তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-৪২ এবং শেষ পর্ব

0
15

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
পর্ব: ৪২
সমাপ্তির প্রথম পর্ব

রিসেপশনের আয়োজনে ব্যস্ত হয়েছেন মিসেস চিত্রা। বাড়ি শুদ্ধ আত্মীয় স্বজনদের একে একে ফোনে নিমন্ত্রণ সারছেন হাসিমুখে। সমর নিজেও ব্যস্ত হয়েছে আয়োজনের কাজে। রিসেপশন মূলত হবে দুই ধাপে দুই জায়গায়। প্রথম ধাপ সম্পন্ন হবে কলকাতায়। রিদিমার বাপের বাড়ির সমস্ত আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধব আর সমরের বিজনেস পার্টনার দের সাথে নিয়ে। অন্যদিকে পরের ধাপ আয়োজিত হবে সমরদের শিলিগুড়ির বাড়িতে নিজেদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে। এছাড়াও মিসেস চিত্রার বাপের বাড়ির লোকজন আছে। সাথে আছে পাড়া প্রতিবেশী সমেত সমরের কলেজের বন্ধু বান্ধবও যাদের সাথে সেই ছোট থেকে তার বড় হওয়া। একসাথে আড্ডা দেওয়া। ফুটবল খেলা ঘুরতে যাওয়া… না জানি আরও কত কি!
রিদিমার ইউনিভার্সিটি তে নতুন ক্লাস এখনও শুরু হয়নি দেখে মিসেস চিত্রা এক্ষুনি সেরে ফেলতে চাইছেন ঝামেলা গুলো। তাইতো যতোটা সম্ভব হয় গুছিয়ে ফেলতে চাইছেন সব কিছু।

ঘড়িতে তখন প্রায় সকাল সাড়ে দশটা বাজে। প্রতিদিনের মতো আজও রিদিমা বসে ছিল সায়নের স্কুলের সামনে। তবে একা একা। মিতালীদের গোটা টিম পাশের শপিং মলে ঘুরতে গিয়েছে। শপিং মল টা নতুন খুলেছে। যার কারণে অফার ও চলছে সব কিছুতে। রিদিমার ওদের সাথে যেতে ইচ্ছে করে নি।
কেন জানি গত দুদিন ধরে ওর শরীর টা ভালো না। গা গোলাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। বমি ও আসছে থেকে থেকে। এখনও সেরকমই লাগছিল। ঠিক তখনই ফোনের স্ক্রিন ভাসিয়ে কল এলো সমরের। রিদিমার তা দেখে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেপ্টে গেল। রিসিভ করে আদুরে গলায় বলল,
“ কি ব্যাপার মিস্টার, আজ হঠাৎ এই সময় ফোন?”

ওপাশ থেকে সমরের আবেগে আপ্লুত কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“ আমার শ্যামলতা কে যে বড্ড মিস করছিলাম। তাই তো এই সময় ফোন করলাম। কেন আপনার কি তাতে কোনো আপত্তি আছে ম্যাডাম?”

রিদিমার ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো প্রিয় মানুষটার কথায়। ও প্রত্যুত্তরে জানালো,
“ উহু, বরং ভালো লেগেছে। একা একা বসে এতক্ষণ বোর ফিল করছিলাম।”
“ সেকি! একা কেন! তোমার টিম মেম্বাররা কোথায়?”

রিদিমা বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“ ওরা ঘুরতে গেছে। ফ্লাই ওভারের পাশে একটা নতুন শপিং মল খুলেছে না ওখানে গেছে সবাই।”
“ তুমি যাও নি কেন?”
“ আমার যেতে ইচ্ছে করে নি।”
“ কেন?”
“ শরীর ভালো লাগছিল না তাই।”

সমর চিন্তা জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“ কেন? তোমার হঠাৎ আবার কি হলো!”

রিদিমা ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে বলল,
“ জানি না কি হয়েছে। ভেতর থেকে একটুও বেটার ফিল করছি না। সব সময় মনে হচ্ছে আমার মাথা ঘুরছে।”

রিদিমার মাথা ঘোরার কথা শুনে সাথে সাথে সমরের কপালে ভাঁজ পড়লো। চিন্তায় গুটিয়ে আসা ভ্রূ জোড়া আরেকটু কুঁচকে মনে মনে ভাবলো,
“ পিল গুলো তো সময় মতো দেওয়া হয়েছে রিদিমাকে তাহলে হঠাৎ মাথা ঘুরাবে কেন?”

রিদিমা ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
“ হ্যালো সায়ুর পাপা, কোথায় হারালে?”
“ আছি!”

বলে সমর বেশ সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ আচ্ছা রিদিমা তোমার লাস্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিল?”

পিরিয়ডের নাম শুনতেই চমকে উঠলো রিদিমা। সে আমতা আমতা করে বলল,
“ বিয়ের এক সপ্তাহ আগে কেন?”

সমর মনে মনে হিসেব কষে বলল,
“ তার মানে বিগত দুই মাসে তোমার এখনও একবারও পিরিয়ড হয় নি।”

রিদিমা খানিক ভয় পেয়ে বলল,
“ না।”

এবার সমরের গলার কন্ঠটা আরেকটু শক্ত হয়ে গেল।
“ এই তোমাকে যে পিলস গুলো এনে দিয়েছিলাম সেগুলো কনটিনিউ নিতে তো!”

রিদিমা এবার কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। কারণ সে রেগুলারিটি মেটেইন করে খায় নি। এক দিন খেয়েছে তো দুদিন মাঝ খানে অফ গেছে। রিদিমা চিন্তায় শুকনো ঢোক গিললো। ওপাশ থেকে সমরের কড়া কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
“ কি হলো বলো?”

রিদিমা বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে মিথ্যে বলল,
“ হ্যাঁ অবশ্যই। খেয়েছি তো নিয়ম মেনে প্রতিদিন। তোমার বিশ্বাস না হলে বাড়িতে ফিরে চেক করে নিও।”

সমর রিদিমার আত্ম বিশ্বাসে ভরা কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যা শুনে রিদিমার মনটা হঠাৎ করে কষ্টে ডুবে গেল। মস্তিষ্ক জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো একের পর এক বাজে ভাবনা। আচ্ছা, মানুষটা কি তাহলে চায় না তার নিজের একটা বেবী হোক। সেও একটা সন্তান ধরুক নিজের শরীরে। তারও কোল আলো করে আসুক একটা ছোট্ট নিজের কেউ। নাকি মানুষটা ভাবছে আমার সন্তান এলে সায়নের প্রতি তার ভালোবাসা কমে যাবে। যত্ন কমে যাবে। আমি অন্য সৎ মায়ের মতো নিজের সন্তানের দিক টা দেখতে গিয়ে সায়নের প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দেবো। এমনকি তার বিষয় আশয় সম্পত্তিতেও ভাগীদার এসে যাবে। রিদিমার ভাবনার মাঝে একে একে মনে পড়লো সমরের সেই সেদিনের বলা কথা গুলো। মানুষটা সেদিন কি বিশাল দৃঢ়তা নিয়ে সায়নের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসার কথা গুলো বলেছিল। সেই সাথে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার জীবনে সায়নের স্থান ঠিক কতখানি গুরুত্বপুর্ন।

এসব নানা কথা ভেবে রিদিমা যখন দুর্ভাবনায় ডুবে সমর তখনও চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“ তাহলে তোমার হঠাৎ পিরিয়ড মিস হলো কেন?”

রিদিমা বুক ভরা কষ্ট টা চেপে গিয়ে বলল,
“ চিন্তা করো না। আমার ইরেগুলার পিরিয়ডের সমস্যা আছে।”
“ ওহ্!”

সমর বোধ হয় এবার পুরোপুরি চিন্তা মুক্ত হলো। ও বলল,
“ তাহলেও একবার ডাক্তার কে দেখিয়ে নিতে হবে। সামনে অনেক চাপ। তোমার সুস্থ থাকাটা জরুরি।”

রিদিমা বেশি কিছু বলল না। শুধু প্রত্যুত্তরে হুম্ জানালো। সমর ফোন রাখতে গিয়ে জানালো,
“ শোনো আজ আমি বোধ হয় তোমাদের নিতে যেতে পারবো না। তুমি ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যেও।”
“ আচ্ছা।”

বলে ফোন কেটে দিলো রিদিমা। তারপর অদূর ভবিষ্যতের ভাবনায় বিলীন হয়ে গেল। সে জানে না তার গর্ভে সন্তান এসেছে কি না। কিন্তু যদি আসে তাহলে? মানুষটা আজ সন্দেহ করে যেভাবে রুড প্রতিক্রিয়া দেখালো তাতে মনে হলো না ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তাহলে সে খুশি হবে। রিদিমা ডান হাতে কপাল চেপে চোখ দুটো বুজে নিলো। চিন্তা হচ্ছে। যদি সে সত্যিই প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে কি হবে?

*
কড়াই থেকে মাছ পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই রান্না ঘরে ছুটে এলেন মিসেস চিত্রা। তাড়াহুড়ো করে গ্যাস অফ করে চেঁচিয়ে উঠলেন চুমকির নাম ধরে। চুমকি তখন কান থেকে ফোনটা ছিটকে বিছানায় ফেলে ছুটে এলো সেখানে। তটস্থ চেহারায় তাকিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ মা কি হয়েছে বলো?”
“ তোর আজকাল কি হয়েছে সেটা বল।”

মিসেস চিত্রার রাগে লাল মুখটা দেখে ঘাবড়ে গেল চুমকি। ভয়ে শুকিয়ে আসা গলাটা শুকনো ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
“ কেন মা কি হয়েছে?”
“ কি হয়েছে সেটা তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? কড়াইতে মাছ বসিয়ে কোথায় গিয়েছিলি তুই। দেখতো পুড়ে সারা ঘরে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে।”

চুমকি মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় বলল,
“ আমি আসলে বুঝতে পারিনি মা। আসলে আগুনের তাপে খুব মাথা ঘুরাচ্ছিলো। তাই তো একটু ঘরে গিয়ে….”

