#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি
তানহা ভয়ে গাড়ির এককোণে গুটিশুটি মেরে বসেছিল। সে সমানে আল্লাহর নাম নিচ্ছিল। কারণ তার মনে হচ্ছিল এই শাহনওয়াজ সিদ্দিকী তাকে সত্যি সত্যি পাচার করে দেব। আচমকা গাড়িটা এসে থাকে চট্টগ্রামের অন্যতম বিলাসবহুল শপিং মল সেন্টার পয়েন্টের সামনে। শাহনওয়াজ গাড়ি থেকে নেমে তানহার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“এই মেয়ে,,নেমে এসো গাড়ি থেকে।”
তানহা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বলে,
“এটা তো বন্দর না শপিং মল মনে হচ্ছে। আমাকে এখানে কেন আনলেন?”
“বেশি কথা না বলে চুপচাপ নেমে এসো।”
তানহা আর কিছু না বলে বাধ্য মেয়ের মতো গাড়ি থেকে নামে। শাহনওয়াজ তানহার হাত শক্ত করে ধরে। তানহা একটু বিব্রতবোধ করে। কিন্তু শাহনওয়াজ সেসবকে পাত্তা না দিয়ে তানহাকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যায় নিজের সাথে। শাহনওয়াজ শপিং মলে প্রবেশ করা মাত্রই আশেপাশের অনেক উৎসুক মানুষের দৃষ্টি তার দিকে থিতু হয়। তানহাকেও অনেকে দেখছিল অবাক চোখে৷ এতে সে আরো মিলিয়ে যায়। শাহনওয়াজ আচমকা তানহাকে নিয়ে একটা ফোনের শোরুমের সামনে এসে বলে,
“তোমার কি কোন ফোন আছে?”
তানহা আমতাআমতা করে বলে,
“ফোন বলতে একটা বাটন ফোন আছে অনেক দিনের পুরোনো,,,”
“ওহ বুঝলাম।”
বলেই সে তানহাকে নিয়ে শোরুমে প্রবেশ করে। শাহনওয়াজকে দেখেই শোরুমের মালিক এগিয়ে এসে বলে,
“আরে স্যার আপনি..কি সৌভাগ্য আমার আপনার পা পড়েছে আমার এখানে। বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।”
শাহনওয়াজ বলে,
“আমাকে আইফোনের লেটেস্ট মডেলের কিছু ফোন দেখান।”
“এই স্যারকে আইফোন ১৬ এর সেরা মডেলগুলো দেখাও।”
কিছুক্ষণের মাঝেই অনেক ফোন এনে রাখা হয়। তানহা বুঝতে পারে না এসব কি হচ্ছে। শাহনওয়াজ তানহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এখান থেকে একটা ফোন বাছাই করে নাও।”
“আমি?”
“হ্যাঁ, তুমি।”
“কিন্তু আমি ফোন নিয়ে কি করব?”
“কেটে কেটে খাবে…রাস্কেল একটা। নিতে বলেছি নাও একটা পছন্দ করে।”
শাহনওয়াজের ধমক খেয়ে তানহা চুপ হয়ে যায়। অতঃপর কয়েকটা ফোন নিয়ে দেখতে থাকে। নিজের বান্ধবীদের কাছে সে শুনেছিল এই আইফোনের কথা। কিন্তু কখনো চোখে দেখেনি। সবাই তো এই ফোনের পাগল। তানহা কখনো ভাবেনি এই ফোন কেনার সুযোগ হবে তার। সে নিজের পছন্দমতো একটা ফোন বেছে নিলো। অতঃপর শাহনওয়াজ তানহাকে নিয়ে বেনারসি শাড়ির শোরুমে গেল। সবচেয়ে দামী কিছু শাড়ি দেখানো হলো তাকে। সেখান থেকে তানহা চুপচাপ একটা শাড়ি বেছে নিলো। এছাড়াও আরো কিছু দামী পোশাক কিনল। তানহা তো কিছুই বুঝতে পারছিল না। নিজের হাতে থাকা লাল বেনারসির দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে বলে,
“এসব আমায় কেন কিনে দিচ্ছেন উনি? উনি তো বলেছিলেন আমায় পাচার করে দেবেন। তাহলে এসবের কি মানে?”
