#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
(৪০)
দুপুরের আগেই মা ছেলে আর বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে হাজির হলো সমর। তপন বাবু আর মনিকা খুব যত্ন নিয়ে তাদের আপ্যায়ন জানালেন। ওদিকে বোনের আসার খবর পেয়ে ছুটে এলো পরমা। রিদিমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট গোলগাল সায়ন কে খপ করে কোলে তুলে নিয়ে গালে টপাটপ কটা চুমু খেয়ে বলল,
“ আমাকে চিনতে পেরেছো সায়ন? ওই যে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম তোমার ম্যামের সাথে!”
সায়ন গোমড়া মুখে গোল গোল চোখে পরমার দিকে তাকিয়েই রইলো অবুঝের মতো। কারণ ওর মনে পড়ছে না। রিদিমা হেসে সায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ ওর মনে নেই বোধ হয়।”
সায়ন অপরিচিত কোলে অস্বস্তি হওয়ায় ঝাঁপিয়ে রিদিমার কোলে। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিস ফিসিয়ে বলল,
“ ও মামুনি মামুনি আমি না টয়লেট যাবো। আমার খুব জোর সিসি পেয়েছে।”
“ আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে যাচ্ছি।”
রিদিমা আর পরমা সায়ন কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। তপন বাবু সমর কে আপ্যায়ন করে বললেন,
“ চলো বাবা ভেতরে গিয়ে বসবে।”
তপন বাবু সমরকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ওদিকে মনিকা মিসেস চিত্রার সাথে স্নেহের আলিঙ্গন শেষ করে তাকে ভেতরে নিয়ে এলো। ঠিক তখনই সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙে হামি তুলতে তুলতে সেখানে এসে উপস্থিত হলো দীপ্ত। সমর কে দেখে একগাল হেসে বলল,
“ আরে সমর দা তোমরা চলে এসেছো। আমি তো আরও ভাবলাম তোমাদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বোধ হয় বিকেল গড়িয়ে যাবে। হে হে হে হে!”
সমর দীপ্তর কথায় কেশে উঠলো খুক খুক করে। বেচারা সবার সামনে লজ্জায় পড়ে একাকার অবস্থা। রিদিমা তখন সদ্য ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সায়নের প্যান্টের চেন আটকাচ্ছিল। সমর কে কাশতে দেখে তড়িঘড়ি ছুটে এসে ফ্রিজ থেকে জল বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলো। দীপ্তর তা দেখে সেকি হাসি। সোফার পিঠে দুহাত মেলে দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলে উঠলো,
“ বাব্বা রিদিমা, তোমার তো দেখছি একরাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। কালকে যাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে আজ তাকে এতো যত্ন!!”
এখানে বাচ্চাদের ইয়ার্কি আড্ডা মারতে দেখে তপন বাবু আর মনিকা মিসেস চিত্রা কে সাথে করে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। এদের মাঝে থাকলে নিজেদেরই লজ্জায় পড়তে হবে। রিদিমা দীপ্তর দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“ একটু সম্মান দিয়ে কথা বলো দীপ্ত দা। উনি কিন্তু তোমার থেকে বয়সে বড়।”
দীপ্ত রিদিমার কথায় ভীষণ মজা পেল। হাসতে হাসতে বলল,
“ ওহ্ রিয়েলী রিদিমা। তুমি বলতে চাইছো সমর দা বুড়ো মানুষ।”
রিদিমা অবাক হয়ে হা করে তাকালো দীপ্তর শয়তানি হাসি ভরা মুখটার দিকে। দীপ্ত হাসতে হাসতে সমরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ দেখলে তো সমর দা তোমার বউ কিন্তু তোমাকে ডাইরেক্টলি বুড়ো বলল।”
সমর রিদিমার মুখের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই রিদিমা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
“ এই না না, বিশ্বাস করো আমি সত্যিই এমন টা বলিনি। দীপ্ত দা তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছো। আমি কখন উনাকে বুড়ো বললাম। আমি তো শুধু বলতে চেয়েছি উনি তোমার চেয়ে বয়সে যেহেতু বড় তাই….”
