যেখানে মন হারায় পর্ব-১৬+১৭

0
12

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

১৬.
রাস্তায় মানুষের আনাগোনা বেড়েই চলেছে।নাবিল রিফার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ।রিফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“আমার বাড়িতে ফিরতে হবে নাবিল।”

নাবিল দুপা এগিয়ে এলো।হঠাৎ রিফার দুহাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,
“ভুল তো মানুষ মাত্রই হয় রিফা।আমি..আমি আসলে পরিস্থিতির স্বীকার ছিলাম।”

রিফা তাচ্ছিল্য হাসলো।
“ভালোবাসার মানুষকে কেও কখনো সন্দেহ করে নাবিল?তুমি কেন শুধু মাত্র কয়েকটা কথার ভিত্তিতে এই সম্পর্কটাই তুচ্ছ বানিয়ে ফেললে?”

“ঐ সময়টাতে আমার অবস্থা কী ছিল তুমি খুব ভালো করেই জানো।বাবাও তখন এই সম্পর্কের কথা শুনে ভীষণ রাগারাগি করেছিলেন।তখন এতকিছু মাথায় আসেনি আমার।তোমাকে ছেড়ে কী আমি খুব শান্তিতে আছি?তুমি’ই ছিলে আমার জীবনের প্রথম নারী এবং শেষ নারী।তোমার পর আমি কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি।”

রিফা নাবিলের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল।নাবিল যত্নে হাত রাখলো তার মাথায়।রিফা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“তোমরা পুরুষ মানুষ কখনো নারীর মনের হাহাকার বুঝবে না।”

“সরি।”

“সরি বললেই সব শেষ হয় না নাবিল।”

নাবিল রিফার মুখ উঠিয়ে বলল,
“আমাকে শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও?বিশ্বাস করো,এই চোখে আর কোনোদিন পানি আসবে না।”

রিফা ছলছল চোখে নাবিলের আনন খানা দেখে শুকনো ঢোক গিলল।দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ভাঙা জিনিস আর কতবার ভাঙতে চাও?”

“আর কখনো আঘাত করবো না।তোমাকে ছাড়া আমিও ভালো নেই।”

রিফা নিঃশব্দে ভারী নিশ্বাস ফেলল।নাবিল রিফার হাত শক্ত করে ধরেই বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো।মাঝে যেতে যেতে দুজনের বেশ কিছু মান অভিমানের গল্প হলো।যেখানে শান্তি ছিলো,বোঝা-পড়া ছিল,আর ছিল দুজনের মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা হাজারটা যন্ত্রণার কথা।
••••
রাইমা বাহারকে ঘুম পাড়িয়ে মাত্রই বিছানা থেকে নেমেছে।ঠিক তখন ফোন বেজে উঠল।সে বাহারের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিয়েই রিসিভ করল।ওপাশ থেকে রুহা বলল,

“আপু কেমন আছিস?”

বোনের কণ্ঠস্বর শুনতেই গাল ভরে হাসল রাইমা।উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“ভালো আছি।তোর কী খবর?জামাই ভালোবাসছে তো?”

রুহা লজ্জায় বলল,
“যাহ,কিসব কথা বলছিস আপু?”

“কিসব মানে?বাসর রাতে কিছু হয়নি?জামাই ভালোবাসেনি বুঝি?”

রুহার গাল গরম হয়ে এলো।বোনের থেকে এমন ধরনের কথা শুনে চিৎকার করে বলল,

“আপু এসব কী বলছিস তুই?এসব বলা যায়?”

রাইমা খিলখিল করে হাসল।রুহা ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে।রাইমা আর একটু লজ্জা দিতে বলল,
“শোন,জামাইকে বেশি বেশি ভালোবাসবি।”

“আপু চুপ থাক।”

“আচ্ছা বাবা,এখন বল নতুন সংসার কেমন লাগছে?”

