#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat
২২.
রুহা মাথা নিচু করে বসে আছে বাশারের সামনে।ভেতরে ভেতরে রাগ থাকলেও তা প্রকাশ করার সাহস হচ্ছে না।বাশার নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি আমার ছোটো বোনের মতো রুহানি।সেইদিনের ব্যবহারের জন্য আমি খুবই লজ্জিত।”
রুহা বোনের দিকে তাকাল।রাইমা করুণ দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে।রুহা খুব সহজেই বুঝে গেলো বোনের চোখের ভাষা।সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মাফ করবেন ভাইয়া,আমিও সেইদিন অনেক রিয়াক্ট করে ফেলেছিলাম।আপনি যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তাহলে আশা করবো ভবিষ্যতে আর কখনো এমনটা হবে না।”
সেদিন বাশার সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাইমাকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরল।সময়ের সাথে সাথে সব কিছু আবার স্বাভাবিকও হয়ে এলো।রুহা ভার্সিটিতে ভর্তি হলো,মুরসালীন কলেজ নিয়ে ব্যস্ত হলো,রিফা নিজের জব নিয়ে আর নাবিল ব্যবসা।
জীবন বোধহয় এমনই।চোখের পলকে কিভাবে যেন দিন পেরিয়ে বছর পেরিয়ে যায় আর আমরা বুঝতে পারি না।এইতো কদিন আগে রুহা পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো দাপাদাপি করে আর এখন?বিয়ের পর ঠিক তার উল্টো হয়েছে।মুরসালীনের নির্দেশ,পড়াশোনা ঠিক রেখে যা ইচ্ছে কর আমার কোনো সমস্যা নেই।জীবনের পথ যে এখনো অনেকটা বাকি।মেয়ে বলে শুধু পড়াশোনা করে বিয়ের পর স্বামীর সংসার করলেই হবে?নিজের জীবন বলতে তো কিছু আছে নাকি?নিজের জন্য হলেও প্রত্যেকটা মেয়ের কিছু করা উচিত।মুরসালীন চায় তার বউও যেন নিজের পায়ে দাঁড়ায়।পরিবারের কাছে বুক ফুলিয়ে গর্ব যেন করতে পারে বউকে নিয়ে।
বছর পেরিয়েছে।রুহা এইবার অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী।পড়াশোনা ভালোই চলছে।আজ মঙ্গলবার।রুহা মায়ের সাথে বসে রান্নার কাজ করছে।নাসরিন বেগম বিয়েটা মেনে নিলেও রুহার সাথে তেমন একটা কথা বলেননা।
রুহা চুলায় তরকারি বসিয়ে খুন্তি নাড়ছিলো।হঠাৎ সেটা ছুড়ে মেরে দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো কমন ওয়াশরুমের দিকে।ইলমা বেগম ভয়ে আঁতকে উঠলেন।চিৎকার করে বললেন,
“এই,তোর কী হলো?”
তিনি চুলার জ্বাল কমিয়ে বের হলেন।ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দেখলেন মেয়েটা গলগল করে বমি করছে।তিনি চিন্তিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে ধরলেন মেয়েকে।ফ্রেশ করিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় এনে বসালেন।
“পেট খারাপ হয়েছে?এভাবে বমি করলি কেন?”
রুহা দুর্বল শরীর মায়ের বুকে ঠেলে দিলো।
“কয়েকদিন ধরেই শরীরটা খারাপ লাগছে মা।”
ইলমা বেগম কী যেন ভাবলেন।রুহাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রিফাকে কল করে কথা বললেন কিছুক্ষণ।সন্ধ্যায় রিফা বাড়ি ফেরার পর ইলমা বেগম রুহার ঘরে গেলেন রিফাকে নিয়ে।রুহা কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিল।ইলমা বেগম ডেকে ওঠালেন মেয়েকে।রুহা উঠে বসলো।চুল হাত খোঁপা করে বলল,
“কী হয়েছে মা?তোমরা এখন এখানে?উনি বাড়ি ফিরেছেন?”
