#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব:৫
রিদিমা বাড়ি ফিরলো দুপুরের পর। ঘেমে নেয়ে গরমে অস্থির হয়ে। মনের সর্বত্র জুড়ে তার অন্য রকম জ্বালা। বাড়িতে মায়ের প্রেশার বাইরে ওই অভদ্র লোকের অত্যাচার। উফ্, মনে হচ্ছে লাইফটা যেন শীল আর পাটার তলায় পিষ্ট হচ্ছে অনবরত। নেই নেই! কোথাও একফোঁটা শান্তি নেই।
মনিকা গত কাল থেকে মেয়ের ভারাক্রান্ত মুখ খানা দেখে যাচ্ছে। মেয়ের যে তাদের পছন্দে ভীষণ অপছন্দ সেটা তার জানা। কিন্তু পছন্দ নয় এমন কারণ টাও তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। এব্যাপারে সে আর কথা বাড়াতে চাইলো না। কারণ সে জানে তাকে কি করতে হবে। না না করে আর কতদূর যাবে। ঠিকই ধরে বেঁধে রাজি করিয়ে ফেলবে..!
রিদিমা বিকেল হতেই আজও গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলো। মিনিট দশেকের মাথায় আবাসনের সামনে এসে দাঁড়ালো রিক্সা টা। রিদিমা ভাড়া মিটিয়ে আস্তে ধীরে রাস্তা পার হচ্ছিল। ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন সায়নের কণ্ঠ শুনতে পেল।
“ ম্যা..ম !”
সায়ন কে খুঁজতে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো রিদিমা। আবাসনের খোলা গেট পেরিয়ে ছোট ছোট কুচো পায়ে ছুটে আসছে বাচ্চাটা। মুখে লেপ্টে একরাশ স্বচ্ছ হাসি। রিদিমা সায়ন কে ওভাবে ছুটে আসতে দেখে জমে গেল ভয়ে। কারণ রাস্তার উল্টো দিক থেকে দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসছে একটা কালো রঙের টাটা সুমো।
’’’’’ সা……..য়ন !’’’’’
কন্ঠনালী ভেদ করে বেরোনো আওয়াজ খানা যেন মুহুর্মুহু ধ্বনিত হলো গোটা এলাকা জুড়ে। দুহাত দূরত্বে এগিয়ে যাওয়া রিক্সা খানাও চলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো হুট করে। রাস্তায় ওপাশে ভুট্টা বিক্রেতাও চমকে উঠেছে। সেই সাথে চমকেছে আশেপাশের মানুষ জন। ভারি দেহ নিয়ে ছুটে আসতে গিয়ে অসাবধানতায় পা মচকে ফেললেন মিসেস চিত্রা। তবুও দুরন্ত নাতিকে বাঁচাতে শেষ প্রচেষ্টা চালাতে চিৎকার দিয়ে উঠলেন….
‘ দাদুভা…….ই !’
ধেয়ে আসা বিপদের দিকে রক্ত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাজহংসীর মতো দুই ডানা মেলে সায়ন কে বুকে আগলে নিলো রিদিমা। ওদিকে তার সেই সুরক্ষিত ডানার আশ্রয়ে ছোট্ট সায়ন লেপ্টে একাকার। থরথর করে কাঁপছে তার ছোট্ট দেহ। বেচারা তখনও বুঝে উঠতে পারে নি কি ভয়ঙ্কর বিপদ ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। ঠিক তখনই শোনা গেল চাকা ঘষার প্রবল শব্দ।
‘ ক্র্শশশশশশ ’
রিদিমা সায়ন কে বুকে জড়িয়ে টাল সামলাতে না পেরে উল্টে কাত হয়ে গড়িয়ে পড়লো কংক্রিটের রাস্তার উপরে। ছিলে একাকার হলো পৃষ্ঠদেশ, থেতলে গেল ডান হাতের কনুই। জুতোর হীল মচকে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটাও উগড়ে একাকার। অক্ষত সায়ন কে বুকে জড়িয়ে মেয়েটা যখন ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠেছে ঠিক তখনই হুড়মুড় করে কেউ ছুটে এসে হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিলো সায়ন কে। রিদিমা আস্তে ধীরে চোখ খুলে তাকালো। সমর কে দেখে আস্তে ধীরে উঠে বসলো কোনোমতে। এরই মাঝে চারিদিক থেকে হুটোপুটি করে ছুটে এলো লোকজন। দুজন মহিলা হাতাহাতি করে টেনে তুলল রিদিমা কে। ওদিকে সমর সায়ন কে বুকের সাথে মিশিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো একপাশে।
আহ্! পিতৃত্ব! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। যা একজন পাষাণের মনেও আপার অনুভূতির জোয়ার নামায়! তাকে বাঁচতে শেখায়! ভালোবাসতে শেখায়!!
