অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-১৯

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি

শাহনওয়াজ সিদ্দিকী ও তানহা বসে আছে কাজি সাহেবের সামনে৷ কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। শাহনওয়াজকে ভীষণ ব্যথিত লাগছিল। তানহার মুখেও নাখোশ ভাব স্পষ্ট। তানহা চোখ বন্ধ করে অতীতের স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়ে বলে,
“তুমি কোথায় বন্ধু? তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে আমার টিফিন বক্সে করে খাবার ভর্তি করে নিয়ে আসবে। আমার সৎমায়ের অত্যাচার থেকে আমায় মুক্ত করবে। সেই কথা কি রাখবে না? আমি তো তোমার অপেক্ষায় কতদিন বসে ছিলাম৷ তারপর খালা এই গ্রামে নিয়ে এলো..তুমি কি পরে কখনো আমার খোঁজ করেছ না ভুলে গেছ আমায়?”

এরমাঝেই কাজি সাহেব বলে ওঠেন,
“কবুল বলো মেয়ে।”

তানহার নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসে। চোখে স্পষ্ট অশ্রু। সে দাতে দাত চেপে একবার নিজের খালার দিকে তাকায়। এই মানুষটার সম্মান বাচাতেই আজ তাকে না চাইতেও এই বিয়েটা করতে হচ্ছে।

“কবুল..”

অবশেষে তানহা সফল হলো এই কঠিন শব্দটি নিজের ওষ্ঠদ্বয়ে আনতে। অতঃপর ধীরে ধীরে শ্বাস নিলো। ক্ষীণ হয়ে আসা তার স্বর যেন নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিলো। শাহনওয়াজও পরিস্থিতির চাপে কবুল বললো। এক অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কে বাধা পড়লো তারা দুজন। যা তাদের দুজনেরই অনিচ্ছার ফসল। কিন্তু এই অনিচ্ছা থেকেই কি নতুন কোন ইচ্ছার জন্ম নেবে। শাহনওয়াজ কবুল বলেই উঠে নিজের রুমে গেল। তার পিছু পিছু আকবরও চলল। শাহনওয়াজ সিদ্দিকী আকবরকে দেখেই বললো,
“এটা ঠিক হলো না..ঐ মেয়েটা বা আমি কেউই এই বিয়েটা মেনে নিতে পারব না।”

এদিকে তানহা এগিয়ে গিয়ে কুলসুম বেগম কে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এটা কি হলো খালা? কেন আমায় এই বিয়েটা করতে হলো? আমি তো এটা চাই নি। এরকম একটা মিথ্যা অপবাদে আমার পুরো জীবন তোমরা এলোমেলো করে দিলে।”

“নাহ, এমন না। তুই সামলা নিজেকে।”

“কিভাবে সামলাবো?”

“আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। দেখিস আজ যেটার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস একদিন আর এই কষ্টটা থাকবে না।”

“সত্যি?”

‘হুম।’

★★
তানহা ও শাহনওয়াজ এসে দাঁড়িয়েছে কুলসুম বেগম এর বাড়ির সামনে। কুলসুম বেগম তাদের দাঁড় করিয়ে বলেন,
“অপেক্ষা করো..তোমাদের আমি বরণ করে ঘরে তুলব।”

শাহনওয়াজ কিছু বলতে যাবে এমন সময় আফনান সিদ্দিকী সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,
“বরণ করে ঘরে তুলতে হবে না,এখন এই শাহনওয়াজ সিদ্দিকী যাবে শ্রীঘরে।”

আকবর, শাহনওয়াজ দুজনেই অবাক চোখে তাকায় আফনানের দিকে। আফনান বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলে,
“কি ভেবেছিলি তোরা? তোরা আইনের চোখ ফাকি দিতে পারি? সেই সামর্থ্য তোদের নেই। শেষ অব্দি ধরা পড়েই গেল। এখন চল, আইনের শাস্তি ভোগ কর।”

সে তার অধীনস্থ এক পুলিশ অফিসারকে বলে,
“হাতকড়া পড়ান এই মাফিয়াকে।”

কিন্তু সেই অফিসার উল্টে আফনান সিদ্দিকীকেই হাতকড়া পড়ায়। আফনান সিদ্দিকী রাগী স্বরে বলে,
“what the hell..তুমি আমায় কেন হাতকড়া পড়াচ্ছ?”

