঝলসে উঠল। গলার শিরা টনটন করে উঠল রাগে। তিনি দাঁত চেপে বললেন,

“চুপ কর! আমার সহ্য ক্ষমতার সীমা আছে। তুই আজ আমায় সীমার বাইরে ঠেলে দিচ্ছিস। মেয়ের মতো আচরণ করছিস না, বরং মাথা উঁচু করে বাবার সামনে তর্ক করছিস।”

রুহা কাঁদতে কাঁদতে বাবার পা আরও শক্ত করে ধরলো। অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলল,
“বাবা, আমি তোমার অবাধ্য হতে চাই না। কিন্তু আমি মন দিয়ে মুরসালীন ভাইকে ভালোবেসেছি। তুমি যদি তাকে অযোগ্য বলো, তবে আমি নিজেকেও অযোগ্য মনে করি। বাবা, আমায় দয়া করে জোর করো না। আমি তোমার মান রাখব, ইজ্জত রাখব, কিন্তু উনি ছাড়া অন্য কারোর নামে কবুল বলতে পারব না।”

কামরুল শেখের এবার রাগে সারা শরীর কাঁপতে লাগল। হঠাৎই তিনি রুহার হাত ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। বেরোনোর আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে বললেন,

“মনে রাখিস রুহা, আমার কথা’ই শেষ কথা। হয় আমি যাকে বলব, তার সাথেই বিয়ে বসবি-নাহয় আজ থেকেই ভুলে যা আমি তোর বাবা।”

কথাটা বলেই তিনি ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।ঘরে তখন নিস্তব্ধতা। রুহার বুক ফেটে যাচ্ছে কান্নায়। ইলমা বেগম মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,
“ধৈর্য ধর মা, আল্লাহর রহমত ছাড়া কারো কপাল লেখা হয় না।”
রুহা যেন শুনতেই পাচ্ছিল না কোনো কথা।তার চোখ থেকে একের পর এক অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে, বুকের ভেতর কেবলই প্রতিধ্বনি করছে বাবার শেষ কথা,
“ভুলে যাবি আমি তোর বাবা।”

রুহা মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।অমন করেই বলল,
“তুমি তো জানো মা,ঐ মানুষটা কেমন?তুমি বলো উনি আমায় সুখে রাখবে না?হয়তো উনার ব্যাংক ভর্তি টাকা নেই তাই বলে কী টাকার কাছে আমি আমার ভালোবাসা বিক্রি করে দিব?”

ইলমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পর বললেন,
“ওরা এসে দেখে যাক,তারপর আমি কিছু একটা করছি।”

“আমি ওদের সামনে যাব না মা।”

“আমার কথা শোন রুহা।”

অনেক বুঝানোর পর রুহাকে রাজী করাতে পারলেন তিনি।ছেলে পক্ষ এসে গেছে।এখন বিকাল ৪টা ছাড়িয়েছে।শেখ বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছেন পাত্র পক্ষ।নাবিল বাড়িতে নেই।সে থাকলে বোধহয় এসব কিছুই হতো না।বোনদের নিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা থাকলেও কাজের জন্য যেতে পারেনি।নরুল শেখ মুখ শক্ত করে ভাইয়ের পাশে বসে আছেন।তিনি জানেন রুহা মুরসালীনকে ভালোবাসেন এবং তিনিও রুহাকে বেশ পছন্দ করেন কিন্তু কামরুল শেখ তা কখনোই মানবেন না।উল্টো ভালোবাসার দোষে ছোটো মেয়েটাকে এইচএসসি পরীক্ষার আগেই বিয়ে দিতে চাচ্ছেন।

রুহা গায়ে খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পড়েছে।হাতে গলায় হালকা কিছু গয়না।মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করা।রুহা এখনো চোখ তুলে সামনে তাকায়নি।হঠাৎ সামনে থেকে অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে রুহা সামনে তাকায়।আদিব স্যার!আর সাথে তিনজন আছে।রুহা ভাবল আদিবের সাথে তার বাবা বিয়ে ঠিক করতে চাইছে?কামরুল শেখ আদিবের ভাই আমিরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“আমার মেয়েটা ভীষণ লাজুক।তোমরা কী আলাদা করে কথা বলতে চাও?”