“খুব ভালো।ছোটো একটা ঘরে উনি আর আমি।”

রাইমা প্রান ভরে শ্বাস নিলো।চোখের পাতা ভিজে এলো বোধহয়।তার তো কোটিপতি লোকের সাথে বিয়ে হয়েও সুখ হলো না।আর তার বোনটা একটা কুঁড়েঘরে গিয়েও রাজরাণী।সে বলল,
“আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে শুকরিয়া আদায় করবি।দোয়া করি সব সময় সুখে থাক।”

রুহা বলল,
“মা কেমন আছে আপু?”

“ভালো নেই।আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলে না।হয়তো ঝগড়া হয়েছে।”

রুহা মন খারাপ করে শুধোয়,
“আম্মুকে কল করতে ভয় হচ্ছে।বাবা কী আজকে বাড়িতে?”

“হ্যা,আজ অফিসে যায়নি।”

রুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোনের সাথে টুকটাক কথা বলে কল কেটে দিল।তাড়াতাড়ি ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুরসালীনের কিনে দেয়া লাল টুকটুকে কাতান শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দেয়ালে টাঙানো আয়নার দিকে তাকাল।লিপস্টিক না থাকলেও কাজল কিনে দিয়েছে তাকে।সে চোখে সুন্দর করে কাজল টানল।মাথার চুল খোঁপা করে সেখানে আঁচল টেনে মাথা ঢাকলো।হাতে দু’মুঠো কাঁচের চুরি।বিয়েতে বউ সাঁজতে পারেনি বলে মুরসালীন এসব কিনে দিয়েছিল আজ।কেনার সময় বলেছিল,—বউ সাজিয়ে বিয়ে করতে পারিনি কিন্তু বউ তোকে সাজবই।”

রুহা মুচকি হেসে রান্না ঘরে গিয়ে লাইট বন্ধ করে ঘরে এলো।সাথে সাথে দরজায় শব্দ হতেই চমকে উঠল।বুকে থুথু দিয়ে বলল,

“কে?”

বাইরে থেকে মুরসালীনের গলা পেয়ে রূহা দুরুদুরু বুক নিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।মুরসালীন রুহাকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেল।ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠল।রুহা পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঘরে আসুন।”

মুরসালীন জুতা খুলে ঘরে ঢুকলো।রুহা দরজা আঁটকে দিয়ে মুরসালীনের দিকে তাকাল।লাজুক মুখটা লজ্জায় আরও লাল হয়ে এলো।মুরসালীন ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

“আমার বউ রুহানি।”

রুহা শাড়ির আঁচল মুচড়ে বলল,
“ইশ,আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তো।”

মুরসালীন বাইরে থেকে এসেছে বলে বেশি সময় না নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।রুহা বিছানার এক কোণে বসে ছিল।মুরসালীন বের হতেই বলল,

“আপনাকে খাবার দিব?”

মুরসালীন রুহার হাতের চুড়ির শব্দ শুনছিল।রুহার কথা শুনে বলল,
“বউ খাইয়ে দিলে আলবাদ খাব।”

রুহা মুরসালীনের জন্য খাবার বেড়ে এনে বিছানায় বসলো।মুরসালীন পাশে বসে রুহাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে।হঠাৎ খেয়াল হলো রুহার মুখ ভার।সে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“মুখ কালো করে রেখেছিস কেন?”

রুহা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কিছু হয়নি।”

“বল নাহলে মার খাবি।”

“এত সুন্দর করে সেজেছি অথচ আপনি একবারও বললেন না তোকে সুন্দর লাগছে।বিয়ে করতে না করতেই ভালোবাসা সব শেষ।”

মুরসালীন কোনো উত্তর না দিয়ে আড়ালে মুচকি হাসল।রুহা ভ্রু কুঁচকে তাকালেও মুখে আর কিছু বলল না।খাওয়া শেষ হলে মুরসালীন থালা পাশে সরিয়ে রাখল।রুহা নিজেও নিঃশব্দে খেয়ে এসে একপাশে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল মুরসালীন।তারপর ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে রুহাকে টেনে নিলো বুকের কাছে।রুহা প্রথমে ভড়কে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলো নিজেকে।

