তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-১+২

0
18

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব -১

****
তখন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। পাঁচ বছরের ছাত্র অঙ্কন কে পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল রিদিমা। এক হাতে কলেজ ব্যাগের ফিতে খানা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে অপর হাতে সালোয়ার তুলে কোনো মতে জলকাদা মাড়িয়ে হাঁটছিল সে। গ্রীষ্মের দাবদাহ কমিয়ে বেশ কিছুদিন হলো বর্ষার আগমন ঘটেছে ধরণীতে। তাইতো ধরিত্রীমাতার দেহে শীতলতা ছড়িয়ে দিতে বেশ কিছুক্ষণ আগেই এক চোট বৃষ্টির আগমন ঘটেছিল। তাতেই পথ ঘাট থৈথৈ করছে।
দূরে দন্ডায়মান স্ট্রিট লাইটের ম্লান আলোতে রাস্তাঘাট ঈশদ অস্পস্ট। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সড়কের ভাঙা জায়গা গুলোতে জল জমে একাকার। রিদিমা নিজের মতো করে হাঁটছিল আনমনে। ঠিক তখনই তাকে নোংরা জলকাদায় আপাদমস্তক স্নানাভিশেক করিয়ে একটা সাদা রঙের চার চাকার গাড়ি প্রবল গতিতে ছুটে বেড়িয়ে গেল উল্টো দিকে।

রিদিমা কাদায় মাখামাখি হয়ে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আস্তে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল সাদা গাড়িটা সামনের গলির মোড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। রিদিমা সেদিকে তাকিয়ে রাগে দুঃখে ফুঁসে উঠলো। মনের আয়েশ মিটিয়ে বেশ কতকগুলো দেশি গালি ছুঁড়ে ওই অবস্থাতেই হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে।

গলির মোড়ে বাক নিয়ে একটা পাঁচ তলা আবাসনের সামনে এসে দাঁড়ালো সাদা রঙের মার্সিডিজ গাড়িটা। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই গাড়িটা পার্ক করে হাতে অফিস ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রিমলেস চশমা পরা এক সুদর্শন যুবক। দারোয়ান তাকে সেলাম ঠুকলো,
“ সালাম সাহেব!”
সে মুখে জবাব দিলো না বরং তাকে উপেক্ষা করে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল লিফ্ট এর কাছে। লিফ্ট এসে দাঁড়ালে তড়িঘড়ি ফিফথ ফ্লোর এর বাটন চেপে ধরলো।

ছোট্ট সায়ন কাঁদতে কাঁদতে সবে মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে মিসেস চিত্রা সবে মাত্র পিঠ এলিয়ে দিয়ে ছিলেন বিছানায় ঠিক তখনই কলিং বেলটা শব্দ করে বেজে উঠলো। বাতের ব্যথার জর্জরিত ভারী শরীরটা টেনে নিয়ে কোনো মতে উঠে বসার ঘরে আসতেই দেখলেন কাজের মেয়ে চুমকি দরজা খুলে দিয়েছে। সমর সু র‍্যকে জুতো জোড়া খুলে রাখতে রাখতে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ সায়ন কোথায় মা? কোথায় লেগেছে ওর?’

মিসেস চিত্রা ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। সন্তানের চিন্তায় বেচারার মুখটায় আধাঁর ছেয়ে গেছে। তাকে খানিক স্বস্তি দিতে বললেন,
‘ দাদুভাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় আমি তোর কফি বানিয়ে আনছি।’

‘ তুমি কিন্তু আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছ মা।’

‘ কিচ্ছু হয় নি ওর! ও ঠিক আছে।’

‘ আমি ফোনে স্পষ্ট সায়নের কান্নার আওয়াজ শুনেছি। আমার সায়ন এমনি এমনি কাঁদে না। নিশ্চয়ই ও ব্যথা পেয়েছে। সত্যি করে বলোতো কি লোকাচ্ছ তোমরা!’

মিসেস চিত্রা ছেলের কথায় খানিক নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। ওদিকে চুমকির মুখ খানাও শুকিয়ে প্রায় রক্তশূন্য হয়ে গেছে। সমর হাতের ব্যাগ খানা সোফার উপর রেখে কোমরে দুহাত চেপে দাঁড়ালো। চোখ মুখের অভিব্যাক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ রেগে আছে।

‘ কি হলো জবাব দিচ্ছ না কেন?’

মিসেস চিত্রা ছেলেকে আর ঘাটাতে চাইলেন না অথচ সত্যিও বলতে মুখে আটকাচ্ছে। সমর রাগী দৃষ্টিতে চুমকির দিকে তাকালো। বেচারী ভয় পেয়ে হড়হড় করে বলতে আরম্ভ করলো আজকে সন্ধ্যায় ঘটা ঘটনা টুকু…

তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটার থেকে সামান্য একটু বেশি বাজে। গোটা আকাশ ঢাকা পড়েছে গুম ধরা মেঘের আড়ালে। পরিবেশে থমথমে গুমোট ভাবটা স্পষ্ট। সেই সাথে গায়ে জ্বালা ধরানো ভ্যাপসা গরমে দমবন্ধ হবার জোগাড়। সায়ন তৃতীয় তলার শৌভিক বাবুর ছেলে অঙ্কনের সাথে চুটিয়ে খেলা করছিল। ঠিক তখনই তাদের বাড়িতে অঙ্কনের টিউটর ম্যাডাম আসে তাকে পড়াতে। অঙ্কনের মা টিউটর এসেছে দেখে ওদের খেলা বন্ধ করে দিয়ে অঙ্কন কে জোর করে পড়তে বসিয়ে দেয়। আর সায়নকে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলে। কিন্তু সায়ন কিছুতেই আসতে চায় না। অঙ্কন কে পড়তে বসতে দেখে বায়না ধরে সেও ওই ম্যাডামের কাছে পড়বে। কিন্তু অঙ্কনের মা কিছুতেই রাজি হয় না। বরং সায়ন কে জোরে ধমক দিয়ে ওঠে। ব্যাস, সেই ধমক খেয়ে সন্ধ্যে থেকে এই রাত পর্যন্ত বেচারা ভয়ে কেঁদেছে।

সমস্ত ঘটনাবলি শোনা মাত্রই রাগের ক্রোধাগ্নিতে সমরের মস্তিষ্কে আগুন জ্বলে ওঠে। গোটা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে রোষানলের উত্তাপ। মানুষ আসলেই এতোটাও নির্দয় হতে পারে বলে ওর ধারণায় ছিল না। একটা চার বছরের বাচ্চা কে কীভাবে ধমকাতে পারে কেউ? আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় তৃতীয় তলার উদ্দেশ্যে।