মিসেস চিত্রা সন্দেহী চোখে তাকালেন। কাছে এসে বললেন,
“ এই কি হয়েছে বল তো তোর। সেদিনও বলছিলি মাথা ঘুরাচ্ছে। আজও বলছিস মাথা ঘুরাচ্ছে।”

চুমকি চোখ মুখ অন্ধকার করে বলল,
“ আমি জানি না মা আমার কি হয়েছে! সারাক্ষণ খালি মাথা ঘোরায়। বমি বমি পায়।”

মিসেস চিত্রা গভীর চোখে চুমকির দিকে তাকালেন। দেখলেন সত্যি মেয়েটার চোখ মুখ শুকিয়ে কেমন যেন কাঠ হয়ে গেছে। চোখের তলায় এক চোট কালির মোটা আস্তর। উনি চুমকির থুতনী ধরে মুখ টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন,
“ তাই তো! তোকে তো সত্যি সত্যিই অসুস্থ দেখাচ্ছে। চল তোকে আজ ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি।”

চুমকি ডাক্তারের কথা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। মিসেস চিত্রা ওকে ঘরে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই কাজে হাত লাগালেন। চুমকি দুরু দুরু বুকে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে খাটের উপর জড়সড় হয়ে বসে কল লাগালো সেই চেনা নম্বরে। রিং হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেসে এলো সেই ভয়ংকর কণ্ঠ….
“ কি হলো বললি না যে, দিয়েছিলি তো মেডিসিন টা?”

চুমকি চুপসান চাপা গলায় বলল,
“ হ হ্যাঁ দিয়েছিলাম।”
“ কবার দিয়েছিস?”
“ দুবার বলেছিলেন দুবারই দিয়েছি। গতকাল সকালে একবার আর আজ সকালে একবার চায়ের সাথে মিশিয়ে দিয়েছি।”
“ গুড।”

চুমকি এবার কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“ বল!”
“ আপনি যে ওষুধ টা পাঠিয়েছেন তাতে ওর প্রাণের কোনো ক্ষতিটতি হবে না তো?”
“ তুই নিশ্চিন্তে থাক। এমন কিছুই হবে না।”
“ সত্যি তো। দেখুন আমি কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছি।”

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। চুমকির বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলো তা।
“ যদি সত্যিই এমনটা হয় তাহলে আমার কি? ফাঁসবি তো তুই!”

চুমকি এবার যেন কেঁদেই ফেলল। ভয়ে শিউরে উঠে বসা থেকে এক ঝটকায় নেমে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। কাঁপা গলায় শব্দের ধার তুলে বলে উঠলো,
“ কি বললেন, আমি ফাঁসবো মানে! এসব তো আপনি করেছেন। আমার নাম কেন আসবে এখানে?”

ওপাশের মানুষটা কৌতুক করে বলল,
“ ওমা আমি আবার কি করলাম! সব তো তুইই করলি। রিদিমার নামে কালাজাদু করা টোনা টোটকা করা তার বালিশের তলায় শেকড় রাখা তার পুত্তোলিকা বানিয়ে ঝাড়ফুঁক করা সবই তো তুইই করলি। অথচ এখন দোষ দিচ্ছিস আমার নামে। বারে বাহ্।”

চুমকি এবার অনুনয় বিনয় করা শুরু করে দিলো,
“ প্লীজ দয়া করুন বৌদি। আমি সারাটা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো। তবুও আপনি আমাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন না পিলিজ।”

চুমকির অনবরত কান্না করা শুনে ওপাশ থেকে খিল খিল করে হাসির বিশ্রী শব্দ ভেসে এলো ফোনের এপাশে। চুমকি মাঘ মাসের শীতে কাঁপার মতো ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো সে হাসি শুনে। কিছুক্ষণ পর হাসি বন্ধ করে মহিলা বলে উঠলো,
“ শোন তোর মতো অকৃতজ্ঞ গোলাম আমাকে কেউ ফ্রিতে দিলেও নেবো না। থু তোদের মতো নরকের কীটের মুখে। যে থালায় খাস সেই থালায় ফুটো করিস।”

চুমকি শুনে একটাও প্রত্যুত্তর করলো না। কারণ আসলেই সে তাই করেছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে ওপাশ থেকে কট করে লাইন বিচ্ছিন্ন হতেই হতাশায় ডুবে ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো চুমকি। মাথার চুল টেনে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে নিজেকে দফায় দফায় গালি দিতে লাগলো সে। কেন যে সেদিন ওসব করতে গেল তাই ভেবে। কথায় বলে কারো জন্য গর্ত খুঁড়লে আগে সেখানে নিজেকেই পড়তে হয়। চুমকির মনে হলো কথাটা একেবারে ওর জন্যই বানানো হয়েছে। হিংসায় রাগে অন্ধ হয়ে ও যেমন রিদিমার ক্ষতি করতে গেছিল ঠিক তেমনি ঈশ্বর ওই ধূর্ত মহিলার হাত ধরে আজ তাকেই সেই ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আজ যদি রিদিমার কিছু হয় তাহলে আইনের নজর খুঁজতে খুঁজতে একদিন ঠিকই তার উপর এসে পড়বে। আর তারপর তার ঠাঁই হবে পুলিশের শ্রীঘরে।

চুমকি মুখে বিছানার চাদর গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওর মিসেস চিত্রার কথা মনে পড়লো। আজ থেকে বিগত তিন বছর আগে ওর নরক গামী জীবন টা কে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল মানুষটা। তাকে নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছিল। সন্তানের মতো বুকে আগলে নিয়েছিল। আর সেই কিনা তার সাথে এতো বড় প্রতারণা করতে পারলো! ছিঃ!

চুমকি দুহাতে চোখ জোড়া ডলে মুছে নিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,
“ একটা কথা মনে রাখবেন বৌদি ডাইনি যখন মরে তখন কিন্তু সাত নিয়েই মরে। আপনি কি ভাবছেন আমি ফাঁসলে আপনি ছাড় পেয়ে যাবেন। তাতো হবে না বৌদি। আমি ফাঁসলে ফাঁসবেন আপনিও।”

*
সায়নের স্কুল ছুটি হতে তখনও চল্লিশ মিনিট মতো বাকি। এদিকে রিদিমা মাথা ঘোরার চোটে বসে থাকতে পারছে না। ঠিক তখনই পাশে এসে বসে ব্যাগি জিন্স আর লেডিস শার্ট পরা এক মহিলা। যার মুখে কালো মাস্ক আর চোখে গগলস। রিদিমা দেওয়ালে হেলান দিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে ছিল চুপ করে। মহিলা সান গ্লাভস পরা হাতে ফোন ঘাটতে ঘাটতে বলে উঠলো,
“ হায় রিদিমা কেমন আছো?”

রিদিমা পরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালো। পাশে বসা মধুপ্রিয়া কে দেখে মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে স্বচ্ছ হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ দেখে কি খারাপ মনে হচ্ছে আমাকে?”

মধুপ্রিয়া মাস্কের আড়ালে লুকিয়ে চাপা হাসলো। গগলসের ভেতর দিয়ে রিদিমার চোখে চোখ রেখে বলল,
“ তুমি কিন্তু আসলেই অনেক বেশি সাহসী একটা মেয়ে। স্বামীর প্রক্তনের সাথে এমন ভাবে কথা বলো যেন তার সাথে তোমার কত দিনের সম্পর্ক।”

রিদিমা স্কুলের গেটের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“ সেটা হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়। আমি যদি স্বামীর প্রাক্তন কে দেখে ভয় পাই তাহলে সে আমাকে দূর্বল ভাববে না!”

রিদিমার কথায় মধুপ্রিয়া হাসলো। বলল,
“ জানো তো রিদিমা পুরুষ মানুষের হৃদয় বড় স্বচ্ছ হয়। যেখানে তার প্রথম ভালোবাসা সব সময়ই এক অনন্য অবিস্মরনীয় হয়ে গেঁথে থাকে। যেমন আমার ভালোবাসা গেঁথে আছে সমরের হৃদয়ে।”

রিদিমা হেসে বলল,
“ তাই নাকি?”
“ হুম্?”
“ কিভাবে?”
“ সায়ন আমার অংশ আমার সন্তানকে বুকে আগলে।”

রিদিমার মুখটা শুকিয়ে গেল সায়নের প্রসঙ্গ উঠতেই। মধুপ্রিয়া রিদিমার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ তুমি কি জানো একমাত্র সায়নের জন্যই ও এতগুলো দিন কাউকে ওর জীবনের সাথে জড়ায়নি। তোমাদের একসিডেন্টাল বিয়ের কথাটা শুনলাম সেদিন। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ওই দিন ওই ঘটনাটা না ঘটলে আজও সে কাউকেই নিজের জীবনে আসতে দিতো না। তারমানে বুঝতে পারছো ওর জীবনে আমার উপস্থিতি আজও কতটা মূল্যবান।”