ইলমা বেগম বললেন,
“মুরসালীনের বাড়ি ফিরতে ৭টা বাজবে।তোকে কল করেছিল,তোর ফোন নাকি বন্ধ।তারপর আমাকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে।”
রুহা বালিশ হাতড়ে ফোন বের করে দেখল সত্যি ফোন বন্ধ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি মিষ্টি করে হাসলেন।রুহা ভ্রু কুঁচকায়।রিফা রুহার পাশে বসে হাতের মুঠো থেকে একটা ছোটো প্যাকেট বের করে রুহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“যা তো চেক করে আয়।”
রুহা চমকে তাকায়।বিস্মিত চোখে রিফার দিকে তাকাতেই রিফা বলল,
“যা যা।”
রুহা আমতা আমতা আমতা করে বলল,
“মানে,এটা তো প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট।”
“তাই তো বলছি,গিয়ে একবার চেক করে আয়।”
“কিন্তু..”
“কোনো কিন্তু নয়,যা তাড়াতাড়ি।”
রুহা মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল।ওয়াশরুমের ভেতর দাঁড়িয়ে রুহার হাত কাঁপছিল।টেস্ট কিটে লাইন ওঠার অপেক্ষার সময়টা তার কাছে যেন এক যমের মতো লাগছিল।বুক ধড়ফড় করছে,মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেছে।কয়েক মিনিট যেন কয়েক ঘণ্টার মতো মনে হলো।অবশেষে স্পষ্ট হয়ে উঠলো ফলাফল।
ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে বের হলো সে।মুখটা ফ্যাকাশে,চোখে পানি জমে আছে।রিফা আর ইলমা বেগম উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
রুহা থমকে দাঁড়াল,হাতে টেস্ট কিট শক্ত করে ধরা। রিফা চিন্তিত হয়ে বলল,
“কী হলো?”
রুহা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“প..পজিটিভ!”
কথাটা বলেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু।
রিফা অবাক দৃষ্টিতে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরল।
“তুই কাঁদছিস কেন পাগলি?এটা তো খুশির খবর।”
ইলমা বেগমও কেঁদে উঠলেন মুখে আঁচল চেপে।বিড়বিড় করে বললেন,
“ আল্লাহর রহমত।”
রুহা হাত দিয়ে চোখ মুছে মৃদু স্বরে বলল,
“সবকিছু যেন হঠাৎ করে…মানে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না মা।”
ইলমা বেগম মেয়েকে আঁকড়ে ধরলেন।রিফা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।বাইরে সন্ধ্যার আজান ভেসে আসছিল।ভেতরে রুহার বুক ভরা ভয়,লজ্জা আর একরাশ অচেনা অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল।রিফা বলল,
“মা সবাইকে ডাকুন।মিষ্টি আনতে হবে তো?”
ইলমা বেগম হেসে ফেললেন।ভেজা কণ্ঠে বললেন,
“আগে বাচ্চার বাপ জানুক,তারপর সবাই জানবে।”
রাতে যখন মুরসালীন বাড়ি ফিরল ক্লান্ত শরীর নিয়ে তখন রুহা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল চুপটি করে।মুরসালীন না খুঁজেই ভেবেছে বউ ঘরে নেই।সে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে গোসল সেরে বের হলো।ভেজা জামা বারান্দায় দিতে গিয়ে দেখল রুহা দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে,এক মনে।আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে গেলো কাছে।
“এই ফাজিল,এখানে কী করছিস?”
রুহা ঘুরে দাঁড়াল।আপছা আলোয় মুরসালীনের মুখশ্রী দেখা যাচ্ছিলো।লোকটা আগের থেকেও ভার-ভার্তিক হয়েছে।রুহা উত্তর না দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুরসালীনকে জড়িয়ে ধরলো।মুরসালীন রুহার পিঠে হাত রাখল।মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“কী হয়েছে?মন খারাপ?”
রুহা ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“উহুম।”
“তাহলে এখানে এই অন্ধকারে একা একা কী করছিস?”