মুরসালীন নিচু স্বরে বলল,
“তোকে আজ আমার বউয়ের মতো সুন্দর লাগছে।এই সাজটা চোখের সামনে থেকে সরাতে ইচ্ছে করছে না।”

রুহা গলা শুকিয়ে গেলেও উত্তর দিল,
“তবুও তো মুখে আগে কিছু বললেন না।”

“আমি তোর সৌন্দর্য চোখে ধরে রেখেছিলাম।শব্দে বললে হয়তো কম মনে হতো।”

রুহা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেলল।মুরসালীন তার চিবুক টেনে নিজের দিকে ফেরাল।চোখের গভীরে ডুবে গিয়ে আরও ধীর কণ্ঠে বলল,
“আজ তোকে একটু গভীর স্পর্শে রাঙিয়ে দেই?বউ সাজিয়েছি তোকে,এখন বউয়ের মতো আপন করে নেব।অনুমতি পাবো বউকে আদর করার?”

রুহার বুক ধড়ফড় করতে লাগল।সে মাথা নামিয়ে রাখল মুরসালীনের বুকে।মুরসালীন নিঃশব্দে আলো নিভিয়ে দিলো ঘরের।ধীরে ধীরে বউয়ের কাছে এগিয়ে এসে শাড়িতে হাত রাখল।সেই রাতটা হয়ে উঠল তাদের জীবনের সবচেয়ে আপন,সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এক রাত!যেখানে ছিল লজ্জা,এক উন্মাদ পুরুষের উন্মাদনা,ভালোবাসা আর একে অপরকে হারিয়ে ফেলার ভয় মিশ্রিত অদ্ভুত উষ্ণতা।অবাধ্য ছোঁয়ায় নববধূকে লাজে রঙিন করেছিল সেই রাতে।
আপন করে নিয়েছিল মনের গহীনে যত্নে পুষে রাখা পাখিটাকে।
••••

ভোর সকালে মুরসালীন পিটপিট করে চোখ খুললো।আধো আলোয় চারপাশটা নরম স্বপ্নের মতো লাগছিল।তার বুকের ভেতর শান্তির এক অদ্ভুত ঢেউ।কিছুক্ষণ স্থির হয়ে শুয়ে থাকল।তারপর মনে পড়ে গেল গত রাতের প্রতিটি মুহূর্ত।
মনে হতেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠল।বিশেষ করে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে রুহার লাজুক কণ্ঠে ফিসফিস করে বলা কিছু কথা যেন বারবার কানে বাজছিল।
সেই স্মৃতিতেই তার ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল।
চোখ নামিয়ে দেখল বউটা নিঃশ্বাসের স্রোতে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ঝুলে আছে।মুরসালীন হাত বাড়িয়ে আলতো করে চুল সরিয়ে দিল।তারপর নিঃশব্দে কম্বল টেনে রুহার উন্মুক্ত শরীর ঢেকে দিল।
এক হাত দিয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখল।চোখ বন্ধ করে রুহার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আজ থেকে তুই শুধু আমার।এই বুকের ভেতরেই তোর ঘর।”

খানিকক্ষণ পর রুহা ধীরে ধীরে চোখ মেলল।ঘুমের ঘোর কেটে যেতেই হঠাৎ বুঝতে পারল,সে মুরসালীনের বুকের ওপর আধশোয়া।চোখ বড়ো বড়ো করে উঠে বসতে গেল, কিন্তু মুরসালীন শক্ত হাতে টেনে আবার বুকে চেপে ধরল।

“কোথায় যাবি?”