রিদিমা মধুপ্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো। হাসতে হাসতেই বলে উঠলো,
“ মানুষকে অনেক অবাস্তব স্বপ্ন দেখতে দেখেছি কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনার মতো এমন ফালতু স্বপ্ন কোনোদিন কাউকে দেখতে দেখি নি। যাইহোক, প্লীজ ক্যারি অন। আমি গেলাম। আমার বাচ্চাটার ছুটির সময় হয়ে গেছে।”

স্কুল ছুটির পর যখন সায়নের হাত ধরে বেরিয়ে এলো রিদিমা তখন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। চোখের সামনে সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। সারা পৃথিবী টলছে উত্তাল সমুদ্রে ভাসমান নৌকার মতো। রিদিমা কোনো মতে স্কুল এর সামনে থেকে ভিড় এড়িয়ে বেরিয়ে এলো। খানিকটা দূর আসতেই ওর হাত পা কাঁপা শুরু হলো মৃগী রোগীর মতো। রিদিমা তাড়াতাড়ি পার্স খুলে ফোন টা বার করতে গেল। কিন্তু পারলো না। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল সেটা। রিদিমা কাঁপা হাত টা নেড়ে কাউকে ডাকতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তার আগেই চোখের সামনে গোটা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে ধপ করে বসে পড়লো সড়কে। শ্বাস প্রশ্বাসের অস্বাভাবিক চলন আর অসাড় হয়ে আসা মস্তিষ্কে কাউকে যেন খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ততক্ষণে চোখের সামনে সব কিছু একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। রিদিমা আস্তে আস্তে রোদে পোড়া সড়কে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। শুধু নিভে আসা মস্তিষ্কে ক্ষীণ স্বরে পৌঁছলো সায়নের ভয়ার্ত কন্ঠের অসহায় কান্না।

চলবে…

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
(সমাপ্তি পর্ব)

হাসপাতালের আইসিইউতে জীবন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে থাকা মেয়েটাকে দেখে সমরের গোটা পৃথিবীটা যেন মুহূর্তেই টলে গেছে। হুড়মুড় করে ভেঙে গেছে দুচোখ ভরে দেখা আগামীর সেই সুন্দর ভবিষ্যত। মুখের অক্সিজেন মাস্ক আর লাইফ সাপোর্ট মনিটরে এঁকেবেঁকে চলা ওই দাগ গুলোতে যতবার চোখ পড়ছে সমরের মনে হচ্ছে ওর হৃদ যন্ত্রটা যেন এক্ষুনি খুলে বেরিয়ে আসবে বুকের পাঁজর ভেঙে।

হাসপাতালে করিডোর জুড়ে তখন কান্নার ঢেউ। একদিকে যেমন মিসেস চিত্রা কাঁদছেন আরেকদিকে কাঁদছে চুমকি। কারণ তার ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। যদি রিদিমা মারা যায় তাহলে পুলিশ আসবে। আর পুলিশ এলেই সবার আগে ধরবে তাকে। মনিকা মেয়ের এমন দুরবস্থা দেখা মাত্রই সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাই তাকেও ভর্তি করা হয়েছে জেনারেল ওয়ার্ডে। দীপ্ত আর পরমা এই মুহূর্তে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওদিকে তপন বাবু, তিনি যেন পাথর হয়ে গেছেন মেয়ের অবস্থা দেখে। তিনি যেন কিছুতেই বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার আদরের ছোট মেয়েটা ওই কাঁচে ঘেরা ঘর টায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এভাবে ঝুলছে। তাদের থেকে হাত খানেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে মধুপ্রিয়া। অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে রিদিমার জন্য চিন্তায় মরতে বসা মানুষ গুলোকে।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। রিদিমা তখন সায়নের হাত ধরে স্কুলের গেট পেরিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে হাঁটছিল। ওদিকে রিদিমার কথায় স্তম্ভিত মধুপ্রিয়া তখন অপমানের জবাব দিতে ওর পিছু পিছু আসছিল। কারণ ‘আমার বাচ্চাটা’ কথাটা ওর হৃদয় চিড়ে বেরিয়ে গেছে। যে সন্তান কে সে দশটা মাস গর্ভে ধরলো। ছয়টা মাস দেহের রক্ত জল করা দুধ খাইয়ে বড় করলো। আজ সেই সন্তানকে দুদিন আসা এই মেয়ে বলে কিনা তার বাচ্চা! এই কথাটা যেন প্রিয়ার কিছুতেই সহ্য হলো না। প্রিয়া মানুষের ভীড় ঠেলে রিদিমার পিছন পিছন আসছিল যাতে তাকে কড়া গলায় কটা কথা শোনাতে পারে। কিন্তু তার আগেই অঘটন ঘটে গেল। মেয়েটা হাত পা ছড়িয়ে ধপাস করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। আর তার পাশে দাঁড়ানো সায়ন রিদিমাকে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিতেই ও আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ত্রস্ত গতিতে ছুটে এলো সেখানে। প্রথমে সায়ন কে বুকে আগল নিলো আর তারপর লোকজনের সাহায্য নিয়ে মেয়েটাকে নিজের গাড়িতে তুলে ছুটে এলো হাসপাতালে।

ছোট্ট সায়ন সমরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে। ছোট ছোট চোখে অবাক হয়ে দেখছিল সবার বিষন্ন মুখ গুলো। ও বুঝতে পারছিল নিশ্চয়ই খারাপ কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি, সেটা ওর ছোট্ট মাথা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। সায়ন এক পলক কাঁচের ওপারে শুয়ে থাকা রিদিমাকে দেখলো। তারপর বাবার হাতটা টেনে ঝাঁকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“ ও পাপা পাপা! মামুনির কি হয়েছে গো? মামুনি ওখানে একা একা ঘুমিয়ে আছে কেন?”

সমর জবাব দিতে পারে না। তারও যে মন মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই প্রশ্ন, তার শ্যামলতা কি কারণে আজ ওই কাঁচের ঘরটায় শুয়ে?

“ আপনি কি পেশেন্টের হাসবেন্ড?”

নার্সের প্রশ্নে সমরের চেতনা ফিরে এলো। চশমার স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে ঢাকা ঝাপসা চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ।”
“ আপনি একটু আসুন। স্যার ইমারজেন্সি ডেকেছেন।”
সমর ছেলে কে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো নার্সের পিছু পিছু।

ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের করিডোর পেরিয়ে শেষ মাথায় ডাক্তারের কেবিন। নার্স দেখিয়ে দিতেই সমর নক করে ঢুকলো সেখানে। ডাক্তার বাবু চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। সমর সায়ন কে কোলে নিয়েই বসলো। ডাক্তার বাবু সিরিয়ার গলায় বললেন,
“ আপনার ওয়াইফের শরীরে মে বি হাইলি ইনফেকসিয়াস পয়জন জাতীয় কিছু গেছে যার কারণে ওনার ইন্টেস্টাইন ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাকস্থলী ওয়াস করে যতোটা সম্ভব আমরা বের করে দিয়েছি তবে পয়জন তার যতটুকু কাজ করেছে তাতে পেশেন্টের অবস্থা তো দেখতেই পারছেন। আপাতত আগামী চব্বিশ ঘন্টা ওনার জন্য ভীষণ বিপদজনক।”

সমর রিদিমার শরীরে বিষ পাওয়া গেছে শুনে হতবাক চোখে চেয়ে বলে উঠলো,
“ কি বলছেন আপনি! বিষ পাওয়া গেছে মানে?”
“ হ্যাঁ আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমরা ধারনা করছি পেশেন্টের শরীরে যে বিষ টা পাওয়া গেছে সেটা সাধারণ কোনো বিষ নয় বরং এক ধরনের ড্রাগ। যেটার কারণে ওনার বডি ধীরে ধীরে রেসপন্স করা বন্ধ করে দিয়ে সাথে সাথে প্যারালাইজড করে দিয়েছে।”

ডাক্তারের কথা গুলো সমরের কানে পৌঁছল কিন্তু মস্তিষ্ক রেসপঞ্জ করতে পারলো না। কারণ বার বার কানে বাজতে লাগলো একটাই প্রশ্ন, রিদিমার শরীরে বিষ এলো কোথা থেকে!”

“ আরেকটা কথা মিস্টার দত্ত।”

ডাক্তারের কথায় বিস্ময় ভেঙে কোনোমতে শ্বাস ফেলল সমর। সে তাকাতেই ডাক্তার বললেন,
“ আপনার ওয়াইফ কে কোনোমতে রেসকিউ করতে পারলেও ফিটাস টাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।”

রিদিমার শরীরে বিষ পাওয়া গেছে শুনে যতোটা না চমকে ছিল সমর। তার চাইতে হাজার গুণ বেশি চমকালো তার গর্ভে বেড়ে ওঠা সেই অজ্ঞাত ছোট্ট প্রাণ টার মৃতুর খবর শুনে। বিস্ময়ের তোপে হতবাক সমর যেন নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেল কিছুক্ষন। ওর হাত পা কাঁপছে। নিজের অংশের মৃত্যুর খবর শুনে কেউ যেন খামচে ধরেছে ওর হৃদপিন্ড। বুকের ভেতরে আচমকা এতো জোরে জোরে হাতুড়ি পেটা শুরু হলো যে সমরের মনে হলো যেন ওর পাঁজর গুলো এক্ষুনি গুড়ো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়বে এই টায়েলস বাঁধাই করা চকচকে মেঝেতে। সমর কাঁপা হাতে মুখ মুছে ডাক্তারের দিকে তাকালো। ভীষণ বিস্ময় চাপা কণ্ঠে বলল,
“ এসব আপনি কি বলছেন স্যার। রিদিমা প্রেগন্যান্ট ছিল?”
“ কেন আপনি কি জানতেন না, শী ওয়াজ প্রেগন্যান্ট ফর এইট উইকস। এই দেখুন রিপোর্ট!”

