অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-০১

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

“এসো আমার সাথে একটা রাত কাটাও। যদি আমাকে সুখী করতে পারো তাহলে তোমায় বিয়ে করব, নাহলে নয়।”

নিজের সামনে দাঁড়ানো অতীব সুদর্শন পুরুষটির মুখে এহেন কথা শুনে ভয়ে, লজ্জায় একদম গুটিয়ে গেল তানহা। দ্রুত কান চেপে ধরল সে৷ তানহাকে এমন করতে দেখে ভ্রুঁ কুচকে তাকাল শাহনওয়াজ সিদ্দিকি। এই মেয়েটা তো নিজের ইচ্ছাতেই এখানে এসেছে। তাহলে এখন এসবের মানে কি?

শাহনওয়াজ হালকা কেশে বললো,
“এই মেয়ে কি হলো তোমার? যা বলছি সেসব কি কানে যায়নি?”

তানহা আমতাআমতা করে বলে,
“আমি..আমি এমন মেয়ে নই..প্লিজ আমায় যেতে দিন।”

কথাটা শুনে মোটেই ভালো লাগল না শাহনওয়াজের। সে রাগী স্বরে বলে উঠল,
“এতই যদি সতী-সাবিত্রী হোস তাহলে এখানে এসেছিলি কেন? এখন এসব কি নাটক করছিস? বেশি নাটক না করে জলদি গা থেকে ওড়নাটা সরা।”

তানহা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে ওঠে,
“নাহ, একজন নারীর কাছে তার সম্মানের থেকে দামি কিছু না। আমি কোন কিছুর বিনিময়েই নিজের সম্মান বিসর্জন দেব না।”

শাহনওয়াজের পুরো শরীর রাগে, ক্ষোভে জ্বলে উঠল। সে তানহার বাহু শক্ত করে আকড়ে ধরে বলে,
“তাহলে এখানে কি রং তামাশা করার জন্য এসেছিলি?”

তানহা এবার ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। সে তো এতকিছু ভেবে এখানে আসেনি। সে নিজের বান্ধবীর কাছে শুনেছিল, এখানে আসলে সে নিজের জীবন পরিবর্তনের একটা সুযোগ পাবে। কিন্তু সেই সুযোগের জন্য যে এত বেশি দাম দিতে হবে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। তানহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে শাহনওয়াজ বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়। এক ধাক্কায় তানহাকে দূরে ফেলে দেয়। তানহা ফ্লোরে পড়ে গিয়ে ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। শাহনওয়াজের রাগ তবুও কমে না। সে সিকিউরিটি গার্ডদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এই মালটাকে জলদি বাইরে ফেলে এসো। এর চেহারাও আর দেখতে চাই না।”

অতঃপর সিকিউরিটি গার্ডরা তানহাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায়। শাহনওয়াজের সর্বসময়ের সাথী তথা তার সেক্রেটারি আকবর ধীর পায় এগিয়ে এসে হালকা ঢোক গিলে বলে,
“স্যার, বাইরে আরো অনেক মেয়ে অপেক্ষা করছে। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে…”

শাহনওয়াজ রক্তিম চোখে তাকায় আকবরের দিকে। তাঁর এই দৃষ্টি দেখে আকবরের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যায়। শাহনওয়াজ বলে ওঠে,
“আমার মুডটাই আজ নষ্ট করে দিয়েছে এই স্টুপিড মেয়ে। এখন আর কোন মেয়ের সাথে দেখা করার রুচি নেই। ওদের সবাইকে চলে যেতে বলো।”

“স্যার, একটা মেয়ে নাহয় একটু বেকে বসেছে কিন্তু বাকিরা..”

শাহনওয়াজের রাগী দৃষ্টি দেখে আর কথা না বাড়িয়ে আকবর তার নির্দেশনা মেনে নেয়। শাহনওয়াজ এবার একটা রকিং চেয়ারে বসে বলে ওঠে,
“আজ অব্দি কারো সাহস হয়নি, আমাকে রিজেক্ট করার। আমি সবাইকে রিজেক্ট করেছি। আর আজ কিনা ঐ সামান্য একটা মেয়ে আমাকে রিজেক্ট করলো! এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এবার এর শেষ দেখেই ছাড়ব।”

আকবর ফিরে এসে শাহনওয়াজ সিদ্দিকির দিকে তাকিয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ তার রাগ সপ্ত আসমানে। আর হবে না-ই বা কেন? শাহনওয়াজ সিদ্দিকি হলো পুরো চট্টগ্রাম শহরের ত্রাসের নাম। খাতায়-কলমে যদিও একজন সাধারণ বিজনেসম্যান তবে তার আসল পরিচয় আরো বেশি ভয়ানক। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যতো অনৈতিক চোরাকারবার সে পরিচালনা করে তা কারো অজানা নয়। তবুও ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না। যারাই তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করে তাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয় সে। আজ অব্দি কতজনকে যে তার আদেশে মেরে সমুদ্রে ভাসানো হয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। এই শাহনওয়াজ সিদ্দিকির পরিবার বলে কিছু নেই। তার ইচ্ছা ছিল এবার বিয়ে করবে। সেজন্যই সে আজ এই আয়োজন করেছিল৷ তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক মেয়েও এসেছিল। শাহনওয়াজের ইচ্ছা ছিল একে একে সব মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে যাকে তার ভালো লাগবে তাকেই স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নেবে। কিন্তু প্রথমেই এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো যা তার পুরো ইচ্ছাটাই শেষ করে দিলো। শাহনওয়াজ সিদ্দিকি আচমকা আকবরের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠল,
“ঐ মেয়ের সম্পূর্ণ বায়োডাটা আমার চাই।”