ওদিকে রিদিমার হাতের কনুই বেয়ে রক্তের টাটকা স্রোত নামতে দেখে ভিড়ের মাঝে কোলাহল যেন বেড়ে গেল হুড়মুড় করে। রিদিমা কে ধরে রাস্তা পার করিয়ে নিয়ে আসা হলো সোসাইটিতে। কেউ একজন দৌড়ে ছুটে গিয়ে ফাষ্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। তুলো ছিঁড়ে অ্যান্টিসেপটিক লিকুইডে চুবিয়ে চেপে ধরলো ক্ষত স্থানে। কেউ একজন পায়ের অবস্থা দেখে হায় হায় করে উঠলো। সাথে সাথে সেখানেও ফাস্ট এইড করা হলো। সমর সায়ন কে বুকে জড়িয়ে সোসাইটির ভেতরে প্রবেশ করলো ধীর পায়ে। চিত্রা দেবী ছেলে আর নাতি কে দেখে ছুটে এলেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে। চোখ দুটো তার অশ্রু জলে সিক্ত। নাতি কে বুকে টেনে নিয়ে অজস্র চুমু খেয়ে বললেন,
“ এভাবে কেউ দৌড়ায় দাদুভাই? দেখোতো তোমার দুষ্টুমির কারণে আজ কত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল।”
“ সলি ঠাম্মা।”
সায়ন কাঁদতে কাঁদতে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরলো তার। মিসেস চিত্রা নাতি কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। কান্না ভেজা ভগ্ন কণ্ঠে আওড়ালেন,
“ হে ঈশ্বর! ভাগ্যিস মেয়েটাকে তুমি সময় মতো পাঠিয়েছিলে। না হলে যে কি হতো।”
বলে আবারো ডুকরে উঠলেন কান্নায়। এরই মাঝে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো চুমকি। চোখ মুখ কুঁচকে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“ ইস্, কি বিশ্রী ভাবে জখম হয়েছে মেয়েটা। কনুই থেতলে গেছে পায়ের নখ উগড়ে গেছে। বাম হাতের অবস্থা তো দেখাই যাচ্ছে না। রাস্তায় ঘষা খেয়েছে মনে হয়। চামড়া উঠে দগদগে সাদা মাংস বেরিয়ে এসেছে।”
মিসেস চিত্রা চোখ মুছে ভিড়ের দিকে তাকালেন। লোকজনের ফাঁকফোকর দিয়ে রিদিমার কান্না ভেজা মুখ খানা দেখে বললেন,
“ ভালো করে ওদিকে তাকিয়ে দেখ। যে মেয়েটাকে সেদিন তারছেড়া বলে অপমান করেছিলি আজ সেই মেয়েটাই নিজের জীবন বাজি রেখে তোর ছেলেকে এতো বড় বিপদ থেকে বাঁচালো। আজ যদি সময় মতো মেয়েটা না আসতো তাহলে কি হতে পারতো ভেবে দেখেছিস।”
সমর মায়ের কথায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ভিড়ের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ করে কেন জানি ভীষণ অনুতপ্ত হলো রিদিমার ব্যাথায় জর্জরিত মুখ খানা দেখে।
সত্যিই তো! আজ যদি মেয়েটা ওখানে না থাকতো তাহলে হয়তো বিরাট বাজে কিছু ঘটে যেতে পারতো সায়নের সাথে। কিন্তু মেয়েটা তা হতে দেয় নি। নিজের জীবনের পরোয়া না করে সায়ন কে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিপদের মুখে।
“ আমাদের ওনাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। দাদা, তাড়াতাড়ি কেউ একজন একটা ট্যাক্সি ডাকুন তো!”