রুহা আশ্চর্য হয়ে আদিবের পাশে তাকাল।আদিবের পাশে এক সু-দর্শন যুবক বসে আছে।শ্যামবর্ণ গায়ের রং,গায়ে সাধারণ সাদা রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট।ঠোঁটে দারুণ হাসি।রুহা চোখ নামিয়ে নিল।বুক কাঁপছে ভয়ে।তার মানে এই ছেলের সাথেই বিয়ের কথা চলছে।আমির একা কথা বলতে চাইল রুহার সাথে।রুহা ঘাড় হালকা বাঁকিয়ে মায়ের দিকে তাকাল।ইলমা বেগম চোখের ইশারায় সম্মতি দিলেন।ওরা বাড়ির বাগানে এসেছে।আমির রুহার দিকে তাকিয়ে গলা পরিষ্কার করে শুধোয়,

“আপনি বোধহয় লজ্জা পাচ্ছেন?”

রুহার রাগ হলো ভীষণ।তবুও বাবার সম্মানের কথা ভেবে নরম গলায় বলল,
“লজ্জা পাব কেন?আমরা কী বাসর ঘরে বসে আছি?”

আমির হতভম্ব হয়ে গেলো এহেন উত্তরে।নিজেকে কোনোরকম সামলে বলল,
“আপনি কী এই বিয়েতে রাজী?”

“না।”

“কেন?”

“জেনে কী করবেন?”

আমির মুচকি হাসলো।সে কথা বাড়াতে চাইল না।তাই নরম গলায় বলল,
“আই লাইক ইট!আপনি ভীষণ সুন্দর,ঠিক আপনার কথার মতো।”

আমির হাঁটা ধরলো বাড়ির দিকে।রুহা আশ্চর্য হয়ে সেদিকের তাকিয়ে রইল।কী আজব মানুষ।সে মানা করল আর এই লোক তার প্রশংসা করে গেল?
বিকেলের মিষ্টি আলো নিভে আসছে আস্তে আস্তে।আদিবরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে।তারা চাইছে সামনে শুক্রবার আমিরের সাথে রুহার কাবিন করিয়ে রাখতে।রুহার পরীক্ষার পর অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলে নিবেন।

এই মুহূর্তে রুহা নিজের ঘরে বসে আছে।রাইমা এলো খানিকক্ষণ পর।দেখল রুহা বিছানায় হ্যালান দিয়ে শুয়ে আছে।সে গিয়ে ওর পাশে বসলো।

“দুপুরে খেলি না কেন?”

রুহা বোনের দিকে ফিরল।চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বাবা কেন এমন করছে আপু?”

“মুরসালীনের জন্য।”

“উনার দোষটা কী বলবি?”

“ভালোবাসাটাই দোষ।”

“আমি ঐ লোককে বিয়ে করতে পারব না।”

ইলমা বেগম এলেন হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে।খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
“করতে হবে না বিয়ে।”

রুহা মায়ের কথা শুনে মাথা নিচু করল।টপটপ করে চোখের পানি ঝরছে।তিনি রুহার পাশে বসে বললেন,
“এক মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে,আমি চাই না আমার আরেক মেয়ের জীবন ধ্বংস হোক।”

“মা তুমি বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলো?”

ইলমা বেগম ধীর কণ্ঠে বললেন,
“তোর বাবা কথা দিয়ে দিয়েছেন।”

“মা?”

ইলমা বেগম শুকনো ঢোক গিললেন।আড়চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“চলে যা তুই।মুরসালীন তোকে সুখে রাখবে।”

রুহা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকায়।

“আমি চলে গেলে বাবাকে কী বলবে মা? উনি তো তোমার উপর ভীষণ রাগ করবেন। তোমায় বকাবকি করবে, হয়তো মারধরও করবে। তখন তুমি সামলাবে কীভাবে?”