রাত সাড়ে আটটায় স্টার জলসার পর্দায় আসা ডেইলি সিরিয়াল টা মিতালীর খুবই পছন্দের। সোফায় বেশ আয়েশ করে বসে রিমোট হাতে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ইন্টিরিয়র ডিজাইন করা ওয়ালজুড়ে আটকানো ছত্রিশ ইঞ্চি টিভির দিকে।পাশেই ফ্লোরে বসে একটা রিমোট কন্ট্রোল টয় ট্রেন নিয়ে একমনে খেলা করছে অঙ্কন। আজকের এপিসোডটা ভীষণ ইম্পর্টেন্ট। ভিলেন শাশুরির আসল রূপ ফাঁস করবে তার বৌমা যাকে সে এতো দিন ধরে বাড়ির সবার নজরে খারাপ বানিয়ে রেখেছিল। কাট কাট উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ তার কাঁপছে। সমস্ত প্রমাণ নিয়ে নায়িকা ঢুকে পড়েছে সবার সামনে….… ঠিক তখনই কাবাব মে হাড্ডি হয়ে কলিং বেলটা বেজে ওঠে। মিতালী ভীষণ বিরক্ত হয়। এই সময় সাধারণত কেউ আসেনা। শৌভিকের ফিরতেও রাত সাড়ে নয়টা বেজে যায়। একবার ভাবলো উঠবেনা। কিন্তু তাকে আরও বিরক্তিতে ফেলে আবারো কলিং বেলটা বেজে ওঠে। মিতালী ভীষণ অস্বস্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ‘জাস্ট রিডিকুলাস’ বলে সোফা ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়।

মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে অপেক্ষামান সমর। ক্রমাগত হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িতে নজর বোলাচ্ছে। ঠিক তখনই দরজার কপাট খুলে বেরিয়ে আসে মিতালী। সমর মিতালীকে দেখে মনে মনে রাগ সামলে কথা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। মিতালী দরজা খুলে টপ ফ্লোরের প্রতিবেশী সুদর্শন যুবক কে দেখে একদম অবাক। সাথে সাথেই কিছুক্ষন আগে সিরিয়াল দেখার মাঝে ডিস্টার্ব করার জন্য যে অস্বস্তি চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল মস্তিষ্কে সেটাও ভাঁটা পড়লো মুগ্ধতার আড়ালে। মুখে অমায়িক তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে মিতালী বলে উঠলো,

‘ আরে সমর বাবু আপনি। ভেতরে আসুন না প্লীজ।’

সমর মিতালীর মিষ্টি ব্যবহারে খানিক দমে এলো। মহিলাদের সাথে সে ততটাও কমফোর্টেবল নয়। রাগের মাথায় চলে এলেও এখন বুঝতে পারছে তার এভাবে আসাটা একদমই উচিত হয় নি। তবুও এসেই যখন পড়েছে কাজটা করে ফেরাই যুক্তিসঙ্গত ভেবে গলায় বাঁধা টাইয়ের নট খানা ঢিলে করে বলল,
‘ না না ভেতরে যাবো না। আসলে আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিল!’

ওর সাথে কথা বলতে এসেছে শুনে মিতালীর যেন সীমা ছাড়ালো বিস্ময়। মন কেমন করা একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়ালো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুখে অমায়িক হাসি এনে বলল,
‘ অ্যা, আমার সাথে কথা!
তা বেশ তো ! ভেতরে আসুন না! একসাথে কফি খেতে খেতে না হয় আপনার কথা গুলো শুনবো।’

মিতালীর অতিরিক্ত আতিথেয়তায় রীতিমত বিরক্ত বোধ করলো সমর। তবুও ভদ্রতার খাতিরে ভেতরে গিয়ে বসলো। মিতালী টিভি অফ করে দিয়ে বলল,
’ আপনি কেমন কফি খেতে পছন্দ করেন? ব্লাক ওর মিল্ক?’

‘ প্লীজ মিসেস বাগচী! এসবের দরকার নেই। আমি জাস্ট দুটো কথা বলতে এসেছি। বলেই চলে যাবো। আপনি কাইন্ডলি বসুন!’

সমরের এবারের কথায় চড়া মেজাজটা বেশ টের পেল মিতালী। তাই কফি টফির প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সিরিয়াস হয়ে বসলো। সমর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখের চশমা টা ঠিক করে পরে বলল,
‘ আপনি কি জানেন, একটা চার পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুর মন মস্তিষ্ক এবয়সে কতোটা অপরিণত হয়? মারামারি ধমকাধমকি তাদের মস্তিষ্কে কি পরিমাণ বাজে প্রভাব ফেলে?

মিতালী সমরের কথা না বুঝে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ জানবো না কেন! অবশ্যই জানি!! আমার অঙ্কন ও তো পাঁচ বছরের।”

‘ ও আচ্ছা ! তাই যদি হয় তাহলে কোন বুদ্ধিতে আপনি আমার ছোট্ট সায়ন কে ওভাবে ধমক দিয়েছেন?”

সমরের অভিযোগ শুনে মুগ্ধতা ভুলে নিমেষে খেই হারালো মিতালী। সমর তখন ক্ষুব্ধ গলায় বলে চলেছে,
“ মানছি ও একটু জেদি। বায়নাও ধরে ছিল হয়তো। তবে ওকে বোঝানো যেত। ওকে আদর করে সরিয়ে আনা যেত। না বুঝলে আপনি আমাদের কাউকে বলতে পারতেন! আমরা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতাম। কিন্তু না! আপনি সেটা না করে বরং ওকে চোখ মুখ পাকিয়ে ধমকে উঠলেন।
আপনি কি জানেন আমার ছেলেটা আপনার ধমকে কতোটা পরিমাণ ভয় পেয়েছে? একটু গিয়ে দেখে আসুন বেচারা ওই সন্ধ্যা থেকে নিয়ে টানা দুঘন্টা ভয়ে কেঁদেছে।’

মিতালী সমরের কথাগুলো শুনে মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হলো। আফসোসে সুরে বলল,
‘ ক্ষমা করবেন। আসলে আমি বুঝতে পারিনি সায়ন ওভাবে ভয় পেয়ে যাবে! সরি!!’

সমর উঠে দাঁড়ালো। হাত মুঠো করে রাগ সামলালো। খেলায় মত্ত অঙ্কনকে দেখে বলল,
‘ নিজের সন্তান হোক আর পরের। দয়া করে আর কক্ষনো কোনো শিশুর সাথে এমন রুড বিহেব করবেন না। আসি নমস্কার!’

________

সারা বিকেল ধরে বৃষ্টির সাথে হালকা শীতল বাতাসে কিছুক্ষণ আগের সেই গুমোট ভাবটা একদম কেটে গেছে। পরিবেশ টা এখন উপভোগ করার মতো সুন্দর। মনিকা তখন রান্নাঘরে, রাতের খাবারের ব্যবস্থা করায় ব্যস্ত। তপন সাহেব সদ্য অফিস থেকে ফিরে চা খেতে বসেছেন। তখনি বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলো। পরমা ল্যাপটপে মেল টাইপ করছিল। কলিং বেলের শব্দ শুনে মাকে এগিয়ে আসতে দেখে তাকে মানা করে নিজেই গেল দরজা খুলতে। তবে দরজা খুলতেই রিদিমার কর্দমাক্ত অবস্থা দেখে চোখ জোড়া ছানাবড়া অবস্থা তার।

‘ সুনু, একি অবস্থা তোর!’

রিদিমা তখন রাগের তোপে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফুঁসছে। বড়ো বোনের কথায় জবাব না দিয়ে জুতো জোড়া খুলে ধুপ ধাপ পা ফেলে চলে গেল নিজের রুমে। মনিকা রান্নাঘর থেকে পরমার কথা শুনতে পেয়ে ওখান থেকেই হাঁক ছাড়ল,
‘ কি হয়েছে রে তনু?’

