তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
18

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
(৩১)

রিদিমার নরম গাল জোড়ায় লাজের রক্তিম আভা। তারা ক্ষণে ক্ষণে ফেঁপে উঠছে উষ্ণতায়। চোখের সামনে চকচক করছে উজ্জ্বল পর্দা, যেখানে ভেসে উঠেছে সেই প্রেমের অমোঘ বার্তা খানা। যেটা গতকাল রাতে চুপি চুপি এসেছিল। আর তারপর শেষ রাতের অন্তিম লগ্নে পদার্পণ করেছিল রিদিমার হৃদ জমিনের সেই স্থানে যেখানে কারও ছাপ পড়েনি অতীতে। সেই গত রাত থেকে তোলপাড় করা ভালোলাগায় ভেসে গেছে রিদিমার মন। প্রণয়ের গোপন অভিসার তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কানে কানে যেন বলে চলেছে প্রতি টা মুহূর্তে,
“ তিরি রারা রুরু
মন উড়ু উড়ু
প্রেম হলো শুরু মনে হয়….”
ইস্! শ্যামলতা! কত আবেগ কতটা অনুভূতির মিশেলে সাজানো এই ছদ্ম নাম টা ভাবতেই রিদিমা যেন বারে বারে ডুবে যাচ্ছিল কল্পনার সেই অন্তহীন সুখসাগরে। আজ পর্যন্ত কেউ কোনদিন তাকে এত সুন্দর নামে ডাকে নি। কেউ কখনও তার হৃদয়ে তোলপাড় করা ভালোলাগার জোয়ার তুলে দেয় নি। কেউ কখনও তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে এভাবে রাজত্ব করেনি যেমন টা ওই গম্ভীর অথচ পর্বতের ন্যায় অটল মানুষটা তার কাছে না থেকেও করছে। আর না সে কারও জন্য কখনও এতো অস্থির হয়ে এতো হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করেছে যেমনটা আজ সকাল থেকে করছে। রিদিমা ফোনের স্ক্রিনে ভাষা মেসেজ টা এই নিয়ে বোধহয় দেড়শ বার পড়লো। কিন্তু তাও যেন মনে হচ্ছে এটা তার প্রথম বার পড়া। রিদিমা আপন মনেই হেসে ফেললো হঠাৎ। নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে ভাবলো, সে বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে লোকটার প্রেমে পড়ে। ইস্, এসব কথা যদি কেউ জানে তাহলে আচ্ছা কেলেংকারী হবে।

সমর দরজায় দাঁড়িয়ে ঠোঁট মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে অবনীর দিকে। এদিকে অবনী হেসেই যাচ্ছে খি খি করে। যার যেন থামার নাম গন্ধ নেই। সমর আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। গম্ভীর গলায় বলল,
“ থামবি এবার।”
অবনী হাসতে হাসতে মাথা দুপাশে নাড়ালো। অর্থাৎ সে থামবে না। সমর বিরক্তি চেপে ভেতরে ঢুকে জুতো জোড়া খুলতে খুলতে আবারো এদিকে ওদিক নজর বোলালো। না, সেই স্নিগ্ধ মুখটা এবারও দেখা দিলো না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মিসেস চিত্রার ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো লাবনী। তার মুখটাও হাসি হাসি। তবে অবনীর মতো খিলখিলে নয়। সে এগিয়ে এলো সমরের কাছে। সুন্দর করে বলল,
“ কেমন আছো দাদাভাই?”

সমর গম্ভীর মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,
“ ভালো, তোরা কেমন আছিস।”
“ এই তো বেশ ভালো।”
বলেই আলতো করে মাথা দোলালো। সমর আরেকটু এগিয়ে আসতেই ডাইনিং টেবিলে সোমেনের দেখা পেল। সে ফোন টিপছিল বসে বসে। হঠাৎ চোখাচুখি হতেই
“ আরে ব্রাদার! হোয়াটস আপ ব্রো!”
বলেই উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো দুহাতে জাপটে। সমর ও হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলো এক হাতে। তিশা সমর কে দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঠোঁটের ভাঁজে একঝাঁক হাসি এঁটে বলল,
“ কেমন আছেন ছোড়দা?”
সমর চমকে তাকালো তিশার দিকে।
“ আরে বৌ মনি, আপনি। হোয়াট আ লাভলি সারপ্রাইজ।”
“ মোটেও না। সারপ্রাইজ তো আমরা হয়েছি আপনার মিসেস কে দেখে। ইস্, কতো প্ল্যান করে এসেছিলাম আপনাদের চমকে দেবো। অথচ কি চমক টাই পেলাম আমরা।”
তিশার কথায় সমর আলতো করে হাসলো শুধু। জবাবে তেমন কিছুই বলল না। ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলের দুটো চেয়ার টেনে দুবোন বসে পড়েছে ইতিমধ্যে। মিসেস চিত্রা এসে বললেন,
“ তোর জন্য সবাই না খেয়ে বসে আছে। কতবার করে বললাম। কেউ দানা টুকু মুখে তুলল না। তাড়াতাড়ি যা। গিয়ে চান সেরে আয়। আমি আর চুমকি খাবার বাড়ছি।”
সমর মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ সায়ন কোথায় মা!”
মিসেস চিত্রা খাবারের প্লেট গুলো সাজাতে সাজাতে দায়সারা ভাবেই উত্তর দিলেন,
“ ওর মায়ের কাছে। ঘুমোচ্ছে।”
সমরের বুকটা বুঝি আবারো শীতল হয়ে এলো। এলো তো! মায়ের কাছে কথাটা যেন মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো মনে হলো সমরের কাছে। আহ্ হা রে তার জনম দুখী বাচ্চাটা! মা থাকতেও কোনোদিন মায়ের আদর তো দূরে থাক কোল টুকুও সেভাবে পায় নি। আর আজ বুঝি সত্যিই মায়ের কোল পেল। সমর গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকা ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে পা বাড়ালো নিজের রুমের উদ্দেশ্যে।