“ তো! আমি ভুল কোথায় বললাম। আমার থেকে বয়সে বড় মানেই তো বুড়োই হলো তাই না। তার মানে তুমি স্বীকার করছো তোমার বর বুড়ো।”
রিদিমা দীপ্তর কথার জালে ফেঁসে গিয়ে রেগেমেগে অস্থির অবস্থা। কোমরে দুহাত চেপে ঝগড়ার মুডে বলল,
“ মোটেও না। আমার বর মোটেও বুড়ো না। আর যদি হয় ও তাহলে সে আমার পার্সোনাল বুড়ো। বুঝেছো তুমি।”
বলেই হন হন করে হেঁটে ঘরে চলে গেল। রিদিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো সমর। আমার পার্সোনাল বুড়ো কথাটা ওর দারুন লেগেছে শুনতে। দীপ্ত সমরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। অতঃপর সিরিয়াস হয়ে বলল,
“ তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সমর দা। সত্যি বলতে সেদিন যদি তুমি ওই বিপদের মাঝে মেয়েটার পাশে না দাঁড়াতে আজ হয়তো রিদিমাকে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম।”
সমর দীপ্তর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চশমা ঠিক করতে করতে বলল,
“ আমাকে ধন্যবাদ দিয়ো না দীপ্ত। এটা ঈশ্বরের প্রাপ্য। সত্যি বলতে আমি নই বরং রিদিমাই আমার ছন্নছাড়া জীবনটা গুছিয়ে দিয়েছে। আমি ঈশ্বরের পাশাপাশি ওর কাছেও কৃতজ্ঞ।”
দীপ্ত মুগ্ধ হেসে বলল,
“ চলো তোমাকে রিদিমার ঘরে নিয়ে যাই। তুমি তো বোধ হয় এখনও ওর রুমে যাও নি।”
দীপ্ত সমরকে রিদিমার ঘরে রেখে চলে গেল। ওর এখনও শস্নান করা বাকি। সমর ঘরে ঢুকে দেখতে লাগলো। ছোট একটা ঘর। ঘরের মধ্যে একটা ডাবল বেডের খাট। তারপাশে একটা টেবিল। তাতে অনেক উপন্যাসের বই। সমরের কয়েক জন পরিচিতি লেখকের নাম চোখে বাঁধলো। মানিক বন্দোপাধ্যায় রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সমরেশ মজুমদার আশাপূর্ণা দেবী। সমর বই গুলোর গায়ে হাত বোলালো। এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো জানালার দিকে। সেখানে ছোট ছোট ঝুলন্ত টব চোখে পড়লো। তাতে বেশ কিছু সবুজ লতানো ইনডোর প্লান্ট দেখা যাচ্ছে। জানালার পাশঘেঁষা একটা কাঠের আলমারি। তার সাথে লাগানো একটা বড় কাঁচের আয়নাওয়ালা ড্রেসিং টেবিল। তাতে সাজিয়ে রাখা কিছু মেয়েলি সাজের জিনিস। যেমন নেলপালিশ কাঁচের চুড়ি ক্যাচার ক্লিপ যেগুলো আজকাল ওর ড্রেসিং টেবিলেও শোভা পায়। তাদের পাশে কাঁচের ফ্রেমে রিদিমার একটা ছবি। সমর ফ্রেম টা হাতে তুলে নিলো। ছবির রিদিমা কে দেখে মনে হলো বাচ্চা একটা মেয়ের ছবি। সাদা কার্গো জিন্স প্যান্ট আর ক্রপ শার্ট পরা। চুল গুলো পনিটেল করে বাঁধা। ডান কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে চলে গেছে স্যাডেল ব্যাগের ফিতে টা। সমর ধ্যান দিয়ে ছবিটা দেখলো। তারপর জায়গায় রেখে দিলো।
“ কি দেখছো?”
রিদিমার আওয়াজ পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো সমর। ছবিটা দেখিয়ে বলল,
“ তোমার ছবিটা দেখছিলাম। অনেক ছোট লাগছে তোমাকে। বোধহয় ছোটবেলায় তুলেছিলে।”
রিদিমা সমরের কথায় মুখ চেপে হেসে ফেলল। আজ ভোরের পর থেকে ওর আপনি আজ্ঞে টা চুমু থেরাপি দিয়ে তুমি তে পরিণত করেছে সমর নিজের দায়িত্বে। সাথে ভালোবাসার ওভার ডোজ তো ছিলই। রিদিমা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ ওটা চার মাস আগে কলেজ ট্যুরে গিয়ে তুলেছিলাম।”
“ হোয়াট!”
সমরের চোখে বিস্ময় দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রিদিমা। কিন্তু সমরের বিস্ময় যেন কিছুতেই কমে না। মেয়েটাকে অন্য পোশাকে এত ছোট লাগে অথচ শাড়ি পরায় কেমন পূর্ণ বয়স্ক লাগছে।
“ সমর দা আসুন মা খাবার খেতে ডাকছে।”
পরমার ডাকে হুশ হলো দুজনার। রিদিমা আড় চোখে লাজুক হেসে বলল,
“ চলো যাওয়া যাক।”
দুপুরের খাবারের টেবিলে বিরাট আয়োজন করেছেন তপন বাবু। রীতিমত আড়ম্বর যাকে বলে। ইলিশ ভাজা থেকে শুরু করে বেগুনি ভেজ ডাল দই কাতলা পটল চিংড়ি গলদা চিংড়ির মালাইকারি মাটন রেজালা। সবাই একসাথে খেতে বসেছে। শুধু ব্যতিক্রম রিদিমা। কারণ সে ব্যস্ত সায়নকে খাওয়াতে। ছেলেটার নতুন অভ্যেস হয়েছে তার মামুনির হাতে খাওয়া। সে সোফায় বসে মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে খাচ্ছে। ততক্ষণে মনিকা পাত সাজিয়ে সামনে রাখে সমরের। সমর সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“ আমি পরে খাচ্ছি। আগে রিদিমা আসুক।”