রুহা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এখন থেকে আমাকে তুমি বলে ডাকবেন আপনি।”
“তোকে তুই করে ডাকলে শান্তি লাগে।”
“এত শান্তি দরকার নেই।”
মুরসালীন হেসে ফেলল।বউকে হঠাৎ করেই পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল।রুহা মুখ লুকিয়ে চুপটি করে বসে আছে স্বামীর কোলে।পূর্ণিমা চাঁদ খানা যেন আজ একটু বেশি’ই সুন্দর লাগছে।মুরসালীন বাউয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আজ চাঁদটা একদম আমার বউয়ের রূপ ধারণ করেছে।চোখ ফেরানো কষ্ট।”
রুহা ঠোঁট কামড়ে হাসল।বাতাসে গরম আর শীতলতা মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করছে। রুহা বুক ধড়ফড় করতে থাকা সত্ত্বেও নিশ্চুপ বসে আছে।মুরসালীন আলতো করে হাত বাড়িয়ে রুহার থুতনি ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল।রুহা ইতস্তত করছিল,তবুও চোখের দৃষ্টি সরাতে পারল না।এক মুহূর্তের নীরবতার পর মুরসালীন ধীরে ধীরে বউয়ের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল।সেই চুমু ছোটো থেকে বড় হতে লাগল,সময় যেন থমকে গেলো।রুহার বুক কেঁপে উঠল,অনুভূতি বেসামাল হয়ে যাচ্ছিল। অজান্তেই হাত রেখে দিল মুরসালীনের বুকে, তারপর হালকা শক্তি দিয়ে ওকে আটকাতে চাইল।
মুরসালীন হেসে ফেলল,নরম স্বরে বলল,
“কি হলো?পালাচ্ছিস কেন?কাছে আসবি না?”
রুহা লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলল,
“পালাচ্ছি না কিন্তু…”
“কিন্তু?”
রুহা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।তারপর সাহস সঞ্চয় করে মাথা তুলল।মুখ লাল হয়ে গেছে, গলা শুকিয়ে এসেছে।লজ্জায় গলা দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না।
“আপনাকে একটা কথা বলার আছে আমার।”
মুরসালীন কৌতূহলী হয়ে ভ্রু উঁচাল।বউয়ের কাঁপা কণ্ঠে ভয়-লজ্জার মিশ্রণ স্পষ্ট।সে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বল,আমি শুনছি।”
রুহা চোখ ভিজে আসা সত্ত্বেও দৃঢ় গলায় বলল,
“আমি…আমি…”
“তুই?”
“আমি প্রেগন্যান্ট।আপনি বাবা হতে চলেছেন।”
কথাটা বলেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।মুরসালীনের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল।মনে হচ্ছিল যেন কোনো ঝড় শুরু হবে।কিন্তু ঝড় নয়, বরং এক গভীর নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল বারান্দাজুড়ে।
অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন মুরসালীনের কোনো স্বারা-শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল তখন রুহা ভীতু চোখে মাথা উঁচিয়ে তাকাল মুরসালীনের দিকে।মুরসালীন পাথরের মতো বসে আছে।রুহার ভয় হলো।মিনমিন করে বলল,
“আপনি খুশি হননি?আপনি না চাইতেন আমাদের মাঝে কেও আসুক?আল্লাহ তো আমার গর্ভে সন্তান দিয়েছেন।”
রুহা মুরসালীনের চোখের দিকে তাকাল।চোখ পানিতে টলমল করছে।খুশির পানি এটা?রুহা অস্থির হলো চিন্তায়।দুহাত দিয়ে মুরসালীনের মুখ আঁকড়ে ধরতেই মুরসালীন চোখ বন্ধ করে ফেলল।শক্ত করে রুহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে এলোমেলো চুমু খেল শরীর জুড়ে।রুহা থমকায়,হকচকিয়ে যায় এহেন কাজে।মুরসালীনের কণ্ঠে স্পষ্ট কাঁপন।সে রুহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি বাবা হব রুহা?তোর গর্ভে আমার সন্তান,আমার রক্ত।”
মেয়েটার লজ্জা লাগলেও কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি আঁকড়ে ধরেছিল।মুরসালীন পাগলের মতো হাজারটা কথা বলেই যাচ্ছিল।রুহা অবাক হয়ে শুধু সব কথা শুনছিল।বাড়ির মানুষ সবাই জানল,খুশিতে এক একজন আত্মহারা।নাসরিন বেগমও যেন আর নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারলেন না।রুহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন মন ভরে।মিষ্টি এনে আগে আত্মীয়দের বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো হলো।পাড়ায় বিলিয়ে দেয়া হলো।সবাই জানল,মুরসালীন বাবা হবে আর রুহা মা।
নাসরিন বেগম যেখানে বিয়েটা মেনে নেননি বছর পেরিয়ে গেলেও সেই তিনি’ই সবার থেকে বেশি খুশি হয়েছেন।
#চলবে..?