ইলমা বেগম এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিলেন। চোখে জমে থাকা জল হাতের আঁচল দিয়ে মুছে ফেললেন। তারপর ধীর কণ্ঠে বললেন,

“আমি অভ্যস্ত রে মা। তোর বাবার রাগ, তেজ, গম্ভীরতা আমি কত বছর ধরে সামলাচ্ছি। তোর সুখের জন্য আমি এইটুকু তো করতেই পারি। তুই শুধু তোর জীবনটাকে নষ্ট হতে দিস না। বাবা হয়তো আমাকে কটু কথা বলবে, হয়তো কিছুদিন কথা বলবে না, কিন্তু সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা যখন দেখবে তুই সুখে আছিস, তখন একদিন তিনিও বুঝবে।”

“তোমার কষ্ট হবে না?”

ইলমা বেগম কাঁপা হাতে মেয়ের গাল ছুঁয়ে দিলেন। কণ্ঠ ভারী হয়ে গেল,
“আমি কষ্ট পাব, বুক ফেটে যাবে কিন্তু তারচেয়ে বড়ো কষ্ট হবে যদি তোকে মনের বিরুদ্ধে কারো ঘরে তুলে দিতে হয়। মা, আমি চাই না তুই প্রতিদিন চোখের জল গোপন করে বাঁচিস। আমার কষ্টের চেয়ে তোর হাসি আমার কাছে অনেক বড়ো।আমি তোকে বলছি,সারা দুনিয়া খুঁজেও মুরসালীনের মতো কাউকে পাবি না।”

রুহা মায়ের কোলের ভেতর মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল।বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে।সে গলায় কান্না চেপে বলল,
“মা, আমি সত্যিই চলে যাব? সত্যিই উনার কাছে যাব?”

“যা!”

ঘরটা ভারী হয়ে উঠল। বাইরে দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। রুহার বুকের ভেতর ঢেউ খেলছে ভয় আর আশা মিশ্র অনুভূতিতে।
•••••
সন্ধ্যার আজানের পর যখন কামরুল শেখ বাড়ি থেকে বের হলেন,ঠিক তার কিছুক্ষণ পর রুহা বাড়ি থেকে বের হলো।বাড়ি থেকে কিছুদূর ঢলীপাড়ার রাস্তায় আসতেই সামনে মুরসালীনের অস্থির মুখশ্রী দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে।মুরসালীন হতভম্ব হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।আশেপাশে তেমন মানুষ নেই।মুরসালীন রুহার বিয়ের কথা শুনেই বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে না গিয়ে সোজা বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছিল।হঠাৎ রুহাকে এই সময়ে বাড়ির বাইরে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে এলো।রুহা পা উঁচিয়ে শক্ত করে মুরসালীনের গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।

“মুরসালীন ভাই,বাবা আমায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল।”

মুরসালীন চোখ বন্ধ করে রুহার পিঠে হাত রেখে নিজের সাথে চেপে ধরলো প্রিয়সীর ছোট্ট দেহটা।বুকের ভেতর রাগ,অভিমান,অসহায়ত্ব মিলে মিশে আগুন জ্বলছিল বুকে।রুহা হেঁচকি তুলে মুরসালীনের গলা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।ঘাড় উঁচিয়ে মুরসালীনের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি মুরসালীন ভাই।আমায় আপনি বিয়ে করবেন?আপনি আজও চুপ করে থাকবেন?”

মুরসালীন হঠাৎ হেসে ফেলল।অথচ চোখে ছিল চিকচিক বালির মতো পানি।রুহা সেই চোখের দিকে তাকাল।মুরসালীন দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করল।রুহা হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল।গলায় আঁটকে থাকা কষ্ট গুলো কোনরকম গিলে জড়াল কণ্ঠে বলল,

“আপনি বলেছিলেন,যেদিন আমি সব ছেড়ে আপনার হাত ধরতে পারব সেইদিন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন।দেখুন না মুরসালীন ভাই,আমি আজ সব ছেড়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।আমাদের কী সংসার হবে না?”

চলবে।

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

১৩.
মুরসালীন রুহার চোখের পানি কাঁপা হাতে মুছে দিয়ে ধরা গলায় বলল,
“আমাদের সংসার হবে মেয়ে!আমা..আমাদের সংসার হবে।”

রুহা ফিঁক করে হেসে দিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল।ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরল তার মনের মানুষকে।মুরসালীনের গাল বেয়েও বোধহয় আজ দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।রুহা চোখ উঠিয়ে সেই চোখের পানি দেখে আজ ভীষণ অবাক হলো।মুরসালীনকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“এই রাস্তা থেকে চলুন,বাবা দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

মুরসালীন রুহার ডান হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।উল্টো রাস্তায় হাঁটা ধরে ঘাড় বাঁকিয়ে রুহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে ঘর ছাড়লি শেষে?”