বলেই রিপোর্ট টা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। সমর কাঁপা হাতে নিলো সেটা। দেখলো অবিশ্বাস্য চোখে। কিন্তু কিছুতেই আজ দুপুরে রিদিমার বলা কথা গুলোর সাথে রিপোর্ট টা মেলাতে পারলো না। সমর চোখের চশমা ঠিক করে বলল,
“ কিন্তু ডাক্তার বাবু আমার ওয়াইফ তো নিয়মিত পিল নিতো। তাহলে কিভাবে…”
“ দেখুন পিল নেওয়ার একটা নিয়ম আছে। একটা গ্যাপ পুরো সাইকেল টাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আমি শিওর এক্ষেত্রে এমন টাই হয়েছে।”

সমর ডাক্তারের কেবিন থেকে কোনো মতে কাঁপা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে আসতেই ঝড়ের গতিতে সেখানে ছুটে এলো রঙ্গন আর হেমন্ত। চোখে মুখে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ এসব কিভাবে হলো।”

সমর জবাব না দিয়ে সায়ন কে মায়ের কাছে রেখে ধপাস করে বসে পড়লো চেয়ারে। হাত দুটো মুঠো করে কপালে ঠেকিয়ে পড়ে রইলো পাথরের মতো। রঙ্গন আর হেমন্ত একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। অতঃপর তারাও বসলো সমরের দুপাশে। কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
“ এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে বল। কি হয়েছে রিদিমার সেটা না জানলে আমরাই বা তোকে হেল্প করবো কেমন করে বলতো।”

সমর কপালে মুঠো ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেল। রক্তিম লালাভ চোখে চেয়ে রঙ্গন কে বলল,
“ ওসি সাহেব কে একটু হাসপাতালে ডাকতে পারবি।”
“ ওসি সাহেব!”
পুলিশের নাম শুনে সাথে সাথে চমকে উঠলো রঙ্গন আর হেমন্ত। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়া আর চুমকি ও চমকালো বিদ্যুতের গতিতে। রঙ্গন প্রশ্ন করলো,
“ কেন?”
“ কারণ টা ওসি সাহেব আসলেই না হয় বলি। আপাতত এই হাসপাতালের বাইরে যাতে এখানে উপস্থিত একটা ব্যক্তিও বেরোতে না পারে সেই ব্যবস্থা কর।”

সমরের কথায় রহস্যের গন্ধ পেয়ে সাথে সাথে কাজে লেগে পড়লো হেমন্ত আর রঙ্গন। কল করার আধ ঘণ্টার মাথায় ওসি সঞ্জয় সিং ঢুকলো সেখানে। সমর সবার সামনেই রিদিমাকে বিষ প্রয়োগ করার কথাটা জানালো। শুধু চেপে গেল তার অনাগত অংশের মৃত্যুর খবর টা। মিসেস চিত্রা থেকে শুরু করে উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো।

ওদিকে চুমকি পুলিশ দেখে ধরা পড়ার ভয়ে থর থর কাঁপছিল। সুযোগ খুঁজছিল কোনোমতে এখান থেকে পালিয়ে যাবার। তাই যখনই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাথরুম যাওয়ার নাম করে পালাতে গেল তখনই হাতেনাতে ধরা পড়লো রঙ্গনের কাছে। ওকে সাথে সাথে রিমান্ডে নিলো পুলিশ।

চৌদ্দ শিকের লোহার সেলে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে চুমকি কে। ঠিক তখনই ত্রস্ত গতিতে সেখানে ঢুকলো ওসি সঞ্জয় সিং। চুমকি তাকে দেখে কাঁদো কাঁদো সুরে বলে উঠলো,
“ বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিচ্ছু করিনি। আপনারা বিনা কারণে শুধু শুধু আমাকে ধরে এনেছেন।”

টেবিলের ওপাশে রাখা চেয়ার টা টেনে নিয়ে সঞ্জয় সিং বসতে বসতে বলল,
“ তাই নাকি। তাহলে হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছিলি কেন?”
“ কোথায় পালাচ্ছিলাম! আমি তো বাথরুম খুঁজছিলাম।”
“ ও আচ্ছা বুঝলাম। এবার সত্যিটা ঝেড়ে কাশ তো দেখি।”
চুমকি এবার কেঁদেই ফেলল।
“ স্যার বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই কিছু জানি না।”

ওসি সঞ্জয় সিং বিরক্ত চোখে তাকালো চুমকির দিকে। এই মুহূর্তে তার এতো ধৈর্য নেই যা খরচ করে ওকে আদর আপ্যায়ন করে জিজ্ঞেস করবে। তাই গলা বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন,
“ মিস্ পূজা!”

একজন লেডি কনস্টেবল দৌড়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
“ ইয়েস স্যার।”
“ আমার খুব ভীষণ সিগারেটের তলব লেগেছে। আমি ওটা শেষ করে আসার আগে আপনি এটাকে সেটিং করে ফেলুন।”
“ ইয়েস স্যার।”
বলেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো লেডি কন্সটেবল। অতঃপর কাল বিলম্ব না করে খপ করে চুমকির চুলের মুঠি ধরে ঠাস্ ঠাস্ করে চড় মারতে আরম্ভ করলো। চুমকি আচমকা বেধড়ক মার খেয়ে হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহত মুখে হাত জোড় করে বলে উঠলো,
“ ম্যাডাম আমাকে আর মারবেন না পিলিচ। আমি বলছি। আমি সব কিছু বলছি।”

তখন সন্ধ্যা বেলা। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে পাঠে বসেছেন সূর্য দেব। পশ্চিমাকাশের এক কোণে অল্প একটু লালিমা ঢেলে বিদায় জানাচ্ছে গোটা পৃথিবী কে। কোমর সমান লম্বা চুল গুলো পিঠ ময় ছড়িয়ে দিয়ে ওই ভর সন্ধ্যেয় ছাদের রেলিং দাঁড়িয়ে ছিল তিশা। মুখের আদলে বিবর্ণতা আর আচরণে এক অদ্ভুত প্রশান্তির বিচরণ। সোমেন আজ অফিস থেকে বড় অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কিছুক্ষণ আগে মিসেস চিত্রার ফোন পেয়ে রিদিমার সম্পর্কে যা কিছু শুনেছে তাতে তার পায়ের তলার মাটি কেঁপে গেছে। সে বাড়ি ফিরে মাকে সবটা জানাতেই নির্মলা মাথায় হাত চেপে বিছানায় বসে পড়লেন। চোখে মুখে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বললেন,
“ হ্যাঁ রে বাবু, মেয়ে টা বাঁচবে তো।”

সোমেন অন্ধকার মুখে জানালো,
“ জানি না মা। তবে শুনলাম অবস্থা নাকি খুব একটা ভালো না।”

নির্মলা আহাজারি করে বললেন,
“ হে ঈশ্বর, এ তুমি কি করলে শেষ পর্যন্ত। ছেলেটা এতগুলো বছর পর একটু সুখের মুখ দেখেছিল। তাতে আবার কার নজর লাগলো।”

সোমেন অস্থির হয়ে ছিল এই খবর টা তিশা কে জানাতে। তাই ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বসার ঘর রান্নাঘর শোবার ঘর সব জায়গায় চোখ বুলিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে বলল,
“ মা তিশা কোথায়?”
“ জানি না। দেখ হয়তো ছাদে গিয়ে বসে আছে। আজকাল তোর বউয়ের যে কি ভিমরতি হয়েছে জানি না। সারাক্ষণ দেখি মুখ পুড়িয়ে বসে থাকে। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না।”

সোমেন মায়ের কথায় পাত্তা দিলো না। শ্বাশুড়ি বৌমার নিত্যদিনের ক্যাচাল এসব। কানে যত কম তোলা যায় ততই মঙ্গল। সোমেন তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে ছাদে গেল। দেখলো আবছা আঁধার আলোয় খোলা চুলের তিশা কে কেমন যেন অশরীরীর মতো লাগছে। সোমেন হাত বাড়িয়ে ছাদের আলো জ্বালাতেই তিশা চোখে হাত চেপে বলল,
“ বন্ধ করো প্লীজ। চোখে লাগছে ভীষন।”

সোমেন আলো নিভিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। কণ্ঠে অস্থিরতা ছড়িয়ে বলল,
“ শুনেছ রিদিমা হাসপাতালে ভর্তি।”

তিশা নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
“ কেন ?”
“ জানি না। তবে বড় মামী জানালো ওর অবস্থা নাকি খুব ক্রিটিক্যাল। বাঁচবে না বোধ হয়।”

আঁধারের গভীরতার মাঝে বাঁচবে না বোধ হয় কথাটা শুনে তিশার ঠোঁটে এক প্রশান্তির হাসি খেলে গেল যা সোমেন দেখতে পেল না। তিশা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস টেনে আচমকা সোমেন কে জড়িয়ে ধরলো। বুকে নাক ডুবিয়ে বলল,
“ তুমি আমার জীবনে আরও আগে কেন এলে না সোমেন?”

তিশার হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় প্রচন্ড বিস্মিত হলো সোমেন। রিদিমার সম্পর্কে এতো বড় একটা খবর শোনার পর তিশার কাছে আচমকা এমন রিয়াকশন সে মোটেও আশা করে নি। ও দুহাতে তিশা কে ঠেলে সরিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল,
“ আশ্চর্য! পাগল হয়ে গেছ তুমি। আমি তোমাকে বলছি কি আর তুমি বলছো কি!”