মনিকা মেয়ের প্রতি জামাইয়ের খেয়াল দেখে ভীষণ তুষ্ট হন মনে মনে। তপন বাবুও মুগ্ধ হন। দীপ্ত ভেজা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ আরে ঠিক আছে। ও আসুক তখনই না হয় সবাই শুরু করবো। এই পরমা তুমিও এসো।”
দুই জামাই তাদের দুই রাজকন্যাকে তাদের চেয়ে বেশি যত্নে রেখেছে দেখে মনিকার চোখ ভরে ওঠে আনন্দে। রিদিমার সায়ন কে খাওয়ানো শেষ হতেই সে হাত ধুয়ে সমরের পাশে এসে বসলো। মনিকা বাকি খাবার গুলো বাড়তে গেলে পরমা বাঁধা দিয়ে বলল,
“ রাখো আমি দিচ্ছি। ভুলে গেছো নাকি তুমি অসুস্থ।”
“ অসুবিধা নেই আমি পারবো।”
বলেই সমরের আর দীপ্তের জন্য খাবার বাড়তে থাকলো। তারপর একে একে বাটি গুলো এগিয়ে দিলো তাদের দিকে। সমরের তো এতো পদ দেখে মাথায় হাত। সে খাবারের দিকে তাকিয়ে রিদিমাকে ইশারায় বোঝালো এত কিছু খেতে পারবে না। রিদিমা জানে লোকটা মিতাহারী। তবুও বোঝালো আজকের জন্য ম্যানেজ করতে। সমর নিরুপায় হয়ে কেবল মাটন রেজালা ইলিশ ভাজা আর সামান্য ডাল নিয়ে বাকিটা সরিয়ে দিলো। মনিকা আর পরমা চাপাচাপি করলেও সে খেল না। বলল চিংড়ি তে এলার্জি আছে। কিন্তু ওদিকে দীপ্ত অতসবে নেই। সে মোটামুটি কব্জি ডুবিয়েই খেল। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সবাই দেখলো সায়ন গেম খেলতে খেলতে সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মনিকা দেখে বললেন,
“ ইস্, দাদুভাই তো ঘুমিয়ে পড়লো রে সুনু। তাড়াতাড়ি যা ওকে নিয়ে গিয়ে তোর ঘরে শুইয়ে দে। আর সমর বাবা তুমিও যাও। গিয়ে একটু রেস্ট নাও।”
কাজের বউটা কে কাজ গুলো দেখিয়ে দিয়ে মনিকা মিসেস চিত্রা কে নিয়ে নিজেদের রুমে ঢুকে গেল। পরমাও খাবার গুলো গুছিয়ে ফ্রিজে রেখে হাত মুছতে মুছতে ঢুকলো নিজের ঘরে। দীপ্ত আর যায় কোথায়। সেও বউয়ের পেছন পেছন হাঁটা ধরলো ঘরে। তপন বাবু চিলেকোঠার ঘরে ঢুকলেন একটু আয়েশ করে উপন্যাস পড়বেন বলে।
খাটের একপাশে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট সায়ন। মাঝ খানে রিদিমা। তার পাশে বসে সমর। তবে সে শান্ত নেই। হাত দুটো সমানে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ল্যাপটপের কী বোর্ডে। রিদিমা পেছন ঘুরে তাকালো সমরের দিকে। মৃদু স্বরে বলল,
“ তুমি শোবে না!”
“ উহু! দুপুরে খাওয়ার পর আমার শোয়ার অভ্যেস নেই। এনি ওয়ে, তোমার কোথায় ঘুরতে যেতে ভালো লাগে। পাহাড় নাকি সমুদ্র।”
রিদিমা উঠে বসলো। সমরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“ মানে?”
“ মানে হলো আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। মানে হানিমুনে যাচ্ছি।”
“ কিহ্ আমরা ঘুরতে যাচ্ছি?”
সমর চশমার ফাঁক দিয়ে রিদিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মাথা নেড়ে বলল,
“ হুম্। তার আগে একটা রিসেপশন পার্টি হবে। তো কোথায় যেতে চাও বলো।”
রিদিমা অনেক ভেবে চিন্তে বলল সমুদ্র। সমর তখন ল্যাপটপ ঘুরিয়ে ওর সামনে ধরে বলল,
“ আমারও সমুদ্র বেশ পছন্দ। মালদ্বীপ আর পাটায়া এই দুটো জায়গা বেস্ট ঘোরার জন্য। এবার ফাইনাল টা তুমি সিলেক্ট করো।”
রিদিমা বিদেশ যাওয়ার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল একেবারে।
“ এতদূর যেতে হবে কেন সমুদ্র দেখতে। আমরা তো দিঘা তেও যেতে পারি। এই তো ঘন্টা চার পাঁচের রাস্তা। সকালে বাসে চড়লে দুপুরে পৌঁছে যাবো।”
সমর ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই রিদিমা বলল,
“ তাছাড়া ছোট বাচ্চা নিয়ে এতদূর যাওয়া ঠিক হবে না এখন। সায়ন জার্নি করতে পারবে না।”
রিদিমার সায়নের প্রতি মাতৃত্ব দেখে সমরের মনটা ভরে উঠলো ভালোলাগায়। মেয়েটা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই কেমন সবাইকে আপন করে নিয়েছে। সমর মালদ্বীপের ট্যুর প্যাকেজ টা বুক করতে করতে বলল,
“ ডোন্ট ওরি সায়নের জার্নি করার অভ্যেস আছে।”
*
রিদিমার ইউনিভার্সিটি ভর্তির কাজ শেষ হয়েছে আজ। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে সে রিনি জবা আর সীমা চার জনে মিলে ঠিক করলো আজ একটু ঘুরতে বেরুবে। তো সেই মতো চারজনে ঢুকলো সাউথ সিটি মলে। দুই ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন জোন ঘুরে ওরা এসে দাঁড়ালো raymond এর শপে। কাঁচের স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপাশে একটা পুরুষ ম্যানিকুইনের গায়ে লাইট ব্লু কালারের একটা শার্ট দেখে রিদিমার খুব ভালো লাগলো। মনে মনে সেই শার্টে সমরকে কল্পনা করতেই মনটা ভালো লাগায় ভরে উঠলো। ও রিনি জবা ওদের বলল,
