অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-০৭

0
13

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি

শাহনওয়াজ তানহাকে নিজের সাথে তার রুমে নিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তানহা শাহনওয়াজের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি আমায় এখানে কেন নিয়ে এলেন? কি দেখাতে চান আমায়?”

শাহনওয়াজ নিজের কাবার্ডের কাছে গেল। কিছু সময় পর সেখান থেকে একটা টিফিন বক্স বের করল। দেখে মনে হচ্ছে টিফিন বক্সটা অনেক পুরাতন। শাহনওয়াজ তানহার সামনে টিফিন বক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“দেখো তো এটা চিনতে পারো কি না।”

তানহা সেটা হাতে নিয়ে বলে,
“এটা তো একটা টিফিন বক্স..কিন্তু এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”

শাহনওয়াজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তার মানে তুমি ভুলে গেছ। অবশ্য ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যাইহোক, তোমার এটার কথা নাহয় মনে নেই কিন্তু এটা কি মনে আছে যে..,”

“কি?”

“তুমি যখন অনেক ছোট ছিলে ৪/৫ বছর বয়স তখন তোমার মাও বেচে ছিলেন। সেই সময় মনে আছে, তুমি বোধহয় সেদিন প্রথম স্কুলে গিয়েছিলে। সেদিন তোমাদের স্কুলের বাইরে একটা কিশোর বসে ছিল৷ সে ক্ষুদার্থ ছিল। তোমার মা সেদিন ছেলেটিকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খেতে দিয়েছিল। মনে আছে, এরপর থেকে তোমার মা প্রতিদিন টিফিনে তোমার জন্য এক্সট্রা খাবার দিত যাতে তুমি সেখান থেকে ছেলেটিকে দিতে পারো। একদিন ছেলেটির হাত চোট লেগেছিল, সেদিন তুমি তোমার ছোট্ট হাতে ঐ ছেলেটিকে খাইয়ে দিয়েছিলে মনে আছে?”

তানহা নিজের অতীতের স্মৃতিতে ডুব দেয়৷ সত্যিই তার সাথে এমনই হয়েছিল। একজন পথশিশুকে সে এভাবেই খাইয়ে দিয়েছিল। এরপর শাহনওয়াজ আবার বলে ওঠে,
“তারপর একদিন তুমি স্কুলের সামনে বসে কাঁদছিলে। পথশিশুটা তোমার কাছে গেলে তুমি তোমার পুরো টিফিনটা তাকে দিলে৷ সেদিন টিফিনে খুব কম খাবার ছিল। তুমি কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটিকে বলেছিলে, তোমার মা আর নেই। তিনি তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। তাই এখন থেকে কেউ আর তোমার জন্য খাবার দেবে না৷ সেদিন ছেলেটা তোমায় সান্ত্বনা দিয়েছিল। তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, এতদিন যেভাবে তুমি ওকে খাবার দিয়েছ তেমনি ভাবে এবার থেকে ও তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে। মনে আছে তোমার?”

তানহার চোখে জল চলে আসে। সে বলে,
“কিন্তু ছেলেটা আর আসে নি। ও মিথ্যাবাদী ছিল। ওর জন্য আমি অনেক অপেক্ষা করেছিলাম। বাড়িতে সৎ মা আমায় ঠিকভাবে খেতে দিত না। আমি আশায় ছিলাম, একদিন ও আসবে আমার জন্য খাবার নিয়ে। কিন্তু…ও নিজের কথা রাখে নি। এক সময় আমিও ওর আশা বাদ দেই। নিজের ভাগ্যের সাথে মানিয়ে নেই।”

শাহনওয়াজ এবার তানহাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি দুঃখিত..তোমার কঠিন সময়ে আমি তোমার কাছে থাকতে পারিনি। বিশ্বাস করো, আমি চেয়েছিলাম তোমার জন্য খাবার নিয়ে যেতে। কিন্তু..পরিস্থিতি এমন ছিল যে..আমাকে সম্পূর্ণ এক নতুন জীবনে প্রবেশ করতে হয়। যেখানে আমার নিজের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। অন্যের কথামতো চলতে হতো আমায়। আর তাই..”

“মানে? তুমিই সেই..”

“হ্যাঁ, তানহা। আমিই তোমার সেই ছোটবেলার বন্ধু। যে ছোটবেলায় তোমাকে দেয়া কথা রাখতে পারি নি। কিন্তু এবার সময় এসেছে নিজের ভুল শোধরানোর। এবার আমি তোমায় সবকিছু থেকে আগলে রাখব। আমি তোমায় কথা দিলাম।”

বলেই সে তানহাকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে। মনে করে, সেদিন তানহাকে দেয়া কথা রাখতে সে খাবার জোগাড় করতে মানুষের দ্বারে দ্বারে খুলছিল। আর ঠিক সেই সময়ই তার দেখা হয় আনোয়ার সিদ্দিকীর সাথে। খাবার জোগাড় করার সময় শাহনওয়াজ যখন একটি রেস্টুরেন্টে চুরি করতে গিয়ে মার খাচ্ছিল তখন আনোয়ার সিদ্দিকী তাকে উদ্ধার করে নিজের সাথে নিয়ে যান নিজের মাফিয়া সাম্রাজ্যে। আর সেখানেই তার জীবনটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এরপর শাহনওয়াজ নিজের ইচ্ছায় কখনো ঐ সাম্রাজ্যের বাইরে আসতে পারেনি। যখন সেই সুযোগ পেল তানহার অনেক খোঁজ করেছে।

কিন্তু তার খোঁজ পায়নি। এরপর ওর বায়োডাটা খুঁজতে গিয়ে সব কিছু বুঝতে পেরেছে। তানহা শাহনওয়াজকে বলে,
“এবার আপনি আমায় সত্যি আগলে রাখবেন তো? আগের মতো আর আমায় ছেড়ে যাবেন না তো?”