আকবর আজ্ঞাবহ দাসের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আচ্ছা, স্যার..পেয়ে যাবেন।”

শাহনওয়াজ আশ্বস্ত হলো। আকবর ছেলেটা বড্ড কাজের। কিভাবে যেন এই ভীতু মানুষটা তার মতো ভয়াবহ মানুষের সাথে মানিয়ে নিলো। আর এখন শাহনওয়াজের ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছে সে।

★★
তানহা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করল, নিজের বাড়ি বললে হয়তো ভুল হবে। সে তো এই বাড়িতে পরগাছার মতো বেড়ে উঠেছে। তখনকার ঘটনা সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। জীবনে অনেক কিছু সহ্য করেছে সে। তবে এমন বাজে পরিস্থিতি তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন। তানহা বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে তার চুলের মুঠি টেনে ধরে বলে,
“সকাল সকাল কোন নাং এর কাছে গিয়েছিলি নবাবজাদী? বাড়ির সব কাজ কি তোর মরা মা এসে করবে?”

তানহা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো। এতেও দয়া হলো না তার সৎ মা মর্জিনা বেগমের। তিনি আরো জোরে তানহার চুল টেনে ধরে বললেন,
“তোর খুব ডানা গজিয়েছে তাই না মা**গী। তোর এই ডানা কিভাবে ছাটতে হয় আমার জানা আছে। আজ সারাদিন একটা দানাও খেতে পারবি না তুই। এটাই তোর শাস্তি।”

তানহার চোখ জলে টলমল করতে থাকে। সে কিছুই বলতে পারে না। মর্জিনা বেগম তাকে আরো নানারকম অশ্রাব্য গালমন্দ করতে থাকে। তানহার কাছে যদিও এসব নতুন নয়। নিজের মাকে হারানোর পর যখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে সৎমা নিয়ে এলো তখন থেকেই তাকে এসব সহ্য করতে হচ্ছে। তার আপন বাবাও কখনো তাকে কাছে টেনে নেয়নি। আর সৎমা তো সৎমাই হয়। এই নরককুণ্ড থেকেই তো মুক্তি চেয়েছিল সে। তাই তো তার এক বান্ধবী যখন তাকে জানিয়েছিল, আজ হোটেল গ্র‍্যান্ড প্যালেসে গিয়ে শহরের অন্যতম ধনী বিজনেসম্যান শাহনওয়াজ সিদ্দিকির কাছে সাথে দেখা করলে তার জীবন বদলে যাবে তখন সে এতো কিছু না ভেবে চলে গিয়েছিল। বছর ২২ এর তানহা বুঝতে পারেনি এই দুনিয়ার চরম জটিলতা।

তানহার উপর যখন এমন অত্যাচার চলছিল তখনই সেখানে উপস্থিত হলো তার সৎ বোন মিহি। সে এসে তানহাকে একটুও দয়া দেখালো না। বরং তার উপর এমন অত্যাচার হতে দেখে যেন খুশিই হলো। নিজের মাকে উৎসাহ দিয়ে বললো,
“মারো এই বান্দির বেটিকে। ওর জন্য আজ আমায় না খেয়ে কলেজে যেতে হচ্ছে। প্রতিদিন সকালের রান্না তো ঐ করে, তাহলে আজ কেন এত ব্যত্যয় ঘটল। ওর মতো বান্দী থাকতে কি এখন তুমি আর আমি রান্না করবো আম্মু?”

মর্জিনা বেগম তেতে উঠে বললেন,
“কখনো না। যদিও আমাদেরই এই বাড়ির সব কাজ করতে হয় তাহলে একে শুধু শুধু পুষছি কেন? এই মা**গী, যা জলদি গিয়ে রান্না বসা। আর বাড়ির সব কাজ আজ তুই করবি। আমি ছকিনাকে আজকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি।”

বলেই তিনি তানহাকে ঠেলে সামনে পাঠান। তানহা অসহায় চোখে তার পানে তাকাতেই তিনি বলেন,
“এভাবে কি দেখছিস? তোর এইসব ন্যাকামি দেখে আমার মন গলবে না। যা রান্নাঘরে।”

অগত্যা তানহা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে মা-মেয়ের হাসির আওয়াজ তার কানে আসে। যেন তাকে এভাবে অপদস্ত করে আর কষ্ট দিয়ে তারা মহাখুশি। তানহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের এই জীবনের সাথে তো সে মানিয়ে নিয়েছে। তবুও মাঝে মাঝে মুক্তির আশা জাগে মনে। সেই ছোট্ট থেকে এভাবে বড় হওয়ায় তার মানসিক বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। কখনো প্রতিবাদ করতে শেখেনি সে।

রান্নাঘরে এসে চোখের জল মুছে সে রান্নার কাজ শুরু করে। রোজকার এই নির্মমতায় বয়ে চলতে থাকে তার জীবন। যেই জীবনের পারতে পারতে রয়েছে বিষাদের ছায়া।

চলবে।