পরমা দরজায় খিল আটকে সোফায় এসে বসে উত্তর দিল,
‘ তোমার মেয়ে কাদা মেখে ভূত সেজে বাড়ি ঢুকেছে মা।’

ফিরতি জবাবে মনিকা কে তেমন কিছু বলতে শোনা গেল না। কারণ বর্ষাকাল। রাস্তায় জলকাদা হবে এটা স্বাভাবিক। তারা শহরতলীতে থাকেন। এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারের বাস বেশি। রাস্তাঘাটের তেমন একটা পরিচর্যা হয় না বললেই চলে। শুধু ভোটের আগের মুহূর্ত টুকু বাদ দিয়ে।

রিদিমা নিজের ঘরে ঢুকে সবার প্রথমে শব্দ করে দরজা আটকালো। বিড়বিড় করে সেই গাড়ি চালক লোকটাকে গালি দিতে দিতে আলমারি থেকে ঢিলা গেঞ্জি আর থ্রী কোয়াটার প্যান্ট টা নিয়ে ঢুকলো ওয়াশ রুমে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে স্নান সেরে বেড়িয়ে এলো বাইরে। মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজেকে দেখলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কিছুক্ষন আগেও পুরো মুখটা কাদায় মাখামাখি ছিল এখন ধুয়ে মুছে একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। তবে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে শ্যাম্পু গিয়ে। রিদিমা ওসবে ততটা ধ্যান দিল না। ময়েশ্চরাইজার ক্রীম খানিকটা ঢেলে মুখে হাতে গলায় ঘাড়ে মেখে টাওয়াল খুলে চুল গুলো ঝেড়ে নিলো।
ফ্লোরে কলেজের ব্যাগটা রাখা ছিল। ওটাতেও খানিক টা কাদা মেখে গেছে। কাল ধুয়ে দিতে হবে। না হলে ব্যবহার করা যাবে না ভেবে সাবধানে ভেতরের জিনিস পত্র গুলো বের করে নিল। বুক পকেটের চেন খুলে ফোনটা বের করতেই শব্দ তুলে সেটা বেজে উঠলো। দেখলো বন্ধুদের গ্রুপে মেসেজ এসেছে। লক খুলে ওপেন করতেই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো,

“ এই মাত্র খবর পেলাম আজ সন্ধ্যায় নাকি চ্যাটার্জী স্যারের বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তোরা কি কিছু শুনেছিস এ ব্যাপারে!!’

রিদিমা মেসেজ টা পড়ে খুব শকড হলো। তাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের ইয়াং লেকচারার হেমন্ত চ্যাটার্জী। হ্যান্ডসাম হবার সাথে সাথে ভীষণ হাস্য রসিক বলে টিচার হিসেবে খুবই পপুলার উনি। তার সম্পর্কে হঠাৎ এমন একটা খারাপ খবর শুনে ভীষন বিচলিত হলো রিদিমা। মেসেজ টাইপ করে সে জানতে চাইলো,
‘ স্যার ঠিক আছেন তো? মানে সিরিয়াস ইঞ্জিয়োর্ড হোন নি তো?’

গ্রুপের একজন জবাবে লিখলো
“ওনার পায়ে আর বুকে সামান্য লেগেছে। হেলমেট ছিল তাই মাথায় লাগেনি।”

“ এখন কেমন আছেন?”

“ জানি না। তবে শুনেছি পায়ের হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে।”

“ ইশ!!”

সবাই মিলে খুব আফসোস করলো স্যারের এমন দুরবস্থার জন্য। অতঃপর ঠিক করলো কাল কলেজ শেষে সবাই মিলে একসাথে স্যার কে হাসপাতালে দেখতে যাবে। বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং শেষ হতেই রিদিমা ফোন টা রেখে পিঠ এলিয়ে দিলো বালিশে। ঠিক তখনই মনিকার গলার আওয়াজ শুনতে পেল।
“ সুনু খাবার দিয়েছি। খেতে আয়।”
__________

সময় টা তখন সকাল সাড়ে নয়টার আসেপাশে। ছেলের বায়না শুনতে শুনতে সমর ভীষণ অতিষ্ট। যতবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে ততবারই মুখ ঘুরিয়ে একই কথা জপে যাচ্ছে, “ আমাল ও অঙ্কনের মতো ম্যাম চাই! আগে ম্যাম এনে দাউ,না হলে খাবোনা।”

“ বাবাই বায়না করে না। নাও হা করো।”

সায়ন বাবার কথা শুনলো তো নাই বরং হাত দুটো বুকে গুঁজে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো অন্যদিকে। সমর আরো দশ মিনিট চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে শেষমেশ মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ মা! কে সেই ম্যাম! তুমি কি তাকে চেনো?’

মিসেস চিত্রা জবাবে বললেন,
‘ তেমন ভাবে চিনি না। তবে ব্যালকনি থেকে দেখেছি কয়েকবার তাকে। কলেজ স্টুডেন্ট মনে হয়। বাচ্চা একটা মেয়ে।’

‘ তুমি ওনার সাথে যোগাযোগ করো। পারলে আজই তাকে বাবাইয়ের জন্য ঠিক করে নাও। টাকার চিন্তা করো না। ছেলেটাকে আমি ব্যস হাসি খুশি দেখতে চাই।’

মিসেস চিত্রা ছেলের কথায় ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলেটা তার কেমন যেন রোবট হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। একেবারে রসকষ হীন জড় বস্তু। শুধু মাত্র এই বাচ্চাটার জন্যই হয়তো পুরোপুরি পাষাণ হতে পারে নি ছেলেটা তার। আবেগ অনুভূতি গুলো তার একটু হলেও এখনও জীবিত। কোনোমতে শ্বাস ফেলছে বিভীষিকাময় অতীত ভুলে।
*
আজ কলেজের অর্ধাংশ শেষ হতেই ডিপার্টমেন্টের ছুটি ঘোষণা করা হলো চ্যাটার্জী স্যারের অ্যাক্সিডেন্ট এর কারণে। তবে ছাত্রছাত্রী দের বারণ করা হলো তারা যেন কিছুতেই একসাথে গিয়ে হাসপাতালে ভিড় না করে। স্যারকে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভালো তবে হাসপাতালের পরিবেশ কে উন্মুক্ত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। তাই ঠিক হলো স্যারের যেহেতু মেজর ইঞ্জুরি হয় নি শুধু পা তটাই ভেঙেছে তাই তার ডিসচার্জ হলেই সবাই কয়েক দলে ভাগ হয়ে স্যারের বাড়িতে যাবে তাকে দেখতে। রিদিমা বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে নিজের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বিকেলে তার অঙ্কন কে পড়াতে যাওয়ার আছে।

দেখতে দেখতে বিকেল চারটার দিকে একদম গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো রিদিমা। আজ কিছু দরকারী জিনিস শপিং করার ছিল। তাই সেটা কিনে একবারেই পড়াতে যাবে ভেবেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে মনিকা পেছন থেকে ডাকলো। মায়ের ডাকে রিদিমা দাঁড়ালো…
‘ যা বলার তাড়াতাড়ি বলো মা। আমার হাতে সময় কম।”

মনিকা মেয়ের সামনে এগিয়ে এসে গমগমে গলায় বললেন,
‘ তৃপ্তীশের মা ফোন করেছিল! শুনলাম তুই নাকি ওর
ফোন রিসিভ করছিস না। বারে বারে কেটে দিচ্ছিস।”
“ তো কী করবো? ব্যস্ততার সময় যদি ফোন আসে তাহলে কী কাজ কর্ম বাদ দিয়ে আষাঢ়ে গল্প শুরু করতে বলছো?”
“ আমাকে কথা শেখাস না সুনু। কাজ শেষ করেও তো কথা বলা যায় না কী? ওদের সামনে তোর বাবার মান সম্মান নষ্ট না করলে তোর হচ্ছিল না তাই না?”