ভিড়ের মধ্যে লোকজনের মুখে ট্যাক্সি ডাকার কথা শুনে আর দাঁড়ালো না সমর। ছেলেকে চুমকির কোলে তুলে দিয়ে বলল,
“ মা কে আর ওকে ঘরে নিয়ে যা। কুইক!”
বলেই শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে ভিড়ের মাঝে ঢুকে গেল সমর।
“ দেখি সরুন তো!”
বলে খপ করে কোলে তুলে নিলো রিদিমা কে। রিদিমাকে কোলে তুলে নিতেই বিস্ময়ে হতভম্ব হলো সকলে। তবে কেউ তেমন কিছুই মনে করলো না। অসুস্থ মেয়েটাকে আগে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া জরুরি। সেই সাথে তার চিকিৎসা টা ও।
ওদিকে রিদিমা নিজেও চমকে গেছে। বাক শক্তি মিলিয়ে গেছে বিস্ময়ের তোপে। কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে হুঁশ ফিরতেই খেঁকিয়ে উঠলো রিদিমা। মুচড়ে উঠে হাত পা ছুঁড়ে বলে উঠল,
“ এই এই দাঁড়ান, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। নামান বলছি!”
সমর রিদিমার কথায় তেমন একটা পাত্তাই দিলো না। বরং নিজের মতো লম্বা পা ফেলে গটগট করে হেঁটে চলে এলো পার্কিং এ। সমরের কেয়ার লেস ভাব দেখে রেগেমেগে করে বোম রিদিমা। শরীরের যন্ত্রণা ভুলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো,
“ কি হলো শুনতে পান নি। নামান, নামান বলছি আমাকে।”
সমর রিদিমার একটাও কথা শুনলো না। বরং জোর করে গাড়ির দরজা খুলে বসিয়ে দিলো মেয়েটা কে। রিদিমা জোর করে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করতেই সমর চোখ পাকিয়ে এক ধমক বসালো।
“ চুপ! আপনাকে নিয়ে প্রেম করতে যাচ্ছি না। হাসপাতালে যাচ্ছি বুঝেছেন! গলা ফাটিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করার আগে নিজের হাতে পায়ের দিকে তাকান। দেখেছেন কেমন রক্ত ঝরছে। এক্ষুনি ট্রিটমেন্ট না করলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।”
সমরের ধমক কে পাত্তা না দিয়ে রিদিমাও দ্বিগুণ স্বরে ধমকে উঠলো,
“ হোক ইনফেকশন। আমার হাত আমার পা আমার রক্ত। আমি বুঝবো। আপনার এত বুঝের দরজার নেই তো। খুলুন দরজা। নামান বলছি গাড়ি থেকে।”
রিদিমার কথায় রাগে ফুঁসে উঠলো সমর। জোর করে গাড়ির দরজা লক করতে করতে বলল,
“ খুলবো না। কারণ গাড়িটা আমার।”
অনেক ঝগড়াঝাটি আর চিৎকার চেঁচামেচির পর প্রায় পনের মিনিটের মাথায় সমরের গাড়ি পৌঁছলো একটা প্রাইভেট নার্সিংহোমের সামনে। সমর দ্রুত বেরিয়ে এসে দরজা খুলে রিদিমা কে আবারো কোলে তুলতে এলেই চিৎকার করে উঠলো রিদিমা।
“ খবরদার, আমাকে ছোঁবেন না বলে দিচ্ছি।”
সমর রিমলেস চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। রিদিমা ছটফট করতে করতে বলল,
“ বারে বারে এভাবে কোলে তোলার কী আছে আশ্চর্য? আমি কী একবারও বলেছি হাঁটতে পারবো না।”