টেবিলে তখন গল্পের আসর বসেছে। সোমেন তিশা কে ক্ষেপাতে এক একটা কথা বলছে আর তাতেই খিল খিল করে হাসছে অবনী আর লাবনী। তিশাও কম যায়না সেও সমান তালে তাল মিলিয়ে জবাব দিচ্ছে সোমেনের কথার।
সোমেন পাতে রাখা শসা টা মুখে পুরে খচর মচর করে চিবোতে চিবোতে বলল,
“ বুঝলে বড় মামী, তোমরা চলে আসার পর আর মামা বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। আগে কতো আনন্দ হতো বলো। বড় মামা ছোট মামা মা তুমি ছোট মামী মাসি আর আমরা ভাইবোন কটা। ওহ্, ছুটির দিন গুলোতে কি মজাই না হতো বলো।”
মিসেস চিত্রা সেই স্বর্ণালী দিন গুলো মনে করে একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আসলেই সেই পুরনো দিন গুলো ভীষণ সুন্দর ছিল। যেখানে ছিল ঝর্নার কলকলে স্বচ্ছ ধারার ন্যায় হাসি খুশি আর আনন্দরা। আর সেই খুশির জোয়ারে প্রবহমান সুখের মুহূর্ত গুলো। সোমেন তখনও বলে চলেছে,
“ বড় মামা মারা যাওয়ার পর সব খুশি সব আনন্দরা কেমন যেন হারিয়ে গেল কোথাও। আর তারপর সমরের ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর তো….”
“ ওসব আলোচনা এখন থাক না হয়। তাছাড়া এমনিতেই আমি ওসব আর মনে করতে চাই না।”
মিসেস চিত্রার কথার ভাঁজে লুকোনো প্রগাঢ় কষ্টটা যেন সবাই বুঝতে পারলো। একটু দূরে দাঁড়ানো রিদিমা ও যেন উপলব্ধি করতে পারলো অনেক কিছু। এরই মধ্যে সাদা টিশার্ট এর সাথে আর পোলোর ধূসর রঙা ডেনভার স্লিম ট্রাউজার পরে সমর কে নামতে দেখে অবনী চেয়ার ছেড়ে দৌড় লাগালো। ওকে দৌড়াতে দেখে সবাই কিছুটা চমকে উঠলেও কেউ কিছুই বলল না। কারণ, কারণটা সবার জানা। অবনী রিদিমাকে এক হ্যাঁচকা টানে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা চাপিয়ে বলল,
“ উফ্ বৌদি ভাই দিচ্ছিলে তো আমাদের মজা টা নষ্ট করে।”
রিদিমা অবাক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতেই অবনী বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“ আরে বাবা, আমরা দাদাভাইয়ের কাছ থেকে ডোনেশন আদায় করবো বলে তোমাকে লুকিয়ে রাখছি বুঝেছো।”
রিদিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“ উনি সত্যিই দেবে?”
“ দেবে না মানে। দিতে বাধ্য।”
“ আর যদি না দেয়!”
“ তাহলে আমরাও ওকে বউ দেবো না।”
রিদিমা ফিক করে হেসে ফেলল অবনীর কথা শুনে। অবনী নিজেও হাসলো তা দেখে। তারপর আবার দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষন পর চুমকি প্লেট সাজিয়ে ওকে খেতে দিয়ে গেল। আর এই সব কিছুই হলো সমরের চোখের আড়ালে। সে এসে সোমেনের পাশের চেয়ার টা টেনে বসলো। স্বভাব সুলভ ভাবে গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে থাকলেও তার চোখ জোড়া সবার অলক্ষ্যে ঘরময় ঘুরে বেড়ালো আবারো সেই স্নিগ্ধ মুখটা দেখার আশায়। কিন্তু সেগুড়ে বালি। কোথাও তার ছায়া টুকুও পাওয়া গেল না।
লাবনীর নজর শুরু থেকেই সমরের উপর ছিল। সে একটু কাছ ঘেঁষে নিচু গলায় বলল,
“ অমন করে কাকে খুঁজছো দাদাভাই!”
সমর যেন থতমত খেল। লাবনী ফিক করে হেসে উঠে বলল,
“ শোনো দাদাভাই, বৌদি ভাই এখন আমাদের হেফাজতে। তাকে যদি পেতে চাও তাহলে পকেট ঢেলা করো। ফাইন না দিলে কিন্তু তাকে পাওয়া তো দূর দেখতেও পাবে না বুঝেছো। ”
সমর লাবনীর কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। লাবনী হাতের মুঠো আলগা করে একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো সমরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ বেশি না, মাত্র পঞ্চাশ হাজার। নো বার্গেনিং। দিয়ে দিলেই বৌদি ভাই কে পেয়ে যাবে।”
সমর কোনো কথা বলল না। ওর বোঝা হয়ে গেছে এদের মতলব। তাকে ফাঁদে ফেলে টাকা হাতাতে চাইছে সব কটা মিলে। তবে এই প্রথমবার ভীষণ ভালো লাগলো। ভাইবোন গুলোর আবদার করা দেখে। প্রথমবার বিয়ের সময় সে প্রিয়া আর ইউনিভার্সিটির কয়েকজন বন্ধু বান্ধব ছিল। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে যেতেই তারা চলে গেছিল। তারপর শুরু হয়েছিল তাদের সংসার জীবন। তাও খুবই এলোমেলো ভাবে। তাতে না ছিল এতো আনন্দ আর না ছিল গভীর ছন্দে রচিত এক একটা মুহূর্ত। সমর খাবার খেতে খেতে আড় চোখে এক পলক মায়ের রুমের বন্ধ করা দরজার দিকে তাকালো। তারপর চুপচাপ খাওয়া শেষ করে চলে গেল নিজের ঘরে। সমরের চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়া দেখে লাবনী অবনী আর সোমেনের মুখ ঝুলে পড়লো চিন্তায়। তারা ভেবেই নিলো সমর এই বিয়েতে বোধ হয় ততটাও আগ্রহী না। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে লাবনীর অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা ট্রান্সফার করে দিলো। তারপর নিচে ছোট্ট করে লিখলো,
“ তোর বৌদি ভাইকে বল, আমার মাথা ধরেছে। এক কাপ কফি লাগবে, এক্ষুনি।”

চলবে..

