অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-১০

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

শাহনওয়াজ এসে উউপস্থিত হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজের মর্গের সামনে। তবে এখনো সে বিশ্বাস করতে নারাজ যে তানহা আর বেচে নেই। নিজের সামনে দাঁড়ানো আকবরের উদ্দ্যেশ্যে সে বলে,
“তোমাদের কাছে নিশ্চয়ই কোন ভুল খবর আছে। আমার তানহার কিছুই হতে পারে না। আমি নিশ্চিত আমার তানহা একদম সহি সালামত আছে।”

আকবর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“এটা সত্য হলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না স্যার। কিন্তু…আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।”

শাহনওয়াজ বলে,
“আমি বলে দিচ্ছি, যদি আমার তানহার কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কাউকে ক্ষমা করব না৷ সবাইকে আমি দেখে নেব। আমার তানহার এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী থাকে তাদের কাউকে আমি ভালো থাকতে দেব না। তাদের সবাইকে আমি তাদের অপকর্মের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দেব।”

এর মাঝে হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা এসে বলে,
“আপনারা কি মিস তানহার বাড়ির লোক?”

শাহনওয়াজ এগিয়ে এসে বলে,
“হ্যাঁ, আমি তানহার হবু বর। গত কালকে ওর সাথে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। মাঝখান থেকে কোথা থেকে কি হয়ে গেল আর…আমার এখনো মনে হয়, আমার তানহার কিছু হয়নি। তবুও..”

“দেখুন, গতকাল রাতে রেলস্টেশন থেকে এই লাশটা আনা হয়েছিল৷ খুব বাজেভাবে ট্রেনে কাটা পড়েছে তার। চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। তবে পোশাক এর সাথে মিল পাওয়া গেছে। আপনার ওখান থেকে যেই লোক এসেছিল সে পোশাক দেখেই শনাক্ত করেছে যে এটাই তানহা। ওনার পরনে বিয়ের বেনারসি শাড়ি ছিল। এখন আপনি একবার লাশটা যদি দেখে শনাক্ত করতেন তাহলে ভালো হতো।”

শাহনওয়াজ সিদ্দিকী বলে ওঠে,
“ঐ বিয়ের লাল বেনারসি শাড়িটা আমিই ওকে কিনে দিয়েছিলাম। আমি দেখলে নিশ্চয়ই তাই চিনতে পারব। আপনি শুধু আমাকে একবার দেখার ব্যবস্থা করে দিন।”

“ঠিক আছে, এসে দেখে যান।”

বলেই লোকটা তাকে মর্গে প্রবেশ করতে আহ্বান জানায়। শাহনওয়াজও পা বাড়ায়৷ তবে এখনো তার স্থির বিশ্বাস, তানহার কিছু হয়নি। তার তানহা একদম ঠিক আছে।

​শাহনওয়াজ মর্গের ভেতর ঢোকে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কম্পন অনুভব করে সে। তার মন বারবার বলছে তানহা ঠিক আছে, তবুও এই শীতল, ভ্যাপসা পরিবেশ আর লাশের গন্ধ তার স্থির বিশ্বাসকে নড়িয়ে দেয়। একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা লাশ রাখা আছে একটি ট্রলির উপর। তার মনে হয়, ওটা নিশ্চয়ই অন্য কারো লাশ। তার তানহা ওখানে নেই।

​মর্গ অফিসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আর শাহনওয়াজ ধীরে ধীরে লাশটির কাছে এগিয়ে যায়। তার পা যেন আর চলতে চাইছে না। যখন সে ট্রলির কাছে পৌঁছায়, তার হাত কাঁপতে থাকে। সে ধীরে ধীরে সাদা কাপড়টি সরাতে শুরু করে। প্রথমটা সে শুধু একটি লাল শাড়ির অংশ দেখতে পায়। তার চোখ ভিজে আসে। সে আর কিছু দেখতে চায় না, কিন্তু তার মন তাকে বলে,
“পুরোটা দেখো। এখনও আশা আছে, এখনও তানহা বেঁচে থাকতে পারে।”

​সে কাঁপা হাতে সম্পূর্ণ কাপড়টি সরিয়ে ফেলে। কিন্তু লাশটির দিকে তাকাতেই তার পৃথিবীটা যেন থমকে যায়। তার সামনে যা আছে, তা কোনো মানুষের অবয়ব নয়। শরীরটা বিকৃত, ছিন্নভিন্ন, মুখটা বোঝার উপায় নেই। শাহনওয়াজের শরীর জমে যায়। তার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়। কিন্তু তার চোখ আটকে যায় সেই লাল বেনারসি শাড়িটার দিকে। শাড়িটা দেখে তার মনে পড়ে, সে নিজে হাতে তানহাকে এই শাড়িটি বেছে দিয়েছিল।

আজ সেই শাড়িটা রক্তে রাঙানো, ছেঁড়া, নোংরা। শাহনওয়াজের বুকে তীব্র একটা কষ্ট অনুভব হয়। সে মাথা ঘুরিয়ে নেয়, চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসে।