রুহা ছলছল নয়নে ঠোঁট কেঁপে বলল,
“আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি।”

মুরসালীন হাসল।প্রাণ ভরে হাসলো আজ।হাঁটতে হাঁটতে একটা টং-এর সামনে এসে রুহাকে বসতে বলল।রুহা আশেপাশে তাকিয়ে মাথায় কাপড় টেনে বসল মুরসালীনের পাশে।মুরসালীন ফোন বের করে ইলমা বেগমের নাম্বার বের করল।আড়চোখে রুহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর বাবার পারমিশন আমি কখনোই নেব না,কিন্তু তোর মায়ের অনুমতি আমার দরকার।”

রুহা নিচু গলায় বলল,
“আম্মু’ই তো আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল।”

মুরসালীন অবাক হয়ে বলল,
“চাচি?”

“হুম!”

মুরসালীন শুকনো ঢোক গিলে ইলমা বেগমের নাম্বারে কল দিতেই সাথে সাথে রিসিভ হলো।মুরসালীন সালাম দিয়ে বলল,
“ভালো আছেন চাচি?”

ইলমা বেগম বোধহয় এতক্ষণ কাঁদছিলেন।গলা কেমন ভার ভার ঠেকছে।তিনি ভারী কণ্ঠে’ই বললেন,
“ভালো আছি বাবা,তুই কেমন আছিস?”

মুরসালীন দূর পথে অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
“আপনার মেয়েকে আমায় দিয়ে দিন,আমার আর দুঃখ থাকবে না চাচি।”

ইলমা বেগমের বুকটা হু হু করে উঠল মুরসালীনের কথায়।আঁচলের কোণ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন,

“তুই যদি আমার মেয়ের কপালে থাকিস, তবে আল্লাহই তোকে তার জন্য বেছে রেখেছেন বাবা। নিয়ে যা রুহাকে। ওকে সুখে রাখিস, দুঃখের আঁচ যেন না লাগে। তোর উপর আমার ভরসা আছে।”

মুরসালীন ফোন কানে ধরে কিছুক্ষণ নীরব রইল। তার গলা কেঁপে উঠল, চোখ দুটো আরও লাল হয়ে গেল। আস্তে করে বলল,
“চাচি, আপনার বিশ্বাস ভাঙব না। আল্লাহ সাক্ষী, আমি রুহাকে নিজের জানের চেয়েও বেশি আগলে রাখব।আপনি শুধু দোয়া করবেন।”

ফোন কেটে গেল। রুহা তখন দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছিল মুরসালীনের হাত। চোখে ছিল ভয়। সে নিচু গলায় বলল,
“আমরা এখন কোথায় যাবো?”

মুরসালীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল,
“প্রথমে কাবিন হবে। আল্লাহর নামে তুই আমার হবি, আমি তোর। বাকিটা সময়ের উপর ছেড়ে দে।”

মুরসালীন নরুল শেখের নাম্বারে কল করল।বেশ কিছুক্ষণ পর রিসিভ হতেই সে সালাম করল।নরুল শেখ অপাশ থেকে বললেন,
“ভালো আছিস বাবা?”

মুরসালীন কথা না বাড়িয়ে বলল,
“বাবা,আজ তোমার থেকে একটু দোয়া চাই আমার।”

নরুল শেখ অবাক হয়ে বললেন,
“কী হয়েছে?”

“আমি রুহাকে বিয়ে করব,আজ এবং এখনই।তুমি কাউকে কিছু জানিও না আগেই।আগে বিয়ে হোক তারপর আমি সব সামলে নেব।”

নরুল শেখ যেন কথা বলতেই ভুলে গেলেন।তিনি কী জবাব দেবেন ভেবে উঠতে পারলেন না।বেশ কিছুক্ষণ পর ধীর কণ্ঠে বললেন,
“রুহা কোথায়?”