শাহনওয়াজ তানহার হাত ধরে বলে,
“এই যে হাতটা ধরলাম। মৃত্যুর আগে অব্দি তোমার এই হাত আমি ছাড়ব না। কথা দিলাম তোমায়।”

“সত্যি?”

“হুম।”

শাহনওয়াজ তানহার কপালে চুমু খায়। তানহা লজ্জায় মিইয়ে যায়।

★★
আজ তানহা ও শাহনওয়াজের গায়ে হলুদ। এই নিয়ে পুরো সিদ্দিকী ম্যানশনে চলছে আয়োজন। আকবরের আজকের পুরো দিন কাটছে ব্যস্ততায়। সে আজ দম ফেলারও সময় পাচ্ছে না।

এর মাঝে সে খেয়াল করেছে, মিহিকে কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে। সে ফোনে কারো সাথে ভীষণ কথা বলছে। আবার তার হাতে ভীষণ দামি একটা ব্রেসলেট, গলায় দামী লকেট। এসব দেখে আকবরের কেমন একটা খটকা লাগে। সে ভাবে,
“এই মেয়ে এত দামি দামি জিনিস কোথায় পেল?”

তবে বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেল না৷ কারণ তার অন্য অনেক কাজ আছে। এমন সময় সে খেয়াল করল, শাহনওয়াজ এসে দাঁড়িয়েছে। সে এসে আকবরকে বলল,
“সব আয়োজন করে ফেলেছ?”

“হুম, সব কিছু ঠিকঠাক।”

তানহাকে পুরো একটা সুন্দর হলুদ শাড়ি পড়েছে। তাকে দেখে যে কেউ বলবে তার মতো সৌন্দর্য আর কারো নেই। মিহি দূর থেকে তাকে দেখে কিছুটা হিংসা করছে। তবে মর্জিনা বেগম এগিয়ে গিয়ে তানহাকে বললেন,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে। চল তোকে প্রথম হলুদ আমিই লাগাবো।”

বলেই তিনি তানহাকে এগিয়ে এনে তার গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিলেন। এরপর মিহিও এগিয়ে এসে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে বললো,
“আশা করি, এই হলুদের মতো তোর জীবনও উজ্জ্বল হবে।”

তানহা জড়িয়ে ধরে মিহিকে। এদিকে মিহির মনে অন্য কিছুই চলছিল। শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর গায়েও হলুদ মাখানো হয়েছে। এরপর সে তানহাকে দেখার জন্য এগিয়ে এলেন। শাহনওয়াজ তানহাকে দেখে বললো,
“তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে। তবে আমার হলুদ লাগানো তো এখনো বাকি।”

বলে সেও মাখিয়ে দেয় হলুদ। মিহি বিড়বিড় করে বলে,
“ঢং যত।”

শাহনওয়াজ তানহাকে বলে,
“আজ রাতে আমাদের বিয়ে। আজ থেকে আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে। এই নতুন জীবনে আমার কেবল তোমার সঙ্গ ও ভরসা চাই। আমি জানি, তুমি আমাকে এখনো পুরোপুরি চেনো না,আমার জীবনের ব্যাপারে তেমন কিছু জানোও না। আমাকে নিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। সব প্রশ্নের উত্তর আমি তোমায় দেব। শুধু আমার উপর একটু ভরসা রাখো। কখনো আমার বিপক্ষে যেও না। কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে আমায় ভুল বুঝো না। আমার কোন ব্যাপার নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগলে সরাসরি আমার কাছে প্রশ্ন করবে৷ আর একটা কথা, কাউকেই অন্ধর মতো বিশ্বাস করো না৷ আমার শত্রুর অভাব নেই, অনেকেই তোমায় প্ররোচিত করার চেষ্টা করবে তুমি শুধু প্ররোচিত হয়ো না।”

তানহা মাথা নাড়ায়। এমন সময় আকবর এসে বলে,
“স্যার একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে?”

“কি সমস্যা?”

আকবর এরপর শাহনওয়াজকে কিছু একটা দেখায়। শাহনওয়াজ সেটা দেখে বলে,
“আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।”

সে তানহার দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“আমার জন্য অপেক্ষা করো তানহা। আশা করি, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হবে।”

তানহা হালকা হাসে।

“আজ রাতেই আমাদের বিয়ে হবে।”

বলেই শাহনওয়াজ তানহার কপালে আলতো করে চুমু খায়। তানহা বলে,
“আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব। আগের বারের মতো এই অপেক্ষার প্রহর যেন এত দীর্ঘ না হয়।”

শাহনওয়াজ তানহাকে ভরসা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