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
(৩২)

মিসেস চিত্রার ঘরে তখন গল্পের আসর বসেছে। রিদিমাকে মধ্যমণি বানিয়ে দুপাশে বসেছে তিশা আর অবনী। লাবনী আরেক পাশে বসে। কোলে তার কোলবালিশ। সায়ন ঘুমোচ্ছে আরেক পাশে। সবার সামনে পুরোনো এলবাম টা বার করে মেলে ধরা। মিসেস চিত্রা একে একে বাড়ির সবার ছবি দেখাচ্ছেন আর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন রিদিমার সাথে।

“ এই দেখো, এটা তোমার বড় পিসি শাশুড়ি আর তার স্বামী। মানে সোমেনের মা বাবা। এই হলো তোমার ছোট পিসি শাশুড়ি আর তার যমজ দুই মেয়ে তিন্নি আর তান্না। এরা সবাই শিলিগুড়ি তে থাকে।”

কথা বলার ফাঁকে পাতা উল্টাতে গিয়ে একটা একুশ কি বাইশ বছরের দুজন যুবক ছেলের ছবি বেরিয়ে এলো। যারা দুজনই পকেটে হাত গুঁজে দারুন একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবনী খপাত করে এলবাম টা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। তারপর দুষ্টু হেসে রিদিমাকে দেখিয়ে বলল,
“ বলো তো বৌদি ভাই এদের মধ্যে সমর দাদাভাই কোনটা?”

রিদিমা দুজন কে ভালো করে দেখলো। ছেলে দুটো বড্ড হ্যাংলা পাতলা। তবুও সাজ পোশাক দেখে মনে হচ্ছে তারা বেশ ব্যক্তিত্ব পূর্ণ। রিদিমা ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝলো ডান পাশের জন সোমেন আর বাম পাশের জন তার একান্ত আপন মানুষটা। রিদিমা আলতো করে আঙুল তুলে সমর কে দেখিয়ে দিতেই অবনী হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“ একদম ঠিক। এটা দাদাভাইয়ের কলেজ জীবনের ছবি। দেখো কেমন রোগা পটকা দেখতে ছিল তখন। অথচ এখন, বাইশেপ গুলো দেখলেই ভয় লাগে আমার।”

তিশা সেই কথার জের টেনে বলল,
“ একদম ঠিক বলেছ। ছোড়দা কিন্তু নিজের প্রতি ভীষণ কেয়ারফুল। খাবার খাওয়ার সময়ই তো দেখলাম কত পরিমিত মাত্রায় খেল। আর এদিকে আমাদেরটা কে দেখো, কোনো নিয়ম মানে না। কোনো রকম কন্ট্রোল নেই জ্বিভে। যা পাচ্ছে সারাক্ষণ গরুর মত খাচ্ছে।”

তিশার ভর্ৎসনা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল অবনী। লাবনী ও হাসলো ঠোঁট টিপে। রিদিমার হাসি পেলেও অতি কষ্টে সামলে নিলো নিজেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে টুং টুং করে পর পর দুটো মেসেজ ঢুকলো লাবনীর ফোনের মেসেজ অ্যাপ্লিকেশনে। সাথে সাথে ফোনটা হাতে তুলে চেক করতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো লাবনী।

“ ওহ্ মাই গড! ওহ্ মাই গড! ওহ্ মাই গড!”

লাবনীর চিৎকার শুনে সকলে তটস্থ নজরে তার দিকে তাকাতেই লাবনী ফোনটা ঘুরিয়ে সবার সামনে তুলে ধরলো। তিশা ফোনটা কেড়ে চোখের সামনে মেলে ধরতেই তারও চোখ জোড়া গোল হয়ে গেল বিস্ময়ে। চমকের আড়ম্বরে জমে কি রিয়াকশন দেবে বুঝে উঠতে পারলো না বেচারী। ওদিকে রিদিমা আর অবনীর ও সেম দশা। তাদেরও যেন কিছুতেই বিশ্বাস হলো না সমর আসলেই টাকাটা পাঠিয়েছে কোনো রকম কোনো কথা না বলে। বিস্ময়ের চমক ভেঙে তিশার চোখ গিয়ে পড়লো সেই কফি পাঠানোর মেসেজটার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে রিদিমা কে কাঁধ দিয়ে আলতো ধাক্কা দিলো সে।
দুষ্টু হেসে বলল,
“ এই যে ম্যাডাম, হেড অফিস থেকে আপনার ডাক এসেছে। যান গিয়ে কফি খাইয়ে আসুন।”

রিদিমা পারে না লজ্জায় মরে যায়। সে তড়িঘড়ি করে উঠে ছুটে পালালো রান্না ঘরে। সে যেতেই বাকিরা সবাই এক চোট হেসে নিলো। তিশা মিসেস চিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“ বুঝলেন বড় মামী, পরিস্থিতি যা দেখছি তাতে বোধ হয় সামনের বছরেই সায়নের ছোট ভাই বোন আসতে পারে বলে মনে হচ্ছে।”

মিসেস চিত্রা জবাবে কিচ্ছু বললেন না। শুধু নীরবে হেসে গেলেন। কথায় বলে মায়ের নজর নাকি বড্ড অশুভ। সন্তানের সুখে নাকি তারই নজর বেশি লাগে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চুপ হয়ে থাকবেন। যাতে তার ছেলেটা এবার সত্যি সত্যিই যেন সুখের মুখ দেখে। ঘর ভরা বউ সন্তান দের নিয়ে সুখে শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটায়।
_____

কফির মগ টা ট্রেতে নিয়ে দোতলায় ওঠার সময় রিদিমার পা জোড়া যেন ঠক ঠক করে কাপছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় নয় পর্বতের চূড়ায় উঠছে এমন। মন মস্তিষ্কে সদ্য গজানো অনুভূতিদের সামলে নিয়ে রিদিমা শেষমেষ সমরের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আঁচল টা টেনে গা ঢেকে দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। রিদিমা আস্তে ধীরে ভেতরে ঢুকলো। রুমের চারিদিকে নজর বুলিয়ে মানুষটাকে খুঁজতে নিলেই ব্যালকনি থেকে ভেসে সমরের ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“ রিদিমা! আমি এখানে।”

সমরের আওয়াজ শুনে নরম পায়ে সেদিকে এগোলো রিদিমা। দেখলো মানুষ টা বরাবরের মতো দুহাত পকেটে গুঁজে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে গ্রিলে হেলান দিয়ে। রিদিমা কফির মগ টা এগিয়ে দিতেই সমর সামনের বিন ব্যাগ দেখিয়ে বলল,
“ বসো।”