“আমার সাথেই।”

“ঠিক আছে,তবে মনে রাখিস বাবা,রুহার পুরো জীবনের দায়ীত্ব তোর।ওকে কখনো কষ্ট দিবি না।”

“আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ওয়াদা করবো বাবা।”

বাবা কল কাটতেই সে ফারদিন আরও তিন ছেলে মেয়ে উভয় বন্ধুকে ফোন করে বের হতে বলল।
রাত নামতে শুরু করেছে। আকাশে আধখানা চাঁদ। শহরের পথজুড়ে কুয়াশার আস্তর। রুহা আর মুরসালীন হাতে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল কাজী অফিসের সামনে।সেখানে মুরসালীনের চারজন ফ্রেন্ড দাঁড়িয়ে আছে।মিহি,তমা,ফারদিন এবং তানভীর।

রুহার বুক ধড়ফড় করছে। কপালে ঘাম জমেছে। চোখ দুটো একেবারে অশ্রুসজল। মুরসালীন রুহার কাঁপা হাতটা ধরে বলল,
“ভয় পাস না। আল্লাহ আমাদের সাক্ষী।”

কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো কাবিনের আসর। সাক্ষীদের সামনে কাজী প্রশ্ন করলেন,
“রুহানি রায়হা, আপনি কী মুরসালীন আবেশকে স্বামী হিসেবে কবুল করছেন?”

রুহা কাঁপতে কাঁপতে এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিল,
“কবুল।”

কাজী আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি কী মুরসালীন আবেশকে স্বামী হিসেবে কবুল করছেন?”

রুহা এবার চোখ বুঁজে অশ্রুভেজা ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল,
“কবুল।”

তৃতীয়বার প্রশ্নের পরও রুহার কণ্ঠ বেজে উঠল,
“কবুল।”

কাজী অফিসের ভেতর সবার মুখে ধ্বনি উঠল “আলহামদুলিল্লাহ।”

রুহার বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে গেল। সে মুখ ঘুরিয়ে মুরসালীনের চোখে তাকাল। মুরসালীনের ঠোঁটের কোণে অশ্রুর ভেজা হাসি ফুটে উঠল। কাজী দু’হাত তুলে দোয়া করলেন,
“আল্লাহ তোমাদের সংসারকে বারাকাহ দিক। তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখকর হোক।”

•••••

কাজী অফিস থেকে বের হয়ে অন্ধকার পথে দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে শীতের হালকা ঝিরঝির।ফারদিনরা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে।রুহা এদিক ওদিক তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এখন কী হবে মুরসালীন ভাই? বাবা যদি জেনে যান?”

মুরসালীন হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে রেখে দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল,
“আজ থেকে তুই আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি তোর স্বামী। তোর বাবার রাগ মিটে যাবে একদিন, কিন্তু আজকের রাতটা ইতিহাস হয়ে রইল রুহা, তুই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সাহস।”

রুহা ফোঁপাতে ফোঁপাতে হেসে ফেলল। ভাঙা গলায় বলল,
“আমি তো সব হারালাম, কিন্তু সবটুকুই জিতলাম আপনার কাছে এসে।”

মুরসালীন ওকে বুকে টেনে নিল।দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইল আকাশের চাঁদের নিচে,নতুন সংসারের প্রথম রাতের সূচনালগ্নে।

মুরসালীন বুক ভরে শ্বাস টানল শেখ বাড়ির সামনে এসে।রুহা ভীতু চোখে বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা ভীষণ রেগে যাবে।”

“কিছু হবে না।”

মুরসালীন বাড়ির মেইন গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।সদর দরজা চাপানো।রুহা শক্ত করে তার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে পা রাখল।ড্রয়িংরুম নাসরিন বেগম ঝাড়ু দিচ্ছিলেন।তা ছাড়া কেও ছিল না সেখানে।সদর দরজার সামনে হঠাৎ চোখ যেতেই তিনি হাত থামিয়ে অবাক চোখে তাকালেন।সিঁড়ি বেয়ে আফনান নামছিল,ভাই আর রুহাকে দেখে চিৎকার করে ছুটে আসলো সে।দৌঁড়ে এসে ভাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে চিৎকার শুরু করল।মুরসালীন ছোটো ভাইয়ের মাথায় হাত রাখলো।তৎক্ষণাৎ আফনানের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সবাই।রাইমা বাহারকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে।কামরুল শেখ ও ইলমা বেগম নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।চোখের সামনে রুহা আর মুরসালীনকে দেখে কামরুল শেখের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল।দাঁত কিরমির করে বললেন,
“কী হচ্ছে এখানে?”

