#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
তানহা মিমের সাথে মিলে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেছে। মিম তানহাকে বলে,
“আপু, এরপর যেই ট্রেন আসবে সেটায় চেপে তুই অনেক দূরে কোথাও চলে যা।”
তানহা বলে,
“কিন্তু আমি যাব কোথায়? আর সেখানে গিয়ে কোথায় থাকব?”
মিম বিরক্তিসূচক ভঙ্গিতে বলে,
“আরে আগে এখান থেকে পালা। তারপরে কি করবি সেটা পরে ভাবিস।”
বলেই তানহাকে মানানোর চেষ্টা করে। এর মাঝে ট্রেন চলে আসতেই মিম তানহাকে বলে,
“দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়।”
তানহা বুঝতে পারছিল না কি বলবে। মিম তানহাকে চুপ দেখে বলে,
“এমন চুপ আছিস কেন তুই? ট্রেনে উঠে পড়।”
তানহা বলে,
“আমার কেমন জানি মনটা কুইকুই করছে। ট্রেনে ওঠাটা কি ঠিক হবে?”
“কেন ঠিক হবে না?”
“আমি বুঝতে পারছি না। কি করব। কোথায় যাব। আমার হাতে তো একটা কানাকড়িও নেই।”
“তুই চুপচাপ চলে যা তো। নাহলে ঐ রাক্ষসটাকে তোকে বিয়ে করতে হবে।”
তানহা তবুও নিজেকে মানাতে পারছিল না। এরমাঝে তার মনে হঠাৎ করে একটা চিন্তা ভেসে ওঠে। সবসময় আমরা চোখে যা দেখি সেটাই কি সত্য হয়? এর বাইরেও তো অনেক কিছু হতে পারে। তাছাড়া শাহনওয়াজ তানহাকে বলেছিল, তার উপর ভরসা রাখতে। এসব মনে করে তানহা বলে ওঠে,
“আমার মনে হয়, আমার একবার মিস্টার শাহনওয়াজের সাথে কথা বলা উচিত। ওনার কাছে জানতে চাওয়া উচিৎ ঐ লোকগুলোকে উনি কেন মারলেন।”
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস আপু? নিজের চোখের ঐ লোকটার এত ভয়ানক রূপ দেখার পরেও তুই কিভাবে এই কথা বলছিস, বল তো?”
“আমরা সবসময় যা চোখে দেখি তার বাইরেও তো কিছু সত্য থাকতে পারে। আমাকে সবটা জানতে হবে।”
বলেই তানহা রেলস্টেশন থেকে বের হবার জন্য সামনের দিকে পা বাড়ায়। গভীর রাত হওয়ায় তখন খুব একটা ভীড় ছিল না। মিম আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নেয় কোন সিসিটিভি আছে কিনা। নেই দেখে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়। মনে করে আফনান সিদ্দিকীর বলা কথা। আজ যে করেই হোক তাকে তানহাকে শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর জীবন থেকে দূরে পাঠাতে হবে। এর বিনিময়ে আফনান সিদ্দিকী মিমকে অনেক অর্থ দেয়ার এমনকি তাকে নিজের জীবনসঙ্গী করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সুবর্ণ সুযোগ মিম কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না। তাই সে তানহার হাত টেনে ধরল। তানহা বলে উঠল,
“কি হলো মিম? আমায় আটকাচ্ছিস কেন?”
মিম বলে ওঠে,
“এদিকে আয় আপু। তোর সাথে জরুরি কথা আছে।”
“আবার কি বলবি?”
“এদিকে আয় না।”
বলেই তানহাকে নিয়ে রেলস্টেশনের কিছুটা সামনে এগিয়ে যায় মিম। তানহা মিমকে বলে,
“আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলি? কি বলবি বল জলদি।”
এর মাঝে ট্রেনের হুইসেল দেয়। মিম বুঝতে পারে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সে তানহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর বলে,
“আমি জানি, সারাটা জীবন আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আম্মুর সাথে মিলে সবসময় তোর উপর অত্যাচার করেছি। এসবের কোন ক্ষমা হয় না সেটাও আমি জানি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুই এসব কেন বলছিস?”
“আমি জীবনে তোর সাথে অনেক খারাপ কিছু করেছি আপু কিন্তু আজ নিজের স্বার্থে তোর সাথে আরো খারাপ কিছু করতে হবে।”
“মানে?”