রিদিমা আস্তে ধীরে গিয়ে সেখানে বসলো। জড়তা কাটিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই আবারো যেন স্থবির হয়ে গেল বিস্ময়ে। আসলে সেদিন রাতে এসেছিল বলে এই ছোট ব্যালকনির সাজ সজ্জা সৌন্দর্য তার চোখ এড়িয়ে গেছিল। তবে আজ যেন তার স্বরুপ নিয়ে হাজির হয়েছে রিদিমার সামনে। রিদিমা অপলক তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
কি সুন্দর ব্যালকনিটা। একপাশ ঘেঁষে কাঠের আধুনিক স্ট্যান্ড বসানো। যার উপর বড় বড় কয়েকটা টবে নাম না জানা ইনডোর প্লান্ট। বাতাসের ছোঁয়ায় তাদের চকচকে সবুজ মসৃণ পাতা গুলো আলতো করে করে দোল খাচ্ছে। গ্রিলের একাংশ জুড়ে শেকল বাঁধা ছোট ছোট টব ঝুলছে। তাতেও বিভিন্ন ধরনের ইনডোর প্লান্ট লাগানো। রিদিমা সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এক সময় হারিয়ে গেল যেন। ঠিক তখনই সমর গলা খাকারি দিলো। শব্দ পেয়ে রিদিমা চেতনা পেতেই সমর খালি মগ টা একপাশে রেখে আবারো তাকালো সামনের দিকে। সমরের আব ভাব দেখে রিদিমা বুঝলো মানুষটা বোধ হয় তাকে কিছু বলতে চায়। হয়তো আগের দিনের অপূর্ন কাহিনী আজ শেষ করতে চায়। তার ধারণা কে সত্যি করে দিয়ে সমর সত্যি সত্যিই বলে উঠলো,
“ রিদিমা, যেহেতু আমরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। তাই কিছু গুরুত্ব পূর্ন বিষয় প্রথম থেকেই ক্লিয়ার হওয়া উচিত।”

বলেই রিদিমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সেই আগের মতো কাঠিন্যে মোড়ানো জলদ গম্ভীর অভিব্যক্তি এঁটে বলল,
“ আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিসিয়াস যদি কিছু থেকে থাকে সে হলো আমার সন্তান, আমার সায়ন। এই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বস্তুও আমার কাছে মূল্যহীন যখন বিষয় টা তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সুতরাং বুঝতেই পারছো সে আমার কাছে ঠিক কতটা দামী।”

রিদিমা বুঝলো কিন্তু প্রত্যুত্তর করলো না। সমর বলে চলল,
“ আমি ডিভোর্সী এবং সন্তান আছে জানা সত্ত্বেও বিগত কয়েক বছরে অনেক বড়লোক বাবারা তাদের সুন্দরী শিক্ষিতা চাকরি জীবী মেয়েদের বিয়ে করার জন্য সরাসরি অফার করেছেন। কয়েকজন তো রীতিমত সম্পত্তির লোভ ও দেখিয়েছেন বিয়েতে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি সে সবে পাত্তা দিই নি। কারণ, আমি কখনই চাই নি নিজের সুখ দেখতে গিয়ে আমার সন্তানের জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠুক। নিজের বাড়িতেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ুক। এতো দিন মা হারা হয়ে থাকার পর সৎমায়ের আগমনে বাবার কোল টুকুও হারিয়ে যাক অবহেলায়, অনাদরে। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এজীবনে আর কোনোদিন কাউকে বিয়ে করবো না আমি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেই শেষমেশ করতেই হলো। যাই হোক, যে কথা বলতে তোমায় ডাকা।
সায়ন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটে বছর মায়ের স্পর্শ ছাড়াই ইতিমধ্যেই কাটিয়ে ফেলেছে। আমি কোনোদিনও তাকে এক মুহূর্তের জন্য মায়ের অভাব বুঝতে দেই নি।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। সম্পর্কের বেড়াজালে জড়িয়ে তার মায়ের স্থানটা আজ তুমি পেয়েছো। আমি কখনও তোমাকে জোর করবো না তাকে আদর করার জন্য। আর না কখনও তার মায়ের অভাব পূরণ করতে বলবো। ওর ঐ অভাব পূরণ করার জন্য তার পাপাই যথেষ্ট।
তাই তোমার কাছে শুধু মাত্র একটাই অনুরোধ, আমার ছেলেটা কে ভালোবাসতে না পারো তাকে কোনোদিন ঘৃণা করো না। ওকে মাতৃত্ব না দিতে পারো অন্তত বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ করে কষ্ট দিয়ো না কোনোদিনও।
আমি কথা দিচ্ছি, আজীবন তোমার আর আমাদের ভবিষ্যত সন্তানদের প্রতি একজন দায়িত্ববান স্বামী ও বাবার কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করবো। কিন্তু তার বিনিময়ে আমার সায়ন যেন এতটুকুও অবহেলা না পায়।”

দীর্ঘ কথন শেষ করে সমর শান্ত হলো যেন। বুকের গভীরতায় গিয়ে মিশে থাকা প্রশ্বাস টুকু নাসারন্ধ্র গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সেই বিয়ের প্রথম দিন থেকেই কথাগুলো সমরের বুকে পাথরের মতো চেপে বসে ছিল। আজ যেন তা মুক্তি দিয়ে হালকা হালকা লাগছে নিজেকে। বেশ স্বস্তি অনুভূত হচ্ছে তার হৃদয়ে। সমর বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে রিদিমার দিকে তাকালো। দেখলো মেয়েটা কেমন যেন অনড় হয়ে বসে আছে চুপ করে। সমর সেদিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। সময় গড়ালো বেশ কিছুক্ষণ। রিদিমা তবুও ওভাবে বসে আছে দেখে সমরের অস্বস্তি হতে শুরু করলো। সে গলা ঝেড়ে বলল,
“ রিদিমা, আর ইউ ওকে? দেখো আমি কিন্তু তোমাকে হার্ট করতে কথা গুলো বলিনি। আমি জাস্ট আমার সায়ন কে নিয়ে ওরিড হয়েছি মাত্র।”

রিদিমা এ পর্যায়ে এসে মুখ খুলল। মৃদু হেসে বলল,
“ আপনি কি জানেন, আপনি নিঃসন্দেহে একজন ভীষণ ভালো বাবা। সায়ন ভীষণ ভাগ্যবান। সে আপনার মতো একজন মানুষকে বাবা হিসেবে পেয়েছে।”