রুহা ভয়ে কথা বলতেই ভুলে গেলো।ইলমা বেগম শুকনো ঢোক গিললেন।রাইমা তাড়াতাড়ি নেমে এসে বাবার পাশে দাঁড়াল।নরুল শেখও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।তিনি মুরসালীন ও রুহাকে দেখে লম্বা শ্বাস টানলেন।ভাইকে এড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“ভেতরে আয় তোরা।”

ওরা ভেতরে এলো।মুরসালীন লম্বা শ্বাস টেনে বুক টানটান করে কামরুল শেখের সামনে দাঁড়াল।রুহার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“মাফ করবেন চাচা,আপনার অনুমতি না নিয়েই আমি আপনার মেয়েকে কবুল করেছি।”

কামরুল শেখ রাগে কাঁপতে লাগলেন।চোখ দুটো দিয়েই যেন সব ধ্বংস করে ফেলবেন।রুহা ভীতু কণ্ঠে বলল,
“বাবা…”

ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বসলেন কামরুল শেখ।রুহার গাল হেলে গিয়ে ঠোঁট কেটে র’ক্ত বেরিয়ে এলো।মুরসালীন তাড়াতাড়ি সামলে নিলো ওকে।টেনে ধরে রুহার ঠোঁটে হাত রেখে দেখল র’ক্ত বেরিয়ে আসছে।তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।কামরুল শেখ চিৎকার করে বললেন,

“কে তোর বাবা?কোন মুখে বাবা ডাকছিস তুই?বেহায়া মেয়ে কোথাকার,নির্লজ্জ,অপয়া,তোর ঐ নোংরা মুখ দিয়ে আমাকে বাবা ডাকবি না।তুই আমার মেয়ে না,আর না আমি তোর বাবা।”

কামরুল শেখের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। রুহা বাবার থাপ্পড় খেয়ে অশ্রুসজল চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁট কেটে র’ক্ত ঝরছে, বুক কাঁপছে। ঠিক তখনই মুরসালীন কেঁপে উঠল ভেতর থেকে। তার বুকের রাগ, কষ্ট আর ভালোবাসা একসাথে গর্জে উঠল তার পুরুষালী কণ্ঠে,

“চাচা! যথেষ্ট হয়েছে। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আজকের পর কেউ রুহাকে অপমান করলে আমি চুপ থাকব না। আপনি তাকে মেয়ে না মানলে মানবেন না, কিন্তু আমি তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে কবুল করেছি। আল্লাহ আমাদের সাক্ষী। কেউ এই সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারবে না।”

সে রুহার হাত আরও শক্ত করে ধরল। চোখ লাল হয়ে গেছে, গলাও কাঁপছে।
“আপনি রুহাকে অপয়া, নির্লজ্জ বলছেন মানে আমাকে বলছেন। কারণ সে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার ইজ্জত। একজন স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব তাকে আগলে রাখা, তার চোখের পানি ঝরতে না দেওয়া। আপনি যদি তাকে ত্যাগ করেন, আমি দ্বিগুণ ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখব। আমি শত্রুর সামনে মাথা নোয়াইনি, নিজের পরিবারের সামনে নত হব না। রুহা এখন শুধু আপনার মেয়ে নয়, আমার স্ত্রীও।
আমি আপনার অনুমতি ছাড়া কাবিন করেছি, এটা সত্যি। কিন্তু আমি হারাম কিছু করিনি। শরিয়ত অনুযায়ী, সাক্ষীদের সামনে, কাজীর সামনে, আল্লাহর নামে রুহাকে কবুল করেছি। এটা গুনাহ নয়, পবিত্র নিকাহ্। আপনি চাইলে আজীবন রাগ করে থাকতে পারেন, কিন্তু আমাদের বন্ধনকে কেউ ভাঙতে পারবে না।”

ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু রুহার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইলমা বেগম চোখ মুছছেন, নরুল শেখ গভীর শ্বাস নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন।
মুরসালীন এবার রুহাকে বুকের সাথে টেনে নিয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

“চাচা, রুহাকে ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আজ থেকে ওর দুঃখ-সুখ আমার কাঁধে। আপনি যদি চান, আমাকে ঘর থেকে বের করে দিন, কিন্তু আল্লাহর নামে বলছি, রুহাকে ছেড়ে আমি এক পাও নড়ব না।”

নাসরিন বেগম হঠাৎ এগিয়ে এলেন ছেলের সামনে।তিনি নিজেও রেগে চিৎকার করে বললেন,
“তুই এই মেয়ের জন্য আয়শাকে বিয়ে করতে চাসনি?এই মেয়ের মাঝে কী দেখেছিস?”

তিনি রুহার দিকে ফিরলেন।দাঁত চেপে মুখে বিশ্রী ভাষা আউড়ালেন,
“মা’গি একটা,দেহ দেখিয়ে আমার ছেলেকে বশ করেছিস?নষ্টামির আর জায়গা পেলি না?”

রুহা চাচির এহেন ভাষা শুনে মুরসালীনের বুকে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে উঠল।মুরসালীনের যেন শরীর জ্বলছে।যদি নাসরিন বেগম তার মা না হতো তাহলে কী যে হত সে নিজেও জানে না।সে কণ্ঠ শক্ত করে মায়ের দিকে র’ক্তলাল চোখে তাকিয়ে হাত উঠিয়ে বলল,
“আম্মু! একবার হলেও ভেবে দেখো, তুমি আজ কী বললে! রুহা আমার স্ত্রী,আমার ইজ্জত, আমার মান। তাকে গালি দিলে মানে আমাকে দিলে, তোমার নিজের ছেলেকে দিলে!কসম আল্লাহর,আজ যদি অন্য কেউ ওকে এমন কথা বলত, আমি তার জিহ্বা কে’টে ফেলতাম।”

সে হাত মুঠি করে নিজের বুকে চাপ দিল, কণ্ঠ কেঁপে উঠল তবুও ভাঙল না,

“আমি তোমার সন্তান, তাই তোমাকে স্পর্শ করলাম না। কিন্তু আম্মু, মনে রেখো, রুহা এখন আমার ঘরের বউ, আমার জানের অর্ধেক। তাকে গালি দিলে, আমাকেও গালি দেওয়া হয়। তাকে নষ্ট বললে, আমাকেও নষ্ট বললে। এই অপমান আমি সহ্য করব না।”

মুরসালীনের গলা হুঙ্কারের মতো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।
“রুহা দেহ দেখিয়ে আমাকে ফাঁসিয়েছে?এমন একটা নোংরা কথা বলতে তোমার মুখে বাঁধলো না মা?তুমি আজকে ওকে কী বলে গালি দিয়েছো একবারও ভেবেছ?রুহার চোখের পানিতে আমি ডুবে গেছি, তার সততায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার দুনিয়ায় আমি যাকে চাই, সে শুধু রুহা। আর আল্লাহর সামনে আমি তাকে হালাল করেছি।”

সে এক পা এগিয়ে এসে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,

“তুমি যদি সত্যিই আমার মা হও, তবে এই সম্পর্ককে অভিশাপ দিয়ো না।কারণ এই সম্পর্ক ভাঙলে তোমার ছেলে মরবে, আম্মু। আমি রুহা ছাড়া বাঁচব না। একদিন তুমি বুঝবে, আমি ভুল করিনি।”

চোখ বন্ধ করে দাঁত চেপে বলল,
“ক্ষমা চাইতে বলে তোমাকে অপমান করব না,কিন্তু তোমার এই ব্যবহার আমার আজীবন মনে থাকবে।আমার স্ত্রীকে করা অপমানের মুহূর্ত আমি কোনোদিন ভুলব না।”

নাসরিন বেগম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন,নরুল শেখ ধমক দিয়ে থামিয়ে বললেন,
“ভদ্রতা বজায় রাখো নাসরিন।আমার মুখ ছুটাবে না।”

ইলমা বেগম চোখে পানি রেখে নাসরিন বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আমার মেয়েকে তুই এত জঘন্য ভাষায় গালাগালি করলি নাসরিন।ও তো তোর মেয়ের মতোই।একজন মা হয়ে সন্তানকে এভাবে..?ছিঃ!”