সমর রিদিমার কথা শেষ হতেই সাথে সাথে সরে দাঁড়ালো। রিদিমা পায়ের ব্যাথা সয়ে কোনো মতে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলল নার্সিং হোমের ভেতরে। সমর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তেজি মেয়েটার তেজালো রুপ। হাতে পায়ের ব্যথা সয়ে খোঁড়াতে রাজি অথচ তার থেকে সাহায্য নিতে নয়।
তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রিদিমাকে সাথে সাথে ভর্তি করে নেওয়ায় ডাক্তার নার্স মিলে শুরু করলো ওর ট্রিটমেন্ট। পায়ের বুড়ো আঙুলে আর হাতের কনুই তে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাকি জায়গা গুলো ড্রেসিং করা শেষ হতে হতে হুড়মুড়িয়ে কেবিনে ঢুকলেন মিসেস মনিকা। চোখে মুখে তার উপচে পড়া চিন্তা দেখে রিদিমা অবাক চোখে তাকালো। মনিকা আহত মেয়েটা কে দেখে আবেগে ফুঁপিয়ে উঠলেন।
“ সুনু, সোনা মানিক আমার!”
বলেই ছুটে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
“ দেখি কোথায় কোথায় আঘাত লেগেছে?”
বলে রিদিমার হাত আর পায়ের ব্যান্ডেজ টায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন স্নেহময়ী ছোঁয়ায়। মায়ের কান্না দেখে রিদিমার সমস্ত অভিমান গলে গেল। ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ চিন্তা করো না মা। আমি একদম ঠিক আছি।”
রিদিমার কথা শেষ হতে না হতেই ব্যস্ত পায়ে কেবিনে প্রবেশ করলেন তপন বাবু। চোখে মুখে অন্ধকার ছড়িয়ে ছুটে এলেন মেয়ের কাছে। মেয়ের প্রতিটা আঘাতে চোখ বুলিয়ে ক্লেষে সিক্ত কণ্ঠে বললেন,
“ মা রে, তোর এ অবস্থা কি করে হলো?”
মনিকা মুখে আঁচল চেপে আবারো কেঁদে ফেললেন।
“ বার বার করে বলেছি রাস্তাঘাটে দেখে শুনে চলবি। দেখলি তো, বেখেয়ালি হয়ে চলার কারণে আজ কত বড় একটা বিপদ হয়ে গেল।”
“ ওনাকে বকবেন না ম্যাডাম। উনি সম্পূর্ন নির্দোষ।”
গমগমে পুরুষালি কণ্ঠের কথা গুলো কানে ভেসে আসতেই মনিকা আর তপন বাবু পেছন ঘুরে তাকালেন। সমর রিদিমার দিকে এক পলক তাকিয়ে এগিয়ে এলো ভেতরে। তপন বাবু আর মনিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আজ যদি উনি না থাকতেন, আমি জানি না আমার বাচ্চা টার কি হতো।”
“ মাফ করবেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
তপন বাবুর কথায় সমর হাত জোড় করে প্রণাম জানালো। ভীষণ সুন্দর ভাবে সম্মান জানিয়ে বলল,
“ নমস্কার, আমি সমর দত্ত। উনি যে আবাসনে পড়াতে যান সেখানের ‘বি’ ব্লকের ফিফথ ফ্লোরে থাকি আমি। আসলে আজ বিকেলের ঘটনা। আমার চার বছরের ছোট বাচ্চা টা আবাসনের গেট খোলা দেখে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে যায়। আমরা ওকে ঠেকানোর চেষ্টা করার আগেই ও মাঝ রাস্তায় পৌঁছে যায়। ওখানে মিস্ রিদিমা আমার সায়ন কে দেখতে পায়। আর ঠিক তখনই উল্টো দিক থেকে ছুটে আসে একটা গাড়ি। ভাগ্যিস ড্রাইভার সময় মতো ব্রেক কষে ছিল। আর না হলে হয়তো দুজনকে আজ আর….!”