সমর থম মেরে গেল রিদিমার চিন্তা ভাবনা দেখে। সে আরও ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো অতিরিক্ত রিয়েক্ট করবে। কিম্বা বাজে কিছু শোনাবে। কিন্তু…!
রিদিমা তখন আবারো বলল,
“ আর জানেন তো, মা কিন্তু সব সময় মাই হয়। তার কখনও কোনো রিপ্লেসমেন্ট হয় না। কারণ সে তার নিজের শরীর ভেঙে আরেকটা নতুন প্রাণের জন্ম দেয়। তারই রক্ত মাংস সিঞ্চন করে গড়ে ওঠে আরেকটা নতুন প্রাণ। ভাবতে পারছেন ঠিক কতটা পরিমাণ কষ্টকর এই প্রক্রিয়া। তারপর তো তার প্রসব বেদনার কথা বাদই দিলাম। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না সে যন্ত্রণা ঠিক কতটা অসহনীয়। তাই আমি মনে করি সে যতই খারাপ হোক না কেন তার স্থান কেউ কোনদিন নিতে পারবে না। আর ঠিক সে কারণেই আমি সায়নের মা হতে চাই না। তাই আমি তার মামনি হিসেবেই ঠিক আছি। তাকে মায়ের মত ভালো বাসতে না পারি অন্তত মামনির মতো করেই না হয় ভালোবাসার চেষ্টা করবো। আর বাকি রইলো অবহেলার কথা… ! আমি সত্যিই জানি না অতটুকু একটা ছোট্ট প্রাণের সাথে ঠিক কি রকম ভাবে অবহেলা করতে হয়। তারপরও বলবো যদি কোনোদিন মনে হয় আমার দ্বারা আপনার সন্তান অবহেলিত হচ্ছে তাহলে দেরি না করে সোজা সুজি সদর দরজা দেখিয়ে দেবেন না হয়।”
“ রিদিমা !”

ধমকে উঠল সমর। শেষের কথায় যেন হুট করে মাথায় রাগ চড়ে গেছে ওর। রিদিমা ধমক খেয়ে মুখ নামিয়ে চুপ করে রইলো। সমর চশমা ঠিক করে নরম গলায় বলল,
“ সদর দরজা দেখিয়ে দেবো মানে? আমি কি তোমাকে তাড়িয়ে দিতে বিয়ে করেছি নাকি? তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার উপর। আমার সম্পদের উপর।”

“ কিন্তু আমি তো সম্পদ প্রাচুর্য চাই না।”

থমকে গেল সমর রিদিমার কথায়। রিদিমা অভিমানে টইটুম্বুর আনত মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ তাহলে কি চাই তোমার?”

রিদিমার খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো আপনাকে। কিন্তু জড়তা কাটিয়ে মুখ ফুটলো না। সে সহসা উঠে দাঁড়ালো। মুখটা ওভাবে আনত রেখেই বলল,
“ দায়িত্ত্ব কিম্বা কর্তব্যের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে যেদিন অন্য কিছু অনুভব করবেন আশা করি সেদিন বুঝতে পারবেন আমার আসলে কি চাই আপনার কাছ থেকে।”

রিদিমা বেরিয়ে গেল দ্রুত সেখান থেকে। তার সদ্য জন্মানো অনুভূতির পালে সমরের দায়িত্ব কর্তব্য নামক অনুভূতিহীন কথা গুলো নিদারুণ ভাবে আঘাত করেছে। ভেঙে ফেলেছে তার নারী হৃদয়। সমর রিদিমার ছুটে যাওয়া দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তারপর খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবলো মেয়েটার বলা শেষের কথা গুলো। অনেক টা সময় নিয়ে ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঠোঁটের কোণে সূর্যের আলোর মতো চকচকে হাসি খেলে গেল তার। মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে ফিক করে হেসে ফেললো সমর। মনে মনে বলল,
“ নাহ্! এই বিয়েটা করে সে কোনো ভুল করেনি।”
________

গোটা একটা রাতের পর আবারও একটা নতুন দিনের সূচনা। ঝলমলে রোদের বদলে আজ আকাশ ঢেকেছে মেঘের আড়ালে। সকাল থেকেই গুমোট গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা আপামর শহর বাসীর। তবে এসির শীতলতায় মোড়ানো ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট টায় আনন্দের ঢেউ খেলছে। সক্কাল সক্কাল শুরু হয়েছে রকমারি রান্নার তোড়জোড়। পাঁচ রকম ভাজা, হালকা ডাল, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশের দোপেঁয়াজা, সরষে দিয়ে ভাপা ইলিশ, মাটন কষা সাথে ফ্রায়েড রাইস আর চাটনি।

আজ সমর অফিসে যায় নি। ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান বেলা বারোটার আগেই সারার কথা তাই আজ সে ছুটি নিয়েছে কাজ থেকে। গতকাল সন্ধ্যায় সমর লাবনী অবনী আর তিশা অনুষ্ঠানের সব কিছু কিনে কেটে এনেছে। ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে রিদিমার জন্য একটা আগুন রঙা ডুয়াল টোন এর কাঞ্জিভরম শাড়ি কিনেছিল তিশা। সেটাই সে ডিপ সবুজ ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে রিদিমাকে পরিয়ে দিলো। মিসেস চিত্রা আলমারি খুলে দুদিন আগে কেনা নতুন গহনা গুলো বের করে দিয়ে বললেন,
“ তিশা এগুলো আমার বৌমা পরিয়ে দাও। আজ ও শুধু শ্বশুর বাড়ির গহনায় সাজবে বুঝেছো।”

তিশা বক্স খুলতেই চমকে উঠলো। একজোড়া ভারী বালা কানের ঝুমকো আর গলার চকর হার রয়েছে তার মধ্যে। তিশা যত্ন নিয়ে সেগুলো পরিয়ে দিলো রিদিমাকে। মিসেস চিত্রা আরেকটা ছোট বক্স খুলে একটা নোয়া বাঁধানো বের করে রিদিমার বাম হাতে পড়িয়ে হেসে বললেন,
“ দেরি করে দিয়েছি বলে কিছু মনে করো না। আসলে বিয়েটা যেভাবে যে পরিস্থিতিতে হলো…! আমি তো প্রথম কয়েকদিন বিশ্বাসই করতে পারি নি যে আমার সমর বিয়ে করেছে তাও আমার পছন্দের পাত্রি কে।”

রিদিমা লাজে গাল ফুলিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো বিছানায়। মিসেস চিত্রা তাকে এই কথাটা বিয়ের পর দিন থেকে যে ঠিক কতবার বলেছেন তার ইয়োত্তা নেই। ওদিকে সায়ন অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে রিদিমার সাজ সজ্জা। ছোট্ট বাচ্চাটা বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কি হতে যাচ্ছে তাদের বাড়িতে। রিদিমা সায়নের ওই গোল গোল চোখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বোলালো। গালে ঠাস করে একটা শক্ত চুমু খেয়ে বলল,
“ কি হয়েছে চ্যাম্প। আজ হঠাৎ এতো চুপচাপ যে!”