​শাহনওয়াজ আর কোনো কথা বলতে পারে না। সে শুধু তার মাথার উপর হাত দিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার বিশ্বাস, তার আশা, তার স্বপ্ন সব কিছু মুহূর্তে ভেঙে যায়। সে মাটিতে বসে পড়ে আর চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।

​আকবর বাইরে থেকে দেখতে পায় শাহনওয়াজের এই অবস্থা। সে ছুটে আসে আর তাকে ধরে তোলে। সে বলে,
“স্যার, নিজেকে সামলান। আমি জানি এটা কঠিন, কিন্তু আপনাকে শক্ত হতে হবে।”

​শাহনওয়াজ আকবরের হাতটা ধরে বলে, “আমার তানহা, আমার তানহা আর নেই। আমার সবকিছু, আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, সব শেষ হয়ে গেল। আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? কেন এমন হলো? কেন? আমার তানহার কি দোষ ছিল? ও তো কারোর কোনো ক্ষতি করেনি। কেন ওর সাথে এমন হলো?”

​আকবর তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“স্যার, শান্ত হোন। শান্ত হোন। এখন আর কোনো লাভ নেই। আপনাকে শক্ত হতে হবে।”

​শাহনওয়াজ আকবরের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। তার কাঁধে মাথা রেখে সে বলে,
“আমি ওকে বলেছিলাম, আমাদের বিয়ে হবে। আমাদের একটি সুন্দর জীবন হবে। কিন্তু কে জানত, আমাদের জীবন এমনভাবে শেষ হবে? আমি ওর জন্য একটা সুন্দর জীবন তৈরি করতে চেয়েছিলাম আর দেখো, ওকে এমনভাবে মরতে হলো। আমি ওদের কাউকে ছাড়ব না। যারা এর জন্য দায়ী, তাদের আমি শেষ করে দেব। আমি শপথ করছি, আমি ওদের খুঁজে বের করব আর উপযুক্ত শাস্তি দেব।”

​আকবর তাকে বোঝায়,
“শান্ত হোন স্যার। প্রতিশোধ নিতে হলে আপনাকে বাঁচতে হবে। আপনাকে শক্তিশালী হতে হবে। প্রতিশোধের আগুন আপনার ভেতরে জ্বলছে, কিন্তু সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। এখন আমাদের তানহা ম্যামের জানাজা…।”

​শাহনওয়াজ চোখের জল মুছে, আকবরের মুখের দিকে তাকায়। তার চোখ লাল, শরীর কাঁপছে। সে বলে,
“হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। আমি ওদের খুঁজে বের করব। আমার ভালোবাসার এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের আমি শেষ করে দেব।”

​শাহনওয়াজের চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে। তার মনের মধ্যে একটিই চিন্তা, যে করেই হোক, তাকে তানহার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে। তার মনে হয়, তানহার মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী। সে যদি তানহাকে একা ছেড়ে না যেত, তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। এই অপরাধবোধ তার মনকে আরও যন্ত্রণা দেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, তার মুখটা শক্ত হয়ে যায়।

আকবর বুঝতে পারে এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে শাহনওয়াজ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে তাই সে শাহনওয়াজকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। কিন্তু বাইরে এসে শাহনওয়াজ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বাইরে এসেই আশেপাশে থাকা ট্রলি, টব সহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। যা দেখে আশেপাশের অনেক মানুষ ভয়ে পালিয়ে যায়। শাহনওয়াজ ডুকরে উঠে বলে,
“তানহা..আমার তানহা কেন আমায় এভাবে ছেড়ে চলে গেল..আমার জীবনে কি একটুও সুখ লেখা নেই..”

শাহনওয়াজের চোখের সামনে তানহার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতেই সে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

এমন সময় সে নিজের সামনে তানহাকে দেখতে পায়। অবাক হয়ে বলে,
“তানহা তুমি?”

তানহা হেসে বলে,
“হ্যাঁ, আমি।”

” তুমি কেন আমার ছেড়ে চলে গেলে? আমার ভালোবাসার কি কোন দাম নেই তোমার কাছে?”

“কে বলল আমি চলে গেছি। আমি তো আপনার পাশেই আছি। মনের চোখ দিয়ে খুঁজলেই আমাকে পেয়ে যাবেন।”

“তার মানে সত্যি তোমার কিছু..”

ধীরে ধীরে তানহার প্রতিচ্ছবি অদৃশ্য হয়। শাহনওয়াজ ক্রোধে একটা টব নিয়ে ছুড়ে ফেলতে যাবে এমন সময় এক নারী কন্ঠ বলে ওঠে,
“হচ্ছে টা কি এখানে? এটা একটা হাসপাতাল, কোন চিড়িয়াখানা নয়।”

শাহনওয়াজ কন্ঠটা শুনে থমকে যায়। অবাক হয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে তার বিস্ময় দ্বিগুণ হয়।

নারীটি এগিয়ে এসে বলে,
“এসব ভাঙচুর করছেন কেন এখানে?”

“তুমি..”

“আমি গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর সোহিনী চৌধুরী..”

শাহনওয়াজ আরো বেশি অবাক হয়ে যায়। আচমকা সোহিনী চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি তানহা..আমার তানহা। আমি জানতাম তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যেতে পারো না ”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