রিদিমা বিরক্ত হলো ভীষণ। অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠলো,
“ একদম আজেবাজে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। আমি ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন করিনি এতে এতো রাগ দেখানোর কী হলো।”

মনিকা মেয়ের উচুঁ গলা দেখে রীতিমত ক্ষেপে গেলেন।
“ চুপ কর তুই। যতবড় মুখ নয় তত বড় কথা। তুই যে ইচ্ছে করেই ওর ফোন রিসিভ করিস না আমি কিছু বুঝি না ভেবেছিস।”

রিদিমা মায়ের দিকে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকালো। মা বাবা বিয়ের নাম করে একটা আস্ত জ্বালাতন ওর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই সমস্যা টা কে ও না পারছে গিলতে আর না পারছে ফেলতে। এই তৃপ্তীশ ছেলেটা এত্ত গায়ে পড়া আর বাঁচাল তা বলার বাইরে। রিদিমার ওকে একদমই পছন্দ নয়। বাড়িতে বহুবার অপছন্দ করার ব্যাপার টা জানিয়েও কোনো লাভ হয় নি। কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাড়ির সবাই ওই ব্যাটা কে ভীষণ পছন্দ করে। রিদিমা দাঁতে দাঁত চেপে আজ আবারো সেই একই অভিযোগ জানালো।

‘ মা আমি বার বার করে তোমাদের জানিয়েছি আমার ওই লোকটাকে একটুও পছন্দ নয়। কেন বোঝো না বলোতো তোমরা! আমার পছন্দ নয় জেনেও জোর করে ওই লোকটার গলায় ঝোলাতে চাইছো।”

মনিকা তেঁতে উঠলেন মেয়ের কথায়…
‘ আজ তোকে পরিষ্কার করে বলতেই হবে কেন, কেন তৃপ্তীশ কে তোর পছন্দ নয়? ছেলেটার মধ্যে কী এমন কমতি আছে হ্যাঁ? শিক্ষিত সুদর্শন প্রতিষ্ঠিত ছেলে! একটা ভালো কোম্পানিতে ভালো স্যালারিতে জবও করছে। নিজস্ব বাড়ি আছে। সচ্ছল পরিবার। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একটা ভালো পাত্র হিসেবে আর কি চাই তোর!’

রিদিমা মায়ের দিকে হতাশায় ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। কেউ কেন বোঝে না শুধু মাত্র ভালো পাত্র হলেই তাকে জীবন সঙ্গী করা যায় না। তার জন্য উল্টো দিকের মানুষটার মনের সম্মতির ও প্রয়োজন হয়। তার মন যদি কাউকে একসেপ্টই না করে তাহলে কিভাবে তার সাথে গোটা একটা জীবন কাটাবে সে? কীভাবে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা সম্পর্ক কে মান্যতা দেবে? রিদিমা মায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল,
‘ মা, আমি তো ওনাকে খারাপ বলিনি। পাত্র হিসেবে তৃপ্তীশ অবশ্যই ভালো ছেলে। কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি আমার ওনাকে ব্যক্তিগত ভাবে ভালো লাগে না। মানে আমার মন ওনাকে লাইফ পার্টনার হিসেবে এক্সেপ্ট করছে না। ব্যস! আর কিছুই না।’

মনিকা মেয়ের স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালো ভাবেই অবগত। মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদি। বলতে গেলে একটু এক্সট্রা বুঝদার। তার মন যে কাজে সায় দেয় সেই কাজই সে করে। আর যে কাজে সায় দেবে না। মেরে ফেললেও সে কাজ তাকে দিয়ে করানো যাবে না। কিন্তু তাই বলে এমন হটকারী সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নেবে না মনিকা। কারণ এটা ছেলেখেলা নয় জীবন। যেখানে আবেগ নয় বিবেক বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হয়।
তাই মেয়ের উল্টোপাল্টা যুক্তি মতো এতো ভালো পাত্র কে বাতিল করা রীতিমত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। মনিকা গলার জোর বাড়িয়ে বলল,
‘ দেখ সুনু! সব সময় তোমার জেদ তোমার বায়না তোমার অযৌক্তিক ভাবনা চিন্তা কে কিন্তু মেনে নেওয়া হবে না। পাত্র তনুর শ্বশুর আর তোমার জেঠুমণির ঠিক করা। সেই সাথে তোমার বাবারও সম্মতিতে এই কাজ আগানো হয়েছে। তাই তোমার এসব ফালতু যুক্তি মেনে বিয়েটাকে কিন্তু কোনো ভাবেই ভাঙা হবে না বুঝেছো।”

রিদিমার ভীষণ রাগ হলো। তাকে দিয়ে জোর করে অপছন্দের কোনো কাজ করালে সে পুরো পাগল হয়ে যায়। এই মুহূর্তে ওর সেরকম পাগল পাগল লাগছে। তবুও মায়ের সামনে বেশি জেদ দেখানোর সাহস তার কোনকালেই ছিল না, আর না এখন আছে। মনের মধ্যে উথলে ওঠা ক্ষোভ টাকে তাই মনের মাঝেই চাপা দিয়ে গজগজ করতে করতে বলল,
‘ মা তোমরা ভুলে যাচ্ছ কেন আমার গ্র্যাজুয়েশন এখনও শেষ হয়নি। সামনেই আমার কোর্স ফাইনাল এক্সাম!’

‘ তো। কে তোমাকে এক্সাম দিতে আটকাচ্ছে? আমরা এক্ষুনি বিয়ে দিচ্ছি না তোমার। যা হবে পরীক্ষার পর হবে।”

রিদিমা রাগ সামলাতে না পেরে প্রায় কেঁদেই ফেলল। জলে টইটুম্বুর চোখে তাকিয়ে ফোস ফোস করতে করতে বলে উঠলো,
‘ আমি আরো পড়াশুনা করতে চাই মা! ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই! তাই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কিন্তু আমার বিয়ের চিন্তা করবে না।”

মনিকা আবারো ক্ষেপে গেলেন। চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠলেন,
‘ বিয়ে ঠিক হচ্ছে বলে তোমার পড়াশুনা বন্ধ করা হচ্ছে না। আর না ভবিষ্যত গড়ার কাজে তোমাকে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। যদি তাই হতো তাহলে তনুর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগে যখন তোমার বাবা আর জেঠুমণি ওর বিয়ে ঠিক করেছিল তখনই ওর লাইফ শেষ হয়ে যেত। মাস্টার্স ও কমপ্লিট করতে পারতো না আর না ও জব পেতো। তাই বিয়ে ভাঙার এসব ফালতু বাহানা দেওয়া বন্ধ করো।’

