#তুরাগের_শ্যামলা_ঢেউ
#পর্বঃ৬
#Jhorna_Islam
অসময়ে যাদের বাড়িতে আসার কথা ও না তাদেরকে বাড়িতে দেখলে অবাক হওয়ারই কথা। ঢেউ কেমন রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে সামনের দিকে তাকিয়ে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে,বা তার কি বলা উচিৎ কিছুই মাথায় ঢুকছে না। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার দেখে মাথা যেনো হ্যাং হয়ে আছে।
প্রিন্সিপাল স্যার আর ঢেউয়ের বাবা মিলে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। হুহা হাসির শব্দে পুরো বাড়ি এখন মুখরিত। ঢেউ চোখ বড় বড় করে তাকায়। স্যার এমন হাসতে পারে জানা ছিলো না সবসময় ঢেউ স্যারকে চুপচাপ আর গম্ভীর স্বভাবের দেখে এসেছে আর আজ কিনা সেই লোক পুরো বাড়িতে হাসির ঝংকার তুলেছে আশ্চর্য বিষয়।ঢেউ লক্ষ করলো কলেজের স্যার আর এখনের স্যারের মধ্যে হাজারগুণ তফাৎ। আর ঢেউয়ের বাবা? সে আর কম যায় কিসে।ঢেউয়ের বাবাকেও অনেক দিন পরে এমন করে হাসতে দেখলো।শুধু মাত্র বন্ধুদের সাথেই তিনি এমন করে হাসাহাসি করে। এদের দেখে মনে হচ্ছে এরা কতো জনমের পরিচিত। ঢেউয়ের মা একটু পর পর এটা ওটা খাবার এনে দিচ্ছে আর দুইজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। রান্না ঘরে গেলে এদের হাসির শব্দ শোনা যায়। কি জানি বলেও তবে বুঝতে পারে না কিন্তু উনি এলেই দুইজনে চুপ হয়ে যায়। মনে হচ্ছে জানতে পারলে বিপদ হয়ে যাবে।
ঢেউ তখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার স্যার দেখে বলে আরে ঢেউ যে কাম কাম।
স্যারের ডাকে ঢেউ শুকনো ঢুক গিলে। চুপচাপ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
“কি হলো? স্যার তোমাকে ডাকছে শুনতে পাওনি নাকি? আসছো না যে।”(ঢেউয়ের বাবা বলে)
ঢেউ এগিয়ে আসে।
ঢেউয়ের বাবা চোখের ইশারায় বসতে বলে। ঢেউ চুপচাপ বসে থাকে।
সামনের টেবিলে রাখা খাবার দেখিয়ে স্যার বলে নাও খাও। ঢেউ আমতা আমতা করে, খেতে ইচ্ছে করছে না তার।বাবা আবারও ইশারা করে বলে খাওয়ার জন্য ঢেউ তারাতাড়ি কিছু একটা নিতে গিয়ে স্যারের জন্য বানানো কফির কাপ মুখে নিয়ে চুমুক বসিয়ে দেয়।
ঢেউয়ের কর্মকান্ডে ঢেউয়ের মা চোখ বড়সড় করে তাকায়। প্রিন্সিপাল স্যার হেসে বলে সমস্যা নাই বাচ্চা মানুষ। ওরা এসব না করলে কে করবে? বরং ওদের এসব কাজ দেখলে আমার আনন্দ হয় জুয়ান বয়সের কথা মনে হয়।
ঢেউয়ের বাবা আর স্যার মিলে আবার গল্প শুরু করে দেয়। ঢেউ আর তার মা এখন নীরব দর্শক। তারা হাসলে তাদের মুখের দিকে তাকানোই যেনো ঢেউ আর তার মায়ের একমাত্র কাজ।
প্রিন্সিপাল স্যার আর ঢেউয়ের বাবার আড্ডা থামে ঠিক বারোটা দশে, মাঝখানে আবার ডিনার সারা হয়েছে। ঢেউয়ের বাবা অনেক করে জোর করলো থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু উনি থাকবেন না।
যাওয়ার আগে ঢেউয়ের বাবাকে বলে গেলেন,,,,
” ভাইসাব আমার থাকা নিয়ে এতো টেনশন করতে হবে না। মাত্র শুরু কতো এসে থাকবো। এখন বলছেন থাকতে পরে বলবেন কি নির্লজ্জরে বাবা দুই দিন পরে পরে এসে পরে। ”
“মোটেও এসব বলবো না ভাইসাব। আপনি এসে থাকলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না। ”