মিসেস মনিকা মুখে আঁচল চেপে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো রিদিমার দিকে। তপন বাবু মেয়ের আঘাত দেখে যতোটা না কষ্ট পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি গর্ব বোধ করলেন বাচ্চাটা কে বাঁচাতে পেরে। ঠোঁট চেপে আবেগ সামলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ সাব্বাস মামনি। আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার উদারতা দেখে।”
রিদিমা বাবার কাছে পুরস্কার পেয়ে ব্যাথা ভুলে বসলো খুশির চোটে। চোখ দুটো ভিজে উঠলো আনন্দের অশ্রুতে। তপন বাবু মেয়ের চোখ দুটো মুছে দিতে দিতে বললেন,
“ এভাবেই জীবনে এগিয়ে যেয়ো মামনি। মনে রেখো তোমার উদারতাই তোমার আসল পরিচয়। বাকি সব কিছু ঠুনকো।”
তপন বাবুর কথায় মনিকা তেরছা চোখে তাকালেন তার দিকে। তপন বাবু মনিকার ওই দৃষ্টি দেখে ঠোঁট এলিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলেন। মনে মনে বললেন,
“ অপেক্ষায় থেকো মনি, আমি অবশ্যই একদিন প্রমাণ করে ছাড়বো তুমি আসলেই সেদিন ভুল ছিলে।”
চলবে…
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব: ৬
*
কেটে গিয়েছে মাঝ খানে দুই দুটো দিন। রিদিমার শারিরীক অবস্থাও এখন বেশ অনেকটাই ভালো। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রভাবে হাতে পায়ের ক্ষত গুলোর ব্যথাও বেশ কম। তখন সময় টা বিকেল। রিদিমা সদ্য ঘুম থেকে উঠে বসে ছিল হেডবার্ডে হেলান দিয়ে। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো টক টক করে। রিদিমা চোখ খুলে তাকাতেই হুট করে চমকে উঠলো অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে। হাতে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে ঘরে ঢুকলো তৃপ্তীশ। মুখে তার উপচে পড়া হাসি।
“ কেমন আছো রিদিমা।”
রিদিমা শুকনো ঢোক গিলে জানালো,
“ এই তো। আছি মোটামুটি।”
তৃপ্তীশ রিদিমার হাতে ফুল গুলো ধরিয়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো।
“ শুনলাম নাকি একটা বাচ্চা কে বাঁচাতে গিয়ে অসাবধানতায় এমন হয়েছে।”
রিদিমা শান্ত চোখে তাকিয়ে জবাব দিলো,
“ হুম্!”
