তুরাগের শ্যামলা ঢেউ পর্ব-০৮

0
15

#তুরাগের_শ্যামলা_ঢেউ
#পর্বঃ৮
#Jhorna_Islam

পৃথিবীর সব অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস বুঝি ঢেউয়ের সাথেই ঘটার জন্য তৈরি হয়েছে। এই যে দুই হাত ঘুমটা দিয়ে নতুন বউ সেজে বসে আছে এটাতো একটু আগেও সে কল্পনায় ও ভাবেনি। জীবন তাকে সবচেয়ে বড় চমক দিয়ে গেলো আজকে। জীবনের সব আশা সব স্বপ্ন নিমিষেই মিশে গেলো। নিজেকে এখন একটা জীবন্ত পুতুল মনে হচ্ছে। সকলে সুতো ধরে টান দিয়ে দিয়ে ইশারা করছে আর সে সেই অনুযায়ী নেচে চলেছে। আহ্ জীবন আহ্।আজকের দিনটা ঢেউয়ের জীবনে না এসে মরণ আসলেও সে সাদরে গ্রহন করে নিতো। ঢেউয়ের মন বারংবার চিৎকার করে বলছে আল্লাহ কেন আমার সাথে এমন হলো? আল্লাহগো আমার সব শেষ হয়ে গেছে। বাবা মা কি করে এমনটা করতে পারলো? যেই বাবা একটা জামা কিনে আনলেও তার পছন্দকে প্রাধান্য দিতো সেই বাবা আজকে বিয়ের মতো এতো বড় একটা ডিসিশন তাকে না জানিয়ে অনায়াসে কি বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। বাবা একটা বার জিজ্ঞেস করতো ঢেউ কি চায়, অন্তত তাকে জানাতে পারতো। নাহ্ আর ভাবতে পারছে না কিছু। মাথা হ্যাং হয়ে আছে।

রুম ভর্তি মানুষজন বসে আছে। সকলেই গল্প গুজব নিয়ে ব্যস্ত। ঢেউ সেখানে রোবট। ঢেউয়ের মনে এখন উদ্ভট ইচ্ছে জাগছে আচ্ছা সে যদি দু তলার বারান্দা থেকে লাফ দেয়? নানা এটা সে পারবে না।
একটা কাজ করা যায় সকলে যখন চলে যাবে চুপিচুপি সে তুরাগের কাছে চলে যাবে। হ্যা এটাই করবে সে।তুরাগের কাছে চলে যাবে। একজন অচেনা, অজানা, অপরিচিত লোকের সাথে সে থাকবে না। থাকতো তাও যদি তার কেউ না থাকতো।কিন্তু সে-তো তুরাগকে ভালোবাসে। তার তুরাগ আছে। আচ্ছা তুরাগ কি তাকে মেনে নিবে? কেনো মেনে নিবে না এতে তো তার কোনো দোষ নেই। সকলে ধরে বেঁধে একটা লোকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে তাকে। এই অপরিচিত লোককে ঢেউ কখনো মেনে নিবে না। এতে যা হওয়ার হবে।
ঢেউ আর কিছু ভাবতে পারছে না মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। উফফ!

*******
ঢেউ খাবার টেবিলে পায়েস দিতে গিয়ে চমকায় নাতবউ শুনে। মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকায়।
ঢেউকে অবাক হতে দেখে বয়স্ক লোক তখন হেসে বলে,,,,,কি ব্যাপার নাত বউ আমার ডাক শুনেই এই অবস্থা? আমার নাতিকে দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবে না তো আবার?

“ন– নাত– ব–উ,ন–নাতি?” কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করে ঢেউ।

ঢেউয়ের মা সকলের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,,,আসলে ওকে কিছু জানানো হয়নিতো এজন্য।

“ব্যাপার না বলে হাসে প্রিন্সিপাল স্যার।”
সকলেই ঢেউকে খেয়ে নিতে বলে। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। কি করে খাবে ঢেউ? এখন কি তার গলা দিয়ে এক লোকমা ভাত ও নামবে? সে তো এখন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তলে তলে সকলে এতকিছু করে ফেলেছে অথচ তাকে কিছু জানায়নি। আর নিজের মাথাতেও আসেনি এমন কিছু।

ঢেউ ঐদিন রাতে আর খেতে পারেনি। বাড়ির কারোর সাথে কোনো কথা ও বলেনি। পরের দিন এই নিয়ে বাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়। ঢেউ রাগারাগি করে সে এখন বিয়ে করবে না। বাড়িতে কারণ জানতে চাইলে চুপ হয়ে যায় কিছু বলতে পারে না। তুরাগের কথা চেয়েও বলতে পারে না কারণ এখনও নিজের মনের কথা তুরাগকে বলতে পারেনি। তুরাগ যদি ঢেউ কে ভালো না বাসে তখন। দু-টানায় পরে আছে ঢেউ। এদিকে তুরাগকে কল দিয়ে ও পাচ্ছে না। ঢেউ বুঝতে ও পারেনি ঐদিন সন্ধ্যায়ই তার জীবনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে। একটা অপরিচিত পুরুষের সাথে নিজের নাম সারাজীবনের জন্য জুড়ে যাবে । বাবা নামক ব্যক্তি তাকে এমন ফাঁদে ফেলবে । হ্যা ফাঁদই তো এটা। এই যুগে এসেও বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ইমোশনাল ব্লেকমেইল করে ধরে বেঁধে অন্যের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।