“ এই তোরা দাঁড়া আমি এখুনি আসছি।”
বলে ভেতরে ঢুকে শার্ট টাতে হাত বুলাতে লাগলো। পাশেই কাস্টমার অ্যাটেন্ডের দাঁড়িয়ে ছিল সে এগিয়ে এলো।
“ ম্যাম, কি লাগবে বলুন আমি সাহায্য করে দিচ্ছি।”
রিদিমা শার্ট টা দেখিয়ে বলল,
“ এটার থেকে বেস্ট কোয়ালিটি সেইম কালারের xl সাইজের শার্ট হবে!”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল,
“ হবে। আপনি আমার সাথে আসুন আমি দেখাচ্ছি।”
রিদিমা ছেলেটার সাথে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা শার্ট বের করে দিলো। রিদিমা একটার পর একটা দেখতে লাগলো মন দিয়ে। সীমা রিদিমাকে শার্ট বাছাই করতে দেখে এগিয়ে এলো। পেছন পেছন এলো রিনি আর জবা।
“ ওয়াও কি সুন্দর রে শার্ট গুলো। দাঁড়া আমিও নেবো রঙ্গন এর জন্য।”
বলেই সীমাও শার্ট বাছতে শুরু করলো। রিনি রিদিমা আর সীমাকে দেখে আফসোসের সুরে বলল,
“ জবা রে আজ আমাদের একটা বর নেই বলে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে জানিস।”
দুঃখ ভরা কণ্ঠে জবাব দিলো জবা।
“ যা বলেছিস ভাই। এই দুই বিবাহিত মহিলার জন্য আজ সিঙ্গেল থাকার আফসোস হচ্ছে।”
“ তোদের বিয়ে করতে মানা করেছে কে?”
রিদিমার কথায় এই দুজনের হতাশা যেন আকাশ ছুঁয়ে গেল। রিনি দুঃখ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ কি করবো বল। আমাদের বাবা মা তো বুঝতেই চায় না আমরা বড় হয়ে গেছি। তাই তো এই দুর্দশা আমাদের।”
“ বিবাহিত বান্ধবীদের সাথে আইবুড়ো হয়ে ঘুরছি।”
জবার কথায় সীমা আর রিদিমা ফিক করে হেসে ফেললো। রিদিমা পছন্দের শার্ট টা বেছে নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনই একটা মিষ্টি কন্ঠের ডাক শুনে ঘাড় ঘোরালো রিদিমা।
“ কেমন আছো রিদিমা?”
রিদিমা চমকে উঠে পাশে তাকাতেই দেখলো সেই আগের দিনের মতো মুখে মাস্ক আর চোখে গগলস পরে মধুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ক্রপ টপ আর ব্যাগী জিন্স। পিয়ারসিং করা নাভিটা দেখা যাচ্ছে শার্টের তলা দিয়ে। স্মুদনিং করা বাদামি চুল গুলো খানিক চোখের উপর ছড়ানো। বাকি গুলো পনিটেল করা। রিদিমাকে অমন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো প্রিয়া। স্যাডেল ব্যাগের ফিতে টা বাম হাতের মুঠোয় পুরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কপালের ছড়ানো চুল গুলো কানে গুজতে গুজতে বলল,
“ বরের জন্য শার্ট কিনছো অথচ এটাও জানো না কোন রং সমরের পছন্দ!”
প্রিয়ার কথায় রিদিমা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। প্রিয়া রিদিমার হাতের থেকে শার্ট টা নিয়ে ভালো করে দেখে বলল,
“ ব্লু! এই রং টা তো ও দুই চক্ষে দেখতে পারে না। ওর পছন্দের রং হলো লাইট ইয়েলো আর পিচ হোয়াইট অথবা আইভরি পিংক। চলো আমি পছন্দ করে দিচ্ছি।”
বলে হাঁটা দিতে গেলেই রিদিমা ওর হাত থেকে শার্ট টা খপ করে কেড়ে নিলো। রাগে থমথমে গলায় জবাব দিলো,
“ উহু, আপনি ভুল জানেন মিস্ মধুপ্রিয়া। আসলে বিগত চার বছরে সমরের শুধু পছন্দই নয় আরও অনেক কিছু বদলে গেছে।”
বলেই শার্ট টা বিল করতে কাউন্টারে জমা করে দিলো। যা দেখে প্রিয়া রিদিমার দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। বিল দেওয়া শেষে রিদিমা পেছন ঘুরে বান্ধবীদের দিকে হাঁটা ধরতেই পেছন থেকে আবারো ডেকে উঠলো প্রিয়া।
“ রিদিমা। তোমার কনফিডেন্স লেভেল টা কিন্তু সেই। মানতেই হবে। যাইহোক, তুমি কিন্তু আমাকে সায়নের সাথে দেখা করিয়ে দিলে না।”
রিদিমা পেছন ঘুরে জবাব দিলো,
“ আচ্ছা চার বছর পর আপনার হঠাৎ সায়নের প্রতি এত মাতৃত্ব জেগে উঠলো কেন? নাকি সতেরো ভরি গহনা আর পাঁচ লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে। তাই ছেলেকে ভালোবাসার ছলাকলা দেখিয়ে সমরের জীবনে এন্ট্রি নিতে চাইছেন।”
রিদিমার জবাবে চমকে উঠলো প্রিয়া। ঠোঁট দুটো যেন অদৃশ্য সুচে সেলাই হলো নিমেষে। রিদিমা দুপা এগিয়ে প্রিয়ার একদম সামনা সামনি এসে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাস মিলিয়ে বলল,
“ লিসেন মিস্ মধুপ্রিয়া, আমি এমনিতে কিন্তু খুব ঠান্ডা মেয়ে। খুব একটা রাগী না। কিন্তু আমার স্বামী সন্তান আর সংসারের দিকে নজর দিলে কিন্তু আমার ঠান্ডা মাথা গরম হয়ে যাবে। তারপর যদি আমি রেগে যাই তাহলে কি হবে আমি নিজেও জানি না। তাই নিজের সীমানার মধ্যে থাকুন। নয়তো….!”