রুহা লাজুক কণ্ঠে বলল,
“ছাড়ুন,উঠতে হবে।”

মুরসালীন ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি টেনে বলল,
“হুম, উঠবি বটে, কিন্তু আমার বউ তো কাল রাতে কত ফিসফিস করছিল।কী যেন বলছিলি?-‘আপনি এক..’”

রুহার চোখ গোল হয়ে গেল।সে কম্বল টেনে মুখ ঢাকল,
“ইশ! আপনি এসব কেন বলছেন?ভুলে যান সব।”

মুরসালীন হেসে তার কান ধরে টেনে নিল,
“ভুলবো কী করে বল? প্রতিটা কথা গেঁথে গেছে কানে।শোন,আজ থেকে প্রতিদিন তোকে লজ্জা দিবো।”

রুহা ঠোঁট ফুলিয়ে রাগের ভান করল,
“আমি কিন্তু কথা বলব না।”

“কথা না বললেও কাল রাতের মতো আবার ফিসফিস করবি।”

রুহা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে কম্বল মাথায় টেনে নিল।মুরসালীন হেসে কম্বল টেনে নামিয়ে দিলো।
“আমার বউ,তোকে লজ্জা দেওয়া আমার সবচেয়ে বড়ো সুখ।”

চলবে।

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

১৭.
রুহা গোসল সেরে রান্নাঘরে ঢুকলো।মুরসালীন খানিক্ষণ পর ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।তার নববধূ ভেজা চুলে গামছা বেঁধে ব্যস্ত হাতে রান্না করছে।গায়ের জামা খানিকটা ভিজে লেগে আছে গায়ে।হালকা সবুজ রঙের থ্রি-পিসটা যেন রুহার গায়ে একটু বেশিই ভালো লাগছে।মুরসালীন এগিয়ে গেল কাছে।চোখ তুলে চুলার দিকে তাকিয়ে দেখল,বউ তার সকাল সকাল রুটি বানানোর জন্য গরম পানি দিয়েছে।ডিম্ ভাজার জন্য সব কেটে কুটে রেখেছে।মুরসালীন বলল,

“তুই বের হো এখান থেকে,আমি করছি এগুলো।”

রুহা বলল,
“কোনো দরকার নেই।তুমি বের হও এখান থেকে।”

মুরসালীন হতভম্ব হয়ে রুহার দিকে তাকাল।কানে যেন ভুল শুনল সে।
“কী বললি?তুমি?”

রুহার হাত থেমে গেল।কখন যে মুখ দিয়ে তুমি ডাকটা বের হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।সে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“তো?আমি আপনার বউ,আপনাকে তুমি বলে ডাকতেই পারি।আপনিও বরং আমাকে তুমি বলে ডাকার অভ্যাস করুন।”

“ডেকেছি তো,কাল রাতে না তোকে তুমি বলে ডাকলাম?এরই মধ্যে ভুলে গেলি?বউ,তোর তো সৃতিশক্তি ক্ষয় হচ্ছে।”

রুহা নাক ফুলিয়ে বলল,
“আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।এসব বাজে কথা..”

মুরসালীন রুহার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“বাজে কথা?বাজে কাজ করার সময় মনে ছিল না?আসছে আমার সাধুনী।”

মুরসালীন রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।রুহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কী যেন বিড়বিড় করল।সকালে খাওয়া দাওয়ার পর মুরসালীন রেডি হলো কলেজে যাওয়ার জন্য।হাতে এখনো অনেক সময়।সে রুহাকে বলল,
“আজ থেকেই কলেজে যাওয়া শুরু কর।এমনিতেই অনেক পিছিয়ে গেছিস।”

রুহা মাথা নাড়িয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নিলো।বাসায় তালা মেরে দুজন বের হলো বাসা থেকে।কলেজ যেহেতু সামনেই তাই আর আলাদা করে রিক্সা নিতে হলো না।কলেজ আসতেই ক্লাসরুমে দেখা হলো জান্নাত আর মিথিলার সাথে।ওরা এতদিন পর রুহাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে।রুহার থেকে সব কিছু শুনে ওরা অবাক চোখে তাকাল।মিথিলা বলল,

“স্যারের সাথে তোর বিয়ে হয়েছে?তোরা আলাদা থাকিস?এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?তোর যদি বিয়েই হয়ে থাকে তাহলে নাকে নাকফুল কোথায়?”