রিদিমার ছোট ছোট জবাব শুনে তৃপ্তীশ বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না। রিদিমা ফুল গুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল আর আড় চোখে মাঝে মাঝে তৃপ্তিশ কে দেখছিল। ঠিক তখনই সেখানে ঢুকলেন তৃপ্তীশের মা মিসেস রিতা আর মিসেস মনিকা। রিদিমার দিকে তাকিয়ে তার ক্ষত গুলোতে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“ ডাক্তার কি বললেন ক্ষত’র ব্যাপারে।”
মনিকা মৃদু হেসে বললেন,
“ এই তো সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“ ঠিক হলেই ভালো। যাই হোক, শোন রিদিমা তোমার আর ওখানে পড়াতে যাওয়ার দরকার নেই। এমনিতেও তোমার ফাইনাল এক্সাম এর মাত্র কয়েক মাস বাকি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরীক্ষা শেষ হলেই তোমাদের চার হাত এক করে দেবো। তাই এই কটা দিন রেস্ট নাও বুঝেছো।”
রিদিমা মিসেস রিতার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। বিস্ময়ে হতভম্ব হলো তার চাহনি। মিসেস রিতার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো রিদিমা। দেখলো তার মা তাকে কেমন করে যেন এড়িয়ে যাচ্ছে সূক্ষ্ম ভাবে। রিদিমাকে আরেক বার ভালো করে দেখে নিয়ে মিসেস রিতা আর দাঁড়ালো না। ‘ এই বাবু, আয়! ’ বলে পেছন ঘুরে বেরিয়ে গেল দাম্ভিক পায়ে। মা চলে যেতেই তৃপ্তীশ ও উঠে দাঁড়ালো। রিদিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ মা কি বলল শুনলে তো। ওখানে আর পড়াতে যাওয়ার দরকার নেই তাহলে। আর শোন, ব্যস্ততা দেখিয়ে রোজ রোজ ফোন কেটে দাও এটা কিন্তু আজকের পর থেকে একদমই মেনে নেব না আমি। তাই যখনই কল করবো ভদ্র মেয়ের মতো ফোন রিসিভ করবে ঠিকাছে।”
বলেই তৃপ্তীশ বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। রিদিমা প্রথম দফায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেও পরবর্তী দফায় ফুঁসে উঠলো রাগে। কোলের উপর থাকা রজনীগন্ধা গুলোকে দলামোচড়া করে মেঝেতেছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
“ মা!”
মনিকা সদ্য অতিথি বিদায় দিয়ে দরজায় খিল দিয়েছেন তখনই মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলেন। মা মা করে বেশ কয়েকবার গলা ফাটানোর পর যখন মনিকা এলেন না রিদিমা ব্যথা পায়েই উঠে এলো বাইরে।
“ মা! আমি তোমাকে বার বার করে বলিনি আমার এই বিয়েতে মত নেই। আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করবো না। তাহলে আজ কোন সাহসে ওরা মা ছেলে এসে আমাকে নসিহত দিয়ে যায়।”
মনিকা মেয়ের উগ্র রুপ দেখে আজ আর রেগে গেলেন না বরং শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। রিদিমা এমনিতেই চুপচাপ চরিত্রের মেয়ে। আজ অতিরিক্ত উত্তেজনায় রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে হাঁফিয়ে উঠলো একেবারে। এতো এতো উত্তেজনা দেখানোর পরও যখন মায়ের তরফ থেকে কোনো রকম ফিরতি জবাব পেল না তখনই কেঁদে ফেলল হুহু করে। কাঁদতে কাঁদতে হুট করেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো,
“ তোমরা আমার সাথে এমন কেন করছো? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমাদের বলো। কেন আমার জীবন টা শুরু হওয়ার আগেই নরকে পরিণত করছো তোমরা?”
“ আমরা তোমার জীবন টা কে নরক বানিয়ে দিচ্ছি। তোমার জীবন টা শেষ করে দিচ্ছি আমরা। শোন সুনু, তোমার জন্য সুপাত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া টা যদি তোমার জীবন টাকে নরকে পরিণত করার সমান হয় তাহলে তাই সই।”
রিদিমা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
“ মা, আমি কি তোমাদের সংসারে অতিরিক্ত হয়ে গেছি বলো। যদি তাই হয় তাহলে বলে দাও। আমি আজ এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
“ হ্যাঁ, ওটাই তো পারো। বাবা মা কে ভুল বোঝা, রাগ দেখিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। দিন দিন পড়াশুনা শিখে তো এসব গুণ গুলোই আয়ত্ব করছো তাইনা।”
রিদিমা মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। ও যে এতগুলো দিন ধরে বার বার করে নিজের কষ্ট গুলো জানালো সেসব কথা মায়ের কানে একটা বারও গেল না। অথচ যেই না বাড়ি ছাড়ার কথা বলল অমনি শুনতে পেল। রিদিমা আর কাঁদলো না। ওর বোঝা হয়ে গেছে মা কোনোদিনও ওর মনের কথা বুঝবে না। রিদিমা চোখের জল মুছে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। কয়েকপা হেঁটে এসে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,
“ একটা কথা বলোতো মা, আমি সত্যিই তোমার নিজের মেয়ে তো?”