বলেই অদ্ভুত ভাবে তাকালো রিদিমা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়া ওর অসম্পূর্ণ কথাটা এক নিমেষে বুঝে ফেলল। ততক্ষণে সীমার শার্ট বাছা শেষ। রিনি আর জবার সাথে মিলে কিছু একটা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে কাউন্টারের দিকে। মধুপ্রিয়া আর দাঁড়ালো না সেখানে। উল্টো পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।
*
“ আরে পাগলী তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? তোর কোনো ক্ষতি হবে না আমি তো বললামই। তুই শুধু আমার কথা মতো কাজ টা কর।”
চুমকি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে বলল,
“ আমি সত্যি বলছি ওসব আমি পারবো না। আমাকে দিয়ে ও সব একদমই হবে না।”
ওপাশ থেকে ধমকে উঠল কেউ,
“ ইয়ার্কি মারছিস আমার সাথে? পারবিনা মানে! তুই পারবি এমন কি তোর ঘাড় ও পারবে। নইলে আমি কি করতে পারি তুই ভালো করেই জানিস। তোর সব কুকীর্তি গুলো এক নিমেষে সমরের কাছে ডেলিভার হয়ে যাবে। আর তারপর তোর জায়গা হবে পুলিশের শ্রীঘরে। যেতে চাস সেখানে?”
চুমকি ভয়ে যেন আরও সিটিয়ে একশা হয়ে গেল। নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে বলে উঠলো,
“ না না আমি শুনবো। আমি আপনার সব কথা শুনবো। আপনি শুধু আমার কোনো ক্ষতি করবেন না দয়া করে।”
ওপাশ থেকে হাসির ঝরঝরে শব্দ ভেসে এলো চুমকির কানে। ফোনের ওপাশে থাকা আগন্তুক খরখরে গলায় বলে উঠলো,
“ খুব ভালো। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এবার শোন আমি তোকে যা যা বলবো শুধু মন দিয়ে তাই তাই করবি ঠিক আছে!”
চুমকি হুম্ বলে সায় জানালো। ফোনের ওপাশে থাকা আগন্তুক চুমকির কানে কাজের কথাটা জানাতেই চুমকি শিউরে উঠলো ভয়ে। লোকটা গম্ভীর গলায় বলল,
“ কাজ টা যেন তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।”
চলবে…
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে #নিতু_সরকার
(৪১)
৪১)
“ সমর বাবু, আপনাকে একটু থানায় আসতে হবে।”
অসময়ে হঠাৎ ওসি সাহেবের ফোন পেয়ে হকচকালো সমর। ও ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ কেন অফিসার?”
“ সেই বাইকার কে খুঁজে পাওয়া গেছে যার গাড়িতে আপনার শ্বশুরমশাই অক্সিডেন্ট করেছিলেন।”
“ বাহ্ এতো খুবই ভালো খবর।”
“ হ্যাঁ তবে এর থেকেও ভালো খবর আছে। সেটা আপনাকে আর মিসেস দত্তের ফ্যামিলিকে সামনে বসিয়ে দিতে চাই। প্লীজ দেরি করবেন না। একটু তাড়াতাড়ি আসুন প্লীজ।”
ওসি সাহেবের কল কেটে যেতেই সমর হাত ঘড়িতে চোখ রাখলো। দেখলো এখন সকাল এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে সবে। বারোটায় সায়নের স্কুল ছুটি হবে। তবে ইমারজেন্সি ছুটি নেওয়াই যেতে পারে ভেবে সাথে সাথে কল লাগালো রিদিমাকে।
স্কুলের বাইরের সেই ছাউনিতে বসে ছিল রিদিমা। সাথে মিতালী আর তার গ্যাং। সবার আলোচনার বিষয় বস্তু হলো লোকের সংসারের হাঁড়ির খবর নিয়ে পিএনপিসি করা। তাদের মধ্যে এক মহিলা হঠাৎ রিদিমার হাতটা মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল,
“ এই রিদিমা শোনো না, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”
রিদিমা জানে এরা তাকে পার্সোনাল প্রশ্নই করবে। তাই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
“ করো।”
মহিলা টা বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
“ বলছি কি তোমার বরের আগের বউ মানে সায়নের মা বেঁচে আছে না কি মরে গেছে?”
রিদিমা বেশ মস্তিষ্ক খাটিয়েই জবাব টা দিলো।
“ বেঁচে আছে না কি মারা গেছে তাতো আমি সঠিক জানি না। তবে এটুকু শুনেছি উনি নাকি যাবার আগে সায়নের বাবা কে ডিভোর্স দিয়েই বাড়ি ছেড়েছিল। তারপর তার বাঁচা মরা নিয়ে এবাড়ির কেউ আর খোঁজ রাখেনি।”
রিদিমার কথা শেষ হতেই পাশের সব কটা মহিলা এক সঙ্গে বলে উঠলো,“ ওহ্ আচ্ছা!”