রিদিমা মায়ের কথায় ঠোঁট চেপে কেঁদেই ফেলল। মায়ের কাছে এসে হাত দুটো ধরে ভীষণ কাতর কন্ঠে বলল,
‘ প্লীজ মা! আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে চাই না। আমি আমার লাইফে অনেক কিছু করতে চাই। আমার স্বপ্ন গুলোকে নিজের দক্ষতায় পূরণ করতে চাই। তাই দয়া করে এই মুহূর্তে আমার লাইফের সবচেয়ে রস্ট ডিসিশন টা নিয়ে আমার কোমরটা ভেঙে দিও না।’

মনিকা মেয়ের মুখে কান্নার ছাপ দেখে খানিক দমে গেল। তবুও নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে ভুললো না। মেয়ের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গমগমে গলায় বলল,
‘ তোমার পছন্দ নয় এমন একটা লেইম এক্সকিউজ দেখিয়ে তৃপ্তীশকে মানা করা যাবে না। তাই দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করে নিজেকে আগামীর জন্য প্রস্তুত করো।’

রিদিমা মায়ের শেষ কথা শুনে আর দাঁড়ালো না। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে এলো বাইরে। কারণ এদের কে বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। এটাই বোধ হয় আমাদের বিংশশতাব্দীর যুগ। যেখানে খুব ফলাও করে বলা হয় মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অথচ কি নিদারুণ কৌশল খাটিয়ে সেই স্বাধীনতা টুকু চুপিসারে হরণ করা হয়। পড়াশুনা জব বিয়ে সব ক্ষেত্রে অবান্তর বিচরণের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয় পরিবারের পছন্দের সাব্জেক্ট, তাদের পছন্দের জব এমনকি তাদের সিলেক্ট করা পাত্র কেও।
‘আমার পছন্দ নয়’ এটা নাকি একটা লেইম এক্সকিউজ!! হাহ!!
আচ্ছা যাকে পছন্দ নয় তার সাথে আমি নামক মানুষটা কিভাবে সারাটা জীবন কাটাবো সেটা কেন তারা ভাবে না। তাদের কাছে ছেলের ভালো জব বাড়ি গাড়ি এসব কিছু থাকা মানে সে ভালো ছেলে, আর তাকেই চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হবে!! অথচ আমার মন আমার ইচ্ছে আমার চাওয়া… সেগুলো? সেগুলোর কী সত্যি কোনো মূল্য নেই কারো কাছে?

কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ির গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো রিদিমা। মনের মধ্যে তখন বয়ে চলেছে এলোপাথারী ঘূর্ণিঝড়। হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে আছড়ে পড়ছে তীব্র ক্ষোভের উচ্ছ্বাস। কেবলি মনে হচ্ছে এই বাড়িতে তার আপন বলতে কেউ নেই। সবাই তার পর। মা বাবা কেউ তার আপন নয়। যেখানে তার মতামতের কোনো দাম কেউ দেয় না তারা তার আপন হতে পারে না।

পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো রিদিমা। এই তার এক দোষ। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দিলেই সাথে সাথে মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মস্তিষ্ক তার নিয়ন্ত্রণ হারায়। এই যেমন এখন হারাচ্ছে। রিদিমা রাগে অভিমানে গজ গজ করতে করতে জনবহুল সড়কের বুকে এলোমেলো পা ফেলে হাঁটে। মনের কষ্ট গুলো কুয়াশার মত চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয়। ছলছল চোখ জোড়া ভিজে ওঠে অশ্রুতে। মনের অন্তঃকরণ পুড়ে ছাই হয়ে যায় অদূর ভবিষ্যতে নিজের পরিণতি কল্পনা করে। ঠিক তখনই প্রবল শব্দ তুলে চাকার ঘর্ষণ কানের পর্দায় ঝংকার দিয়ে ওঠে। মস্তিষ্কের সমস্ত ভাবনা গুলো সহসা ছিঁড়ে খুঁড়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক ভয়ংকর দৃশ্য। একটা ছুটন্ত সাদা রঙের চার চাকার গাড়ি, গাড়িটা তীরের গতিতে ছুটে আসছে তার দিকে। রিদিমা চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখে প্রাণভয়ে কানে হাত চেপে জোর গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে….

‘ আ.…………………………..!’

চলবে…..

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব:২

রিদিমা চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখে প্রাণভয়ে কানে হাত চেপে জোর গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে….

‘ আ.…………………………..!’

অতঃপর সব কিছু শান্ত। বেশ কয়েক সেকেন্ডের শুনশান নীরবতা। তারপর পরই হৈ চৈ হট্টগোলে কান ধরে এলো রিদিমার। আস্তে আস্তে চোখ দুটো খুলেই দেখতে পেল ও দাঁড়িয়ে আছে ঠিক রাস্তার মাঝখানে। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক। আর ওর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন ভদ্রলোক। মধ্যম উচ্চতার চশমা পরা লোকটা ভ্রূ কুঁচকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

‘ ম্যাডাম আপনি ঠিক আছেন?’

এক ভদ্রলোকের কথায় হুশ ফিরল রিদিমার। বুকটা তখনও প্রচন্ড গতিতে ধড়ফড় করে লাফাচ্ছে। কাঁপতে থাকা শরীরে মাথা নেড়ে কোনো মতে জবাব দিলো রিদিমা,
‘ হুম্!’

একজন ভদ্রমহিলা রিদিমা কে ভালো করে পরখ করে দেখলো।
‘ তোমার কোথাও লাগেনি তো মা!’

আবারো মাথা নেড়ে উত্তর দিল রিদিমা। আরেকজন ভদ্রলোক বললেন,
‘ মেয়েটাকে ধরে একটু বসানো দরকার। দেখেছেন কেমন কাঁপছে। আপনাকে ধন্যবাদ দাদা! সময় মতো যদি ব্রেক টা না কষতেন তাহলে এই মুহূর্তে একটা মারত্মক বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো।’

রিদিমাকে ততক্ষণে রাস্তার পাশের একটা চায়ের দোকানে বসানো হয়েছে। একবোতল জল ও দেওয়া হয়েছে খাওয়ার জন্য। তেমন কিছু ঘটে নি দেখে লোকজনের ভিড় ও কমে এলো একটু একটু করে। আশপাশ একটু ফাঁকা হতেই চশমা পরা ভদ্রলোক রিদিমার একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। চাপা কণ্ঠে বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,
‘ ভেরি ফ্লপ ড্রামা মিস্। টাকা হাতানোর কৌশল টা কিন্তু মারাত্মক জঘন্য ছিল!’