“তুই তো জানিস, আমি সবসময় ধনী জীবনের স্বপ্ন দেখতাম। তোর বোন হয়ে থেকে হয়তো আমার জীবনে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসতো কিন্তু আমার নিজের সম্রাজ্ঞী হওয়া হতো না। আর তাই যাতে আমার রাস্তা একদম ক্লিয়ার হয় তাই এটা আমায় করতেই হবে। আমার সব অন্যায় তো আগেও তুই ক্ষমা করেছিস,পারলে আজকের টাও ক্ষমা করিস। ওপারে ভালো থাকিস আপু।”
বলেই মিম সজোরে ধাক্কা দেয় তানহাকে। তানহাকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়। সে একদম রেললাইনে পড়ে যায়। আর ট্রেনটা দ্রুত চলতে শুরু করে। তানহা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে দাঁড়াবে তার আগেই ট্রেনটা এসে তাকে পিষে দিয়ে যায়। তানহার আর্তনাদে পুরো আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মিম দ্রুত রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে যায়। রেলস্টেশনের বাইরে এসে বলে,
“তানহার চ্যাপ্টার ক্লোজ। এবার আমাকে আফনানের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। আপাতত কিছুদিন আমায় আত্মগোপনে থাকতাম হবে।”
বলেই সে নিজের ফোন বের করে আফনানকে কল করে।
★★
শাহনওয়াজ সিদ্দিকী যখন নিজের কাজ শেষ করে সিদ্দিকী ম্যানশনে ফিরে জানতে পারে তানহা এখানে উপস্থিত নেই তখন সে ভীষণ রেগে যায়। নিজের ঠিক করে রাখা গার্ডদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তোমরা আমার কথার অমান্য করলে কোন সাহসে? তোমাদের আমি বলেছিলাম না তানহার উপর নজর রাখতে। ও যেন তোমাদের চোখের আড়াল না হয়। তাহলে কিভাবে তোমরা ওকে এভাবে যেতে দিলে?”
সবগুলো গার্ডস মাথা নিচু করে নেয়। শাহনওয়াজ বলে,
“যদি আজ আমার তানহার কিছু হয় তাহলে তোমাদের কাউকে আমি ছাড়ব না।”
এরপর সে ক্ষিপ্তদৃষ্টিতে মর্জিনা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
“আপনার মেয়ে তানহাকে নিয়ে কোথায় গেছে? ভালোয় ভালোয় বলুন, নয় তো..”
“বিশ্বাস করো বাবা, আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানি না। তোমার খোঁজ করতেই তো তানহা বেরিয়ে গেল আর মিম ওকে সঙ্গ দিতে গেল।”
“তানহা তো নিজের ফোন নিয়ে যায় নি। আপনার মেয়ে তো নিয়ে গেছে। তো আপনার মেয়েকে একটা ফোন করুন।”
মর্জিনা বেগম মিমের নাম্বার ডায়েল করে কল করে। কিন্তু ফোনটা সুইচ স্টপ দেখায়। শাহনওয়াজ ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। আকবর এগিয়ে এসে বলে,
“আপনি চিন্তা করবেন না বস। আমি ওনার লোকেশন ট্রাক করার ব্যবস্থা করছি। যত দ্রুত সম্ভব তানহা ম্যামকে খুঁজে বের করব আমি। ওনার কোন ক্ষতি হতে দেব না।”
এদিকে মর্জিনা বেগম ভাবেন,
“এই মিমটা কোথায় গেল এভাবে? আমাকে তো কিনা বলল না। না জানি কোন বিপদ আসে আর আমি সেই বিপদে ফেসে যাই। তানহার কিছু হয়ে গেলে তো এই শাহনওয়াজ সিদ্দিকী আমায় ছিড়ে খাবে।”
★★
নতুন দিনের আগমন ঘটেছে চট্টগ্রামে। কিন্তু শাহনওয়াজের জীবনে যেন ঘোর অমানিশার আগমন ঘটেছে। কাল রাত থেকে এখনো অব্দি তানহার কোন খোঁজ নেই। শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর আদেশে আকবর শহরের প্রতি কোনায় কোনায় তানহাকে খুঁজে চলেছে। মিমের লাস্ট লোকেশন বলছে বন্দর এলাকায়। কিন্তু এরপর আর কোন খোঁজ নেই তাদের।
শাহনওয়াজ বুঝতে পারে না কি হয়েছে।
এর মাঝে আকবর বিমর্ষ ও নতজানু ভঙ্গিতে শাহনওয়াজের সামনে এসে দাঁড়ায়। শাহনওয়াজ আকবরকে এভাবে দেখে ভ্রু কুচকে বলে,
“কি হয়েছে আকবর? তোমায় এমন লাগছে কেন? ইজ এভরিথিং ওকে?”
আকবর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“জানি না স্যার, আপনাকে সংবাদ টা কিভাবে দেব।”
“তানহার খোঁজ পেয়েছ তুমি? কোথায় ও? ওকে এক্ষুনি আমার সামনে নিয়ে এসো। তারপর ওকে আমি বোঝাচ্ছি পালানোর শাস্তি কি হতে পারে।”
আকবরের গলার স্বর ভেঙে আসে,
“কাকে শাস্তি দেবেন আপনি স্যার? শাস্তি দেয়ার জন্য মানুষটাকে তো থাকতে হবে।”
“মানে? এসব কি হেয়ালীপনা করছ তুমি? যা বলার স্পষ্ট করে বলো।”
“আপনাকে এক্ষুনি আমার সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গে যেতে হবে।”
শাহনওয়াজ বিস্ফোরিত স্বরে বলে,
“মর্গে!”
“গতরাতে রেললাইনে একটি মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ট্রেনে কাটা পড়ে। তার দেহ সম্পূর্ণ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে পোশাক-আশাক ও খন্ডিত অংশ দেখে আমরা শনাক্ত করেছি যে ওটাই তানহা ম্যাম!”
শাহনওয়াজ চিৎকার করে বলে ওঠে,
“নাহ, এটা হতে পারে না। মিথ্যা বলছ তুমি। আমার তানহার কিছু হতে পারে না।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