সেই মহিলা আবারো প্রশ্ন ছুড়লো,
“ ধরো উনি বেঁচে আছে। হঠাৎ একদিন তোমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল উনি সায়নের মা। সায়নের বাবা উনার হাসবেন্ড। উনি এখন ফ্যামিলিতে ব্যাক করতে চান। তাই তোমাকে বলল সরে যেতে। তখন তুমি কি করবে?”
রিদিমা এই প্রশ্নের জবাবে বেশ চমৎকার একটা হাসি দিলো। তারপর বলল,
“ জীবন টা সিনেমা কিম্বা সিরিয়াল নয় দিদি। যে প্রাক্তন হুট করে হাজির হতেই সব কিছু বদলে যাবে। আর তারপর সে যা চাইবে তাই হবে। কারণ কিছু কিছু টপিক নন নেগোশিয়েবল হয়। এই ব্যাপারটাও তেমনি। আমি আশা করবো আপনারাও এটা নিয়ে আর আলোচনা করবেন না।”
সবার মুখ মুহূর্তেই ভোটা হয়ে গেল রিদিমার ধারালো জবাব শুনে। মিতালী তো জাস্ট হা করে রইলো রিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ঠান্ডা মাথায় শান্ত জবাবে এভাবেও যে মুখ বন্ধ করে দেওয়া যায় তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেল সে। তখনই রিদিমার ফোনটা পার্সের মধ্যে শব্দ করে বেজে উঠলো।
“ এক্সকিউজ মি!”
বলে রিদিমা মিতালীর পাশ থেকে উঠে চলে গেল কথা বলতে।
অবশেষে আর্জেন্ট লিভ নিয়ে সায়ন কে ছুটি করানো হয়েছে। রিদিমা সায়ন কে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতেই সেখানে পৌঁছলো সমর। অতঃপর ছেলে বউকে নিয়ে রওনা হলো পুলিশ স্টেশনের পথে।
হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো অবস্থায় সামনা সামনি বসানো দুই আসামি। টেবিলের এক পাশে তৃপ্তীশ আরেকপাশে সেই বাইকার ছেলেটা। লকাপের বাইরে দাঁড়ানো তপন বাবু মনিকা রিদিমা আর সমর। সায়নকে আসার পথে বাড়িতে রেখে এসেছে যাতে পুলিশ দেখে ভয় না পায় বাচ্চাটা। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তৃপ্তীশ এর বাবা আর মা। নন্দন বাবু মনে মনে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসেছেন স্ত্রীর কান্না কাটি দেখে। একমাত্র ছেলে বলে কথা। যতোই ক্রিমিনাল হোক নিজের সন্তান তো!
ওসি সাহেব সঞ্জয় সিং সবার সামনেই বলতে শুরু করলো,
“ আসামি ওরফে তৃপ্তীশ রায় যে এতো জঘন্য রকমের একটা ক্রিমিনাল মাইন্ডের মানুষ ওনাকে দেখলে কিন্তু বোঝাই যায় না। শুধু মাত্র প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে যে আস্ত একটা মানুষের উপর হামলা করে বসবেন কেউ কি তা ধারণা করতে পেরেছিল! কিন্তু সেটাই হয়েছে। উনি এই ছেলেটাকে ভাড়া করে হামলা চালিয়েছে তপন বাবুর উপর। ওই ছেলেটির নাম বিজয়। বাড়ি বিহারের কানাড়া নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বছর দুয়েক আগে কাজের খোঁজে আসে কোলকাতায়। তারপর কোনো এক ভাবে হেরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তৃপ্তিশ এর সাথে যেদিন কলেজের সামনে সমর বাবু আর রিদিমা ম্যাডামের ঝামেলা হয় সেদিনই পরিচয় হয় ওদের। তৃপ্তীশ পর পর দুজনের হাতে ভরা ক্যাম্পাসে মার খেয়ে যখন রাগে ফুসছিল তখন ওখানেই ছিল বিজয়। ও রোড সাইড একটা হোটেলে এঁটো বাসন মাজার কাজ করতো। তো, এর পর কিভাবে কিভাবে যেন ওদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপরই বন্ধুত্ব।
কথায় কথায় তৃপ্তীশ ছেলেটার দুর্বলতার কথা জানতে পেরে পয়সার বিনিময়ে ওকে কাজে লাগায়। প্রথমে তো চেষ্টা করেছিল কোনো ভাবে রিদিমা ম্যাডামের বড়সড় কোনো ক্ষতি করে দেওয়ার। কিন্তু পারে নি। পরে প্ল্যান চেঞ্জ করে তপন বাবুর অ্যাক্সিডেন্ট করানো হয়।”
তপন বাবু মনিকা সহ রিদিমা থানায় উপস্থিত সকলেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ওসি সাহেবের কথা গুলো শুনে। ওসি সাহেব ওদের দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে লাগলো,
“ কতোটা সূক্ষ্ম ভাবে যে প্ল্যান টা করা হয়েছিল আপনারা তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেন না। আমরা তো ঘটনা টাকে জাস্ট অ্যাসিডেন্ট বলে চালিয়ে দিচ্ছিলাম। হয়তো ওই বিজয় নামের ছেলেটা কখনও ধরাই পড়তো না। শুধু ৪২০ এর ফ্রডারি মামলায় কয়েকমাসের জেল খেটে বেল নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতো ক্রিমিনাল টা। যদি না ওই সূক্ষ্ম ভুল টা তৃপ্তীশ করতো।”
বলেই পেছন ঘুরে এক পলক তাকালো তৃপ্তীশ এর নত করে রাখা মুখটার দিকে।
“ উনি ভুলে গেছিলেন যারা নেশায় আসক্ত হয় তারা একবার কোথাও টাকার গন্ধ পেলে বারবার সেখানেই হাতড়ায়। এই কেসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শুরু করে সব জায়গায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও যখন আমরা কিছুই পাই নি তখন প্রায় আশাই ছেড়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু ঠিক তখনই একটা ছোট্ট মেসেজ কেসের জট এক টানে খুলে দেয়। বিজয় কে যে পরিমাণ টাকা দিয়েছিল তৃপ্তীশ সব টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় মাস দুয়েকের মধ্যেই ভাঁড়ারে টান পড়ে বেচারার। তখন ও উপায় না পেয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। আর তারপরই ধরা পড়ে আমাদের জালে।”
লম্বা কথা শেষ করে ওসি সঞ্জয় সিং বলে,
“ মিস্টার দত্ত, আমরা কালকের মধ্যেই চার্জশিট রেডি করে আদালতে জমা করবো। আর চেষ্টা করবো তার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করার।”
“ আমি তৃপ্তীশ কে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই অফিসার!”