সায়ন বড় বড় পলক নাড়িয়ে রিদিমাকে বলল,
“ তুমাকে বউ বউ লাগচে মামুনি।”

রিদিমা হেসে বলল,
“ তাই!”

সায়ন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“ হুম্!”

পাশে দাঁড়ানো তিশা মজা করে বলল,
“ আচ্ছা বাবাই বলোতো দেখি তোমার মামনি কার বউ?”

সায়ন উত্তর দিতে পারলো না। সে বেচারা ঠোঁট দুটো গুজ করে তার ছোট্ট মাথায় ভাবতে লাগলো তার মামনি আসলে কার বউ হয়? কিন্তু উত্তর খুঁজে পেলো না। তিশা সায়নের মুখের ভাব ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। প্রশ্ন করলো,
“ তুমি জানো না তো?”

সায়ন মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সে জানে না। তিশা রিদিমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
“ আমিও জানি না জানো। কিন্তু তোমার পাপা জানে তোমার মামনি আসলে কার বউ।”

সায়নের মুখটা আস্তে ধীরে সরল হয়ে উঠলো। সে আনন্দে নেচে উঠে বলল,
“ পাপা জানে?”
“ হ্যাঁ তো। যাও যাও। গিয়ে জেনে এসো।”

সায়ন আর দাঁড়ালো না সেখানে। এক ছুটে চলে গেল বসার ঘরে। যেখানে বসে বসে সোমেন আর সমর গল্পের আসর বসিয়েছে সেখানে। সায়ন একলাফে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ ও পাপা পাপা বলো না মামনি কার বউ?”

সমর ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ছেলের প্রশ্নে। কিন্তু সায়ন থামলো না। সে আবারো একই প্রশ্ন করলো ইনিয়ে বিনিয়ে। সোমেন সায়নের প্রশ্ন শুনে গাল চওড়া করে হাসতে হাসতে বলল,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ বল। আমিও জানতে চাই ওর মামনি কার বউ? বল বল!”

সমর বুঝলো ছোট বাচ্চাটার আবুঝপনার সুযোগ নিয়ে এরা তাকে যতোটা পারছে পচাচ্ছে। তাই ঠিক কি বলে বাচ্চাটাকে বোঝাবে ভাবতেই খট করে দরজা খুলে গেল। ক্ষণকাল পেরিয়ে তিশা আর অবনীর হাত ধরে বেরিয়ে এলো রিদিমা। লালচে কমলা শাড়ির সাথে গহনায় সজ্জিত রিদিমাকে দেখে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সমর। অমনি সাথে সাথে হৃদপিণ্ডের অন্তরালে কিছু একটা যেন ভেঙে চুরচুর হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। সমর শুকনো ঢোক গিললো। চোখের দৃষ্টি ও যেন হৃদ যন্ত্রের মতো থমকে গেছে ওই অপার সৌন্দর্যের মাঝে। গুরু গম্ভীর সমর হুট করেই যেন প্রেমিক হয়ে গেল। বুকের মাঝে হাত চেপে ধরে মনে মনে আওরালো,
“ মেঘবালিকা আমার!”

চলবে….

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
(৩৩)

“ আজ থেকে সারাজীবনের জন্য তোমার ভাত কাপড় সহ সব কিছুর দায় দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিলাম। কথা দিচ্ছি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাবো আমি!”

পঞ্চ ব্যঞ্জন দিয়ে সাজানো ভাতের থালা সহ তসর সিল্কের শাড়িটা রিদিমার হাতে তুলে দিয়ে কথা গুলো আওড়ালও সমর। সাথে সাথে শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিদিক। রিদিমা লাজুক চোখে আনত হয়ে রইলো। সমরের দিকে ভুল করে একবারও তাকালো না। লাবনী অবনী আর তিশা বায়না ধরলো নতুন বর কনেকে একই থালায় খেতে হবে। তাও আবার একে অপরকে নাকি খাইয়েও দিতে হবে। এটাই নাকি নিয়ম। মিসেস চিত্রা বাচ্চাদের ফাজলামি দেখে আর দাঁড়ালেন না। চুপ চাপ চলে গেলেন ঠাকুর ঘরে বরণ কুলো ধূপ দীপ এগুলো রাখতে। সমর অল্প অল্প না না করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। তারপর দুজনকে বসানো হলো পাশাপাশি আসনে। ওদিকে সোমেন দক্ষ ক্যামেরা ম্যানের মতো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে খচ খচ করে ছবি তুলে চলল ফোনের গ্যালারি ভরে। বড়ো কাসার থালে ভাতের মন্ড তার উপর একটু গরম ঘি আর দুটো কাঁচা লঙ্কা রাখা। পাতের পাশ ঘেঁষে সাজানো রকমারি সব আইটেম। অবনী তাড়া দিয়ে বলল,
“ এই দাদাভাই তুমি আগে খাওয়াবে বৌদিভাইকে।”

সমর আনত রিদিমাকে ভালো করে দেখে সত্যি সত্যিই ডালে মেখে ভাতের লোকমা তুলে ধরলো মুখে। চারিদিক তখনই হাততালি তে ফেটে পড়লো। ছোট্ট সায়ন ও পিসি দের দেখাদেখি হাত তালি দিতে লাগলো খুশিতে। রিদিমা ওভাবেই আড়ষ্ঠ হয়ে কোনোমতে মুখে নিলো ভাত টুকু। এবার এলো রিদিমার পালা। কিন্তু জড়তায় সংকোচে কিছুতেই পারছিল না খাবার তুলতে। ওদিকে অবনী সমানে বলে চলেছে,
“ কমন বৌদি ভাই, এতো লজ্জা পেলে চলে। আর কতক্ষন অপেক্ষা করাবে আমার দাদাভাইকে। দেখো না বেচারা, তখন থেকে ক্ষিদে চেপে বসে আছে।”

রিদিমা বহু কষ্টে আড় চোখে তাকালো সমরের দিকে। সাথে সাথে চোখে চোখ পড়লো মানুষটার। স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে থাকা ওই চোখ জোড়ায় কি যেন একটা ছিল, যা দেখে ভেতরে ভেতরে একেবারে জমে গেল রিদিমা। কি নিরেট, কি ধারালো মানুষটার দৃষ্টি জোড়া। যেন ওর অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নেবার ক্ষমতা রাখে তারা। রিদিমা সাথে সাথে নজর সরালো। সাথে সাথে মনে পড়লো সমরের বলা গত কালকের কথা গুলো। মুহূর্তের ব্যবধানে মনটা উদাস হয়ে গেল মেয়েটার। মনের পর্দায় ভাসমান রঙিন ফানুস গুলো যেন হুট করেই ভু পতিত হলো। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস টা আড়ালে ফেলে ভাতের লোকমা তুলে ধরলো রিদিমা।