“ সুনু। ”
“ বলো মা আমি শুনছি। আজ আমিও জানতে চাই আমি আসলেই তোমার সন্তান কি না। যার কাছে বাইরের মানুষের ইচ্ছে তাদের মতামত তার নিজের সন্তানের মতামতের চেয়ে বেশি দামী। সে সত্যি সত্যিই আমার জন্মদাত্রী মা কি না আমি আজ জানতে চাই।”
মিসেস মনিকা রিদিমার বেয়াদপি সহ্য করতে না পেরে ঠাস্ করে চড় বসিয়ে দিলেন রিদিমার ডান গালে। তপ্ত চোখে চেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
“ আর একটা আজেবাজে কথা বললে তোর মুখ ভেঙে দেবো আমি অভদ্র মেয়ে। কি ভেবেছিস কি তুই! তোর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমরা দমে যাবো। আমাদের মত পাল্টে ফেলবো। কক্ষনো না। তোর বিয়ে যে তারিখে ঠিক করা হয়েছিল ঠিক সেই তারিখেই হবে। তুই চাইলেও হবে আবার না চাইলেও হবে বুঝেছিস।”
রিদিমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মুখে হাত চাপা দিয়ে। রাগে ক্ষোভে মনে হলো গোটা বাড়ির সব কিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে। ঠিক তখনই আবারো কলিং বেল টা বেজে উঠলো। মনিকা রিদিমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজা খুলতে। রিদিমা আর সেখানে দাঁড়ালো না। ব্যাথা পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল নিজের ঘরে।
“ আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
এক জন প্রৌঢ়া মহিলার সাথে একটা চারপাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে কে দেখে ভ্রূ কুঁচকে গেল মিসেস মনিকার। মিসেস চিত্রা হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। মিষ্টি করে হেসে বললেন,
“ নমস্কার দিদিভাই, আমি সমরের মা।”
“ সমর…!
বলেই মিসেস মনিকা মনে করার চেষ্টা করলেন। মিসেস চিত্রা তার সুবিধার জন্য বললেন,
“ ওই যে সেদিন রিদিমাকে যে হাসপাতালে..!”
“ ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। আসুন, আসুন! ভেতরে আসুন।”
মিসেস চিত্রা সায়ন কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। মিসেস মনিকা তাকে বসার ঘরের সোফায় বসালেন যত্ন করে। সায়নের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ এই বুঝি আপনার সেই দুষ্টু নাতি।”
মিসেস চিত্রা সায়নের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হাসলেন গাল ভরে। মিসেস মনিকা সায়নের দিকে তাকালেন। বাচ্চাটার টোপা টোপা ফুলো গাল জোড়া দেখে খুব আদর পেল মনে। সায়ন কে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ কি নাম তোমার বাবু?”
“ থায়ন দত্ত।”
“ বাহ্ খুব সুন্দর নাম তো তোমার।”
সায়ন ভদ্র বাচ্চার মতো ঠোঁট ছড়িয়ে একটু খানি হাসলো কেবল। কিন্তু তার চোখ জোড়া সারাঘরময় ঘুরে বেড়ালো ম্যাম কে দেখার উদ্দেশ্যে। মিসেস মনিকা বাড়িতে অতিথি এসেছে বলে চা জলখাবার বানানোর জন্য ব্যস্ত হচ্ছেন দেখে মিসেস চিত্রা সাথে সাথে বাঁধা দিলেন তাকে। হাত ধরে বললেন,
“ দিদিভাই, দয়া করে কোনরকম আয়োজন করবেন না। আমরা শুধু রিদিমাকে দেখতে এসেছি। মেয়েটা সেদিন যে পরিমাণ আঘাত পেয়েছিল উফ্। সে যে কি ভয়ঙ্কর, আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
মিসেস মনিকা রিদিমার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তখন অসুস্থ মেয়েটার ওপর ওভাবে তিনি গায়ে হাত তুলতে চান নি। কিন্তু মেয়ের মাত্রাতিরিক্ত বেয়াদপি ও সহ্য করতে পারেন নি।
“ ও থাম্মি থাম্মি আমার ম্যাম কোথায়?”