তপন বাবুর কথায় ওসি সাহেব তাকালো তার দিকে। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল,
“ করুন। কিন্তু যা জিজ্ঞেস করবেন লকাপের বাইরে থেকে করুন। যদিও এভাবে আসামি কে সামনে রেখে কথা বলানোর নিয়ম নেই। তবুও দত্ত বাবুর রিকোয়েস্ট তাই আমি ইগনোর করতে পারি নি।”
তপন বাবু লোহার গরাদের বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন,
“ তুমি এমনটা কেন করলে তৃপ্তীশ। আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। আর না আমার মেয়েটা তোমার কোনো ক্ষতি করেছে। তাহলে?”
তৃপ্তীশ একথার জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। তপন বাবু তৃপ্তীশ কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জবাব টা বুঝে নিলেন মনে মনে। মনিকা রাগে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠলো,
“ ছিঃ! আমার ভাবতেও ঘৃণা হয় তোমার মতো একটা ক্রিমিনালের সাথে আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটাকে বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে গেছিলাম আমি। হায় রে, না জানি কত মানসিক অত্যাচার করেছি মেয়েটাকে রাজি করানোর জন্য।”
বলেই চোখ মুছলো আঁচলে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“ তবে আমি তোমাকে একটা কারণে ধন্যবাদ দেবো। বিয়ের দিন তুমি যদি আমার মেয়েকে বদনাম করার জন্য সমরের নাম না জড়াতে তাহলে হয়তো আমার মেয়েটা এত ভালো একটা মানুষ কে কখনই জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতো না। আর এটার জন্য তুমি অবশ্যই ধন্যবাদের দাবি রাখো।”
মনিকা একথা বলে তৃপ্তীশ এর মায়ের দিকে তাকালো। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ক্ষোভ উগরে বলল,
“ কি যেন বলেছিলেন আপনি! সন্তান শুধু জন্ম দিলেই হয় না তাকে সুশিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ ও করতে হয়। আজ দেখে নিন কে নিজের সন্তান কে মানুষ করতে পারে নি। আমি নাকি আপনারা! কারণ সন্তান তো রাস্তার কুকুরও জন্ম দেয়।”
মিসেস রিতা লজ্জায় অপমানে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইলো এক কোনায়। কিন্তু নন্দন বাবু সইতে পারলেন না এতো বড় বাজে কথাটা। তিনি এক নজর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। কারণ তার পক্ষে আর বাজে কথা সহ্য করা সম্ভব না। এমনিতেও পাড়ার লোকে তাদের একঘরে করেছে। ক্লাবের ছেলেপেলে রোজ রোজ হুমকি ধামকি দিয়ে যায় পাড়া ছাড়া করার। পাশের বাড়ির মহিলা গুলো অনর্গল টোন টিটকারী মেরে কথা শুনায়। মেয়েটাও সম্পর্ক কেটেছে মাস দুয়ের বেশি হয়ে গেল। জামাই টা আগে যাও বা টুকটাক খোঁজ খবর নিত সেই বিয়ের ঘটনার পর থেকে সে ভুলেও ফোন করে না খোঁজ খবর নেওয়া তো দূরের কথা।
মনিকা ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল সেখান থেকে। রিদিমা অনেক ক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবার মুখ খুলল,
“ যদিও প্রশ্ন করার কিছুই নেই তবুও একটা কথা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা তৃপ্তীশ আপনি হঠাৎ আমার উপর এতো প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে গেলেন কিভাবে? আপনি না সব সময় দাবি করতেন আপনি নাকি আমাকে ভালোবাসেন!”
