অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-০১

0
12

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১
#সারা মেহেক

আপুর একমাত্র বন্ধু আদ্রিশ ভাইয়ের হবু বউ পালিয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ের বাড়িতে কম হুলস্থূল কান্ড ঘটেনি! মেয়ের বাড়ির লোকেরাও ঘটিয়েছে বিশাল বিশাল কান্ড। অথচ উনি নির্বিকার। যেনো এসবের কোনো প্রভাবই পড়ছে না উনার উপর।

আজ মেয়েদের বাড়িতে মেহেদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। কাল হলুদ,পরশু বিয়ে। কিন্তু আজ দুপুরে পার্লারে যাবার নাম করে মেয়ে পালিয়ে যায়। সেই খবর আদ্রিশ ভাইদের বাড়িতে পাঠানো হয় সন্ধ্যার পর। খবর পেয়ে তৎক্ষনাৎ আদ্রিশ ভাই ও আংকেলসহ বেশ ক’জন মেয়েদের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে বাঁধে আরেক ঝামেলা। তাদের মেয়ে পালিয়ে যাবার সম্পূর্ণ দোষ এসে পড়ে আদ্রিশ ভাইয়ের ঘাড়ে। মেয়ের আত্মীয়স্বজনের কথা হলো, ‘মেয়ে তাদের দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা। সে কখনো তার বাবা মায়ের নাক কাটাতে পারে না। নিশ্চয়ই ছেলের কোথাও সম্পর্ক আছে। সে মেয়েকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে। তাই তাদের মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে।’
মেয়ের আত্মীয়স্বজনের এহেন অযৌক্তিক যুক্তি শুনে সকলের মাথায় হাত। আর আমার মুখে। কেননা তাদের এ যুক্তিতে আমার হাসি বাদে কিছুই আসছে না। সিরিয়াস মহলে এমন হাসি পাওয়ায় আপুর কাছে বকাও শুনলাম বটে। কিন্তু আমি হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না।

এ মুহূর্তে আমিসহ আমাদের বাসার সবাই আদ্রিশ ভাইদের বাসায়। আদ্রিশ ভাইদের সাথে আমাদের সম্পর্ক একদম নিকটাত্মীয়ের মতো। আর সম্পর্কের মূল ভিত্তি আপু ও আদ্রিশ ভাইয়ের বন্ধুত্ব। আপু, ইমাদ ভাই ও আদ্রিশ ভাইয়ের বন্ধুত্ব ক্লাস এইট থেকে। সেই থেকে এই অব্দি তাদের বন্ধুত্ব পূর্বের মতোই মজবুত আছে। মাঝে শুধু আপু আর ইমাদ ভাই প্রেম করে বিয়ে করে নিয়েছে। আর বেচারা আদ্রিশ ভাই এখনও সিঙ্গেল। তবে পিওর সিঙ্গেল নয়। আমার তীব্র সন্দেহ,উনি নিশ্চিত কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে আছেন।

আমার আপু ও ইমাদ ভাই এবং আদ্রিশ ভাইয়ের বন্ধুত্বের একটা মজার কাহিনি আছে। ক্লাস এইটে থাকতে আপু এখানকার স্কুলে ভর্তি হয়। জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসটা পুরো অসুস্থ থাকায় আপু মার্চ মাস থেকে ক্লাস শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই এই অসময়ে নতুন স্টুডেন্টকে দেখে নানানজন নানান কথা বলে, মজা করে। আর এই দলের মূখ্য সদস্য ছিলো আদ্রিশ ভাই। এবং তখন থেকেই ইমাদ ভাই ছিলো আপুর প্রটেক্টর। এদিকে ইমাদ ভাই ও আদ্রিশ ভাইয়ের বন্ধুত্বও ছিলো চোখে পড়ার মতো। আপুকে সময়ে অসময়ে রাগাতো ও জ্বালাতো আদ্রিশ ভাই। কিন্তু ইমাদ ভাইয়ের এটা সহ্য হয়নি। সে আপুর সাথে হওয়া এই অসদাচরণের জন্য আদ্রিশ ভাইয়ের বিরুদ্ধে চলে যায়। দু বন্ধুর মধ্যে রেষারেষি চলে কিছুদিন। পরে ইমাদ ভাই-ই সব ঠিক করতে এগিয়ে আসে। আদ্রিশ ভাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে আপুর কাছে ক্ষমা চায়। এরপর হতেই শুরু হয় তিনজনের অমর বন্ধুত্ব। যদিও এই বন্ধুত্বের আড়ালে পরবর্তীতে আপু ও ইমাদ ভাইয়ের গোপনে মনের আদান-প্রদান চলে। এবং সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবগত ছিলেন আদ্রিশ ভাই।

আপু ও ইমাদ ভাই একে অপরকে নিজেদের মনের কথা জানায় এসএসসি পরীক্ষার পর। এ কথা জানার পর আদ্রিশ ভাইয়ের সে কি অভিমান! তাঁর কথা হলো, তাদের বন্ধুত্বের মাঝে ‘প্রেম’ নামক থার্ড পার্সনটা কেনো নাক ঢুকাবে! বন্ধুত্ব হবে প্রেম, ভালোবাসা নামক অনুভূতি থেকে সহস্র ক্রোশ দূরে। এই প্রেমের টানেই আপু ও ইমাদ ভাই একই ভার্সিটি থেকে থ্রিপল ই-তে অনার্স শেষ করে। আর আদ্রিশ ভাই টাঙ্গাইল মেডিকেল থেকে এমবিবিএস শেষ করেন।