সায়নের ডাকে সাড়া পেয়ে নড়ে উঠলেন মিসেস মনিকা। সায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ এসো আমার সাথে। তোমার ম্যাম ওই ঘরে আছে।”
রিদিমার ধৈর্য যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে। বান ডেকেছে চোখে। মায়ের হাতের চড় তাকে ততটাও ব্যথা দেয় নি যতোটা ব্যথা পেয়েছে তাদের তার প্রতি উদাসীনতা দেখে। ঠিক আর কতবার বললে আর কতভাবে বোঝালে তার মা বাবা বুঝতে পারবে সে এই বিয়েটা করে কখনও সুখি হবে না। বরং দুঃখের সাগরে ডুবে যাবে সে চিরতরে। রিদিমা বালিশে মুখ গুজে কাঁদছিল। হৃদয় ভেঙে আছড়ে পড়েছিল তার বাঁধ ভাঙা নীরব অশ্রুর ঢল। ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষের দরজায় টোকা পড়লো। মায়ের উপর অভিমান করে রিদিমা শুনেও সাড়া দিলো না।
“ ঠক ঠক! ঠক ঠক!”
এবার পরপর দুবার আওয়াজ হলো। রিদিমা কান্না থামিয়ে বালিশ থেকে মুখ তুলে তাকালো। বিরক্ত হয়ে কন্ঠে ঝাঁঝ তুলে বলে উঠলো,
“ চিন্তা করো না। আমি মরিনি।”
বলে আবারো যেই শুতে যাবে ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো এক মৃদু মিষ্টি শিশু কন্ঠ।
“ ম্যাম।”
আচমকা সায়নের গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো রিদিমা। সাথে সাথে চোখ মুখ মুছে দরজার দিকে তাকালো। অপেক্ষা করতে লাগলো সায়নের মিষ্টি ডাক শুনে হৃদয় তৃপ্ত করার। ঈশ্বর হয়তো ওর মনের কথা শুনে বেশি অপেক্ষা করালেন না। সায়ন এবার বেশ জোরেই ডেকে উঠলো,
“ ও ম্যাম ম্যাম। আই অ্যাম সলি ।”
রিদিমা আর এক দন্ড সময়ও নষ্ট না করে ছুটে এসে দরজা খুলে সায়ন কে তুলে নিলো কোলে। সায়নের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ সায়ন, বাবু! কার সাথে এসেছো তুমি এখানে?”
সায়নের অত কিছুতে হুঁশ নেই। সে তার প্রিয় ম্যাম কে পেয়ে গলা জড়িয়ে নিশ্চিন্তে মাথা এলিয়ে দিয়েছে কাঁধে। যেন কত শত জনমের পরিচয় তার রিদিমার সাথে। রিদিমা নিজেও অনুভব করলো তার একটু আগের রাগ অভিমান সব কিছু যেন একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে। উত্তেজনার প্রকোপে তার বক্ষস্থলের পাঁজরে পাঁজরে যে অদ্ভুত যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো ও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। রিদিমা সায়নের গালে গাল ঠেকিয়ে আলতো করে চুমু খেল। আরেকটু শক্ত করে সায়ন কে জড়িয়ে ধরতেই মিসেস চিত্রা সামনে তার এসে দাঁড়ালেন। রিদিমা তাকে দেখে একটু স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতে গেলে তিনি বললেন,
“ কেমন আছো রিদিমা?”
চলবে..