সমর গত কাল থেকেই মেয়েটা কে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। তাদের অন্তিম কথপোকথনের পর থেকেই মেয়েটার মুখের জৌলুশ কেমন যেন কমে এসেছে। ঠোঁটের কোণ উপচে পড়া লাজুক হাসি টাও সেই তখনের পর থেকে ভীষণ ম্লান। ঠিক যেন গ্রহণ লাগা চাঁদের মতো। তাইতো সমর অম্লান দৃষ্টিতে সেই তখন থেকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল মেয়েটা কে। খুঁজে যাচ্ছিল সেই খুশি টা যা তার চোখে মুখে গতকালও ঝলমল করছিল।

“ কি হলো ছোড়দা। নাও হা করো। বেচারী আর কতক্ষণ এভাবে তুলে ধরে রাখবে।”

তিশার কথা শুনে সমর ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। হা করে মুখে নিলো ভাতের গাল টুকু।
___

ফোনের মেসেজ অ্যাপ্লিকেশনে এই নিয়ে পর পর চারটে বার্তা ঢুকলো। রিদিমা ফোনের নোটিফিকেশনে মিস্টার দত্ত বলে লেখা নামটা ভাসতে দেখে চুপটি করে আড়ালে গিয়ে লক খুলল। বার্তা গুলো ঠিক এমন ছিল,
“ Ridima are you sad!”
“ দেখো কাল আমি তোমায় হার্ট করার জন্য জন্য ওসব কথা বলিনি।”
“ আসলে আমি বোধ হয় তোমাকে ঠিক করে বোঝাতে পারি নি আমার মনের অবস্থা।”
“ Ok! Am sorry! আমার তোমায় ওভাবে বলা টা উচিত হয় নি। Sorry again.”

বার্তা গুলো পড়তেই রিদিমার ভার মনটা হঠাৎ করেই খুশিতে ভরে উঠলো। পাখির পালকের মতো সব কষ্ট গুলো একটু একটু করে হাওয়ায় ভেসে গেলো যেন। মানুষটা তার মনের কষ্ট টা অনুভব করেছে তাহলে। আবার কতো সুন্দর করে ক্ষমাও চাইছে। রিদিমার এই প্রথম এতো খুশি লাগলো কেউ তার মনের খোঁজ রেখেছে দেখে। তাই সেও আর সময় অপচয় করলো না ফিরতি বার্তা পাঠাতে। ইস্, বেচারা নিশ্চয়ই অপরাধ বোধে ভুগছে এখনও। রিদিমা মুচকি হেসে লিখলো,
“ Its ok! আমি বুঝেছি।
তবে সরি টা তখনই এক্সেপ্টেড হবে যখন আমার শর্ত পূরন হবে! তার আগে নয়।”

সমর ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। ভাইব্রেট হতেই ওপেন করলো তা। আর সাথে সাথেই মুখের আদল জুড়ে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
______

সন্ধ্যের আঁধারে দিনের আলো নিমজ্জিত হতেই নীরব বিষন্নতায় ঘিরে ধরলো গোটা পৃথিবী। বাইরে আজ স্বস্তি নেই। বিকেলের পর থেকে শুরু হয়েছে তুমুল বর্ষণ। সেই সাথে বইছে মৃদু মন্দ বাতাসের তোড়।

মনিকা এতক্ষণ রিদিমার ঘরে বসে ছিল। হাতের ভাঁজে তার ছবির ফ্রেম। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল ছবিটা কে। তপন বাবু ক্রাচে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আলোর সুইচ চেপে লাইট জ্বালিয়ে বললেন,
“ এই অন্ধকারে একা একা কি করছো তুমি?”
বলেই পেছন ঘুরে চাইতেই দেখতে পেলেন স্ত্রীর বিষন্ন মুখ। তিনি বুঝলেন সব টা। এক গভীর ব্যথায় মোড়ানো উষ্ণ শ্বাস বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে এলো সহসা। তিনি খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন। হাতের ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ফ্রেমের কাঁচের উপর অজস্র ফোঁটা বিন্দু জমে আছে। আর তাতেই অসচ্ছ হয়ে উঠেছে রিদিমার মুখ। ঠিক তখনই নাক টানার শব্দ কানে ভেসে এলো। তপন বাবু স্ত্রীর দিকে তাকাতেই মনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ আমি এতটা পাথর কি ভাবে হয়ে গেলাম তপন। আমি কি ভাবে আমার মেয়েটা কে দিনের পর দিন ভুল বুঝে গেলাম বলোতো।”

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মনিকা। চোখে আঁচল চেপে লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলানোর প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন নিরন্তর। তপন বাবুর চোখেও তখন দহনের বৃষ্টি। বুকের পাঁজরে গাঁথা অব্যক্ত আকুতি। সেই একই প্রশ্ন; যা তাকেও দিনরাত তাড়া করে ফেরে। হৃদয় পোড়ায় অহর্নিশ। কেন সেদিন মেয়েটা কে একটা বার বিশ্বাস করলেন না তিনি। কেন! মনিকা কাঁদতে কাঁদতেই বিলাপ শুরু করল..
“ হে ঈশ্বর! আমি কত বড় অন্যায় করেছি। নিজের জেদ পূরণ করতে গিয়ে আমার মেয়েটা কে না জানি কত কষ্ট দিয়েছি কত নোংরা কথা বলেছি কতো বার তার গায়ে হাত তুলেছি অথচ মেয়েটার বার বার বলা আকুতি ভরা কথা গুলো একটা বারও বোঝার চেষ্টা করি নি আমি। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তপন। আমাকে ধিক্কার দাও। মা নামের কলঙ্ক আমি। আস্ত একটা ডাইনি।”

মনিকা কান্নায় ভেঙে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। তপন বাবু ও চোখ মুছলেন ফতুয়ার কোন টা তুলে নিয়ে। কাকে দোষ দেবেন তিনি! মনিকা কে! নিজেকে! নাকি সেই মুহূর্তের পরিস্থিতিকে!!
_____

তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা হবে। সারাদিনের ধৈর্য ভেঙে অঝোর ধারায় নেমেছে তুমুল বর্ষণ। তার সৌন্দর্যকে আরেকটু বাড়াতে মাঝে মধ্যে ডেকে উঠছে মেঘের মৃদু গুড়গুড় ডাক। যেন চেনা ছন্দে অচেনা সুরের ঝংকার বাজছে বাতাসে।