এমন সময় আকবর হেসে ওঠে৷ তার সাথে শাহনওয়াজও। আকবর বলে,
“তোমার সব দূর্নীতির প্রমাণ আমি পুলিশের কাছে পৌঁছে দিয়েছি৷ কিভাবে তুমি শাহনওয়াজের নাম ভাঙিয়ে অন্যায় করতে তা এখন দুনিয়ার সবার সামনে পরিস্কার। তাই এই ভালো মানুষের মুখোশটা খুলে ফেলো।”

আফনান সিদ্দিকীর চোখ জ্বলে ওঠে। নিজের পরাজয় বুঝতে পেরে সে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলে,
“এটা হতে পারে না। আমি মানি না…বারবার আমি এভাবে এই শাহনওয়াজের কাছে হারতে পারি না। প্রথমে নিজের বাবার ভালোবাসা, বাবার উত্তরাধিকার পাওয়া সূত্রের সম্পত্তি, মাফিয়া কিং হবার যোগ্যতা সব একে একে হারিয়েছি এর জন্য। আর এত বছরের নিখুঁত প্ল্যান করে আমি যে ওকে ফাসিয়েছিলাম সেটাও শেষ অব্দি ব্যর্থ হলো।”

শাহনওয়াজ হেসে বলে,
“তুমি তো ভালো করেই জানো, আমার সাথে লড়াই করে জেতা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে কেন শুধু শুধু চেষ্টা করতে গেলে? দিনশেষে নিজের ফাদে নিজেই পড়লে তো!”

আফনান সিদ্দিকী ফোসফাস করতে থাকে। ততক্ষণে তাকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। গ্রামে উৎসুব মানুষের সংখ্যা একটু বেশিই। তাই ততক্ষণে বেশ ভালোই ভিড় জমে। সবাই বোঝার চেষ্টা করে কি হচ্ছে এখানে। কুলসুম বেগম এগিয়ে এসে আকবরকে বলে,
“এসবের মানে কি বাবা? তোমার বন্ধুর আসল পরিচয় কি?”

“আমার বন্ধু শাহনওয়াজ সিদ্দিকী, ও হলো একজন সৎ ব্যবসায়ী। অন্ধকার জগতে যে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছে। মাফিয়া হয়েও যে নিজের জীবন জনকল্যানে বিলিয়েছে ”

শাহনওয়াজের ব্যাপারে এমন কথা শুনে তানহা এবার তার প্রতি কিছুটা মুগ্ধতা নিয়ে তাকায়। এরমধ্যে একটা গাড়ি এসে থামে তাদের বাড়ির সামনে। সেই গাড়ি থেকে নেমে আসে সোহিনী। তার পরণে ফর্মাল ড্রেস। সোহিনী গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে ছুটে এসে শাহনওয়াজের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“মিস্টার শাহনওয়াজ..আমি দুঃখিত সবকিছুর জন্য। আজ আমি সব সত্য জানতে পেরেছি। ঐ আফনান সিদ্দিকী কিভাবে আমায় ম্যানিপুলেট করেছে সব আজ আমার কাছে পরিস্কার।”

শাহনওয়াজ কঠিন স্বরে বলল,
“যাইহোক, বাস্তবতা যে আপনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন এটাই অনেক। কিন্তু আমার পক্ষে কখনো আপনাকে ক্ষমা করা সম্ভব নয়। আপনি আমার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন।”

সোহিনী এবার চুপসে যায়। কি বলবে সে? এই অভিনয় করতে গিয়ে যে সে সত্যিই শাহনওয়াজ প্রেমে পড়ে গেছে৷ তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল এই একটি মানুষের রাজ। সোহিনী ভাবল, এটাই সঠিক সময় শাহনওয়াজকে নিজের মনের কথা জানাবে। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইবে৷ এমনো তো হতে পারে, সে আরেকটা সুযোগ পেল। এই ভাবনা থেকেই সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় শাহনওয়াজ তানহার দিকে ইশারা করে বলল,
“তুমি একটু এদিকে এসো তো..”

তানহা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। সোহিনী তানহার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শাহনওয়াজ তানহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মিট মাই ডিগনিটিফুল ওয়াইফ, তানহা..আজকেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন অবশ্যই।”

সোহিনী বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। এত বড় সত্যটা সে মেনে নিতে পারে না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। তার দুচোখে জল জমে। শাহনওয়াজ সেদিকে খেয়াল না করে বলে,
“কি হলো? দোয়া করবেন না?”

সোহিনী জোরপূর্বক হেসে বলল,
“কেন নয়? সুখী হোন আপনারা। আল্লাহ আপনাদের জীবন সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভড়িয়ে দিক। আপনাদের দাম্পত্য জীবন চিরসুখী আর চিরস্থায়ী হোক।”

বলেই সোহিনী আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলে,
“গাড়ি স্টার্ট করো..আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকতে চাই না।”

পুরো রাস্তা সোহিনী চোখের জল ফেলে।

স্বগতোক্তি করে বলে,
“এখন কেন কাঁদছিস সোহিনী? তুই এটাই ডিজার্ভ করিস। মানুষটাকে তো কম কষ্ট দিস নি। তোর বোকামির জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেলি আজ।”

মাঝরাস্তায় সে গাড়ি থেকে নেমে একা রাস্তায় হাটতে থাকে। আজ সে আর নিজের মধ্যে নেই। আচমকা সে মাটিতে বসে পড়ে। অতঃপর আর্তনাদ করে বলে,
“কেন? কেন ভাগ্য আমার সাথে এমন খেলা খেলল? অভিনয় করতে গিয়ে আমি বাস্তবে এত বড় একটা কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর থেকে তো মৃত্যুও শ্রেয়।”

বলেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার দুঃখে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