এরপর শাহনওয়াজ তানহাকে আরো অবাক করে দিয়ে তাকে নিয়ে জুয়েলারি শপে যায়। চারিদিকে সোনা, হিরার এত দামি দামি গহনা দেখে তানহা একদম হা হয়ে যায়। শাহনওয়াজকে দেখেই জুলেয়ারি শপের এক কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বলে,
“বলুন স্যার কি লাগবে আপনার।”
“এই ম্যামের জন্য কিছু ডায়মন্ড ও গোল্ডের লাক্সারিয়াস গহনা দেখাও। কানের দুল থেকে শুরু করে হাতের বালা সব যেন থাকে।”
“জ্বি, স্যার।”
সহসাই তানহার সামনে বিভিন্ন মডেলের অনেক গহনা হাজির করা হয়। তানহার চোখ ধাদিয়ে যায় একসাথে এত গহনা থেকে। শাহনওয়াজ তাকে বলে,
“এখান থেকে পছন্দ করে নাও।”
তানহা বলে,
“আমি তো বুঝতেই পারছি না কি নেব..এত গহনা আমি কখনো চোখে দেখিনি।”
শাহনওয়াজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আচ্ছা, সব গহনা প্যাকেজ করে দিন।”
“এত গহনা কিনবেন আপনি?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে তানহা। শাহনওয়াজ বিরক্তির স্বরে বলে,
“হ্যাঁ, কিনবো কোন সমস্যা?”
তানহা মাথা নাড়ায়। সবকিছু কেনা শেষে তারা শপিং মল থেকে বের হয়। তাদের চারপাশে সবসময় ঘিরে রয়েছে পাহারাদাররা। তাই তানহা পালাতেও পারছিল না। কিন্তু এসব কিছু তার সুবিধারও ঠেকছিল না। তাই বাইরে এসেই সে শাহনওয়াজকে প্রশ্ন করে,
“আপনি তো বলেছিলেন আমায় পাচার করে দেবেন। তাহলে আমার জন্য এতকিছু কিনলেন কেন?”
“কোরবানির আগে তো কোরবানির পশুর একটু যত্ন করতে হবে, তাইনা।”
” তার মানে আপনি আমায় সত্যি পাচার করবেন?”
“হুম।”
তানহার চোখে জল চলে আসে। তার মনে যে আশা জেগেছিল সেই আশা যেন ভেঙে গেল। একই সময়ে আকবর এসে উপস্থিত হয় শাহনওয়াজের সামনে। সে এসেই মাথানত করে বলে,
“স্যার,আমায় ডেকেছিলেন।”
“হুম, তোমায় একটা কাজ করতে হবে।”
“কি কাজ?”
“গোটা শহরে পোস্টার ছাইয়ে দাও, সকল নিউজ পেপার এবং টিভি চ্যানেলে খবর দাও আগামী শুক্রবার শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হবে। দেশি-বিদেশি আমার যত শুভাকাঙ্ক্ষী, বিজনেস পার্টনার আছে সবাইকে ইনভাইট করে দাও। আর আজ থেকেই বিয়ের আয়োজন শুরু করে দাও। আমি চাই না, আয়োজনে কোন কমতি থাকুক। ষোলা সিঙ্গার ফুকিয়ে বিয়ে হবে আমার। যা চট্টগ্রামের বুকে ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে।”
তানহা অবাক হয়ে বলে,
“বিয়ে!”
শাহনওয়াজ তানহার দিকে তাকিয়ে আর কিছু না বলে তাকে গাড়িতে উঠতে ইশারা করে। তানহাও বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে উঠে বসে।
★★
চট্টগ্রামের সমস্ত খবরের কাগজ, নিউজপেপার সব যায়গায় ছেয়ে গেছে বিখ্যাত বিজনেসম্যান শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর বিয়ের খবর। শুধু তাই নয়, পাত্রীর নাম যে তানহা এটাও দেখানো হয়েছে। টিভি খুলতেই এই সংক্রান্ত নিউজ দেখে চমকে উঠলেন মর্জিনা বেগম। সাথে সাথেই উঠে চলে গেলেন মিহির রুমে। মিহি তখন ঘুমাচ্ছিল। মর্জিনা বেগম মিহিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন,
“এই মিহি ওঠ..দেখ কি কাণ্ড হয়ে গেছে।”
মিহি বিরক্তির স্বরে বলে,
“ধুর, এভাবে আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুললে কেন? তোমার উত্তেজনা দেখে তো মনে হচ্ছে লটারী পেয়েছ।”
“লটারী নয় রে পুরো হিরের খনি পেয়েছি।”
“হিরের খনি?”