আজ সমর আর রিদিমার ফুলশয্যা। সমরের বিলাস বহুল মাস্টার বেডরুমে গোলাপের পাপড়ি ভরা ফুলের নরম বিছানায় একটু আগেই রিদিমাকে বসিয়ে দিয়ে গেছে তিশা লাবনী আর অবনী। সেই থেকেই কলমিলতার মত নেতিয়ে বসে আছে মেয়েটা। বুকের ভেতর তার অস্থির কম্পন আর হৃদয় জুড়ে এক সমুদ্র লজ্জা যেন তাকে চুবিয়ে মারার চেষ্টা করছে নিরন্তর। তন্মধ্যে খট করে শব্দ হলো। রিদিমা গলা অব্দি টানা ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পেল সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। গায়ে তার সেই দুপুরের হলদে পাঞ্জাবি টা। হাতা দুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো। বাম হাতের কব্জিতে চকচকে সিলভার রঙের ঘড়ি আর ডান হাতে জ্বলজ্বলে সোনার ব্রেসলেট। মুখটায় উপচে পড়া ক্লান্তি। সমর দরজা লক করে তার দিকে হেঁটে আসছে দেখে হাত পা গুলো যেন আরও আড়ষ্ঠ হয়ে গেল রিদিমার।

সমর ঘরে ঢুকে হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে একপলক বিছানার দিকে তাকালো। বুক টা হঠাৎ ধুক করে কেঁপে উঠলো এক অজানা শিহরণে। বেলী ফুলের গহনায় সেজে অধীর অপেক্ষায় বসে আছে তার মেঘবালিকা। সমর ফটাফট চশমা খুলে কাবার্ট থেকে রাতের পোশাক বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। বেরিয়ে এলো প্রায় মিনিট দশেক পর। অতঃপর বড় জড়তা নিয়ে রিদিমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আসলে কি বলবে আর কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। যতোই বিয়েটা তার দ্বিতীয় হোক না কেন এভাবে ফুলশয্যার এই অভিজ্ঞতা তার কাছে একেবারেই নতুন।

সমর বড় অস্বস্তি নিয়ে রিদিমার পাশে এসে বসলো। চুল গুলোয় আঙুল চালিয়ে বলল,
“ আসলে কি বলে শুরু করবো বুঝতে পারছি না আমি। রিদিমা! আর ইউ স্কেয়র্ড?”

রিদিমা ঘোমটার আড়াল থেকে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতেই ফিক করে হেসে ফেললো সমর। একটা গভীর শ্বাস টেনে বলল,
“ ডোন্ট ওরি! তোমার সম্মতি ছাড়া কিছুই করবো না আমি। ইন ফ্যাক্ট টাচও করবো না। ওয়েল, আমি কি তোমার ঘোমটা টা একটু তুলতে পারি।”

রিদিমা লজ্জার অথৈ সাগরে ডুবে কোনো রকমে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সমর বুক ভরে দম টেনে আস্তে ধীরে ঘোমটা টা তুলতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য হার্টবিট টা থমকে গেল যেন। আজ প্রথম বার মনে হলো মেয়েটা অবর্ণনীয় সুন্দরী। শ্যামলা রঙে সেই সৌন্দর্যের মাত্রা শত গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে যেন। আজ বুঝতে পারলো ওই তৃপ্তীশ ব্যাটা কেন এই মেয়ের পেছনে জোকের মতো লেগেছিল। এতো সৌন্দর্য দেখলে আসলেই মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। রিদিমার ওই স্নিগ্ধ রুপ দেখে শুকনো ঢোক গিললো সমর। মনের অজান্তেই বিড় বিড়িয়ে বলে উঠলো,
“ অসম্ভব সুন্দর!”

রিদিমা আস্তে ধীরে চোখ তুলে তাকালো। দুজনের একে অপরের সাথে চোখা চুখি হতেই আবারো লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেয়েটা। সমর অপলক তাকিয়ে থেকে বলল,
“ শ্যামলতা, তাকাও আমার দিকে।”

আদুরে নামটা শুনে আবারো যেন শীতলতায় জমে গেল রিদিমা। লজ্জায় একাকার হয়ে কোনোমতে চোখ তুলে তাকালো তার একান্ত মানুষটার দিকে। সমর হাত বাড়িয়ে দিলো তার সামনে। হঠাৎ এক অদ্ভুত আবদার করে বলল,
“ আজকের এই বিশেষ দিনে আমার তোমার কাছে বিশেষ কিছু চাই। দেবে কি?”

রিদিমা এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি !”
“ একটা সুযোগ। যাতে দায়িত্ব কর্তব্যের সীমাবদ্ধতা পার করে তোমাকে নিয়ে নতুন কিছু ভাবতে পারি। নতুন পথের পথিক হতে পারি। নতুন করে আবার ভালোবাসতে পারি। দেবে কি সেই সুযোগ!! প্লীজ!!”

লোকটার কাতর কন্ঠে রিদিমা যেন গলে একাকার হয়ে গেল। মনের অভ্যন্তরে যতো জড়তা যতো দ্বিধা যতো অস্বস্তি ছিল সব যেন মিলিয়ে গেল বাতাসে। রিদিমা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে ধীরে হাত রাখলো সমরের হাতে। সমর ও বুঝে নিলো তার নীরব সম্মতি টুকু। সে আলগোছে পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বার করলো। ভেতর থেকে চকচকে হীরের আংটি বার করে রিদিমার অনামিকায় পড়িয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিস ফিসিয়ে বলল,
“ সুযোগ টুকু দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ মিসেস ওয়াইফি। আমি কি তোমার চাঁদ কপালে একটা চুমু খেতে পারি?”

রিদিমা এমনিতেই লজ্জায় হাবুডুবু খাচ্ছিল। তাতে করে সমরের এমন প্রেমের আহ্বানে কাঁপতে লাগলো ঠক ঠক করে। সমর বুঝলো মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। সে রিদিমা কে আর জ্বালালো না। শুধু এগিয়ে এসে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে লাইট নিভিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় আলগোছে রিদিমার ফুলের গহনা গুলো খুলতে খুলতে কানে কানে বলল,
“ ডোন্ট প্যানিক রিদিমা। আমি তোমার সম্মতির অপেক্ষা করবো।”
তারপর গায়ে ব্ল্যাংকেট চাপিয়ে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়েই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

চলবে…