ভদ্রলোকের কথাটা কানে শোনা মাত্রই রিদিমার মস্তিষ্ক প্রায় শূন্য হয়ে এলো। কী বলল লোকটা? টাকা হাতানোর কৌশল মানে? রিদিমা লোকটার কথা বুঝতে না পেরে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট!’
‘ না বোঝার মত এতোটাও কঠিন কথা বলা হয় নি মিস্ নাটকওয়ালি।

লোকটার কথার জঘণ্য মানে টা এবার বুঝতে পারল রিদিমা। সাথে সাথে সর্বাঙ্গ চিরবিড়িয়ে উঠলো রাগে। এতক্ষণ ধরে মনের মাঝে আঁকড়ে থাকা ভয় ডর নিমেষে উবে গিয়ে মাথায় ভর করলো চড়চড়ে অপমান। একটু আগের উত্তেজনা ভুলে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো রিদিমা। ক্রোধে ফুঁসে উঠে বলল,
‘ আপনি বলতে চাইছেন, আমি আপনার গাড়ির সামনে ইচ্ছে করে চলে এসেছি যাতে অ্যাক্সিডেন্টের নাটক করে আপনার কাছ থেকে টাকা হাতাতে পারি!’
‘ এজ্যাক্টলি! কোনো সন্দেহ!!’

রিদিমার উচ্চস্বরে চিৎকার করার অভ্যেস কোনোদিন ও নেই। তাই ওই মুহূর্তে রাগের পারদ সীমা ছাড়িয়ে গেলেও চিৎকার করে ঝগড়া করতে পারলো না মেয়েটা। শুধু রাগের চোটে নাকের পাটাটাই ফুলালো তার। লোকটার পাশে দাঁড়ানো আরেক ভদ্রলোক লোকটাকে থামিয়ে বলে উঠলো,
‘ সমর! কি সব উল্টো পাল্টা কথা বলছিস তুই? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!! উনি কেন এসব করতে যাবেন? উনাকে দেখেই ভদ্র পরিবারের মনে হচ্ছে।’

সমর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।
‘ শোন রঙ্গন। এই দুনিয়াটা তোর থেকে অন্তত একটু হলেও বেশিই দেখেছি আমি। তাই আর যাই হোক মানুষ চিনতে কখনও ভুল হয় না আমার। এদের মতো ভদ্র পোশাক পরা ভদ্র ঘরের ট্যাগ লাগানো মেয়েরাই মানুষ ফাঁসাতে ওস্তাদ হয়।’

রিদিমা আর এক মুহূর্তও অভদ্র লোকটার নোংরা কথা গুলো সহ্য করতে পারলো না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের কাঁধের ব্যাগটাকে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলল,
‘ আমি আপনার মানুষ বিচার করার ক্ষমতা দেখে সত্যিই অবাক না হয়ে পারলাম না মিষ্টার এক্স ওয়াই জেড হোয়াট এভার। যাইহোক, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি অতি সত্তর আপনার প্রকৃত দৃষ্টির উন্মোচন হোক। সত্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠুক আপনার সো কল্ড ভুল চিন্তাধারা গুলো, আসি।”

বলেই সা সা করে হেঁটে বেরিয়ে গেল রিদিমা। রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে বেশ মেজাজ দেখিয়ে বলল,
‘ হোয়াটস রং অ্যাবাউট ইউ ইয়ার! কি দরকার ছিল মেয়েটা কে এসব নোংরা কথা বলার।
কেন তুই সবাই কে একই দাঁড়িপাল্লায় মাপিস বলতো। কেন তুই ভুলে যাস সবাই কিন্তু প্রিয়া নয়।’

সমর রাগে হাত চেপে মুঠো করে ধরলো।
বাঁকা চোখের কোনায় ছাই চাপা আগুনের মতো ফুলকি দিয়ে ওঠা রাগের লাগাম টাকে টেনে ধরে বলল,
‘ লুক রঙ্গন! আই উইল ওয়ার্ন ইউ ফর দ্যাট লাস্ট টাইম। আর কক্ষনো ওর নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবি না বলে দিলাম!’
______

চঞ্চল বৈরী হওয়ার হুহু দাপট আর মেঘের গুড়গুড় ডাক শুনে বোঝা যাচ্ছিল আজ সন্ধ্যায় আবারো বৃষ্টির আগমন ঘটতে চলেছে। থেকে থেকে বর্ণিল বিদ্যুতের স্বর্ণালী তরঙ্গ আকাশের বুকে ফুল্কি বাজির মত জ্বলে জ্বলে উঠছিল। কখনও সখনও বুকে কাঁপন ধরানো বড়ো বড়ো ডাক ছেড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল তার আগমন হতে চলেছে অতি সত্তর।

সদ্য অঙ্কনকে পড়িয়ে মিতালীদের ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো রিদিমা। খুব তাড়াতাড়ি বাইরের পরিস্থিতি খারাপ হতে চলেছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি পৌঁছানো দরকার ভেবে যেই রিদিমা সামনে এগুবে অমনি কথা থেকে একটা সাড়ে তিন কি চার বছরের বাচ্চা ছেলে ম্যাম ম্যাম বলে দৌড়ে ছুটে এসে ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরলো রিদিমাকে। আচমকা ছোট বাচ্চার স্পর্শ পেতেই রিদিমা প্রথমে খানিক হকচকিয়ে উঠলেও পরক্ষণে চিনতে পারলো বাচ্চাটাকে। এটা সেই কালকের বাচ্চাটা। কি জেদ টাই না ধরেছিল কাল ওর কাছে পড়বে বলে। কতক্ষন আদুরে হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বসেও ছিল। তারপর তো মিতালী এসে ওকে ধমকে ধামকে নিয়ে চলে গেল বাইরে। ইশ! খুব কেঁদেছিল বাচ্চাটা।
রিদিমা সাথে সাথে সায়ন কে কোলে তুলে নিয়ে ওর ফোলা গালে একটা মিষ্টি চুমু খেয়ে বলল,
‘ একি সায়ন! তুমি এখানে? কার সাথে এসেছো সোনা?’

সায়ন আঙুল তুলে পাশে ঈশারায় দেখিয়ে বলল,
‘ থাম্মির থাতে!’

ওর মুখে তোতলানো ‘থাম্মি’ কথাটা এতো কিউট শোনালো যে রিদিমা একই প্রশ্ন আবার করলো।
‘ কার সাথে?’

তবে এবার আর সায়ন কে উত্তর দিতে না দিয়ে মিসেস চিত্রা নিজেই বলে উঠলেন,
‘ আমি! সায়নের ঠাম্মা।’

রিদিমা সায়ন কে নিচে নামিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে প্রণাম জানালো তাকে। মিসেস চিত্রা রিদিমার বড়োদের প্রতি এমন সম্মান বোধ দেখে বেশ খুশি হলেন মনে মনে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে সহবোধ সম্মান বোধ এসব গুণ গুলো যেন একেবারে উঠেই গেছে। তিনি হেসে বললেন,
‘ থাক থাক, খুব ভালো থেকো মা। আসলে আমি তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম।’

রিদিমা অবাক হলো,
‘ আমার সাথে!!’
‘ হুম্! একটা আবদার নিয়ে এসেছিলাম আসলে।’

রিদিমা যারপরণাই অবাক হলো,
‘ আবদার!! কি রকম আবদার?’

মিসেস চিত্রা সায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘ আসলে কালকের ঘটনাটা তো তুমি নিজে চোখে দেখেছো। এবারে একটা বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে। যার মূল সমাধান তুমি!’

মিসেস চিত্রার কথা শুনে রিদিমার তো রীতিমত বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড়। বিস্ময়ে হতভম্ব চেহারা। রিদিমা বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলল,
‘ মানে? আমি কিছু বুঝিনি আন্টি!’
‘ বলছি বলছি! যা এক জটিল ঝামেলা পেকেছে না তার সমাধান একমাত্র তুমিই দিতে পারবে মা?’