আপু ও ইমাদ ভাইয়ের রিলেশনের কথা জানতে পেরে আব্বু অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। তাই দুই মিঙ্গেলের মাঝে একা রয়ে যায় সিঙ্গেল আদ্রিশ ভাই। বিয়ের প্রতি তার তীব্র বিতৃষ্ণা। কেনো, কে জানে। আপুর কাছে শুনেছি বিয়ের কথা শুনলেই উনি নাক সিটকাতেন। তাই আপুও সিদ্ধান্ত নেয় তাদের ষষ্ঠ বিবাহবার্ষিকীর আগেই সিঙ্গেল আদ্রিশ ভাইকে মিঙ্গেল বানাবে। এজন্য কম মেয়ে খোঁজা হয়নি। কিন্তু উনার কোনো মেয়ে পছন্দ হয় না। উনার সামনে সবচেয়ে সুন্দরী ও গুণী মেয়েকে হাজির করলেও উনি তা রিজেক্ট করেছেন। কিন্তু কেনো করেছেন তা আপু আমাকে বলেনি। শুধু জানি পছন্দ হয়নি। এভাবে টানা দু বছর মেয়ে খোঁজার পর এবার উনি একজন মেয়েকে পছন্দ করে। যদিও মেয়েটি খুব একটা সুন্দরী ও গুণবতী ছিলো না। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে ঐ মেয়েটিকেই কেনো পছন্দ করেছিলেন কে জানে!
আপুর এত বছরের প্রচেষ্টায় আদ্রিশ ভাই এবার সংসারে থিতু হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উনার ভাগ্য থিতু হতে চায়নি। তাই তো মেয়েটি পালিয়ে গেলো!
এ নিয়ে আন্টির কি হা-হুতাশ! এত কষ্টে ছেলে সংসার করতে রাজি হলো। কিন্তু তাঁর কপালে সংসারই জুটলো না! কি জালিম দুনিয়া! এ নিয়ে মেয়েটিকেও উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েছেন উনি।

বিয়ে উপলক্ষে আদ্রিশ ভাইদের নিজস্ব ফ্ল্যাটটি আত্মীয় স্বজনে পরিপূর্ণ। সেই ভরা বাড়িতেই উনার মা, দাদি ও ফুফুর মৃদু আহাজারি। আমি বসে আছি উনাদের ডাইনিং এর একটি চেয়ারে। আপু,ইমাদ ভাই ও আদ্রিশ ভাই বসে আছেন ড্রইং রুমের সোফায়। এছাড়াও উনার বাবা, চাচা,মামা,খালু,আমার আব্বুও বসে আছে। সবার চোখেমুখেই হতাশার ছাপ। আংকেলের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। কেননা এ বিয়ে নিয়ে কম খরচাপাতি করেননি তিনি। একমাত্র ছেলে বলে কথা! নিজের প্রায় সকল বিজনেস পার্টনারকে তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। কেটারিং কোম্পানিতে দিয়েছেন বিশাল অঙ্কের টাকা। কেননা খাবারের তালিকা বেশ বড়সড় হয়েছে। অথচ বিয়ের দু’দিন আগে মেয়ে গেলো পালিয়ে! এখন এত খরচাপাতির খরচ উঠাবে কি করে! এসব ভেবেই আংকেলের মাথায় হাত। প্রেশারও বোধহয় হাই হবার পথে। তাই তো উনার ভাইরা মিলে স্বান্তনা দিচ্ছেন।
এদিকে আদ্রিশ ভাইকে স্বান্তনা দিচ্ছেন ইমাদ ভাই ও আপু। কিন্তু উনার চাহনি ও আচরণ দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না উনি স্বান্তনা পাবার যোগ্য। কেননা উনি সোফায় বসে খোশ মেজাজে দিব্যি রুবিকস কিউব মেলাচ্ছেন। আশেপাশের কোনো খোঁজ নেই। উনার এরূপ আচরণে আমারই রাগ হচ্ছে৷ একটা মানুষ এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢুকছে না। আমি গালে হাত দিয়ে বসে বসে উনার এরূপ নির্বিকার চিত্তের কারণ উদঘাটন করছি।

হঠাৎ চারপাশে চিৎকার চেঁচামেচিতে আমি চমকে উঠলাম। বোধ হলো যে আমি ভাবনার জগতে মগ্ন থেকেই কোন ফাঁকে যেনো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চিৎকারেই আমার সেই ক্ষণিকের ঘুম ভাঙলো। মাথা তুলে দেখলাম সোফার সামনে ঠিক মেঝেতে আংকেল পড়ে আছেন। সবাই সেদিকেই ছুটে যাচ্ছে। আংকেলকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে নির্বিকার আদ্রিশ ভাই এক ছুটে মেঝেতে বসে পড়লেন। ক্ষণিকের মাঝেই আংকেলের মাথাটা নিজের কোলে রাখলেন। চারপাশের অবস বেগতিক দেখে আমার মস্তিষ্কে বিপদের ঘণ্টা বাজলো। মনে উঁকি দিলো সবচেয়ে খারাপ কিছু কথা। আংকেল কি তবে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক করলেন? নাকি মারা………..

#চলবে কি?