তিশা রাগ করলো না। সোমেনের হাত দুটো ধরে ছলছল চোখে চেয়ে বলল,
“ সোমেন আমাদের না অনেক পথ চলার বাকি ছিল জানোতো। কিন্তু সেটা বোধ হয় আর সম্ভব হলো না।”

সোমেন তিশার এমন কথায় কেন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ও চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“ এই তিশা, কি হয়েছে তোমার। কি সব আবোল তাবোল বলছো তখন থেকে।”

তিশা জবাব দিলো না সোমেনের এ কথার। সে আরেকটু এগিয়ে এসে সোমেনের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
“ আমাকে ক্ষমা দিও সোমেন। আমি তোমাকে কোনোদিনও ভালো বাসতে পারি নি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও প্লীজ।”

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিশা। সোমেন তিশার কথা শুনে আর কান্না দেখে কেন যেন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। ও দুহাতে তিশা কে খাবলে ধরে অস্থির হয়ে বলল,
“ এই মেয়ে কি হয়েছে তোমার। সেই তখন থেকে কি সব উদ্ভট কথা বলছো। দেখো তিশা এমনিতেই রিদিমার খবর শোনার পর থেকে প্রচন্ড চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। তার মধ্যে তোমার এসব পাগলামো আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগছে না।”

তিশা কান্না থামিয়ে মলিন হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর চোখ মুছে আস্তে ধীরে পা বাড়ালো নিচে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো। নির্মলা গিয়ে দরজা খুলতেই চমকে উঠলো বাড়ির উঠানে একগাদা পুলিশ দেখে। উনি ভয় পেয়ে বাবু বাবু বলে ডাকতেই সোমেন তিশার আগেই ছুটে এলো নিচে। শিলিগুড়ি থানার ওসি কে দেখে সোমেন ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে বলল,
“ কি হয়েছে স্যার। আপনারা হঠাৎ আমাদের বাড়িতে।”
ওসি সাহেব সোমেন কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ মিসেস তিশা রায় আপনার কে হন।”
“ আমার ওয়াইফ।”
“ তাকে ডাকুন। ওনার নামে অ্যাটেম্পড টু মার্ডার এর কেস ফাইল হয়েছে।”
“ কি!!”
সোমেন আর নির্মলা যেন হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। ওদিকে লেডি কনস্টেবল গুলো ধুপধাপ পা ফেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর দুহাত পিছ মোড়া দিয়ে বেঁধে ধরে নিয়ে চলে গেল থানাতে।

পরের দিন দুপুর বেলা। রিদিমা সামান্য একটু রেসপন্স করতেই ডাক্তার জানালেন বিপদ কেটে গেছে। গোটা চব্বিশ ঘণ্টার চরম অস্থিরতা যেন ওই একটা সংবাদেই কেটে গেছে সকলের মন থেকে। রিদিমা কে ইমারজেন্সি থেকে নর্মাল বেডে শিফ্ট করা হলো সব রকম প্রিকোশণ মেনে। রিদিমা আলতো করে চোখ মেলতেই মনিকা কে দেখতে পেল। মনিকা কাঁদবে না কাঁদবে না করেও মুখে আঁচল চেপে কেঁদেই ফেলল। অক্সিজেন মাস্ক মুখে রিদিমা চোখের ইশারায় মাকে চুপ করতে বলে অস্থির চোখে খুঁজতে লাগলো ছোট্ট সায়নকে। গত কাল জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ও চেষ্টা করে গেছিল বাচ্চা টা কে নিরাপত্তা দিতে কিন্তু পারে নি। তাই জ্ঞান ফেরার পর সেই অস্থিরতা এখনও তার মস্তিষ্কে গেঁথে রয়েছে। মনিকা রিদিমাকে ছটফট করতে দেখে বলল,
“ কাকে খুঁজছিস মা। আমাকে বল।”

রিদিমা অনেক কষ্টে জানাতে চাইলো কিন্তু কথা বলতে পারলো না। ওর গলায় প্রচন্ড ব্যাথা। হবে না! গলার ভেতর পাইপ ঢুকিয়ে কাল সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ওয়াশ করা হয়েছে যে। নার্স পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এসে রিদিমাকে শান্ত হতে বলে বলল,
“ এভাবে উত্তেজিত হবেন না ম্যাম। আপনি কাকে দেখতে চান ইশারায় বলুন তাকে ডেকে নিয়ে আসছি।”

নার্স এক এক করে সবার নাম নিলো। রিদিমা সায়নের কথা শুনে ইশারায় জানালো সে তাকে দেখতে চায়। মনিকা মেয়ের কপালে আদর দিয়ে বেরিয়ে যেতেই সায়ন কে নিয়ে সেখানে ঢুকলেন মিসেস চিত্রা। সায়ন রিদিমা কে দেখে ছুটে এসে দাঁড়ালো একদম তার মাথার কাছে। ছোটছোট হাতে মুখে আদর করতে করতে বলল,
“ ও মামুনি জানো। আমি না তোমাকে খুব মিস করেছি। তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও না প্লীজ।’

বলে অনেক গুলো আদর করলো রিদিমার গালে। রিদিমা ও বিনিময়ে হাসলো। কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা কোনরকম মাথায় তুলে আদর ও করে দিলো বাচ্চাটাকে। মিসেস চিত্রা রিদিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাঙা গলায় বললেন,
“ কতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি জানিস। এভাবে কেউ ভয় দেখায়।”

বলেই আঁচল চেপে কেঁদে ফেললেন তিনি। রিদিমা নিজেও কাঁদলো। মিসেস চিত্রা রিদিমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক অনেক আদর করলেন। রিদিমা ও চুপ করে থেকে সেই আদর উপভোগ করলো। এর পর একে একে সবাই এলো। দেখা করলো। টুকটাক কথাও বলল। তারপর চলে গেল। সব শেষে এলো সমর। সম্পূর্ণ ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে। রিদিমা অশ্রু ভরা টলটলে চোখে তাকিয়েই রইলো প্রিয় মানুষটার মুখ পানে। মুখে কিছু না বলতে পারলেও মনে মনে বলে উঠলো, আমি এক্ষুনি তোমার বুকে একটু আশ্রয় চাই। একটু টেনে নাও না গো তোমার বুকের ওই উষ্ণ ওমে।

সমর গতকাল থেকে কষ্ট গুলোকে আটকে রেখেছিল বুকের ভেতরে পাথর চাপা দিয়ে। একদিকে ভালোবাসার মানুষটার বেঁচে থাকার লড়াই অপর দিকে অনাগত অংশের এমন ভয়াবহ মৃত্যু। যা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছিল ওর সমস্ত অনুভূতি গুলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেগুলো যেন উন্মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলো সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে। সমর রক্তাভ নয়নে রিদিমার চোখে চোখ রাখতেই ওর চোখ জোড়া আচমকাই ভরে উঠলো উষ্ম নোনা জলে। আর তারপর, বাঁধন খুলে হুড়মুড় করে ঝরতে শুরু করলো রাশি রাশি অনুভূতি হয়ে।

সমর রিদিমার গলায় মুখ গুঁজে গা কাঁপিয়ে কাঁদছে। ওদিকে রিদিমা কাঁদছে স্বামীর আদুরে স্পর্শ পেয়ে। সমরের হৃদয়ে তখন অনাগত অংশটাকে হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ। রিদিমার মনে তখন স্বামীর আদুরে স্পর্শে গলে যাওয়ার ঢেউ। অথচ মেয়েটা জানেই না কি অমূল্য রত্ন সে হারিয়ে ফেলেছে।

এদিকে কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে সমর আর রিদিমার এমন অনুভূতি প্রবণ দৃশ্য দেখে মনে মনে নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য হাসলো মধুপ্রিয়া। এককালে ঠিক এভাবেই তো তার সাথে কত শত পাগলামি করতো ছেলে টা। আর সে বিরক্ত হয়ে দূরে ঠেলে দিতো। ন্যাকামো ভেবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। অথচ আজ অদ্ভুত ভাবে সেই ন্যাকামো গুলোকেই তার ভীষণ ভাবে মনে পড়ে। সেই পাগলামি গুলোই পেতে চায় মন। কিন্তু তা আজ আর সম্ভব নয়। কারণ নিজের দোষেই যে সেসব হারিয়েছে সে। প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে ধীরে সরে গেল সেখান থেকে। একেবারে হাসপাতালের গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো। মনে মনে বলে উঠলো,
“ রিদিমা ঠিকই বলেছিল, সময়ের সাথে সাথে এক সময় মানুষের পছন্দ আর ভালোলাগা দুটোই অদ্ভুত ভাবে বদলে যায় যেখানে পুরোনো কোন কিছুর আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা। আমি অযথাই মরীচিকার পেছনে ছুটছি। আমার উচিত নিজের পথ নিজেই খুঁজে এগিয়ে চলা।”

দুদিন পর। জেলের লোহার সেলে মুখোমুখি বসানো হয়েছে তিশা আর চুমকি কে। চুমকির মুখ ফুলে থালার মতো হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার সাথে খাতির যত্ন বেশ ভালো ভাবেই হয়েছে দুদিন ধরে। সেলের ওপাশে দাঁড়িয়ে সমর হেমন্ত রঙ্গন আর সোমেন। সোমেনের অবস্থা বিধ্বস্ত। বিগত দুইদিন বেচারা কিভাবে কাটিয়েছে তার অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওসি সঞ্জয় সিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিশা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“ তো মিসেস তিশা, আসামি চুমকির বক্তব্য আপনিই নাকি সেই মাস্টার মাইন্ড যে ভয় দেখিয়ে মিসেস রিদিমার খাবারে বিষ মেশাতে ওকে বাধ্য করেছিলেন।”
“ হ্যাঁ!”