তৃপ্তীশ এই পর্যায়ে মুখ তুলল। হাতকড়া পরানো হাত দুটো দিয়ে এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে। অতঃপর দুপা হেঁটে এসে দাঁড়ালো রিদিমার সামনে। মাঝখানে শুধু মাত্র একটা লোহার শিকের দেওয়াল আর ঘৃণার দূরত্ব। তৃপ্তীশ রিদিমার চোখে চোখ রেখে বলল,
“ তোমাকে ঘৃণা করতে তুমিই আমাকে বাধ্য করেছো রিদিমা। আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে ভালবাসতাম।”
রিদিমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“ আমি কিভাবে আপনাকে বাধ্য করেছিলাম।”
তৃপ্তীশ রিদিমার পাশে দাঁড়ানো সমরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“ তোমার মনে আছে একদিন তুমি এই লোককে রাস্তার মধ্যে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলে। আমি কিন্তু তখন ওখানেই ছিলাম। নিজের ফিয়ান্সে কে একটা পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরে পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যে কারো মাথা গরম হবে। আমারও হয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে বসে কথা বলতে। একটা মিউসিয়াল ডিসকাশন এ আসতে। কিন্তু কি দেখলাম! এই লোক তোমাকে যত্ন করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পার্কে। আর তারপর বেঞ্চে বসিয়ে প্রেমিকদের মতো সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমার মাথা গরম হবে না!!
তাই তো তোমরা কি করো সেটা দেখতে লাগলাম দূর থেকে। তুমি কাঁদছিলে আর এই লোক পাক্কা প্রেমিকের মতো নিজের রুমাল এগিয়ে দিলো। আর তার কিছুক্ষন পর তোমার ঢংয়ের কান্না ও থেমে গেল। আর তারপর তোমরা দুজন গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে গেলে। কিন্তু আমিও সেদিন থেমে থাকিনি। গাড়ির পিছু নিয়ে সেই সেই জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে যেখানে তোমরা গেলে। ওই ফাস্ট ফুডের দোকানে মেডিক্যাল শপে আর তারপর তোমার কলেজে।
আমি আসলেই সেদিন আলোচনা করতে চেয়েছিলাম আমাদের মধ্যের অশান্তি নিয়ে। কিন্তু তোমার বার বার করা ইগনরেন্স আর অন্য পুরুষের সাথে ঢলাঢলি দেখে আমি সহ্য করতে পারি নি। তাই সেদিন হঠাৎ রুড বিহেভ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার বদলে তুমি কি করলে ভরা পাবলিক প্লেসে আমাকে চড় মারলে। আমাকে জুতো দিয়ে মারার হুমকি দিলে। আর তারপর তুমি চলে যেতেই এই লোক আমাকে হুমকি দিলো। এমনকি সবার সামনে মেরে মাটিতে ফেলে শাসালো যাতে তোমার থেকে দূরে থাকি নয়তো আমাকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াবে। আমি এতটা অপমান জীবনেও হই নি। কেউ আমাকে এতোটা ইনফ্রাওরিটি ফিল করায়নি যতোটা তোমরা করিয়েছিলে সেদিন।”
“ তাই আপনি সেই অপমানের প্রতিশোধ তুলতে এতো বড় একটা পরিকল্পনা আঁটলেন। তাইতো!”
তৃপ্তীশ রিদিমার কথার জবাব দিলো না। রিদিমা হাসলো। শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
“ আপনি আমাকে কোনোদিন ভালই বাসেননি তৃপ্তীশ। কারণ যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে ডোমিনেশন করার মানসিকতা কোনোদিন থাকে না। আপনি আমাকে সব সময় ডমিনেট করতে চেয়েছিলেন। নিজের প্রপার্টি ভাবতে শুরু করে ছিলেন। যখন ডমিনেট করতে পারেন নি, নিজের পার্সোনাল প্রপার্টি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন নি। ঠিক তখনই ক্ষেপে গেলেন আর প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে গেলেন।”
তৃপ্তীশ রিদিমার দিকে অপলক তাকিয়ে কথা গুলো শুনলো। রিদিমা সমরের হাত টা নিজের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
“ জানেন তৃপ্তীশ ভালোবাসা মানে পাশে থাকা। বিপদে ভরসার আশ্রয় হওয়া। বন্দীত্ব ঘুচিয়ে উন্মুক্ত আকাশে উড়তে দেওয়া। পরস্পরের প্রতি সম্মান রাখা। আর তার চাইতে বড় কথা যেকোনো পরিস্থিতিতে তার হাত টা ঠিক এভাবে শক্ত করে ধরে রাখা। যাতে সে নির্ভিক হয়ে সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে নির্ভয়ে। না কি প্ল্যান করে ফাঁসানোর চেষ্টা করা।”
তৃপ্তীশ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো এই পর্যায়ে। রিদিমা তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলল,
“ যাক, যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আর আগামী তে যা হবে তা ভালোই হবে। আশা করছি সাজা সমাপ্তি হলে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করবেন। আসি।”
রিদিমা সমরের হাত টা ধরে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এলো। অতঃপর বাবা মা কে বিদায় জানিয়ে চলে গেল নিজের আস্তানার উদ্দেশ্যে। সমর আজ একটা কথাও বলে নি। ও শুধু মন দিয়ে রিদিমার চোখে মুখে ফুটে ওঠা আত্মবিশ্বাস দেখছিল। আরও দেখছিল নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন। আসলেই ঈশ্বর আছেন। তিনি সবাইকে ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগ দেন। শুধু মাত্র সুযোগ টা আমাদের লুফে নিতে হয়।
এর পর প্রায় এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। যা ঘটলো তাতে সমরের স্বপ্নের ঘরে যেন বজ্রপাত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
চলবে….