কামরুল শেখ পিছু ঘুরলেন।নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে চড়া মেজাজে বললেন,
“বেরিয়ে যা তোরা এই বাড়ি থেকে।কলঙ্ক গায়ে লাগিয়ে এই বাড়িতে থাকার অধিকার তোদের নেই।আজ থেকে ভুলে যাবি,তোদেরও বাবা মা আছে।”

মুরসালীন চাচাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এই বাড়িতে আমি কিংবা আমার বউ,কেও’ই পা রাখব না চাচা।আল্লাহ সাক্ষী,আমরা কোনো অন্যায় করিনি।”

মুরসালীন রুহার হাত ধরে গটগট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।ইলমা বেগম সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন।মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন ছেলে মেয়ে দুটো যেন সুখী হয়।সুন্দর ছোটো একটা সংসার হয়।
••••••
রাত তখন ১১টা ছাড়িয়েছে।মুরসালীনের দুতলা ভাড়া বাসায় এসেছে রুহা।তার নতুন ছোট্ট সোনার সংসারে।মুরসালীনের ছোটো একটা ঘর।সেখানে জিনিস পত্রও সীমিত।রুহা বিছানায় বসে আছে,মুরসালীন হাত মুখ ধুয়ে রান্না বসিয়েছে চুলায়।হয়েও গেছে প্রায়।রুহা সামনেই তাকিয়ে আছে মুরসালীনের দিকে।ঘরের মধ্যেই সব।রান্নাঘরটা ঘরের একদম কোনায়,আর অপর পাশে ওয়াশরুম।মুরসালীনের পরনে ছাই রঙা একটা ট্রাউজার আর পাতলা একটা টি-শার্ট।চোখে চশমা পড়ে ব্যস্ত হাতে রান্নায় ব্যস্ত।রুহার খারাপ লাগলো,সে থাকতে মুরসালীন কষ্ট করছে।রুহা বিছানা থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

“আমি সাহায্য করি মুরসালীন ভাই?”

মুরসালীন ভ্রু কুঁচকে রুহার দিকে তাকাল।তরকারি হয়ে গেছে।সে চুলা নিভিয়ে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল,
“আজ আমি করলাম কাল তুই করবি।পরশু আমি করলে,তারের পরের দিন তুই করবি।”

রুহা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল।বলল,
“কেন?আমি না আপনার বউ?রান্না বান্না তো বউকেই করতে হয়।”

মুরসালীন মুচকি হাসলো।তরকারি ঢেকে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে রুহার কাঁধে হাত রেখে ঘরের ভেতর আসতে আসতে বলল,
“তুই’ই করবি সব কিন্তু জামাই হিসেবে আমারও তো কিছু কর্তব্য আছে নাকি?যখন আমার কাছে সময় থাকবে তখন আমি’ই সব করবো।”

“আর যাইহোক,মুরসালীন ভাই আমি কিন্তু মাছ কাটতে পারি না।”

মুরসালীন হেসে ফেলল।বিছানায় বসে রুহাকে বলল,
“পাশে বোস।”

রুহা বসল।মুরসালীন বলল,
“শোন,এই সংসার আজ থেকে তোর আর আমার।কিন্তু সব কিছু গুছিয়ে নেয়ার দায়ীত্ব তোর।”

“ঠিক আছে,ঠিক আছে নিলাম দায়ীত্ব।আপনার এবং এই সংসারের।”

মুরসালীন রুহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“অনেক বড়ো হয়ে গেছিস।”

“শুধু তোমার জন্য।”

দুজন একসাথে হেসে ফেলল।চাঁদের আলোয় সেই হাসি টুকু আরও মিস্টিময় করে তুলল।যেন দুজনের কানে কানে ফিসফিস করে বলছে,
“এই সুখটুকুও শুধু তোমাদের জন্যে!”

#চলবে..?