তিশার নির্লিপ্ত জবাবে কেঁপে উঠলো সমর সহ সকলে। ওদিকে লোহার শিক গুলো শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে ক্ষিপ্র গলায় চেঁচিয়ে উঠলো সোমেন,
“ এই তিশা পাগল হয়েছ তুমি। কি সব আজেবাজে কথা বলছো খেয়াল আছে তোমার।”

তিশা সোমেনের কথায় জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলো ওভাবে। সোমেন ছুটে সমরের হাত চেপে ধরলো। পাগলের মতো করে বলল,
“ এ ভাই দেখ না ও কি সব বলছে। ওকে তুই একটু বোঝা প্লীজ। ও কেন রিদিমার সাথে এমন করতে যাবে তুইই বল। ও পাগল হয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত ওর মাথায় সমস্যা হয়েছে।”

সমর সোমেন কে জড়িয়ে ধরলো বুকে। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“ চুপ কর ভাই। আগে ওকে বলতে দে ও এমনটা কেন করেছে।”
সোমেন ডুকরে কেঁদে ফেলল।
“ তুই বুঝতে পারছিস না ভাই ও ফেঁসে যাবে।”
সমর ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
“ তুই আমাকে বিশ্বাস করিস তো।”
সোমেন মাথা নেড়ে হ্যা জানালো। সমর ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“ তাহলে ভরসা রাখ। তিশা নির্দোষ হলে আমি নিজে ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসবো। আগে ওকে বলতে দে ও কি বলতে চাইছে।”

সঞ্জয় সিং সোমেনের শান্ত হতেই তিশাকে প্রশ্ন করলো,
“ কেন?”
তিশা মাত্রা বিহীন প্রত্যুত্তর করলো,
“ প্রতিশোধ নিতে।”

সবার ভ্রূ কুঁচকে গেল ওর জবাবে। ওসি সঞ্জয় সিং পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“ কিসেস প্রতিশোধ! আমার জানা মতে মিসেস রিদিমাকে আপনি মাস খানেক আগে কোলকাতা ঘুরতে এসে প্রথমবার দেখেছিলেন।”

তিশা একথায় ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর ঘাড় কাত করে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল,
“ কেউ পাপ করে আর কেউ শাস্তি পায় কথাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। ব্যাপার টা এখানে এমনই। রিদিমার সাথে আমার সরাসরি কোনো দ্বন্দ্ব নেই। শুধু মাত্র ওই লোকটার কারণে তাকে আমার প্রতিহিংসার বলি হতে হয়েছে।”

তিশার হাতের ইশারায় প্রত্যেকের চোখ ঘুরে সমরের উপর পড়তেই থমকে গেল সবাই। সমর নিজেও চমকে উঠলো বিস্ময়ে। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“ আমি! কিন্তু কিভাবে? আমি তো আপনাকে চিনিও না ঠিক মতো।”

তিশা তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ সেই এখন তো চিনবেই না। কারণ নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে হবে যে!”

ওসি সঞ্জয় তিশার এমন গোল গোল কথায় বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ এতো না পেঁচিয়ে যা বলার সরাসরি বলুন। শুনি একটু, কিভাবে উনি আপনার ক্ষতি করেছেন।”

তিশা তাচ্ছিল্য হেসে বলতে আরম্ভ করলো,
“ আমি তখন সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছি। আমাদের বাড়িতে একবার বিরাট কালী পুজোর আয়োজন করা হলো। বাবার নাকি মানসী ছিল। সেদিন বাবার বন্ধু প্রভাস কাকু তার গোটা পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। পরিচয় করালেন আমাদের সাথে। আমি সেদিন তার উচ্চমাধ্যমিকে পড়া ছেলেটাকে দেখেছিলাম প্রথম বার। ছিমছাম গড়নের ছেলেটার চোখে চশমা। আমি আর আমার বান্ধবীরা তাকে নানা ভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলাম। ছেলেটার আশপাশ দিয়ে কতবার যে ঘুরলাম তার ঠিক নেই। কিন্তু না সে ভুলেও একবারের জন্য আমার দিকে তাকালো না দেখে মনে মনে সূক্ষ্ম অপমানিত হলাম। ঠিক করলাম এই ছেলের কিসের এত দেমাগ সেটা দেখতেই হবে। সেই পুজো উপলক্ষে ওরা আমাদের বাড়িতে দুদিন ছিল। আর ওই দুদিনে আমি কিভাবে কিভাবে যেন গভীর ভাবে প্রেমে পড়ে গেলাম তার। তার চুপ করে থাকা, গম্ভীর গলায় দুয়েকটা মেপে কথা বলা কিম্বা ঠোঁট চেপে অল্প একটু হাসা এগুলো আমাকে এত আকৃষ্ট করেছিল যে আমি কিভাবে কিভাবে যেন তার প্রতি অবসেসড হয়ে গেলাম। তারা চলে গেল। অথচ আমার দিন কাটতে লাগলো বড্ড অস্থিরতায়।
আমার সদ্য কিশোরী মনটা যে হঠাৎ করে এক সমুদ্র আবেগ পুষে ফেলেছে।

আমার এমন মানসিক অস্থিরতার মাঝে বাবা একদিন একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিলো। আমি প্রথম দিন গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেচে উঠেছিলাম মনে মনে কারণ সেই কোচিং সেন্টারে সেও পড়তো। আসতে যেতে তাকে দূর থেকে দেখেই যেন মনের পিপাসা মিটে যেত আমার। এভাবেই কেটে গেল একটা বছর। তার পরীক্ষা শেষ হতেই সে চলে গেল। আমি আবারো হতাশায় ডুবে গেলাম।

এর পর প্রায় তিন বছর পরের কথা। একদিন প্রভাস কাকু আমাদের বাড়িতে এলেন। আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম। উনি বাবার সাথে জরুরি কথা বলছিলেন দেখে মা আমার হাতে চা পাঠালো। আমি চা নিয়ে যেতেই ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম প্রভাস কাকু বাবার হাত দুটো ধরে বলছেন,
“গোপাল তোর মেয়েটা কে আমায় দিয়ে দে। অমি আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যাই।”

বাবা দেখলাম মানা করলো না। হেসে রাজি হয়ে গেল। আমি সেদিন লজ্জায় খুশিতে চা দিতে যেতে পারিনি। মাকে গিয়ে ট্রে টা ফেরত দিয়ে দৌড়ে ছুটে ঘরে চলে এসেছিলাম। আমি আপনাদের বলে বোঝাতে পারবো না। আমি সেদিন কি পরিমাণে খুশি হয়েছিলাম। পাগলের মতো খুশির চোটে হেসেছিলাম ভালোবাসার মানুষটাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবো ভেবে। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন ওই লোকটা ভেঙে দিয়েছিল কলকাতায় পড়তে গিয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে। আমি সেদিন পাগলের মতো করে কেঁদেছিলাম যেদিন জেনেছিলাম ওই মানুষটা আরেকটা মেয়েকে ভালোবেসে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।”

তিশা বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সমর সোমেন রঙ্গন হেমন্ত সবাই নির্বাক চোখে তাকিয়ে ওর দিকে। তিশা আবার বলা আরম্ভ করলো।
“ ছেলের এই রকম একটা ব্যবহারে প্রভাস কাকু বাবার কাছে এসে ক্ষমা চাইলেন। বাবা না চাইতেও ক্ষমা করে দিলো। সত্যি তো! কিই বা করতেন আর। যেখানে ছেলের মত নেই সেখানে জোর করে মেয়ে বিয়ে দিলে সুখী হতো না ভেবে ক্ষমা করে দিলেন। আর আমি মনের কষ্ট সয়ে মেনে নিলাম সবটা। তারপর ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। কিন্তু আমি সেভাবে স্বাভাবিক হতে পারলাম না। আমার হৃদয়ে মন ভাঙার যে ধাক্কা লেগেছিল সেটা সামলে উঠতে বহু দিন লেগে গেল। তবুও নিজেকে কোনোমতে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। সবার সামনে অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। সবাইকে বোঝাচ্ছিলাম আমি ভালো আছি। আমি ঠিক আছি। কিন্তু রাতের নীরবতায় কিম্বা একাকী নির্জনে এই বুক টা ফেটে যেত। চোখের জলে বালিশ ভিজতো একের পর এক রাত। বার বার মনে হতো আমি ছুটে চলে যাই। আর তাকে গিয়ে প্রশ্ন করি। সব তো ঠিকই ছিল, তাহলে কেন তুমি আমায় বেছে নিলে না সমর?