রুহা খালি নাকে হাত বুলিয়ে বলল,
“নাক তো ফুটো করিনি।”

জান্নাত বলল,
“কলেজ ছুটির পর পার্লারে যাবি?”

“আমার কাছে তো টাকা নেই।”

“আমি দিব।আমাকে পরে দিয়ে দিস।”

রুহা মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকাল।কলেজ ছুটির পর রুহাকে টেনে ওরা পার্লারে নিয়ে গিয়ে নাক ফুড়িয়ে নিয়ে এলো।বড়ো সাদা পাথর খানা জ্বলজ্বল করছিল নতুন বধূর নাকে।

বিকেলের দিকে রুহা বাসায় ফিরল।নাকে ব্যথায় মুখটা শক্ত করে রেখেছে। খানিকক্ষণ পরেই মুরসালীন ফিরে এলো।দরজা খুলতেই চোখে পড়ল বউয়ের নাকে পাথরের মতো কিছু একটা,আর ফুলে ওঠা লালচে দাগ।নাকের কোনায় হালকা রক্ত জমাট বেঁধেছে।
সে আঁতকে উঠল।তাড়াতাড়ি ঘরে প্রবেশ করে রুহার গাল আঁকড়ে ধরে বিচলিত হয়ে বলল,
“এই মেয়ে কী করেছিস তুই?”

রুহা দাঁত চেপে কষ্ট লুকাতে লুকাতে বলল,
“বিবাহিত মেয়েদের নাক ফোড়াতে হয়।তাই পার্লার থেকে ফুড়িয়ে এসেছি।কিন্তু বাসায় ফিরে গোসল করার সময় নাকে ব্যথা পেয়েছি।”

“আমাকে না জিজ্ঞেস করে এসব কেন করলি? নাক ফুলে গেছে,সহ্য করছিস কিভাবে?”

রুহা চোখ নামিয়ে ছোট্ট করে বলল,
“এটা তো নিয়ম।করতেই হয়।আপনার বেতন হলে সবার আগে আমার নাকফুল কিনে দিবেন।”

মুরসালীন দু’হাতে রুহার গাল আঁকড়ে ধরল। চোখে আতঙ্ক-ভরা আদর।ধীরে ধীরে বউয়ের কপাল ছুঁয়ে নামিয়ে আনল ঠোঁটের কাছে।নাকের ব্যথা ভুলিয়ে দিতে আলতো করে চুমু খেল।

“সব দিব।বেশি ব্যথা করছে?”

“না।”

মুরসালীন ঘরের দরজা আঁটকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো।দেখল,বউ আগেই সব খাবার তৈরি করে রেখেছে।রুহা খায়নি বলে এক প্লেটে খাবার নিয়ে বসলো।ভাত মাখিয়ে রুহার সামনে ধরতেই রুহা ধরা গলায় বলল,

“আমার খিদে নেই।”

মুরসালীন রুহার চোখে পানি দেখে ভাবল নাকে ব্যথা করছে।সে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“গরম তেল মালিশ করে দিলে ব্যথা সেরে যাবে।”

রুহা মাথা ঝাঁকিয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল।বলল,
“আপু কল করেছিল।বাবা আম্মুর গায়ে আজ হাত তুলেছে।একজন পুরুষ মানুষ কিভাবে তার বউয়ের গায়ে হাত তোলে মুরসালীন ভাই?বাবাকে আজ বাবা বলতেও কেমন যেন লাগছে আমার।”