“তা আমি জানি। আচ্ছা তাহলে আসি।খুব শিগগিরই দেখা হচ্ছে কিন্তু। ”
“অবশ্যই ভাইসাব।”
“ঢেউ মামনি আসি ভালো থেকো। ভাবি গেলাম অনেক কষ্ট দিয়ে। ”
“না না কি বলেন এসব? আবার আসবেন।” সৌজন্যে মূলক হাসি হেসে বলে ঢেউয়ের মা ।
স্যার চলে যায়। ঢেউয়ের বাবা দরজা লাগিয়ে দেয়। ঢেউয়ের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,, “রুমি আসো আমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। গলাটা কেমন গম্ভীর শুনালো ঢেউয়ের কাছে। এতোকিছু নিয়ে ভাবলো না সে রুমে চলে যায় ঘুমোতে আবার ঘুমে ধরেছে তার।
*****
কয়দিন পরই এডমিশনের যুদ্ধ শুরু হবে, ঢেউ আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু পরতে বসবো বসবো করে আর বসছে না। এদিকে সময় তো আর তার জন্য বসে থাকে না। সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকে। ঢেউয়ের একটা স্বভাব সবকিছুতে সে ঢিলে কিন্তু একবার শুরু করলে ঐটা না হওয়া পর্যন্ত থামে না। সেই শুরু করতেই তার দেরি।
আগামীকাল থেকে পাক্কা পড়তে বসবে। বসবেই বসবে এর আর কোনো হেরফের হবে না। খাতায় লিখে রেখেছে পড়তে বসবে সে। আগামীকাল আর কেউ তাকে আটকাতে পারবে না। এটা নিয়ে ফেসবুকে ও পোষ্ট দিয়ে এসেছে,, ” আগামীকাল থেকে যদি আমি পড়তে না বসি তাহলে আমাদের বুড়িগঙ্গার পঁচা পানি খাই।” এই নিয়ে পোষ্টে হাহা রোল পরে গেছে। ঢেউ নিজেও এই নিয়ে খুব হাসলো।মেসেঞ্জার গ্রুপে এই নিয়ে অনেক পঁচাচ্ছে তাকে। ঢেউ ঐসবে পাত্তা দেয় না তার কাছে ভালোই লাগছে।
আজ দুই দিন ধরে তুরাগের সাথে কথা হয় না ঢেউয়ের। মনটা খারাপ তবে পাত্তা দিচ্ছে না কারণ তুরাগ বলে গেছে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছে। দুই দিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবে। ঢেউ জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে দুই দিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবে কিন্তু ঢেউ জিজ্ঞেস করার আগেই তুরাগ বলে,,এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমি এসে সব আপনাকে বলবো। আপাতত ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন এই কামনাই করি।আল্লাহ হাফেজ। তুরাগের দেওয়া লাস্ট মেসেজ ঢেউ অগনিত বার পরেছে।
আজও খুব ইচ্ছে করছে তুরাগের সাথে কথা বলতে কিন্তু তুরাগ লাইনে নেই। ঢেউ ভাবলো লাইনে নেইতো কি হয়েছে? ঢেউয়ের মেসেজ দেওয়ায়তো আর মানা নেই। সে মেসেজ দিতেই পারে।
“কেমন আছেন তুরাগ? কি করছেন এখন? খেয়েছেন আপনি? আচ্ছা আমার কথা কি আপনার একবারও মনে পরছে না? তারাতাড়ি ফিরে আসেন তুরাগ। মিস ইউ। ”
মিস ইউ লিখলেও মনে মনে হাজার বার আই লাভ ইউ বলা হয়ে গেছে তুরাগকে শুধু মুখে বলতে পারছে না। তবে ঠিক করে নেয় এবার বলবে। তুরাগ ফিরলেই তার মনের কথা বলে দিবে। এভাবে আর মনের ভিতর লুকিয়ে রেখে নিজেকে কষ্ট দিবে না। যা হওয়ার হবে।
ঢেউ আবার মেসেজ দেয়,,, “তারাতাড়ি ফিরে আসুন তুরাগ আপনাকে একটা কথা বলার আছে। ”
মোবাইলটা বিছানার একপাশে রেখে ঢেউ চোখ বন্ধ করে। ঘুম পাচ্ছে তার। এখন ঘুম দিবে আর কাল আটটার আগে উঠবে না।
ঢেউয়ের যখন চোখ লেগে আসে তখন তার মা ডাকতে থাকে।
“ঢেউ এই ঢেউ কই তুই, ঘুম থেকে তারাতাড়ি উঠ।ঢেউ শুনতে পারছিস?”