এর পর কেটে গেল প্রায় সাত আট মাস। একদিন হঠাৎ শুনলাম সমরের বউ নাকি চলে গেছে সংসার করবে না বলে। খবর টা শুনে আমার কেন যেন খুব ভালো লাগলো। মনে মনে বললাম ভালো হয়েছে। দেখ কেমন লাগে। আমাকে কাঁদানো। এবার নিজে কেঁদে দেখ কেমন লাগে। কিন্তু যখন মানুষটাকে রাস্তায় রাস্তায় বিধ্বস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম তখন খুব কষ্ট হতো। মনে হতো ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুমি কষ্ট পেও না প্লীজ। আমি আছি তো তোমার জন্য। তোমার সব কষ্ট গুলো শুষে নেবো। শুধু একটাবার আমায় তোমার বুকে জায়গা দাও। কিন্তু বলতে পারিনি।”

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তিশা। ফের বলা শুরু করলো।
“ এর পর কেটে গেল প্রায় আরও একটা বছর। আমি তখন কলেজে অনার্স কোর্সে পড়ি। সদ্য সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। হঠাৎ গোটা বিশ্ব জুড়ে মহামারী দেখা দিলো। চারদিকে লকডাউন। বাবার ট্রাভেলের ব্যবসায় ধ্বস নেমেে একাকার হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রভাস কাকু। তিনি আমাদের সেই সময় খুব সাহায্য করেছিলেন। খাবার ওষুধ রেশন টাকা পয়সা সবই প্রায় পাঠাতেন প্রয়োজন মতো। সেই সময় হঠাৎ একদিন উনি এসে আবারো বাবার কাছে আমাকে চাইলেন। বাবা এবার আর এতো সহজে সম্মত হলেন না। বললেন আগে ছেলের মতামত জেনে আসতে। তার একদিন পর সত্যি সত্যি তিনি ফোন করলেন। জানালেন ছেলে নাকি সম্মতি দিয়েছে। ওই মহামারী পরিস্থিতিতে দুই পরিবার মিলে ঠিক হলো শুধু বামন বিয়ে পড়ানো হবে। বিয়ের দিন ঠিক হবার আগের দিন ওই লোকটা কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। ফেরে তার আগের বউকে সাথে করে নিয়ে। আগের বারের অপমান টা আমি মেনে নিলেও পরের বারের এই অপমান টা আমি সত্যিই সইতে পারিনি। আমার মনে ওই মানুষটার জন্য যে ভালোবাসা জন্মেছিল এককালে সেই ভালোবাসা গুলো এক নিমেষে কঠোর ঘৃণায় পরিণত হলো। আমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠলাম অনুভূতিহীন পাথর। মনে মনে ঠিক করলাম একদিন আমি এর প্রতিশোধ নেবোই নেবো। আর এটা আমার নিজের সাথে নিজেরই অঙ্গীকার।

জানেন আমার বাবা সেই অপমান সইতে না পেরে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমি হয়ে যাই অনাথ আশ্রয়হীন। সেদিন ওই মহামারীর লক ডাউনে আমাদের ঘরে যখন প্রিয়জন হারানোর হাহাকারে কাঁদছি তখন ওই লোক আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ছেলে হবার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গেছিল। আমি যখন ভালোবাসা সম্মান স্বপ্ন সবকিছু হারিয়ে ভিখারী হয়ে গেছি, সেই সময় ওই জঘন্য লোকটা স্ত্রী পুত্র সংসার ভালোবাসা নিয়ে স্বপ্নের জগতে বসবাস করছে। এবার আপনারাই বলুন আমার মনে রাগ হবে না! আমার হৃদয়ে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগবে না!! জাগবে অবশ্যই জাগবে।

তবে সত্যি কথা কি জানেন তো, ঈশ্বরের কাজ ঈশ্বর করেন। করো মনে জেনে শুনে দুঃখ দিলে তাকে সেই একই দুঃখে দুখী হতে হয়। হ্যাঁ, আমাকে যেমন ওই লোকটা দুঃখ দিয়েছিল। ঠিক তেমনই ওই লোকের বউও মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ছেলে সংসার সুখ সব কিছু পায়ে ঠেলে আবারো পালিয়ে গেল। জানেন আমি সেদিন ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। সত্যি বলতে আমার আত্মা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছিল। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য দেখুন ওই লোকের বাবা আবার এলো আমাকে তার বাড়ির পুত্রবধূ করতে। কিন্তু এবার তার ছেলের জন্য নয় বোনের ছেলের জন্য। আমি সেদিন খুব অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম। এমন এমন কথা শুনিয়েছিলাম যে উনি বাড়ি ফিরে তিন দিনের মাথায় স্ট্রোক করে মারা যান। বিশ্বাস করুন আমার একটুও খারাপ লাগেনি সেই মৃত্যুর খবর শুনে। যার জন্য আমার দুই দুবার অপমান হতে হলো। আমার বাবাকে কষ্ট পেয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে হলো সেই রকম একটা জঘন্য লোকের মরে যাওয়ার খবর টা নিঃসন্দেহে ভালো।

কিন্তু নিয়তির লেখা বুঝি অন্য কিছুই ছিল। বছর দুয়েক পরের কথা, আমি যে ছেলেকে নিজের অজান্তেই রিজেক্ট করেছিলাম তার সাথেই আমার পরিচয় হলো। দেখা হলো প্রেম হলো এমনকি বিয়েও বলো। বিয়ের পর বৌভাতের দিন আমি জানলাম কি!
আমার স্বামীর মামার ভাই হলো সেই লোকটা যাকে আমি এই ত্রিভুবনে সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করি। তাইতো যখন রিদিমার জন্য ওই লোকটার চোখে এক আকাশ সমান গভীর প্রেম দেখলাম তখনই সিদ্বান্ত নিয়েছিলাম ওই মানুষটাকে কোনোদিনও সুখী হতে দেবো না আমি। কোনো দিনও ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে ভালো থাকতে দেবো না। ঠিক যতোটা দুঃখ যতোটা কষ্ট আমি পেয়েছি তাকে ভালোবেসে না পেয়ে ঠিক ততোটা কষ্ট ততোটাই দুঃখ সেও পাক ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে।”

বলেই খিল খিল করে হাসতে আরম্ভ করলো। ওদিকে লোহার কারাগারের ওপাশে দাঁড়ানো সোমেন যেন পাথর হয়ে গেছে। সমর নিজেও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজের অজান্তেই একটা মেয়ের মনে এতো বড় বড় আঘাত দিয়েছে ভাবতেই যেন গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠছে তার। সমরের মনে ক্ষোভ জাগলো। তার পরিবার তাকে কোনো কিছু না জানিয়ে কিভাবে এত কিছু করতে পারলো। এই যে তিশা আর তার পরিবার বিনা কারণে যে কষ্ট টা পেল। এতো কিছু সাফার করলো তার দায় কে নেবে?
ওসি সঞ্জয় সিং বললেন,
“ তাহলে এই চুমকি না চামেলী এর সাথে আপনার যোগাযোগ হলো কেমন করে?”

তিশা চুমকির নত করে রাখা মুখটার দিকে তাকালো। “ আমরা কলকাতায় গেলাম ঘটনাটা সেদিন রাতের। আমরা সেদিন সবাই গল্প গুজব করে শুতে শুতে বেশ রাত হয়ে যায়। প্রায় শেষ রাতের দিকে জল তেষ্টায় আমার ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দেখি জলের বোতল খালি। আমি খালি বোতল টা নিয়ে জল নিতে নিচে নেমে আসি। কিচেনে গিয়ে জল খেয়ে বোতল ভরে উপরে উঠতে গিয়ে হঠাৎ নাকে কেমন যেন একটা ধূপ পোড়া গন্ধ আসে। আমি চমকে উঠি। সেই গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে চুমকির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দরজার নবে হাত দিতেই দেখি লক খোলা। আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে থ হয়ে যাই। দেখি গোটা ফ্লোরে সিঁদুর দিয়ে নক্ষত্রের চিহ্ন আঁকা। সেই নক্ষত্রের পাঁচ দিকে পাঁচটা মোম বাতি জ্বলছে। আর তার ভেতরে একটা কাপড়ের পুতুল। আর এই চুমকি হাত খানেক দূরে বসে একটা পাত্রে কি যেন একটা পোড়াচ্ছে। আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না এই মেয়েটা কালোজাদু করছে। আমি ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখি পুতুলটার গায়ে একটা লাল শাড়ির ছেড়া পাড় প্যাঁচানো।
ও আমাকে হঠাৎ দেখে ধরা পড়ে একেবারে থতমত খেয়ে গেল। আমি ওকে সবাই কে বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ঘাড় চেপে ধরতেই ও কেঁদে টেডে অস্থির হয়ে বলল আর এসব করবে না। আমার কাছে ওর পুরো ভিডিও রেকর্ড ছিল। যেটা দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমি ওকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছি।

আমরা যে কদিন ওখানে ছিলাম কোইনসিডেন্টলি আমার হাতে অনেক কিছু ধরা পড়লো। যেমন রিদিমার বালিশের কভারের ভেতরে লাল সুতোয় পেঁচানো শেকড়। সিঁদুর মাখা পুটুলি। ছেঁড়া চুলের মাদুলি এমন আরও অনেক কিছু। আমার তখন দুয়ে দুয়ে চার করতে একটুও সময় লাগে নি যে ও রিদিমাকে এই সংসার থেকে সরাতে চায়। ওর ক্ষতি করতে চায়।”
“ আপনি কাউকে এব্যাপারে বলেন নি কেন?”
“ কেন বলবো? কারণ আমিও তো আল্টিমেটলি ওর ক্ষতিটাই চাইছিলাম। তাই তো ভয় দেখিয়ে কাজ টা করালাম।”

ওসি সঞ্জয় সিং চুমকির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ আর ও এই কাজ কেন করেছিল?”
“ আমি জানি না।”
“ জিজ্ঞেস করেন নি।”
“ নাহ্। প্রয়োজন মনে হয় নি।”

ওসি সঞ্জয় সিং চুমকির দিকে তাকিয়ে ধাম করে টেবিলের উপর হাতের চাপড় বসালেন। চুমকি তাতে চমকে চেয়ার নিয়ে উল্টে পড়তে নিলো। ওসি সাহেব রক্তিম চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ এবার তুই বল কেন করেছিস এসব?”

চুমকি ভয়ে কাঁপতে থাকা গলায় বলল,
“ হিংসায়।”
“ একটা কাজের লোক হয়ে মালিকের বউয়ের সাথে কিসের এত হিংসা তোর?”