মিসেস চিত্রার জড়ানো প্যাচানো কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না রিদিমা। তবে কাল সায়নের কান্না সে নিজের চোখে দেখেছে। খুব খারাপ লেগেছিল বাচ্চাটার কান্না শুনে। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। রিদিমা চোখ মুখ আধাঁর করে অপরাধী কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে ক্ষমা করে দেবেন আন্টি।আমি আসলেই কাল বুঝতে পারিনি মিতালী বৌদি ওভাবে ওকে বকবে। আমি তার জন্য সত্যিই দুঃখিত।’

মিসেস চিত্রা রিদিমার অমন করে ক্ষমা চাওয়া শুনে ভীষন অপ্রস্তুত হলেন। সাথে সাথে রিদিমার ভুল ভাঙিয়ে দিতে বললেন,
‘ এমা! তুমি ক্ষমা চাইছো কেন মা! এখানে তো তোমার কোনো দোষ ই নেই।’
‘ তবুও..!”

মিসেস চিত্রা স্মিত হাসলেন। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বললেন,
“ বাদ দাও ওসব। কালকের কথা কালকেই মিটে গেছে। আমি আসলে তোমার সাথে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছিলাম।”
“ অন্য বিষয়!”
“ হ্যাঁ আর বলোনা। আসলে আমার নাতি কাল থেকেই বায়না ধরে বসে আছে ওর ও নাকি ম্যাম লাগবে। তাও অন্য কেউ নয় তোমাকেই লাগবে ওর। আজ সকাল থেকেই একই কথা ক্রমাগত রটে যাচ্ছে আমারও ম্যাম চাই। আমিও ম্যামের কাছে পড়ব।’

মিসেস চিত্রার কথা শুনে রিদিমার মনটা হঠাৎ উড়ন্ত বাষ্পের মতো ঝুপ করে হাল্কা হয়ে গেল যেন। মনের সমস্ত অপরাধ বোধ উবে গিয়ে মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পড়লো মৃদু হাসির ঝলক।
‘ ওহ্হ এই কথা! ইশ! আর আমি কি না কি ভেবে ফেলেছি!’

মেয়েটার গজ দাঁতের নজরকাড়া হাসিটা যেন একদম মন ছুঁয়ে গেল প্রৌড়ার।
‘ তোমার হাসিটা খুব সুন্দর! একদম নিখাঁদ!’

মহিলার কথা শুনে হঠাৎ করে কেন যেন ভীষণ লজ্জা পেল রিদিমা। তলপেটের মধ্যে অদ্ভুত রকমের একটা অনুভূতি মোচড় দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে হাসিটা মিলিয়ে গেল মুখমন্ডল থেকে। মিসেস চিত্রা রিদিমার হাত ধরে বললেন,
‘ এসো না মা আমাদের ফ্ল্যাটে! দুটো কথা বলি তোমার সাথে!’

রিদিমা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
‘ আসলে আন্টি আমি বাড়ি ফিরতে চাইছিলাম আর কি। দেখেছেন তো আকাশের অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। যে কোন সময় ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে।’
‘ ম্যাম তলো না আমাল থাতে!’

বলেই দুটো ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে আবারো রিদিমার হাঁটু জড়িয়ে ধরলো ছোট্ট সায়ন। রিদিমা পড়লো মহা বিপাকে। এদিকে বাড়ি ফেরার তাড়া অপর দিকে ছোট্ট বাচ্চাটার আবদার। ফিরিয়ে দিলে বেচারা কষ্ট পাবে ভেবেই মনটা ছোট হয়ে আসছে। এদিকে সে নিরুপায়। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। রিদিমা হাঁটু মুড়ে বসে সায়ন কে জরিয়ে ধরে দুগালে দুটো চুমু খেয়ে বলল,
‘ আজ নয় সোনা কাল যাবো ঠিক আছে! এখন আমাকে যেতে দাও!”
“ না কালকে না। তুমি একুনি তলো।”

সায়নের অবুঝ আবদার। রিদিমা কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ঠিক তখনই বিশাল শব্দজোগে বজ্রপাত হলো। সাথে সাথে পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি কেটে গিয়ে গোটা ভবন ডুবলো ঘুটঘুটে অন্ধকারের বেড়াজালে। তার মিনিট দুই পরেই শা শা শব্দ তুলে শুরু হলো প্রবল ঝড়ো বাতাস। সেই সাথে মুহুর্মুহু মেঘের ডাক। এতো জোরে জোরে মেঘের ডাক শুনে আচমকাই ভয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো সায়ন। রিদিমা সদ্য নিজের মোবাইল টা তুলে টর্চ লাইট অন করেছে মাত্র। সায়ন কে ওভাবে কাঁদতে দেখে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলো তাকে বুকের মাঝে।
আলোটা মাথার উপর তুলে ধরে বলল,
‘ সায়ন! বেবী ডোন্ট ক্রাই! এদিকে তাকাও! দেখো আমি আছি তোমার কাছে!’

সায়ন তবুও থামলো না। সমানে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মিসেস চিত্রা অমন পরিস্থিতিতে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে অন্ধকার তো আরেক দিকে সায়নের কান্না। নাতি কে সামলে এই অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের ফ্ল্যাটে যেতেও পারছেন না। তাছাড়া কারেন্ট অফ তাই লিফ্ট ও বন্ধ। যেতে হলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হবে। যা এই ভারী শরীর নিয়ে ওনার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। মারাত্মক হাঁটুর ব্যাথায় আজ আট টা বছর ভুগছেন তিনি। টুকটাক হেঁটে চলে বেড়ান এই অনেক। সিঁড়ি ভাঙলে তাকে কাল আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই উপায় অন্তর না পেয়ে রিদিমাকে অনুরোধের সুরে বললেন,
‘ মা যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা সাহায্য আবদার করতে পারি?
রিদিমা নিঃসংকোচে বলল,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আন্টি কেন নয়? বলুন না কী করতে হবে?”

মিসেস চিত্রা রিদিমার হাত চেপে ধরে বললেন,
‘ আমাদের যদি একটু ফিফথ ফ্লোর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে তাহলে বড় উপকার হতো মা!!”’