“ঢেউ ঘুমের ঘোরে বলে মাত্র ঘুমালাম এতো তারাতাড়ি সকাল হয়ে গেলো?”
” ঢেউ মা উঠ তোর বাবা যেনো কেমন করছে। ” কান্না করতে করতে বলেন উনি।
ঢেউ হন্তদন্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে। হাত পা কেমন কাঁপছে তার। দরজার অপর পাশ থেকে তার মা দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কান্না করছে। এক মিনিট ও দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
“উঠেছিস তুই দেখ মা তোর বাবা কেমন করছে। বুকটা নাকি খুব ব্যাথা করছে। আয় একটু আমার খুব ভয় করছে। ”
ঢেউ দৌড়ে বাবার রুমে যায়। রুমে শুয়ে ব্যাথায় তিনি গোঙ্গাচ্ছে।
“বাবা কি হয়েছে তোমার এমন করছো কেনো?
এই বাবা কথা বলো।খুব খারাপ লাগছে? ”
ঢেউয়ের বাবা ব্যাথায় কথা বলতে পারছে না। মাথা নাড়িয়ে জানায় খারাপ লাগছে।
এতো রাতে কি করবে বুঝতে পারছে না।
তারউপর একজন ছেলে মানুষ নেই। বিপদের সময় মাথা কাজ করে না। ঢেউয়ের মা কান্না করে করেই বেহুঁশ।
হুট করেই ঢেউয়ের মাথায় আসে পাশের ফ্লাটে একজন ডাক্তার আংকেল আছে। মাকে বলে দৌড়ে সেখানে চলে যায়। গিয়ে কয়েকবার কলিংবেল বাজায় কিন্তু দরজা খুলে না। ঢেউ এবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকে,,, “আংকেল, আংকেল দরজাটা খুলুন।আংকেল শুনতে পারছেন? ”
মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলে। চোখে চশমা পরতে পরতে বলে,,,কি হয়েছে মা এতো রাতে এখানে?
“আংকেল একটু আমার সাথে আসুন।”
“কোথায়?
” আমাদের ফ্লাটে। বাবা যেনো কেমন করছে আংকেল একটু আসুন না।”
“বলো কি দাঁড়াও এক মিনিট আসছি ” কথাটা বলেই উনি রুমে চলে যায়।
মিনিট দুয়েক পরে একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে।
“চলো, চলো।”
ঢেউয়ের বাবাকে ভালো করে চেক-আপ করে বলেন,,,,উনাকে এখনই হসপিটালাইজড করতে হবে। অবস্থা খুবই আশংকাজনক। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে।
ঢেউ আর তার মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে ডক্টর নিজেই এম্বুলেন্স কল করে। ঢেউয়ের বাবাকে নিজ দায়িত্বে হসপিটালে এডমিট করিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। ডাক্তাররা দেখে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসা শুরু করে দেয়। সকালে জানায় আপাতত ঢেউয়ের বাবার অবস্থা আশংকা মুক্ত। উনাকে কেবিনে দেওয়া হয়। একটা নার্স এসে জানায় উনি উনার মেয়ে আর ওয়াইফকে ডাকছেন।
ঢেউয়ের মা ওয়াশরুমে গেছেন ঢেউ আর অপেক্ষা করে না বাবার সাথে দেখা করতে দৌড়ে চলে যায়।
কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হয় দুইজনের। চোখের ইশারায় ঢেউ কে ডাকেন উনি।
ঢেউ এক ছুটে বাবার কাছে গিয়ে হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পরে।
“ব- ব-বাবা!” কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না ঢেউ।
“আমি ঠিক আছি মা।” ক্লান্ত গলায় বলে ঢেউয়ের বাবা। এ কথা শুনার পরও ঢেউয়ের কান্না থামে না। থামবেই বা কি করে? কালকে রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনের উপর প্রচন্ড ভাবে গেঁথে গেছে তার।
#চলবে?