“হ্যাঁ, রে। ঐ শাহনওয়াজ সিদ্দিকী নামে যে মাফিয়াটা আমাদের বাসায় এসেছিল সে নাকি তানহাকে বিয়ে করতে চলেছে।”
মিহি হতবাক স্বরে বলে,
“এসব কি বলছ তুমি আম্মু? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“হ্যাঁ, ঠিকই আচ্ছে। বিশ্বাস না হলে তুই ফোনে খুঁজে দেখ।”
মিহি তড়িঘড়ি করে ফেসবুকে প্রবেশ করে। সাথে সাথেই এ সংক্রান্ত বিভিন্ন নিউজ দেখে তাজ্জব বনে যায়। নিজের মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুমি তো ঠিকই বলেছিলে আম্মু। কিন্তু এতে আমাদের কি ফায়দা? ঐ তানহাকে তো তুমি নিজে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছ।”
মর্জিনা বেগম বলেন,
“আমি কি জানতাম যে ও এমন সোনার ডিম পাড়া হাস বের হবে। এখন কি করব সেটাই ভাবছি।”
মিহির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সে বলে,
“তানহা যেমনই হোক, মনের দিক দিয়ে অনেক সহজ সরল। যদি আমরা ওর সামনে গিয়ে একটু ন্যাকাকান্না করতে পারি তাহলেই ও গলে যাবে।”
“ঠিক বলেছিস, আমিও এটাই ভাবছিলাম। আমি যাই তোর আব্বুর সাথে কথা বলে আসি।”
★★
তানহা তো শাহনওয়াজ এর বাড়ি তথা সিদ্দিক ম্যানশনে এসে পুরো অবাক হয়ে যায়। এত বড় বাড়ি সে জীবনে চোখে দেখে নি। বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ আর সেখানে কত দামী দামী আসবাপত্র। তানহার দুচোখ পুরো ছানাবড়া হয়ে যায়। তানহা চারিদিকে পর্যবেক্ষণই করছিল এমন সময় একজন মধ্যবয়সী মহিলা তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“আপনিই তানহা ম্যাডাম?”
তানহা বুঝতে পারে না এত বয়স্ক একজন মহিলা তাকে কেন ম্যাডাম বলছে। তবুও সে মাথা নাড়ায়।
“বাহ, আপনি তো দেখতে মাশাল্লাহ। স্যারের পছন্দ আসলেই সুন্দর, একটু সাজগোজ করলে আপনাকে আরো সুন্দর লাগবে।”
তানহা বলে,
“আমাকে সাজতে হবে কেন?”
“ওমা আর এক সপ্তাহ পর আপনার বিয়ে। আপনাকে তো এখন সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকতে হবে।”
তানহা যেন আকাশ থেকে পড়ে৷ সে তো জানত যে, শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর বিয়ে হতে চলেছে৷ কিন্তু তার বিয়ের কথা উঠছে কেন। তানহা বলে,
“আপনার বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বিয়ে হবে কেন। ঐ শাহনওয়াজ সিদ্দিকী তো আমায় পাচার..”
বলতে গিয়ে থেমে যায় তানহা। এমন সময় শাহনওয়াজ সেখানে এসে বলে,
“হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছ তুমি। সামনের শুক্রবার তোমায় পাচার করে দেব। এজন্য বলছি সুন্দর করে সেজে পরিপাটি হয়ে থাকো। যাতে তোমাকে বিক্রি করে ভালো দাম পাই।”
তানহা দাঁত চিবিয়ে বলে,
“মোটেই আমি ভালো করে সাজব না। একদম পেত্নির মতো সাজব৷ তারপর দেখি আমায় কে পছন্দ করে।”
শাহনওয়াজ এবার এগিয়ে এসে তানহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“এই পেত্নীকেও নিজের ঘাড়ে ঝুলিয়ে নেয়ার মানুষের অভাব নেই, বুঝলে পাগলী!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