মুরসালীন স্তব্ধ হয়ে গেল।একহাতে রুহাকে বুকে টেনে নিলো।আজ তাদের জন্যেই ইলমা বেগম কষ্ট পাচ্ছেন,অত্যাচার সহ্য করছেন।মুরসালীন লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
“আমি দেখছি কী করা যায়।বউ,একটু খেয়ে নে আমার খুব খিদে লেগেছে।”

রুহা অল্প খাবার খেলো।মুরসালীন হাত ধুয়ে এসে বিছানায় বসলো।নাবিলের নাম্বারে কল করে জানতে পারলো নাবিল কাল রাতে সিলেটের বাইরে গেছে।মুরসালীন আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইল না।নাবিলের যেই রাগ,পরে দেখা গেলো উল্টো পাল্টা কাজ করে বসবে।সে ইলমা বেগমের ফোনে কল দিতেই কিছুক্ষণ পর রিসিভ হলো।অপাশ থেকে ভাঙা গলার শব্দ শুনে বুকটা কেমন কামড়ে ধরলো তার।

“আসসালামু ওয়ালাইকুম চাচি।”

ইলমা বেগম সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
“ভালো আছিস বাবা?”

“আল্লাহ ভালো রেখেছে।আপনার শরীর ভালো আছে?”

“হ্যা।”

মুরসালীনের হাত থেকে রুহা ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে কানে ধরে ডুকরে উঠল।
“আম্মু?কেমন আছো তুমি?”

ইলমা বেগম হুহু করে কেঁদে উঠলেন মেয়ের কণ্ঠ শুনে।রুহা জড়াল কণ্ঠে বলল,
“মা তুমি আমার কাছে চলে আসো।তোমার ঐবাড়িতে থাকতে হবে না।আপুর আর তোমার মধ্যে পার্থক্য কী বলতে পারো?”

“আমার সংসার রেখে আমি কোথায় যাব মা?”

“কীসের সংসার মা?বাবা তো এক তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তোমার গায়ে হাত তুলেছে।যা করার আমি করেছি তাহলে তোমাকে কেন এটার মাশুল দিতে হবে?”

“রাগ ভেঙে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।তুই চিন্তা করিস না।তোরা ভালো আছিস?”

“ভালো আছি মা।খুব ভালো আছি।”

মুরসালীন শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ওকে।কল কেটে গেছে।রুহা কাঁদছে।মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি বলেছিলাম,আমার হতে হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে,ত্যাগ করতে হবে।”

“আমি ভাগ্যবতী যে আপনাকে পেয়েছি কিন্তু মায়ের কী দোষ?বাবা এমন কেন মুরসালীন ভাই?”

“তোর বাবা আমার পেশা পছন্দ করেননা।তিনি চায় না আমি এই কাজ করি।বাবার ব্যবসায় হাত দিতে বলেছিলেন বহু বছর আগেই কিন্তু আমি মানা করে দিয়েছিলাম।ঠিক তখন থেকেই তোর বাবার দুই চোখের কাটা আমি।”

“আপনার জীবন,আপনি যা ইচ্ছা করবেন তাতে বাবার কী?”

“তোকে চেয়েছিলাম।”

রুহা অবাক চোখে তাকায়।
“মানে?”

“তুই তখন স্কুলে পড়তি।তোর বাবার সাথে আমার কথা হয়েছি অনেকদিন আগে।তখন আমি নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি।আমি বলেছিলাম তুই বড়ো হলে তোকে ঘরের বউ বানাবো আমি।তোর বাবা আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিল।বলেছিল তোকে বিয়ে করার মতো যোগ্যতা আমার নেই।”

রুহা চোখ বন্ধ করল।বুকের ভেতরটা ভার ভার লাগছে।মুরসালীন আর একটু শক্ত করে ধরতেই বলল,
“সত্যিই হয়তো তোকে দামি দামি জিনিস কিনে দিতে পারব না,সব সখও পূরণ করতে পারব না কিন্তু আমার সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করবো তোকে সুখে রাখার।”

#চলবে..?