মিনিট খানেকের মধ্যে জেনারেটর পরিষেবা গুলো চালু হওয়াতে তাদের আর সিঁড়ি ভাঙতে হলো না। লিফ্ট এ করেই নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন মিসেস চিত্রা। যেহেতু বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে তাই অগত্যা আসতেই হলো রিদিমা কে। মিসেস চিত্রা রিদিমা কে নিয়ে ভবনে পা রাখা মাত্রই চারিদিকে আলো ঝলমলিয়ে উঠলো। ইলেকট্রিসিটি ফিরে আসতেই চুমকি তাড়াতাড়ি করে ইনভার্টার টা বন্ধ করে দিলো। মিসেস চিত্রা তা দেখে মজা করে বললেন,
‘ বাহ্! তুমি তো দেখছি স্বয়ং মা লক্ষ্মীর অবতার! দেখেছো, কেমন আমার বাড়িতে পা রাখা মাত্রই চারিদিক আলোয় আলোয় ভরে উঠলো।’

রিদিমা এবার আর লজ্জা পেল না। বুঝলো মহিলা খুবই মিষ্ট ভাষী। কথায় তার সর্বদাই মধু ঝরে। মিসেস চিত্রা রিদিমা কে নিয়ে বসালেন ডাইনিং এর নরম সোফায়। রিদিমা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো চারিদিক। এটা ফ্ল্যাট বললে ভুল হবে। এটা একটা মহল। চারিদিকে দামী দামী এলিট ক্লাসের আসবাব। যেমন ফ্লোর তেমনি ঘরের দেওয়াল। মাখনের মতো মসৃণ আর চকচকে। রিদিমা কখনও ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট দেখেনি। আজ দেখলো। এমন স্বপ্নের মত সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি দেখে মনটাই জুড়িয়ে গেল রিদিমার।

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে প্রায় ঘন্টা দুই সময়। ততক্ষনে বৃষ্টি সামান্য কমে এসেছে প্রায়। বিগত দুই ঘণ্টায় মিসেস চিত্রা তাকে নাতি আর তার দুষ্টুমি নিয়ে এতো এতো গল্প শুনিয়ে ফেলেছেন যে রিদিমার মনে হচ্ছে সে সায়নের ব্যাপারে মোটামুটি সব কিছু জেনে গেছে। মিসেস চিত্রা সত্যিই একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ। যেমন মিষ্ট ভাষী ঠিক তেমনই অতিথিপরায়ন। আসার পর থেকেই একটার পর একটা খাবার এনে জোর করে খাইয়ে চলেছেন মনের আনন্দে। ওদিকে সায়ন, সে তো ম্যাম পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। ছোট ছোট পায়ে ছুটে গিয়ে তার ছোট্ট বইয়ের ব্যাগ টা টানতে টানতে নিয়ে এলো রিদিমার কাছে।
“ ম্যাম, এই যে আমাল বুক।”

বলে বুকে ভর দিয়ে সোফায় উঠে বসলো। এরপর রিদিমা কে চমকে দিয়ে ABCD এর বইটা বের করে তুলে দিলো রিদিমার হাতে।

“ ম্যাম আমি ABCD থব পলতে পালি। তুমি থুনবে?”

বলেই একা একাই পড়তে শুরু করলো তোতলা তোতলা বুলিতে। রিদিমার এতো ভালো লাগলো শুনতে তা বলার বাইরে। থার্ড ফ্লোরের অঙ্কন ও ওর কাছে পড়ে। কিন্তু ভারী পাজি। হাজার বার বললেও একটা অক্ষর উচ্চারণ করতে চায় না। এদিকে বকাও যায় না। একটু চোখ মোটা করে তাকালেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে। সায়নের আগ্রহ দেখে রিদিমাও তার সাথে তাল মিলিয়ে এটা ওটা পড়ে শোনাতে লাগলো। যতক্ষণ বৃষ্টি না থামলো ততক্ষণ পর্যন্ত দুজনে মিলে পিকচার ড্র করলো, রাইমস পড়লো শুড়শুড়ি শুড়শুড়ি খেলল আরো কতো কী!!
রিদিমার খুব ভালো লাগলো মিসেস চিত্রার অমায়িক ব্যবহার আর সায়নের পড়ার প্রতি এত আগ্রহ দেখে। সে আর মানা করতে পারলো না। তাই কথা দিয়ে ফেলল সায়ন কে সে পড়াবে। অঙ্কন কে পড়িয়ে তারপর আসবে সে।ঠিক তখনই বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলো।
‘ ওইতো দাদা এসেছে !’
বলেই চুমকি দৌড়ে ছুটে গেল দরজা খুলতে।

হাত ঘড়িতে সময় দেখে রীতিমত চমকে উঠলো রিদিমা। কারণ ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত নটা দশ বাজে। রিদিমা তড়িঘড়ি করে মোবাইল ফোন টা বার করে দেখলো অলরেডি মায়ের দশটা মিসড কল। পড়ানোর সময় যাতে ডিস্টার্ব না হয় তাই সাইলেন্ট করে রেখেছিল। ভেবেছিল রাস্তায় বেরিয়ে নরমাল মোড করে নেবে। কিন্তু অঙ্কন দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা কিছু ঘটলো। তারপর তো সায়ন আর মিসেস চিত্রার সাথে এখানে এসে গল্প গুজব খেলা ধুলা করতে গিয়ে একদম ভুলে গেছিল ফোনের কথা। রিদিমা সাথে সাথে জ্বিভ কেটে মাকে কল ব্যাক করলো। দুই সেকেন্ডের মাথায় ওপাশ থেকে মনিকার রাম ধমক শুনে কান জ্বলে উঠলো রিদিমার। মায়ের বকা গুলো কান পেতে শুনে নিয়ে কোন মতে বলল,
‘ বৃষ্টিতে আটকে গেলে আমার কী দোষ। এখনও অঙ্কন দের ওখানেই আছি আমি। তুমি বাবাকে একটু বলো না আমাকে এসে নিয়ে যেতে।’

মায়ের সাথে কথা শেষ করে রিদিমা ব্যাগ টা গুছিয়ে কাঁধে তুলে উঠে দাঁড়ালো। মিসেস চিত্রা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ আন্টি এবার তাহলে আসি। বাবা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে নিতে।’

মিসেস চিত্রা সাথে সাথে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন,
‘ সেকি তোমার বাবাকে আবার কষ্ট করে এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আসতে বললে কেন? আমার ছেলে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসতো তোমাকে!’

রিদিমা হেসে বলল,
“ না না আন্টি। সেসবের দরকার নেই। বাবা এই তো এলো বলে।”

সায়ন সোফা থেকে নেমে রিদিমার সামনে গাল ফুলিয়ে দাঁড়ালো।
“ ম্যাম, আলেকটু তাকো না প্লিস।”

রিদিমা সায়নের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। সায়নের ফোলা নরম গাল দুটো দুহাতের আঁজলায় তুলে বলল,
“ এরকম বায়না করে না সোনা। আমি বাড়িতে না গেলে হবে বলো। আমার মা চিন্তা করবে না?”

সায়ন বুঝদারের মতো মাথা দুলিয়ে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। রিদিমা সায়নের গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
“ এই তো, দ্যাটস লাইক আ গুড বয়।
তাহলে কাল আমাদের দেখা হচ্ছে ঠিক আছে চ্যাম্প। আন্টি, আজ আসি তাহলে।”

বলে উঠে দাঁড়াতেই রিদিমার সামনে এসে দাঁড়ালো এক অতি পরিচিত মুখ। যে কিনা আজই বিকেলে ওকে ধান্দা বাজ মেয়ে বলে অপমান করে ছিল। ওদিকে সমরও হতবাক। এই মুহূর্তে তার বাড়ির ভেতরে বিকেলের সেই ঝগড়ুটে মেয়েটাকে দেখে সেও প্রচন্ড বিস্ময়ের ধাক্কায় বিমূঢ়। মুহূর্তের মাঝে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমর আর রিদিমা পরস্পর পরস্পরকে দেখে একসাথেই বলে উঠলো,
‘ আপনি?/ আপনিই?’

চলবে….