চুমকি প্রথমে মুখ খুলতে না চাইলেও মারের ভয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলো।
“ আমি অনেক কষ্ট পেয়ে জীবনে বড় হয়েছি। পনেরো তে পা দিতে না দিতেই মা আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। স্বামীটা এক নম্বরের মাতাল আর মা গীবাজ ছিল। রোজ গিলে এসে মারধর করতো। কত কষ্ট করে পাঁচ টা বছর ওই সংসারে ছিলাম তার ঠিক নেই। এর মধ্যে আমার পেটে বাচ্চা এলো। ভাবলাম, এবার সন্তানের মুখ দেখে যদি লোকটা ভালো হয়। সংসারে মন ফেরে। আমার সে আশায় ছাই দিয়ে দিলো সে। আমার তখন পাঁচ মাসের পেট। শুয়োরের বাচ্চা টা গলা অবধি গিলে এসে আমাকে খুব মারলো। তাতেই আমার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার মা আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনলো। সুস্থ করলো। এভাবেই কেটে গেল আরও একটা বছর। আমি তখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি। এর মধ্যে মা মারা গেল মহামারী তে। আমার তখন কি দুর্দশা। কেউ কাজ দেয় না। ভিখারীর মতো দরজায় দরজায় ঘুরি। সেসময় এই মাসিমা আমায় তার বাড়ি নিয়ে এলো। খাবার দিলো কাপড় দিলো আশ্রয় দিলো। আমি মনে প্রাণে ঈশ্বর কে ধন্যবাদ জানাতে লাগলাম। কিন্তু আমার মনে হঠাৎ লোভ জমলো। এই বাড়ি গাড়ি বিষয় আসয় সংসার সব দেখে মনে হলো এসব যদি আমার হতো। আমি ভুলে গেলাম আমি এই বাড়ির কাজের লোক। মনে মনে পরলিকল্পনা করলাম একবার যদি এই বাড়ির মালিক কে বিছানায় নিতে পারি তাহলেই আমাকে আর ঠেকায় কে। বউ ছাড়া পুরুষ মানুষ দেহের চাহিদা তো থাকবেই।
আমি সেই মতো সমর দাদাভাই এর কাছ ঘেঁষা শুরু করলাম। ঘন ঘন তার ঘরে যেতে লাগলাম। তার সামনে সব সময় সেজে গুজে থাকতে লাগলাম। কিন্তু পরিকল্পনা সফল হলো না। সে আমার কাছ ঘেঁষা দেখে আমাকে দোতলায় উঠতেই মানা করে দিলো। আলাদা কাজের লোক রাখলো দুই বেলা উপরের ঘর দোর পরিষ্কার করে রাখার জন্য। আমি মনে মনে হতাশ হলেও ভেঙে পড়িনি। ঠিকই নানা ভাবে তার কাছে ভালো মানুষ সেজে থাকার চেষ্টা করেছি। সায়নের বেশি বেশি খেয়াল রেখেছি যাতে তার আমাকে মনে ধরে। কিন্তু সেদিন সব কিছু শেষ হয়ে গেল। আমি দুঃস্বপ্নেও কখনও কল্পনা করিনি উনি ওই ম্যাডাম কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। আর তাই…”

“ আর তাই তুই তাকে তোর রাস্তা থেকে সরানোর জন্য কালোজাদু করা শুরু করলি তাই তো।”

চুমকি মাথা নিচু করে বসে রইলো চুপ করে। তিশা ও চুপ করে মাথা নুইয়ে বসে রইলো। গোটা সেলের ভেতর তখন পিন পতন নীরবতা নেমে এসেছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যেন একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ টাও শুনতে পাচ্ছে। সেই নীরবতা ভেঙে সমর উঠে এলো।
তিশার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আমাকে ক্ষমা করে দেবেন তিশা। আমি আসলেই জানতাম না আমার পরিবার আপনাকে আমার জন্য সিলেক্ট করেছিল কোনোদিন। তাই অজান্তেই আপনাকে অনেক অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। সরি। কিন্তু তাই বলে ওই নির্দোষ মেয়েটার এতো বড় ক্ষতি করা উচিত হয় নি আপনার। এর জন্য আমি আপনাকে বিন্দু মাত্র ক্ষমা করবো না। রেডি হয়ে থাকুন। আপনাকে এর সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে যা যা ব্যবস্থা নেয়া লাগে আমি তাই নিয়ে আপনার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করবো বলে দিয়ে গেলাম।”

সমর কথা শেষ হতেই ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। সোমেন এতক্ষণ এক দৃষ্টিতে তিশার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার ও কথা বলল,
“ তিশা তোমার মনে যে এত ক্ষোভ পুষে রাখা ছিল কই আগে তো কোনোদিন বলো নি তুমি। তাহলে সেই ভালোবাসার কথা গুলো কি মিথ্যে ছিল যা তুমি আমায় শোনাতে। সেই স্বপ্ন গুলো কি মিথ্যে ছিল যা আমরা একসাথে দেখেছিলাম।
তিশা দুঃখ আর কষ্ট না পাওয়ার বেদনা কার জীবনে নেই বলোতো। তাই বলে সেটা মনে পুষে রেখে এভাবে প্রতিশোধ নিতে হবে! ছিঃ! আজকের পর থেকে তুমি আমার আর কেউ নও। আমি খুব শীঘ্রই ডিভোর্সের কাগজ পাঠাবো রেডি হয়ে থেকো। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু তোমাকে কিছুতেই জেল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করবো না। আর সেই আশায় কখনও বসেও থেকো না। আসি।”

সোমেন বেরিয়ে যেতেই গা কাঁপিয়ে কেঁদে ফেলল তিশা। সে জানে না তার ভবিষ্যতে কি লেখা আছে? কি হতে চলেছে তার সাথে।

প্রায় সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। রিদিমা এই মুহূর্তে বেশ সুস্থ। আজ তাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে। সমর এই একটা সপ্তাহে একটা বারের জন্যও ওকে কাছ ছাড়া করেনি। সব সময় পাশে থেকেছে। রিদিমার মনে সেদিন উদয় হওয়া মন খারাপ গুলো ভ্যানিশ হয়ে গেছে সমরের আদর যত্নে।
ওদিকে মিসেস চিত্রা সব কিছু শুনে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাকে কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিতে এতো কিছু করলেন সেই তার এতো বড় ক্ষতি করে দিলো শেষ পর্যন্ত। আর তিশার ব্যাপার টা শুনে বড্ড আক্ষেপ করলেন। কারণ এসব তারও জানা। কিন্তু তাই বলে মেয়েটা এমন প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে যাবে স্বপেও ভাবতে পারেন নি তিনি।

ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে প্রায় একটা বছর সময়। রিসেপশন থেকে শুরু করে সব কিছু বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল রিদিমার শরীর খারাপ শুনে। আজ সমর আর রিদিমার বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। স্টেজের উপর লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পড়ে আধুনিক ব্রাইডাল সাজে দাঁড়িয়ে রিদিমা। তার দুপাশে রাজকীয় সাজে শেরয়ানি পরে দাঁড়িয়ে দুই বাপ বেটা। সায়ন আর সমর। তারা তিনজনে হাত জোড় করে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করছে। মিসেস চিত্রার মুখে রাজ্যের হাসি। তার ফুল বাগানের মতো ভরা সংসার দেখে। ওদিকে মিসেস মনিকা তপন বাবু দূর থেকে মেয়ের সুখ দেখে মনে মনে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করছেন যেন আর কোনো কুদৃষ্টি তাদের জীবনে না পড়ে। পার্টি শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। পার্টির সাজ তুলে বিছানায় এসে বসতেই সমর রিদিমাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে গেলো ব্যালকনিতে। রিদিমা প্রিয় মানুষটার গায়ের ওমে একদম চাদরের মতো লেপ্টে গেল। সমর ওকে কোলে নিয়েই বসলো নরমবিন ব্যাগের উপর। কানে ঘাড়ে গলায় চুমু খেতে খেতে বলল,
“ প্রথম বিবাহবার্ষিকীর অনেক অনেক শুভেচ্ছা আমার শ্যামলতা।”

রিদিমা ও সমরের গলায় থুতনিতে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
“ তোমাকেও আমার হৃদয় রাজ।”

সমর পকেট থেকে একটা ছোট গয়নার বাক্স খুলে একটা সরু সোনার চেন সমেত ডায়মন্ড পেনডেন্ট টা পরিয়ে দিয়ে বলল,
“ এটা তোমার গিফ্ট। দেখো তো পছন্দ হয়েছে নাকি!”

রিদিমা গলায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ খুব সুন্দর। থ্যাঙ্ক ইউ।”
“ এবার আমার গিফ্ট দাও।”

রিদিমা সমরের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
“ কি গিফ্ট চাই তোমার ?”

সমর রিদিমার হাত টা মুঠোয় পুরে তাতে চুমু খেয়ে বলল,
“ আমার যে সে গিফ্ট নয় খুব স্পেশাল গিফ্ট চাই। যেটা তুমি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না।”

রিদিমা একটু অবাক হয়ে ভাবতেই বুঝে ফেলল সমর কি চেয়েছে। সে লজ্জায় একাকার হয়ে মিশে গেল সমরের বুকের সাথে। সমর বুঝলো তার শ্যামলতা তাকে গিফ্ট দিতে সম্মত হয়েছে। সে আর দেরি করলো না। রিদিমাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। গিফ্ট আনার প্রসেস টা শুরু করতে হবে যে।

____সমাপ্ত ___