অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
13

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ২০(শেষ পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা_মনি

শাহনওয়াজ ও তানহা পাশাপাশি বসে আছে৷ শাহনওয়াজ সিদ্দিকী এতক্ষণ ধরে তানহাকে নিজের মাফিয়া জীবনের সব ঘটনা বললো। সব শুনে তানহা অবাক হলো। শাহনওয়াজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
“আমার স্ত্রী হিসেবে এসব জানার অধিকার ছিল তোমার। তাই বললাম, তোমারও যদি আমাকে কিছু জানানোর থাকে তো জানাতে পারো।”

তানহা হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
“জ্বি, আমারো আপনাকে কিছু বলার আছে। জানি না..ব্যাপারটা আপনি কিভাবে নেবেন। আমাদের বিয়ে যেই পরিস্থিতিতেই হোক, আপনি তো এখন আমার স্বামী। আর কোন স্বামীই তার স্ত্রীর অতীতকে ভালো ভাবে নেয় না। তবে আমার অতীতটা একটু ভিন্ন। আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন আমার খুব ভালো একজন বন্ধু ছিল। সেই সময় আমার মা বেঁচে ছিল। আমার মা আমাকে নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেত আর স্কুলে যাওয়ার পথে আমার পরিচয় হয় আমার সেই বন্ধুর সাথে। ও অনেক অসহায় ছিল। আমার মা ওকে খাবার খেতে দেয়। তারপর প্রতিদিন আমিক ওর জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। একদিন আমার মা এই পৃথিবী ত্যাগ করলেন। তারপর আমার ঐ বন্ধুকে আমি যখন কেদেকেটে সব সত্যটা বলেছিলাম তখন ও আমায় বলেছিল ও এরপর থেকে আমার জন্য খাবার আনবে। কিন্তু ওর সেই কথা ওহ রাখেনি। ও সেদিন আচমকা হারিয়ে গেল।”

শাহনওয়াজ চমকে উঠে তাকায় তানহার দিকে। তার গলার স্বর ধরে আসে। তানহা শাহনওয়াজের এমন চেহারা দেখে বলে,
“কি হয়েছে? আপনাকে এমন লাগছে কেন?”

তানহার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে শাহনওয়াজ। ব্যথিত স্বরে বলে,
“আমিই তোমার সেই বন্ধু যে তোমাকে কথা দিয়ে সেই কথা রাখতে পারিনি।”

কথাটা শুনে পুরো হতবাক হয়ে যায় তানহা। ধরে আসা গলায় বলে,
“তুমিই সেই?”

“হুম।”

তানহা শাহনওয়াজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শাহনওয়াজ তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তানহা বলে,
“খালা বলত আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আজ তার প্রমাণ পেলাম।”

“আমিও। এর আগে একজন আমার সাথে প্রতারণা করায় আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম। তবে আজ বুঝতে পারছি, আমার সেই ভেঙে পড়া অমূলক হয়নি। আজ আমার জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছি আমি। সব কষ্ট ভোলার ওষুধ আমি পেয়ে গেছি।”

“আমিও তোমাকে ঘিরেই নতুন জীবন শুরু করতে চাই বন্ধু। আর কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না তো?”

“প্রশ্নই ওঠে না। আমার অগ্নিদগ্ধ হৃদয় আজ নতুন ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছে। আমি চাইনা এই ভালোবাসা মলিন হোক, এই ভালোবাসা কানায় কানায় পূর্ণ হোক। এটাই আমার চাওয়া।”

★★
সময় পেরিয়ে গেছে এক মাস। এই এক মাসে তাদের দুজনের বিবাহিত জীবন একে অপরের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছে৷ আজ তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে হানিমুনে যাবে। আর সেজন্য জায়গাও পছন্দ করা হয়ে গেছে। তারা দুজনে ঘুরতে যাবে নিউইয়র্কে। সেখানে শাহনওয়াজের বিজনেস ডিলও আছে। আকবর তাদের যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাদের দুজনকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে শাহনওয়াজ বলে ওঠে,
“আপনাদের জন্য শুভকামনা রইল স্যার৷ ভালো ভাবে এনজয় করুন।”

তানহা ও শাহনওয়াজ দুজনেই মুচকি হাসে।

​তানহা এবং শাহনওয়াজ যখন জন এফ কেনেডি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামলো, তখন নিউইয়র্কের শরৎকালের মিষ্টি রোদ ঝলমল করছে। উঁচু উঁচু কাঁচের দালানগুলো যেন আকাশ ছুঁয়ে কথা বলছে। তাদের হাতে থাকা লাগেজগুলো আকবরের পূর্ব-ব্যবস্থা অনুযায়ী দ্রুতই তাদের জন্য অপেক্ষা করা গাড়িতে লোড হয়ে গেলো।
​শাহনওয়াজ তানহার দিকে ঘুরে মুচকি হেসে তার হাত ধরলো।

“ওয়েলকাম টু দ্য সিটি দ্যাট নেভার স্লিপস, প্রিয়তমা।”

​তানহা চোখ দুটো বড় করে দেখছিল চারপাশের ব্যস্ততা। সে বলে,
“বাব্বা! কী দারুণ লাগছে! এতোটা ব্যস্ত আর প্রাণবন্ত শহর আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে যেন গোটা পৃথিবীটা এখানে এসে ভিড় করেছে।”