অনেক কষ্টে তুরাগের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে ঢেউ। তুরাগের সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করার জন্য বলে,কিন্তু তুরাগ শুধু কাজের দোহাই দেয়। অনেক কাকুতি মিনতি করে ঠিক করে নেয় পরের দিন শুক্রবার দেখা করবে। ঢেউ তুরাগের সাথে দেখা করে সব বলবে। তারপর বাড়িতে এসে তুরাগের কথা জানাবে যদি মানে তাহলে ভালো নয়তো সে তুরাগের সাথে পালিয়ে যাবে। ভালোবাসা ছাড়া সে থাকতে পারবে না। কিন্তু দেখা করার সুযোগ পাচ্ছে না ঢেউয়ের মামাতো বোন সারাক্ষণ তার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। এটা যে বাড়ির সবার কারসাজি ঢেউ খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। কিন্তু ঢেউ ও কম না আজ যে করেই হোক দেখা করবে। জীবন মরনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঠিক মতো না খেয়ে, না ঘুমিয়ে খুব দূর্বল হয়ে গেছে শরীর টা। চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। ঢেউ চেয়েও খুলে রাখতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বিকাল হতে আরো কয়েক ঘন্টা আছে। ঢেউ ভাবলো একটু ঘমিয়ে নিই তাহলে শরীর টা ও ভালো লাগবে। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঢেউ ঘুমে তলিয়ে যায়।
ঘুম ভাঙে হৈচৈ করার শব্দে। বাসায় মনে হয় অনেক লোকজন এসেছে সকলের কথার আওয়াজে ঢেউয়ের ঘুম ভাঙে। আড়মোড়া ভেঙে বসে বালিশের পাশে ফোন খোঁজে পায় না। ব্রু কুঁচকে আসে তার,ফোন কোথায় গেলো? পুরো বিছানায় খুঁজেও ফোন পায় না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়টা বাজে? তারাতাড়ি উঠে ড্রয়িংরুমে যায় দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় সন্ধা ছয়টা বেজে গেছে। ফোনের কথা ভাবতেই তাকিয়ে দেখে ঢেউয়ের মামাতো ভাই রিশাব তার ফোনে গেমস খেলছে। ঢেউয়ের মেজাজ গরম হয়ে যায়, এগিয়ে গিয়ে টান দিয়ে ফোন ছিনিয়ে নেয়। ঢেউ কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখতে পায় তার বান্ধবী ইমা আর নিশি তার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

“ত-তোরা?”

“হেহেহে সব কথা পরে হবে। বেশি সময় নেই হাতে চলচল সাতটা বেজে যাচ্ছে। ” বলেই ইমা আর নিশি টানতে টানতে রুমে নিয়ে যায়।

সকলে মিলে জোরজবরদস্তি করে ঢেউ কে তৈরি করে। ঢেউ কিছু বলতে চায় পাত্তাই দিচ্ছে না। এদিকে বাড়ি ভর্তি লোক এতো লোকের সামনে কিছু বলতেও পারছে না সে।

বাবার জন্য আজ নিজের জীবন অচেনা ব্যক্তির সাথে চিরদিনের জন্য বেঁধে গেলো। বাবা সুইসাইড করার হুমকি দিয়ে ঢেউকে বাধ্য করলো এই বিয়ে করতে। বাবার উপর এক আকাশ সমান অভিমান জমেছে ঢেউয়ের। সে আর কোনোদিন বাবার সাথে কথা বলবে না। বাবা তার কথা একটি বার ভাবলো না সেও ভাববে না আর। ঢেউয়ের কাছের সকলে তার সাথে বেঈমানী করলো। কেউ তার আপন না কেউ না।

ঢেউয়ের ভাবনার অবসান ঘটে তার মামির নিয়ে আসা খবরে। বর নাকি ইমার্জেন্সি কাজে চট্টগ্রাম চলে গেছে। আজকে ঢেউ কে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হচ্ছে না। আপাতত সকলের ডিসিশন ঢেউ এখানেই থাকবে। এসব শুনেও ঢেউয়ের কিছু যায় আসে না । এতোদিনের নিজের মনে করা বাড়িটাও এখন নিজের লাগছে না। আর না লাগছে এই মানুষগুলোকে নিজের। এখান থেকে পালাতে পারলে ঢেউ বাঁচে। সে ঠিক পালিয়ে যাবে। দরকার পরলে কাজ করে খাবে যদি তুরাগ তাকে মেনে না নেয় তবুও এখানে থাকবে না আর না ঐ অদেখা, অচেনা, অজানা লোকের সাথে সংসার করবে।

পরের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে। ছোট্ট একটা ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় অল্প কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। সকলে ঘুম থেকে উঠার আগেই ঢেউ চলে যাবে এখান থেকে।

টিপটিপ করতে করতে ঢেউ এগিয়ে যায় মেইন দরজার দিকে। আশেপাশে ভালো করে দেখে নেয় কেউ আছে নাকি। আস্তে করে মেইন দরজা খুলতেই পিছন থেকে আওয়াজ আসে,,, “কোথায় যাচ্ছো?”

#চলবে?,,,