​গাড়ি চলতে শুরু করলো ম্যানহাটনের দিকে। তারা উঠেছিলো টাইমস স্কোয়ারের কাছে এক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে, যা ছিল শাহনওয়াজেরই সম্পত্তি। ফ্ল্যাটের বিশাল জানালা দিয়ে টাইমস স্কোয়ারের রঙিন বিলবোর্ডগুলো আর মানুষের কোলাহল দেখা যাচ্ছিল।

​অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে তানহা মুগ্ধ হয়ে বললো,
“অসাধারণ! মনে হচ্ছে যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে আছি।”

​শাহনওয়াজ পিছন থেকে এসে তানহার কোমর জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চিবুক রাখলো।

“স্বপ্ন নয়, এটা আমাদের নতুন জীবনের শুরু। আমাদের ভালোবাসার নতুন ঠিকানা।”

​পরের দিনগুলো ছিল কেবলই ভালোবাসার। শাহনওয়াজ সকালে তার বিজনেস ডিলের জন্য কিছুটা সময় দিলেও, বাকিটা সময় পুরোপুরি তানহার জন্য বরাদ্দ রেখেছিল।
​একদিন তারা গেলো সেন্ট্রাল পার্কে। সোনালী রোদে নরম ঘাসের ওপর বসে তারা হাতে হাত রাখলো। তানহা চোখ বন্ধ করে এক গভীর শ্বাস নিয়ে বললো,
“শহরের মাঝে এমন একটা সবুজ জায়গা যেন শান্তির এক টুকরো মেঘ।”

​শাহনওয়াজ তার হাতটা আলতো করে চেপে ধরলো আর বললো,
“ঠিক বলেছো। ভালোবাসাও ঠিক তাই। জীবনের সব কোলাহলের মাঝেও একটা নিবিড় শান্তি।”

​বিকেলে তারা ফিফথ অ্যাভিনিউতে হেঁটে বেড়ালো। তানহা বারবার মুগ্ধ চোখে দেখছিল চোখ ধাঁধানো শোরুমগুলো। কিন্তু শাহনওয়াজ দেখছিল কেবল তানহাকে। তার চোখেমুখে লেগে থাকা সরল আনন্দই ছিল শাহনওয়াজের কাছে পৃথিবীর সেরা দৃশ্য।
​আরেকদিন রাতে তারা গেলো এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর চূড়ায়। রাতের নিউইয়র্ক শহর তখন লক্ষ কোটি তারার মতো জ্বলছে। তানহা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল।

​শাহনওয়াজ এসে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বললো, “এই পুরো শহরটাকেও আজ আমার কাছে তোমার হাসির আলোর মতো মনে হচ্ছে। এত উজ্জ্বল, এত সুন্দর!”

​তানহা হেসে বললো,
“তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলতে শিখে গেছো, বন্ধু।”

​”তোমার ভালোবাসা শিখিয়েছে। যে অগ্নিদগ্ধ হৃদয় একদিন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতো, আজ তা কেবল তোমার জন্য প্রেম আর শান্তি খুঁজে পেয়েছে।”

​তাদের হানিমুনের শেষ দিন। দুপুরে শাহনওয়াজ তানহাকে নিয়ে একটা ছোট, নিরিবিলি কফি শপে গেলো। তানহা কফির মগ হাতে নিয়ে শাহনওয়াজের দিকে তাকালো আর বললো,

​”একটা কথা বলবো?”

​”অবশ্যই, বলো।”

​”আমার জীবনের গল্পটা অদ্ভুত, তাই না? কিন্তু আমাদের গল্পে কোনো নাটকীয়তা নেই, আছে কেবল গভীর বিশ্বাস আর বন্ধুত্বের হাত ধরে আসা এক সত্যিকারের ভালোবাসা।”

​শাহনওয়াজ মৃদু হেসে তানহার হাত ধরে চুম্বন করলো এবং বললো,
“তোমার ঐ বোকা, ইনোসেন্ট মনটাই আমার ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলেছে। আমি হয়তো আজও মাফিয়া, কিন্তু তোমার জন্য আমি একজন স্বামী, একজন বন্ধু, একজন প্রেমিক। আমার প্রথম জীবনের ব্যর্থতা আমাকে তোমার কাছে পৌঁছানোর পথ তৈরি করে দিয়েছে। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।”

​তানহা শান্তিতে চোখ বন্ধ করে বললো,
“আমিও তোমাকে ঘিরেই আমার জীবন সাজাতে চাই। এখন আর আমি কোনো কিছুর ভয় পাই না। আমার বন্ধু এখন আমার পাশে আছে।”

​শাহনওয়াজ উঠে এসে তানহার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,
“কথা দিচ্ছি, এই হাত আর কোনোদিন ছাড়বো না। আমাদের অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা আজ সফল। আমরা জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছি।”

​তাদের ভালোবাসার আকাশে তখন কোনো মেঘ ছিল না, ছিল কেবল উজ্জ্বল রোদ আর এক নতুন জীবনের হাতছানি। নিউইয়র্ক শহর সাক্ষী রইলো তাদের অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসার, যা পূর্ণ হলো প্রেম বন্ধনে।

সমাপ্ত ✨